অনাহুত

অফিস শেষে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি গাড়ির জন্য। পেছন থেকে রাসেলের গলা কানে আসলো, ”আজকে কিন্তু শফিক ভাইয়ের বাসায়, মনে আছে তো?”

রাসেল এর কথায় মনে পড়ল তাইতো! আজক রাতে তো লীগের ফাইনাল খেলা। খেলা দেখা হবে সদলবলে শফিক ভাইয়ের বাসায়। ওনার বাসায় ফুটবল খেলা দেখার মজাই আলাদা। একা মানুষ। বিশাল বাসা। সুযোগ পেলেই বন্ধু বান্ধব ভাই-ব্রাদারদের নিয়ে সেই পার্টির আয়োজন করে ফেলেন। উপলক্ষ্য থাকে অবশ্যই ফুটবল খেলা।

“হুম, আছে বৈকি। বাকিরা আসছে তো?”

“আরে মিস করবে কে! রনি, রাশেদ, মিলন, তুই আর আমি। সবাই হাজির হয়ে যাবে ঠিক সময়ে। আর খেলা তো রাতে দেড়টার দিকে।”

“আমাকে ১১ টার দিকে পিক করে নিয়ে যাস।”

“আচ্ছা… রেডি থাকিস।”

১৬ তলা বিল্ডিংটার ১১ তলায় শফিক ভাইয়ের বাসা। সাড়ে এগারোটার মাঝেই আমরা ৫ জনই হাজির। শফিক ভাই এরই মধ্যে এলাহি আয়োজন করে ফেলেছেন।

ভূরিভোজ সেরে সবাই গোল হয়ে টিভির সামনে বসে পড়লাম। শফিক ভাই এর টীম এর সাপোর্টার মাত্র দুইজন। রাশেদ আর শফিক ভাই নিজে। বাকি সবাই আমরা বিরূদ্ধে। আমাদের টীমের এতগুলা সাপোর্টার থাকার পরও ৩০ মিনিটেই ৩ গোল হজম করে বসে রইলাম।

শফিক ভাই এমনিতেই মজার মানুষ আর এখন তো তার সময়ই চলছে ভালো। খেলা চলছে আর তার ভয়াবহ সব হাসির গল্প চলছে। এক একটা গল্প শুনছি আর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার দশা। আরো এক দফা কফির জন্যে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিলেন এরই মাঝে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আরেকটা উদ্ভট গল্প মনে পরে গেল তার। ওখানে দাঁড়িয়েই বলা শুরু করে দিলেন। আর হাসি থামিয়ে রাখতে না পেরে ফ্লোরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম এবারে, তখনই জিনিসটা খেয়াল করলাম প্রথমবার!

আমার ঠিক বা পাশেই খাটটা। আমি ফ্লোরে শুয়ে ওদিকটায় তাকাতেই চোখ পরল খাটের নিচটায়।

শফিক ভাই!

চিত্‍ হয়ে শুয়ে আছেন। মুখটা হাঁ করে  বিভত্‍স ভাবে খোলা, চোখ দুটো বের হয়ে আছে প্রায় পুরোটাই। যেন কপালের নিচে দুটো কালো গর্ত থেকে বের হয়ে  দুটো সাদাটে ডিম ঝুলে আছে গালের উপর!

ভয়ংকর ভাবে হাঁ করা মুখটা থেকে দুটো তেলাপোকা  বেরিয়ে এল… আবার ঢুকেও গেল। যা দেখছি আমার মাথায় ঠিকমতন ঢুকছেনা। চোখ বন্ধ করতে চেয়ে ও পারলাম না। আটকে গেছে যেন। আমার সারা শরীরে বেয়ে ঠান্ডা একটা ভয়ের স্রোত যেন নেমে গেল। মুখ থেকে আওয়াজ বের করতে প্রানপন চেষ্টা করেও পারছিলাম না। ঘাড় নারানোর শক্তিটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

এটা কি শফিক ভাইয়ের লাশ? এখানে?

তাহলে ওই তো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এত হেসে হেসে কথা বলছে সে কে?

আমি চোখের কোন দিয়ে দরজার দিকে তাকাতে চাচ্ছি কিন্তু কোনমতেই পারছিনা। আমার চোখ দুটো যেন খাটের নিচে থাকা এই শফিক ভাইয়ের খোলা মুখটার অন্ধকারের অতলে হারিয়ে গেছে। কান দিয়ে কোন শব্দই পাচ্ছি না আর। কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সব কিছু এক মুহূর্তেই!

খেলার হইচই, বন্ধুদের হুল্লোর সব কেমন যেন স্তব্ধ খেয়ে আছে! মনের সব টুকো শক্তি দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করলাম, এক ঝটকায় উঠে বসলাম। চোখ খোলার পর যা দেখলাম, মনে হলো আজীবন চোখদুটো আর না খুললেও হয়তো ভালো হতো!

রনি… রাশেদ… রাসেল… মিলন সবাই যে যেখানে বসে ছিল সেখানেই আছে। শুধু প্রত্যেকের মাথা পিছন দিকে লম্বা হয়ে বেঁকে গিয়ে পিঠের সাথে গিয়ে মিলেছে! গলার হাড় ভেঙে সাপের মত লম্বা হয়ে আছে, জিভ বের করা মাথাগুলো ভয়ংকর ভাবে হাঁ করে আছে।

প্রত্যেকটা চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। আমি জানি ওই ঘোলাটে চোখ গুলোতে কোন প্রাণ নেই। দেয়াল ঘড়িটায় রাত দু টা বাজার জানান দিলো আর তখনই বুঝতে পারলাম,

আমি এই ১৬ তলা বিল্ডিংয়ের ১১ তলার এই বিশাল বাসায় রাত দুটোর সময় ৬ টা বিকৃত লাশের সাথে একা। একদম একা!

২.

ছোট্ট টেবিলটার এ পাশে আমি বসে আছি। অপর পাশে বসে আছে শফিক ভাই। আমি অবশ্য বলেছি এ শফিক ভাই না। হতেই পারে না। আমি নিজে দেখেছি  শফিক ভাইয়ের পঁচে যাওয়া লাশ। খাটের নিচে পরে থাকা ওই বিভত্‍স লাশের কথা অত সহজে ভুলবোও না। তাও এরা বলছে এই নাকি শফিক ভাই।

দেখতে এক হলেই শফিক ভাই হয়ে গেল? বললেই হবে!

“তো মি. রোকন?”

আমার নাম ধরে ডাকতেই চমকে উঠলাম। থানার বড়বাবু ও যে পাশে বসা মনেই ছিলো না।

“জ্বী”

“এই তো আপনার মরে ভুত হয়ে পড়ে থাকা শফিক সাহেব?”

“শফিক ভাই মরে গেছে। এই লোক শফিক ভাই না! কতবার বলবো।”

“কিন্তু আমাদের জানামতে আপনি এই একটা শফিককেই চেনেন। আর সেই শফিক রহমান আপনার সামনে বসে আছে।”

“আমি বলেছি তো, এই লোক দেখতে শফিক ভাইয়ের মত কিন্তু সে না। আমি খাটের নিচে তার ডেডবডি দেখেছি ২ হাত দূর থেকে।”

“আপনি তো আপনার আরো বন্ধুদের ও লাশ দেখছেন, কি রকম যেন? ও হ্যাঁ, ঘাড় বাকানো ভয়ংকর বিভৎস সব লাশ। তাই তো?”

“একটা কথাও মিথ্যে ছিলো না। রনি, রাসেল ওদের সবাই কে আমি দেখেছি! প্রত্যেককে মৃত দেখেছি! আমি জানি আমি কি দেখেছি! ওই রাতের কথা আমি জীবনে কখনোই ভুলবো না!”

কথাটা বলতে গিয়ে  অনুভব করলাম পিঠ বেয়ে একটা ঘামের সুক্ষ্ম ধারা নেমে যাচ্ছে। শিরশির করে উঠলো পুরো শরীর সে রাতের কথা মনে হতেই। খাটের নিচে পরে থাকা শফিক ভাইয়ের লাশ, রাসেল, রনি, রাশেদ, মিলন সবার ওই  প্রাণহীন চোখ!

আরো একজনকে দেখেছিলাম। আরেকজনের  লাশ পড়েছিল কিন্তু চিনতে পারিনি।

আমার তখন মাথা কাজ করছিলো না এক বিন্দু ও।

এতগুলো মরে যাওয়া মানুষ এর মাঝে বসে থাকার চেয়েও বেশী ভয় লাগছিলো ওই রান্নাঘরে যাওয়া শফিক কে নিয়ে? ও কে ছিল?

যদি সেই শফিক ভাই হয় তাহলে আমার পাশে পড়ে থাকা লাশটা কার ছিল? আমার বন্ধুদের ওভাবে কে মারলো? কোন উত্তরই জানা হয়নি।

জ্ঞান ফিরেছিলো নাকি দু’দিন পর! হাসপাতালের বেডে। সেখান থেকে পুলিশ, থানা আর এখন এই ইন্টারোগেশন রুম আর আমার সামনে বসে থাকা আরেকটা শফিক ভাই!

আসলেই শফিক ভাই? এত এত কথা হচ্ছে অথচ লোকটা একদম নিশ্চুপ! অদ্ভুদ।

“আপনার সব ঘটনাই তো শুনলাম রোকন সাহেব কিন্তু কয়েকটা মারাত্মক ভুল আছে আপনার কাহিনীতে।”

অফিসারের কথায় বাস্তবে ফিরে এলাম।

“মারাত্মক ভুল?”

“আপনি শফিক রহমানকে কতদিন ধরে চেনেন?”

“হবে ২ বছর। অফিসের বড় ভাই হিসেবেই চিনি, কেন?”

“আপনি কোন অফিসে চাকরি করেন? কত বছর ধরে চাকরি করেন?”

“এলিট এলায়েন্স গ্রুপ। ৩ বছর চলে, এসব তো আগে ও বলেছি! আবার কেন জিজ্ঞেস করছেন?”

“হুম। মন দিয়ে কিছু কথা শুনুন রোকন। প্রথমত… আপনি বলেছিলেন শফিক সাহেব অনেক মজার মজার গল্প বলেন, সেদিন রাতে ও বলছিলেন?

“হ্যাঁ! কেন ?”

“শফিক রহমান পাঁচ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন। সোজা বাংলায় শফিক রহমান সম্পুর্ন বোবা একজন মানুষ।”

“মানে! বুঝিনি আমি আপনার কথা! মানে কি?”

“আরো আছে, আপনি গত ৬ বছর ধরে কোন রকম চাকরিই করছেন না। আপনি এর আগে লেখালেখি করতেন যতটা জানতে পেরেছি আমরা। আপনার রনি রাশেদ মিলন এসব নামে কোন বন্ধুও নেই। সেদিন রাতে আপনি ঠিকই শফিক সাহেবের বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন সেটা আমরা জানি না। আপনার মানসিক সমস্যা আছে কিংবা ছিলো এমন কিছুও এখনো জানতে পারিনি। আপনি কেন এরকম কাহিনী বানাচ্ছেন অথবা সত্যিই কিছু ঘটছে কি না আপনার সাথে সেটা আমাদের ও জানা দরকার রোকন। কো-অপারেট করেন  আমাদের!”

“আপনি জানেন আপনি কি পরিমান অবাস্তব উদ্ভট কথা বলে চলেছেন?”-প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম। “আমি রোকন মাহমুদ। আমি জানি আমি কে, আমি জানি আমি কি! আপনি কিভাবে আমার পরিচয় আপনার গাঁজাখুরি এক গল্পে উড়িয়ে দিচ্ছেন?!”

“যা বলছি প্রতিটি কথা সত্যি। যে কোন প্রমান আপনাকে আমরা দিতে পারবো। আপনি নিজেই দেখেন।”

একের পর এক ছবি একের পর এক ফাইল আমার সামনে রাখলো ওরা। আমার পরিচিত সব মানুষ, আমার পরিচিত পৃথিবী সব কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে! মানে কি এসব এর। হয় আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, পুরোপুরি পাগল হয়ে গিয়েছি। নিজের কল্পনার জগতে বাস করছি… সব কিছু আমার ভ্রান্তি!  না হয় অন্য কারো অন্য কোন জীবনে আমার অনুপ্রবেশ ঘটছে! গল্প উপন্যাসে পড়া আরেক পৃথিবীর আরেক জগতের আরেক আমি?

অসম্ভব! এ দুটোর কোনটাই  না। আমি জানি না! ওরা কেন বলল আমার সাহায্য ওদের দরকার? আমার বন্ধুরা? ওরা ও আমার কল্পনা? নাকি অন্য জগতের!

“আপনি কেন বললেন আমার কো অপারেট খুব দরকার আপনাদের?”-প্রশ্ন করলাম।

“কারন সেই দিন রাতে শফিক সাহেবের বাড়িতে সত্যিই ৫ টা খুন হয়েছিল। শফিক সাহেব বাড়িতে ছিলেন না। ভেতরে ৫ জন ছেলেকে ঘাড় ভাঙা অবস্হায় পাওয়া যায়। এবং লাশ গুলোর পিছনে আপনাকে পাওয়া যায় অচেতন অবস্থায়। প্রাথমিক ভাবে আপনাকে এই খুন গুলোর জন্যে সন্দেহ করা হলে ও ওদের গলায় ঘাড়ে যে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে তা আপনার নয়। এদের কারো সাথেই আপনার কোন পূর্ব যোগাযোগ নেই। কিন্তু আপনি এটা কেন বলছিলেন জ্ঞান ফিরার পর যে ৬ টা লাশ? লাশ তো ৫ টা ছিল।”

“আমাকে সন্দেহ থেকে বাদ দেয়ার আরো কারন নিশ্চই আছে। সেটা কি?”

“হুম, ৫ জনের ঘাড়ে যে হাতের ছাপ পাওয়া গেছে সেই একই ছাপ আপনার ঘাড়ে ও পাওয়া গেছে কিন্তু আপনি বেঁচে গেছেন। এ জন্যেই আপনার সাহায্য আমাদের দরকার এই রহস্য ভাঙতে।”

কোন কথাই তখন কানে যাচ্ছিলো না। দুটো কারনে!

৬ নম্বর লাশ এর রহস্য আমার কাছে এখন পরিষ্কার লাগছে! ঠিক যে জায়গায় আমি ওই আতংক আর অবিশ্বাস নিয়ে অপরিচিত একটা ঘাড় বাকানো লাশ পরে থাকতে দেখেছি সেখানে আসলে একটা আয়না ছিলো!

আর সেটাতে শুধুমাত্র আমার প্রতিচ্ছবিই পড়ছিলো তখন!

এর মানে কি বোধগম্য হওয়ার আগেই চোখ পরল দেয়ালের ক্যালেন্ডারে।

একটা না, তিনটা ক্যালেন্ডার ঝোলানো। সবগুলোতেই দ্রুত চোখ বোলালাম।

২০১৭ সালের এর ৩০ জুন হওয়ার কথা আজকের তারিখ। কিন্তু…!

“আজ কত তারিখ?” কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলাম।

“৩০ জুন। কেন?”

“কত সাল?”

“আপনি জানেন না এটা কত সাল?”

“এটা কত সাল?”-  অনেক জোড় গলায়  প্রশ্ন করলাম আবারো। হাত দুটো কাঁপছে!

“২০০২ সাল!”

৩.

রুমটা ছোট্ট। সাদা রং করা দেয়াল। খাটের উপর বসে আছি পা তুলে। সামনে চেয়ারে ড. রশীদ বসে আছেন। ভদ্রলোক সাইকিয়াট্রিস্ট। সোজা বাংলায় পাগলের ডাক্তার। আমাকে মোটামুটি বদ্ধ পাগল হিসেবে অনানুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য খারাপ হয়নি। চুপচাপ বসে ভাবছি। যা যা ঘটছে সব কিছু!

২০০২ থেকে ২০১৭? মাত্র ১৫ বছর। খুব একটা বিশাল কিছু নয় এই ১৫ বছর। আবার কখনো অনেক অনেক সময়। কিন্তু এখানে যা হচ্ছে এই ১৫ বছর কয়েক শতাব্দীর প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে!

আচ্ছা, মেনে নিলাম এটা ২০০২, আমি দু’দিনের ব্যবধানে ২০১৭ থেকে ১৫ বছর পেছনে চলে এসেছি!

আমি রোকন মাহমুদ আসলে ২০০২’য়েই বাস করি। আমি ছয় বছর ধরে এক রকম নিঃসঙ্গ ভাবে একাকী বাস করি। কোন কাজটাজ করি নাহ, একজন লেখক। আমার রনি রাশেদ নামে কোন বন্ধুও ছিলো না ,আমার এত দিন ধরে জেনে আসা সব কিছুই মিথ্যা!

এত্ত সহজ?

সম্ভব আর অসম্ভব এর মাঝখানের সীমারেখাটাই অনেক আগে পার হয়ে গেছে।

আমাকে ওরা বের হতে দিয়েছিল বাইরে, কারন আমি বিশ্বাস করিনি একটা কথাও। বেশিক্ষন না মাত্র আধা ঘন্টার মাঝেই আমি বুঝে গিয়েছি আমি সত্যিকারেই ২০০২এই আছি!

“আমি যদি এই রোকন মাহমুদই হই আমার কোন কিছুই মনে নেই কেন এই জীবন সম্পর্কে? আপনি বলতেই পারেন যে আমার স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে এটা সেটা, আপনাদের এই পুরানা আমলের মেশিন এর রিপোর্টে ও আসতে পারে যে আমি সোজা কথায় একটা পাগল। কিন্তু…!”

সামনে বসা ড. রশীদের মুখে অদ্ভুদ রকমের বিদ্রুপের হাসি দেখে থেমে গিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

“পুরানো মেশিন? আপনি জানেন এখানে যা যা আছে সব কিছুই সম্পূর্ন নতুন এবং লেটেষ্ট টেক! এগুলো ইম্পোর্টেড ফ্রম জাপান! শুধুমাত্র আমাদের কাছেই 2001 ব্রান্ডের মেডিটেক পাওয়া যাবে পুরো দেশ খুঁজলে!”

আমি রশিদ সাহেবের এই সাধের জাপান থেকে আগত লেটেষ্ট সব টেক এর বেশীর ভাগই কদিন আগেও ভাঙারীর দোকানে কেজির দরে বিক্রী করতে দেখেছি সেই কথা আর বললাম না। এই লোকটার সাহায্য খুব দরকার এখন আমার।

“যাই হোক রশীদ সাহেব। আপনি একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট যতটা জানি এবং বুঝেছি। আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন যে গুলো আমার নিজের ও জানা দরকার।

“বলুন।”

“আমি যদি মেনেও নেই আমি এতদিন কোন মেন্টাল ডিজঅর্ডারের মাঝে ছিলাম… আপনাদের ভাষায় আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার, তাহলেও তো আমার কাটানো সময় দিনক্ষন এভাবে অদ্ভুদ রকম ভাবে এতটা এলোমেলো হওয়ার কথা না! ১৫ বছর সামনে চলে গিয়েছিলাম আমি? সেটা শুধুমাত্র আমার একটা মনের অসুখ? এই যুক্তি কি খাটে?”

“আপনি কি ভাবে নিশ্চিত যে আপনি ২০১৭তেই ছিলেন। হতে পারে আপনি এই সময়েই ছিলেন আর আপনার অবচেতন মন আপনার মনের ভ্রান্তি আপনাকে বলেছে আপনি ১৭তে আছেন!”

“কথাগুলো কেমন খোঁড়া যুক্তি হয়ে গেলো না? আমার জন্মের পর থেকে ২০১৭ পর্যন্ত যতটা স্মৃতি মনে রাখা সম্ভব মনে আছে। কিন্তু এই সালে এই সময়ে এই জীবন এর কথা তো আমার মনে নেই! আর আমার বয়স? ৩০ বছর আমার হিসেবে, ১৯৮৬। সে হিসেবে এখন আমার বয়স ১৭ হওয়ার কথা। আমাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে?”

“নাহ। আপনার বয়স ৩০ ই রোকন সাহেব। শুধু জন্মসাল টা ১৯৭২। আপনার বার্থ সার্টিফিকেট, স্কুল কলেজ ভার্সিটি এই সব ছবি…সবই তো দেখেছেন।”

“হুম। দেখেছি এবং এটাও বারবার বলেছি এগুলোর কোনটাই কোন কালে আমার ছিল মনে পড়ছে না! অথচ সবগুলোই আমি! আমি জানি নাহ! কিচ্ছুই ঢুকছেনা মাথায়। রাগে মাথার চুল টেনে ধরতে মন চাচ্ছে! কিভাবে কি প্রমান করবো! একটা কাজ করতে পারি। একের পর এক ভবিষ্যত্‍ বানী করে যেতে পারি কোন বছর কোন মাসে কি ঘটবে! ২০১৭ পর্যন্ত! মাথা পুরোপুরিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!”

“আপনি বিশ্রাম করুন রোকন সাহেব। আমি পরে আসছি আবার। আমাদের সাথে শফিক রহমানের বাড়ি যেতে হবে আপনার, ক্রাইম সীনে। এখন যাচ্ছি আমি।”

রশীদ সাহেব চলে গেলেন।

চোখ বন্ধ করলাম। মাথা একদম ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। আমি হয় সময়ের পিছনে চলে এসেছি। না হয় আমি সামনে চলে গিয়েছিলাম সময়ের। দুটোই একই রকম অবাস্তব শোনাচ্ছে!

আমি যদি সময়ের পিছনেই চলে আসি ১৫ বছর, তাহলে প্রশ্ন, আমার পরিচয় ভিন্ন কেন? এটা কোন রোকন মাহমুদ! এটা কার জীবন? অল্টারনেট টাইমলাইন এর যে কল্পনা করা হয় তাতেও ব্যাখ্যা কি হচ্ছে? ১৫ বছর পিছনে এসে ওই ৬ টা খুনের জায়গাতেই কেন শুরু হবে এই গল্প? আমি যদি আরেকটা রোকন মাহমুদের  জীবনেই প্রবেশ করে ও থাকি সেটা কেন?

রুমে দরজার কাছে কেমন একটা শব্দ হলো। তাকাতেই  অদ্ভুদ কিছু চোখে পরলো। রুমের সিলিং থেকে ফ্লোর পর্যন্ত কেমন স্বচ্ছ পর্দার মত কিছু একটা। কিছুক্ষন আগেও দেখিনি। পর্দাটার ভেতর দিয়ে ওপাশের দেয়াল, দরজা সবই দেখা যাচ্ছে। পর্দা না বলে প্রজেক্টর অথবা হলোগ্রাফিক ছায়া বললেই যেন মানাবে জিনিসটা!

স্বচ্ছ পর্দাটায় কারো যেন একটা ছায়া পরলো। একটা মানুষ যেন দাড়িয়ে আছে ওই স্বচ্ছ পর্দাটার ভেতরে। কালো অবয়বটা দেখা যাচ্ছে শুধু। আমার খুব চেনা এই ছায়া! আস্তে আস্তে ছায়াটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম! যে কোন সময় যেন মিলিয়ে যাবে! আমি একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে। কেন জানি মনে হলো ছায়াটাও ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে দিলো একটা!

[ ঠিক একই সময়ে অন্য কোথাও ]

“আচ্ছা ধরুন আপনি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। পথে দূর্ঘটনায় পরলেন। ছোটখাটো না বেশ ভয়ানক রকমের দুর্ঘটনা। আপনার গাড়ি বরাবর সামনে রাস্তায় কোন ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে তার মায়ের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে। এতটাই আচমকা ওরা সামনে এসে পরল আপনি এখন ব্রেক কষেও হয়তো ওদের বাঁচাতে পারবেন না।

আপনার সামনে এখন দুটো রাস্তা, আপনি গাড়ি ডান দিকে ঘুড়িয়ে দিতে পারেন যার মানে দাড়াচ্ছে সামনে থেকে প্রচন্ড বেগে আসা বিশাল লরিটার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ায প্রবল সম্ভাবনা। কিংবা আপনি গাড়ির গতি এক বিন্দুও না কমিয়ে আপনার সামনে থাকা ছোট্ট মেয়েটা আর তার মায়ের উপরে দিয়ে উঠিয়ে দেয়া। আপনি কি করতেন রোকন সাহেব?”

এক মুহূর্তও চিন্তা না করেই উত্তর দিলাম,

-“সোজা পিষে ফেলে সামনে চালিয়ে চলে যেতাম।”

ভাবলেশহীন নির্বিকার গলায় জবাব দিলাম। যাতে সামনের লোকগুলোর গা শিরশির করে ওঠে। সেই কখন থেকে এই গর্দভগুলোর উদ্ভট সব কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছি। এদের আজগুবি সব প্রশ্ন একের পর এক চলছেই। মেন্টাল এসাইলাম? আমি পাগল না এরা পাগল!

পুলিশের গার্ডও বহাল। সবই আমার জন্যে! গত ছয় বছরের মাঝে নিজেকে এতটা গুরুত্বপূর্ন মনে হয়নি কখনো। এদের প্রশ্ন করার ধরণ দেখে লাগছে আমি মানসিক ভাবে অসুস্হ কিনা তা জানার আপ্রান চেষ্টা চলছে। মনে হচ্ছে আমি সাইকো টাইপ কিছু হলেই এরা খুশী।

সব কিছু কেমন গুবলেট হয়ে আছে। চারপাশের সব কিছুই অচেনা, অন্যরকম লাগছে। কেমন অতি অত্যাধুনিক যেন সব কিছু। একেকজনের হাতে বিরাট বড় ডিসপ্লেওয়ালা মোবাইল। ছোট ছোট চ্যাপ্টা সব কম্পিউটার! আগে দেখাই হয়নি এসব মডেল! অদ্ভুদ সব সাজসজ্জা।

কিছুই বুঝতে পারছিনা। যেটাই হোক। সব চেয়ে এলোমেলো হয়ে গেছে দু’রাত আগের কাজটা!

কথা ছিলো জেড গ্রুপের ৬ জন থাকবে শফিকের বাড়িতে। আমি সব গুলোকে কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই মারার ব্যবস্হাও করে ফেলেছিলাম।

ওদের এই আমি… রোকন মাহমুদ সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই আমি যে কি কি করতে পারি। কিন্তু কি হলো সেই রাতে কিছুই বুঝলাম না। কিছু মনেও নেই। অদ্ভুদ!

এখন শুনছি, খুন ঠিকই হয়েছে। ৬টা খুনই হয়েছে। কিন্তু এগুলো কারা? রনি…রাশেদ… মিলন! জীবনে তো নামই শুনিনি!

তার থেকে ও আরো অদ্ভুদ একটা ব্যাপার ঘটছে।

এই পাগলের আড্ডাখানায় ডাক্তার টাক্তার সব নির্ঘাত পাগল। পাগল না হলে কি বারবার এটাকে ২০১৭ সাল বলে?

আজব!

২ দিনের মাথায় ২০০২ থেকে ২০১৭ হয়ে গেছে?

আরে আমি তো আমার লেখা গল্পগুলোতেও এমন উদ্ভট কিছু লিখি না! আমার লিখালিখি করাই বৃথা। কিভাবে এই হসপিটাল থেকে বের হওয়া যায় ভাবতে ভাবতে চোখ আটকে গেল রুমের উল্টো দিকে!

কেমন ছায়ার মতো কিছু একটা। যেন সাদা আলোর আবছা পর্দার মত! উপর থেকে নিচ অব্দি রুমের।হঠাৎ কোথেকে আসলো? অদৃশ্য হয়ে যাবে যেন এখুনি।

পর্দায় যেন কাউকে দেখা যাচ্ছে আবছা অস্পস্ট। কেউ যেন খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো! আমি আলোর আবছা দেয়ালটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওপাশের ছায়াটা খুব চেনা! একটা হাত বাড়িয়ে দিলাম কেন জানি ছায়াটার দিকে। ওপাশ থেকেও একটা হাত এগিয়ে আসলো আমার দিকে!

৪.

৩ জুলাই ২০১৭, ঢাকা

প্রচন্ড বৃষ্টি। এই একটা জিনিস কখনোই ভালো লাগাতে পারলাম না। এত গল্প কবিতা লিখেছি কোন দিন বৃষ্টি নিয়ে ভালো কিছু বেরোয়নি মাথা থেকে। ঢাকার এখন আগের থেকেও খারাপ অবস্থা! মাত্র এই কয় বছরে এত পরিবর্তন!

মানুষ আগের থেকে তিন গুন বেড়ে গেছে লাগছে। এখানে একটা চেনা ঠিকানা বের করতেও মাথা নষ্ট হওয়ার দশা। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সামনে এগোচ্ছি। চারপাশ এর পরিবেশ বেশ থমথমে!

কাল রাতে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডাক্তার, কয়েকটা বাচ্চা আর পুলিশ সহ ১৩ জন খুন হয়েছে। পুরো দেশে এ খবর বিদ্যুতের মত ছড়িয়ে পরা উচিত্‍, হয়েছেও তাই। যতটা দ্রুত আশা করেছিলাম তার থেকে ও দ্রুত খবর ছড়িয়েছে।

কি বলে এগুলোকে? ওহ, ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ ইউটিউব  এর যুগ নাকি চলছে। আমাদের সময় এগুলো থাকলে আরো কত কত সুবিধা পেতাম ভেবে আফসোস লাগছে।

যতক্ষনে আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছি আমি সত্যিই ২০১৭ সালে চলে এসেছি কোন না কোনভাবে ততক্ষনে  ৯ জন কে মেরে ফেলেছি সম্ভবত। ২/১ জন কম বেশী  হতে পারে। শেষে বের হওয়ার সময় ওই বাচ্চাগুলোকে না মারলে বেরুতে সমস্যা হয়ে যেত। এখন আমার বিরুদ্ধে কোন রকম প্রমাণ এর অবশিষ্ট পর্যন্ত নেই। কেউ কোন দিন জানবেও না আমিই!

অনুশোচনা বোধ? কোন কালেই ছিলো না, হাহ! কেউ কোনদিনও জানতে পারেনি এই একাকী বাস করা অখ্যাত লেখক রোকন মাহমুদ প্রকৃতপক্ষে একজন সিরিয়াল কিলার।

প্রফেশনাল… ভাড়াটে…সাইকো…শখের খুনী, যেটা খুশীই বলা যায়। একজন লেখক খুব ভালোভাবেই জানে মানুষকে কিভাবে কিভাবে কত সহজে মারা যায় ঠিক একজন ডাক্তারের মত। আমার বাম হাতের গ্লাভসটা অবশ্য ফেলে এসেছি। ওটা থাকলে সব কিছু আরো সহজে হয়ে যেত।

সব কিছু ঠিকঠাক ভাবেই যাচ্ছিল কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে সেটা আমার নিজেরও হিসেবের বাইরে! স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশ আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। এই ১৫ বছরের মাঝে কতটা এডভান্স হয়েছে দেখা যাক! নাকি আগের মতই ওদের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে যাব সেটাও দেখার বিষয়। আমি জানি আমাকে ধরার সাধ্য নেই।

এখন আমার আপাতত দুটো কাজ।

পুরানো পেপার, খবরের কাগজগুলো দেখতে হবে খুঁজে খুঁজে, ২০০২ সালের অবশ্যই। জুন-জুলাই এর বিশেষ করে। আর একজন মানুষকে এই সময়ের এই শহরে খুঁজে বের করতে হবে যার থেকেই এই সব কিছুর শুরু, শফিক রহমান।

[একই মুহূর্তে, অন্য জগতে]

৩ জুলাই ২০০২, ঢাকা

“গুড মর্নিং লেখক সাহেব”

পুলিশ সার্জেন্ট আসাদ এর কথায় চমকে উঠে চোখ মেললাম। পেছনে ড. রশীদকেও দেখলাম আসতে। শুয়ে ছিলাম , উঠে বসতে বসতে বললাম,

“আমি কোন লেখক টেখক নই, আগেও বলেছি, কেন বারবার একই কথা তুলছেন?”

“আসলে আপনিই ঠিক রোকন সাহেব। আপনি লেখক টেখক কেউ না। আপনার সত্যিকার পরিচয়ের খুব কাছে চলে গেছি আমরা। যদি আমাদের ধারনা এক বিন্দু সত্যিও হয় আপনি কত বড় ধরনের ক্রিমিনাল তা প্রকাশ হয়ে যাবে!”

“ক্রিমিনাল! কি? চোর? ডাকাত? কি আমি!”

“তার থেকেও অনেক ভয়ানক কিছু আপনি। ভয়ংকর এক সাইকো… অবলীলায় খুন করা যার বা হাতের খেল। আপনার গ্লাভস জোড়া কোথায় রোকন সাহেব?”

“আমার গ্লাভস? কোন গ্লাভস?”

“গ্লাভস উইদ জেলীফিশ স্টিংস। আপনার তো ফেভারিট কিলিং ওয়েপন। দু’হাতে গ্লাভস পরে এক হাতে কারো গলার দু’দিক সারাশির মত চেপে ধরে আরেক হাত থুতনির নিচে দিয়ে এক হেচকা টান… ব্যাস মুহূর্তের মাঝে গলার কন্ঠনালি ভেংগে ঘাড় উল্টে শেষ।”

চুপ করে শুনে যাচ্ছিলাম। এতদিনে ওই ঘাড় ভাংগা লাশ গুলোর ব্যখ্যা পরিষ্কার হলো!

“আপনার এই স্মৃতিভ্রমের নাটক বেশীক্ষন চলবেনা আর মি. রোকন… সব প্রমান যখন হাতে পেয়ে যাব আপনার নাটকের যবনিকা সেই মুহুর্তেই টানবো।”

রুম থেকে বের হয়ে চলে গেলেন সার্জেন্ট। রশীদ সাহেব সামনে এসে বসলেন। তিনি কি বললেন না বললেন আমার মাথায় ঢুকলো না কারন এই প্রথম ভয়ানক কিছু একটার আশংকা খেলে গেল মনের ভেতরে যেটা আরো অনেক আগেই ভাবা উচিত ছিলো।

আমি যদি ২০১৭ থেকে ২০০২ এ চলে আসি আরেকজন রোকন মাহমুদ হয়ে যে একজন লেখক এবং পুলিশের ভাষ্যমতে ভয়ংকর খুনি, সেই রোকন মাহমুদ ও যদি ঠিক আমারই মত ২০০২ থেকে ২০১৭ তে চলে গিয়ে থাকে?

আমার পরিচয়ে… আমি হিসেবে আমার জীবনে? ঠিক যেভাবে আমি তার জীবনে অনুপ্রবেশ করেছি! ওহ গড!

এটাই হয়েছে! এটাই আরো অনেক অনেক আগে ভাবা উচিত্‍ ছিল আমার।

আমার পরিচয়ে আমার চেনা সময়ে আরেকজন ভয়ংকর অপরাধী ঘুরে বেরাচ্ছে এই চিন্তাটাই আমার সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে দুঃস্বপ্নের মত। এই পুলিশ পাহাড়ায় থাকা হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার ও কোন উপায়  নেই।

সেই চেষ্টা করে ও লাভ নেই। বরং রশীদ সাহেব কে বলে দেখা যাক। এই একটা মাত্র লোক যে আমার কথা আমার মনে হয় সম্পূর্ন বিশ্বাস করে। কেন করে সে রহস্য আমার জানা নেই।

যা যা এতক্ষন মাথায় ঘুরছিল সব বললাম রশিদ সাহেবকে।

কতটা কি বিশ্বাস করেছেন তা জানি না, কিন্তু মুখ দেখে মনে হল কথাগুলো খুব একটা উদ্ভট লাগেনি তার কাছে।

“সময়? সেই সায়েন্স ফিকশান জগতের সময় সুরঙ্গ? টাইম লুপ… টাইম ট্রাভেল আর প্যারালাল ইউনিভার্স?”

“আমি জানি পুরো ব্যাপারটা কত খানি হাস্যকর অসম্ভব এবং গাঁজাখুরি শোনাচ্ছে…!”

“অসম্ভব অথবা হাস্যকর কোনটাই না। যদি আপনার ধারনা ঠিক বলে ধরেও নেই কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়।”

“কিছু না, হাজারটা অসম্পূর্ণ প্রশ্ন। যদি আমি টাইম টানেলের মাঝে পরে ও থাকি তাহলে আমার নিজের অতীতে ফিরে যাওয়ার কথা, আরেক জনের না!”

“হুম প্যারালাল ওয়ার্ল্ড এর সাথে এই টাইম রিভার্সাল, কোন না কোন যোগসূত্র আছে।”

“কি সেটাই তো মাথায় আসছে না !”

দুজনেই চুপ করে রইলাম। এই জগতের রোকন যদি একজন সাইকো সিরিয়াল কিলারই হয় তাহলে সে রাতের সবগুলো খুন সে করেছে, কিন্তু কথা হচ্ছে কোন সময়ের?

প্যারালাল ওয়ার্ল্ড যেটা আমার কাছে সত্যি সেটা এদের কাছে ভ্রম আর যেটা আমার কাছে মিথ্যা সেটাই ওদের কাছে সত্যি।

ধরে নিলাম এই টাইম লাইনের রোকন মাহমুদ এখন আমার সময়, আমার জীবনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। যতটা জেনেছি তার সম্পর্কে সে হয়তো এতক্ষনে বের করে ফেলেছে এই টাইম টানেল আর প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের সব কিছু, এখন যদি সে এখানে আর ফিরতে না চায়! যদি সে কোন না কোন ভাবে সব সময়ের জন্যে আমাকে আটকে দেয় এই সময়ের ফাঁদে!

তার সমস্ত অপরাধ আমার উপর অথচ আমার বলার কিচ্ছু নেই! না! আমার  ফিরতেই হবে। কিন্তু কিভাবে?

“যেখান থেকে সব কিছুর শুরু সেখান থেকে…!”

বিরবির করলো ড. রশীদ।

“সব কিছুর শুরু…!”

দুজন প্রায় একই সময় একটা নাম উচ্চারন করলাম –

“শফিক রহমান।”

শফিকই হচ্ছে একমাত্র লিংক এই দুই জগতের মাঝখানে ! দুটো ঘটনার মাঝেই একটা জিনিস কমন, শফিক ভাইয়ের বাসার উপস্থিতি আর তিনি নিজে। হয়তো সেই রাতে দেখা খাটের নিচের লাশ কিংবা সেই আয়নায় দেখা আমারই প্রতিচ্ছবি।

এগুলোর কোনটাই হয়তো এই টাইম রিভার্সাল আর এই সমান্তরাল ২ পৃথিবীর রহস্যের সব উত্তর।

“যেভাবেই হোক এই শফিক রহমানের বাসায় যেতেই হবে রশীদ সাহেব” মরিয়া গলায় বললাম আমি।

“কিন্তু আপনাকে বের করব কিভাবে! প্রায় অসম্ভব এই মুহুর্তে আর…!”

“কি আর?”

“যদি আমরা বুঝে থাকি শফিক সাহেবের এই পুরো ব্যাপারটায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এই মূহুর্তে ২০১৭ তে থাকা প্রচন্ড চালাক আর ভয়ংকর আরেকটা আপনি… সেই রোকন মাহমুদও নিশ্চই সেটা বের করে ফেলেছে!”

“আমারো সেই একই ভয়! যদি শফিক ভাইকে ও আমাদের আগে ওখানে খুঁজে বের করে ফেলে…!”

“আরো ভয়ংকর কিছু ঘটবে!”

“ও কিছু করার আগেই আমাদের এখান থেকে কিছু না কিছু করতেই হবে রশীদ সাহেব ! প্লীজ হেল্প মি সল্ভ দিজ… ব্রেক দিজ প্যারাডক্স!”

রশীদ উঠে রুমের দরজাটা খুলে বাইরেটা একটু দেখলো। কিছু একটা ভেবে নিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমার দিকে ঘুরলো,

“তৈরী হয়ে নিন রোকন সাহেব। শফিক রহমানের বাসা।আজই এই সব রহস্য… এই সময় সুরঙ্গের শেষ দেখে তবেই ছাড়বো।”

৫.

সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। শহরের এক কোনায় পুরানো এক বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো ড. রশীদ। হাসপাতালের অত নিরাপত্তার মাঝে ওভাবে রিস্ক নিয়ে আমাকে বের করে আনতে পারবে রশীদ, আশা করিনি। লোকটা অনেক সাহায্য করছে।

বাড়িটার চারপাশে অনেক অনেক গাছ। একদম গাছের আড়ালে পরে গেছে পুরো বাড়ি। অথচ আমার সময়ের শফিক ভাইয়ের বাসা ছিলো ১৬ তালা এক আকাশচুম্বী দালানে। এই বাড়িটা অনেক পুরানো। ভিক্টোরিয়ান আমলের আদলে তৈরী! বয়স ৭০/৮০ বছরের কম হবে না। অন্ধকার হয়ে গেছে প্রায়। অস্বস্তি লাগছে খুব বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতেই। আশেপাশে একটা মানুষ এর ও ছায়া নেই, অন্য কোন বাড়ি দোকান পাট তো দূরের কথা।

“শফিক বাড়িতে নেই মনে হচ্ছে। রাত প্রায় হয়ে এল, পুরো বাড়িই অন্ধকার।”

আস্তে আস্তে বললাম।

“ভেতরে গেলেই জানা যাবে। চলুন।”

রশীদ সামনে পা বাড়ালো। আমার নিজের কাছে প্রচন্ড বাজে অনুভুতি হচ্ছে। পা যেন আগাতে চাচ্ছেনা, খুব খারাপ কিছু যেন ঘটবে এমন আশংকা বার বার আসছে মাথায়।

রশীদকে দেখলাম নির্দ্ধিধায় সামনের বাগান পাড় হয়ে একদম দরজায় পৌছে গেছে। মাথা থেকে সব অজানা ভয় জোড় করে ঝেড়ে ফেলে দরজার কাছে গিয়ে দাড়ালাম।

“লক করা ?”

“না। শফিক বাড়ি নেই মনে হচ্ছে।”

“ওর অপেক্ষা করা উচিত্‍?”

“কতক্ষন আন্দাজের উপর অপেক্ষা করবেন। এর চেয়ে ভেতরে যাওয়া যাক। ভেতরে থাকলে তো ভালো না থাকলে ও ভালো। আমাদের কাজ আমরা করে ফেলি।”

দরজায় আলতো ধাক্কা দিতেই খুলে গেল । অন্ধকার একদম ভিতরে। রশীদ নিজের একটা টর্চ জ্বেলে আরেকটা আমাকে দিলো।

একটা ধাক্কার মতো খেলাম টর্চের আলো চারপাশে ফেলতেই!

হুবুহু সেই শফিক ভাইয়ের বাসা! সেই ২০১৭ সালের শফিক ভাই এর ১১ তালার বাসার ভিতরে দাঁড়িয়ে আছি যেন। একদম কার্বন কপি! একই রং একই আসবাব পত্র, একই রকম দেয়ালে টানানো পেইটিংস গুলোও! মানে কি?

এমন কিছু জিনিসও আছে যা এই ২০০২ তে এখন ও তৈরীই হয়নি! ওসব এখানে এই সময়ে কিভাবে! রশীদকে বলতে নিয়ে খেয়াল করলাম ও একটা রুমের দরজার দিকে আলো ধরেছে! দরজার দিকে তাকিয়ে আমার শরীর পুরোটা কেমন কেঁপে উঠলো। আমার হার্টবিট প্রত্যেকটা আমি নিজেই শুনতে পাচ্ছি।

রশীদের আলো ধরা দরজাটা সেই ড্রয়িং রুমের… সব ভয়ংকরের সূচনা যেখানে! রশীদ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম।

“এটাই তো সেই রুম?”

“ড. রশীদ…!”

“আমি জানি আপনার মনের অবস্থা রোকন, কিন্তু ভেতরে না গেলে এর উত্তর ও হয়তো পাওয়া যাবে না। আসুন।”

রশীদের কথাই ঠিক! এই ভয় কোন উত্তর দিবে না, ভয়ের সামনে যেয়ে দাঁড়াতে হবে। আস্তে করে রুমের গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো রশীদ, ওর ঠিক পেছনেই আমি।

ওইতো সেই টিভি। বিশালাকার স্ক্রীন, সেই একই সাউন্ড সিস্টেম। একই রকম টাইলস, একই মেঝে, সেই আয়না।আর…যেখানে আমি বসেছিলাম সে রাতে ঠিক সেই জায়গাতেই সেই ছোট্ট খাটটা।

দুজনে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলাম। সব কিছুই যেন খুব স্বাভাবিক। কোথাও অদ্ভুতুরে কিছু নেই । এখান থেকেই নাকি কয়দিন আগে কোন এক মাফিয়া গ্রুপের ৬ জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আমাকেও অচেতন অবস্থায় পেয়েছে ওসবের কোন চিহ্নই নেই।

“এই খাটটার কথাই তো বলছিলেন রোকন?”

খাটের উপরে আলো ফেলল রশীদ।

“হুম। এটাই ।”

খাটটার দিকে এগিয়ে গেলাম। কেন জানিনা সেই রাতে যে ভাবে বসে খেলা দেখছিলাম ঠিক সেভাবেই খাটটার পাশে বসলাম। রশীদ আমার দিকে টর্চ ধরে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়ে পরলাম খাটের পাশে, ঠিক সেভাবে। আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুড়িয়ে খাটের নিচে তাকালাম। ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার । আমি জানি না আমি কি দেখতে চাচ্ছি । হাতের টর্চটা খাটের নিচটায় ফেলতেই যেন হৃদস্পন্দন যেন থেমে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্যে!

নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না।

শফিক ভাই! একদম সেই রাতে দেখা শফিক ভাই… একই ভাবে পড়ে আছে!

ঠিক যেভাবে ভয়ংকর রকমের বিকৃত লাশটা দেখেছিলাম সেই একই দৃশ্য যেন আরো একবার আমার চোখের সামনে মঞ্চস্থ হচ্ছে আর আমি দেখে যাচ্ছি নির্বাক! প্রচন্ড রকম অবিশ্বাস আর আতংক নিয়ে মাথাটা রশীদের দিকে ঘুরাতেই আরেক বারের মত হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম!

রশীদ আমার দিকে কেমন অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে! ঠোঁটের কোনে অদ্ভুদ একটা ক্রুর বাঁকা  হাসি!

আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখলাম রশীদের একটা হাত উপরে উঠে গেল, হাতে শক্ত করে ধরে রাখা স্টীলের টর্চটা সজোরে নামিয়ে আনলো আমার মাথা বরাবর ! চারপাশের অন্ধকার আরো দ্বিগুন গাঢ়  অন্ধকার হয়ে নেমে এলো দু’চোখে।

৬.

রাত কত হলো! চারপাশ প্রচন্ড রকম নিশ্চুপ। জ্ঞান ফেরার পর কিছুক্ষন বুঝতে পারছিলাম না কোথায় আছি। আস্তে আস্তে খেয়াল হলো সব কিছু। ওই রুমেই একটা চেয়ারে বসে আছি। এখন আর অন্ধকার নেই। প্রচন্ড উজ্জ্বল একটা আলোয় পুরো ঘর আলোকিত।

আমার সামনে আরেকটা চেয়ারে বসে আছে ড. রশীদ। মুখে সেই বাঁকানো হাসিটা ঝুলে আছে এখনো।

“ওয়েল-কাম ব্যাক রোকন সাহেব।”

এই গলা আগে শুনিনি আগে রশীদের! গা শিরশির করে উঠলো।

“খুব কনফিউশনে পরে গেছেন না? ভাবছেন কি হচ্ছে! অত ভালো লোক রশীদ কেন এমন উদ্ভট আচরন করছে! তাইতো?”

কথা সত্যি। মাথার ভেতর তোলপাড় করেও কোন উত্তর পাচ্ছি না! রশীদ? হচ্ছে কি এখানে!

“আচ্ছা আমিই বলছি। আপনি শুনতে থাকুন চুপচাপ।

আপনার কি মনে হয় রোকন সাহেব? এই পুরো সময় ভ্রমন, এই টাইম রিভার্সাল পুরোটাই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা? একটা এক্সিডেন্ট? না! মোটেও না। পুরোটাই ওয়েল প্লানড এন্ড পারফেক্টলি এগ্জিকিউটেড… বাই মি অফকোর্স! আমিই ছিলাম এর শুরু থেকে শেষ অব্দি।”

আমি দম বন্ধ করে শুনে যাচ্ছিলাম রশীদের কথা। এখন পরিষ্কার লাগছে কেন রশীদ আমার সব কথা অত সহজেই মেনে নিয়েছে! প্রতিটা কথায় সায় দিয়েছে বিনা বাক্য ব্যয়ে।

“যা কিছু হচ্ছে সব কিছুর শুরু ঠিক এই জায়গা থেকে। আপনার ২০১৭ এর ওই শফিক এর বাসা থেকে না। এই শফিক রহমানের বাসা থেকে। আর একটু আগে খাটের নিচে যাকে দেখেছেন সেটা শফিক রহমানের লাশই বটে। আমিই মেরে রেখেছি ওখানে।” বাঁকা হাসি হাসলো রশীদ।

“কেন? কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আমার সাথে এসবের কি সম্পর্ক? আপনি কেন এসব করছেন রশীদ সাহেব!”

অসহায় গলায় প্রশ্ন করলাম।

“আপনি? না না… আপনি তো জাস্ট একটা সিম্পল স্টেপ। একটা ছোট্ট অংশ, অনেক অনেক বিশাল কোন কিছুর প্রারম্ভের।”

একটু থামলো রশীদ। আবার শুরু করলো-

“আপনি জানতে চেয়েছিলেন এই টাইম টানেল এর শুরু কোথায়! এই ওয়ার্মহোল অব টাইম এর দরজা এই রুমেই আছে। আপনার ধারনা একদম সঠিক, কিন্তু সেটা ওই আয়না অথবা ওই খাটের নিচে নয়। এই সময় সুরঙ্গের একমাত্র দরজা আপনার একদম সামনে।

এই বিরাট টিভি স্ক্রিনের মত যে স্বচ্ছ গ্লাসের মত জিনিসটা দেখছেন… এটাই। জাস্ট এ ক্লিক অন দি সুইচ, এক্টিভেটেড ইন আ মোমেন্ট!”

মাথায় সব কিছু ঢোকাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এই স্ক্রিনের মত জিনিসটা? এটাই এই দুই ডাইমেনশান; এই দুই প্যারালাল পৃথিবীর মাঝে একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম? এর কারনেই আমি ১৫ বছর পিছনে চলে এসেছি? কিন্তু আমিই কেন?

“কারন ওই মুহুর্তে এই জায়গায় এগজাক্ট রেঞ্জে একমাত্র আপনিই  ছিলেন।”

“আমি?”

“আপনি মানে আপনার ১৫ বছর আগের আরেক সত্ত্বা, আরেক রোকন মাহমুদ। আপনার কি মনে হয় আমাদের চারপাশে শুধুমাত্র দুটো অদৃশ্য জগত? না! অসংখ্য, অগনিত।

এই মুহূর্তে প্রতি মিনিটে; প্রতি সেকেন্ডে এক একজন আলাদা আলাদা রোকন মাহমুদ কিংবা একেকজন আলাদা আলাদা রশীদ রহমান তাদের নিজস্ব জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের নিজেদের আলাদা আলাদা পরিচয়ে জীবন কাটাচ্ছে। সেই সব জগতের কোন এক আপনি চলে এসেছেন আমার জগতের রোকন সাহেবের পরিবর্তে, এক অনাহূত অতিথি হয়ে।”

মাথায় হালকা হালকা ঢুকছে কথাগুলো। প্রশ্ন করলাম সেই খুনী সাইকো রোকন কেন এই রুমে এসেছিলো?

“ওই রোকন মাহমুদকে আমিই পাঠিয়েছিলাম। বললেনই তো ও একটা সাইকো! ভাড়াটে খুনী জানেনই। এখানে খুন করতেই এসেছিলো। একটা এক্সপেরিমেন্টের জন্য গিনিপিগ হিসেবে কয়েকটা ঘৃন্য অপরাধীর থেকে বেস্ট অপশন কি হতে পারে? একটা ক্রাইম গ্যাং আর একটা সাইকো সিরিয়াল কিলার। আমি আগেই জানতাম শফিক রহমানের বাড়ির এই গোপন রহস্যের কথা। তাই দুই পক্ষকেই এখানে নিয়ে এসেছিলাম মাথা খাটিয়ে। আমার শুধু এটা পরীক্ষা করার দরকার ছিলো… সারভাইভ করা পসিবল কি না!”

“তার মানে ওই গ্যাংয়ের বাকি সদস্য যাদের শফিক মেরেছে তারা আমার জগতের আমার বন্ধুরা? আর তাই আমি ওদের লাশগুলো দেখেছি! তাহলে শফিকের লাশ? ও তো বেঁচে ছিলো এ জগতে যখন আমি আসি! ও মারা গেছে পরে, আমি আসার পরে। আগে কিভাবে ওর লাশ দেখলাম?” গলা দিয়ে কথা সরছেনা আমার।

“আমি যতটা বুঝেছি ইউ হ্যাভ আ প্রিমনিশন! নাহ, প্রিভিশন বলা উচিৎ! আজকের এই লাশ দেখার দৃশ্যটাই আপনি আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখে ফেলেছিলেন এই টাইমলাইনের বাউন্ড ক্রস করে! তারপর পর আবার অরিজিনাল টাইমে ফিরে এসেছিলেন এই সময়সীমার! এটা পারফেক্টলি স্ট্যাবল না!” মাথা নাড়লো রশীদ।

“শফিক এর বাড়িতে এই টাইম মেশিন কিংবা যাই হোক, কেন? শফিক এটার কথা জানতো?

” এটুকু জানতো যে, এটা স্বাভাবিক কিছু নাহ। আমার সাথে ওর পরিচয় হওয়ার পর প্রথম যখন ওর বাসায় আসি আমি হকচকিয়ে যাই সব দেখে। বোবা শফিক সব আমাকে বোঝাতে পারে নি কিন্তু আমি নিজেই বের কি এর রহস্য। কিন্তু কখনো ব্যবহার করে দেখার চেষ্টা করিনি। আর এই মেশিনটা? এটা হয়তো কয়েকশত কিংবা হাজার বছর আগের! হয়তো আমাদের জগতের না, হয়তো অন্য কোন জগতের।”

“তার মানে দাঁড়াচ্ছে… এই সমস্ত কিছুতে আমার কোন রকম ভূমিকাই ছিলো না? শুধুমাত্র আপনার পাগলামির জন্যে আমি এই অবস্থায়?” প্রায় চেচিয়ে উঠলাম রাগে ক্ষোভে।

“পাগলামি? কোনটা পাগলামি?” হিংস্র গলায় বলল রশীদ-”আপনার কোন ধারনাই নেই আমি কি কি করতে পারি এই সময় সুরঙ্গের নিয়ন্ত্রন নিতে পারলে। আমি এই পুরো মহাবিশ্বব্রক্ষ্মান্ড শাসন করবো! আমার হাতে থাকবে সময় এর চাবিকাঠি! আপনি আন্দাজও করতে পারছেন না রোকন সাহেব! শত সহস্র নতুন ইতিহাস রচিত হবে! দুঃস্বপ্নের মত অসংখ্য অতীত, অসংখ্য স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারবো আমি! শত সহস্র যুদ্ধ, কোটি কোটি মৃত্যু,  অসংখ্য সভ্যতা সব কিছু নতুন করে তৈরী হবে! আই উইল বি দ্য নিউ বিগিনিং! নিউ গড! দ্য গ্রেটেস্ট ওয়ান! আপনার ক্ষমতাও নেই আন্দাজ করার!”

পারছি আমি আন্দাজ করতে। এরপর রশীদ কি করবে তাও বুঝতে পারছি। মেরে ফেলবে আমাকে। এই অসীম ক্ষমতা ওর হাতে পরতে দেয়া যাবে না কোনমতেই। তখন খাটের নিচে দেখার আগে আর একটা জিনিস আমার চোখে পরেছিল। একটা গ্লাভস। বা হাতের গ্লাভস। জানি ওটা কার। রোকন মাহমুদের সেই গ্লাভস। পুলিশ কেন খুঁজে পায়নি এটা বুঝলাম না অত মাথা ঘামানোর সময়ও নেই! এক পা দিয়ে সেটা কে অনেকক্ষন আগেই চেয়ারে নিচে এনে রেখেছি। আমাকে বেঁধে রাখেনি রশীদ। আমি কিছু করবো বা করতে পারবো এ অবস্থায় ভাবেনি সে।

রশীদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি গ্লাভসটা এক হাতে তুলে নিয়ে ওর উপর লাফ দিয়ে পরলাম। ওকে মারার চেয়েও আমার একমাত্র উদ্দেশ্য এই স্ক্রিনটা ভেঙে ফেলা। কিছুতেই এই ম্যানিয়াকের হাতে এটা পরতে দেয়া যাবে না! রশীদ প্রস্তুত ছিলোনা এর জন্যে। পরমুহূর্তে সামলে নিয়ে এক ঝটকায় আমাকে সরিয়ে দিলো। লম্বা একটা ছুরি বের করে আনলো জামার ভেতর থেকে। আমার তখন মাথায় কোন কিছুই কাজ করছেনা ! রশীদ ছুরি নিয়ে সামনে এগোতেই চেয়ারটা ছুড়ে দিলাম ওর দিকে, একটু বেসামাল হতেই ওর উপর হামলে পড়লাম।

ছুরিটা হাত থেকে ছিটকে পরল চেয়ারের এক কোনায় লেগে… একদম স্ক্রীনটার সামনে। রশীদ ওদিকে ছুড়িটা নেয়ার চেষ্টা করতেই ওর সাথে প্রচন্ড ধস্তাধস্তি করতে করতে দুজনেই গিয়ে পরলাম বিশাল স্ক্রীনটার একদম ওপরে! কারো একজনের হাতের ধাক্কার সুইচ অন হয়ে গেলো। সাথে সাথে প্রচন্ড আলোর ঝলকানি তে চারপাশ সবকিছু যেন শূন্য হয়ে গেলো! জ্ঞান হারালাম পর মুহুর্তে!

”গো ও ও ও ও ল ”-  একসাথে অনেক গলায় হইচইতে সম্বিত ফিরে পেলাম।

রাশেদ!

ওইতো রাসেল! রনি,মিলন সবাই! আমি ফিরে এসেছি! সেই রাতে  সেই ১১ তালায় শফিক ভাইয়ের বাসায়। ওইতো শফিক ভাই! তার ভয়ানক সব হাসির গল্প বলে চলছেন। ভয়ে ভয়ে একবার আরচোখে খাটের নিচ টায় চোখ বোলালাম।

…কিচ্ছু নেই…!

বহুদিন পর যেন একবুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এ জগতে থাকা ওই ভয়ংকর রোকন মাহমুদ ফিরে গেছে তার নিজের যায়গায়, হয়তো চিরজীবনের জন্যে!

আর… আর… আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না, ঘুম দরকার! অনেক দিন পর শান্তির ঘুম।

(পরিশিষ্ট…)

অনেক হইচই হট্রগোল চারপাশে। রশীদের জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু হাত পা কিছুই নাড়াতে পারছেনা! শুধু ঘাড় একটু কাঁত করতে পারলো। কোথায় ও?

মধ্যদুপুর! চারপাশে হাজার হাজার মানুষ! গোল হয়ে ঘিরে রেখেছে যেন। কোন এক বিরাট খোলা ময়দানের মাঝখানে হাঁটু গেড়ে বসে রশীদ। হাত পা সব শক্ত করে বাঁধা। ওর ডানে বামে আরো অনেকে একসারি তে এভাবে বাঁধা অবস্থায় বসা। কেউ একজন গমগমে গলায় বলে উঠলো…

”আজ ৪ঠা জুলাই ১৮৭৪ সাল। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে এই বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হবে এই মুহুর্তে।”

“১৮৭৪? তার মানে…!”

বেশীক্ষন ভাবার সময় পেলোনা রশীদ। পেছনে দাঁড়ানো জল্লাদের খোলা বিশাল তরবারিটা তার ঘাড়ে নেমে এলো প্রচন্ড জোড়ে ।।।

সমাপ্ত…

  • সাজ্জাদ সিয়াম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *