অভিভাবকহীন এক জাতি

কয়েকদিন আগে মাঠে হাঁটতে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা ছেলেকে অনেক মানুষ মিলে পেটাচ্ছে। যে যেভাবে পারছে মারছে। কেউ লাথি মারছে, কেউ চড়থাপ্পড়কিলঘুষি মারছে, কেউ লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে। ছেলেটা শুধু আর্তনাদ করছে, আমি চুরি করিনি বলে চিৎকার করছে। কেউ একজন গিয়ে পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে পিচ্চিটাকে ধরে নিয়ে গেল। জানতে পারলাম জুতা চুরির অভিযোগে তাকে এভাবে মারা হচ্ছে, যদিও চুরি আদৌ সে করেছে কি না সেটা প্রমাণিত নয়। আমার পরিচিত একজনের কাছে জানতে চাইলাম তাকে কেন তার অভিভাবকের কাছে তুলে না দিয়ে এভাবে মারা হচ্ছে, এতটুকু একটা ছেলে, কোনো অপরাধ যদি করেই থাকে তবে তো তার অভিভাবকের কাছে বলা উচিত। সে বললতার কোনো অভিভবক নেই। দেখে ভালো ঘরের ছেলে বলেই মনে হলো যদিও পরনে ছিন্নবস্ত্র।

 পরিচিত লোকটির কাছ থেকে সেই বাচ্চাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম। তার বাবা নাকি অনেক ধনী প্রতাপশালী। তারা অনেকগুলো ভাই। শক্তিসামর্থ, টাকাপয়সা, প্রভাবপ্রতিপত্তি সব মিলিয়ে এলাকার কেউ তাদের দিকে চোখ তুলে তাকানোরও নাকি সাহসও করত না। ভাইগুলোর মধ্যে যতদিন মিলমহব্বত ছিল ততদিন তাদের পারিবারিক সুখস্বাচ্ছন্দও যেমন ছিল তেমনি এলাকাতে তাদের নামযশও ছিল। তার বাবা ভালোর ভালো আবার খারাপের মহা যম। ছেলেদেরকে খুব ভালোবাসত বাবা। কিন্তু যখন থেকে ছেলেরা জমিজমা, অর্থসম্পত্তি নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ববিবাদ শুরু করল তখন থেকে বাবা ছেলেদেরকে বারবার শুধু সাবধান করে আসছিল যে, এভাবে তোরা যদি নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব করিস তাহলে তোরা দুর্বল হয়ে যাবি আর আমিও আমার সকল সম্পত্তি থেকে তোদের বঞ্চিত করব, সবাইকে ত্যাজ্যপুত্র করব।

 এই সাবধানবাণী ছেলেরা শোনেনি। দ্বন্দ্ব একসময় সংঘাতে রূপ নিল। ভাইগুলো কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে সংঘাতে লিপ্ত হলো, এক পর্যায়ে এক ভাই আরেক ভাইয়ের মাথায় আঘাত করল, এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা পর্যন্ত করে ফেলল। এসব দেখে বাবা অত্যন্ত দুঃখিত ক্রোধান্বিত হলো। বাবা সবগুলো ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করে দিল। ছেলেগুলোর আর অভিভাবক থাকল না, তারা যার যার মতো আলাদা হয়ে গেল। ভাইগুলোর মধ্যেও আর ভালো সম্পর্ক থাকল না। এখন এক ভাইয়ের বিপদে আরেক ভাই এগিয়ে আসে না।

 

এতক্ষণে বুঝলাম ছেলেটিকে কেন সবাই মিলে এভাবে মারছিল। আসলে অভিভাবক না থাকাটাই তার অপরাধ। যদি ভাইগুলো এভাবে দ্বন্দ্ব না করত, যদি বাবার সাবধানবাণী শুনে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত না হতো তাহলে আর এভাবে সবার হাতে মার খেতে হতো না, সবার লাথি খেতে হতো না।

 আজ মুসলিম জাতির ঠিক একই পরিণতি। রোহিঙ্গারা মার খেয়ে দেশান্তরী হয়েছে অভিভাবকহীন হবার কারণে। ফিলিস্তিনীদের উপর নির্যাতন চলছে যুগ যুগ ধরে, কাশ্মির, কাশগড়, উইঘোর, জিংজিয়াং, বসনিয়া, চেচনিয়া, কম্পুচিয়া এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই মুসলিম জাতি অসহনীয় নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এই জন্য যে, তাদের কোনো অভিভাবক নেই। তাদের অভিভাবক মহান আল্লাহর সাবধানবাণী সত্ত্বেও এই জাতি সত্য ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ করেছে বহু আগে, বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি করে মরছে, দ্বন্দ্বসংঘাত করছে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে। এজন্য মহান আল্লাহ তাদের অভিভাবকত্ব ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের হৃদয়বিদারী চিৎকার আর চোখের জল আল্লাহর কাছে পৌঁছাচ্ছে না।

 এখন আল্লাহকে অভিভাবক হিসাবে গ্রহণ করার জন্য মুসলিমদেরকে আল্লাহর হুকুম তথা যাবতীয় সত্য ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আল্লাহর নিকট প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে, আমরা আর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত করব না, আমরা হবো এক জাতি, একপ্রাণ, আমরা জীবনের সমস্ত অঙ্গনে কেবল তোমারই হুকুম মানব, তোমারই এবাদত করব, তোমার কাছেই সাহয্য প্রার্থনা করব, তোমাকেই অভিভাবক হিসাবে জানব।

.

লেখা: রাকিবুল বান্না

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *