এক সমুদ্র প্রেম [পর্ব-১১]

পিচঢালা রাস্তায় গাড়ি ছুটছে। ধূসর ড্রাইভার হিসেবে মন্দ নয়। ভালোই চালায়। পিউ বসেছে একদম বরাবর ওর পেছনে। ধূসরের গাল ছাড়া কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছেনা। পিউ খুশখুশ করল কিছুক্ষন। ভিউ মিররের কথা মনে পড়তেই চট করে তাকাল সেদিকে। ওইতো স্পষ্ট প্রতিবিম্ব ভেসে আছে ধূসরের। পিউ মুচকি হেসে চেয়ে থাকে সেদিকে। হঠাৎ খেয়াল পরে ড্রাইভ করতে করতে ধূসর আয়নার দিকে কয়কবার তাকাচ্ছে। পিউয়ের খটকা লাগে। কী দেখছে ধূসর ভাই? পিউ হিসাব মেলাতে বসল। যোগ বিয়োগ করে ফলাফল যা পেল অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠল তাতে। তার এখান থেকে ধূসর কে দেখা যাচ্ছে মানে, ধূসরের ওখান থেকে ওকে দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়ই। এর মানে ধূসর ভাই তাকেই দেখছিল? পিউ আনন্দে নেঁচে ওঠে। মনে মনে লাফায়। খুব কষ্টে শান্ত হয়ে বসে রয়।
ইকবাল এসি বন্ধ করে জানলা খুলে দিল। শনশন বাতাস ছুঁয়ে গেল মুখমণ্ডল। ইকবালের ফুরফুরে মেজাজ আর গাঢ় হয়। ঠোঁট ফুলিয়ে শীষ বাজায় সে। তারপর গলা ছেড়ে গান ধরে,
” এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হবে তুমি বলোতো।
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়,তবে কেমন হবে তুমি বলোতো!”
পেছন থেকে পিউ মজা করে বলল ” তুমিই বলো।”
ইকবাল শব্দ করে হেসে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিক ফিরে বলল,
” বুঝলে পিউ,তুমি আমার নিজের বোন হলে বেস্ট হতো। আমাদের দারুন মিল। তাছাড়া আমাদের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে,যা অন্যদের মধ্যে নেই।”
শেষ টুকু বলতে বলতে ইকবাল পুষ্পর দিকে তাকায়। পুষ্প দ্বিতীয় ভেঙচি কাটে তখনি। থতমত খেয়ে চোখ ফেরায় সে। পাশ থেকে ধূসর বলল, ” তোর মুখটা কিছুক্ষন বন্ধ রাখ ইকবাল। ” ইকবাল ভ্রুঁ কুঁচকে বলল ” কেন, কেন?” ” কানের পাশে এভাবে মশা ঘ্যানঘ্যান করলে,ড্রাইভ করা যায়?” পুষ্প এতপথ দুশ্চিন্তায় ডুবে ছিল। অথচ ধূসরের কথাটুক শুনেই ফিক করে হেসে ফেলল। ইকবালের ঠোঁট উল্টে-পাল্টে এলো। মুখ ছোট করে পিউকে বলল
” আমার হয়ে কিছু বলবে না পিউপিউ?”
পিউ ওর টান ধরে কিছু বলতে হা করল এর আগেই ধূসর বলে ওঠে
” ও কী বলবে? ওটা কী কম,সে তোর আরেক স্বজাতি। “
পিউ হা করে তাকাল। পরপর দাঁত কটমট করল। ইকবাল ভ্রুঁ কপালে তুলে বলল, ” পিউ তোমাকে মশা বলেছে ধূসর! আমাকে বলেছে ঠিক আছে,কিন্তু তোমার মত এত মিষ্টি মেয়ে শেষে কী না মশা? এটা কি মানা যায়?” পিউ হাঁসফাঁশ করল। তবে যুক্তিসঙ্গত উত্তর পেলোনা। ঠিক কী বললে ধূসরকে যথাযোগ্য পঁচানি দেয়া যাবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ভার্সিটির দোরগোড়ায় গাড়ি থামে। ওমনি পুষ্পর বুক দুরদুরানি শুরু হয়। বার কয়েক শুকনো ঢোক গেলে সে। কী যে আছে ভাগ্যে!
ইকবাল সবার আগে নামল। পরপর বাকীরা। পিউ নেমেই ভার্সিটির উঁচু ভবন দেখে বলল,
” আইলা! কত সুন্দর রে আপু।”
ধূসর গাড়ি একদম পার্কিং লটে রেখে এসে দাঁড়াল ওদের পাশে। পুষ্পকে শুধাল,
” ডিপার্টমেন্ট হেডের রুম কোন দিকে?”
পুষ্প ফের ঢোক গিলে বলল, ” সামনে গেলেই পরবে।” ” চল । ” পিউ উৎস্যুক নেত্রে আশপাশ দেখছে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। তার ক্ষুদ্র জীবনে প্রথম বার এলো কোনও ভার্সিটি চত্বরে। একেকটা ভবন এত বিশাল,ঘুরে ঘুরে দেখতে গেলেও মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরবে। হঠাৎ তার পাশ কাটিয়ে দুটো ছেলে চলে গেল। বেখেয়ালে একজনের সঙ্গে খানিক ছুঁইছুঁই হলো পিউ। তবে শরীরে স্পর্শ লাগেনি। এর আগেই সচেতন দুরুত্বে সরে গেছে সে।
ধূসর যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতে বাড়াতেও দৃশ্যটা দেখে থেমে দাঁড়াল। ভ্রুঁ কোঁচকাল। চারপাশ দেখল সতর্ক চোখে। আশেপাশে গিজগিজ করছে ছেলেরা। কেউ কেউ এদিকেই দেখছে। তক্ষুনি ইকবাল ডাকল,
” ধূসর একটু শুনে যা।”
ধূসর তাকালে ইকবাল সাইডে আসতে ইশারা করল। মেনে নিল ধূসর। ইকবাল তার কাঁধ পেঁচিয়ে চলে এলো এক কোনায়। ফিসফিস করে অনেক কিছু বলল। হাত নেড়ে নেড়ে কত কথা বোঝানোর পর ধূসর সব শেষে মাথা নাড়ে। পিউ সেদিকে কপাল গুঁছিয়ে চেয়ে থেকে পুষ্পকে বলল, ” এরা কী বলছে বলতো!” পুষ্প চেঁতে বলল,
” তাতে আমার কী? যা মন চায় তাই বলুক। তোর মনে সুখ আছে তুই দ্যাখ। আমি বাঁচিনা আমার জ্বালায়,উনি এসছেন কে কী বলছে তা নিয়ে।’ পিউ নিজেও ভেবে দেখল কথাখানা সঠিক। তার নিজেরও উচিত বোনের দুঃখে দুঃখী হওয়া। কিন্তু হঠাৎ একটা চিন্তা টোকা দিল মস্তকে। সে কৌতুহল নিয়ে বলল, ” আচ্ছা আপু,রেজাল্ট খারাপ হলে তো স্কুল কলেজে অভিবাবক ডাকে। ইউনিভার্সিটি তে ডাকে কেন? তাহলে স্কুলের সাথে ভার্সিটির তফাৎ রইল কই?”
পুষ্প চিবুক গলদেশে ঠেকাল। চোখ খিঁচে বুজে ফের খুলল। মনে মনে বলল, ” তোকে কী করে বোঝাব,রেজাল্ট নয়, আমি শেষ চার মাস ধরে একটা ক্লাস ও করিনি বলে ডেকেছেন।” মুখে আমতা- আমতা করে বলল, ” সে আমি কী জানি! হয়ত আব্বুর পরিচিত বলেই ডেকেছেন। ” পিউয়ের যুক্তি পছন্দ হয়৷ বুঝতে পেরেছে এমন ভঙিতে মাথা দোলায়। এর মধ্যে ফিসফিসানি ইতি ঘটে ইকবালদের। দুজন এগিয়ে আসে। ইকবালের ঠোঁটের দীর্ঘ হাসি দেখে পুষ্পর গা- পিত্তি জ্বলে ওঠে। সে আছে চিন্তায়,আর এই লোকের দাঁত ক্যালানি দেখো! ধূসর কপালের পাশ চুল্কে বলল, ” পুষ্প,তুই ইকবালের সাথে যা। আমি আর পিউ এখানে থাকছি।” পুষ্প অবাক চোখে তাকালে ইকবাল বাম চোখ টিপল। ভড়কে গেল সে। পিউ ছটফটে কণ্ঠে বলল, ” কেন, আমরা যাব না ধূসর ভাই?” ” না।” পিউয়ের মুখ ছোট হয়ে আসে। ধূসর ইকবালকে বলল,” যা। কী বলে জানাস।” ইকবাল আলোড়িত কন্ঠে আওড়াল, ” আরে ভাবিস না,ওদের হেড মাস্টার যা যা বলবেন একেবারে গড়গড় করে এসে বলব তোকে।” ধূসর বলল, ” গর্দভ! হেড মাস্টার না,ডিপার্টমেন্ট হেড উনি।” ইকবাল কাঁধ নাঁচিয়ে বলল, ” ওই একই,আগেপিছে হেড তো আছে।” ধূসর হেসে বলল ” বুঝেছি, যা।” ইকবাল ভদ্র ছেলের মত পুষ্পকে রাস্তা দেখিয়ে বলল, ” চলো আপু।” পুষ্প বাধ্য মেয়ের মত হাঁটা ধরল সামনে। পেছনে পা ফেলে ইকবাল। ধূসর দাঁড়িয়ে থাকে,পাশে পিউ। তার মনটাই খারাপ হয়ে গেছে। নাঁচতে নাঁচতে এলো অথচ কিছুই শুনতে পাবেনা বলে কৃষ্ণবর্নে ছেঁয়ে গেল আনন। ঠিক তখনি ধূসর তার এক হাত মুঠোতে নেয়। পিউ চকিতে তাকায়,আশ্চর্য হয়। ধূসর শান্ত কন্ঠে বলে,
” চল,ওদিকে যাই।”

ধূসরদের ছাড়িয়ে, মোটামুটি সচেতন দুরুত্বে এসেই পুষ্প জোড়াল ঘুষি বসাল ইকবালের বাহুতে। আচমকা হামলায়,ব্যাথায় মুচড়ে উঠল সে। হাত ডলতে ডলতে বলল,
” কী হলো?”
পুষ্প কটমট করে বলল,
” আমি তোমার আপু?”
” আরে ওটাত ধূসরের সামনে বলেছি। যাতে ও সন্দেহ না করে। নাহলে আমার সন্টুমন্টুটাকে আমি আপু ডাকব কোন দুঃখে! ” পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ” চুপ করো, একটা কথাও বলোনা। তুমি একটা বাজে, স্বার্থপর লোক।” ইকবাল বিস্ময়াবহ হয়ে বলল, ” আমি আবার কী করলাম?” পুষ্প হাঁটা রেখে দাঁড়িয়ে গেল। কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, ” কী করোনি তাই বলো। এই যে আমি ক্লাস মিস দিয়েছি বলে স্যার ডেকে পাঠিয়েছেন,কার জন্যে হয়েছে এসব? ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে কার সঙ্গে ঘুরেছি আমি? কে নিয়েছে ঘুরতে? তুমিইতো! তাহলে সেই তুমি কী করে আমার বিপদে পাশে না থেকে মিরজাফর হয়ে গেলে ইকবাল? কখন থেকে বত্রিশটা দাঁত দেখিয়ে বেড়াচ্ছো, একবারও খেয়াল করেছ আমায়? বুঝেছো আমার মনের অবস্থাটা?”
সব কটা কথা পুষ্প ইমোশোনাল হয়ে বলল। অথচ ইকবাল হেসে ফেলল । হাসি দেখে পুষ্প আহত হয়। অভিমানে চোখ ভিজে আসে। ইকবাল তখন গাল টেনে আদুরে কন্ঠে বলল,
” মাই লাভ, আপনি কী সারাজীবনে বোকাই থেকে যাবেন? “
এই যে আমি মানুষটা কী মাত্রাধিক ব্যস্ততায় দিন কাটাই। এখন আবার ধূসর অফিস জয়েন করেছে, শ্বাস ফেলার ও জো নেই। অথচ সেই আমি সব কাজবাজ ফেলে আজ ছুটে এলাম। ইনিয়েবিনিয়ে আপনাদের সাথে এসেছি এ অবধি,কেন? আপনার জন্যেইতো!” পুষ্প প্রথম দফায় অবিশ্বাস্য চোখে তাকাল। পরমুহূর্তেই মুখ বেঁকিয়ে বলল,
” মিথ্যে কথা।”
” মিথ্যে নয় জানেমন,একদম দুই শতভাগ সত্যি। “
পুষ্প ভ্ররু উঁচিয়ে বলল,
” ও তাই? তা এসে কী করতেন আপনি? ধূসর ভাইতো আসতেই যাচ্ছিলেন সাথে। তারপর কী ভেবে এলেন না। যদি আসতেন? “
ইকবাল আনন্দ চিত্তে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল,
” আমি জানতাম ও আসবে না। এমন টনিক দিয়েছি ওকে। আরে শুরু থেকেই ভাবছিলাম কী বলে ওর আসা আটকাব আর আমি যাব তোমার সাথে। এখানে এসে এমন জব্বর উপায় পেয়েছি না!”
” কী উপায়?”
পুষ্পর আগ্রহ দেখে ইকবাল চমৎকার হেসে বলল,
” পরে বলব মাই লাভ,চলো আগের কাজ আগে সাড়ি।”
পুষ্প মাথা দোলায়। দুজনে হেঁটে এসে থামে নির্দিষ্ট কামড়ার সামনে। পুষ্প বিনয়ী হয়ে প্রশ্ন পাঠায়,
” উড আই গেট ইন স্যার?”

পিউ ক্ষনে ক্ষনে ধূসরের ধরে রাখা হাতের দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিবারই লজ্জ্বায় আড়ষ্ট হচ্ছে। হচ্ছে লাল- নীল। মুচকি হেসে নিজেই মাথা নোয়াচ্ছে। তুলছে আবার। ধূসর সুদৃঢ় হস্তে ধরেছে,যেন পিউ আসামী। ছাড়লেই পালাবে। তবু পিউয়ের এতেই শান্তি। তার ধূসর ভাই ধরেছেতো, ছুঁয়েছে তাকে। এই হাত পারলে সে আলমারিতে তুলে রাখতো। ভরে রাখত সিন্দুকে। তবে হ্যাঁ, আপাতত এক সপ্তাহ এই হাতখানা কাউকে ছুঁতেই দেবেনা। ধূসরের স্পর্শ মুছে যাবে যে। পিউয়ের কত দিনের স্বপ্ন,ধূসরের হাত ধরে আকাশ দেখবে। হাঁটবে সুদীর্ঘ পথ। সেই স্বপ্ন পূরন,কোনও না কোনও ভাবে হচ্ছে তো আজ । এই যে হাঁটছে। দেখছে মাথার ওপর খোলা সাদা আকাশ।
কিছুটা পথ হেঁটে এসে ধূসর ক্যান্টিনের সামনে থামল। পিউ কৌতুহলি হয়ে বলল,
” আমরা কি এখন খাব ধূসর ভাই?”
ধূসর তাকাল, ” খিদে পেয়েছে তোর?”
পিউ ফটাফট দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল ‘ না’।
এর মধ্যে ধূসরের ফোন বাজে। অন্য হাতেই ছিল। ধূসর রিসিভ করল৷ কথা বলায় ব্যস্ত হলো। সময় এগোচ্ছে। ওদিকে পুষ্প আর ইকবালের দেখা নেই। এদিকে ধূসরের কথা শেষ হওয়ার নাম নেই।
পিউ মহাবিরক্ত হয়ে পরল। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অসহ্য সে। ধূসর গুরুতর বিষয় নিয়ে আলাপে মত্ত। রাজনৈতিক ব্যাপার স্যাপার। পিউয়ের মোটা মগজে ওসব ঢুকলোনা। সে ঘাড় চুল্কে ‘চ’ বর্গীয় শব্দ করল। ধূসর তখন এমন ভাবে বলেছিল ” চল ওদিকে যাই।” পিউ ধরেই নিল স্বর্গে যাচ্ছে । কিন্তু সে এসে দাঁড় করাল এখানে।
পিউ আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,
” ভেতরে গিয়ে বসব?”
ধূসর কথার এক ফাঁকে জবাব দিল ” না।”
পিউ ওষ্ঠ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে। এখানেই কী দাঁড়িয়ে থাকবে তবে? ভেতরে গিয়ে বসলে কী হয়?
ধূসর ফোন নামাল কান থেকে। উশখুশ করতে থাকা পিউকে দেখে বলল,
” কোনও সমস্যা?”
পিউ এবারেও মাথা নাড়ল। ধূসর চোখ ছোট করে বলল,
” তোর মুখ নেই পিউ? বোবা তুই?”
” বোবা হলে বুঝি খুশি হতেন?”
ধূসরের বিরক্তি নিয়ে বলল,
” এসব আজগুবি কথাবার্তা কোত্থেকে আমদানি করিস? “
পিউ নিষ্পাপ চাউনিতে তাকাল। যেন ভাজা মাছ উলটে খেতে জানেনা। কিছুক্ষন পর,ধূসর নরম কন্ঠে শুধাল,
” চা খাবি?”
পিউ চটপট সামনে পেছনে মাথা দোলায়। খাবে সে। ধূসর ভাইয়ের সাথে চা খাওয়ার এই দারুন মুহুর্ত কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবেনা। এতক্ষনে ধূসর হাত ছোটাল।
ক্যান্টিনের কাছে গিয়ে বলল চা দিতে। পেছন থেকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল পিউ। ঠোঁটের সবদিক জুড়ে হাসি বিস্তৃত। ধূসরের চওড়া কাঁধ,যে কোনও রঙের শার্ট ফুটে ওঠে পড়নে। দেখলে তার অক্ষিদ্বয় জুড়িয়ে আসে, শীতল হয়। তার হুশ,লাজলজ্জা কেড়ে নেয়া মানুষটা কবে একান্ত ওরই হবে! কেউ যদি একটু বলে দিত এসে। সেই আগন্তুকের পায়ে জান লুটিয়ে দিত পিউ।
দেখতে দেখতে ধূসর চা নিয়ে এলো। ওয়ান টাইম কাপে উষ্ণ চা ধোঁয়া ছাড়ছে। কাছাকাছি আসতেই পিউ হাত বাড়াল ধরতে। ধূসর দিলোনা। হাস্যহীন চেহারায় বলল,
” অনেক গরম,হাত পুড়বে। একটু ঠান্ডা হোক,তারপর নিস।”
পিউয়ের অন্তঃস্থল তৃপ্ত হয়ে আসে। ধূসরের এই সামান্য যত্ন টুকু তার কাছে ঠিক কী,কেউ বুঝবেনা। একদমইনা। সে চোখ নামিয়ে লাজুক হাসে।
ক্ষানিকক্ষন বাদে, ধূসর কাপের চারপাশে আঙুল ছোঁয়াল। পরীক্ষা করল কতটা কী গরম। বুঝেশুনে পিউকে বলল, ” নে ধর।” পিউ মোহিত লোচনে চেয়েছিল ওর দিকে। কথাটায় নড়েচড়ে উঠে বলল ” হু? কিছু বললেন?” ধূসর ভ্রুঁ বাঁকাল, ” মার খাবি?”
পিউ তৎপর ঘনঘন মাথা ঝাকিয়ে বলল
” না না। “
” তাহলে ধর!”
পিউয়ের গোলগাল চেহারা ফের সংকীর্ন হয়। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে চুমুক বসায়। ওমনি ছ্যাঁকা লাগে জ্বিভে। ” আহ” বলে ঠোঁট চেপে ধরে। ধূসর অসহায় চোখে তাকাল।
” তুই কী কোনও দিন ঠিক হবিনা পিউ? হাত যাতে না পুড়িস সেজন্যে এতক্ষন কাপটা দিইনি,অথচ জ্বিভ ঠিকই পুড়লি।”
পিউ নিজের প্রতি নিষ্পৃহায় শ্বাস ফেলল। সে ঠিক কী করে হবে? প্রেমে পড়লে ঠিকঠাক থাকা কোন প্রেমিকার সাধ্যি? যা ভয়ঙ্কর প্রেমলীলায় মেতেছে গত তিন বছর যাবৎ,পাগল হয়নি সেই বেশি।


পিউ আরেকদিক চেয়ে চেয়ে চা খাচ্ছে। হঠাৎই মনে পড়ল ধূসর ভাইতো চা নেয়নি। একটা কাপইতো আনলেন।
চটজলদি ফিরে তাকাল জিজ্ঞেস করবে বলে। কিন্তু ধূসর পাশে নেই। পিউ ডানে বামে দেখে সামনে তাকাতেই’ থ ‘বনে গেল বিস্ময়ে। তার প্রিয় ধূসর ভাই লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছেন। পিউ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। বাম হাত দিয়ে কচলে আবার তাকাল। তখনও স্পষ্ট ভাবে দেখল ধূসর সিগারেট টানছে। রীতিমতো নাক মুখ দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে তার। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল পিউ। আর্তনাদ করে বলে,
” একী! ধূসর ভাই আপনি সিগারেট খান?”
পিউ যতটা উদ্বোলিত,ধূসর ততটাই নিরুত্তাপ। ধীরস্থির জবাব দেয় ,
” হ্যাঁ কেন? তোর কোনও সমস্যা?”
পিউ উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। তার মন তিঁমিরে তলিয়ে। যে সিগারেট তার দু চোখের বিষ,জন্মের পর বাপ চাচা কাউকে ছুঁতেও দেখেনি। সেই সিগারেট কী না, ধূসর এইভাবে টানছে? পিউয়ের অন্তকরনের পরতে পরতে ধেঁয়ে গেল মন খারাপের স্রোত। ধূসর হঠাৎই ডেকে ওঠে, ” পিউ!” হিমশীতল আওয়াজ। পিউ তাকাল,ধূসর আরেকদফা ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, ” তোর আঠের বছর হবে কবে?” ” যেদিন জন্মদিন, সেদিন,তাইনা পিউ?” পেছন থেকে উচ্ছ্বসিত উত্তর দিতে দিতে এসে দাঁড়াল ইকবাল। পেছনে বিড়াল ছানার মত পিলপিলে পুষ্প। তার চেহারায় তখনও ভয় স্পষ্ট। ধূসর সিগারেট ফেলে জুতো দিয়ে পিষে দেয়। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, ” কী বলল?” ইকবাল গা ঝাড়া ভঙিতে বলল, ” আরে তেমন কিছুনা। পুষ্পর একবার জ্বর হয়েছিল না কী? মারাত্বক, ভয়াবহ জ্বর? ধূসর ক্ষনশ্বর ভেবে বলল, ” হ্যাঁ। ” ” তখন তো ও ক্লাশ এটেন্ড করতে পারেনি। তাই পার্সেন্টেজ কম এসেছে কিছুটা। সে নিয়েই কথা বলেছেন।” ধূসর সন্দেহী কন্ঠে বলল ” এতটুকু বলতে অভিবাবক ডাকবে কেন?” পুষ্প আতঙ্কে গুঁটিয়ে গেছে। ইকবাল যা বলছে ঘটনার আগামাথা মিল নেই। ডিপার্টমেন্ট হেড উলটে কড়া কন্ঠে হুশিয়ারী দিয়েছেন ওকে। চল্লিশ পার্সেন্টের ও কম উপস্থিতি হলে পরবর্তী পরীক্ষায় বসতে দেবেন না জানিয়েছেন। লোকটা আমজাদ সিকদারের পরিচিত। কী করে, কীভাবে পুষ্প জানেনা। আর পরিচিত বলেই সরাসরি এ্যাকশন না নিয়ে আগে অভিবাবক ডেকেছেন তিনি। নাহলে এ ধরনের ঝামেলায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসতে জান বেরিয়ে যায়। ঝড় যা গেছে ইকবালের ওপর দিয়ে। ধূসরের পরিচয় দিয়েছে সে। আমজাদ সিকদার বলে রেখেছিলেন তো, ” ভাইয়ের ছেলেকে পাঠাবেন।” সে সুযোগটাই লুফে নিয়েছে দুজন। আর এখন বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যেও বলছে। ভাগ্যিশ গত মাসের শেষে দিকে জ্বরটা বাধিয়েছিল। কী বলতো নাহলে এখন?
ধূসরের কথায় ইকবাল তৎক্ষনাৎ উত্তর দিতে পারেনা। কথা খোঁজার ছুঁতোয় দাঁত বের করে হেহে করে হাসল। ধূসর চোখ গুছিয়ে বলল,
” গাঁধার মতো হাসছিস কেন?”
” তুই গাঁধাকে হাসতে দেখেছিস কখনও? “
” না,গাঁধাকে দেখিনি,তোকে দেখেছি।”
ইকবালের হাসি দপ করে নিভে গেল। পুষ্প ঠোঁট চেপে আরেকদিক চেয়ে হাসল।
ধূসর একটু চুপ থেকে বলল,
” আমি নিজে একবার কথা বলে আসি। এই সামান্য কারনে অভিবাবক ডাকার মত কারন পাচ্ছিনা।”
পুষ্পর হাসি বন্ধ৷ ধূসর যাবে শুনতেই আঁতকে উঠল শঙ্কায়। ধূসর পা বাড়ানো মাত্রই ইকবাল লাফিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল। ” তুই আমায় বিশ্বাস করিস না ধূসর?” ধূসর মুখের ওপর বলল ” না ” ইকবাল দুই ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল, ” এই তোর বন্ধুত্ব ধূসর! এই আমি তোর ছোট বেলার বন্ধু? এই তুই আমাকে ভালোবাসিস? আজ বুঝলাম,যাকে বিশ্বাসই করিস না তাকে আর কীসের ভালোবাসা,কীসের বন্ধুত্ব। ঠিক আছে,যা,যাচাই করে আয় আমি সত্যি বলেছি না মিথ্যে। তারপর এসে আমার গর্দান ছেদ করিস ওকে?”
পুষ্প আবেগে গলেগলে পরল। ইকবালের কথায় তার চোখ ভরে আসে প্রায়। মানুষটা কী কষ্টই না করছে ওর জন্যে। ইকবাল মারাত্মক মুখভঙি তে কথাগুলো বলল। আরেদিক তাকাল অভিমান করে। ধূসর ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলে বলল,
” গাড়ি নিয়ে আসি,দাঁড়া।”
ধূসর চলে যায়। পুষ্পর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে আসে। বিজয়ের হাসি হেসে ইকবালের পানে তাকায়। ইকবাল চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করে। পুষ্প বুক ভরে শ্বাস টানে। যাক,বাঁচা গেল। তারপর খেয়াল পরে সামনে দাঁড়ানো পিউকে। পুষ্প কপাল গুঁটিয়ে বলল,
” এই পিউ, ওখানে কী করছিস,এদিকে আয়।”
পিউ নড়েচড়ে ওঠে। যেন ধ্যানে ছিল এমন। মাথা নামিয়ে এগিয়ে আসে। ইকবাল আনন্দ সমেত শুধায়,
” কী ব্যাপার পিউপিউ,কী ভাবছিলে এত?”
পিউ হাসার চেষ্টা করে দুপাশে মাথা নাড়ে। এর মধ্যে ধূসর হাজির হয় গাড়ি নিয়ে৷ উঠে বসে ওরা।
আসার সময় সারা পথে পুষ্প গোমড়া মুখে ছিল।সে এবার প্রফুল্ল চিত্তে, অথচ উলটে গেল পিউ। চুপচাপ জানলার দিক চেয়ে বসে আছে। জানলা খোলা,হুহু করে হাওয়া আসছে ভেতরে। পিউ ক্ষনে ক্ষনে দীর্ঘকায় শ্বাস ফেলছে । ধূসর সিগারেট খায়,বিষয়টা জেনে একটুও ভালো লাগছেনা। কেন সব বদভ্যেস তার ওই মানুষের মাঝেই থাকতে হবে? ধূমপান করে কতশত রোগ হয়,সে কি জানেনা?
” হাত সরা পিউ।”
গুরুগম্ভীর স্বরে পিউ হুশে এলো। জানলা থেকে হাত বাইরে ঝুলিয়ে বসেছিল। ধূসর বলতেই চট করে ভেতরে আনল। তাকাল ভিউ মিররের দিকে। ধূসরের চোখ সামনে, তাহলে বুঝল কী করে তার হাত কোথায় ছিল?
ইকবাল হঠাৎই বলল ” তুমি এত চুপ করে গেলে কেন পিউপিউ?’
পুষ্প শুধাল, ” তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?” ” না,ঠিক আছি আমি।’ ওদের ফিরতে প্রায় বিকেল গড়িয়েছে। রাস্তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য স্ট্রিট ফুডের ভ্যান। পুষ্পর আগে থেকেই যা ভীষণ পছন্দ। জ্বিভে জ্বল চলে এলো দেখে দেখে। কিন্তু ধূসরকে বললে কোনও দিন খেতে দেবেনা এসব৷ বলবে অস্বাস্থ্যকর, অপরিষ্কার। কিন্তু আইসক্রিমের ভ্যান দেখে পুষ্প আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। গাড়ির মধ্যে থেকেই চেঁচিয়ে উঠল,
” ভাইয়া আইসক্রিম খাব।”
ধূসর স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
” এই ঠান্ডায়? “
” কিচ্ছু হবে না ভাইয়া। প্লিজ, আমার খেতে মন চাইছে খুব। ও ভাইয়া আমি আপনার সব কথা শুনিনা? সেই ভদ্রতার খাতিরে তো একটা আইসক্রিম পেতেই পারি।”
ইকবাল ও সায় দিয়ে বলল, ” একটা আইসস্ক্রিম তো বন্ধু। থামা না গাড়িটা।”
ধূসর হার মানল। ব্রেক কষল রাস্তার একপাশে নিয়ে। ইকবাল আগে আগে নেমে গেল৷ বলল ‘আমি নিয়ে আসছি। ” পুষ্পও নেমে গেল গাড়ি থেকে। পরপর ধূসর,আস্তেধীরে নামল পিউ। সে গিয়ে এক কোনে দাঁড়াল রাস্তার। ধূসর আড়চোখে পিউকে দেখতে দেখতে ফোন বার করে পকেট থেকে। ইকবাল দুহাতে দুটো আইসক্রিম এনে ধূসরকে বলল, ” ভাংতি আছে রে ধূসর? আমার কাছে আস্ত নোট, নিচ্ছেনা।” ” আমি দিচ্ছি।” ধূসর ভ্যানের দিকে এগিয়ে যায়। ইকবাল ওর যাওয়া দেখে চোখ সরিয়ে পুষ্পর দিক তাকায়। আইসক্রিম বাড়িয়ে বলে, ‘ নাও,তোমার ফেব্রেট ম্যাংগো ফ্লেভার।” পুষ্প গদগদ হয়ে বলল ” থ্যাংক ইউ।” ইকবাল হাসল। পিউয়ের দিকে চোখ পড়লে বলল, ” ওর হঠাৎ কী হয়েছে বলোত?” ” জানিনা, বুঝতে পারছিনা।” ” দাঁড়াও ওকে আইসক্রিম টা দিয়ে আসি।” ইকবাল পিউয়ের কাছে গিয়েই শুধাল, ” তোমার কী মন খারাপ পিউ?”
পিউ মৃদূ কণ্ঠে বলল,
” না তো ভাইয়া।”
” তাহলে চুপ করে কেন,তুমিতো এমন নও।”
পিউ অল্প হাসে। ইকবাল জোর করল
” কী হয়েছে আমাকে বলো। ধূসর কিছু বলেছে? “
” না,না।”
ইকবাল মেকি চোখ রাঙিয়ে বলল, ” বলবেনা আমায়?” পিউ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আচ্ছা ভাইয়া,উনি সিগারেট কবে থেকে খান?’ ” কে ধূসর?” ” হু।” ইকবাল আকাশ থেকে পরে বলল, ” কই,ধূসরতো এসব খায়না।” ” আপনি বন্ধুর হয়ে মিথ্যে বলছেন,আমি নিজে খেতে দেখেছি।” ইকবাল কিছু একটা ভেবে বলল, ” তোমার বুঝি স্মোকিং পছন্দ না?” ” একটুওনা। আচ্ছা,উনি কি ড্রিংকও করেন? ” পিউয়ের কাতর কণ্ঠ। ইকবাল বুঝে উঠল না কী বলবে। তার জানামতে ধূসর তো এসব হাবিজাবি ছুঁয়েও দেখেনা। সে নিজে কতবার সেধেছে,তাও ধরেনি। তাহলে আজ হঠাৎ! ইকবালের মাথায় ঢুকলনা কিছু। এই ধূসরটা যে কী করতে চাইছে কে জানে! তবুও পিউয়ের মন ভালো করা জরুরি। তাই বলল, ” তুমি আমায় বিশ্বাস করছোনা পিউ? ধূসর কিন্তু সত্যিই এসব খায়না।” পিউ বড় করে দম ফেলল। একটু দূরের কালো কুকুরটাকে দেখে দুষ্টুমি করে বলল, ” আচ্ছা,ওকে বলতে বলুন,ও যদি বলে যে ধূসর ভাই এসব খায়না,তবেই মেনে নেব।” ইকবাল তব্দা খেয়ে বলল, ” এ্যা?” পিউ মিটিমিটি হাসল। ইকবাল ওর মন ঘোরাতে কুকুরটার দিকে চেয়ে আইসক্রিম দেখিয়ে বলল, ” কী পিউয়ের বন্ধু, খাবে?” পিউ প্রতিবাদ করবে এর আগেই কুকুরটা খাবার দেখে ঘেউ করে উঠল। ওটা যে বরফখণ্ড,খেতে পারবেনা সে কী আর প্রানীটা বোঝে! পিউয়ের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। ভয়ার্ত নেত্রে কুকুরটার দিক তাকাল। রীতিমতো বসা থেকে উঠে আসছে ওটা। এই কুকুরে পিউয়ের ভীষণ ভয়। কামড়ে দিলেই চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন। যেখানে একশ হাত দূরে কুকুর দেখলেও কাঁপে, সেখানে এগিয়ে আসতে দেখে পিউয়ের ঘাম ছুটে যায়। মোটামুটি
কাছে আসা মাত্রই পিউ চিৎকার ছুড়ল,
” আয়ায়ায়ায়া”
পরপর প্রবল বেগে ছুটল লাগাল। ওকে দৌড়াতে দেখে পেছন পেছন কুকুরটাও ছুটল। পরপর ঘটনা গুলোয় আহাম্মক বনে গেল ইকবাল। পিউ যেদিক দুচোখ যায় ছুটছে, সাথে গলা ফাটিয়ে ডাকছে, ” ধূসর ভাই, আয়ায়া আপু,আয়ায়া ধূসর ভাই…. ” পিউয়ের গলা শুনে বিদ্যুৎ বেগে ফিরে তাকাল ধূসর। ওকে এভাবে নাকমুখে ছুটতে দেখে তাজ্জব হলো। পরপর খেয়াল পরল পেছনে ধাওয়া করা কুকুরের দিকে।
” ও শীট!”
এবার একিরকম ছুট লাগাল সেও। ইকবাল,পুষ্প সব ছুটছে। আশেপাশের গুটিকতক মানুষ দেখছে তাদের ছোটাছুটি । ধূসর ছুটতে ছুটতে সাবধান করছে ” পিউ দাঁড়া,পিউ ছুটিস না। পিউ শোন….” পিউয়ের কানে একটা কথাও ঢুকলনা৷ সে পেছন ফিরে একবার কুকুরটাকে দেখে, আর দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছোটা কালো কুকুর দেখে তার প্রান ওষ্ঠাগত। উল্টোপথ থেকে রিক্সা আসছিল। পিউ বেখেয়ালে ছুটতে গিয়ে ধাক্কা লাগে তাতে । হুমড়ি খেয়ে পরে রাস্তায়। রিক্সার সামনের চাকা উঠে যায় পায়ের ওপর। ধূসর দেখতেই চেঁচিয়ে ওঠে,
” পিউ! “
ইকবাল ঢিল ছুড়ল কুকুরের গায়ে। লেজ তুলে পালাল সেটা। পিউ পা চেপে বসে পরেছে। রিক্সাচালক ভয় পেলেন। পাব্লিকের গণধোলাইয়ের থেকে বাঁচতে তাড়াহুড়ো করে রিক্সা সমেত ভেগে গেলেন। পিউ কেঁদে ফেলল ব্যাথায়। রক্ত পরছে আঙুল দিয়ে। ধূসর হাওয়ার বেগে ছুটে এসে হাটুমুড়ে বসল। উদ্বিগ্ন হয়ে,হাঁসফাঁস করে বলল,
” কোথায় লেগেছে? এখানে? ব্যাথা করছে খুব? ও গড! কতবার বলেছি কুকুর দেখলে দৌড়াবিনা? ” পিউ নাক টানল। ধূসর আহত পা হাতে তুলে করুন চোখে চেয়ে রইল। পকেট থেকে রুমাল বের করে চেপে ধরল ক্ষততে। ইকবাল এসে সেও বসে পরল পাশে।
” শুধু শুধু কেন ছুটতে গেলে?তুমি না ছুটলে ওতো তোমাকে তাড়া করতোনা। “
পিউ কেঁদে কেঁদে বলল,
” আমি কী করব ভাইয়া, কুকুর দেখলে আমার পা ঠিক থাকেনা আপনা আপনি ছোটে।”
ধূসরের মেজাজ খারাপ হলো। কষে এক ধমক দিল, ” চুপপ। ” পিউ চুপসে গেল। এই অবস্থায়ও ধূসর ভাই ধমকাচ্ছেন তাকে? কী নিষ্ঠুর! নির্মম!
এতক্ষনে পৌছাতে পারল পুষ্প। পিছিয়ে ছিল সে। বোনের পা থেকে রক্ত বের হতে দেখেই তার মাথা ঘুরে আসে। এমনিতেই কাটাছেঁড়া দেখতে পারেনা। তাও কোনও রকম তাকাল পিউয়ের কান্নারত চেহারায়৷ পিউকে কাঁদতে দেখে সেও কেঁদে ফেলল। এদিকে নাকের জল চোখের জল এক হয়ে গেছে পিউয়ের। ধূসর কেটে যাওয়া আঙুল শক্ত করে চেপে ধরেছে। তারপর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ” গাড়িতে ফার্স্ট এইড বক্স আছেনা ইকবাল?” ” আছে, আছে।” ” বের কর।” ইকবাল উঠে গেল। ধূসর পুষ্পর ফ্যাঁচফ্যাঁচ কান্নায় বিরক্ত হয়ে বলল,
” তুই কাঁদছিস কেন?” পুষ্প ওড়না নিয়ে নাক মুছে বলল ” ওরতো ব্যাথা করছে ভাইয়া।”
ধূসর অতিষ্টতায় মাথা নাড়ল।
পিউ ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছিল। আচমকা ধূসর কোলে তুলল তাকে। হকচকিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল পিউ। পুরো বিষয়টা মাথায় ঢুকতেই, কান্নাকাটি বন্ধ,ব্যাথা শেষ। পিউ বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসে প্রায়। বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে ধূসরের পানে তাকায়। ধূসর ভাই তাকে কোলে তুলেছেন? এ কি সত্যি না কী কল্পনা? পিউকে দুহাতে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা ধরল ধূসর। পেছনে পা মেলাতে মেলাতে আসছে পুষ্প। পথে বোনকে সান্ত্বনা দিচ্ছে ” কিছু হবেনা, কমে যাবে।” পিউয়ের ওসবে মনোযোগ নেই। সে অবাক লোচনে ধূসরের শ্যামলা চেহারায় চেয়ে থাকতে ব্যস্ত। হাঁটার মধ্যেই ধূসর ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে। পিউয়ের ডাগর ডাগর চোখের দিকে তাকায়। নিরেট স্বরে বলে, ” এত জ্বালাস কেন আমায়?”
চলবে,

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *