টিকটিক করে ঘড়ি বেজেই চলেছে৷ ১২টা ছুঁইছুঁই। ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে নীরার। আর কতক্ষণ ঘুমের সাথে লুকোচুরি খেলা যায়! চোখ বারবার নিবদ্ধ হচ্ছে দরজার দিকে৷ এভাবে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়লো নীরা।
দেড়টা বেজে প্রায় কুড়ি মিনিট। দূরে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কমিউনিটি পুলিশের বাঁশির শব্দ। আর বাকিসব শুনশান, প্রচন্ড নিরবতায় ঢেকে গেছে এ শহর। নিশাচর বাদে বাকিসব মানুষ পাড়ি জমিয়েছে ঘুমের দেশে। মাঝরাত মানেই মায়াময়, রহস্যময়, আলো-আঁধারির খেলা। ভারী অদ্ভুত এ সময়টা। কিছু মানুষ রাতজেগে একের পর এক অর্থহীন স্বপ্ন বুনে যায়, কেউবা ক্লান্তিহীন অপেক্ষায় মগ্ন। কিছু কিছু অপেক্ষা দীর্ঘদিন রয়ে যায় বহমান। প্রতীক্ষার প্রহরগুলো বুঝি একটু বেশি-ই দীর্ঘ হয়। কেউ কেউ সেই প্রতীক্ষার কদর বুঝে, কেউ বা এড়িয়ে যায় নির্বিঘ্নে!
একটা ত্রিশ মিনিটে কলিংবেল বেজে উঠলো। আওয়াজ পেয়ে হুড়মুড় করে নীরা ঘুম থেকে জেগে উঠল। কেমন অবসন্ন অবসন্ন লাগছে। ইচ্ছে করছে সবকিছু তুচ্ছ করে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে, তারপরও নীরা কষ্ট করে দরজা খুলে দিল।
-এতো দেরি হলো যে আজ?
– হুমমমম।
– তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো আমি টেবিলে ভাত দিচ্ছি।
– লাগবে নাহ। ক্ষুধা নেই।
– অল্প করে দেই? আমিও তোমার জন্য খাইনি….
– আমি তো তোমাকে বলিনি নাহ খেয়ে থাকতে। তোমার খাবার তুমি খেয়ে নিবে। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কেন?
আফনান ফ্রেশ হয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নীরা বুঝতে পারলো ক্ষুধায় তার পেট চো-চো করছে কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে। সে সব খাবার গুছিয়ে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখলো। ইদানীং তার ঘুম খুব কম হচ্ছে তাছাড়া আফনানের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। কয়েকদিন ধরে সে দেরি করে বাসায় ফেরে। রাতে এসে খাবার খায় নাহ। নীরা তবু নিয়ম করে তার জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। অপেক্ষা করতে করতে তার আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে। দেরি করে আসার কারণ জিজ্ঞেস করাও মানা। পাছে তিনি বিরক্ত হন। নাহ তার ঘুমানো উচিত, অনেক রাত হয়েছে।
-আফনান! আফনান!
নীরা কয়েকবার আফনানকে ডাকলো। ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়৷ ঘুমন্ত মানুষকে এতো অদ্ভুত আর এতো নিষ্পাপ লাগে কেন কে জানে! হয়তো দুনিয়ার সকল দুশ্চিন্তা আর হতাশা সেখানে ঠাঁই পায় নাহ বলে ঘুমন্ত মানুষের চোখমুখে শীতলতায় ছেঁয়ে যায়।এতটা কাছে থেকেও আকাশ-জমিন সমান দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে পেতে দুটো মানুষের মাঝামাঝি একটা ঘন দেয়াল কখন গড়ে উঠে মানুষগুলো টের পায় নাহ। নীরা আস্তে করে খাট থেকে বেরিয়ে যাওয়া আফনানের পা টাকে বিছানায় ঢুকিয়ে দিল। মশারী টাঙ্গালো। এরপর একপাশে গুটিসুটি হয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো।
ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙলো নীরার। আফনান তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আজানের জবাব দিয়ে অজু করে সে জায়নামাজে দাঁড়ালো। তার বুকটা আজ কেমন ভার হয়ে আছে৷ কতদিন ধরে তাহাজ্জুদ পড়া হয় নাহ। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে তার দিনগুলো। রব্বে করিমের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়াতেই কি তাদের সম্পর্কের এ অবনতি? মনে মনে নিয়ত করলো কাল থেকে আবার তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস করবে৷ বহুদিন পর সেজদায় গিয়ে নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত কান্না আজ উজার করে দিল সে রবের সামনে। আজ রবের কাছে আকুল আবেদনের সঙ্গে জানালো নিজের ইচ্ছেটাকে!
নীরা ফজরের পর কখনো ঘুমায় নাহ। ঘুমালে নাস্তা বানাতে খুব হিমশিম খেতে হয়। বিয়ের আগেও সে ফজরের পর ঘুমাতো নাহ৷ কখনো মাকে সাহায্য করতো। কখনো ছাদে গিয়ে গাছের পরিচর্যা করতো। আবার কখনোবা বই পড়ে সময় কাটাতো।বাসার অন্য সদস্যরা নামাজ শেষে ঘুমাচ্ছে। নীরা নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে। ভাজির জন্য আলু কেটেছে, রুটি বেলছে। পাশাপাশি চুলায় ভাজি বসিয়ে দিল। নীরার কাজ খুব গোছানো এবং কাজও সে দ্রুত করতে পারে ঠিক তার মায়ের মতো। সকালে এই দুই-আড়াই ঘন্টা নীরার খুব প্রিয়। এসময় সে মনে মনে আগের দিনগুলোর কথা চিন্তা করতে পারে অনায়াসে, বিরক্ত করার মতো কেউ নেই। কাজের ফাঁকে ডুব দেয় সে চিন্তা নামক মহাসাগরের অতলে। একটা একাকী সময়, একটা নির্জন সকাল, বিরহ চিত্তে মগ্ন মন কত শত স্মৃতির জাগরণ ঘটায়। চোখের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে কিছু জমানো সুখ, কিছু লুকানো ব্যাথা আর কিছু ফেলে আসা স্বপ্ন। হারিয়ে ফেলা প্রিয় মানুষটাকে টেনে নিয়ে আসে মনের আয়নায়। কিছু মুহূর্তের দূরত্বকে মনে হয় যেন কত হাজার বছর ধরে হয়নি তার সাথে কথা, কত হাজার গোপনীয়তা হয়নি তাকে বলা। ইচ্ছে করে ফিরে যেতে সে পুরোনো দিনগুলোতে৷ হারিয়ে যাওয়া সময় তো কভু ফিরে আসবে নাহ। তবু সেগুলো মনে করে পাওয়া যাবে কিছু শূন্যতা আর সারাজীবনের সকল অপূর্ণতার মাঝে কিছু পূর্নতা!
নীরা সবে রুটি সেকাঁ শেষ করেছে এসময় তার ননদ রাইসা রান্নাঘরে উঁকি দিল। “ভাবী গতকাল টেবিলের উপরে একটা ছোট প্যাড রেখেছিলাম, দেখেছো?”
“কই নাহ তো। অন্য কোথাও রেখেছো হয়তো ভুলে গেছো”
“হতে পারে৷ তোমার নাস্তা বানানো শেষ? আমার নাহ খুব ক্ষুধা পেয়েছে।”
” আচ্ছা দিচ্ছি।”
নীরা রাইসা সহ নাস্তাগুলো খাবার টেবিলে দিয়ে এসে চুলায় চায়ের পানি বসাল। আফনানও উঠে গেছে। একফাঁকে দেখে এলো সে রেডি হচ্ছে। আফনানের জন্য আলাদা করে ডিম ভাজতে হয়। ডিম ছাড়া রুটি দিলে সে খেতে চায় নাহ। নীরা একটা ডিম ভেজে আফনানের প্লেটে দিয়ে আসলো। সবার নাস্তা করা শেষ হলে অনেক থালাবাসন জমে। সেগুলো ধুতেই অনেক সময় চলে যায়। আফনানকে বেরিয়ে যেতে দেখে টিফিনকারী বক্স নিয়ে নীরাও পেছন পেছন গেল। বক্সটা হাতে দিয়ে বলল,
– সাবধানে যেও।
– আচ্ছা আসছি।
নীরার আবার কাজের পর্ব শুরু হয়ে গেল। তার শ্বাশুড়ির ডায়াবেটিস সাথে হাই প্রেশারও আছে। তেমন একটা কাজ করতে পারেন নাহ। প্রথম প্রথম রান্না তিনি-ই করতেন। এখন সব কাজ ওকে একাই সামলাতে হয়। নাস্তার পর শ্বশুর মশাই চা খেতে খেতে বারান্দায় বসে পেপার পড়েন। নীরা তাকে গিয়ে চা দিয়ে আসল৷ এ বাড়িতে নীরাকে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন তিনি। বাইরে হাঁটতে গেলে অনেক সময় তিনি চালতা, জলপাই যে সিজনে যে টকফল পাওয়া যায় পেলেই নিয়ে আসেন। নীরা তখন হেসে বলে, “এসব কেন বাবা?”
” শুন মা, তোর বয়সে তোর শ্বাশুড়ি মা কে দেখতাম এসব খেতে। এখন বুড়ে হয়ে গেছেন তাই ওসব খান নাহ। আফনান সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকে। আগে তো এসবের জন্য নিজের বাবার কাছেই আবদার করতি নাকি? এখন থেকে আমার কাছে আবদার করবি। নিজেও খাবি আমাকেও খাওয়াবি হাহা”
শ্বশুরের কথায় চোখে জল আসে নীরার। আগে সে টক-ঝাল খুব পছন্দ করতো। বাড়িতে তাদের নিজস্ব আম, চালতা, তেতুলের গাছ ছিল। সিজন এলেই বাবা বাড়ি থেকে নিয়ে আসতেন। বিয়ের প্রথম প্রথম আফনানই এই দায়িত্ব পালন করতো। হয়তো তিনি সেসব খেয়াল করে মনে রেখেছেন এখনো।এই মানুষটার সেবা করতে পারলে ওর কাছে খুব আনন্দ লাগে।
সারাদিনের কাজ শেষে দুপুরে ঘুমে চোখ ভেঙে আসছিল। এসময় রাইসা বই নিয়ে এলো। ভাবী আমাকে এই টপিকসটা বুঝিয়ে দেও নাহ, মাথায় কিছু ঢুকছে নাহ। রাইসা এবার অ্যাডমিশন টেস্ট দিবে। বেশিরভাগ সময় পড়াশুনা করেই কাটে। নীরা তাকে আধ ঘন্টায় বুঝিয়ে দিল। ননদ চলে যাওয়ার পর নীরার চোখ থেকে ঘুমও চলে গেল। এ পাশ ও পাশ করেও ঘুম আসছে নাহ দেখে মা কে ফোন দিল। মায়ের সাথে দুদিন আগে কথা হয়েছে। ওকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য মা অনেকবার করে বলেছেন কিন্তু নীরা এখনো আফনানকে সে কথা জানাতে পারেনি।
আসরের নামাজ শেষে নীরাকে আবারও সন্ধ্যার নাস্তার জন্য রান্নাঘরে ঢুকতে হলো। রাইসার ঘরে গিয়ে সন্ধ্যার নাস্তা দিয়ে এলো। শ্বাশুড়ি মাকে নাস্তা দিতে গিয়ে দেখল উনার আবারও প্রেশার উঠেছে। তিনি নাস্তা করলেন নাহ। মাথাব্যাথায় নাকি তার অসহ্য লাগছে। নীরা চট করে এক গ্লাস তেতুল পানি খাইয়ে দিল। এরপরও প্রেশার কমছে নাহ দেখে চিন্তায় পড়ে গেল। এদিকে শ্বশুরও বাসায় নেই। পাশের বাসায় ছোট ছেলেটাকে দিয়ে একটা পাউরুটি আনিয়ে শ্বাশুড়িকে পাউরুটি খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিল। কিছুক্ষণ পর তার প্রেশার নেমে এলো। নীরা তাকে বিশ্রাম নিতে বলে নিজের রুমে ফিরে এলো। টেবিলের উপর মীরার দেয়া দুটো বই পরে আছে। সময়ের অভাবে পড়া হয়নি। কি ভেবে একটা বই নিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে পড়া শুরু করলো।মীরা নীরার ছোটবোন। প্রায় প্রতিমাসেই সে তার বোনের জন্য বই পাঠায়। নীরা নিজের জন্য একটু সময় পেলে বই নিয়ে বসে।
আফনান আজও দেরি করে বাসায় ফিরল। নীরা ঘুমিয়ে গিয়েছিল, কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল সে। আফনান জামা বদলে ফ্রেশ হতে যাচ্ছিল। তাই দেখে জিজ্ঞেস করলো, “খাবার দিব টেবিলে?”
“হু”
নীরা ছুটল খাবার গরম করতে। খাবার খেতে খেতে সে বাবা বাড়ী যাওয়ার কথা তুলল।
– মা সেদিন বারবার করে বলছিল ও বাড়ি যেতে। তুমি সময় পাও নাহ বলে বলতে পারি নাহ।
– ঠিক আছে কাল যেও।
– আচ্ছা।
– কাল আমার অফিসে তাড়াতাড়ি যেতে হবে মিটিং আছে। তুমি একা যেতে পারবে নাহ?
– হুম।
– রাইসাকে বলো বাসে উঠিয়ে দিতে।
– আচ্ছা। তুমি কবে যাবে..?
– দেখি, হাতে এখন অনেক কাজ।
সকালে আফনান নাস্তা করেই বেরিয়ে গেল। তার সাথে নীরার আর কথা হয়নি। নীরাও সবাইকে বলে বেরিয়ে পড়লো। রাইসার নাকি আজ কোচিং আছে তাই ওর শ্বশুর সঙ্গে এলো। ও অনেকবার নাহ করেছিল তারপরও তিনি এলেন। মেয়েটা একা একা যাবে ব্যাপারটা তার কাছে খুব খারাপ লাগছিল। বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। নীরা জানালা দিয়ে বললো, ” বাবা আসি। নিজের খেয়াল রাখবেন।” “ঠিক আছে রে মা। সাবধানে যাস।”
আজকের দিনটা নীরার অসম্ভব ভালো কাটলো। এখানে এসে সে যেন তার পূর্বের প্রাণচঞ্চল “আমিটা” কে খুঁজে পেল। মীরার তো কথাই শেষ হয় নাহ। পেটে যত কথা জমে ছিল সব যেন আজকেই বলে শেষ করবে৷ একের পর এক সে গল্প করে যেত লাগলো। কলেজে সম্প্রতি কি কি ঘটনা ঘটেছে, বন্ধুদের কার কি অবস্থা, এলাকার কোথায় নতুন করে কি হয়েছে সবকিছু যেন তার নখদর্পনে। অবশেষে তার থেকে মুক্তি পেয়ে সন্ধ্যায় চা নিয়ে নীরা তার চিরচেনা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এখান থেকে সামনে একটা বিশাল মাঠ দেখা যাচ্ছে। এই মাঠে নীরার শৈশবের কত মধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। কত বার খেলতে গিয়ে হাত পায়ে ব্যাথা পেয়েছে আর কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে এসে আশ্রয় খুজতো। মা হালকা করে মেয়েকে বকা দিতেন,দুষ্টুমি নাহ করার ওয়াদা নিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিতেন। মনে হয় এই সেদিনও সে এই রাস্তা দিয়ে ভার্সিটিতে গিয়েছে। বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরেছে। আচমকা নিজের অজান্তে নীরার মুখ থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো৷ মেয়েদের জীবনটা বড্ড অদ্ভুত। যৌবনের প্রথমদিকে কি আনন্দ আর বিস্ময় নিয়ে সংসারজীবনের স্বপ্ন বুনে। সংসার জীবনে পদার্পণের প্রথমদিনগুলো ভালোই কাটে। ধীরে ধীরে দায়িত্বের ভারে নুইয়ে যেতে থাকে। প্রিয়মানুষের অবহেলায় চোখ থেকে স্বপ্ন হারিয়ে যেতে থাকে। একদিন সে নিজের অস্তিত্বটাকেই যেন হারিয়ে ফেলে। নীরার মনের আকাশে আজ বড্ড মেঘ জমেছে যেকোন মুহূর্তে সামান্য ঝড়ো হাওয়া এসে বৃষ্টি বইয়ে দিতে পারে। এক ফোটা চোখের জল অজান্তেই টুপ করে চায়ের কাপে পড়লো…..
নীরা যাওয়ার পর থেকে আফনানের মন মেজাজ খারাপ হতে থাকে। ও থাকলে সবকিছু ও-ই গুছিয়ে রাখে। এখন কোথায় কি রাখে নিজেই ভুলে যায়। দরকারের সময় কিচ্ছু খুঁজে পায় নাহ। রাতে এসে ঠান্ডা খাবার খেতে হয়। আফনান অফিসের জন্য রেডি হতে হতে ভাবে নীরার সাথে এ পর্যন্ত মাত্র দুবার কলে কথা হয়েছে তাও সে-ই কল দিয়েছে। রেডি হওয়ার পর দেখল ঘড়ি খুঁজে পাচ্ছে নাহ। কি মুসিবত! টেবিল-ড্রয়ার, বিছানা-বালিশ সব এলোমেলো করে ফেলল। বালিশের নিচে এটা আবার কি! আফনান দেখলো বালিশের নিচে একটা কাগজ, তাতে কিছু লেখা আছে। সে জরুরি নাহ ভেবে রেখে দিতে গেল তারপর আবার কি ভেবে পড়া শুরু করল।
❝ তুমি সারাদিন অফিসে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাসায় আসো জানি। তোমার সেই ক্লান্ত চেহারা আমাকেও পীড়া দেয়। তোমার জন্য রাত জেগে বসে থাকি যেন কষ্ট করে তোমায় খাবার গরম করে খেতে নাহ হয়, একা একা খেতে নাহ হয়। তুমি বাসায় ফিরে সবদিন খাও নাহ। কই একবারও তো জিজ্ঞেস করলে নাহ আমি খেয়েছি কিনা। যেদিন তুমি খাও নাহ সেদিন আমারও আর খেতে ইচ্ছে হয় নাহ। তুমি হয়তো বাইরে থেকে খেয়ে আসো। কিন্তু আমি প্রচন্ড ক্ষিধে নিয়ে অপেক্ষা করি। সারাদিন তোমার সাথে আমার ৭-৮ টা শব্দের কথা হয় কিনা তাও সন্দেহ। দরকার ছাড়া কোনো কথা বলার প্রয়োজন বোধ করো নাহ। সারাদিন কাজ করে আমারও তো ইচ্ছে হয় দুটো মনের কথা বলি। একই সাথে কোনো স্বপ্ন বুনি। কতদিন আমরা বাইরে খেতে যাই নাহ, কতদিন কোথাও ঘুরতে বের হইনি বলতে পারো? সারাদিন কাজ শেষে সুখ দুঃখের গল্প করার মতো আমারও তো একটা মানুষ ছিল একদিন। দুপুরবেলা খেয়েছো কিনা, কি করছো তা জানার জন্য এখন আর তোমায় কল দেই নাহ পাছে বিরক্ত হও। মনে পড়ে একদিন তুমিই বলতে আমি কল দিয়ে খবর নাহ নিলে তোমার হাঁসফাঁস লাগে? কল লিস্টটা একবার চেক করে দেখো কতদিন আগে তোমার ফোন থেকে আমার ফোনে কল এসেছিল। বদলানোই মানুষের বৈশিষ্ট্য কিন্তু ভীষনভাবে বদলে গেলে পাশের মানুষটার কতটা কষ্ট হয় তা কি কখনো ভেবে দেখেছো? সেই পুরোনো দিনগুলো আর ফিরবে নাহ ঠিকই তবে চাইলেই আমরা বদলাতে পারি। তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। শুধু অবেহেলায় অভিমান জমে জমে পাহাড়সমান হয়ে আছে।
আমি অর্ধযুগ ধরে তোমায় ভালোবাসি
তুমি জানলে নাহ,
শ্রাবণ ধারায় তোমার নামে অজস্র কাব্য উৎসর্গ করি
তুমি শুনলে নাহ!
আমার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাসে তোমায় রাখি
তুমি বুঝলে নাহ,
আমার নিরব হৃদয়ে তোমার অস্তিত্বের বসবাস
তুমি দেখলে নাহ!
রোদের স্পর্শে তোমায় কল্পনা করি
তুমি রোদেলা হয়ে আমার কপাল ছুঁলে নাহ,
চাঁদের নিষ্পাপ জোছনায় গা ভিজিয়ে দেই
তুমি আমার পূর্ণিমা হলে নাহ,
আমি মুগ্ধ চোখে তোমায় দেখি
তুমি ফিরে তাকালে নাহ,
আমার গাওয়া গানে তোমায় খুঁজি
তুমি অনুভব করলে নাহ।
তুমি দূরে সরে রইলে
কাছে আর আসলে নাহ!❞
~ নীরা
চিঠিটা পড়ে যেন আফনানের বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠলো। সে যেন এতদিন প্রবল ঘোরের মধ্যে ছিল। কাজের চাপে নীরার প্রতি যে অবিচার করা হচ্ছে একবারও মাথায় আসেনি। সেই প্রথমদিন গুলোতে নীরা আর তার মাঝে যেন দূরত্ব সৃষ্টি নাহ সর্বাত্মক সে চেষ্টা করতো। তাকে নিজের করে আগলে রাখতে চাইতো। অথচ তারই কারনে আজ নীরার সাথে আকাশ সমান দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। সে তার মতো ব্যস্ত থাকে অথচ মেয়েটা তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কিন্তু সে কিনা দিনশেষে বাড়ি এসে একটিবার খোঁজ নেয়ার পর্যন্ত ফুরসত পায় নাহ কি অদ্ভুত!
ঘন্টা দুয়েক পর। আফনান বাসে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেও সে আসলে হারিয়ে গেছে পুরোনো স্মৃতির ভীড়ে। তার এক হাতে একটা প্যাকেট যাতে রয়েছে একটা আসমানি রঙের শাড়ি, অন্য হাতে দুটো বেলি ফুলের মালা। নীরার খুব প্রিয় দুটি জিনিস। বিয়ের পর একদিন আফনান যখন জানতে পারলো নীরার প্রিয় ফুল বেলি তখন সারপ্রাইজ দিবে বলে অফিস থেকে আসার সময় পাঁচটা বেলি ফুলের মালা নিয়ে গিয়েছিল বাসায়। নীরা যে সামান্য এ ফুল পেয়ে এতো খুশি হবে ভাবতে পারেনি আফনান। সেই ফুল সে শুকিয়ে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল তার অতি গোপন কুঠুরি অর্থাৎ ড্রয়ারে। বাসের হর্নের শব্দে কল্পনা থেকে ফিরে আসে আফনান। বাস খুব স্পিডে চলছে। আফনান গুণগুণ করে গান গাইছে, “ যাব পেহলি দেখা থা তুমে, আজাবসি আজাবসি লাগা থা।” হঠাৎ জোরে একটা শব্দ হলো। প্রচন্ড ঝাঁকিতে বাসের মধ্যে সবকিছু উলোটপালোট হয়ে গেল। দ্বিতীয় ধাক্কায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই আফনান জানালা দিয়ে দূরে ছিটকে পড়লো। মাথা থেকে গলগল করে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্তে তার শার্ট ভিজে যাচ্ছে। হাতে জড়িয়ে আছে দুটো বেলি ফুলের মালা। শেষবারের মতো প্রিয় মানুষটির প্রতি অগাধ ভালোবাসা নিয়ে তার মুখ থেকে বের হলো, যাব পেহেলি দেখা থা তুমে…….
……….:- সমাপ্ত -:………..