পর্ব- ০১
লেখিকা: মিফতা তিমু
————————-
এক টানা কানের কাছে একই গান শুনতে শুনতে শেষমেশ বাধ্য হয়েই চোখ জোড়া খুললো বিনী। এখন ভর দুপুর বলে সে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু তার এত শান্তি কি আর তার বোনের সহ্য হয় ? তাইতো ওর সাধের ঘুম নষ্ট করতে চলে এলো। তারই প্রস্তুতি স্বরূপ এতক্ষণ কানের কাছে একই গান গাইছিল। সে ভালো করেই জানে বিনী গান বাজনা দুই চক্ষে দেখতে পারেনা তবুও বিনীকে জ্বালাতে সে গানই ধরেছে।
বিরক্তিতে নাক মুখ কুচকে আসফিয়ার দিকে তাকিয়ে বিনী বললো ‘ আফু তোর কোন পাকা ধানে আমি মই দিয়েছি বলতো ? কেন আমার সাধের ঘুমটা নষ্ট করছিস বলতো ? একটু ঘুমোতে দে না… আবার কবে না কবে এমন দুপুরে ঘুমাতে পারবো খোদা জানে। তোরা তো আছিসই আমাকে কখন বিয়ে দিয়ে বিদায় করবি এই সুযোগে। ধুর সর… আমি ঘুমাবো। ‘
কথাগুলো বলেই বিনী বালিশের নরম গায়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বুজে নিলো। কিন্তু তার আর সাধ করে ঘুমানো হলো না কারণ পাশ থেকে আসফিয়া তাকে ঠেলছে। বিনী বেশ বিরক্ত হলো কিন্তু জবাব দিল না। আসফিয়া ওকে ঠেলতে ঠেলতে বললো ‘ এই আপা উঠ না… মা ডাকছে তোকে। বলেছে উঠে একটু মুখে চন্দন পাউডার দিয়ে ফেস প্যাক দিতে। এখন দিলে নাকি সন্ধ্যার সময় মুখ ঝলমল করবে। ‘
বিনী ভেবেছিল একটু প্রতিবাদ করবে কিন্তু যখন শুনলো মা ডেকেছে তখন আর কিছু বললো না। বিছানা ছেড়ে নেমে গেলো। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে গিয়ে ছোট বাটিতে করে চন্দন পাউডারের তৈরি ফেসপ্যাক এনে ঘরের মেঝেতে বসলো। হাতে আলতো করে নিয়ে মুখে লাগাতে লাগাতে আসফিয়াকে বলল ‘ তুই লাগাবি নাকি ? ‘
‘ হুম লাগাবো তো… আজকে তো লাগানো মাস্ট। এই আপা শুনেছি সন্ধ্যায় নাকি দুলাভাইয়ের চাচাতো ভাই বোনেরাসহ অনেকেই আসবে। তুই জানিস কে কে আসবে ? ‘ আসফিয়া মুখে ফেস প্যাক লাগাতে লাগাতে বললো।
‘ উহু…আমি কি করে জানবো ? আমি তো তোদের প্রিয় দুলাভাইকেই দেখলাম না আবার তার কোন ভাই বোন আসবে সেটা কি করে জানবো ? ‘ বিনী বললো।
‘ এই আপা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো ? সত্যি করে বলবি তো ? ‘ আসফিয়া দুষ্টু হেসে বললো।
‘ তোকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ বলতো ? এত ভনিতা না করে পেটে যা আছে উগড়ে দে। শুনি তোর বিশেষ কথা। ‘
‘ আপা সত্যি করে বলতো তোর দুলাভাইকে দেখতে ইচ্ছা করে না ? তুই তো উনার নামটাও জানিস না। তোর কি একটুও ইচ্ছা করেনা তার নাম জানতে, তাকে দেখতে ? ‘ আসফিয়া জিজ্ঞেস করলো।
‘ নাহ্ দেখতে ইচ্ছা করবে কেন ? আজই তো উনার সঙ্গে বিয়ে হবে। তারপর বাসর রাতে তো এমনিতেই দেখতে পারবো। আমি তোর মতো এত বিয়ে পাগল না। আমার শখ নেই কাউকে দেখার বা নাম জানার। আমি নিতান্তই ভদ্র মেয়ে। ‘
‘ ধুস ওটা বলিনি… তোদের বিয়ের কথাবার্তা তো এক মাস ধরে চলে। এক মাস কি তোর কম মনে হয় ? সেই কবে থেকে দেখছি বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত তুই দুলাভাইয়ের নাম জানতে কিংবা তাকে দেখতে চাসনি। আচ্ছা তুই এমন অদ্ভুত কেন ? তোর কি ইচ্ছা করে না দুলাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে প্রেম করতে ? তোর জায়গায় আমি হলে প্রেম অবশ্যই করতাম। জানিস আপা আমি ঠিক করেছি যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে তার সঙ্গে আমি বিয়ের আগে পুরো এক মাস প্রেম করবো। তারপর বিয়ে করবো… এই আজ তো তোর চাচাতো দেবর আসছে। তার সাথে প্রেম করলে কেমন হয় ? ‘ আসফিয়া তার দুই বেনি দুলাতে দুলাতে বললো।
আসফিয়ার কথা শুনে প্রথমে বিনী কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত রইলো তবে একটু পরেই ধীর স্বরে বলল ‘ আচ্ছা আফু আমি যদি এখন হুট করে বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে যাই তখন কি হবে ? বাবা কি মান সম্মান বাঁচাতে আমার জন্য তার ঠিক করা পাত্রের সঙ্গে তোর বিয়ে দিবে ? ‘
বিনীর কথায় আসফিয়ার চোখে মুখে এতক্ষণ বোনের বিয়ে নামক যেই আনন্দ ছিল তা ক্ষনিকেই কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। তার পরিবর্তে চেহারায় এসে ভিড় করলো এক রাশ ভীতি। সে ভীত গলায় বলল ‘ আপা তুই এসব কি বলছিস ? পালিয়ে যাবি মানে ? কেন পালাবি ? ‘
আসফিয়ার কথায় বিনী বাটি গুছাতে গুছাতে বললো ‘ মজা করছিলাম… ভাবলাম তোকে চমকে দেই। তুই চমকে গেছিস না ? ‘
‘ এভাবে কেউ মজা করে আপা ? আমি ভাবলাম বাবা জোর করে তোর বিয়ে দিচ্ছে আর তোর এই বিয়েতে মত নেই। ‘ আসফিয়া সঙ্গে সঙ্গে হেসে দিয়ে কথাটা বলল।
‘ বাবা আমাকে আমার মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিবে না এটা তোর জানার কথা তাইনা ? তোর দুলাভাইয়ের পরিবার কেমন জানিস ? ‘ বিনী তার কাজে ব্যস্ত থেকেই বললো।
‘ বাহ্ এতদিন পর বিয়ের দিন বিকেলে জিজ্ঞেস করছিস শশুর বাড়ি নিয়ে। আমি ভাবলাম তুই একবারে শশুর বাড়ি উঠেই সবার সঙ্গে আলাপ করবি। আমি তেমন কিছু জানিনা তবে কিছু কিছু জিনিস জানি তোর হবু বর সম্পর্কে। বলবো ? ‘ আসফিয়া দুষ্টু হেসে বললো।
‘ বলতে পারলে বল… সম্পূর্ণ তোর ইচ্ছা। ‘
‘ দুলাভাইয়ের নাম আবির হাসান। উনারা সবাই যৌথ পরিবারে থাকেন। উনার এক চাচা, তার পরিবার, ভাইয়ার বড় ভাই,তার বউ বাচ্চা এবং উনিসহ উনার মা বাবা। উনার মা শাহিদা আন্টি একটু গম্ভীর এবং অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। ‘
‘ ভালো ‘ এক বাক্যে কথাটা বললো বিনী।
‘ ভালো বলছিস তুই ? এখানে ভালোর কি দেখলি ? বাবা যে বেছে বেছে যৌথ পরিবারে তোর বিয়ে ঠিক করবে এটা কে জানত। এই ব্যাপারে মাও জানতো না। আজ সকালেই জানতে পারলো। জেনেই সে রেগে এক চোট। বাবাকে অনেক কড়া কথা শুনিয়েছে। আর বাবা নিরীহ মুখে কেবল বললো কথাবার্তা তো সব ঠিক করে ফেলেছে, বিয়ের তারিখও চলে এসেছে। এখন কিছু বললে মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। অথচ তুই ভালো বলছিস। তুই না ছোট থেকে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বিয়ের বিরুদ্ধে ছিলি ? ‘ আসফিয়া আরক্ত মুখে বললো।
‘ কপালে যা থাকবে তাইতো মেনে নিতে হবে। ভাগ্যের লিখন কি খন্ডানো যায় ? আমার ভাগ্যে জয়েন্ট ফ্যামিলি আছে তাই ওই পরিবারে বিয়ে হচ্ছে। এখানে আমার ভালো বলা ছাড়া আর কিছু করার উপায় আছে ? আফসোস করলে যদি লাভ হতো তাহলে নাহয় আফসোস করতাম। আফসোস করলে যখন কাজে দিবে না তখন শুধু শুধু করে লাভ কি ? ‘ কথাগুলো বলে বিনী হাতের ফেস প্যাকের বাটিটা টি টেবিলের উপর রেখে মুখ ধুতে গেলো।
বিনী যখন মুখ ধোয়ায় ব্যস্ত তখনই ঘরে সালমা ইসলাম ঢুকলেন। মেয়েকে মুখ ধুতে দেখে বললেন ‘ বিনী তোর কি মুখ ধোয়া শেষ ? ‘
বিনী মুখটা ধুয়ে বাথরুমের স্ট্যান্ড থেকে সাদা ফকফকে টাওয়েলটা নিয়ে তাতে মুখ মুছে বললো ‘ হ্যাঁ শেষ… কিছু বলবে ? ‘
সালমা ইসলাম মেয়ের কথায় মেয়ের হাতে মেহেদীর টিউব ধরিয়ে দিয়ে বললেন ‘ চট করে মেহেদীটা হাতে দিয়ে ফেলতো দেখি। বিয়ের কনে তুই। হাতে মেহেদীর রং না থাকলে আত্মীয় স্বজন অনেক কথা বলবে। আফি তোর আপার হাতের এক কোণায় তোর দুলাভাইয়ের নামটা লিখে দিস তো। তোর দুলাভাইয়ের নামে মেহেদী দিলে মেহেদীর রং ভালো হবে । ‘
‘ মা তুমি এখনও এসব বিশ্বাস করো ? কোন মান্দাতার আমলে বাবার নামে মেহেদী পড়েছিলে আর তখন মেহেদীর রং ভালো এসেছিল বলে এখনও সেই ধারণা নিয়ে বসে আছো। এসব কুসংস্কারকে পাত্তা দিও না মা। ‘ আসফিয়া উঠে এসে বললো।
‘ এত কথা না বলে মা যেটা বলেছে সেটা কর। আমি মেহেদী দেওয়া শেষে তোর দুলাভাইয়ের নামটা লিখে দিবি। তাহলে তোর কাজ শেষ। আমি বাড়তি কথা চাচ্ছি না। ‘ বিনী মেহেদীর টিউবটা ছিদ্র করতে করতে বললো।
‘ হ্যাঁ তোর আপা যা বলছে তাই কর আফি। এত কথা বলিস না। আর কি যেন বলতে এলাম ? ওহ হ্যাঁ বিনী এই পাঁচশো টাকাটা নে… বিয়ের পরে এটা দিয়ে নিজের পছন্দ মতো কিছু কিনিস। নে তুই মেহেদী দিতে বস আর আমি তোর লাগেজটা গোছাচ্ছি। ‘ বলে সালমা ইসলাম বিনীর হাতে পাঁচশো টাকার নোটটা গুঁজে দিয়ে লাগেজ বের করতে গেলেন।
বিনী হাতে থাকা পাঁচশো টাকার নোটের দিকে তাকিয়ে আছে। আজকালকার দিনে এই পাঁচশো টাকার একটা নোট অনেক দামি। সে বাবার আদরের মেয়ে হলেও এটাই তার পাওয়া সবথেকে বড় অঙ্কের টাকা যেটা তার মা দিয়েছে। ওর মা সালমা ইসলাম মেয়েরা বাবার আদরের মেয়ে বলে হাতে ইচ্ছা মতো টাকা দিয়ে ছেড়ে দেননি কখনও।
সালমা ইসলাম তার পুরো জীবনে ভীষন হিসাব করে চলেছেন আর মেয়েদেরকেও তাই শিখিয়েছেন। উনার এই হিসাবী স্বভাবের জন্য আত্মীয় স্বজনরা আড়ালে উনাকে অ্যাকাউন্ট্যান্টের বউ বলে ডাকেন। কিন্তু উনি ওসবে কান দেন না। হিসাব করে চলেন বলেই উনার ঢাকা শহরের মতো দামী জায়গায় উনার দোতলা বাড়ি আছে।
—-
‘ এই আফু হাতের মেহেদী তো ভালই রং উঠেছে। তাহলে কি মায়ের কথাই সত্যি ? তোর দুলাভাইয়ের নাম লেখাতে মেহেদীর রঙ গাঢ় হয়েছে ? ‘ বিনী ওর মেহেদীর রঙে রঙিন হাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো।
‘ মায়ের মত বোকা বোকা কথা বলিস না আপা। ওটা নারিকেল তেলের কেরামতি। অদ্ভুত তোদের কুসংস্কার। আমি হোম রেমেডিসের কথা বুঝাতে বুঝাতেই পাগল হয়ে যাবো। ‘ আসফিয়া ওর পায়ে আলতা দিতে দিতে বলল। আজ সে ঠিক করেছে তার আপার বিয়েতে লাল আলতা পায়ে ছামছাম নূপুর পায়ে পুরো বাড়ি হাঁটবে। আলতা পায়ে নূপুর এক অন্যরকম ভালোলাগা।
‘ এই আপা তোর ভয় লাগছেনা জীবনে প্রথম বিয়ে করে শশুর বাড়ি যাবি তাও আবার জয়েন্ট ফ্যামিলিতে ? ভয় তো লাগার কথা। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে মানিয়ে নেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। ‘
‘ ভয় লাগবে কেন ? আর বিয়ে তো মেয়েদের একবারই হয়। তার আবার প্রথম আর দ্বিতীয় কি ? বিয়ে যৌথ পরিবারে হোক আর একক পরিবারে, দুই জায়গায়ই মানিয়ে নিতে হয়। মানিয়ে নেওয়া ছাড়া সংসার করা যায় না। ‘
‘ একটা গোপন কথা বলবো আপা ? ‘
‘ বলতে পারলে বল… তোর ইচ্ছা ‘
‘ দুলাভাইয়ের চাচাতো বোন রঙ আছে না ? ওই যে আমার বয়সী মেয়েটাকে যে দেখলে তোমাকে যখন দেখতে এসেছিল ? ওর না বয়ফ্রেন্ড আছে। নাম তুষার…. সিএ ফার্মে ফাইনাল ইয়ারে পড়ে। ‘ আসফিয়া বললো।
‘ ওর বয়ফ্রেন্ড আছে তুই কি করে জানলি ? তোকে কে বললো ? ‘ বিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘ ওই তো বললো যে ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। অবশ্য বলেছিল এই কথা কাউকে না বলতে। কিন্তু তুই তো জানিস আমি কোনো কথা চেপে রাখতে পারিনা। তাই তোকে বলেছি… ‘ আসফিয়া বোকা বোকা মুখ করে বলল।
‘ তাহলে তো মেয়েটার কপালে শনি আছে। বেছে বেছে তোকেই বলতে হলো ওর। তুই মীর জাফরের দলের নেতা, কথা রাখতে জানিস না। আমার আগে আর কাকে কাকে বলেছিস কথাটা ? আর কাউকে বলিস না কিন্তু… ‘
‘ তোকেই প্রথম বললাম। আর কাউকে বলিনি… আচ্ছা বলবো না কিন্তু তুই এটা ঠিক করলি না আমাকে মীর জাফরের দলের নেতা বলে। আমি কিন্তু তুই যে ছোটবেলায় একবার মেনী বিড়ালকে ঘরে এনে মাছ ভাত দিয়েছিলি ওটা মাকে বলিনি। ‘ আসফিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বললো।
‘ বুঝেছি, তোকে এখন থেকে আর মীর জাফরের দলের নেতা বলা যাবে না। তোকে তাহলে ঘসেটি বেগম বলে ডাকতে হবে। ঘসেটি বেগম, হবে না ? ‘ বিনী চোখে মুখে মেকি অসহায় ভাব ফুটিয়ে বললো।
‘ আপা তুই বড্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছিস। এখনই এই অবস্থা… না জানি বিয়ের পর কি হবে। বুঝে গেছি তোকে আর কোনো সিক্রেট বলা যাবে না। ঠিকাছে আমিও বলবো না। ইন ফ্যাক্ট আর কথাই বলবো না। তোর সাথে আর কোনো কথা নেই আমার ‘ বলে আসফিয়া রাগ করে মেঝে থেকে উঠে গিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেলো আর বিনী আপন মনে হাসতে লাগলো।
পর্ব- ০২
গলির মোড়ে থাকা চায়ের দোকানে বসে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে আর চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছে সরাব। বন্ধুরা তাকে নিয়ে আর বিনীকে নিয়ে রসালো রসালো ঘটনা সাজাচ্ছে। এই ধরুন তাদের বিয়ের পরের জীবন কেমনটা হতে পারে। সরাবও সেসবে মুচকি মুচকি হাসছে আর মাথা দুলোচ্ছে। সে যখন বন্ধুদের রসালো আলাপ শুনতে ব্যস্ত তখনই অনির্বাণ দৌড়ে এলো।
বন্ধু অনির্বাণকে দৌড়ে আসতে দেখে উঠে দাড়ালো সরাব। বন্ধুর কাধে হাত রেখে বলল ‘ কিরে এভাবে ছুটছিস কেন ? ‘ বন্ধু তখন এতটা পথ দৌড়ে আসায় হাঁটুতে হাত রেখে হাপাচ্ছে। কিন্তু সরাবের কথায় সোজা হয়ে ধারালো। বুকের উঠতি নামতি নিঃশ্বাসে নিয়ন্ত্রণ আনার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে সরাবের হাতে বিয়ের জমকালো কার্ড ধরিয়ে দিল। সরাব অবাক হয়ে তাকিয়ে একবার কার্ডটা দেখলো আরেকবার বন্ধুকে দেখলো। তারপর কোনো কথা না বলে কার্ডটা খুললো।
বিয়ের জমকালো সাজে সজ্জিত কার্ডটা বের করে কনের জায়গায় বিনীদৃতা মাহিরাত নূর আর বরের জায়গায় আবির হাসানের নাম দেখে সরাবের চঞ্চল চোখ জোড়া থমকে গেলো। সে অসার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে লাল সোনালী রঙের মোড়কে মোড়ানো কার্ডটার দিকে। ক্ষনিকের মাঝেই কার্ডটা তার হাত থেকে পড়ে ভুলন্ঠিত হলো। বন্ধুর এমন অবস্থা দেখে সরাবের আরেকজন বন্ধু আশফাক কার্ডটা তুলে বাকি বন্ধুদের নিয়ে কার্ডটা দেখলো। কনের জায়গায় বিনীর নাম দেখে তারাও হতবাক। অথচ এই কিছুক্ষণ আগেই এই বিনী আর প্রাণপ্রিয় বন্ধু সরাবকে ঘিরে কত রোমাঞ্চকর কথা চলছিল তাদের মাঝে।
‘ সরাব আঙ্কেল মনে হয় তোর আর বিনীদৃতার ব্যাপারে কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন। তাই সবার অলক্ষ্যে দীর্ঘ এক মাস কথাবার্তা চালিয়ে অবশেষে আজ বিনীদৃতার বিয়ে দিচ্ছেন। মনে আছে তোকে বলেছিলাম তুই যখন ব্যবসার কাজে গ্রামে গেছিলি তখন দুটো কালো গাড়ি এসেছিল এক মাস আগে ? আমার মনে হয় ওরা পাত্রপক্ষই ছিল। ‘ অনির্বাণ দ্রুত গতিতে পেটের ভিতর যা ছিল সব উগড়ে দিয়ে বললো যেন সব তার আগে থেকেই মুখস্ত ছিল।
তবে বিনীর বিয়ের কথা শুনে খানিকটা গম্ভীর হয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পরিবর্তনই চোখে পড়লো না সরাবের মাঝে। সে বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই দোকানের বেঞ্চে বসে দোকানিকে আরেক কাপ লাল চা দিতে বলল। বস্তুত সে দুধ চা খায় না কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে লাল চা খাওয়ার একটা বদ অভ্যাস আছে তার। সে তার উরুর উপর হাত দুটো জড়ো করে শান্ত ভঙ্গিতেই বললো ‘ পাত্রকে চিনিস ? কি করে সে ? ‘
সরাবের এহেন ধারার কথায় সকলেই যেন পিলে চমকে উঠলো। এখন যা পরিস্থিতি তাতে সরাবের উচিত বিনীদৃতার বাবার কাছে ছুটে যাওয়া এবং তার পায়ে পড়ে তার মেয়েকে ভিক্ষা চাওয়া। অথচ সরাব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বসে আছে। আশফাক ধারণা করলো সরাব কি তবে বিনীদৃতার বিরহে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে গেলো। সে অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলো ‘ তুই এত স্বাভাবিক কি করে আছিস ? তোর খারাপ লাগছে না বিনীদৃতার বিয়ে হয়ে যাবে বলে ? তোর তো উচিত ওর বাবার কাছে পা ধরে ওকে ভিক্ষা চাওয়া। ‘
‘ আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি আশফাক। খারাপ লাগছে বৈকি কিন্তু বিনীর বাবার পা ধরে তাকে ভিক্ষা চাওয়ার কোনো মানে হয়না। কি বলবো উনাকে ? যে উনার মেয়েকে আমি পছন্দ করি তাই বিয়ে করতে চাই ? অথচ উনার মেয়ে কি আমাকে আদৌ পছন্দ করে ? তাহলে এক পাক্ষিক অনুভূতির উপর ভিত্তি করে এত বড় নাট্য রচনা কেন করবো ? ‘ সরাব বেশ শান্ত ভঙ্গিতেই দোকানির দেওয়া লাল চায়ে চুমুক দিয়ে কথাগুলো বললো।
‘ বিনীদৃতা তোকে পছন্দ করে না মানে ? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে ? তুই এসব কি বলছিস ? পছন্দ না করলে ভার্সিটি আসতে যেতে তোর দিকে তাকিয়ে হাসবে কেন ? ‘ অনির্বাণ অবাক হয়ে বলল।
‘ অবশ্যই পছন্দ করে কিন্তু সেটা অন্যরকম। এই পছন্দ বিয়ে করে সারাজীবন একসাথে থাকার মতো পছন্দ নয়। তাছাড়া ইন্টার পাশ ছেলেকে ওর মতো অনার্স পাশ মেয়ে কেনই বা বিয়ে করবে ? আমার কি আছে ? ডিগ্রী বলতে ওই মেট্রিক ইন্টারে শুধুমাত্র প্রথম স্থান অধিকারের সম্মাননা আর কাপড়ের ব্যবসার দোকান। ইন্টার পাশ ব্যবসায়ী ছেলেকে বিয়ে করে ও সারাজীবন কষ্ট করে পার করবে এটা ভাবা বাড়াবাড়ি নয়কি ? ভুলটা আমার… বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চেয়েছি। দেখিস বিয়ের পর দুই দিনেই স্বামীকে চোখে হারাবে। কই অনির্বাণ বললি না যে পাত্র কেমন ? আঙ্কেল নিশ্চই দেখেটেখে বড়লোক পাত্র ঠিক করেছেন। ‘
বন্ধুর কথায় অনির্বাণের বেশ মায়া হলো। ছেলেটা এই বয়সে কতই না কষ্ট করেছে। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে সরাব। সম্বল হিসেবে সুদর্শন চেহারা আর বাবার কাপড়ের দোকানটাই আছে। ওর বাবা মারা গেছে বছর ছয়েক আগে। হুট করে নিরাপদ আশ্রয় হারিয়ে সরাব যেন অথৈ সাগরেই পড়েছিল। যার দরুন সংসারের হাল ধরতে ইন্টারের পরই পড়াশোনা ছেড়ে বাবার ব্যবসায় হাত দেয়।
সেই থেকে এই পর্যন্ত ব্যবসা করে অবস্থার অনেকটাই উন্নতি ঘটিয়েছে সরাব। সরাবের ঘরে মা আর বোন আছে। বোনকে বিয়ে দিয়েছে বছর দুয়েক আগে। ভাগ্যক্রমে বোন তার সুপাত্রেই গেছে তাই এখন সংসার ভালই চলছে। তবে তার মায়ের অবস্থা তেমন ভালো নয়। তিনি ডায়াবেটিসের রোগী বলে ভীষন নিয়ম মেনে চলতে হয় যার কারণে পছন্দের খাবারগুলো সীমিত পরিমাণ খেতে পারেন। আর মন মতো খেতে না পারার কারণেই সেই রাগ সরাবের উপর তুলেন। সারাদিন শেষে বাড়ি ফিরেও সরাব শান্তি পায় না মায়ের চেঁচামেচির তালে। বাধ্য হয়ে নিজের ঘরে কানে বালিশ দিয়ে পড়ে থাকে।
‘ পাত্রকে ঠিক চিনি না কিন্তু এলাকার বড় ভাইদের কাছে শুনেছি পাত্র নাকি ডাক্তার। এই শহরেই থাকে পুরো পরিবার নিয়ে। যৌথ পরিবার তার। ডাক্তার হিসেবে তার অনেক নাম। দাতের ডাক্তার। নাম আবির হাসান। ‘ অনির্বাণ ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল। কথাগুলো বলতে তার কেমন অসস্তি করছে। হয়তো প্রাণের প্রিয় বন্ধুকে তার ভালবাসার মানুষটার বিয়ের কথা বলা প্রকৃত বন্ধুর পক্ষে কখনোই এত সহজ না । অনির্বাণের কথায় সরাব স্রেফ হাসলো তারপর দোকানির টাকা মিটিয়ে হাঁটা ধরলো।
বিনীদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে সরাব। তার পাশেই আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে অনির্বাণ। সে যদি আগে বুঝত সরাব এখানে আসবে তাহলে কিছুতেই আসতে দিত না। সে টের পেলো যখন সরাব বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো। এখন চাইলেও সে সরাবকে ফেরাতে পারবে না।
শত শত রঙিন আলোক সজ্জার ভিড়ে সেজে উঠা জমকালো সফেদ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে সরাব। বাড়িটা বিনীদের। আগে কত শত এখানে এসেছে শুধুমাত্র বিনীকে একটু চোখের দেখা দেখবে বলে। অথচ আজ থেকে আর সেই অধিকারটাও থাকবে না তার। কথাটা ভাবলেই সরাবের কষ্টে বুকটা পাথর হয়ে উঠে। হাজার দুঃখ কষ্টে জর্জরিত হয়ে তার মন আর চোখ দুটোই পাথর হয়ে গেছে। তাই এখন আর শত কষ্টের স্পর্শেও তার চোখ বেয়ে নোনাজল গড়ায় না।
‘ আর কতক্ষন দাড়িয়ে থাকবি সরাব ? চল এখান থেকে… এখানে দাড়িয়ে থাকলে বিনীদৃতা আসবে না। সে এখন আর তোর নেই । ‘ বন্ধুর কাধে হাত রেখে বলল অনির্বাণ। অনির্বাণের কথায় মৃদু হাসলো সরাব। মৃদু গলায় বললো ‘ বিনী কবে আমার ছিল যে তার বিয়ে হলে সে আর আমার হবে না ? ‘
বন্ধুর কথায় জবাব দিলো না অনির্বাণ। শুধু অবাক হয়ে চেয়ে রইলো সরাবের মুখ পানে। এই কি সেই ভদ্র ছেলেটা যাকে একটু দুঃখ কষ্ট ছুঁলেই তার বাবা বাড়ি মাথায় তুলতো ? অথচ আজ এই ছেলেটাই জীবনের সবথেকে বড় কষ্ট পেয়ে জমে শক্ত পাথর হয়ে গেছে। মানুষের কত রূপ তাইনা ? জীবনের এক এক পরিস্থিতি তাকে কত রূপ দিয়েছে। পানিকে যেমন একেক পাত্রে রাখলে একেক আকার ধারণ করে তেমনি মানুষও জীবনের একেক পরিস্থিতি একেক রূপ ধারণ করে।
—-
বাড়িতে বরের আগমনে বাড়ির প্রতিটা কণা মুখরিত হচ্ছে হরেক রকমের গানের তালে। বাড়িতে উপস্থিত সকল তরুণ তরুণীই গানের তালে তাল মিলিয়ে সুর তুলছে। কেউ মিষ্টি ও সুরেলা গলায় আবার কেউ কাকের গলায়। যেভাবেই হোক গান গেয়ে প্রতিভা প্রদর্শন প্রতিযোগিতায় সকলেই নাম লিখিয়েছে। এমন কি আবিরের চাচাতো ভাই বোন জাদিদ, জাবিয়া ও আবিরের বড় ভাইয়ের মেয়ে জুহারিনও। জুহারিন তার বাচ্চা বাচ্চা গলায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারণ করছে।
তবে সালমা ইসলাম কড়া করে আদেশ জারি করেছেন যেন কোনো মেয়ে মানুষ গানের তালে কোমর না দোলায়। এতগুলো মানুষের সামনে মেয়েদের নাচানাচির ব্যাপারটা উনার কাছে চক্ষুশূল ব্যাপার। উনার মনে হয় এসব বাইজিদের কাজ। হাজার লোকের সামনে কোমর দোলানো কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ের কাজ হতে পারে না।
মায়ের আদেশে আসফিয়া তো বটেই তার মামাতো, ফুপাতো, খালাতো যত ধরনের ভাই বোন আছে সকলেই বেশ তক্কে তক্কে আছে। তারা কিছুতেই আদরের বোনের বিয়েতে কোনো ঝামেলা তৈরি করতে চাননা। আসফিয়া হলো তার নানা দাদার বাড়িতে সবার ছোট। তার আগে হলো বিনীদৃতা। কাজেই অনেকটা সবার ছোট বোন হওয়ায় তার প্রতি সবার ভালোবাসাটাও বেশি। এমন কি সে তার ছোটো বোনের কাছেও বেশ সমাদৃত।
অবশেষে আষাঢ় মাসের পনেরো তারিখ বিকাল পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিটে বিনীদৃতার বিয়েটা হয়ে গেলো। বিয়ে হতেই এতক্ষণ মন খারাপের মেঘ কাটিয়ে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। বিয়ের পরপরই বৃষ্টি যেন শুভ সংকেত। সব মেয়েরা শাড়ির কুচি তুলে দিলো দৌড় ছাদের দিকে। ছাদে উঠতেই সকলে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেলো। মেয়েরা বৃষ্টিতে ভিজছে বলে ছাদে ছেলেদের উঠতে নিষেধ করা হয়েছে। ছাদের চারদিকে উচুঁ দেওয়াল দিয়ে ব্যারিকেট করা বলে মেয়েদের বৃষ্টি ভেজা নাচ আশেপাশের কারোর নজরে পড়ছে না।
আসফিয়া তার আত্মীয় বোন ও সখীদের নিয়ে ছাদে বৃষ্টিতে নাচছে। তার সঙ্গে বিনীর ননদেরাও আছে। বিনীর ননাস লিমা আসেনি তার ছেলের জ্বর বলে। আবিরের তরফ থেকে আত্মীয় বলতে আবিরের চাচাতো ভাই বোন আর আবিরের বড় ভাই তার পরিবার নিয়ে এসেছে। আবির, তার ভাই আনিস আর জহির সাহেব(বিনীর বাবা) বাড়ির ভিতরেই নিচ তলায় কথা বলছেন। জহির সাহেব বারবার আবিরের হাত ধরে কিছু একটা বলছেন আর চোখের পানি মুছছেন।
স্বামীকে কাদতে দেখেও এগিয়ে গিয়ে কিছু বললেন না সালমা ইসলাম। মেয়েকে যৌথ পরিবারে বিয়ে দেওয়ায় উনি এখনও স্বামীর উপর চোটে আছেন। তাই উনি স্বামীর এহেন অসহায় পরিস্থিতি দেখেও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন। উনি সিড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে ছাদে গেলেন মেয়েকে দেখতে। বিনী ছাদের চিলেকোঠার ঘরের পাশে দাড়িয়েই বোনদের নাচ দেখছিল। তাকে বেশ কয়বার ডেকেছে তার ননদ জাবিয়া। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজলে তার ঠান্ডা লেগে যায় এই অজুহাতে সে প্রস্তাব নাখোচ করেছে।
মেয়েকে একলা শুকনো মুখে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সালমা ইসলাম বললেন ‘ কিরে তুই বৃষ্টিতে ভিজলি না ? তোর না বৃষ্টিতে ভেজা পছন্দ ? ‘
‘ ইচ্ছে করছে না মা… ‘ বিনী স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো।
মেয়ের কথায় সালমা ইসলামের অশান্ত মন আরও অশান্ত হলো। উনি জানেন বিনী স্বেচ্ছায় বিয়েটা করেনি। শুধু বাবার কথার অবাধ্য হবে না বলেও ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা করে নিয়েছে। কিন্তু এই জোরজবরদস্তির বিয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে উনি জানেন না। সেটা ভাবতে গিয়েই উনার মনটা ক্রমশ আরও খারাপ হচ্ছে। তবুও উনি নিজেকে শান্ত করলেন। মেয়ের কাধে হাত রেখে বললেন ‘ বাবার উপর রাগ করিস না মা। আমি জানি তুই বিয়েটা নিজের ইচ্ছায় করিসনি। কিন্তু বাবা মা যা করে ছেলে মেয়েদের ভালোর জন্যই করে। তাই তুই তোর জীবনে ভবিষ্যতে অনেক সুখী হবি এটাই দোয়া করি। ‘
বিনী শুনলো তার মায়ের কথা কিন্তু উত্তর দিল না। সে এক মনে বোনের নাচ দেখছে। তার আশ্চর্য লাগছে রোজ যেই বোনের মুখ দেখে তার দিন শুরু হয় কাল থেকে সেই বোনকেই দেখতে পাবে না। অথচ কাল থেকে এক অচেনা, অজানা মানুষের মুখ দেখেই তাকে দিন শুরু করতে হবে যার সঙ্গে তার ক্ষণিক আগেই বিয়ে হয়েছে।
পর্ব- ০৩
————————-
সরাব এসেছে তার ছোট কাকার বাড়িতে। ছোট কাকা, আব্দুল মিয়া এলাকার এক সাধারণ দিনমজুর। সরাবের বাবা বেচেঁ থাকাকালীন তাদের সাহায্য করতেন। এখন উনি মারা যাওয়ার পর সরাব করে। আব্দুল মিয়ার বাড়িটা সাধারণ টিন সেটের বাড়ি। ঘর তিনটা…. খাওয়ার ঘর, আব্দুল মিয়া ও তার স্ত্রীর ঘর এবং তাদের মেয়ে রুনার ঘর। এছাড়া তাদের বাড়ির সামনে খানিকটা জায়গা জুড়ে আঙিনা আছে।
আব্দুল মিয়ার অবস্থা কোনোকালেই তেমন ভালো ছিল না। বাড়ন্ত বয়সে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন যার কারণে ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ে যোগ দেওয়ার যোগ্যতাও ছিল না। সেই কারণেই দিন খেটে এখন দিন মজুরের কাজ করে যতটুকু আয় হয় তাতে নিজেদের খরচ চালিয়ে মেয়েকে কলেজ পাঠান।
আব্দুল মিয়ার একমাত্র মেয়ে রুনা। পড়াশোনায় সাধারণ গোছের। এবার সে ইন্টারে পড়ছে। কলেজে উঠলে কি হবে ? পড়াশোনায় তার বিন্দুমাত্র মনযোগ নেই। তার সব মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু সরাব। সরাবকে সে ভীষন পছন্দ করে আবার খানিকটা সমীহও করে যেহেতু তার কাকার ছেলে। এই যে এখন সরাব এসেছে, তাদের সঙ্গে মেঝেতে বসে ডিম আলুর তরকারি খাচ্ছে সে তাতেই ভীষন খুশী।
সরাবকে অনেকদিন পর পেয়ে তসলিমা বেগম ভাতিজার প্লেটে আরও বেশি করে ভাত তুলে দিলেন। ব্যস্ততায় সরাব তাদের বাড়ি আসে না। শুধু প্রত্যেক মাসে সময় করে কারোর হাত দিয়ে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেয়। ওই পাঁচ হাজার টাকায় তাদের অনেকটা সাহায্য হয়।
সরাব খেতে খেতে হাত দেখিয়ে তসলিমা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বললো ‘ আর দেওয়ার প্রয়োজন নেই কাকী। এটুকুই যথেষ্ট। ‘ সরাবের কথায় তসলিমা বেগম আর ভাত দিলেন না তবে বললেন ‘ আপার কি অবস্থা সরাব ? শরীরটা ভালো তো ? কয়দিন হলো দেখা করতে পারিনা। আসলে ঘর,সংসারে এতই ব্যস্ত হইয়া যাই যে সুযোগ হয়না। ‘
সরাব তসলিমা বেগমের কথার জবাবে কিছু বললো না। তবে গলা ঝেড়ে অন্য কথা তুললো ‘ কাকা আমার আপনার সঙ্গে একটা জরুরী কথা ছিল। ‘
ভাই পোর কথা শুনে আব্দুল মিয়া একটু নড়েচড়ে বসলেন। সরাবের এত আয়োজন করে কথা রাখার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে ব্যাপারটা গুরুগম্ভীর। উনি হেসে বললেন ‘ বলো না বাবা। আমি শুনছি। ‘
সরাব প্লেটের শেষ নলা মুখে তুলে পানি খেয়ে বললো ‘ আপনি রাজি থাকলে আমি রুনাকে বিয়ে করে ঘরে তুলতে চাই। ‘
—-
বিনীর বিদায়ের ঘণ্টা বেজেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। বিদায়ের সময় পুরো বাড়ি শুদ্ধ মানুষ যেন আকাশ,বাতাস কাপিয়ে কাদছিল। বিনীর বাবা জহির সাহেবও নাক টেনে খানিকটা কেঁদেছেন। সালমা ইসলাম মেয়ের বিদায়ের সময় কাদেননি তবে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দিয়েছেন। মায়ের মত বিনীও কাদেনি। কান্নাকাটি করা তাদের মা মেয়ের ধাঁচে নেই।
বর্তমানে বিনী ও আবির বিনীর শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছে। ওদের বিয়ের গাড়ি হিসেবে আবিরের বাড়িরই একটা গাড়ি সাজানো হয়েছে। আবিরের বড় ভাই আনিসসহ তার পরিবার এবং জাবিয়া, জাদিদ ওরা অন্য দুই গাড়িতে করে রওয়ানা দিয়েছে। আবির এবং বিনী পাশাপাশি বসে আছে। কারোর মুখে রা নেই।
কথাটা প্রথমে বিনীই শুরু করলো। আবির কেমন উসখুশ করছে। হাতের ঘড়ি ধরে টানা হেঁচড়া করছে। বিনী বললো ‘ চাইলে ঘড়িটা খুলে রাখতে পারো। ‘
বিনীর কথার বিপরীতে কিছু বললো না আবির। ও হাতের ঘড়ি খুললো। তারপর পকেট থেকে শুভ্র রুমাল বের করে রুমালে ঘড়ি পেঁচিয়ে ফেললো যাতে হাত থেকে পড়ে গেলেও ঘড়ি ভেঙে না যায়।
বিনী চুপচাপ বসে আছে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে প্রকৃতি দেখছে। আবিরের সঙ্গে সেই একবারই কথা হয়েছে। এরপর আর কথা আগায়নি সে। আবির নিজেও হয়তো ইচ্ছুক না কথা আগাতে তাই বিনী আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলেনি। বিনী বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই লক্ষ্য করলো বাহিরের গতিশীল প্রকৃতি থেমে গেছে। বিনী ঘাড় ঘুরিয়ে আবিরকে দেখলো। আবির ওকে দেখে বললো ‘ নামো, বাড়ি এসে গেছি। ‘
বিনী গাড়ি থেকে নামতে নামতে ভাবলো বাপের বাড়ি থেকে শশুর বাড়ি আস্তে তার বেশি সময় লাগেনি। পথের দূরত্ব কম, তারমানে যাওয়া আসার ঝামেলায় ট্রাফিক জ্যামে বেশি পড়তে হবে না। আরামেই বিয়ের দুই একদিন পরে যাওয়ার যে ব্যাপারটা সেটা একদিনের মাথাতেই সেরে ফেলতে পারবে।
বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিনী, আবিরসহ বিয়ের বর যাত্রী যারা ছিল তারা সকলে। আবিরদের বাড়ি শুভ্র রঙ্গা দোতলা এক বাড়ি। বাড়ির বাহ্যিক নকশা বলছে বাড়িটা বেশ পুরনো। হয়তো ব্রিটিশ আমলের। অনেক আগের বাড়ি অথচ এখনও দেওয়ালের শুভ্র রং রাতের আধারেও জ্বলজ্বল করছে।
বিনী আর আবিরকে আবিরের মা শাহিদা খাতুন বরণ করলেন। বরণ শেষে শাহিদা খাতুন উনার জা জাহানারাকে বললেন ‘ জাহান নতুন বউরে নিয়া তুমি আর আফিফা আবিরের ঘরে যাও। ‘
বড় জায়ের আদেশ এক বাক্যে মেনে নিলেন জাহানারা। আফিফাকে ইশারায় উনার পিছন পিছন আস্তে বললেন। আফিফা ইশারা বুঝে জাহানারা এবং বিনীর সঙ্গে এগিয়ে চললো।
বিয়ে বাড়ি হাজার মানুষের জায়গা। বিয়ের মৌসুমে বাড়ির মেয়ে বউদের হাজার কত কাজ থাকে। সেসব কাজেই ব্যস্ত থাকেন শাহিদা খাতুন। শাশুড়ির সাহায্য করা প্রয়োজন বলে আবিরের বিয়েতে যেতে পারেনি আফিফা। জায়ের সঙ্গে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করবেন বলে জাহানারাও যাননি। আবিরের বাবা এবং কাকাও এতজন মানুষ নিয়ে বরযাত্রী হিসেবে গিয়ে মেয়ের বাড়ির লোকজনকে বিপদে ফেলার প্রয়োজন মনে করেননি কাজেই তারাও যাননি।
বিনীদের বাড়ি থেকে আবিররা খেয়ে এসেছে। তাই তাদের আর খাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। বাকিরাও খাওয়া দাওয়া শেষ করে ফেলেছে ওদের পৌঁছতে পৌঁছতে। শাহিদা খাতুন সব একা হাতে সামলাচ্ছিলেন। বিনীকে আবিরের রুমে দিয়ে এসে আফিফা এবং জাহানারাও কাজে হাত দিলেন। আবির তখন বাবা আজাদ সাহেব এবং চাচা সাজ্জাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে ব্যস্ত।
কাজের মাঝে শাহিদা খাতুন ছেলেকে হাক ডাকলেন। মায়ের ডাকে বাবার আড্ডা ছেড়ে উঠলো আবির। সে এগিয়ে আসতেই শাহিদা খাতুন বললেন ‘ ঘরে বউ রাইখা বাপ ভাইয়ের সঙ্গে কি অত ফুসুর ফুসুর করো ? বিয়া কি করছো বউ সাজায় রাখার জন্য ?ঘরে যাওনা কি জন্য ? ‘
মায়ের ধমকে আবির দ্রুত সিড়ির দিকে হাঁটা দিলো। আবিরকে উঠে যেতে দেখে আফিফা এগিয়ে এলো। আস্তে করে বললো ‘ ঘরে গিয়ে এরকম বাংলার পাঁচপান্নর মতো মুখ বানায় রাখবা না। আমার জা যেন কোনো অভিযোগ করার সুযোগ না পায়। পারলে একটু আদর,সোহাগ করিও ভাই। তোমরা ভাইয়েরা যা নিরামিষ। ‘
আফিফার কথায় আবির লজ্জায় পড়ে গেলো। আফিফা বয়সে তার ছোট হলে কি হবে ? সম্পর্কে বড় বলে যখনই দেখা হয় লজ্জায় ফেলার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলে তার জন্য। আবিরের মনে হলো আফিফাকে এগিয়ে আসতে দেখে দাড়িয়ে যাওয়াটা তার সবথেকে বড় ভুল। তাই ভুল শুধরাতে ও কোনো কথা না বলে দ্রুত পা চালিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠে গেলো।
আবির ঘরে এসে দেখলো ঘরময় ফুলেল সুবাস। আজ তাদের বাসর রাত বলে ঘরকে গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে সাজিয়েছে। কিন্তু বিনী আবিরের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি। তার আগেই কাগজ দিয়ে বিছানার উপর থেকে ফুলের পাপড়িগুলো সরিয়ে ফেলছে। আবিরকে আসতে দেখে বিনী বলল ‘ আসলে গোলাপে আমার এলার্জি আছে তাই সরিয়ে ফেলেছি। তোমার কোনো সমস্যা হবে ? ‘
বিনীর কথা শুনে আবিরের কুঞ্চিত ভ্রু সোজা হলো। ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ঘরে ঢুকে দরজার খিল এঁটে দিলো। গায়ের পাঞ্জাবি খুলতে খুলতে বললো ‘ জী না। বিছানায় ফুলের পাঁপড়ি রেখে ঘুমানো সম্ভব নয়। তাই আমার আসার আগেই সরিয়ে ফেলার জন্য ধন্যবাদ। কাল বুলুকে বলে দিলেই হবে, ও ঘর পরিষ্কার করে দিবে। ‘
—-
দরজা পেটানোর শব্দে ছুটে এলেন নূরজাহান বেগম। বিরক্তিতে মুখ ছেয়ে আছে। এভাবে দরজা ধাক্কালে রাগ না উঠা কি স্বাভাবিক ?দ্রুত দরজা খুলে নূরজাহান বিশ্রী গালি আউড়ে বললেন ‘ তোর সমস্যা কি ছোটলোকের বাচ্চা ? ‘
কিন্তু কথাগুলো বলে সামনে দৃষ্টি দিতেই একটু ভরকে গেলেন। সরাবের সঙ্গে রুনা দাড়িয়ে আছে। নূরজাহান এবার একটু অপ্রস্তুত হাসলেন। রুনা নূরজাহানের মুখ থেকে গালিগালাজ শুনে মুখ নামিয়ে ফেলেছে। নূরজাহানের অবস্থা এত খারাপ তার জানা ছিল না। নূরজাহান ভাতিজিকে দেখে হেসে বললেন ‘ রুনা নাকি ? কতদিন পর এলি। আয় ভিতরে আয়, একলা এসেছিস নাকি ? তোর মা কোথায় ? ‘
সরাব রুনার আগেই বাসায় ঢুকলো। মায়ের এসব গালিগালাজে অভ্যস্ত সে। বাসায় ঢুকে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল ‘ রুনাকে ঘরে ঢোকান আম্মা। এখন থেকে ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে। আপনার আর সারা বাসায় একা একা থাকতে হবে না। ‘
সঙ্গী পেয়ে নূরজাহান খুশিতে বলেন ‘ তাই ? রুনা বুড়ি বুঝি কলেজে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে ? বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বুড়ি ? বাসায় ঢোক। ‘
সরাব ভিতরের ঘর থেকেই নূরজাহানের কথা শুনছিল। সে গলা চড়িয়ে বললো ‘ আমি রুনাকে বিয়ে করেছি আম্মা। তাই এখন থেকে ও এখানেই থাকবে আপনার সাথে। কাকা কাকী কাল এসে দেখা করে যাবে আপনাদের সাথে। ‘
—-
বিছানায় অন্য পাশ ফিরে ঘুমিয়ে আছে আবির। বিনী বাথরুম থেকে গোসল সেরে বেরিয়েছে। বিয়ের ভারী শাড়ি, গয়নাতে থাকা তার জন্য কষ্টদায়ক। তাই সেগুলো বদলে ফেলেছে। ভারী জামা কাপরগুলো বদলে শাড়ি পড়াতে এখন শান্তি লাগছে। বিনী কিছুক্ষণ জানালার কাছে দাড়িয়ে রইলো তারপর বিছানায় গিয়ে আবিরের গা ঘেসে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলো। কিন্তু ঘুম এলো না।
সকাল হয়েছে। বিনী ঘুম থেকে উঠে পরিপাটি হয়ে রান্নাঘরে এসেছে। শাহিদা খাতুন বিনীকে রান্নাঘরে দেখে বললেন ‘ তুমি এই সময় রান্নাঘরে কেন বউ ? ‘
বিনী মাথার কাপড় ঠিক করে বললো ‘ সকালের নাস্তা তৈরি করতে সাহায্য করি আম্মা ? ‘
শাহিদা খাতুন প্রথমে ভেবেছিলেন না করে দিবেন কিন্তু পরে ভাবলেন প্রয়োজন নেই। এখন থেকে রান্নাবান্নার অভ্যাস থাকলে পরে আর সমস্যা হবে না। উনি বললেন ‘ সাহায্য করতে পারো কিন্তু আগে নিজের নখ কাইটা আসো। ‘
শাহিদা খাতুনের কথা শুনে বিনী ওর কাকী শাশুড়ির দিকে তাকালো। জাহানারা বড় জায়ের কথা শুনে আর বিনীর দৃষ্টি দেখে বিপদে পড়লেন। হেসে বললেন ‘ আমি ওকে নখ কাটায় দিচ্ছি আপা। ব্লেড আমার ঘরেই আছে। আসো বউ, আমার সাথে আসো। ‘
—-
বিনী জাহানারার ঘরে বিছানায় বসে আছে। জাহানারা ঝুড়ি খুঁজে ব্লেড এনে বিনীর হাতে দিলেন। তারপর বিনীর পাশে বসলেন। বিনী ব্লেড পেয়ে নখ কাটতে ব্যস্ত। জাহানারা অনুনয় মাখা গলায় বললেন ‘ আপার কথায় রাগ করো না বউ। উনি একটু কড়া ধরনের। সব কথাই গম্ভীর গলায় বলেন। কিন্তু উনি তোমার ভালোর জন্যই নখ কাটতে বলেছেন। এখন তোমার বিয়ে হয়েছে। রোজ রান্নাবান্না করবা, থালাবাসন ধুইবা, সবজি কাটাকুটিও করবা। নখ থাকলে তো সমস্যা কাজ করতে। ‘
বিনী জাহানারার কথা মন দিয়ে শুনছিল। নখ কাটতে কাটতেই সে বললো ‘ আমি বুঝেছি কাকী। ‘
জাহানারা আর কিছু বললেন না। বিনীর নখ কাটা শেষে নিচে নেমে রান্নাঘরে গেলেন তারা। বিনী মোড়ায় বসে রুটি বেলছে রুটির পিড়িতে। জাহানারা সেই রুটি নিয়ে এক এক করে ভাজছেন। আরেক চুলায় আলু ভাজি হচ্ছে। আফিফা সবজি কাটছে আর শাহিদা খাতুন থালা বাসন মাজছেন।
—-
খাবার ঘরে সকলে জড়ো হয়েছেন। আবির একেবারে তৈরি হয়ে দপ্তরের ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমেছে। সে খেয়ে একবারে বেরিয়ে যাবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। আফিফা এবং বিনী মিলে সবাইকে রুটি ও ভাজি দিচ্ছে। আবিরকে নামতে দেখে আফিফা বিনীর কানে কানে বললো ‘ রুটি নিয়ে তোমার বরের কাছে যাও। ‘
বিনী আফিফার কথা শুনে আবিরের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। আবিরকে দুটো রুটি দিয়ে বলল ‘ আরও দিবো ? ‘
‘ এত বড় পুরুষ মানুষের দুটো রুটিতে হবে ? আরও তিনটা দাও। ঘরে রুটির অভাব পড়েনি। ‘
বিনীর প্রশ্নের উত্তর দিত আবির কিন্তু মায়ের গলা শুনে আর কিছু বললো না। বিনীর কথা শুনে শাহিদা খাতুনই রান্নাঘর থেকে গলা চড়িয়ে বলেছেন কথাটা। জাবিয়া, জাদিদ বিনী ও আবিরকে একসঙ্গে দেখে হাসছিল কিন্তু শাহিদা খাতুনের কড়া কথায় তাদের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। আজাদ সাহেব ছোট ভাই সাজ্জাদ সাহেবের সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে বলতে খাওয়া দাওয়া শেষ করলেন।
শাশুড়ির কথায় বিনী মন খারাপ করলো নাকি করলো না সেটা তার মুখ দেখে বুঝা গেলো না। মুখোভাব তার স্বাভাবিক। আবির একবার বিনীকে দেখে শেষ ভাগটা খেয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। বিনীর চোখ মুখ দেখে হয়তো বোঝা যাচ্ছেনা তার মনের অবস্থা কিন্তু আবির জানে বিয়ের পরের দিনই এরকম একটা কথা শুনে কোনো মেয়েই ঠিক থাকতে পারবে না।
শাহিদা খাতুনের কথায় খারাপ লাগেনি বিনীর। যৌথ পরিবারে বিয়ে হলে যে এরকমভাবে সবার সামনে কথা শুনতে হবে এটাই তার জানা। তার মাকেই তো এমন কত কথা শুনতে দেখেছে সে। যতদিন তার দাদী বেঁচেছিলেন ততদিন তার মা এভাবেই কথা শুনে এসেছে। এছাড়াও ভুল তো তারই। এত বড় একজন মানুষ তো বেশি রুটি খাবেই। সুতরাং নিজের ভুল নিজেই শুধরে নেয়ার বুদ্ধিমানের কাজ।

————————-
দুপুরে কাজ শেষে নিজের ঘরে বসেছিল বিনী। সময়টা কেমন ধীর গতিতে কাটছে। এতক্ষণ কাজের মধ্যে ছিল তাই দ্রুত কেটে গেছে কিন্তু এখন তো আলসে সময় যাচ্ছে। বিনী কি করবে খুঁজে পেলো না। আশেপাশে কয়েকবার চোখ ফেরালো। আবিরের ঘরের এক কোণায় বইয়ের শেলফ আছে। বিনী ভাবলো অলস সময় না কাটিয়ে একটা বই পড়া যায়। এমনিতেও শুয়ে বসে থাকতে তার ভালো লাগছে না।
বিনী বেছে বেছে হুমায়ূন আহমেদের প্রিয়তমেষু বইটা হাতে নিল। শেলফের কাছে থাকা বিরাট আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মুখের সামনে বই মেলে ধরলো। তবে রাতের অনিদ্রার ফলে প্রিয়তমেষুর মতো এত আবেগী বই পড়েও তার জেগে উঠা নিদ্রা কাটানো গেলো না। উল্টো বই পড়তে পড়তে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি।
বিনীর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধে হয়ে গেছে। বিনী হুড়মুড়িয়ে উঠলো। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ সে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে। শাহিদা খাতুন তো রেগে বোম হয়ে আছেন মনে হয়। বিনীর ভয় হচ্ছে।
বিনীকে লাফিয়ে উঠতে দেখে জাবিয়া চমকে গেছে। সে এসেছিল বিনীকে ডাকতে। কিন্তু সে ডাকার আগেই বিনী জেগে গেছে। এমনভাবে জেগেছে যে জাবিয়া নিজেই ঘাবড়ে গেছে। জাবিয়া শান্ত গলায় হেসে বললো ‘ ভয় পেলেন ভাবি ? ‘
বিনী এতক্ষণে জাবিয়ার উপস্থিতি টের পেলো। অপ্রস্তুত গলায় বললো ‘ আসলে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছিলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে টেরই পাইনি। আম্মা কি রেগে আছেন ? ‘
বিনীর কথায় অবাক হয়নি জাবিয়া। এমনটাই হয়। যারা শাহিদা খাতুনকে জানেন না তারাই প্রথম দেখায় উনাকে মেজাজি মনে করেন। তবে জাবিয়া জানে বিনী তাদের কাকীকে জানতে শুরু করলে আর এমন ভয় পাবে না আর সেটা বিনী নিজে থেকেই উপলব্ধি করবে। তাই জাবিয়া বললো ‘ আমি জানিনা ভাবি।আপনি নিচে চলুন। কাকী আপনাকে ডাকতেই পাঠিয়ে ছিলেন আমাকে। ‘
জাবিয়ার সঙ্গে দ্রুত নিচে নেমে এসেছে বিনী। মাথার কাপড় ঠিক করে খাবার ঘরে ঢুকলো সে। বসার ঘরে আজাদ সাহেব ও সাজ্জাদ সাহেব চা, নাস্তা করছেন। জাদিদ খাবার ঘরে বসে চানাচুর খাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই ভার্সিটি থেকে ফিরে ভাত খেয়ে উঠেছে সে। চা, নাস্তা শেষে জাবিয়া পড়তে বসবে নিজের ঘরে। জুহারিন বসার ঘরে মেঝেতে বসে খেলছে।
বিনী যেমন ভেবেছিল তেমন কিছুই হয়নি। তাকে দেখা মাত্র শাহিদা খাতুন তার হাতে আরও কিছু পাকোড়া ধরিয়ে দিয়ে বললেন যেন আজাদ সাহেবদের দিয়ে আসে। শাহিদা খাতুনের কথা মতোই পাকোড়া নিয়ে এগিয়ে গেলো বিনী। শান্তি লাগছে শাহিদা খাতুন রাগ করেননি।
—-
কাজ কর্ম শেষে শাড়ির আঁচলে হাত মুছে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো বিনী। শাহিদা খাতুন ও জাহানারা যার যার ঘরে আছেন। আফিফা জুহারিনের জন্য ভাত নিচ্ছে প্লেটে। আগে আগে বাচ্চাকে খাইয়ে দিয়ে তারপর সবাইকে ভাত দিবে। বিনী ভাবলো এখন ঘরে ঢুকবে না। ঢুকে লাভ নেই, হয়তো ক্লান্তিতে বিছানায় বসতেই ঘুমিয়ে পড়বে। তাই বিনী জাবিয়ার ঘরে ঢুকলো।
জাবিয়া টেবিলে বসে পড়ছিল। ঘরের দরজায় টোকা পড়তেই সে নড়েচড়ে বসলো। বিনী তার অনুমতি নিয়েই ঘরে ঢুকলো। বিনীকে দেখে জাবিয়া ওকে নিয়ে বিছানায় বসালো। তারপর উঠে গিয়ে একটা মেহেদী এনে বললো ‘ আমি আসফিয়ার কাছে শুনেছি আপনি খুব ভালো মেহেদী দিয়ে দিতে পারেন। আমাকে দিয়ে দিবেন ? ‘
বিনী তার অলস সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। সে আগ্রহ নিয়ে জাবিয়ার হাতে মেহেদি দিয়ে দিচ্ছে। মেহেদী দিয়ে শেষ করতে করতেই জুহারিনও হাজির। সে বায়না ধরেছে সেও দিবে। বারবার নাক টেনে বলছে ‘ জুহারিন দিবে কাকী। ‘
জুহারিনের কথা পরিষ্কার তাই বিনীর বুঝতে বেগ পেতে হয়নি। সে বলল ‘ দিয়ে দিবো তো। আগে ফুপিকে দিয়ে দেই। ‘
জুহারিন ভদ্র ধরনের। তাই বিনীর কথা মেনে সে আর কথা বাড়ায়নি। জাবিয়ার বাম হাতে মেহেদি দেওয়া শেষে বিনী জুহারিনের হাতে মেহেদি দিতে শুরু করলো। মেহেদী দেওয়া শেষে জুহারিনের খুশির অন্ত নেই। সে খুশি মনে নাচতে নাচতে তার দাদুকে হাত দেখাতে গেছে।
বিনী ভাবলো এখন একবার ঘরে গিয়ে দেখা উচিত আবির এসেছে কিনা। সকালে জিজ্ঞেস করেনি আবির হসপিটাল থেকে কখন ফিরে। বিনী ঘরে গেলো কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখলো ঘরের বাতি আগেই জ্বালানো। বাথরুম থেকেও পানির শব্দ আসছে। বিনী বুঝলো আবির চলে এসেছে।
বিনী আর আফিফা মিলে সবাইকে রাতের খাবার দিচ্ছে। আবির গোসল সেরে খাবার ঘরে এসেছে। বিনী আর আফিফা মিলে সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে নিজেরা খেতে বসলো। শাহিদা খাতুন এবং জাহানারাও বউদের সঙ্গে খাবেন বলে আগে খাননি। এই বাড়িতে ছেলেদের খাওয়ার পরই মেয়েদের খাওয়ার নিয়ম।
শাহিদা খাতুন লক্ষ্য করলেন রান্না করা হয়েছে বেশ কয়েক রকমের পদ। গুনে দেখলে দেখা যাবে চার পাঁচ রকমের হয়েছে। অথচ বিনী পাতে শুধু ভাত আর ডাল তুলে নিয়েছে। শাহিদা খানিকটা অসন্তোষ গলায় বললেন ‘ রুই মাছের পেটি নাও বউ। ‘
শাশুড়ির ভয়েই হোক কিংবা কথা না শুনে বেয়াদবি করার ব্যাপারটাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করে, বিনী ওর পাতে রুই মাছের পেটি তুলে নিলো। খেতে খেতে সে শাহিদা খাতুনকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করলো।
শাহিদা খাতুন বাহিরে দিয়ে যতটা শক্ত পোক্ত দেখান নিজেকে আদতে উনি ততটাই নরম। সকালে বিনীর হাতে বড় বড় নখ দেখে ওকে কাটতে বলেছেন যাতে ওর পরে হাতে না লাগে। তারপর আবার এখন শুধু ডাল দিয়ে খেতে দেখে মাছও নিতে বললেন। অবশ্য মাঝে সকালে তার নির্বুদ্ধিতার জন্য ধমক দিয়েছিলেন কিন্তু সেটা মনে নেয়নি বিনী। বরং শাহিদা খাতুনের ধমকের চেয়ে তার লুকানো ভালবাসাটাই বেশি চোখে পড়ছে তার।
কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা অন্যের কাছে ভালোবাসার প্রকাশটা করতে ভয় পান। তারা মনে করেন কাউকে ভালোবাসা তাদের দূর্বলতা। ভালোবাসা কখনও কখনও ব্যক্তি ক্ষেত্রে দূর্বলতা হয় কিন্তু সবক্ষেত্রে ভালোবাসা লুকিয়ে রাখা যায়না।ভালোবাসা ঝড়ো হাওয়ার মতোই উত্তাল। একে দেখা তো যায়না কিন্তু অনুভব ঠিকই করা যায়।
আজকের মতো সব কাজ গুছিয়ে রেখে ঘরে ফিরে এসেছে বিনী। আবির বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। বারান্দার দরজা চাপিয়ে দেওয়া। ঘরের বাতি জ্বলছে। বিনী এগিয়ে গেলো বারান্দায়। বারান্দার দরজা খুলতেই নাকে সিগারেটের উটকো গন্ধ এলো। বিনী খানিকটা হাসলো। আবিরের পাশে দাড়িয়েছে সে। মুখে বলল ‘ সিগারেট খাচ্ছ কোন দুঃখে ? ‘
আবির অন্যমনস্ক ছিল। বিনীর কথায় হকচকিয়ে উঠলো। হেসে বললো ‘ কিছু বললে ? ‘
বিনী মাথা নেড়ে বললো ‘ হ্যাঁ বলছিলাম যে কার দুঃখে এমন সিগারেট খাচ্ছ। কোনো প্রেমিকা আছে নাকি ?’
আবির বিনীর কথায় অবাক হলো। বলল ‘ কোনো ওয়াইফ যে এত স্বাভাবিক মুখ নিয়ে হাজব্যান্ডকে প্রেমিকার কথা জিজ্ঞেস করতে পারে জানতাম না। তোমার কেন মনে হলো আমার প্রেমিকা থাকতে পারে ? ‘
বিনী আবিরের কথা শুনে এমনভাবে হাসলো যেন আবির ওর সঙ্গে রসিকতা করেছে। ও হাসতে হাসতেই বললো ‘ প্রেমিকা থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া আমি শুনেছিলাম ছেলেরা নাকি প্রেমে ছেকা খেয়ে এসব সিগারেট ফিগারেট খায়। ‘
‘ তাহলে বলতে হয় তুমিও ছেকা খেয়েছো কারণ আমাদের বিয়েতে আমি তোমাকে খুশি হতে দেখিনি। ছেকা খাওয়ার ব্যাপারটা তোমার ভুল ধারণা। ছেলেরা সবসময় ছেকা খেয়ে সিগারেট খায় না। মাঝে মাঝে শখ করেও খায়। ‘
আবিরের কথায় বিনী প্রতি উত্তর করলো না। চাঁদনী রাতে আবিরের পাশে ফাঁকা বারান্দায় দাড়িয়ে জোছনায় ঢাকা পরিবেশ উপভোগ করছে সে। আবির বলল ‘ একটা জিনিস আছে তোমার জন্য। ‘
‘ আমার জন্য ‘ বিনী অবাক হয়ে হেসে বললো।
‘ হুম তোমার জন্য ‘ বলে আবির বারান্দা ছেড়ে ঘরে গেলো আর বিনীকে যাওয়ার আগে ইশারা করে গেলো যেন সুবোধ বালিকার মতো বারান্দায় চুপটি করে দাড়িয়ে থাকে। বিনী চুপচাপ দাড়িয়ে আছে রেলিং ঘেঁষে। ভাবছে সরাব কি করছে এখন ? সে কি বিনীর বিয়ের খবর পেয়েছে ? না পাওয়ার কথা না। বিনীকে পাত্রের দেখতে আসার ব্যাপারটা জহির সাহেব লুকিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু সেটা বেশিদিন চাপা পড়েনি। বিয়ের দিনই এলাকা জুড়ে সবটা ছড়িয়ে পড়েছে।
—-
ভাতের মাড় গালতে গিয়ে গরম পাতিলে হাত লেগেছে রুনার। রুনার আর্তনাদ শুনে ছুটে এসেছেন নূরজাহান। রান্নাঘরের মেঝেতে থাকা ভাতের পাতিলের মাড় দ্রুত গালতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘ কি হয়েছে রুনা ? ‘
‘ মাড় গালতে গিয়ে লেগেছে আম্মা। ‘
রুনার কথা শুনে নূরজাহান রুনার হাত ধরে ওকে টেনে তুললেন। কলের নিচে হাত ধরে বললেন ‘ এভাবে অমনযোগী হয়ে কাজ করছিলি কেন ? হাতটা পুড়ল তো। ‘
রুনা অমনযোগী ছিল। সরাবের ব্যবহার ওকে ভাবাচ্ছে। সরাব ওকে বিয়ে তো করেছে কিন্তু এখনও স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয়নি। বলা ভালো বিয়ের পর থেকে তাদের মধ্যে কোনো কথাই হয়নি।
রুনা নূরজাহানের কথা শুনল। উত্তরে কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু তার কথা অব্যক্তই রয়ে গেলো। সরাব এসেছে। সদর দরজা পেটাচ্ছে সে। বাহির থেকে সে রুনার নাম ধরে ডাকছে। রুনা নূরজাহানকে রেখেই দরজার দিকে ছুটলো। দরজা খুলতেই সরাব বললো ‘ কি করছিলি ? কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছি। ‘
‘ দুঃখিত ‘ বলে রুনা সরাবের হাত থেকে পেট মোটা বাজারের ব্যাগটা নিলো। সরাব বাজার করে এনেছে। বাজারের ব্যাগ হাতে রুনা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল ‘ আম্মার সঙ্গে কথা বলছিলাম তাই তোমার দরজা ধাক্কানো শুনিনি। ‘
সরাব রুনার কথা শুনেনি কিংবা শোনার প্রয়োজন মনে করেনি। তার পূর্বেই সে ঘরে ঢুকেছে। সরাবের বিরুপ আচরণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুনা। সরাবের নিজের দেওয়া প্রস্তাবে বিয়ের পর সরাবের কাছ থেকে এই ব্যবহার আশা করেনি।
রুনা ভাত আর তরকারী সাজিয়েছে মেঝেতে দস্তরখানা বিছিয়ে। নূরজাহান এসেছেন কিন্তু সরাব এখনও আসেনি। রুনা উঠে গিয়ে সরাবকে ডাকলো কিন্তু সরাব জানালো সে বাহির থেকে খেয়ে এসেছে। রুনা নীরবে শুকনো মুখে ফিরে এলো। নূরজাহানকে সরাবের শরীর ভালো না জানিয়েছে সে। নূরজাহান যদি জানতে পারেন সরাব বাহির থেকে খেয়ে এসেছে তাহলে চেঁচামেচি করবেন যেটা রুনা চায় না। এমনিতেই নূরজাহানের শরীর ভালো না।
—-
উঠান থেকে তুলে আনা কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখছে রুনা। সরাব বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতটা কপালে তুলে চোখ ঢাকা। রুনা কাপর গোছাতে গোছাতে বললো ‘ এভাবে বাহির থেকে খেয়ে এসো না। আম্মা ব্যাপারটা ভালো চোখে নিবে না। ‘
‘ আচ্ছা ‘
সরাব উত্তরে শুধু আচ্ছা বললো অথচ রুনা আরও কিছু আশা করেছিল। সরাব কেমন যেন ব্যবহার করছে। রুনার সঙ্গে নিজের কথা আগানোতে তার ভীষন উদাসীনতা। কেমন বিয়ে করেও বউ ছাড়া ছাড়া ভাব যেন তার বিয়েই হয়নি। সারাদিনে কোনো কথাই বলে না। কাজে যখন বাহিরে থাকে তখন খোঁজ নেওয়ার উপায় নেই কিন্তু ঘরে থাকলেও তো কথা বলে না। কালকের পর আজ পর্যন্ত কোনো কথাই বলেনি। ….
( এখানে বেলি ফুলের মালা গল্পের প্রথম পর্বে উল্লেখ করেছিলাম আবিরের ডিভোর্সি বোন আর তার ছেলে আছে। কিছু কারণে তাকে বাদ দেওয়া হলো। এতে গল্পের চরিত্রের সংখ্যা এতে শুধু বাড়বেই। )

পর্ব- ০৫
————————-
‘ ওহে এলোকেশী কন্যা
চুলগুলো বাঁধিও তোমার,
আমার আনা মমতা মাখা
এক গাছি বেলি ফুলের মালায় ‘
এক গাছি বেলি ফুলের মালা রাখা বাদামি প্যাকেটে চিরকুটটা পেলো বিনী। আবির তার হাতে একটা বাদামী রংয়ের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিল। তার ভিতরেই বেলি ফুলের মালা আর সাদা কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে এই চার লাইনের ছন্দ ছিল। আবিরের কাজে বিনীর মুখে কোনো অনুভূতির দোলাচল দেখা গেলো না। সে নিষ্প্রভ হয়ে তাকিয়ে আছে বেলি ফুলের মালার দিকে।
‘ চিরুনি নিয়ে কাছে এসো। চুলে বেণী করে মালাটা পড়িয়ে দেই। ‘
আবিরের কথায় বিনীর ভাবনায় ছেদ পড়ল। আবির বিছানায় বসে আছে। বিনী চিরুনি নিয়ে আবিরের কাছে গেলো। মেঝেতে পা গুটিয়ে আসান ধরে বসেছে বিনী। আবির ওর জট বাধানো চুলে জট ছাড়াচ্ছে। চুলের ভয়াবহ অবস্থায় সে হতাশ হয়ে বললো ‘ চুলের এমন অবস্থা কেন ? যত্ন নাও না। ‘
আবিরের কথার উত্তরে বিনী বললো ‘ চুলে মা আর আসফিয়া তেল দিয়ে দিত। বিয়ের ব্যস্ততায় এবার আসফিয়া খেয়াল করে দিতে পারেনি। আমি তেল দিতে পারিনা। ‘
আবির বিনীর কথায় হেসে বললো ‘ এতদিন তাহলে আসফিয়া আর মা তেল দিয়ে দিতেন। চিন্তার কিছু নেই। এখন থেকে আমি তেল দিয়ে দিবো। তাছাড়া আম্মা তো আছেনই। তোমাকে তেল দিয়ে দিবেন উনি। ‘
‘ আম্মা ? উনি তেল দিয়ে দিবেন ? ‘
বিনী অবাক হয়ে বলল। আবির ওর কথা শুনে জট ছাড়িয়ে এবার বেণী করতে করতে বলল ‘ হ্যাঁ আম্মা দিয়ে দিবে। আম্মা তো আফিফা ভাবীকেও দিয়ে দেন তেল। ‘
বিনী উত্তরে শুধু ওহ বললো। আবির এবার বললো ‘ আম্মা বকলে মন খারাপ করো না। উনি অমনই, কড়া ধরনের। কিন্তু আম্মা মোটেই খারাপ মানুষ নন। শুধু একটু স্ট্রিক্ট হওয়ার চেষ্টা করেন। আম্মা ভাবেন শক্তের ভক্ত আছে জম নেই। ‘
‘ আমি কিছু মনে করিনা। ‘
ব্যাস এতটুকুই যা বলার ছিল বিনীর। ও আর কথা বাড়ায়নি আবিরের সঙ্গে। আবির নিজেই কথা বলতে বলতে ওর চুলে বেণী করছে। বেণী শেষে আবির ওর চুলে কিভাবে কিভাবে যেন মালা পেঁচিয়ে পিন লাগিয়ে দিল। বিনী সেই বেণী সামনে এনে দেখলো আবির বেণী করেনি উল্টো দুই ভাগ চুলকে একটা আরেকটার সঙ্গে দড়ির মতো পেঁচিয়ে কোনোমতে বেধে রেখেছে। সেই সঙ্গে মালাটাও কোনোভাবে বেঁধেছে।
ছেলে মানুষের কাছ থেকে এর বেশী আশা করা অপরাধ। চুলে বেণী করা,তেল দিয়ে দেওয়া তাদের হাতের কাজ নয়। তবে আবির যেভাবেই বেণী করুক না কেন এতটা দায়িত্ব নিয়ে যখন করে দিয়েছে তখন এর প্রশংসা করা অবিশ্যম্ভাবী দায়িত্ব মনে হলো বিনীর। বেণীর হুট করেই কেন যেন আবিরের এই যত্নশীল দিকটা মনে লাগলো। আগে এমন করে কেউ তার যত্ন করেনি। করার কথাও না। পারিবারিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যই প্রেম সে করেনি।
‘ সুন্দর হয়েছে বেণী। ‘ বেণী থেকে বেরিয়ে আসা এলো চুলগুলো দেখে বললো বিনী।
আবির বিনীর কথায় খুশি হলো। বললো ‘ তাহলে এখন থেকে রোজ বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবো আর নিজের হাতে তোমার বেণীতে লাগিয়ে দিবো। ‘
বিনী স্রেফ মাথা নাড়ল। আবির ওর হসপিটালে যাওয়ার ব্যাগটা গুছিয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ঘরের বাতি নিভিয়ে আবিরের পাশে বিনীও শুয়ে পড়লো। কথা বলার জন্য আবিরের দিকে ফিরল সে। মুখের নিচে কনুই রেখে বলল ‘ বলছিলাম পরশুদিন তোমাকে আর আমাকে বাড়িতে যেতে হবে। এটা নাকি কি একটা নিয়ম। ‘
‘ বাড়ি যেতে হবে!! তা ভালো তো। তুমি তাহলে আম্মাকে জানিয়ে অনুমতি নিয়ে রেখো। দেখছোই তো কথা বলারই সুযোগ হচ্ছে না। তার উপরে যেহেতু তোমাদের বাড়ি যাবো তাই কয়েকদিনের ছুটিও নিতে হবে হাসপাতাল থেকে। পারবে না আম্মাকে বলতে ?’
আবিরের কথায় বিনীর আর বলা হলো না শাহিদা খাতুনের কাছ থেকে অনুমতি নিতে তার ভয় করছে। সে চুপ করেই রইলো। আজও তার রাতে ঘুম হয়নি। তবে ভোরের দিকটায় ঘুম চোখে ধরা দিয়েছিলো। নিদ্রার এই লোভাতুর হাতছানি সে উপেক্ষা করতে পারেনি। ঘুমিয়ে পড়ে ঘুমের নেশায়।
সকাল হয়েছে, বিনী ঘুম থেকে উঠে পরেছে। চুলে মোড়ানো বেলি ফুলের মালা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বিছানায় হুটোপুটি খাচ্ছে। বিনী বিছানায় উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে পাশ ফিরে তাকালো। আবিরের পরনের লুঙ্গি পায়ের হাঁটুর কাছে উঠে এসেছে। বিনী আবিরের জামা কাপড়ের অবস্থা দেখে হাসলো। হাত দিয়ে লুঙ্গিটা নামিয়ে দিল আর আবিরের কপালের উপর হেলিয়ে থাকা এলো চুলগুলো আলতো হাতের স্পর্শে ঠিক করে দিলো।
বিনী পরিপাটি হয়ে পূর্বের দিনের মতোই রান্নার পাড়ে চলে এসেছে। শাহিদা খাতুন আজ সকালের নাস্তায় ভেজা খিচুড়ি করবেন। খিচুরিটা নিজ হাতেই রাধবেন তিনি। বিনী সবজিগুলো কেটে দিলো আর চাল ধুয়ে দিল। এই ফাঁকে আফিফা জুহারিনকে এক দফা খাইয়ে এসেছে।
খাওয়া দাওয়া শেষে আজাদ সাহেব আর সাজ্জাদ সাহেব বেরিয়ে গেলেন কাজের উদ্দেশ্যে। জাদিদ ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে আর জাবিয়া কলেজের জন্য বেরিয়েছে। আবির কাধে ব্যাগ নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বের হলো। বিনী তখন রান্নাঘরে কাজ করছিল কিন্তু আবিরের বের হওয়ার খবরে এগিয়ে এলো না সে। শাহিদা খাতুন ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন।
শাহিদা খাতুন আবিরকে ডাক দিলেন। মায়ের ডাকে আবির অবাক চোখে তাকালে শাহিদা খাতুন ইশারা করলেন যেখানে আছে সেখানেই যেন দাড়িয়ে থাকে। তারপর তিনি বিনীকে ডাকলেন। বিনী কাজ করছিলো কিন্তু শাহিদা খাতুনের ডাকে উঠে এলো।
‘ জী, আম্মা ‘
বিনী খাবার ঘরে শাশুড়ির ডাকে ছুটে যেতেই শাহিদা খাতুন ওর হাতে একটা টিফিন বাক্স ধরিয়ে দিয়ে বলল ‘ আবিরকে দিয়া আসো। বউ হয়ে জামাইয়ের একটু খেয়াল না রাখলে জামাই কি তোমারে ভালোবাসবো ? এখন থেকা রোজ নিজে টিফিন বানাইবা আর নিজ হাতে দিয়া আইবা। ঠিক আছে ? ‘
শাহিদা খাতুনের ভরাট কণ্ঠে বিনী প্রতিবাদ করেনি। সে কোনোমতে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে টিফিন বাটি নিয়ে দ্রুত পা চালাচ্ছে। আবির বেরিয়ে যাচ্ছিল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে কিন্তু মায়ের ডাক শুনে দাড়িয়ে পড়েছে। বিনী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আবিরের সামনে দাড়ালো। আবিরের দিকে টিফিন বাক্সটা এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ বাইরের খাবার খাওয়ার প্রয়োজন নেই। বাক্সে রাখা খাবারগুলো খেও। ‘
আবির সায় দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে টিফিন বাক্স হাতে নিয়ে বলল ‘ আম্মার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রেখো। ‘ বিনী উত্তরে মাথা নেড়ে সায় দিল আর আবির বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। বিনী ধীর পায়ে রান্নাঘরে আবার এসে ঢুকলো। রান্নাঘরের মেঝেতে সে ছোট মাছ নিয়ে বসেছে। মাছ কুটতে কুটতেই সে শুনতে পড়লো বসার ঘরে টেলিফোন বাজছে।
বিনী টেলিফোনের শব্দে উঠতে নিয়েছিল কিন্তু শাহিদা খাতুন ইশারা করলেন উঠার প্রয়োজন নেই, উনি দেখছেন। বিনী আর উঠলো না। শাহিদা খাতুন হাতের পানি ফেলে এগিয়ে গেলেন। সোফায় বসে টেলিফোনটা কানে ধরলেন। ওপাশ থেকে জহির সাহেবের গলা শোনা গেলো। জহির সাহেব মিষ্টি হেসে সালাম দিলেন ‘ আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন ? ‘
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি শাহিদা খাতুন, মিসেস আজাদ বলছি। ‘
জহির সাহেব বেয়াইনের কথার প্রতি উত্তরে বললেন ‘ আমি জহির চৌধুরী, বিনীর বাবা। ‘
নতুন বেয়াইয়ের পরিচয় পেয়েও শাহিদা খাতুনকে আন্তরিক হতে দেখা গেলো না। উনি গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন ‘ কেমন আছেন ভাইজান ?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর রহমতে ভালো আছি আপা। আসলে একটা জরুরী প্রয়োজনে টেলিফোন করেছিলাম। বিয়ের ব্যস্ততায় জামাইয়ের খাতির করতে পারিনি। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে ওরা একটু কাল কিছু দিনের জন্য আসতো। ‘
জহির সাহেবের কথায় কিয়ৎপল মৌন রইলেন শাহিদা খাতুন। ভাবনা চিন্তা করে সময় নিয়ে বললেন ‘ নিশ্চই, আমার কোনো আপত্তি নেই এই ব্যাপারে। ‘
‘ ধন্যবাদ ‘
জহির সাহেবের সঙ্গে কথা শেষে রান্নাঘরে ঢুকেছেন শাহিদা খাতুন। বিনী বসে বসে মাছ কুটছিল। শাহিদা খাতুনকে ঢুকতে দেখে ভয়ে ভয়েই সে বললো ‘ আম্মা কে টেলিফোন করেছিল ? ‘
‘ তোমার বাবা ‘
শাহিদা খাতুনের গম্ভীর, ভরাট কণ্ঠে বিনী মুখ তুলে তার দিকে তাকালো কিন্তু শাহিদার চেহারা দেখতে পেলো না সে। উনি অন্যদিকে ফিরে কাজ করতে ব্যস্ত। বিনী খানিকটা ভয়াল গলায় বললো ‘ কি বললো বাবা ? ‘
‘ বলছিলেন তোমাকে আর আবিরকে কিছুদিনের জন্য তোমাদের বাড়ি থেইকা ঘুইরা আসতে। ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় শান্তি পেলো বিনী। যাক তার কাজটা জহির সাহেবই করে দিলেন। কিন্তু চিন্তার বিষয় অন্য জায়গায়। শাহিদা খাতুন কি আদৌ রাজি হবেন ? অথচ আবির তো বললো অনুমতি নিয়ে রাখতে। অনুমতি নিতে না পারলে তো ও রেগে যাবে। বলে তো রেখেছে বিনীদের বাড়ি যাবে বলে হাসপাতাল থেকে ছুটি নিবে। এখন যদি বিনী ছুটি নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে তো বেচারার এত ঘটা করে ছুটি নেওয়া ব্যর্থ হবে।
মন খারাপ করেই বিনী বললো ‘ আপনি কি বললেন ? ‘
‘ যেটা বলার সেটাই বলছি। ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় মন খারাপ হলো বিনীর। ও মুখে শুধু ‘ ওহ ‘ বলে কাজে মন দিলেন। শাহিদা খাতুন ওর কাটা ছোট মাছগুলো ঝুড়িতে নিয়ে ধুতে ধুতে বললেন ‘ জলপাইয়ের আচার আছে। কিছুদিন আগেই বানিয়েছি বানাইসি। কাল যাওয়ার সময় মনে কইরা নিয়া নিও। আসফির তো পছন্দ। ‘
শাহিদা খাতুনের মুখে যাওয়ার কথা আর বোনের নাম শুনে চমকে উঠলো বিনী। অবাক হয়ে বড় বড় চোখে বললো ‘ তাহলে কি আমি আর আবির যাবো বাড়িতে ? ‘
‘ নাম ধইরা বলো কেন ? স্বামীকে নাম ধরে ডাকতে নেই। খুব প্রয়োজন হইলে ঘরে ডাকবা কিন্তু সবার সামনে ডাকবা না। আমি বইলা কিছু বলি নাই কিন্তু অন্যরা ছাড়বে না। আর তোমাদের বাড়ি যাওয়া নিয়া এত প্রশ্ন কেন ? নিয়ম যখন একটা আছে তখন তো পালন করতেই হইবো। নিয়ম পালন তো আর আমার অনুমতির অপেক্ষায় আইটকা থাকব না। কাল যাওয়ার সময় আবিররে নিয়া গিয়া ভাইজান, আপা আর আসফির জন্য মার্কেট থেইকা ভালো কিছু কিনা নিয়া যাইও। ‘
বিনীর আনন্দ দেখে কে। আনন্দে ওর চোখে জল এলো। ও মাছ গুছাতে গুছাতে বললো ‘ আপনি অনেক ভালো আম্মা। ‘
শাহিদা খাতুন যেন বিনীর কথা শুনেও শুনলেন না। মুখে বলতে থাকলেন ‘ পেঁয়াজের আচারও বানাইছিলাম। ওইটা নিয়া যাইও। তোমার আম্মারে বলিও তার মেয়ে আমাগো বাড়িতে খুশি আছে। যেন চিন্তা না করে। মনে থাকবে তো ? ভুইলা যাইও না বলতে। মনে কইরা বলবা। ‘
বিনী শুধু আনন্দে মাথা নাড়ল। তার চোখে জল এখন ছলছল করছে। আনন্দের জোয়ারে তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কোনোমতে গলা ভিজিয়ে বললো ‘ ভুলবো না আম্মা। ‘
—-
বিনী কাজকর্ম শেষে খাওয়া দাওয়া করে কি করবে বুঝতে পারলো না। বাড়ির সকলেই ঘুমোচ্ছে এখনও। বাড়িতে নতুন এসেছে সে। তার বিয়ের মাত্র দুইদিন।এখনই রান্নাঘরে ঢুকে শাহিদা খাতুনকে না জানিয়ে তার শখের রান্নাঘরে রান্না করাটা দৃষ্টি কটু। কিন্তু কিছু করারও তো নেই।
কিন্তু বিনীকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না। পাঁচটা বাজতেই ঢুলু ঢুলু চোখে জাবিয়া এসে হাজির। সে জানালো শাহিদা খাতুন বিনীকে ডাকছে। বিনী শাশুড়ির ডাকে দ্রুত ছুটে গেলো। বসার ঘরে বসে আছেন শাহিদা খাতুন।
বিনী ঘরে ঢুকতেই দেখলেন শাহিদা খাতুন আফিফার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। বিনীকে দেখে উনি বললেন ‘ দুই মিনিট বসো। চুলের তো তুমি কাকের বাসা বানাইসো। আগে বড় বউরে তেল দিয়া দেই তারপর তোমারে ধরতেছি। বুঝিনা এসব ভাই। মানুষ এখন কত কত ইস্টাইল করে। ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী শাহিদা খাতুনের পাশে গিয়ে বসল। আফিফাকে তেল দিয়ে দেওয়া শেষে আফিফাকে উঠিয়ে দিলেন আর বিনীকে সামনে এসে বসতে বললেন শাহিদা। বিনী শাশুড়ির কথা মতোই কাজ করলো। শাহিদা বিনীর মাথায় তেল দিয়ে দিতে দিতে বললেন ‘ চুলের এই অবস্থা কেন ? একেবারে ঝাড়ুর মতো লাগছে। একটু তেল দিতে হয় তো নাকি ? ‘
বিনী শাহিদা খাতুনের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিল। শাহিদা তার চুল টেনে টেনে তেল দিয়ে দিচ্ছে। তেল দিতে দিতেই তিনি বললেন ‘ পারলে জামাইরে দিয়া একটু চুলে তেলতুল দেওয়াইবা। পুরুষ মানুষরে বেশি ছাড় দিতে নাই। বেশী স্বাধীনতা পাইলে মাথায় চইড়া বসে হেরা। এগুলান তো বলার বিষয় না। আর যেন অমন ফাটা ফাটা চুল না দেখি। আমি কি বলছি বুঝছ ? ‘
বিনী এবারেও মাথা নাড়ল। শাহিদা খাতুন আরও অনেক কথা বললেন কিন্তু সেদিকে বিনীর মন নেই। সে ভাবতে ব্যস্ত শাহিদা হয়তো সামনে দিয়ে নিজেকে কঠিন দেখান কিন্তু উনি ভিতর দিয়ে নারিকেলের মতোই নরম। উনার শাসন ভরা কথা শুনলেও বুকটা সুখ সুখ অনুভব হয়। বিনীর শুধু ইচ্ছে করে শুনেই যাক মানুষটার কথা

————————-
পরের দিনের জন্য সবজি কেটে রাখছেন শাহিদা খাতুন আর বিনী। আফিফা আর জাহানারা রান্নাঘরে রাতের খাবার জ্বাল বসাচ্ছেন। বিনী কাজ করতে করতে নীরবে শাহিদা খাতুনের কথা শুনছে। ওদের কথাবার্তার মাঝেই আবির ফিরলো। আজ একটু দ্রুতই ফিরেছে সে। সে বাড়ি ফিরতেই শাহিদা খাতুনের চেহারার ভাব বদলে গেলো। উনি গম্ভীর মুখে ছেলেকে টিটকারী মেরে বললেন ‘ বিয়া করলা অথচ বউ সেবার নাম নাই। এই লেগাই বউয়ের মাথার চুলের এই অবস্থা। একেবারে কাকের বাসা হইয়া আছে। ‘
আবির শাহিদা খাতুনের কথা শুনলো তবে উত্তর দিলো না। ছেলেকে চুপ দেখে শাহিদা বললেন ‘ যেমন বাবা তেমন তার ছেলে। বাপে জীবনে চুলে তেল দিয়ে দিবার চায় নাই। ছেলেগুলাও হের মতোই রসকষ ছাড়া হইসে। বউয়ের সেবা করলে যে সওয়াব হয় হেইডা আর কেউ জানেনা। ‘
আবির এতক্ষণে মুখ খুললো। বললো ‘ আমি জানতাম বিয়ে হওয়ার পর মায়েরা ছেলেদের আরও নিজের দিকে টানার চেষ্টা করে ছেলে হারানোর ভয়ে। কিন্তু আপনার আপনার ছেলের থেকে ছেলের বউয়ের প্রতি চিন্তা বেশি। আমাকে দেখি উল্টো বিনীর সেবা করতে বলছেন। ‘
‘ তোমার কি আমারে ওসব মায়ে গো মতো মনে হয় যারা এত বছর পাইলাপুইসাও বিয়ের পর ছেলেরে হারাতে ভয় পায় ? তয় জাইনা রাখো আমি অমন মহিলা না। আমি জানি আমি মইরা গেলেও আমার ছেলেরা আমারই থাকবো। কিন্তু বিয়ের পর হেরা শুধু আমার ছেলে না,আরেক মাইয়ার স্বামীও। তাই তাগো ভালো স্বামীও হইতে হইবো। আমাগো বাড়ির বউয়েরা শুধু বউ না আমাগো সম্মানও । হেগো অবমাননা আমি শাহিদা খাতুন, বাইচা থাকতে মানুম না। ‘
আবির মায়ের কথা শুনে হাসলো আর বিনী হতবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। আবির সিড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে শুনলো শাহিদা খাতুন বিনীকে বলছেন ‘ যাও জামাইয়ের পিছে পিছে যাও। জিজ্ঞেস করো কিছু লাগবো কিনা। ‘
শাশুড়ির কথার অবাধ্য হলো না বিনী। সে আবিরের পিছু পিছু ঘরে এলো। আবির ঘরে এসে দপ্তরের ব্যাগ থেকে বেলি ফুলের প্যাকেটখানা নামিয়ে রাখলো। ঘর্মাক্ত শার্ট খুলতে খুলতে বললো ‘ আম্মা কিন্তু তোমাকে বেশ পছন্দ করেন। চুলে কি আম্মা তেল দিয়ে দিয়েছেন ? ‘
বিনী মাথা নেড়ে সায় দিল। তার ইশারা দেখে আবির বললো ‘ বলেছিলাম না আম্মা শুধু বাইরে দিয়েই শক্ত। আসলে সে তার ছেলের বউদের ছেলেদের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। ‘
আবির বাথরুমে ঢুকেছে গোসলে। বিনী ওর প্রয়োজনীয় জিনিস বিছানার উপর সাজিয়ে রেখে নিচে মেনে এসেছে। বেলি ফুলের মালাটা সে সযত্নে তুলে রেখেছে, রাতে আবির তাকে নিজ হাতে পড়িয়ে দিবে। বিনী নিচে এসে দেখলো শাহিদা খাতুন টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন। দেয়াল ঘড়িতে রাত সাড়ে নটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। একটু পরেই আজাদ সাহেব ও সাজ্জাদ সাহেব এসে হাজির হবেন রাতের খাবার খেতে। অফিস থেকে ফিরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন এতক্ষণ তারা।
বিনীও হাতে হাতে সবকিছু এগিয়ে দিল। খাওয়া দাওয়া হলো। খেতে বসে কথা কেউ বলেনি। সবশেষে শাহিদা খাতুন বিনী আর আফিফাকে বললেন ‘ তোমরা ঘরে যাও। ঘরের জানালা,দরজা আমি আর জাহানারা লাগায় দিমু। ‘
শাশুড়ির কথা অগ্রাহ্য কেউই করেনি। আফিফা গেল নিজের ঘরের দিকে আর বিনী উপরে উঠে এলো। ঘরে ঢুকেই সে দেখলো আবির তার জন্য বেলি ফুলের মালা হাতে বিছানায় বসে আছে। বিনী ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে পিঠ দিয়ে মেঝেতে বসে বললো ‘ বেণীটা খুলো না। আম্মা করে দিয়েছেন। ‘
বিনীর কথায় আবির হাসলো। বিনীর চুলে মালা জড়াতে জড়াতে সে বলল ‘ বুঝেছি। দুই শাশুড়ি,বউ মিলে এক দল হয়ে আমাকে শায়েস্তা করবে। আফিফা ভাবি তো এমনি করে। ভাইজানের উপর রেগে গেলে আম্মার কাছে নালিশ করে। আর আম্মা দেয় ভাইজানকে এক ধমক। আম্মার ধমক খেয়ে ভাইজান ওখানেই স্তব্ধ। আমরা দুই ভাইই আব্বা অপেক্ষা আম্মাকে একটু বেশি ভয় পাই। ‘
মালা গাঁথা শেষে বিনী তার বেণীর গোছা সামনের দিকে এনে দর্পণের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দর্পণে তার শাড়ি পড়া, বেণীতে বেলি ফুল জড়ানো প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। কালও আবির মালা গেঁথে দিয়েছিলো। কিন্তু পার্থক্য শুধু এটাই কাল সেটা বেণী করেছিল আবির আর আজ সেটা শাহিদা খাতুন। বিনীর মনে হচ্ছে তার মনে থাকা যৌথ পরিবারের প্রতি ভয়টা যেন আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে যৌথ পরিবার অতটাও ভয়ানক নয় যতটা লোকে বলে। তার মা সালমা ইসলাম শুধু শুধুই চিন্তা করছিলেন।
—-
আবিরকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে বিনী। আবির ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিনী ঘুম ঘুম পাচ্ছে। সে হাই তুলতে তুলতে আবিরকে বললো ‘ শুভ রাত্রি ‘।
আবির হাসলো। বললো ‘ এখন থেকে তাহলে রোজ আমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমিও। বালিশে তো আর তোমার ঘুম হয়না। ‘
আবিরের কথায় বিনী কিঞ্চিৎ লজ্জাই পেলো কিনা।সে আবিরকে ছেড়ে সরে যেতে চাইলো কিন্তু আবির ছাড়লে তো। আবির ওকে আগলে ধরে রেখেছে। অগত্যা বিনী আর জোরাজুরি করলো না। আবিরকে জড়িয়ে ধরেই সে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিলো।
—-
বিনীদের বাড়ি যাওয়ার আগে ও বাড়ির সবার জন্য কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিল আবির আর বিনী। কাজ শেষে দুজনেই ফিরে এসেছে। বাড়ি ফিরতেই শাহিদা খাতুন তাকে আর আবিরকে তাড়া দিলেন বেরিয়ে পড়ার জন্য।
শাহিদা খাতুন একে একে বেশ কয়েকটা আচার বিনীর ব্যাগে ভরে দিলেন। সঙ্গে কিছু তরী তরকারীও দিলেন। সব মিলিয়ে বিনীদের তিনটে ব্যাগ হয়েছে। সবগুলোই গাড়িতে তোলা হয়েছে। মদু কাকা তুলে দিয়েছেন। মদু কাকা হলেন আবিরদের পুরনো ড্রাইভার। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আবির আর বিনী উঠে বসলো গাড়িতে। গাড়িতে উঠার আগে বিনী শাহিদা খাতুনকে তার আর আজাদ সাহেবের ওষুধ মনে করে খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
অবশেষে বিদায় নিয়ে বিনীদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ওরা। পথ স্বল্প তাই পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। ওরা পৌঁছতেই জহির সাহেব আর সালমা ইসলাম সঙ্গে আসফিয়া বেরিয়ে এলেন। বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মেহমান সব চলে গেছে আর প্রকান্ড বাড়িটাও খালি। সব জিনিস গুছিয়ে বিনী আর আবির গেলো ঘরে বিশ্রামের জন্য।
—-
দোকানে বসে হিসাবের অঙ্ক কষছে সরাব। এই মাসের হিসাবটা কিছুতেই মিলছে না। বারবার জগাখিচুড়ী হয়ে যাচ্ছে। আসল কথা মাথায় এক চিন্তা রেখে অঙ্ক কষতে বসলে এমনই হয়। বাধ্য হয়েই মাথা ঠাণ্ডা করতে অঙ্ক ছেড়ে উঠলো সরাব। মজুমদার মিয়াকে দোকানের দেখাশোনার কাজে বসিয়ে রেখে সে এগোলো টংয়ের দোকানের দিকে। এখন এক কাপ আদা চা খেলে তার মাথাটা ঠান্ডা হবে।
দোকানের বেঞ্চিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক বসাচ্ছিল সরাব। এমন সময় তার বিপদের বন্ধু আশরাফ এসে হাজির। এক কাপ দুধ চা দিতে বলে সে সরাবের পাশেই বসল। গম্ভীর মুখে বললো ‘ শুনলাম তুই তোর কাকাতো বোন রুনাকে বিয়ে করেছিস ? ‘
‘ হ্যাঁ ‘
সরাবের কথায় অসন্তুষ্টি নিয়ে আশরাফ বললো ‘ মানলাম বিনীদৃতাকে ভুলতে পারছিস না। তাই বলে এখন বিয়ে করে অন্য মেয়ের জীবন কেন নষ্ট করলি ? আগে কিছুদিন অপেক্ষা করা যেত না নাকি ? আগে তুই ওই মেয়েকে নিজের মাথা থেকে ঝাড়তি তারপর নাহয় বিয়ে করতি। ‘
‘ বিনীকে পছন্দ করতাম তারমানে এই না তার বিয়ে হয়ে যাওয়াতে তার দুঃখে আমি শোকাহত হয়ে আজীবন চিরকুমার থেকে যাবো। আমার আম্মা আছেন। তার দেখাশোনার জন্যও একজন প্রয়োজন। ‘ সরাব বিরক্তি মুখে বললো।
‘ কাকীর প্রয়োজনটা দেখলি অথচ নিজের সুখটা দেখলি না। ‘ এক প্রকার আফসোসের সুরেই বললো আশরাফ।
আশরাফ আর কোনো কথা বাড়ায়নি। সে সরাবের সঙ্গে নীরবেই চা খাচ্ছে। তাদের চা খাওয়ার মাঝেই অনির্বাণ এলো। সেও চা দিতে বলে সরাবদের মুখোমুখি বসলো। জিজ্ঞেস করলো ‘ বিনীদৃতা এসেছে জানিস ? ‘
অনির্বাণের কথায় আশরাফকে বিস্মিত দেখালেও চমকালো না সরাব। সে চা খেতে খেতে বললো ‘ বিয়ে হয়েছে তার। বিয়ের পর স্বামী নিয়ে বাবার বাড়ি ঘুরতে আসবে এটাই স্বাভাবিক। এটা সবে শুরু, তোর আর আমার জন্য তো ওর বাবার বাড়ি ঘুরতে আসা ও বিসর্জন দিবে না। ‘
অনির্বাণ আর আশরাফ দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিনীর বিয়ে হয়ে যাওয়াতে যে তাদের বন্ধু এরকম হয়ে যাবে এটা তাদের জানা ছিল না। দোষটা কি ছিল সরাবের ? তার ভালোবাসায় তো কোনো খাদ ছিল না। তাহলে এত ভালোবেসেও কেন মানুষটাকে পেলো না ?
—-
দুপুরে সকলে একসঙ্গে খেতে বসেছে। জহির সাহেব আবিরের দিকে মুরগি রোস্টের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন ‘ বাবা বেশি করে নাও। কোনো সংকোচ বোধ করো না। এটা তোমারই বাড়ি। ‘
‘ নিচ্ছি বাবা। ‘
আবির জহির সাহেবের কথায় নিচ্ছি তো বলে দিলো কিন্তু আদতে সে সংকোচ ঠেলে আগ বাড়িয়ে কিছুই নিতে পারছে না। সালমা ইসলাম আবিরের এই সংকোচ দেখে নিজ হাতে তরকারি দিয়ে দিলেন ওর পাতে। সম্মানিত চোখে আবির মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো সালমা ইসলামকে এবং খাওয়ায় মন দিল।
জহির সাহেব এবং আবিরকে খাইয়ে দিয়ে আসফিয়া, বিনী এবং সালমা ইসলাম একসঙ্গে আসফিয়ার ঘরে খেতে বসেছেন। ইচ্ছে করলে সবার সঙ্গেই খেতে পারতেন কিন্তু সালমা ইসলামের হুট করে আলাদা করে মেয়েদের নিয়ে একসঙ্গে খাওয়ার মনোবাসনা জেগে উঠেছে।
বিনী খেতে খেতে লক্ষ্য করলো সালমা ইসলাম কথা বলছেন না। বিনী ধীর লয়ে বললো ‘ মা বিয়েটা নিয়ে কি তোমার এখনও আপত্তি আছে ?তুমি এসে থেকে আবিরের সঙ্গে কথা বলনি। ‘
বোনের কথায় চোখ তুলে তাকালো আসফিয়া। সে জানতো সালমা ইসলামের মেয়ে যৌথ পরিবারে বিয়ে দেওয়া নিয়ে আপত্তি আছে। কিন্তু তাদের মা যে সেই রাগ এখনও পুষে রেখে নতুন জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলেনি সেটা তার জানা ছিল না।
মেয়ের কথার জবাবে কিছু বললেন না সালমা ইসলাম। বিনী খেতে খেতেই বললো ‘ যৌথ পরিবারে বিয়ে হয়েছে ভেবে তুমি যদি আবির এবং ওর পরিবারের সাথে সুসম্পর্ক না রাখো তাহলে সেটা তোমার সবথেকে বড় ভুল হবে। ‘
এরপর আর কথা হয়নি সালমা ইসলামের সঙ্গে বিনীর। হাত ধুয়ে সে ঘরে চলে এসেছে। আবির তখন ওর জন্য বসে অপেক্ষা করছিল। ওকে ফিরতে দেখে সে নড়েচড়ে বসলো। বিনী গিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। বললো ‘ এখানে তো চলে এলে। এখন আমার জন্য বেলি ফুলের মালা আনবে কে ?’
‘ কোনোকিছুই আমাকে তোমার জন্য বেলি ফুলের মালা আনা থেকে আটকাতে পারবে না। মালা তুমি পেয়ে যাবে। ‘
বিনী আবিরের কথার প্রতি উত্তরে কিছুই বলতে পারেনি কারণ ততক্ষণে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার আর জগৎ সংসারের প্রতি মন নেই। সে হারিয়েছে নিদ্রার রাজ্যে। বিনীকে ঘুমাতে দেখে আবির ভাবলো সময় আছে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়। সেও শুয়ে পড়লো।
—-
বিনীর ঘুম ভাঙলো আসফিয়ার ডাকে। আসফিয়া ওকে পাশ থেকে ডাকছে। বিনী বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। ওকে উঠতে দেখে আসফিয়া বললো ‘ আপা তুই বসার ঘরে চল। ‘
‘ কেন ? ‘ হাই তুলতে তুলতে বললো বিনী।
‘ শাহিদা আন্টি টেলিফোন করেছেন। ‘
শাহিদা খাতুনের কথা শুনে বিনী বিছানা ছেড়ে নেমে দ্রুত হাঁটা দিলো। বসার ঘরে তখন গম্ভীর মুখে সালমা ইসলাম বসেছিলেন। মেয়ে সবে বাপের বাড়ি এসেছে। এখনই তার শাশুড়ির ফোন করা উনার মনঃপুত হয়নি। বিনীকে ঢুকতে দেখে উনার কুঞ্চিত ভ্রু আরও কুচকে গেলো।
‘ আসসালামু আলাইকুম আম্মা ‘ সোফায় বসে কানে টেলিফোন ধরে বললো বিনী।
‘ সবকিছু নিলা অথচ বোনের লেইগা জলপাইয়ের আচারটা নিলা না। এমনে কেউ ভুইলা যায় ? ‘
শাহিদা খাতুনের কথা শুনে বিনীর কণ্ঠ খাদে নেমে গেলো। ও মৃদু গলায় অপরাধী সুরে বলল ‘ দুঃখিত আম্মা। মনে ছিল না। ‘
‘ হইসে হইসে এখন আর মন খারাপ করবার কোনো দরকার নাই। বাপের বাড়ি গেছো, এই কয়দিন প্রজাপতির মতো উইড়া বেরাইবা। ভুইলা গেছো বইলা মন খারাপ করবা না। আমি জাদিদরে পাঠাইসি। ও আচার নিয়া যাইতাছে। ‘
শাহিদা খাতুনের আদর মাখা শাসন শুনে বিনীর মনটা শান্ত হলো। আজ সারাটাদিন এই মানুষটার কথা শোনার জন্যই মনটা খচখচ করছিলো। ও বললো ‘ এত কষ্ট করার প্রয়োজন ছিল না আম্মা। দ্বিতীয়বার নাহয় নিয়ে আসতাম। ‘
‘ তোমার দ্বিতীয়বার যাওয়ার আশায় বইসা থাকা বোকামি। কখন না কখন যাবা সেই আশায় বসে থাকবো নাকি। বেশি কথা না বইলা জাদিদের কাছ থেইকা আচার নিবা আর তোমার আম্মার জন্য আমসত্তা পাঠাইছি। ওটাও নিও। এখন রাখো, সন্ধ্যার নাস্তার যোগান দেয়া লাগব। ‘
‘ আসসালামু আলাইকুম আম্মা। ‘
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম বউ ‘
নিজের চাওয়ার চেয়েও বেশি সম্মান শাশুড়ির কাছ থেকে পেয়ে অশ্রুসিক্ত বিনী যখন টেলিফোনটা রাখলো সন্দেহপ্রবণ সালমা ইসলাম তখনও তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে। মেয়ের চোখের পানি দেখে তার সন্দেহ হচ্ছে। মায়ের এই দৃষ্টি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিনী। আসফিয়াকে বললো ওর চাচাতো দেবর জাদিদ আসছে, সে আসলে যেন বিনীকে ডাকা হয়। আসফিয়া বোনের কথায় বললো সে ডেকে দিবে। বিনী ঘরের দিকে গেলো। তার একটু পরিপাটি হওয়া দরকার তাছাড়া আবির কোথায় সেটাও দেখতে হবে। ঘুম থেকে উঠে পায়নি তাকে।
————————-
বাসায় কলিং বেল বাজছে। বিনী রান্নাঘরে ছিল আর আসফিয়া ছিল খাবার ঘরে। কলিং বেল বাজার শব্দে সঙ্গে সঙ্গে সালমা ইসলামের কান খাড়া হয়ে গেছে। খাবার ঘর থেকে সদর দরজা কাছে হওয়ায় আসফিয়া এগিয়ে গেলো দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই দরজার ওপাশে পরনে এক কালো শার্ট ছেলেকে দেখলো সে। ছেলেটা অন্য পাশে ফিরে আছে।
‘ জি, কাকে চাই ? ‘
আসফিয়ার কথায় জাদিদ সামনে ফিরলো এবার। তবে সপ্তদশী আসফিয়ার সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপের পাপড়ির মতো ভরা টসটসে সৌন্দর্যের সামনে তার পুরুষালি সৌন্দর্য্য ফিকে পড়ে গেলো। সে তাকিয়ে রইলো অদ্ভুত সম্মোহিত চোখে। বিনীদের বাসায় আগে শুধু বিয়ের দিনই এসেছিল। বিনী আর আবিরের বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন তার এক্সাম থাকায় সে আসতে পারেনি।
বিয়ের দিনও তো এসেছিল জাদিদ। তখন তাহলে এই সুন্দরী কমলা ছিল কোথায় ? কোথায় তাকে তো চোখে পড়েনি। জাদিদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আসফিয়া ভ্রু কুঞ্চিত চোখে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই বিনী এসে হাজির। বেসন মাখানো হাতে জাদিদকে দেখে সে বললো ‘ যাক এসেছ। তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল। এর আগে মাত্র একবার এসেছ। বলা যায়না পথ চিনে আসতে পারতে কিনা। দাড়িয়ে আছো কেন ? ঘরে আসো না। ‘
বসার ঘরের সোফাতে বসে আছে জাদিদ। তার সামনেই মুখোমুখি সালমা ইসলাম। তিনি তীক্ষ্ণ নজরে ওকে দেখছেন যেন অপরাধীর অপরাধ জরিপ করছেন। জাদিদ সালমা ইসলামের এই দৃষ্টির সামনে অসস্তিতে পড়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। তাকে অসস্তির হাত থেকে বাঁচাতেই বিনীর আগমন। ও পেঁয়াজু,বেগুনি, আলুর চপ ভেজে এনেছে। ওকে চা, নাস্তা নিয়ে ঢুকতে দেখে জাদিদ বললো ‘ কি প্রয়োজন ছিল এতকিছু করার ? আমি তো আর থাকতে আসিনি। ‘
‘ আমার কি করার প্রয়োজন ছিল সেটা নাহয় আমিই বুঝবো। তুমি শুধু খাও। আসফিয়া পানির গ্লাসটা নিয়ে আয়। ফেলে এসেছি গ্লাস। ‘
জাদিদের কথার বিপরীতে বললো বিনী। বিনীর ডাকে আসফিয়া পানির গ্লাস নিয়ে এলো। জাদিদের সামনে থাকা টি টেবিলে গ্লাস রাখলো সে। গ্লাস রেখে সোজা হয়ে হাঁটা দিতে গিয়েই সে লক্ষ্য করলো জাদিদ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে নেই কোনো লালসা কিংবা কামুকতা। শুধুই আছে মুগ্ধতা। জাদিদের এই মোহময়ী দৃষ্টির সামনে বেশিক্ষণ টিকলো না আসফিয়া। দ্রুত সে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আবিরের চাচাতো ভাইয়ের আগমনে বেশ বিরক্ত সালমা ইসলাম। এমনিতেই মেয়ের যৌথ পরিবারে বিয়ে মেনে নিতে পারছেন না। তার উপরে মেয়ে বাপের বাড়ি আসতে না আসতেই শাশুড়ির ফোন আর এখন দেবরের আগমন। বিনীর বিয়ের পর থেকে তার শশুর বাড়ির প্রত্যেকের কাজেই যেন সালমা ইসলাম অনৈতিকতা খুঁজে পাচ্ছেন। উনি শুধু শুধুই বিরক্ত হয়ে পড়ছেন।
চা, নাস্তা খাওয়া শেষে বিনীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো জাদিদ। সে অবশ্য আশা করেছিলো যাওয়ার পূর্বে একবার হলেও আসফিয়ার চাঁদ মুখখানা তার নজরে পড়বে কিন্তু আসফিয়া সেই সময়ের পর আর দেখা দেয়নি। বাধ্য হয়েই মন খারাপ বেশে সে ফিরে গেলো ক্লান্ত,পরাজিত পথিকের ন্যায়।
এতক্ষণ সালমা ইসলামের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ লক্ষ্য করেছে বিনী। ও জানে সালমা ইসলাম ওর শশুর বাড়ির লোকদের পছন্দ করেন না। এর পিছনে অন্যতম কারণ হলো তার অমতে বিনীর বিয়ে যৌথ পরিবারে হয়েছে। উনি কখনোই চাননি উনার দুই মেয়ের একজনও যৌথ পরিবারে বিয়ে করুক। নিজে এত বছর যৌথ পরিবারে বিয়ে করে শাশুড়ি, ননদ, জায়েদের কাছে অত্যাচারিত হয়েছেন। নিজের মেয়ের বেলায় এমনটা তিনি মেনে নিবেন না।
সালমা ইসলাম তার বেলায় ঘটা ঘটনাগুলোর জন্য অবচেতন মনেই ধরে বসে আছেন যৌথ পরিবারে বিয়ে হওয়া মানেই জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া। কিন্তু উনার খেয়ালে নেই সব মানুষ এক নন। যেই মানুষটার মনেই যৌথ পরিবার সম্পর্কে এত বড় খারাপ ধারণা পুষে রাখা তাকে আর বোঝানো যায় না। অবুঝকে বুঝানো সম্ভব কিন্তু যে বুঝেও বুঝতে চায় না তাকে বুঝানো সম্ভব নয়।
—-
দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। রুনা চুলায় তরকারি রেখেই দ্রুত ছুটে গেলো দরজা খুলতে। রান্নাঘর ছেড়ে বেরোনোর আগে নূরজাহানকে বলে এসেছে তরকারিটা যেন দেখেন। দরজা খুলতেই ক্লান্ত শরীরে ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে উঠা সরাবের দেখা মিলল। হাতে বাদামি রঙের কাগজ মোড়ানো চারকোনা বস্তু।
রুনা দরজা খুলতেই সরাব ঘরে ঢুকলো। রুনা সরাবকে ফিরতে দেখে রান্নাঘরের দিকে গেলো। সরাব তখন সবে গায়ের শার্ট ঝুলে মেঝেতে বসেছে। রুনা শরবত হাতে ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর দিকে শরবতটা বাড়িয়ে দিয়ে রুনা বললো ‘ শরবতটা খাও ‘।
সরাব হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিল শরবত। সে আজ বড্ড ক্লান্ত। মাথা যেন ধরেছে।
শরবতের গ্লাসটা সরাবের হাত থেকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রুনা। যাওয়ার আগে বলে গেলো সরাব যেন দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে খেতে আসে। সরাব সেই মতে জামা কাপড় বদলালো তারপর হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলো। নূরজাহান আজ অনেকদিন পর ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছেন। সারাদিন রুনার সঙ্গ পেতে এখন আর ক্ষণে ক্ষণে মেজাজ হারান না।
‘ রুনাকে নিয়ে কাল কাছে কোথাও থেকে ঘুরে আসিস সরাব। মেয়েটা আমার সারাদিন ঘরে থাকে। তোদের বিয়ের পরে তো তোরা একসঙ্গে কোথাও যাসনি। ‘
নূরজাহান ব্যবহার যতই খারাপ করেননা কেন সরাব কখনও উনার কোনো কথার উপরে কিছু বলেনি কিংবা অবাধ্য হয়নি। কাজেই রুনাকে বাইরে নিতে গিয়ে ঘুরিয়ে আনার প্রস্তাবটা তার কাছে অসম্ভব কিছু মনে হলো না। তাছাড়া এমনিতেও তো এক না একদিন তার রুনাকে মেনে নিতেই হবে। আর যাই হোক রুনা তো তারই বিয়ে করা বউ।
নূরজাহানের কথায় রুনা আপত্তি করেছিল কিন্তু নূরজাহানের দৃঢ় ইচ্ছার সামনে রুনার সেই আপত্তি ফিকে পড়ে যায়। তাছাড়া তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া নিয়ে সরাব আপত্তি তো দূর উল্টো এক কথায় মেনে নেয়। সরাবের এই পরিবর্তনে স্তম্ভিত রুনা আর কথা বাড়ায়নি। সে চুপচাপ থাল প্লেট নিয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে যায়।
সরাব মেঝেতে কুপি জ্বালিয়ে দোকানের কাজ নিয়ে বসেছে। সকালে যেই হিসাবখানা মিলাতে পারেনি এখন তাই মিলাচ্ছে। তার হিসেব মিলানোর মাঝেই রুনা কাজ সেরে উঠানের শুকনো কাপড়গুলো নিয়ে এসে ঘরে এসে ঢুকলো। বাকি ঘরগুলোর কুপি নিভিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই তেলের যা খরচ বাড়ছে তাতে তাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের বেচেঁ থাকা কষ্টের হয়ে দাড়াবে।
সামর্থ্য থাকলেই সবসময় খরচ করতে নেই। ভবিষ্যতের জন্যও জমানো প্রয়োজন। সরাব কাল রুনাকে হাত খরচের টাকা দিয়েছিলো। রুনা তার পুরোটাই তুলে রেখেছে। সে তো ঘরেতেই থাকে কাজেই টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই। এর থেকে বরং টাকাটা তোলা থাকলে সেটা এক সময় ঘরের প্রয়োজনে কাজে লাগানো যাবে।
রুনা ঘরে ঢুকেই বিছানার উপর ফেলে রাখা শুকনো কাপড় গুছাতে ব্যস্ত। তাদের বাড়িটা ছোট। দুটো ঘর আর একটা রান্নাঘর সঙ্গে বাড়ির সামনে প্রকান্ড আঙ্গিনা। তবুও ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়ে সারাদিন সময় লেগে যায়। সকাল থেকে উঠেই ভাত বসানো তারপর তাড়াতাড়ি করে সরাবযে ভাত দেওয়া থেকে শুরু করে রাতে শুকনো কাপড় গুছিয়ে রাখা পর্যন্ত সবই সে আর নূরজাহান মিলে করে। তিনজন মানুষের সংসারে যা কাজ থাকে তার সব নূরজাহান এবং সে মিলে করাতে পরিশ্রম কম হয়।
সরাব তার হিসেবের খাতায় সংখ্যা বসাতে বসাতে বললো ‘ কাঠের টেবিলের উপর একটা বাদামী রংয়ের চারকোনা প্যাকেট আছে। ওটা নিয়ে এখানে এসে বস তো। ‘
রুনা তখন কাপড়গুলো গুছিয়ে রেখে বেতের চেয়ারের উপর রাখছিল। সকালে উঠে যার যার ঘরে কাপড়গুলো রাখবে। সরাবের কথায় কাঠের টেবিলের দিকে নজর দিল সে। একটা চারকোনা পেট মোটা বাক্স রাখা। রুনা সেটা হাতে তুলে নিয়ে সরাবের সামনে কুপি জ্বালানো আলোতে গিয়ে বসলো।
‘ বাক্সটা খোল ‘
রুনা সরাবের কথায় কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বাক্সটা খোলার কাজে হাত দিল। বাদামি রং এর মোড়ক সরাতেই করতেই ধীরে ধীরে উন্মোচন হলো রুনার কলেজের বইগুলো। রুনা তার নিজের বই দেখে অবাক হয়ে বললো ‘ এগুলো তো আমার বই। তোমার কাছে কি করে ? ‘
‘ বিয়ের বাহানা দিয়ে এই কয়দিন তো ঠিকই পড়াশোনা ছেড়ে ঘুরে বেড়িয়েছিস। এখন থেকে আর এসব চলবে না। আজ থেকে রোজ পড়তে বসবি। রোজ তো কলেজ যেতে পারবি না কাজেই শুধু পরীক্ষাটা দিলেই হবে। বিয়ে করে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে এমনটা হতে দিবো না আমি। ‘
রুনা সরাবের কথায় আজ শুধু অবাকই হচ্ছে। সরাব তাকে নিয়ে এত ভাবছে, তার পড়াশোনা বন্ধ হোক চায় না। সরাবের এই অল্প স্বল্প যত্ন তার মনে আনন্দের ধুম লাগিয়ে দিয়েছে। সে শুধু কোনোমতে মাথা নেড়ে বললো ‘ আচ্ছা ‘। সরাব ওর হিসাবের খাতায় সংখ্যা বসাতে বসাতে বললো ‘ পাশের বাড়ির রুমা খালা আছেন, উনি অনার্স পাস। উনার কাছেই এখন থেকে রোজ পড়বি। উনি নিজে এসে পড়িয়ে যাবেন তোকে। আমি কথা বলে রেখেছি তার সাথে। চলবে না ? ‘
রুনা সরাবের কথায় হাসলো। বলল ‘ দৌড়বে ‘। সরাব আড়চোখে একবার রুনাকে দেখলো। রুনার চোখে জল আর ঠোঁটে হাসি। মেয়েটার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে আজ তার শান্তি লাগছে। এই কদিন সে কথাই বলেনি ওর সাথে। কিন্তু এখন আর এমন করবে না। রুনা তো ওর নিজের বিয়ে করা বউ।
—-
আবিরের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিনী ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত তখন আনুমানিক তিনটে। বিনীর হঠাৎ ঘুম ভেংগে গেল। ঘুম ভেংগে সে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলো অথচ সে খাবার টেবিলে আবিরের জন্য বসে অপেক্ষা করছিল। তাহলে এখানে এলো কি করে সে ? বিনী চিন্তিত হয়ে অন্য পাশে ফিরলো কিন্তু আরেক পাশে ফিরতেই দেখলো আবির তার পাশেই হাতের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে।
আবিরকে দেখে খানিকটা চমকেই উঠলো বিনী। আবির কখন ফিরেছে সে টের পায়নি। অথচ আবির কি নিশ্চিন্তে তার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক চোখে। তার দৃষ্টির নেই কোনো নড়চড়। বিনীকে জেগে উঠতে দেখেও আবিরের মুখে কোনো রা নেই। সে ঘরের হলদে টিমটিমে বাতিতে এক নজরে দেখে যাচ্ছে বিনীকে।
হলদে টিমটিমে আলোতে বিনীর চোখ মুখ পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না তবে মুখের অদল বোঝা যাচ্ছে। আবির তাকিয়ে আছে বিনীর দিকে। বিনীর মায়া মায়া মুখখানা তার খুব প্রিয়। মনে হয় যেন এই মায়া ভরা অদলের মায়া সে কোনওদিন কাটাতে পারবে না।
বিনী অবাক হয়ে দেখছে আবিরকে। আবিরের এই দৃষ্টি সে এমন আগে দেখেনি। বাহিরে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টি ঝরছে। যেন এই গুরুগম্ভীর পরিবেশকে নিমেষেই প্রেমময় করে তুলবে। ক্ষণে ক্ষণে বাজও পড়ছে। বিনী কখনও বাজের শব্দে ভয় পায় না। কিন্তু আবিরের ওই ঘোর লাগা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বাজের শব্দ পেলো তখন সে কেপে উঠলো।
ভয়ে বিনীর কমলার কোয়ার মতো ঠোট দুটো কেপে উঠলো। শরীর কাটা দিয়ে উঠেছে। আবির কেমন সম্মোহন চোখেই সরে এলো ওর দিকে। ওর মায়াবী মুখখানা নিজের দুই হাতের আজলা ভরে তুলে নিলো। নিঃশব্দে অধরে অধর ছুয়ে দিয়ে নিজের প্রচ্ছন্ন অনুভূতির জানান দিলো। আবিরের অধরের স্পর্শে বরাবর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নিজেদের অন্তরঙ্গতার ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়া বিনীও যেন কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।
বিনীর এই কদিনের সংযমে ভাঙন ধরেছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। সেই এক রত্তি অশ্রুর দিকে তাকিয়ে মেঘ রাজ যেন হেসে উঠলেন। তিনি এক ইশারায় এলো হাওয়া এবং অভিমানী বর্ষণ দুয়েরই গতি বাড়িয়ে দিলেন। বিনীর লম্বা বেণীতে গেঁথে থাকা আবিরের কিয়ৎক্ষণ পূর্বে আনা বেলি ফুলের মালা চূর্ণ বিচূর্ণ হতে শুরু করেছে। নিঃশব্দ রাত হয়ে উঠেছে বেলি ফুলের মালায় জড়ানো এক অন্যরকম বিষণ্ণময় ভালবাসার রাত।
————————-
সবে সকাল আটটা…চারদিকে ঝলমলে রোদ্দুর। কাল মাঝ রাতের দিকে যে এত ঝড়,বৃষ্টি হয়েছে তার এখন কোনো নাম গন্ধই নেই। সূর্যি মামা পূর্বে উকি দিয়ে বহু ক্ষণ পূর্বেই। গরম গরম ভাত সরাবের পাতে বেড়ে দিয়ে বসেছে রুনা। নূরজাহান খেয়ে উঠেছেন একটু পূর্বে। সরাব এতক্ষণ ঘুমোচ্ছিল কিন্তু মাত্র উঠে হাত,মুখ ধুতে গিয়েছে সে। জামা, কাপড় বদলে একেবারে তৈরি হয়ে পাটিতে বসলো ও।
সরাবের পাতে এক পাশে আলু ভর্তা এবং শিং মাছ দিয়ে আলুর তরকারি দিলো রুনা। রুনার তরকারি দেওয়া হতেই সরাব দ্রুত খাওয়ার কাজে মন দিল। খেয়ে বের হতে হবে তার। আজ তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে দুপুরের দিকে ফিরবে তারপর খেয়ে দেয়ে রুনাকে নিয়ে কাছের এক পার্কে যাবে। রুনার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে এবং সে রুনাকে তার ভরণ পোষণও দিচ্ছে কিন্তু সেটা আক্ষরিক অর্থে। তাদের বিয়ের পর এখন পর্যন্ত শরীয়ত সমেত সে স্বামীর সব দায়িত্ব পালন করে উঠতে পারেনি।
সরাব তার চিন্তা ভাবনা করতে করতেই ভাত খাচ্ছিল কিন্তু লক্ষ্য করলো রুনা খাচ্ছে না, ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে তাকে এক দৃষ্টে দেখে যাচ্ছে। সরাব জানে রুনা তাকে রেখে খায়না কখনও। কিন্তু এখন সে খাওয়া সত্ত্বেও খাচ্ছে না কেন ? সরাব বললো ‘ কি ব্যাপার ? খাচ্ছিস না কেন ? ‘
‘ তুমি খাও, আমি পরে খাচ্ছি। ‘
রুনার সুমিষ্ট হাসি দেখে খানিকটা অবাক হলো সরাব। রুনার হাসিটা বড্ড সুন্দর। একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই সুন্দর বলা যায়। হাসলে তার গণ্ডদেশে টোল পড়ে। রুনাকে সরাব আগেও হাসতে দেখেছে কিন্তু কোনওদিন এভাবে মন দিয়ে তার সেই টোল পড়া হাসি দেখেনি। দেখলে হয়তো বিনী নামক সেই বসন্তের কোকিলের প্রেমে সে পড়তো না যে এসেছিল তার জীবনে শুধুই ক্ষণিকের জন্য।
‘ আমার পরে খেতে হবে কেন ? আমার সঙ্গে খেলে কি সমস্যা ? তোর কি আমার সঙ্গে খেতে বসা পছন্দ না ? ‘
সরাবের কথায় রুনা বললো ‘ হ্যাঁ বলেছে তোমাকে!! তোর কি আমার সঙ্গে খেতে বসা পছন্দ না ?’ শেষের কথাটা রুনা সরাবের মতোই ভেঙ্গিয়ে বললো। সরাব ওর কথা বলার ধরন দেখেও কিছু বলল না। সে নিজে খেতে ব্যস্ত। রুনা তার পাতে ভাত বাড়ছে।
—-
কলেজ শেষে বান্ধবীদের সঙ্গে করে বাড়ির দিকে হাটা দিবে আসফিয়া। বাড়ি থেকে তার কলেজের পথ অনেকটা। তাই পুরোটা পথ যাতে একা আসা যাওয়া করতে নাহয় তাই সে কিছু বান্ধবী জুটিয়ে নিয়েছে। রোজকার মতোই বান্ধবীদের নিয়ে কলেজের বাহিরে এসে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু আজ কলেজের সামনে এক নতুন মুখ দেখতে পেলো আসফিয়া। কলেজের সামনে দাড়িয়ে আছে এক সুদর্শন চেহারার চেনা পুরুষ।
জাদিদের ভার্সিটি থেকে আসফিয়ার কলেজের দুরত্ব বেশি নয়। পায়ে হেঁটে মাত্র দশ মিনিট। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই ভার্সিটি শেষে আসফিয়ার কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে জাদিদ। জাদিদকে দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না আসফিয়া। বরং সে না দেখার ভান করে এড়িয়ে এগিয়ে গেলো।
আসফিয়ার দুই বান্ধবী রানী আর কুসুমও লক্ষ্য করেছে জাদিদকে। কিন্তু নিত্য দিনের পথচারী ভেবে আর তাকে নিয়ে ভাবান্তর দেখা দেয়নি তাদের মাঝে। তারা নিশ্চিন্তেই বান্ধবীর পিছনে এগিয়ে গেছে। আসফিয়াকে এগিয়ে যেতে দেখে জাদিদও এগিয়ে গেলো ওদের পিছনে। তবে তা দূরত্ব বজায় রেখে।
জাদিদের থেকে মিটার কয়েক সামনেই আসফিয়া এবং তার বান্ধবীরা হাঁটছে। রানী আর কুসুম গল্পে ব্যস্ত। আসফিয়া কথা বলছে না, সে শুধুই তার দুই সখীর কথা শুনছে। জাদিদের হাসি পেলো। একটা আস্ত মানুষ এই তিনজনের পিছন পিছন হাঁটছে অথচ এখন পর্যন্ত কেউ ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো না। স্বাভাবিক মানুষ হাঁটলেও তো চারদিকে নজর রাখে। অথচ তারা মশগুল নিজেদের গল্পে।
আসফিয়াদের বাড়ি থেকে কিছুটা আগেই কুসুম আর রানীর বাড়ির রাস্তা আলাদা হয়ে যায়। তিনজন যাচ্ছে তিন দিকে। আসফিয়া তার বন্ধুদের ছেড়ে বাকি রাস্তা একলা যাওয়ার জন্য এগোলে আসফিয়াকে একা পেয়েও জাদিদ এগিয়ে গেলো না। সে পূর্বেই মতোই দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে।
আসফিয়া বান্ধবীদের থেকে আলাদা হয়ে কিছুটা এগোতেই হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে জাদিদকে বলল ‘ আপনি কি আমায় অনুসরণ করছেন ? ‘
এই প্রথম আসফিয়া জাদিদের সঙ্গে কথা বলেছে। জাদিদ আসফিয়ার কথা শুনে এগিয়ে গেলো। আসফিয়ার পাশাপাশি সামান্য দুরত্ব বজায় রেখে হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ মোটেই না। আমি ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। ‘
‘ কিন্তু আপনার ভার্সিটি তো আমার কলেজের উল্টো দিকে পড়ে। তাহলে আপনি এখানে আমার কলেজের সামনে কি করছিলেন ? আমার কলেজ দেখছিলেন বুঝি ? ‘
জাদিদ জানে সে অনেকক্ষণ পূর্বেই ধরা পড়ে গেছে। তবুও আসফিয়ার এই কথায় সে হাসি আটকে রাখতে পারলো না। ঠোঁট চেপে হেসে দিল সে। আসফিয়া ওর হাসি দেখে কিছু বলল না। একাকি,নীরবে তারা পথ চলতে লাগলো। আসফিয়াদের বাড়ির গলির কাছে এসে জাদিদ আর এগোলো না।
আসফিয়ার সঙ্গে জাদিদের পথ অতটুকু অব্দিই। এখন বাকিটা আসফিয়া একলা চলবে। জাদিদ থেমে গেছে, তার সঙ্গে আর এগোবে জানার পরও থামলো না আসফিয়া। সে নিরন্তর পথ চলতে চলতেই একসময় পিছন ফিরে বললো ‘ এভাবে করে রোজ উস্কোখুস্কো চুলে, আলুথালু হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াবেন না বেয়াই সাহেব। এই সমাজ আপনার চাওয়া কখনোই বুঝবে না। ‘
জাদিদ এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আসফিয়ার যাওয়ার পথে। আসফিয়া এরপর আর একবারও তার দিকে ফিরে তাকায়নি। সে হেঁটে যাচ্ছে আপন মনে। একসময় তার মায়াবী অবয়ব গলির মোড়ে হারিয়ে গেলো। জাদিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরতি পথে হাঁটা দিলো। বইছে মৃদু হাওয়া সঙ্গে ঝরা পাতার খচখচ শব্দ।
—-
কাল ধুয়ে দেওয়া কাপড়গুলো ছাদ থেকে তুলে এনেছে বিনী। এখানে তার শাড়ি আর আবিরের শার্ট, প্যান্ট, লুঙ্গি আছে। কাপড়গুলো বিছানায় রেখে সে গুছাতে ব্যস্ত। আবির তখন ঘরের এক কোণায় থাকা আরাম কেদারায় বসে নিত্য দিনের খবরের কাগজ পড়ছে আর এক সিপ এক সিপ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। খবরের কাগজ পড়তে পড়তেই ‘ ঘুড়ে বেড়ানো ‘ শিরোনামে একটা পার্কের ছবিতে নজর পড়লো আবিরের।
আবির আর বিনীর বিয়ের পর থেকে তারা একদিনও কোথাও একসঙ্গে ঘুরতে বের হয়নি। আবিরের মনে হলো সে এখন ছুটিতে আছে, শশুর বাড়ি এসেছে। এটাই মোক্ষম সময় তার আর বিনীর বাহিরে বেড়াতে যাওয়ার। দূরে কোথাও নয়, এখানেই কাছের কোনো পার্কে।
যেই ভাবা সেই কাজ। আবির ভাবলো বিনীকে এখন বলবে না। বিকেলে হুট করে না জানিয়ে নিয়ে যাবে তারপর চমকে দিবে। তাই আবির আর তার মনে মনে চলা পরিকল্পনা সম্পর্কে উচ্চবাচ্য করলো না। তারা নিত্য দিনের মতোই দুপুরে খাওয়া দাওয়া করলো তারপর সবশেষে বিশ্রাম নিতে যে যার যার ঘরে গেলো।
বিকেলে বিনীর ঘুম থেকে উঠতেই আবির তাকে বললো তৈরি হয়ে নিতে, তাদের বাহিরে যেতে হবে। আবিরের কথায় বিনী খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘ বাহিরে কোথায় ? আগে বললে না যে ? ‘
‘ আছে এক জায়গা। আগে জানতাম না, হঠাৎ করেই ঠিক হলো। ‘
আবির তখন হাতে ঘড়ি পড়তে ব্যস্ত তাই বিনী আর কোনো কথা বাড়ালো না। ও শাড়ি পরে তৈরি হয়ে নিলো। দর্পণের দিকে তাকিয়ে কপালের মাঝখানটায় কালো টিপ জুড়ে দিল। হাতে এক গোছা কাচের চুড়ি আর কপালে টিপ। এ যেন কোনো স্বর্গের দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসেছে রূপমাধুরী। আবির বিনীকে দেখে কিছু বলতে গিয়েও যেন বললো না। স্রেফ এগিয়ে গিয়ে বিনীর কপালের টিপটা ঠিক করে দিলো।
—-
রুনার খুশি যেন আজ ধরা যায় না। সে শাড়ি পড়ে রিমঝিম নূপুর পায়ে বেণীতে বকুল ফুলের মালা জড়িয়ে ঘরময় বিচরণ করছে। তার মৃদু খিলখিলে হাসি বাতাসের গায়ে ঝংকার লাগাচ্ছে। নূরজাহান নিজের ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘুমোচ্ছেন আর রুনা আছে সরাবের প্রতীক্ষায়। সরাবের আজ দুপুরে বাড়িতে ফেরার কথা ছিল কিন্তু সে জরুরি কাজে আটকে পড়ে আর ফিরতে পারেনি বাড়ি। তবে মজুমদার মিয়াকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে যে সে অবশ্যই বিকালে রুনাকে নিয়ে বেরোবে। রুনা সেই প্রতীক্ষাতেই দিন গুনছে।
রুনার অপেক্ষার দীর্ঘতম প্রহর কাটিয়ে যখন সরাব বাড়ি ফিরলো তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা। চারটা থেকে রুনা তার অপেক্ষায় বসে আছে কিন্তু সরাবের কোনো দেখা নেই। বিষণ্ণ রুনা তখন চোখের কাজল লেপ্টে দিয়ে অভিমানী মেঘবতীর মতো কাদতে বসেছে। সে যখন হু হু করে কাদতে ব্যস্ত তখনই সরাব এসে ঘরে ঢুকল। রুনাকে কাদতে দেখে সে এগিয়ে গেলো। রুনার সামনে মেঝেতে বসে রুনার কাধে হাত রেখে বলল ‘ কিরে কাদছিস কেন ? ‘
দুঃখিনী রুনা যখন কাদতে কাদতে সরাবের ডাক শুনে মাথা তুললো তখন এই প্রথম সরাবের মনে হলো রুনার হাসির সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুটোও নজরকাড়া। হরিণী চোখের সঙ্গে দোহারা চেহারা যেন একটু বেশিই মানিয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো গোলাপের পাপড়ির মতোই কোমল আর সতেজ। সরাব ভাবলো এই দোহারা সুন্দরীকে কেন সে আগে দেখেনি ? দেখলে অতিথি পাখির ফাঁদে পড়তে হতো না তার ।
সরাবের মনে এক কঠিন ধারণা ছিল যে একমাত্র বিনীর চোখই তার কাছে সৌন্দর্যের প্রতিমা। অথচ জলে ভেসে যাওয়া রুনার হরিণী ছলছল চোখ যেন অন্য কিছু বলে। তাকে নিজের দিকে সমুদ্রের ভাটার মতোই টানতে টানতে বলে ‘ এসো সরাব এসো, এই অনিন্দ্য সুন্দরীর চোখের প্রেমে পড়ো। ‘
” তুমি এত দেরি করলে ? আমি ভেবেছিলাম তুমি ফিরবেই না। ”
সরাব ব্যস্ত ছিল রুনার চোখের ভাষা বোঝার দায়িত্বে। কিন্তু রুনার ডাকে তার গতি হলো। সে খানিকটা হেসে রুনার গোলগাল মুখে হাত রেখে বলল ‘ কথা যখন দিয়েছি তখন ফিরবোই। তুই বস… আমি তৈরি হয়ে আসছি। ‘
কথাগুলো বলে সরাব উঠে গেলো আর রুনা এই কদিনে প্রথমবার সরাবের কণ্ঠে তার প্রতি স্নেহ পেয়ে আনন্দে ঝলমল করে উঠল।
—-
আবিরের সঙ্গে পার্কে এসে দাড়িয়েছে বিনী। আবির তাকে নিয়ে পার্কে আসবে এই আশা সে করেনি। কাজেই সে চমকে গেলো। সে শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আবিরের গমন পথে। আবির তার জন্য বাদাম কিনতে গেছে। তাকে পার্কের এক বেঞ্চে বসিয়ে দিয়ে গেছে। বাদাম কিনে যখন আবির ফিরছে তখন তার চোখে মুখে সুন্দর এক হাসি। বিনীর জন্যই যেন সেই হাসি।
‘ পার্কে আসবো এটা আমাকে আগে বললে না কেন ? ‘
বিনীকে বাদামের খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছিল আবির। বিনীর কথা শুনে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতেই বললো ‘ ভাবলাম বিয়ের তো কয়দিন হলো কিন্তু তোমাকে নিয়ে কোথাও গেলাম না। তাই ভাবলাম শশুর বাড়ি এসেছি, ছুটি আছে যখন একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। তোমার নিজেরও একটু ফ্রেশমেন্ট দরকার। বলা যায়না আবার কখন না কখন সুযোগ হয়। ‘
আবিরের কথায় বিনীর ঠোঁটের কোণ বেকে গেলো। যেন সে সকলের অলক্ষে প্রচ্ছন্ন হাসছে। আবিরও তার সেই হাসি দেখেনি কিন্তু হাসতে হাসতেই যখন বিনী অন্যদিকে তাকালো তখন ওর ঠোটের কোণে থাকা হাসি মুছে গেলো। সরাব এক অচেনা মেয়ের সঙ্গে পার্কে এসেছে। বিনী চিনে না সেই মেয়েকে কিন্তু সে আন্দাজ করতে পারছে মেয়েটা হয়তো সরাবের স্ত্রী। প্রেমিকা যে নয় সেটা সে ওদের দেখেই বুঝতে পেরেছে। দুজন একে অপরের পাশাপাশি হাঁটছে।
বিনী এবার বিষণ্ণ হাসি হাসলো। তার অনুপস্থিতি সরাবের জীবনে এত পরিবর্তন আনবে তার জানা ছিল না। কিন্তু সরাবকে ওই অচেনা মেয়ের সঙ্গে ভালই মানিয়েছে। কি সুন্দর মায়া মায়া মুখ মেয়েটার। দেখলেই যেন মন,প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিনী সেইদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তার প্রিয় মানুষটার সুখী মুহূর্ত অবলোকন করছে। এমন সৌভাগ্য হয় কতজনের।
সরাব রুনাকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে নিজে বাদাম আনতে এগিয়ে গেছে। রুনার গরম গরম খোসাওয়ালা বাদাম খুব প্রিয়। বাদাম নিয়ে ফিরতে ফিরতে সে ভাবলো রুনা আজ বাইরে বেরিয়ে অনেক খুশি। আনন্দে মেয়েটার চেহারায় এক অন্যরকম দ্যুতি খেলা করছে। এই প্রথম যেন কারোর খুশির কারণ হতে পেরে অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভব করলো সরাব। প্রশান্তিতে তার চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে গেলো। কিন্তু তার সেই হাসি মিলিয়ে গেলো যখন রুনার থেকে খানিকটা দূরে থাকা বেঞ্চে বিনী আর তার সঙ্গে বসা এক যুবককে দেখলো সে।
বিনী ও তার পাশে বসা যুবককে দেখে সরাবের মুখভাব থমথমে হয়ে উঠলো। তার এতক্ষণের হাস্যোজ্জ্বল চোখ দুটো খানিকটা চোখের জলে জ্বলজ্বল করে উঠলো। ও শক্ত চোখে সেই দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো সহসাই বন্ধ করে ফেললো। না এভাবে হেরে গেলে চলবে না। মানিয়ে নিতে হবে সবটা। নিজের জন্য আর রুনার জন্য। এই মেয়েটা তাকে ভালোবেসে নিজের সবকিছু ছেড়ে এসেছে। সে পারেনা এভাবে তার বিশ্বাসের সঙ্গে খেলা করতে।

পর্ব- ০৯
————————-
বাড়ি ফিরে বিনী সালমা ইসলামের থমথমে মুখ দেখলো। সালমা ইসলাম বিরক্তি মুখে জানালেন শাহিদা খাতুন ফোন দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এও জানালেন দুই দিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেছে বিনী। তাতেও কি মহিলার শান্তি নেই যে রোজ টেলিফোন করতে হবে। প্রথমে সরাবকে পার্কে এক অন্য নারীর সঙ্গে দেখা এরপর এখন আবার মায়ের এসব কথা শুনে বিনীর মনটা বিষিয়ে গেলো।
বিনী দূর্বল পায়ে বসার ঘরে সোফায় গিয়ে বসলো। টেলিফোনের ডায়াল প্যাডে শাহিদা খাতুনের বাড়ির নাম্বার চেপে কানে ধরলো ফোনটা। কিছুক্ষণ ভনভন শব্দ করে ঐপাশ থেকে কেউ বললো ‘ আসসালামু আলাইকুম, মিসেস শাহিদা খাতুন বলছি। ‘
শাহিদা খাতুনের কণ্ঠ শুনে বিনীর জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো উপচে আসতে চাইলো। সে শুধু কোনোমতে নিজেকে সামলে বলল ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম আম্মা। কেমন আছেন ? ‘
‘ বউ নাকি ? কেমন আছো ? আবিরের কি অবস্থা ?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি আম্মা। আবিরও ভালো আছে। আপনি যখন ফোন দিয়েছিলেন তখন আমরা দুজনে বাহিরে ছিলাম। আপনার কি কোনো জরুরী কথা বলার ছিল ? ‘
বিনীর কথায় আমতা আমতা করলেন শাহিদা খাতুন। কথাটা বলবেন কিনা বুঝতে পারছেন না। বললেও বিনীর প্রতিক্রিয়া যেমন হবে কে জানে। কিন্তু সাহস করে তো বলা প্রয়োজন। তাই তিনি বললেন ‘ না মানে জরুরি কিছু না। শুধু জানতে চাচ্ছিলাম বেয়াই, বেয়াইন কেমন আছেন ? তোমার বোন কেমন আছে ? ‘
শেষ মুহূর্তে শাহিদা খাতুন কথা আর বলতে না পেরে কথা ঘুরিয়ে দিলেন। শাহিদা খাতুনের মুখে সালমা ইসলামের নাম শুনে বিনীর এবার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেলো। সালমা ইসলাম তখন তার সামনেই বসে আছেন সোফাতে। বিনী যতবার শাহিদা খাতুনের সঙ্গে কথা বলতে বসার ঘরে আসে ততবারই তিনি কড়া পাহারায় থাকেন। এসবে বিরক্ত বিনী। সবকিছুর একটা সহ্য সীমা আছে যেটা সালমা ইসলাম পার করেছেন।
বিনী কোনোকালেই ধৈর্য্যধারী ছিল না কাজেই আজও তার ধৈর্য্যতে কুলালো না। সহসাই সে শাহিদা খাতুনকে বললো ‘ আম্মা আমি আর আবির কাল ফিরছি। ‘
যদিও ওদের ফেরার কথাটা সাহস করে বলতে পারছিলেন না শাহিদা খাতুন কিন্তু বিনী নিজ থেকে বলাতে শান্তি পেলেন তিনি। খুশি হয়ে বললেন ‘ তাই নাকি ? তাহলে আসো তোমরা। আমি বুলুকে দিয়ে তোমাদের ঘর পরিষ্কার করিয়ে রাখবো। ‘
এরপর আরও অনেক কথা শেষে বিনী ফোন রাখলো। সে ফোন রাখতেই এবার সালমা ইসলামের রাগত চেহারার মুখোমুখি হলো। তিনি ভীষন ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। তার সেই রাগের সামনে যে কেউ মিইয়ে যাবে কিন্তু বিনী দমলো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই উঠলো এবং বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এগোলো। ওকে বেরিয়ে যেতে দেখে সালমা ইসলাম যেন আরও বেশি রেগে গেলেন। বিশ্রী ভাবে বলে উঠলেন ‘ নিজের শশুর বাড়ির দালালি করছিস তাইনা ? কি দিয়েছে ওরা তোকে ? জাদু করে ফাঁসিয়েছে নাকি যে তুই এখন তোর বাপের বাড়ি থাকতে চাইছিস না ? ‘
‘ এটা আমার বাপের বাড়ি নয় মায়ের বাড়ি। এই বাড়ির উপর বাবার অধিকার কোন দিন ছিল বলতে পারবে ? মেয়েকে যৌথ পরিবারে বিয়ে দিয়েছে বলে তুমি এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলনি। আমি শশুর বাড়িতে মানিয়ে নিয়েছি বলে তোমার তাতেও সমস্যা। আমি আমার মায়ের বাড়ি থাকতে চাইছি না। যেদিন এই বাড়ি মায়ের বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি হবে সেদিন আমি থাকবো। যেখানে আমার শশুর বাড়ির সম্মান নেই সেখানে আমারও জায়গা নেই। অন্তত আমার শশুর বাড়ি বাপের বাড়ি নিয়ে কিছু বললে দালালি করছি বলবে না। ‘
মেয়ের এতসব তিক্ত কথায় কিছু বলার বোধ হারিয়ে ফেললেন সালমা ইসলাম। যেই মেয়েকে উনি এত ভালোবাসেন, যার জন্য দিনরাত খেটেছেন সেই এমন তর কথা বলবে তাতো অভাবনীয়। যেই মেয়ে কিনা ছোটবেলায় উনার সঙ্গ পাওয়ার জন্য কাদত সেই এখন শশুর বাড়ির হয়ে কথা বলছে। সব কি তবে যৌথ পরিবারে বিয়ে দেওয়ার ফল ?
ঘরে এসে নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে বিনী। আচমকা ওকে ব্যাগ গুছাতে দেখে আবির খানিকটা চমকে গেলো। ও অবাক গলায় বললো ‘ একি ব্যাগ গুছাচ্ছো কেন ? ‘
বিনী আবিরের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না। সে নিজের মতো ব্যাগ গুছিয়েই যাচ্ছে। তাকে চুপ থাকতে দেখে এগিয়ে গেলো আবির। বিনীর পাশে দাড়িয়ে কাধে হাত রাখলো। আবিরকে কাছে পেয়ে বিনীর গলার কাছে জমে থাকা কান্নাগুলো উপচে পড়লো। কেঁদে উঠে বলল ‘ আমি আর এখানে থাকতে চাই না আবির। আমাকে নিয়ে চলো তুমি বাড়িতে। আমি আম্মার কাছে যাবো। আমি এখানে থাকবো না আর। আর কখনো থাকবো না। এই বাড়ির লোকেরা শান্তি দিবে না। তুমি আমায় নিয়ে চলো। ‘
—-
রুনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সন্ধ্যাতেই বেরিয়ে গেছে সরাব। তারপর আর তার কোনো দেখা নেই। সেই থেকে রুনা বসে অপেক্ষা করেই যাচ্ছে কিন্তু সরাব ফিরেনি। নূরজাহান কিছুক্ষণ বকবক করে তারপর নিজে থেকেই খেয়ে দেয়ে শুতে গেছেন। আজকাল ছেলের এসব কাজে উনার মেজাজ শুধুই গরম হচ্ছে বৈকি ঠান্ডা হচ্ছে না। ছেলের ভাবগতি বোঝা যাচ্ছে না এটাই বড় সমস্যা।
রুনা বুঝতে পারছে না কি করবে সে। এখন কটা বাজে তার ধারণা নেই। ঘরে ঘড়ি নেই। তবুও রুনা আন্দাজ করলো প্রায় মাঝরাত এখন। কিন্তু সরাব যে ফিরছে না। সে কি আদৌ এসে খাবে ? না খেলে খাবারগুলো তো নষ্ট হবে। অনেক ভেবেচিন্তে রুনা তরকারিগুলো জ্বাল করে ভাতে পানি ঢেলে রাখলো যাতে কোনোটাই নষ্ট না হয়। সরাবের চিন্তায় তার নিজেরও খেতে মন চাচ্ছে।
সরাবের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রুনা একসময় অধৈর্য্য হয়ে লন্ঠন ধরিয়ে উঠে দাড়ালো। ঘরে বিদ্যুৎ নেই। এতক্ষণ অন্ধকারের মাঝেই সে বসেছিল যদি এতে কিছু তেল বাঁচে। এমনিতেই আজ বাহিরে ঘুরতে গিয়ে টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন সেসব টাকার খরচ পোষাতে হবে। অন্ধকারে থাকার কারণে মশার কামড়ও খেতে হয়েছে। মশার কামড় খেয়ে রুনার এখন অবস্থা বিবর্ণ। হাত পা সব জ্বলছে।
ভালোবাসার মানুষটার চিন্তায় শারীরিক যন্ত্রণা ভুলে লন্ঠন হাতে ঘরের বাহিরে ছুটে গেলো রুনা। সরাবকে এখন খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কে জানে কোনো বিপদে পড়লো কিনা। প্রচন্ড চিন্তায় রুনার মাথায় কিছু আসছে না। সে নূরজাহানকে জানাবে কি জানাবে না করে করেও দোনোমনা হয়ে কিছুই জানালো না। একাই লন্ঠন হাতে ছুটে বেরিয়ে গেলো।
লণ্ঠনের ঝাপসা আলোয় চঞ্চল রুনা তার পা দ্রুত চালিয়ে আঙ্গিনা পেরিয়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু দুশ্চিন্তায় তার আর খেয়াল হলো না আঙিনার বড় লোহার শিকলের গেটটা পেরিয়ে কেউ আসছে। সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। ততক্ষণে আঁধারে সেই আগন্তুক এগিয়ে এসেছে। ফল বশত যা হওয়ার তাই হলো। আনমনা রুনা তখন ধাক্কা খেলো বলিষ্ঠ দেহী এক আগন্তুকের গায়ে।
ধাক্কা খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে টালমাটাল রুনা পড়ে যাচ্ছিল কিন্তু আগন্তুক তাকে ধরে ফেললো। অন্ধকারে লোকটাকে ঠাওর করে উঠতে পারেনি রুনা। সে ভ্রু কুঞ্চিত চোখে লন্ঠন উপরে উঠিয়ে আগন্তুকের মুখের সামনে ধরলো। সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচন হলো বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির চিরচেনা মুখ। ফর্সাটে মুখশ্রীর সুদর্শন সরাব ঘেমে নেয়ে, উস্কখুস্ক চুলে শার্ট, জিন্স পড়ে উদভ্রান্তের মতো দাড়িয়ে আছে। তার চোখ দুটোতে কেমন ঘোর লেগে এসেছে। এক নজরে তাকিয়ে আছে রুনার দিকে।
লন্ঠনের আলোয় লালিমা মাখানো রুনার দোহারা চেহারা দেখে এই প্রথমবারের মতো বুকের কোথাও এক সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলো সরাব। লন্ঠনের সোনালী আলো রুনার গোলগাল মুখে আছড়ে পড়ছে। যেন এই আলো রুনাকে ছুঁয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় তৎপর। সামান্য এই লণ্ঠনের এত বড় দুঃসাহস দেখে অবাক হলো সরাব। যেই নারীকে এখনও সেই ছুঁয়ে দেখেনি তাকে কিনা অর্থ বিত্তে সামান্য এক লন্ঠনের আলো ছুঁয়ে দিয়েছে। এত বড় স্পর্ধা তো অভাবনীয়।
সরাবের হা হয়ে যাওয়া মুখ আর স্তব্ধ হয়ে যাওয়া চোখের দৃষ্টি দেখে রুনার খানিকটা অদ্ভুত লাগলো। ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘ এভাবে কি তাকিয়ে আছো ? বাড়ি ঢুকবে না ? এখানে অনেক মশা। বাড়ি চলো নাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই মশার খাবারে পরিণত হতে হবে। ‘
সরাব লক্ষ্য করলো রুনা যখন কথা বলে তখন তার কাজল দীঘির মতো গভীর ভাসা ভাসা চোখ দুটো যেন অজান্তেই হেসে উঠে, ঠোঁট দুটো প্রশস্ত এগিয়ে যায়। চোখ দুটোয় অজানা এক আনন্দে ঝিলিক দিয়ে উঠে। সামনের ছোট চুলগুলো গন্তব্যহীন উড়তে থাকে। সরাব সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। ওর মাথাটা মনে হয় আজ খারাপ হয়ে গেছে। রুনার চিরকাল দেখা রুপ আজ সে অন্য ভাবে দেখছে। এসব কি হচ্ছে তার সঙ্গে ? সে কি রুনার প্রেমে পড়ে যাচ্ছে ? এত তাড়াতাড়ি কি আদৌ কারোর প্রেমে পড়া সম্ভব ?
প্রেম অভাবনীয়। এর জন্য নির্দিষ্ট বরাদ্দকৃত কোনো সময় নেই। এটা যখন তখন, যেখানে সেখানে, যার তার সঙ্গে হয়ে যেতে পারে। এর উপর কারোর কোনো হাত নেই। কিন্তু প্রেম এবং ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য আছে। কারোর প্রেমে সহজে যত্রতত্র পড়া গেলেও কাউকে ভালোবাসা সহজ নয়। ভালোবাসতে হলে উপলব্ধি করাও জানতে হয়। কিন্তু সরাব কি করে বুঝবে কে তার প্রেম আর কে তার ভালোবাসা ? রুনা নাকি বিনী ?
সরাব স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ ও বিভ্রান্ত। বরাবর নিজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ সরাব আজ অজ্ঞ। সে পরিষ্কার হতে পারছেনা তার অনুভূতি সম্পর্কে। কিন্তু তাকে এভাবে একঘেয়ে, এক ধ্যানে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বিনী বেশ বিরক্ত। সে অধৈর্য্য গলায় সরাবের হাতে হাত রেখে বল প্রয়োগ করে বললো ‘ তুমি কি ভিতরে আদৌ ঢুকবে ? মশা খাচ্ছে তো। পরে শরীরে ডেঙ্গু জ্বর বাঁধাবে। ‘
রুনার কথায় হেসে ফেললো সরাব। কোনওদিন যা তার দ্বারা হবে না ভেবেছিল তাই করে বসলো। রুনাকে জড়িয়ে ধরলো । কিন্তু কিছু বললো না। কিছু সময় নীরবে নিভৃতে কাটানো প্রয়োজন। এতে আত্মিক শান্তি আর শুদ্ধি দুটোই মিলে।
আচমকা সরাবের কাজে চমকিত রুনা থমকে গেলো। তার হাত পায়ের লোম শিউরে উঠছে। তাদের বিয়ের এক সপ্তাহ হয়েছে অথচ সরাব একদিনও তার কাছে আসেনি। রাতে তারা এক বিছানায় শোয় ঠিকই কিন্তু সরাব তাকে ছুঁয়ে দেখে না। অথচ আজ অনাড়ম্বরে তাকে জড়িয়ে ধরলো। তাহলে এতদিনের আয়োজন করে বানানো দূরত্বের কারণ কি ?
সরাব নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরে আছে রুনাকে। আজ আর প্রেম,ভালোবাসার মাঝে পার্থক্য করতে ইচ্ছে করছে না। প্রেম এবং ভালোবাসা এমন একটা জিনিস যার মাঝে গ্যাড়াকলে পড়ে অঙ্ক কষে উত্তর বের করা যায় না। এরা যেমন আছে, যেভাবে আছে সেভাবেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। এতে যদি জীবন তার মতো চলে তাহলে চলুক। কি দরকার কে ভালবাসা আর কে প্রেম তার সমাধান বের করার ? সময় হলে সমাধান আপনিতেই এগিয়ে আসবে। ঈশ্বর যখন সমস্যা দিয়েছেন তখন তার সমাধানও দিয়েছেন।
—-
সবশেষে বাড়ি ফিরে এসেছে বিনী আর আবির। হঠাৎ তাদের ফেরার কথা শুনে আসফিয়া এবং জহির সাহেব দুজনই অবাক হয়েছিলেন কিন্তু এটা ওটা বুঝিয়ে বিনী চলে এসেছে। আসার আগে সালমা ইসলামের থমথমে মুখও তার নজর এড়ায়নি। কিন্তু তার যে কিছুই করার নেই। ওই বাড়িতে থাকার মতো মন মানসিকতা তার এখন আর নেই। থাকলেই দেখা যাবে সালমা ইসলাম কথায়,আচরণে শুধু আবিরদের ভুল ধরবেন। তার থেকে ফিরে আসাই শ্রেয়।
প্রায় দুই দিন পর আবির আর বিনীকে দেখলেন শাহিদা খাতুন। তবুও তার মুখে কোনো উদ্বেগ নেই। শান্ত ভাবেই ওদের ঘরে ঢোকালেন তারপর বিশ্রাম নিতে নিজেদের ঘরে যেতে বললেন। শাহিদা খাতুন শক্ত পোক্ত মনের মানুষ তাই হয়তো তার মাঝে কোনো উৎকণ্ঠার ছাপ নেই। কিন্তু বিনী খানিকটা নরম মনের। টানা দুদিন মানসিক অশান্তিতে কাটিয়ে যখন শাহিদা খাতুনের দেখা পেলো তখন আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেনি সে। সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।
বিনী শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরতেই উপস্থিত অনেকেই খানিকটা চমকে যায়। আবিরের কাশি শুরু হয়। সে দ্রুত এক গ্লাস ভর্তি করে পানি গলাধঃকরণ করে। বিনী যে শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরার মত অবিশ্যম্ভাবী কাজ করবে সেটা তার জানা ছিল না। যদিও আফিফা বিনীর এমন আচরণ আশা করেনি তবে তার ভালো লাগলো বিনী অন্তত সাহস করে শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরেছে। তার তো সাহসই হয়না এমন করার।
সবার সঙ্গে সঙ্গে শাহিদা খাতুনও চমকেছেন। বিনী তাকে জড়িয়ে ধরবে এই আশা তিনি কস্মিনকালেও করেননি। যেখানে উনার ছেলেরাই বড় হওয়ার পর তাকে জড়িয়ে ধরার সাহস করতে পারেনি সেখানে দু দিনের মেয়ে এসে হুট করে জড়িয়ে ধরবে সেটা আশা করা নেহাৎ বোকামি। তবে আশা না করে যে শাহিদা খাতুন বোকামি করেছেন সেটা বিনী পরিষ্কার তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

—————————
আজও রোজকার দিনের মতো আসফিয়ার কলেজের বাহিরে দাড়িয়ে আছে জাদিদ। আসফিয়া যথারীতি বেরিয়ে এলো বান্ধবীদের সঙ্গে। তারপর বরাবরের মতোই বান্ধবীদের নিয়ে পথ চলতে শুরু করলো আর জাদিদ ওদের পিছন পিছন এগোতে শুরু করলো। কাল রানী আর কুসুম জাদিদকে লক্ষ্য না করলেও আজ তাদের চোখে ঠিকই পড়লো।
একলা নির্জন রাস্তায় একটা ছেলের পিছন পিছন আসার ব্যাপারটা রানী আর কুসুমের ভালো ঠেকলো না। খানিকটা ভয়ে ভয়েই কুসুম কথাখানা ফিসফিসিয়ে আসফিয়ার কানে তুললো ‘ এই আফু!! আমাদের পিছন পিছন একটা ছেলে আসছে। ‘
কুসুমের ভয় মিশ্রিত গলায় আসফিয়ার মাঝে ভাবান্তর হলো না। ও জানে কে আসছে ওর পিছন পিছন। তাই ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বলল ‘ তো ? ‘
‘ তো মানে ? ওই ছেলে যদি ছেলে ধরা হয় তাহলে ? তুই ব্যাপারটা বুঝেছিস ? এই ধরনের লোক যা ইচ্ছা তা করতে পারে। ‘ আসফিয়ার এমন পাত্তা দিলাম না ভাব দেখে বিস্মিত গলায় বললো রানী।
‘ উনি ছেলে ধরা নন আর না আমাদের অপহরণ করতে আমাদের পিছন পিছন আসছেন। উনি আমাদের পিছন পিছন না আমার পিছন পিছন আসছেন। ‘
আসফিয়ার কথায় প্রশ্ন করতে গিয়েও যেন আর কিছু বলল রানী আর কুসুম। তারা এখনও আতঙ্কিত। এখনকার সময় ভালো না। রোজ মেয়েদের অপহরণের খবর বের হচ্ছে পত্রিকায়। এই তো আজই কুসুমের বাবা সকালে পত্রিকায় পড়ছিলেন কুষ্টিয়ার এক ১০ বছরের মেয়েকে টাকার লোভে অপহরণ করে পরে ধরা খাওয়ার ভয়ে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।
যথারীতি আসফিয়াদের বাড়ির কাছে আসতেই তিন জনের পথ আলাদা হয়ে গেলো। আবারও জাদিদ আর আসফিয়ার পথ একলা হলো। জাদিদ এগিয়ে আসফিয়ার পাশাপাশি পিচ ঢালা কংক্রিটের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলো। দুজনের মাঝে পিনপতন নিরবতা। কারোর মুখে কোনো শব্দ নেই।
প্রথম কথাটা জাদিদই আগালো। বললো ‘ বাড়ির সবার কেমন অবস্থা ? ‘
‘ আপা আর আবির ভাই বাড়ি ফিরে গেছে। ‘
বিনী আর আবিরের বাড়ি ফেরার কথা শুনে বিস্মিত জাদিদ বললো ‘ মাত্র না পরশু এলো ? এর মধ্যেই আজ আবার ফিরে গেলো। বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে দুই দিন থাকার কারণ কি ?অন্য মেয়েরা আরও বাবার বাড়ি গিয়ে দশ, পনেরো দিন থাকতে চায় ওরআর ভাবী সুযোগ পেয়েও মাত্র দুই দিন। কারণটা কি ? ‘
‘ মেয়েরা বাবার বাড়ি এসে দশ, পনেরো দিন থাকে, মায়ের বাড়িতে থাকে না। আমি যেই কারণে আপনাকে এড়িয়ে যেতে চাই আপাও ঠিক সেই কারণেই নিজের কষ্টগুলো ধামা চাপা দিয়ে ফিরে গেছে। ‘
‘ কি কারণ ? ‘
‘ আপার বিয়ে আপনাদের যৌথ পরিবারে হয়েছে। যৌথ পরিবার নিয়ে এক বিশ্রী অভিজ্ঞতা হয়েছে মায়ের সংসার জীবনে। আর সেসবের কারণেই উঠতে বসতে মা আপাকে কথাবার্তায় বুঝায় তার বিয়েতে মায়ের মত নেই। মায়ের ধারণা তার সঙ্গে যা অন্যায় হয়েছে সেসব তার মেয়েদের সঙ্গেও হবে যদি যৌথ পরিবারে বিয়ে হয় মেয়েদের। ‘
আসফিয়ার কথায় কি বলবে বুঝতে পারলো না জাদিদ। তাদের পরিবার নিয়ে এত আপত্তি সালমা ইসলামের শুধুমাত্র তারা যৌথ পরিবার বলে। ভালোবেসে এক পরিবারে থাকাও বুঝি অপরাধ। এরপর আর তাদের মধ্যে কোনো কথা হলো না। নিজের বাড়ির গলিতে ঢুকে যাওয়ার পূর্বে আসফিয়া বললো ‘ আর এ পথে আসবেন না বেয়াই সাহেব। এই ইট, কংক্রিটের তৈরি মানুষ আপনাদের মত বড় মনের মানুষদের জন্য নয়। ‘
আসফিয়া চলে গেছে অনেকক্ষণ। তবুও জাদিদ এক ধ্যানে দাড়িয়ে আছে। তার কার্নিশে নোনা অশ্রু জমেছে। চোখ দুটো সিক্ত হয়েছে কানায় কানায়। জাদিদ আরও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো। যদি আসফিয়া ফিরে আসে। কিন্তু না আসফিয়া আর ফিরেনি। সে চলে গেছে সবসময়ের জন্য। জাদিদও ভঙ্গুর হৃদয়ে ফিরতি পথে হাঁটা দিলো।
দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আসফিয়া। তার গলার কাছে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আছে। সে আড়াল থেকে একবার লম্বাটে, বলিষ্ঠ দেহী প্রতিমূর্তিকে দেখলো। মানুষটা তবে চলে যাচ্ছে। এছাড়া আর কিইবা করার থাকে। যাদের ভবিতব্য ছিল আলাদা হওয়া তাদের সম্পর্কের বাঁধন যে কখনও জোড়া লাগার নয়। এ তো আর বেলি ফুলের মালা নয় যে এবড়ো থেবড়ো ফুল গাট বাঁধলো এক সুতোয়। এ আস্ত দুই মানব মানবীর জীবন। যাদের মাঝে না আছে মিল আর না আছে এক হওয়ার মতো ভাগ্য লিখন।
—-
শাহিদা খাতুনকে জড়িয়ে ধরে নাকের জলে,চোখের জলে অবস্থা করে ফেলেছে বিনী। ওর কান্নাকাটি দেখে সকলেই হতভম্ব। শাহিদা খাতুন পড়ে গেছেন অসস্তিতে। তিনি বিনীকে নিজের কাজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন ‘ এমন কান্দনের কি আছে ? বাপের বাড়ি থেইকা এত তাড়াতাড়ি আসছো বইলা কান্না আইতাছে ? তাইলে আরও কয়দিন থাইকা আইতা ? এখন কাইন্দা লাভ কি ? এই আবির তোর বউরে নিয়া ঘরে যা। আমার শাড়ি নিজের চোখের পানি দিয়া ভাসায় দিতাছে তোর বউ। তাড়াতাড়ি ঘরে নে ওরে। ‘
শাহিদা খাতুন বিনীকে আবিরের কাছে ধরিয়ে দিয়ে শাহিদা খাতুন রান্নাঘরে গেলেন। রান্নাঘরের মেঝেতে থাকা সবজি কাটতে কাটতে ছেলে আবিরের উদ্দেশ্যে বললেন ‘ এখনও খাড়ায় আছস ? বউমারে ঘরে নে। একটু বিশ্রাম নে দুজনে। আজ আর রান্নাঘরে আসবার প্রয়োজন নাই। আমি,বড় বউমা আর জাহানারা সব কইরা ফেলমু। ‘
বিনী ততক্ষনে নিজেকে সামলে নিয়েছে। চোখের পানি মুছে শাহিদা খাতুনকে মৃদু গলায় বললো ‘ আম্মা গাড়ি করেই এসেছি, বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে একটু সাহায্য করি ? ‘
বিনীর কথায় ধমকে উঠলেন শাহিদা খাতুন। বললেন ‘ তুমি বড় না আমি বড় ? তুমি বেশি জানো ? চুপচাপ ঘরে যাইয়া বিশ্রাম করো। বিকালে উইঠা তোমার আব্বারে চা কইরা দিবা। কথাখানা মাথায় রাখবা। মানুষটা তোমার হাতের চা খাইবো বইলা রোজ অপেক্ষা করে। ‘
শাহিদা খাতুনের ধমক খেয়ে বিনী চুপ করে গেলো। আবির তাদের দুই শাশুড়ি বউয়ের ধমকাধমকি দেখে উপরে চলে গেছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। বাধ্য হয়ে এখন তাকেও যেতে হবে। বিনী মন খারাপ করে ঘরে ফিরে এলো। আবির ততক্ষনে জামা,কাপড় বদলে নিয়েছে। বিনীকে ঢুকতে দেখে সে কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল ‘ তুমি যে কাদতেও পারো সেটা জানতাম নাতো ? ‘
আবিরের কথা শুনে ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকালো। কিন্তু আবির ওর রাগী চোখ,মুখ পাত্তা দিলো না। সে হাসতে হাসতে বললো ‘ এত বড় মেয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছে ভাবলেই তো হাসি পায়। ‘
বিনী এবার থমথমে মুখে বিছানার উপর পড়ে থাকা কোসন আবিরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে নিজেদের কাপড়ের ব্যাগ গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
আবির কোসন তার গায়ে পড়ার আগেই ধরে ফেললো। তার হাসি এখনও চলমান। তাকে হাসতে দেখে প্রথমে বিনী কপট রাগ দেখালেও একসময় না পারতে সেও হেসে ফেললো কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা বজায় রেখে। আবির সেই হাসি মুগ্ধ চোখে দেখছে। বিনী আজ পর্যন্ত কোনওদিন তার সামনে বড় গলায় হাসেনি। বিনীর সবকিছুই পরিমিত। কথায় কথায় সে আবেগীও হয়ে পড়ে না।
—-
‘ ওহে প্রিয়
তুমি আছো যেথায়,
কভু পাবে নাকো আমায়
আমি যে তোমারই সাধ্যের বাহিরে সেথায়। ‘
শুভ্র কাগজে কালো রংয়ের গোটা গোটা অক্ষরে আঁকিবুকি করছে আসফিয়া। কল্পনায় তার জাদিদ। মানুষটা তাকে আর শান্তি দিলো না। যেদিন থেকে দেখা হয়েছে সেদিন থেকেই তার কল্পনায় যখন তখন চঞ্চল বিহঙ্গের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসছে। যখন তখন হাজির করছে কল্পনার রাজ্যে নিয়ে। তার কাজেকর্মে বিরক্ত প্রায় আসফিয়া। বিরক্তিতে ছেয়ে থাকা মুখে প্রায়ই ফিসফিসিয়ে বলছে ‘ অসহ্য অসহ্য ‘।
কিন্তু মুখে আসফিয়া অসহ্য বললেও তার বেয়াই সাহেবকে নিয়ে ভাবতে তার ভালো লাগে। তার এই ভাবাভাবি তাদের প্রেম পর্যন্তই। নিজেদের বিয়ের স্বপ্ন সে দেখেনা। কারণ সে জানে তার দৌড় কত দূর। তার মা তার বোনের বিয়েটা তো যৌথ পরিবারে হতে দিয়েছে কিন্তু তার বিয়ে কখনও হতে দিবে না।
সালমা ইসলামকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে বহু পূর্বেই। নিজের সাংসারিক জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কারণে যৌথ পরিবার নিয়ে একরকম আতঙ্কে ভুগছেন তিনি। বিগত দিনগুলোতে প্রচন্ড মানসিক অশান্তির মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। এই কারণেই এখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করেনা। তবুও তো বিনীর বিয়ে নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অশান্তি করেননি এই বেশি। এরপর আসফিয়ার সাহস নেই তার মায়ের মানসিক চাপ বাড়িয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
—-
আজাদ সাহেব বসার ঘরে থাকা প্রকান্ড কাঠের চেয়ারটায় বসে আছেন। তার হাতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় খ্যাত দূর্গেশনন্দিনী। বেশ মনযোগ সহকারে চেয়ারে দুলতে দুলতে বই পড়ছেন তিনি। চেয়ার যতবার নড়ছে ততবারই ক্যাচ ক্যাচ করে এক আওয়াজ হচ্ছে। এই চেয়ারটা বেশ পুরো সময়ের। আজাদ সাহেবের দাদার। উত্তরাধিকার সূত্রে দাদার বাড়ি থেকে এই চেয়ারটা পেয়েছিলেন তিনি।
আজাদ সাহেব ছিলেন তার দাদা আজিম সাহেবের খুব প্রিয়। সকালে হাটতে বেরোনো কিংবা বিকেলে বসে চা খাওয়া, সবক্ষেত্রেই তিনি আজিম সাহেবের সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিলেন। সেই সূত্রেই আজিম সাহেব মারা যাওয়ার পর তার প্রিয় চেয়ারখানা নিজের কাছে নিয়ে আসেন তিনি।
‘ আব্বা ‘
আজাদ সাহেব যখন বিপুল মনযোগে বই পড়তে ব্যস্ত তখনই এক মেয়েলি গলার স্বর শুনতে পেলেন। বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে সামনের দিকে নজর দিলেন। সামনে দাড়িয়ে আছে খয়েরী রংয়ের সুতি শাড়ি পড়া বিনী। নব বিবাহিতা বিনীর ফর্সা শরীরে তখন অল্প স্বল্প সোনার গয়না। হাতে সোনার চুড়ি, গলায় সরু চেইন আর কানে ছোট দুল। ফর্সা বদনে হালকা কিছু এই সোনার গয়নাতেই তাকে অপরূপ সুন্দরী মনে হচ্ছে।
বিনীর মাথায় ঘোমটা টানা। হাতের চায়ের ট্রে কিছুটা কাপছে। ভয়ে ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। আজাদ সাহেব আনমনে হাসলেন। হেসে চেয়ারের গায়ে হেলান দিয়ে চোখে হাত রেখে চোখ দুটো বুজলেন। চোখে ভাসছে তেতাল্লিশ বছর পুরনো সেই অম্লান স্মৃতি। ঠিক এরকমই এক স্মৃতি মৃন্ময়ীরও আছে।
মৃন্ময়ী তখন বছর পনেরোর কিশোরী আর আজাদ সাহেব তেইশ বছরের যুবক। মায়ের পীড়াপীড়িতেই বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলেন বছর পনেরোর এক কিশোরীকে। সেই কিশোরী মৃন্ময়ী ছিল তার প্রথম স্ত্রী। জীবনে প্রথম কোনো বাহিরের নারীর পদার্পণের জন্যই নাকি অন্য কিছুর কারণে কে জানে কিন্তু আজাদ সাহেব পড়েছিলেন সেই কিশোরীর প্রেমে। কিশোরীর উত্তাল প্রেমে ভেসে যাওয়া আজাদ সাহেব একদিন আবিষ্কার করলেন সপ্তদশী সেই কিশোরী মা হতে চলেছে আর উনি বাবা।
তারপর ? তারপরই একদিন এলো সেই সর্বনাশা রাত। সেই রাতে মৃন্ময়ী হঠাৎ শয্যাশায়ী হলো। আনিসের তখন এক মাস। এমনিতেই অল্প বয়সে বাচ্চা জন্ম দিয়ে মৃন্ময়ী সুস্থ ছিল না। তার উপরে সেই রাতে এমন কিছু একটা হলো যার পর মৃন্ময়ী আর বিছানা ছাড়তে পারলো না। তারপরই পরদিন সকালে আজাদ সাহেব পেলেন তার নিথর দেহ।
দৃশ্যখানা এখনও আজাদ সাহেবের চোখের সামনে অম্লান। সময়ের স্রোতে আজাদ সাহেবের বয়স বেড়েছে, বুড়ো হয়েছেন তিনি কিন্তু প্রথম স্ত্রীকে ভুলেননি তিনি। ছেলের জন্য মায়ের অভাব পূরণ করতেই শাহিদা খাতুনকে বিয়ে করেছিলেন আর সেই অভাব ঘুচেছেও। শাহিদা খাতুন কোনওদিন নিজের ছেলে আর আনিসের মধ্যে পার্থক্য করেননি। শাহিদা খাতুনকেও ভালোবাসেন আজাদ সাহেব কিন্তু সে শুধুই ভালবাসা। সে মৃন্ময়ীর মতো প্রেমিকা আর হয়ে উঠতে পারেনি।
আজাদ সাহেবের এখনও মনে পড়ে বিয়ের পরের দিন মৃন্ময়ী যখন তার জন্য চা এনেছিল তখন তার হাতও বিনীর মতোই কাপছিল। পড়নে অল্প কিছু সোনার গয়না আর তাতের শাড়ি। টসটসে টমেটোর মতো আলতা বরণ কিশোরীর ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে উঠা মুখ আজও ভুলতে পারেননি আজাদ সাহেব। বিনীকে দেখে আবারও তার সেই সপ্তদশী প্রেমিকার কথা মনে পড়ে গেলো যে একাধারে তার প্রেমিকা, স্ত্রী এবং সন্তানের মা ছিল।
সেই সোনালী দিনগুলোর কথা মনে পড়লেও এখন বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই আসে না। যদি সেদিন উনি একটু সতর্ক থাকতেন তাহলে আজ হয়তো মৃন্ময়ী তাদের মাঝে থাকতেন। অল্প বয়সে সংসার আর সন্তান যে একটা মেয়ের জীবনকে ঠিক কতটা ঝুঁকিতে ফেলে দেয় সেটা তিনি এখন বুঝেন। যদি এই কথাটাই আরও আগে বুঝতেন তাহলে আজ তার প্রিয়তমা বেচেঁ থাকতেন।
আজাদ সাহেবের আজও মনে পড়ে মৃন্ময়ী মৃত্যুর পূর্বে বলেছিলেন তার ছেলেকে যেন দেখে রাখেন, তাকে যেন কখনও মায়ের অভাবে পড়তে না হয়। আজাদ সাহেব মৃন্ময়ীর কথা রেখেছেন। ছেলের জন্য মা এনেছেন আর নিজের জন্য স্ত্রী। কিন্তু সেই স্ত্রী আর তার প্রিয়তমা হয়ে উঠতে পারেনি। শাহিদা খাতুন বিয়ের পর থেকেই আনিসকে নিজের ছেলে মেনে নিয়েছেন। উনি নিজেও মা হারা ছিলেন তাই একজন সন্তানের মায়ের প্রতি হাহাকার বুঝেন তিনি।
শাহিদা খাতুন চেয়েছিলেন আনিস আর আবিরের মধ্যে যেন কখনও কোনো ভেদাভেদ না হয়। তারা যেন সবসময় আপন ভাইদের মতো থাকেন। তাইতো উনি যে আনিসের নিজের মা নন এবং আজাদ সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী সেই কথা বড়রা ছাড়া কেউ জানেন না। সন্তানদের জানিয়ে তাদের মধ্যে বিদ্বেষ করতে চাননি কখনও শাহিদা খাতুন।
—————————
আজাদ সাহেবকে কপালে হাত রেখে চোখ বুঁজে হাসতে দেখে বিনী ভরকে গেল। কিছুটা ভয়ে ভয়ে ‘ আব্বা ‘ বলে দ্বিতীয়বার ডাকলো। তাদের বিয়ের পর থেকে আজাদ সাহেবের সঙ্গে তার তেমন কোনো কথা হয়নি। এমনকী সে তার সামনেও কম এসেছে। কেন সেটা সেও জানেনা কিন্তু আজাদ সাহেবকে তার খানিকটা ভয় করে। আজাদ সাহেব গম্ভীর ধরনের মানুষ। তার একমাত্র আলোচনার বিষয় হলো রাজনীতি যার আগামাথা কিছুই বুঝে না বিনী।
আজাদ সাহেব এবার সোজা হয়ে বসল। বিনীর দিকে মুখ তুলে চাইলেন। সুন্দর করে হাসলেন ঠিক যেমনটা তেতাল্লিশ বছর পূর্বে প্রথম দিন মৃন্ময়ীকে ভয়ে কাঁপতে দেখে হেসে দিয়েছিলেন। বিনীর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে বিনীকে সামনের সোফায় বসতে ইশারা করলেন। বিনী আজাদ সাহেবের ইশারা মতো সামনের সোফায় বসলো।
‘ মাস্টার্সে ভর্তি হচ্ছো কখন ? ‘
আজাদ সাহেবের মুখে ভার্সিটির কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো বিনী। সে ধারণা করেনি আজাদ সাহেব এই পরিস্থিতিতে তার পড়াশোনার কথা তুলবেন। তবে বিনীকে চুপ থাকতে দেখে আজাদ সাহেব আলতো হেসে আবারও একই প্রশ্ন করলেন। এবার বিনীর খানিকটা সাহস হলো। সে তার বহু দিনের জমানো কথা খুলে বললো।
‘ মাস্টার্সে ভর্তি হবো না আব্বা। ‘
বিনীর কথায় আজাদ সাহেব বিস্ময়ের চূড়ান্ত রেশ ঘটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ‘ কেন ? ‘
‘ এমনিতেই আব্বা। এতকাল তো পড়াশোনা করলাম। এখন নাহয় একটু ঘরের কাজকর্ম করে আম্মাকে সাহায্য করি। আম্মারও সুবিধা হবে। ‘
বিনীর কথায় হাসলেন আজাদ সাহেব। চা খেতে খেতে বিনীকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। অনুমতি পেয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো বিনী। আজাদ সাহেব সেদিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আরাম কেদারার গায়ে শরীর এলিয়ে দিলেন। বয়সের ভারে শরীরটা কেমন দূর্বল লাগছে।
—-
রান্নাঘরে এক প্রকার জোর করেই পিড়িতে বসেছে বিনী। শাহিদা খাতুন কিছুতেই ওকে কাজ করতে দিতে রাজি নন। উনার ভাষ্য মতে বিনী এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছে কাজেই আজ আর কাজে হাত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এমনটা শুধু বিনীর ক্ষেত্রেই নয়। আফিফা যখন তার বাবার বাড়ি কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যায় তখন ফিরে এসে তাকেও কোনো কাজে হাত দিতে দেননা শাহিদা খাতুন। উনার বরাবরের কথা হলো বাড়ির বউরা উনাদের বাড়ির মেয়ের মতো। তারা ঝি চাকর নন যে কামলার মতো খাটতে হবে।
বিনী চেয়েছিল কিছু কাজকর্ম করবে কিন্তু শাহিদা খাতুন ওকে কাজেই হাত দিতে দিচ্ছেন না। কাজেই বাধ্য হয়ে ও একটু আধটু সাহায্য করছে, শাহিদা খাতুনকে রান্নায় জিনিস এগিয়ে দিচ্ছে। শাহিদা খাতুন যদিও উপর দিয়ে উপর দিয়ে কপট রাগ দেখাচ্ছেন কিন্তু উনার এই রাগের তীব্রতা নেই। উনি শুধু মুখেই বিরক্তিকর শব্দ করছেন এই যা।
‘ বাপের বাড়ি কয়দিনের লেইগা গেলা ঘুরতে অথচ দুই দিন থাইকাই আইয়া পড়লো। কারণডা কি হুনি ? ‘
শাহিদা খাতুন খুন্তি নাড়তে নাড়তেই কথাটা বললেন। বিনী ভেবে পেলো না কি বলবে। তার মা যে তার শশুর বাড়ির লোকদের বিশেষ করে শাহিদা খাতুনকে পছন্দ করেন না এই কথাটা তো আর বলা যায় না। তাই সে বললো ‘ এমনিতেই আম্মা। ওই বাড়িতে মন টিকছিল না। আপনাদের কথা মনে পড়ছিল তাই চলে এসেছি। ‘
কথাটা যে একেবারেই মিথ্যে তা না। বিনীর আসলেই শাহিদা খাতুনদের কথা মনে পড়ছিল। তার এই বাড়িতে বিয়ে করে আসার দিন ক্ষণ সবে মাত্র এক সপ্তাহ অথচ এই এক সপ্তাহেই এই বাড়ির লোকেদের সে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। তাদের ছাড়া তার মনটা আনচান করে। কোথাও যেন টিকতে চায় না। অথচ সে চঞ্চলা নয়।
জাহানারা হাসলেন বিনীর কথায়। বড় জা শাহিদা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘ বউ দেখি এখনই আমাদের পাগল আপা। পরে আবার বেয়াইন না বলেন আমরা বউমাকে কালো জাদু করেছি। ‘
জাহানারার কথায় শাহিদা খাতুন কিছু বললেন না। তিনি তরকারি নাড়া দিতে দিতে বিনীকে বললেন ‘ ফ্রিজে আমের গলা আচার আছে। ইচ্ছা করলে বড় বউরে নিয়া খাইতে পারো। ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী আর আফিফার চোখ চকচক করে উঠলো। আফিফা হাতের কাজ রেখে ছুটে গেলো আচারের বোয়ম নামাতে। মিনিটের মধ্যে একটা বড় আচারের বোয়ম আর দুটো বাটি নিয়ে সে হাজিরও হয়ে গেলো। দুই বাটিতে আচার নিয়ে একটা নিজের জন্য আর আরেকটা বিনীর দিকে এগিয়ে দিল। বিনী নিঃশব্দে বাটিটা হাতে নিয়ে আচার মুখে দিলো।
আচার মুখে দিতেই বিনীর চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো। এ যেন সে অমৃত খাচ্ছে। কোনো আচার এত সুস্বাদু হতে পারে সেটা তার জানা ছিল না। সে খেতে খেতে শাহিদা খাতুনকে বললো ‘ আম্মা একটা কথা বলার ছিল। ‘
‘ তো বলবাই না। কেউ কি তোমারে কসম দিসে যে কথা কইবার পারবা না ? ‘
শাহিদা খাতুনের আঁকাবাঁকা কথা বিনী গায়ে মাখলো না। সে বলল ‘ বলছিলাম আমাকে আচার বানানো শিখিয়ে দিবেন ? আমিও শিখতে চাই। ‘
‘ কোন আচারখান ? সবগুলা না শুধু তোমার হাতের টা ? ‘ শাহিদা খাতুনের তির্যক প্রশ্ন।
‘ সবগুলাই শিখি। তাহলে ভালোভাবে শিখতে পারবো। ‘
‘ তাইলে আগে অন্য ডি শিখান লাগবো। আমের মৌসুম অহন প্রায় শেষের দিকা। এখনকার আম দিয়া এই আচার হইবো না। আমেরটি তোমার সামনের বছর শিখা লাগবো। এহন তাইলে অন্য ডি শিখো ? ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী সায় দিয়ে বললো ‘ আচ্ছা। ‘
তারপর বিনী আর আফিফা দুজনেই আচার খেতে খেতে জাহানারা আর শাহিদা খাতুনের সঙ্গে কথাবার্তা চালালো। আচার খাওয়া শেষে আর উপায় না পেয়ে বিনী ঘরে চলে এলো। শাহিদা খাতুন তার বাবার বাড়ি থেকে ফিরে আসা নিয়ে বেশি করছেন। তাদের বাড়ি থেকে বিনীদের বাড়ি অতও দূরে নয় যে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। তবুও তিনি মনের শান্তির জন্যই এই কাজ করছেন।
ঘরে ফিরে বিনী দেখলো আবির ঘুমিয়ে আছে। আবিরকে ঘুমন্ত দেখে সে ভাবলো রোজনামচা লেখা যায়। সেই ভেবেই সে নিজের আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো। তার তালা দেওয়া ড্রয়ার থেকে তার গুপ্ত দিনপঞ্জি নামিয়ে আনলো। পঞ্জিখানা আবিরের টেবিলের উপর রেখে নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসলো। তার প্রিয় ফাউন্টেন কলম খুলে রোজ নামচা লেখায় মনস্থির করলো।
এই ফাউন্টেন কলমটা বিনীর খুব প্রিয়। এই কলমটা তাকে দিয়েছিলেন জহির সাহেব তার পনেরো তম জন্মদিনে। তখনকার সময়ে এর দাম ছিল প্রায় একশো টাকা যা আজ থেকে প্রায় নয় বছর পূর্বে। বেশ পুরনো সময়ের বলে কলমের গায়ে বেশ নজরকাড়া কারুকার্য করা। কিছু কিছু জায়গায় রঙিন পাথর বসানো।
বিনী কলম টেনে পঞ্জির হলদে পাতায় লিখতে আরম্ভ করলো,
পাতা ৫৫…
২২ আষাঢ়,১৯৯০
আজ বিয়ের সপ্তম দিন। বাড়িতে গিয়েছিলাম আমি আর আবির। সেখানে তাকে দেখেছি এক মেয়ের সঙ্গে। চিনিনা ওকে আমি ?হয়তো ওর স্ত্রী হবে। প্রেমিকা নিয়ে ঘোরার হলে এতদিন আমার অপেক্ষায় প্রহর গুনত না। ওকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখে কি আমার খারাপ লেগেছে ? বুকের ভিতরটা চিনচিনে ব্যাথা দুমড়ে মুচড়ে গেছে ? ভালোবাসার মানুষটাকে অন্য কারোর সঙ্গে দেখা কি এতই সহজ ?
মা ভাবে আমি আবির আর তার পরিবারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, ওদের অনেক ভালোবাসি। কথাখানা আংশিক সঠিক। আমি আসলেই আবিরের পরিবারের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। যেই ভয়ে কোনওদিন যৌথ পরিবারে বিয়ে করতে চাইনি সেই ভয় আমার কেটে গেছে। ওদের আমি ভালোবাসি এটাও ঠিক। যেই অদেখা পরিবার কোনওদিন আমারও হবে এই স্বপ্ন মনে নিয়ে বেড়ে উঠেছি সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হয়েছে।
কিন্তু!! কিন্তু…কিন্তু, কিন্তু আমি আবিরের প্রেমে পড়িনি। আমি শুধুই তাতে মুগ্ধ হয়েছি। প্রেমের প্রথম শর্ত মুগ্ধ হওয়া। আমি ওর প্রেমে পড়ার দিকে এক ধাপ এগিয়েছি। ওর আমার প্রতি যত্ন,আমার ইচ্ছের মূল্যায়ন করা আর আমার জন্য চিন্তা করা আমায় মুগ্ধ করেছে। কিন্তু ওকে আমি ভালোবাসিনি। ভালো আমি একজনকেই বেসেছি যে রোজ আমার জন্য বেলি ফুলের মালা হাতে রাস্তার পাশে এক ধ্যানে দাড়িয়ে থাকতো।
তার মতো করে আবিরও বেলি ফুলের মালা আনে। কিন্তু তার আর আবিরের মাঝে যে বিস্তর ফারাক। সে কোনওদিন আমার লম্বা বেণীতে বেলি ফুলের মালা জড়িয়ে দেওয়ার অধিকার পায়নি অথচ কি অবলীলায় মাত্র তিনটে শব্দের দাপটে আবিরের সঙ্গে এখন আমি একই বিছানায় শুই। আমাদের মধ্যে শারীরিক ঘনিষ্ঠতাও হয়, সে আমায় তার উত্তাল ভালোবাসার জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এমনকী বেলি ফুলের মালাও চুলে জড়িয়ে দেয় কিন্তু তবুও যেন আফসোস থেকেই যায়। ভালোবাসার মানুষটার কাছ থেকে একবার অন্তত চুলে বেলি ফুলের মালা জড়াতে না পারার আফসোস। আমাদের প্রেমটা আর কাব্যিক হলো না। তার আনা বেলি ফুলের মালা আর জড়ানো হলো না চুলে। আফসোস,আফসোস আর আফসোস। এই জীবন মনে হয় আফসোসের সুরেই কেটে যাবে।
লেখা শেষে দিনপঞ্জির যেই পাতায় সে নতুন লিখেছে সেই পাতায় এক টাটকা গোলাপ গুঁজে পঞ্জিটা নিয়ে আলমারিতে তার রাখা শাড়ির ভাঁজে রেখে দিল। আলমারি আটকে দিয়ে চাবির গোছা নিয়ে বালিশের পাশে রাখল। তারপর নিঃশব্দে আবিরের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। আবিরের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো সে। বিনীর হয়তো পুরো জীবন কাটবে আফসোসে আফসোসেই। সরাবকে নিজের করে না পাওয়ার আফসোস, আবিরকে বিয়ে করেও তাতে শুধুই মুগ্ধ হওয়ার আফসোস, আবিরের সম্পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাকে ভালোবাসতে না পারার আফসোস।
—-
রোজকার মতোই রান্নাঘরে কাজ করছেন শাহিদা খাতুনসহ বাড়ির বাকি বউরা। তবে আজ শাহিদা খাতুনের উপর নতুন এক দায়িত্ব পড়েছে। যুহারিন বিশেষ করে আবদার করেছে আজ যেন দুপুরের খাবারে তার জন্য নিজ হাতে পোলাও রাধেন শাহিদা খাতুন। শাহিদা খাতুন বাহিরে দিয়ে যতই নিজেকে শক্ত পোক্ত দেখান না কেন আদতে তিনি খুবই কোমল। একমাত্র নাতনির কোনো আবদার পূরণ না করার সাধ্য তার অন্তত নেই। তাই তিনি পোলাও রাধার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। চালগুলো ধুয়ে ঝুড়িতে ঝরতে দিয়েছেন।
বিনী মাংসে মশলা মাখাচ্ছে। যুহারিন যখন চেয়েছে তখন পোলাওয়ের সঙ্গে সঙ্গে কষা গরু মাংসও রাধা হবে। তার জন্যই মূলত মাংসে মশলা মাখানোর কাজ চলছে। আফিফা কালকের জন্য রুটি বানিয়ে রাখছে আর জাহানারা চুলায় চিংড়ির মালাইকারি বসিয়েছেন।
জাবিয়ার আজ কলেজ বন্ধ তাই সে বাড়িতেই আছে। যেহেতু কলেজ বন্ধ সেহেতু পড়াগুলো এগিয়ে রাখছেন। এতক্ষণ ঘরে একলা সময় নিয়ে পড়েছে সে। কিন্তু এখন আর ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। তখনই ক্রিং ক্রিং শব্দে বসার ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠলো। জাবিয়া নিজে দেখছে জানিয়ে বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।
‘ আসসালামু আলাইকুম, কে বলছেন ? ‘
‘ জাবিয়া আমি আবির। তোর ভাবি কোথায় ? ‘
ফোনের ওপারে আবিরের গলা পেয়ে আর বিনীর নাম শুনে মৃদু হেসে উঠলো জাবিয়া। কৌতুক গলায় বললো ‘ কেন ? কোনো বিশেষ প্রয়োজন বুঝি ? ‘
জাবিয়ার মজা আবিরের ঠিক সইলো না। সে কঠোর গলায় ঝাড়ি দিয়ে বললো ‘ বড় ভাইয়ের সঙ্গে এসব কি ধরনের কথা বলছিস ? লাজ শরম কি সব ভুলে খেয়েছিস ? যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটার উত্তর না দিয়ে উনি এসেছেন উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করতে। দ্রুত বল তোর ভাবি কোথায় ‘
আবিরের ঝাড়ি খেয়ে জাবিয়া আর কথা এগোলো না। স্রেফ বললো ‘ ভাবি রান্নাঘরে কাজ করছে। ‘
‘ ওকে ডেকে দে, বল জরুরি কথা আছে। ‘
বিনী অধীর আগ্রহে তার কাজ করছে। তার মনযোগ আর কোনদিকে নেই। সে ব্যস্ত সবজি কাটতে। মাংসের মশলা মাখিয়ে রেখে দিয়েছে। জাবিয়া চাইনিজ সবজি খাবে আবদার করেছে। এই সবজির নাম আগে শুনেনি বিনী, এই প্রথম শুনলো সে। তাই রান্নার নিয়মকানুনও জানা নেই তার। কিন্তু তার এই মুশকিল আসান করে দিয়েছে জাবিয়া। কোথা থেকে রান্নার বই এনে হাজির করেছে। এখন সেটা থেকেই দেখে জিনিস জড়ো করছে বিনী।
‘ ভাবি আবির ভাই ফোন দিয়েছেন। আপনাকে ডাকছে,বলেছে জরুরি কথা আছে। ‘
বিনী যখন সবজি কাটতে ব্যস্ত তখনই জাবিয়া এসে আবিরের ফোন দেওয়ার ব্যাপারটা জানালো। আবির ফোন করেছে শুনে বিনী শাহিদা খাতুনের দিকে অনুমতির আশায় মুখ তুলে তাকালো। শাহিদা খাতুন ওর দৃষ্টি দেখে বললেন ‘ অহন আমার দিকে তাকাও কেন ? তোমার জামাই কি ফোন করবার আগে আমার থেইকা অনুমতি নিয়া ফোন করছিলো যে এহন তার সাথে কথা বলবার লেইগা তোমার আমার অনুমতি নেইবার প্রয়োজন আছে ? যাইয়া তাড়াতাড়ি কথা কও, আমার ছেলে তোমারে খাইয়া ফালাইবো না। ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় বিনী সবজি রেখে উঠে দাড়ালো। ফর্সা, নিটোল হাতখানা পরিস্কার তোয়ালে দিয়ে মুছে বসার ঘরে গেলো। টেলিফোনটা কানে দিয়ে বললো ‘ বিনী বলছি। ‘
বিনীর গলা পেয়ে আবির সুধালো ‘ কি করছিলে ? ‘
বিনী এক রোখা হয়ে জবাব দিল ‘ সবজি কাটছিলাম। ‘
‘ তাহলে এক কাজ করো। তুমি গিয়ে বাড়ির সদর দরজাটা খুলো আর কি দেখলে সেটা এসে জানাও আমাকে। ‘
আবিরের কথায় বিনী কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো ‘ কেন ? ‘
কিন্তু আবির সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললো ‘ আহা যাও না, গেলেই দেখতে পাবে। ‘
অগত্যা উপায় না পেয়ে বিনী টেলিফোন হোল্ডে রেখে সদর দরজা গিয়ে খুললো। দরজা খুলতেই সে দেখলো পাড়ার মন্টু মিয়া এক মাঝারি বাক্স হাতে দেরি আছে। বিনীকে দেখা মাত্র মন্টু মিয়া বাক্স ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। বিনী কিয়ৎক্ষণ বোঝার চেষ্টা করলো বাক্সের ভিতর কি আছে। কিন্তু বুঝতে না পেরে একসময় খুলেই ফেললো বাক্সের মোড়ক।
বাক্স খুলতেই উন্মোচিত হলো এক ডজন রঙিন চুড়ির গোছা। এত চুড়ি আগে কখনও একসাথে পায়নি বিনী। আনন্দে তার চোখের কোণে অশ্রুরা ভিড় করলো। বিনী চুড়ির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে একটা ছোট চিরকুট পেলো। চিরকুটটা খুলে সে দেখলো ক্রিম কালারের কাগজের গায়ে কালো অক্ষরে লেখা ‘ শুধুই আমার বিনীর জন্য ‘
( এটাকে অন্য সব রোমান্টিক গল্পের মতো না ভাবার অনুরোধ রইলো, কারণ এই গল্পে নির্দিষ্ট কোনো ধরা বাধা নায়ক নায়িকা নেই। এই গল্পে সকলেই তাদের নিজ নিজ জীবনে নায়ক। )
—————————
এতগুলো রং বেরংয়ের চুড়ি দেখে বিনী আনন্দে খিলখিল করে উঠলো। তার অনেক দিনের ইচ্ছা, সুতি শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে চুড়ি পড়বে, পায়ে সরু নূপুর পড়াবে আর চুলে বেলি ফুলের মালা। ব্যাপারটাই যেন অন্যরকম। তবে এটা ঠিক সে চেয়েছিল এসব তার জন্য সরাব করবে। কিন্তু মানুষটা তার ভাগ্যে থাকলে তো।
বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষকে না পেয়ে বেদনায় নীল হওয়ার মতো বোকা বিনী নয়। সে আগেও এমন অনেক কিছু চেয়েছে যা কখনও পায়নি। জহির সাহেবের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল বিধায় যেকোনো জিনিস চাইলেই সহজে পেয়ে যেত। কিন্তু এসব বিলাসিতার বদলে তার খুবই কাছের মানুষজন তার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে।
বিনীর তেমন কোনো চাওয়া পাওয়া ছিল না। সে শুধু চেয়েছিল তার শৈশবের দিনগুলোতে জহির সাহেব আর সালমা ইসলাম তাকে সময় দিবেন। ছুটির দিনগুলোতে তাদের দুই বোনকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি। সালমা ইসলাম বরাবরই তার চাকরি নিয়ে আর জহির সাহেব তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের ফিরে তাকানোর মতো সময় তাদের ছিল না।
বাবারা তো কাজ করে তাই তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু মা!! তাদের সমস্ত সময় বরাবরই সন্তানদের জন্য বরাদ্দ। তাহলে তারা কেন সন্তান ফেলে শুধু নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভাবে ? চাকরি যখন করছে তখন সেইভাবে সংসারও সামলানো উচিত।
তবে বিনী এখন আর ওসব নিয়ে মন খারাপ করে না। এসব তার সয়ে গেছে। এমনকী আসফিয়াও এসব মেনে নিয়েছে। তার মতো করে কোনওদিন সে অভিযোগ জানায়নি। সে ব্যস্ত তার পড়াশোনা নিয়ে। মা বাবাকে নিয়ে মাতামাতি করা তার জন্য বিলাসিতা। পড়াশুনা আর উপন্যাসের রাজ্যই তার জন্য যথেষ্ট।
সালমা ইসলাম তো এখনও চাকরি করে চলেছেন। বেসরকারি এক কলেজে প্রফেসর তিনি।
বিনীর এত বছরের জীবনে তার বিয়ের সময় ছাড়া সে কখনো সালমা ইসলামকে এত লম্বা ছুটিতে দেখেনি। এত বছরে উনি কেবল মেয়ের বিয়েতেই ছুটি নিয়েছেন। এছাড়া কোনওদিন ছুটি নেওয়ার কিংবা স্বামী,সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে হয়নি তার। বিনী যখন ছোট্টটি ছিল তখন প্রায়শই ঘুরতে যাওয়ার আবদার করতো। কিন্তু যতই ও ক্রমশ বড় হতে শুরু করলো ততই ওর আবদার আর অভিযোগের ঝুলি কমে যেতে শুরু করল।
বিনী আনন্দ চিত্তে বাক্সখানা হাতে নিয়ে বসার ঘরে এলো। টেলিফোন কানে ধরে লাজুক কণ্ঠে বললো ‘ ধন্যবাদ আমার ইচ্ছের ঝুলি থেকে একটা ইচ্ছে পূরণ করার জন্য। ‘
আবির হাসলো বিনিময়ে। তাদের মাঝে আরও কিছু কথা হলো যা আমাদের না শুনলেই হয়। কথা শেষে বিনী টেলিফোন রেখে ওর উপহারের বাক্স ঘরে রেখে এসে আবারও কাজে বসলো।
শাহিদা খাতুন বিনীকে ফিরতে দেখলেন কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। স্বামী, স্ত্রীর কথার মাঝে ঢুকে উনিই বা কি করবেন। অনেক শাশুড়ি আছেন যারা ছেলের বউয়ের সঙ্গে ছেলের ঘনিষ্ঠতা মেনে নিতে পারেন না। ছেলে আর ছেলের বউয়ের কথার মাঝে পড়ে নিজের হাত, পা, নাক, কান সব গলিয়ে দেন। শাহিদা খাতুনের মনে হয় এসব ব্যক্তিত্বহীন মানুষেরই কাজ। ছেলেকে তো বিয়েই দেওয়া হয়েছে আরেক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বংশ বৃদ্ধি করার জন্য। তাহলে ঘনিষ্ঠ হলে যদি এত আপত্তি থাকে তাহলে বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনই নেই। ছেলেকে ননীর পুতুল সাজিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখুক।
—-
রোজকার মতো আজও কলেজ শেষে নিয়ম করে বান্ধবীদের নিয়ে পথ চলা আরম্ভ করেছে আসফিয়া। সে ভেবেছিল কালকের ঘটনার পর আজ আর হয়তো জাদিদ আসবে না। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে আজও জাদিদ কলেজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আসফিয়া এতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো তবে সেই দিকে মাথা না ঘামিয়ে সে পথ চলতে শুরু করল। কুসুম আর রানীও জাদিদকে লক্ষ্য করেছে। আগের তুলনায় জাদিদকে নিয়ে তাদের মনের ভয়টা কমেছে।
আসফিয়া তার বান্ধবীদের সঙ্গে নীরবে হাঁটতে হাঁটতেই এগোচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ সামনে জাদিদের দেখা পেয়ে তিন বান্ধবীই থেমে গেলো। আসফিয়া ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে আর কুসুম এবং রানী খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। জাদিদ তাদের থেকে বয়সে অনেক বড় তার উপর শরীরে স্বাস্থ্য ভালো বলে একটু বেশিই লম্বা মনে হয়। এমনিতেও তারা ভাইয়েরা উচ্চতায় অনেকটা লম্বা। এখন এহেন ইয়া লম্বা একটা ছেলেকে দেখে কুসুম আর রানীর মতো ভীতু মানুষের দল ভয় না পেয়ে যায় কোথায়।
‘ আমাদের কি একটু একলা ছাড়া যায় আপুরা ? ‘
জাদিদ কথাটা কুসুম আর রানীর দিকে তাকিয়েই বললো। ওর কথা শুনে কুসুম আর রানী একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো তারপর আলতো মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জাদিদ আর আসফিয়াকে ফেলে একলা হাঁটতে শুরু করলো দুজনে। ওদের এভাবে এগিয়ে যেতে দেখে হতবাক আসফিয়া ‘ এই তোরা আমায় ফেলে কোথায় যাচ্ছিস ? ‘ বলে এগোতে চাইলো কিন্তু বিধি বাম।
জাদিদ তার লম্বা বলিষ্ঠ হাত দুটো দিয়ে আসফিয়াকে জাপটে ধরেছে বাহুতে। আসফিয়া শত চেষ্টায়ও সেই বন্ধন উপেক্ষা করতে পারছে না। চেহারায় মেকি বিরক্তিকর ভাব এনে বললো ‘ আটকে ধরেছেন কেন এভাবে ? বলিনি কাল মা কখনোই আপনাকে মেনে নিবে না ? হাতটা ছাড়ুন আশেপাশে সবাই দেখবে। ‘
আসফিয়ার কথা শুনে জাদিদ ওর হাত ছেড়ে দিল। ছাড়া পেয়ে আসফিয়া সস্তির নিশ্বাস ফেলে হাঁটতে শুরু করলো। তবে জাদিদ তার পিছু ছাড়লো না। সে আসফিয়ার পিছন পিছন এগিয়ে গেলো। খানিকটা দ্রুত হেঁটে নিজেদের পথের তাল মিলিয়ে নিলো। আসফিয়া ওকে এভাবে ওর পাশে পাশে হাঁটতে দেখে অবাক হলো। বিস্মিত গলায় বলল ‘ আমি আপনার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আপনি আমাদের এলাকায় দাড়িয়ে এখনও আমার পাশে হাঁটবার মতো সাহস করছেন। ‘
আসফিয়ার কথায় ভাবান্তর দেখা দিল না জাদিদের মাঝে। তবে সে মৃদু হাসলো। হেসে আসফিয়ার এক হাত নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে পথ এগোতে এগোতে বললো ‘ সাহসের কথা বলছো ? সাহস না থাকলে প্রেমে পড়ার মতো দুঃসাহসিক কাজ করতাম না। আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের বর্তমান নষ্ট করার মতোই অবিবেচক আমি নই। বুদ্ধিমানরা কখনও ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের বর্তমান নষ্ট করে না। তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয় ভাগ্যের উপর। ‘
আসফিয়া জাদিদের কথার জবাবে কিছু বললো না। সে নীরবে সময়টা জাদিদের সঙ্গে উপভোগ করছে। আপাতত সালমা ইসলামের কথা ভেবে নিজের সুখ, শান্তি নষ্ট করার ইচ্ছে বা শক্তি তার নেই। তবে চিন্তা করতে ইচ্ছা করছে না বললেও চিন্তা ঠিকই রয়ে যাচ্ছে। তাদের এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি ? আদৌ কি তাদের অদৃষ্ট এক বন্ধনে বাধা পড়বে ?
—-
বিনী আবারও একই ভুল করেছে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে সে খানিক বিশ্রাম করবার জন্য বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলো। ক্লান্তি সমস্ত শরীরে ভার করায় বিছানা গা লাগানো মাত্র অতল নিদ্রায় তলিয়ে যায় সে। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। ধরফরিয়ে উঠে বসে সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা সাতটা অথচ আজাদ সাহেব, সাজ্জাদ সাহেব বিকালে চা খান। বাড়ির সকলে বিকালেই চা, নাস্তার পাট চুকিয়ে রাখেন।
বিনী অপরাধী মুখে দ্রুত হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। মাথার আঁচল টেনে রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালো নগ্ন পায়ে। বিনীত সুরে গলা খাদে নামিয়ে বললো ‘ ক্ষমা করবেন আম্মা। বিছানায় শুয়েই চোখ লেগে গেছিল তাই ঘুমের মধ্যে টের পাইনি। দয়া করে রাগ করবেন না। আমি বুঝতে পারিনি এত দেরী হয়ে যাবে। ‘
শাহিদা খাতুনের মুখ থমথমে। উনি জোরে জোরে রান্নাঘরের কল পাড়ে বাসন মাজছেন। মুখে রা নেই তার। তাকে চুপ দেখে বিনীর এবার কান্না পেলো। সে না পারছে তার পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলতে আর না পারছে কাদতে। সে তার কান্না সামলে আফিফাকে ধরলো। অসহায় গলায় বললো ‘ ভাবি আম্মাকে বলেন না এই ভুল আর হবে না। আমি এরপর থেকে আর দুপুরে কাজের পর ঘুমাবো না, ঘরেও ঢুকবো না। তাও যেন আম্মা রাগ কইরা না থাকে। ‘
বিনীর কথা শুনে আরও রেগে গেলেন শাহিদা খাতুন। তিনি ফোঁস করে হাতে থাকা বাসন বিকট শব্দে মেঝেতে রাখলেন। থালা বাসনের ঝনঝন শব্দে জাহানারা কেপে উঠলেন। আফিফা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো শাশুড়ির দিকে। আসল কথা শাহিদা খাতুন রেগেছেন কি কারণে সেটাই বুঝতে পারছে না ও। রাগার মতো কি হয়েছে ?
‘ খবরদার মুখ সামলাইয়া কথা কও বউ। তুমি অনার্স পাস মাইয়া মানুষ এমনে কথা কইলে আমরা মূর্খ মহিলা মানুষ কেমনে কথা কমু ? খবরদার এই ভাষায় আর ভবিষ্যতে কইবা না। আর দেরি কইরা উঠছো তো কি হইসে ? মহাভারত অশুদ্ধ হইসে নাকি ? দেরি হইয়া গেছে ভালো কথা। মানুষ মাত্রই ভুল, ঘুম আইবারই পারে এতে এত ক্ষমা চাইবার কি আছে ?তুমি ঘুমাইসো তাতে আমি রাগ করমু কেন ? মনে হয় আমি ঘুমাই নাই ? ‘
শাহিদা খাতুনের আচমকা বিরূপ আচরণে বিনী কান্না ভুলে থতমত খেয়ে গেল। সে আশা করেছিলো শাহিদা খাতুন এখন আরও তার অসময়ে ঘুমিয়ে পড়াতে রাগারাগি করবেন, বকাঝকা দিবেন এবং শেষে হয়তো কয়েকটা কড়া কথাও শোনাবেন। অথচ পরিস্থিতি পুরোই উল্টো। উনি নাকি বিনী ক্ষমা চাওয়াতে রেগে গেছেন ?
আফিফা এবার না পারতে হেসে উঠলো। সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি শাহিদা খাতুন রেগেছেন কেন। এখন তার মস্তিষ্কে ধরা দিয়েছে শাহিদা খাতুন প্রয়োজন বিনা অতিরিক্ত কথা পছন্দ করেন না অথচ বিনী ক্ষমা করে দিন বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। এদের দুই জনের কাহিনী দেখলে তার হাসি পায়। তার বিয়ের পরপর সেও শাহিদা খাতুনকে ভয় পেত কিন্তু সেই ভয়ের মাত্রা দুই দিনের বেশি ছড়ায় নী। অথচ বিনীর বিয়ের সাত দিন কিন্তু বিনী এখনও শাহিদা খাতুনকে জমের মতো ভয় পায়।
‘ এত হাসবার কি আছে ? মাইয়া মানুষ গো হাসতে নাই জানোনা বউ ? চুপচাপ কাম করো। হাজারবার কইছি কামের সময় এত কথা কইবার না কিন্তু হেগো যত কথা কামের সময়ই মনে পড়ে। অসহ্য…অসহ্য। ‘
শাহিদা খাতুন রাগে গজগজ করতে করতে আবারও থালা বাসন মাজতে বসলেন। উনার মাথা গরম আপাতত। বারবার ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটা উনার মোটেই পছন্দ নয়। এতে নিজেকে ছোটলোক মনে হয়। তার মতে কেউ কোনো অপরাধ করলে তাতে নিজের অপরাধ স্বীকার করতে পারে এবং দুঃখ প্রকাশও করতে পারে। কিন্তু বারবার ক্ষমা চেয়ে অপর পাশের মানুষটাকে নিজের নজরে বড় করে দেয় ঠিকই কিন্তু মানুষটা নিজের নজরে ছোট হয়ে যায় সেটা আর কেউ বুঝে না।
শাহিদা খাতুনের এহেন রাম ধমক খেয়ে বিনী আর কিছু বলবার সাহস পেলো না। সে নীরবে, নিঃশব্দে কাজে বসলো। রাতের তরকারি করতে হবে। আজ সকলে রাতের খাবারে রুটি খাবে তাই বিনী ঠিক করলো রুটিটা করে ফেলা যায়। সেই মতেই সে আফিফাকে কানে কানে সুধালো আটা কতটুকু দিবে।
আফিফা মানুষ ভেবে পরিমাণ জানালো।
আফিফা আর বিনীর ফুসুর ফুসুর দেখে আবারও রেগে গেলেন শাহিদা খাতুন। কটমট দৃষ্টিতে বললেন ‘ এত ফুসুর ফুসুর কিসের ? আমারে কওন যায় না ? ‘
বিনী শাহিদা খাতুনের ধমক শুনে বলে উঠলো ‘ আম্মা আপনিই তো বললেন কথা না বলতেন। ‘
‘ খামোশ… আমি বলিনি প্রয়োজনেও কথা না বলতে। ‘
এরপর আর কথা বাড়ালো না বিনী। সে আটা সিদ্ধ করতে দিয়েছে চুলায়। কাজের মাঝেই সবার কানে এলো টেলিফোনের শব্দ। জাবিয়া তখন বসার ঘরেই বই নিয়ে বসে সাজ্জাদ সাহেবের কাছে হায়ার ম্যাথ করছিলো। সে ছুটে গেলো ফোন ধরতে। টেলিফোনের শব্দ বন্ধ হয়ে যেতেই আর কেউ উঠে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। যে যার যার কাজে মন দিলেন।
কথা বলে রান্নাঘরে এসে দাড়ালো জাবিয়া। সে জানালো জাহানারার বড় ভাই আজমল সাহেব ফোন করেছেন, জরুরি এক বিষয়ে কথা আছে। জাহানারা তা শুনতে পেয়ে হাত পা ধুয়ে মুছে এগিয়ে গেলেন বসার ঘরে। বড়রা কথা বলবে বিধায় জাবিয়া আর বসার ঘরে বসলো না। সে বই খাতা নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো।
দীর্ঘ এক আলাপ সেরে খাবার ঘরে এসে দাড়ালেন জাহানারা। তার চোখে মুখে আনন্দের রেশ। উনি হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠস্বরে শাহিদা খাতুনকে বললেন ‘ একটা সুখবর আছে আপা। ‘
সুখবরের কথা শুনে শাহিদা খাতুন মুখ তুলে চাইলেন। কাজ করতে করতে বললেন ‘ কি সুখবর ?’
‘ আমার বড় ভাইয়ের ছেলে শাহরিয়া আছে না ? ও কিছুদিন আগে বিলেত থেকে ফিরেছে। একবারে দশ বছর পর পড়াশোনা শেষে ফিরেছে। এই দেশেই নাকি একবারে ব্যবসা পাতি করবে। ভাইজান ঠিক করেছেন শাহরিয়ার বিয়ে দিবেন। তাই আমাদের জাবিয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ‘
জাহানারার কথায় সকলে চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু বিনী যেন খুশি হয়েও খুশি হতে পারল না। আসফিয়ার কাছে বিয়ের আগে শুনেছিল জাবিয়ার প্রেমিক আছে, নাম তুষার। তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক কতটুকু গভীর সে জানেনা। তবে যদি সত্যি সত্যি তারা একে অপরকে ভালোবেসে থাকে তাহলে তো এই বিয়ে করে সুখী হতে পারবে না জাবিয়া। ভালোবাসাহীন সম্পর্কে আদৌ কি সে সুখী থাকবে ?

—————————
আজমল সাহেবের একমাত্র ছেলে শাহরিয়া সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংকে নিজের ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিল। সেই সূত্রেই অনার্স শেষে আরও উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমিয়েছে দূর দেশে। দীর্ঘ চার বছর পর সেই পড়াশোনার পাট চুকিয়েই দেশে ফিরে এসেছে সে। বয়স বেড়ে উনত্রিশ তাই এখনই আজমল সাহেব বিয়ে দিয়ে ছেলের সংসার গোছাতে চাচ্ছেন।
আজমল সাহেবের স্ত্রী মারা গেছেন শাহরিয়ার যখন দশ বছর তখন। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি ছেলের মুখ চেয়ে আর দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবেননি। একা হাতেই ছেলেকে বড় করেছেন। একলা বাবা হয়ে চাকরি সামলে ছেলেকে বড় করার পথ সহজ ছিল না। কিন্তু জাহানারার জন্য উনার অনেকটা সুবিধা হয়েছে।
মা হারা একমাত্র ভাতিজাকে আগলে নিয়েছিলেন জাহানারা। উনি যখন ছোট ছিলেন তখন এই শাহরিয়ার বাবাই উনাকে আগলে আগলে রেখেছেন। তাই ভাইয়ের দুর্দিনে একজন বোন হিসেবে দূরে সরে যাওয়ার অপরাধটা করতে পারেননি। তাই সময় সুযোগ হলেই ভাতিজাকে নিজের বাড়ি এনে রাখতেন। সেই থেকেই শাহরিয়ার সঙ্গে আবিরদের বাড়ির সকলে অনেক ভালো সম্পর্ক।
ভালো সম্পর্ক হওয়ায় শাহরিয়া আর জাবিয়ার বিয়ের কথা শুনে কেউই আপত্তি করতে পারেননি। উল্টো সাজ্জাদ সাহেবের খুশি যেন ধরতে চায় না। শাহরিয়ার মতো এত ভদ্র ও মার্জিত ছেলেকে নিজের জামাই করার সুযোগ কোনো বাবাই হাতছাড়া করতে চাইবে না। উনি তো খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেছেন মেয়েকে বিয়ে দিতে। আজাদ সাহেব যাও বা জাবিয়ার বয়স নিয়ে কথা তুলেছিলেন কিন্তু সাজ্জাদ সাহেব ব্যাপারটায় বেশ কয়েকটা অকাট্য যুক্তি দেখিয়ে আজাদ সাহেবকে রাজি করিয়ে নিয়েছেন বিয়েতে।
জাবিয়ার বিয়ের খবরে যেমন বিনী খুশি হতে পারেনি তেমনই জাবিয়া নিজেও খুশি হতে পারছে না। খবরটা শোনার পর তার পায়ের তলার মাটির নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে সে এখনই মাথা ঘুরে পড়ে হবে। সে কোনোমতে আশপাশ দেওয়াল হাতড়ে নিজের ঘরে ঢুকলো তারপর নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে বিছানায় পা থেকে মাথা অব্দি কাথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
—-
বাহিরে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। আবির বাড়ি ফিরেছে কাক ভেজা হয়ে। হসপিটাল থেকে সে রোজ গাড়ি দিয়েই ফিরে কিন্তু আজ পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই গাড়ি গ্যারেজে পাঠিয়ে দিয়ে তাকে পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরতে হয়েছে। বাড়ি ফেরার সময় অর্ধেক রাস্তা অব্দি পরিবেশ শান্তই ছিল কিন্তু হঠাৎই বাড়ির খানিকটা কাছে আসতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। উপায় না পেয়ে ব্যাগ কাধে দৌড়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো আবির। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না তার। সেই বৃষ্টিতে ভিজে কাক ভেজা হয়েই ফিরলো সে।
আজ কয়েকদিন পর ছুটি কাটিয়ে হাসপাতালে জয়েন করাতে রোগীর চাপ বেশি ছিল তাই ফিরতেও দেরি হয়েছে। যার ফলে সে ফিরতে ফিরতে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও ঝড় বাদলের দিন বলে বিনীর সঙ্গে সঙ্গে শাহিদা খাতুনও বসেছিলেন। দুই শাশুড়ি বউ বৃষ্টির মরশুমে আদা চা খেয়ে সময় কাটাচ্ছিলেন। তাকে ফিরতে দেখে শাহিদা খাতুন উঠে দাড়ালেন এবং তাকে জামা কাপড় বদলে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়তে বলে নিজেও ঘরের দিকে গেলেন।
জামা কাপড় বদলে বিছানায় বসেছে আবির। বিনী ওর ভেজা জামা কাপড়গুলো বাথরুমে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। আবিরের এখন আর খেতে মন চাইছে না। ব্যস্ততায় আজ বিনীর জন্য বেলি ফুলের মালা আনতে পারেনি তাই মন মেজাজ ভালো না। বিনী অবশ্য সেসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি। ঝড় বাদলের সময় ফুলের মালা নিয়ে তর্ক করার মতো বোকা সে নয়।
বিনীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ছটফট করছে আবির। অথচ বিনীর সেইদিকে খেয়াল নেই। সে আপনমনে আবিরের ময়লা কাপড়চোপড় খচেই যাচ্ছে। এতে আবির বেশ বিরক্ত। বাধ্য হয়ে সে একসময় বললো ‘ এই কাপড়গুলো কি কাল বুলুকে দিয়ে ধোয়ানো যেত না ? রাত বিরাতে এসব ধোয়ার প্রয়োজন কি ? ‘
‘ এখন ধুয়ে মেলে দিলে কাল রোদ উঠলে দ্রুত শুকাবে। তুমি খাবে না নাকি ? খাবার তো দিয়ে রেখেছি, খেয়ে শুয়ে পড়ো। ‘ বিনী কাজ করতে করতেই বললো।
‘ আজিব তো। আমি কি তোমাকে ছাড়া খাবো ? তুমি খেয়ে ফেলেছো ভালো কথা তাই বলে একটু খাওয়ার সময় আমার সঙ্গে বসবে না ? খেতে খেতে একটু কথা বলা উচিত না আমাদের ? তুমি চুড়িগুলোও পড়নি ‘
আবিরের কথায় হাসলো বিনী। কাপড় চিপতে চিপতে বললো ‘ ধুস!! কাজের সময় চুড়ি পড়লে কাজ করবো কি করে ? এভরিথিং হ্যাস এ পারফেক্ট টাইমিং। সময় হলেই পড়ব। ‘
বিনীর কথায় আবির চোখ দুটো গোলগোল করে বললো ‘ তা আপনার সেই সময় কবে হবে ম্যাডাম ? আমি বুড়ো হলে ? ‘
‘ না না তোমাকে অত অপেক্ষা করাবো না। একদিন দেখবে হুট করে শাড়ি, চুড়ি,নূপুর আর বেলি ফুলের মালা সব পড়ে সেজেগুজে তোমাকে চমকে দিয়েছি। ‘
‘ তোমার সেই একদিনের অপেক্ষায় থাকবো আমি। আই উইশ দ্রুত আসুক সেই একদিন। ‘
তারপর বিনী আর আবিরের মাঝে আরও কথা চললো। বিনী কাজ করতে করতেই সেই বার্তালাপ চালালো। বিনী আবিরের জামা কাপড় বারান্দায় মেলে দিলো, ঘরের জানালাগুলোর খিল আটলো, পর্দা দিলো, বিছানা ঝেড়ে দিয়ে আবিরকে মশারি করতে বলে সে নিচে গেলো। পুরো বাড়ির সব ঘরের বাতি পর্যবেক্ষণ করে একবারে ঘরে এলো। ততক্ষনে আবিরের মশারি করা হয়ে গেছে। সে বারান্দার দরজা আটকে দিয়ে শুতে এলো।
‘ রাগ করলে ? ‘
বিনী তখন উল্টো দিকে ফিরে শুয়েছিল। জাবিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে জাহানারার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন তার। জাবিয়ার মতামতও নেওয়া প্রয়োজন কারণ দিনশেষে বিয়েটা হলে সংসার সেই করবে। কিন্তু আবিরের কথায় আবিরের দিকে ফিরে শুলো। অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলো ‘ তোমার কেন মনে হলো আমি রাগ করেছি ? ‘
‘ আজ তোমার জন্য ফুলের মালা আনতে পারিনি। বিশ্বাস করো বের হতে এত দেরি হয়েছে যে ফুলওয়ালাকে খুজেই পাইনি। ‘
বিনী মৃদু হাসলো। বললো ‘ আমি পাঁচ বছরের বাচ্চা নই আবির। যে কারোর পরিস্থিতি বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে। আমি জানি তুমি আনোনি তারমানে পরিস্থিতি তোমার অনুকূলে ছিল না। এত ছোট কথায় রেগে যাই না আমি। আমাকে রাগিয়ে দেওয়া এত সহজ না। এর জন্য তোমাকে শত সহস্র বছর সাধনা করতে হবে। ‘
আবির এবার খানিকটা আশ্চর্যই হলো। তবে বিনী রাগ হয়নি জেনে প্রশান্তি পেলো তার উত্তাল হৃদয়খানা। সে মৃদু গলায় বললো ‘ তাহলে আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো যেকোনো মূল্যে তোমাকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। ‘
‘ শুনেছিলাম লোকে বিয়ের পির চেষ্টা করে যাতে বউ কোনক্রমেই রেগে না যায় আর তুমি উল্টো চাইছো আমি যেন রেগে যাই। ভেরি স্ট্রেঞ্জ!!! ‘
‘ আমি চাই আমার বউ রেগে যাক। যেই মানুষটাকে তিন কবুল বলে বিয়ে করেছি, যার শরীরের প্রত্যেকটা ভাজে ভাজে আমার স্পর্শ তার রাগ, দুঃখ, অভিমান সবকিছুই সহ্য করার মতো সাহস আমার থাকা উচিত বলেই আমি মনে করি। যেই মানুষ আমার জন্য আমার পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে, নিজের হাত পুড়িয়ে রাধতে পারে, রাত বিরাতে আমার ময়লা কাপড় ধুয়ে দিতে পারে তার জন্য আমি এতটুকু করতেই পারি। ‘
শেষের কথাটা আবির বিনীর বাম হাতটা টেনে ধরে পুড়ে যাওয়া জায়গায় নিজের অধর ছুয়ে দিয়ে বললো। বিনীর হাতে এই ক্ষত তৈরি হয়েছে আজ বিকেলে আবিরের শার্ট আইরন করতে গিয়ে, বেখেয়ালে হাতে লেগে গেছে গরম ইস্ত্রি। বিনী সেটা কোনক্রমেই টের পায়নি অথচ আবির কিছুক্ষণ থেকেই লক্ষ্য করে ফেলেছে। বিনী মুগ্ধ আবিরের ব্যবহারে। এই মানুষটা এমন কেন ? তার প্রত্যেকটা জানা,অজানার খেয়াল রাখে সেই প্রথম দিন থেকে।
আবির বিনীকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। বিনীর ঘর্মাক্ত মুখে চুমু খেয়ে বললো ‘ এখন থেকে আমি বাড়ি ফিরলে আর কাজ করবে না। ‘
বিনী ওর কথা শুনে বললো ‘ তাই ? তা ঘরের কাজগুলো কি আমার ভুত করে দিয়ে যাবে ? ‘
‘ প্রয়োজনে কাজ মিটিয়ে রাখবে কিংবা পরের দিন করবে কিন্তু আমি যতক্ষণ বাড়ি থাকবো ততক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। আমায় ভালোবাসবে, যত্ন করবে। বুঝলে ? ‘
বিনী এবার আবিরের কথায় নিজেকে আবিরের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। গলা টেনে বলল ‘ উ… আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। তোমার এত আশেপাশে ঘুরলে আম্মা অন্য কিছু ভাববেন। আর কথা পাও না না ? আমি বুঝি তোমার কোলে বসে থাকবো ? ‘
‘ দরকার পড়লে তাই করবে তবুও আমি ঘরে থাকলে কাজ করা যাবে না। আমি যতক্ষণ আশেপাশে থাকবো আমি চাই তোমার সমস্ত মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু তখন আমিই হবো। ‘
বিনী হাসলো। আর কথা বাড়ালো না সে। সে জানে আবির যখন বলেছে তখন মানতেই হবে। আবিরকে বিয়ের পর এই কদিনে যা বুঝেছে তাতে ও এক কথার মানুষ ঠিক তার মায়ের মতো। তাই আবিরকে আর ঘাটালো না সে। তুমুল বর্ষণ শেষে উকি দিয়েছে এক ফালি চাঁদ। সেই চাঁদের আলো পর্দার ফাঁক গলে ঘরের ভিতর উকি দিচ্ছে। টুকরো টুকরো চাঁদের আলোয় ঘরটা অন্যরকম মায়াবী লাগছে। মায়াবী আলোয় দুই কপোত কপোতী ডুবেছে তাদের ভালবাসার অনন্ত মায়ায়।
—-
জাহানারা বিছানা গুছিয়ে রাখছেন। বাহিরে সাজ্জাদ সাহেব খেতে বসেছেন। জাবিয়া এখনও ঘর ছেড়ে বের হয়নি। অবস্থা ভালো না দেখে জাহানারা তাকে ঘরে গিয়ে দেখে এসেছেন। জাবিয়ার শরীর কাপিয়ে জ্বর এসেছে তাই আপাতত সে ঘরেই আছে। শরীর ভালো না হওয়া পর্যন্ত কলেজে যাওয়া হবে না।
জাহানারাকে একাকি দেখে বিনী ঘরের দরজা কড়া নাড়লো। বিনীকে দেখে জাহানারা হেসে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন ‘ কিছু বলবা নাকি বউ ? আজ হঠাৎ রাস্তা ভুলে আমার ঘরে ? আপা কি কাজ করতে মানা করেছে ? ‘
‘ না কাকী আসলে জরুরি এক ব্যাপারে কথা ছিল। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে বলতাম। ‘ বিনী সংকোচ ঠেলে বললো।
বিনীকে এত আমতা আমতা করতে দেখে জাহানারা নির্ভয় দেখিয়ে বললেন ‘ আরে এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তুমি শুধু বলো, আমি শুনছি। ‘
‘ শুনলাম জাবিয়ার মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে ওর বিয়ের কথা চলছে। বলছিলাম যে জাবিয়ার সঙ্গে কথা বললে ভালো হতো না ? না মানে ওর কোনো আলাদা পছন্দ আছে কিনা ? ‘
জাহানারা মন দিয়ে বিনীর কথা শুনলেন। অতঃপর ঘর ঝাড়ু দিতে দিতে বললেন ‘ জীবনটা বাচ্চাদের উপর নির্ভর করলে চলে না আম্মা। আমার বিয়ের পঁচিশ বছর আর জাবিয়ার বয়সই আঠারো বছর। আমি ওর থেকে অনেক বেশি দুনিয়াদারি দেখেছি কাজেই কে ওর জন্য ভালো সেটা আমি জানি। ওর সাময়িক সুখের কথা ভেবে আমি ওর ইচ্ছা মতো জীবন সঙ্গী বেছে দিতে রাজি হলে ওর শেষ জীবনটা আফসোসেই কাটবে যেটা আমি মা হিসেবে চাইনা। ‘
এরপর আর কিছু বলতে পারলো না বিনী। জাহানারা আর জাবিয়ার সঙ্গে তার সুন্দর সম্পর্ক। জাবিয়ার প্রেমিক তুষারের কথা তুলে দুজনের সঙ্গে সম্পর্কটা সে নষ্ট করতে চাইছে না। তবে জাবিয়ার সুখের কথা ভেবে চুপও থাকা যাচ্ছে না। কিছু একটা করা প্রয়োজন। জাবিয়ার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।
—-
বাড়িতে একটা হইচইয়ের আমেজ তৈরি হয়েছে। প্রিয় ভাগ্নির জ্বরের খবর পেয়ে ছেলেকে নিয়ে ছুটে এসেছেন আজমল সাহেব। এত বছর ছেলের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বিদেশে ছিলেন তাই ভাগিনা, ভাগিনির সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়না অনেকদিন। তার উপর দিয়ে জাবিয়ার এমন জ্বরে পড়ার খবর শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না তিনি। পুত্র এবং পারিবারিক ডাক্তার সমেত হাজির হলেন তিনি।
ডাক্তার দেখে দিয়েছেন জাবিয়াকে। জানিয়েছেন ঋতু পরিবর্তনে ভাইরাল ফিভার হয়েছে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম আর সেবা নিলে দিন দুই তিনের মাঝেই সুস্থ হয়ে উঠবে। চেক আপ শেষে আজমল সাহেব ডাক্তার সাহেবকে এগিয়ে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আর বাকিরা যার যার মতো বেরিয়ে গেলো। বিনী ভেবেছিল সে জাবিয়ার কাছে বসবে কিন্তু পরে আবার ভাবলো জাবিয়া এখন অচেতন প্রায় কাজেই বসে থেকে তাকে বিরক্ত করে লাভ নেই। তাই সে জাবিয়াকে দেখে বেরিয়ে গেলো।
ডাক্তার সাহেবের ওষুধের প্রভাবে জাবিয়ার জ্বর নামতে শুরু করেছে। ঘুমের ঘোরেই সে ঘেমে উঠছে। নাকের উপর জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। জাবিয়া ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরলো। তার ঘুম হালকা হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ পরেই জাবিয়া পুরোপুরি চোখ খুললো। সে উঠে বসলো বিছানা ছেড়ে। জ্বরের প্রকোপে শরীরটা বড্ড দূর্বল লাগছে, মাথাও ঘুরছে।
ঘরের জানালা খুলে দিল জাবিয়া। জানালা খুলতেই উত্তাল দখিনা বাতাস এসে হাওয়া লাগিয়ে গেলো জাবিয়ার সমস্ত অঙ্গে। জাবিয়া মলিন হাসলো। এই দখিনা হাওয়া সে কত উপভোগ করেছে তুষারের সঙ্গে তার ইয়াত্তা নেই। অথচ কিছুদিন পরেই সেসব মনে করাও তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে দাঁড়াবে। এটা কি আদৌ সম্ভব ? মনে একজনকে রেখে আরেকজনের সঙ্গে সংসার করা ?
নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে জাবিয়ার গলা উপচে কান্না উঠছে। সে জানালা ধরে বসে পড়লো। হু হু শব্দে কেঁদে উঠলো মৃদু স্বরে। কেউ শুনে ফেলবে সেই ভয়ে গলা চড়িয়ে কাদতেও পারছে না। কাদতে পারলে হয়তো মনটা হালকা হতো। জাবিয়ার জানা ছিলনা কাউকে ভালোবাসলে এত কষ্ট পেতে হয়। জানলে সে নিজ দায়িত্বে এসব থেকে সরে দাঁড়াত।
জাবিয়ার মনে পড়লো তুষারের সঙ্গে কাটানো সোনালী দিনগুলোর কথা। তুষার এক সময় তাদেরই কলেজের স্টুডেন্ট ছিল। জাবিয়াদের কলেজে দুটো সেকশন। একটা স্কুল সেকশন আর আরেকটা কলেজ সেকশন। সেই কলেজ সেকশনেরই এক দুর্দান্ত ছাত্র ছিল তুষার। জাবিয়া তখন সপ্তম শ্রেণীতে ছিল যখন তুষার পড়তো ইন্টার শেষ বর্ষে। দেখা সাক্ষাৎ তাদের রোজই হতো কিন্তু প্রেমটা তখনও জমেনি।
তুষার আর জাবিয়া, দুজনের প্রেম তখন হলো যখন মেট্রিক শেষে জাবিয়া একই কলেজের ইন্টার সেকশনের ভর্তি হলো যেখানে তুষার ইন্টার পড়েছিল। দুর্দান্ত ছাত্র হওয়ায় কলেজের সব শিক্ষকদের বিশেষ নজরে ছিল। বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে তার ডাক প্রায়ই পড়তো। সেখান থেকেই তাদের প্রণয়ের আজ এক বছর পূর্ণ হয়েছে। অথচ সময় কত তাড়াতাড়ি দেখতে দেখতে পেরিয়ে যায় তাইনা ?
জাবিয়ার আজও মনে হয় সেই তো কালই তো সে কলা কৌশলে তুষারকে মনের কথা জানিয়েছিল। অবশ্য প্রণয়ের সূচনা তুষারই করেছিল কিন্তু ভালোবাসার কথাটা মুখে সর্ব প্রথম তো জাবিয়াই এনেছিল। অথচ জাবিয়াকেই এই ক্ষণস্থায়ী প্রণয়ের ইতি টানতে হবে। শুরুটা তুষার করলো অথচ শেষ করবে সে এক হৃদয়হীনার তকমা নিয়ে। ভালোবাসা এতটা কেন নির্দয় ?
জাবিয়া কান্নাকাটি শেষে চেয়ার টেবিল টেনে লিখতে বসলো। তুষারকে কথাগুলো তার নিজ মুখে বলা সম্ভব না। তাই সেসব চিঠিতে লিখবে। আর দিয়ে বলবে চিঠিটা যেন সে যখন তাকে দিয়ে ফিরে আসবে তখন পড়ে কারণ তুষারের সেই ডাগর ডাগর চোখগুলো দেখার সাহস তার নেই। দেখলেই মনে হবে মানুষটার সঙ্গে অপরাধ করেছে সে।
চিঠি লিখা শেষে উঠে দাঁড়ালো জাবিয়া। চিঠিটা নিজের কলেজ ব্যাগে মোটা একখানা বইয়ের ভিতর ঢুকিয়ে রেখে ঘর ছেড়ে বেরোলো। সিড়ি দিয়ে ত্রস্ত পায়ে নেমে এলো। মেয়েকে নামতে দেখে জাহানারা হাক ছাড়লেন। সকালের নাস্তা খেতে ডাকছেন তিনি। জাবিয়া জ্বরের ঘোরে এতক্ষণ বেসামাল ছিল বলেই খাওয়ানোর চেষ্টা করেননি। এখন যখন উঠেছে তখন খেয়ে নেওয়াই ভালো।
মায়ের ডাকে খাবার ঘরে ঢুকলো জাবিয়া। রান্নাঘরে বিনীরা কাজ করছে। জাহানারা জাবিয়ার প্লেটে পাতলা খিচুড়ি ঢেলে দিলেন। আজ সকালের নাস্তায় খিচুড়ি করা হয়েছে যেহেতু কাল রাতের তুমুল বর্ষণে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আজ। হিজল গাছের পাতায় এখনও বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির ফোঁটা। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ভেজা মাটির গন্ধ।
জাবিয়া খেতে খেতে বসার ঘরের দিকে তাকালো। বসার ঘরে সোফায় শাহরিয়া সাজ্জাদ সাহেবের মুখোমুখি বসে দুই হাঁটুতে হাত রেখে মনযোগ দিয়ে কথা শুনছে। পরনে সফেদ শার্ট আর ঢোলা কালো প্যান্ট। মানুষটাকে দেখেছে জাবিয়া দশ বছর পূর্বে অথচ এতদিন পর দেখেও তার ভিতর কোনো আগ্রহ বা কৌতূহল জন্মাচ্ছে না মানুষটার প্রতি। কিন্তু এই অনুভূতিহীন হৃদয় নিয়েই তাকে মৃত্যুর আগ অব্দি মানুষটার সঙ্গে সংসার করে যেতে হবে।
আসলে কপালে যা লেখা থাকে তাই ঘটে। অদৃষ্টের লেখন খন্ডানোর ক্ষমতা কারোর নেই। তাই জাবিয়াও মেনে নিয়েছে তার নিয়তিকে। জাবিয়া খাওয়া শেষে নিজের ঘরের দিকে গেলো। বিনীদের সব কাজ মিটিয়ে উঠতে উঠতে দুপুর হয়ে গেলো। বিনী দ্রুত ঘরে গিয়ে শাড়ি বদলে নিলো। গোসল সে সকালেই সেরে নিয়েছে। শাড়ি বদলে বেরিয়ে আফিফা আর সে মিলে দুপুরের খাবার পরিবেশন করলো সবাইকে।
শাহরিয়া এখনও বাড়ি ফিরেনি। জাহানারা তাকে বহু পীড়াপীড়ি করে রেখে দিয়েছেন। বলেছেন একবারে সন্ধার নাস্তা খাইয়ে তবেই ছাড়বেন। সত্যি বলতে এতদিন পর একমাত্র ফুপুর দেখা পেয়ে শাহরিয়াও আর বাড়ি ফেরা নিয়ে মাতামাতি করেনি। এই বাড়িতে আসতে তার ভালই লাগে। আগে বাংলাদেশে থাকাকালীন তো কতই এসেছে এই বাড়িতে। এখন তফাৎ শুধু এটা এখন থেকে সে আসবে ভিন্ন পরিচয়ে।
খাওয়া দাওয়া সেরে সকলে যখন খাবার টেবিলে বসে জাবিয়া আর শাহরিয়ার বিয়ে ঠিক হওয়ার খুশিতে মিষ্টি খেতে ব্যস্ত তখন জাহানারা জাবিয়াকে বললেন ‘ জাবু, মা আমার শাহকে একটু আমাদের ছাদখানা দেখিয়ে আন। কতদিন পর এলো ছেলেটা বাড়িতে। কে জানে ভুলেই গেছে কিনা। ‘
জাহানারার কথায় হাসলো শাহরিয়া আর কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো জাবিয়া। দশ বছরের দূরত্বে কেউ গোটা বাড়ির নকশা ভুলে যেতে পারে সেটা জাহানারার কথা না শুনলে সে জানতে পারতো না। শাহরিয়া হেসে বললো ‘ আমার স্মৃতি অতটাও দূর্বল নয় ফুপিজান। ছাদের রাস্তা আমার মনে আছে। ‘
‘ তবুও জাবুর সঙ্গে যা তুই। দুজনে মিলে ছাদ থেকে একটু খোলা হাওয়া খেয়ে আসবি। ‘
অগত্যা জাহানারার কথায় জাবিয়া আর শাহরিয়া কেউই আপত্তি করলো না। মানুষটার সঙ্গে যখন ঘর করতেই হবে তখন এখন থেকেই মানিয়ে নেওয়া শিখতে হবে। বিনা বাক্য ব্যয়ে জাবিয়া শাহরিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় তার পিছু নিতে বলে এগিয়ে গেলো। শাহরিয়া জাবিয়ার ইশারা লক্ষ্য করে হাতে থাকা মিষ্টির বাটি টেবিলের উপর রেখে হাঁটা ধরলো জাবিয়ার পিছন পিছন।
—-
ঘরের কাজকর্ম সব সেরে নূরজাহানকে জানিয়ে বই খাতা নিয়ে পাশের বাড়ির রুমা খাওয়ার কাছে ছুটলো রুনা। সরাব স্পষ্ট বলে দিয়েছে সে যেন পড়াশোনায় ঠিক মতো মন দেয়। পড়াশোনায় গাফিলতি সরাবের পছন্দ নয়। তাই রুনা ঠিক করেছে যাই হয়ে যাক না কেন সে ঠিকই পড়াশোনা চালিয়ে যাবে। তাকে ভালো নাম্বার করতেই হবে, সরাবের জন্য।
রুমা উনুনে কাঠের টুকরো ঢুকিয়ে দিলেন। ভাত চড়িয়েছেন তিনি। রুনাকে ঢুকতে দেখে বললেন ‘ এত দেরি করলে চলবে ? সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে তো নাকি ? তোর জামাইয়ের কানে গেলে কি হবে বুঝতে পারছিস ? ‘
রুমার কথায় রুনা দ্রুত মাথা নেড়ে বই তক্তার উপর সাজাতে সাজাতে বললো ‘ আর এমন ভুল হবে না। আসলে বুঝোই তো আপা বাড়িতে আমি আর আম্মা একা। আম্মার কাছে কাজকর্ম রেখে তো আসতে পারিনা। তাই সব কাজ মিটিয়ে আসতে আসতে দেরি হয়ে যায়। ‘
রুনার কথায় রুমা উত্তরে বললেন ‘ সেটা নাহয় আমি বুঝব কিন্তু তোর পরীক্ষায় নাম্বার খারাপ হলে সরাব আর তোর কলেজের মাস্টারদের কে বুঝাবে ? সরাব বলে রেখেছে তোর এবার ফার্স্ট ডিভিশন পেতেই হবে। ঠিক মতো যেন পড়াই তোকে। কাল কি পরীক্ষা ? ‘
রুমার কথায় রুনা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জীব বিজ্ঞানের বইখানা সামনে এগিয়ে দিল। রুমা কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রুনাকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর বই হাতে তুলে বেছে বেছে প্রত্যেকটা অধ্যায় থেকে ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো সুধালেন। বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর রুনা সঠিক দিলো তবে মাঝের দুটো ভুল হয়ে গেলো। তাতে প্রশ্নের বাণ সমাপ্ত করে রুমা বললেন ‘ রিভিশন তো মোটামুটি ভালই দিয়েছিস এখন কাল পরীক্ষা কেমন দিবি সে তো আল্লাহই জানেন। আমি তাও আরও কিছু প্রশ্ন দাগিয়ে দিচ্ছি আর হ্যাঁ বিগত পরীক্ষার প্রশ্নগুলো দেখে যাস। কিছু কমন পড়ে যেতে পারে। ‘
রুনা বিনিময়ে স্রেফ মাথা নাড়ল। রুমার কাছ থেকে প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলো দাগিয়ে নিয়ে ফিরে এলো সে। তক্তার উপর দিনের আলোয় বই মেলে পড়তে বসলো সে। ইতিমধ্যে কলেজে টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে তার। এই টেস্টে যেভাবেই হোক ভালো নাম্বার তুলতে হবে নাহলে সরাব তার খবর করে ফেলবে। এমনিতেই রাতে ফিরেই তার পড়ার খবর নিচ্ছে এখন রোজ।
রুনা পড়তে পড়তে একসময় অভ্যাস বশত খাতায় টুকিটাকি লিখা শুরু করলো। এটা তার পুরোনো অভ্যাস। পড়তে পড়তে দু চার লাইনের ছন্দ লেখা। এবারও সে এক ছন্দ লিখেছে। লেখা শেষে সে নিজেই সুর করে পড়লো ছন্দগুলো…
‘ ফাগুন প্রেমের আগুন
কৃষ্ণচূড়ার বনে ছড়ানো রূপের আগুন,
পক্ষিরা অপেক্ষায় আছে প্রেমের প্রহর জুড়ে
কেটে গেছে সময় হাজার বসন্তের ফুলে।
পেরিয়ে যায় সাঁঝের বেলা
উড়ে যায় বসন্তের কোকিল,
ঝরে যায় বৃষ্টি নীরবে
ভালোবাসার কোনো এক সংগোপনে।। ‘
ছন্দগুলো লেখা কাগজটা কেটে একটা সামান্য টিনের বাক্সে জমিয়ে রাখলো রুনা। বাক্সে আরও অনেক এমনই টুকরো টুকরো ছন্দ আছে। রুনা এগুলো কোনো এক বিশেষ দিনে সরাবকে উপহার হিসেবে দিবে। তার বহু দিনের পুরনো ইচ্ছে সরাব নিজে তাকে এগুলো পড়ে শুনাবে। আর সে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইবে সরাবের সেই আখরোটের মতো স্বচ্ছ বাদামি চোখের ভিড়ে।
কাঠের সদর দরজাখানা খোলার শব্দে রুনার কান দুটো সজাগ হয়ে উঠলো। ও ঘরের পিছন দিকে তক্তায় বসে জীব বিজ্ঞান পড়ছিল আর মাঝে চিন্তা ভাবনা করছিলো। কিন্তু দরজার শব্দে উঠে এলো সে। নূরজাহান নিজের ঘরে পানের সুপারি কাটছেন। রুনাকে উঠতে দেখে উনি আর উঠলেন না। রুনা তার ঘরের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে দেখলো সরাব এসেছে। ওর মনে পড়লো দুপুরের খাবার সে রাধতে পারেনি। ঘরের লাকড়ি ফুরিয়ে গেছে। নূরজাহান কাল রাতের রাখা পান্তা ভাত মরিচ আর পেয়াজ মেখে খেয়ে নিয়েছেন।
সরাব রুনাকে দেখে হাতের স্যান্ডেল জোড়া নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে বললো ‘ কাল না জীব বিজ্ঞান পরীক্ষা ? রুমা আপা কিছু দেখিয়ে দিয়েছেন নাকি ? ‘
রুনা কথার জবাবে স্রেফ বললো ‘ হু, গিয়েছিলাম আপার কাছে। কিছু প্রশ্ন দাগিয়ে দিয়েছে আর বলেছে পুরনো পরীক্ষার প্রশ্নগুলো দেখে যেতে। ‘
‘ তাহলে তুই আরও কিছুক্ষণ পড়, আমি গোসল সেরে আসছি। তারপর আম্মাকে নিয়ে খেতে বসবো। ‘
‘ আম্মা খেয়ে নিয়েছে। ‘
‘ তাহলে আর কি!! তুই একটু পড়। আমি গোসল সেরে এলে দুজনে মিলে খাবো। ‘
সরাবের কথায় রুনা মাথা নেড়ে সায় তো দিলো কিন্তু বলার সুযোগ হলো না আজকে দুপুরে রান্না হয়নি, ঘরে লাকড়ি ফুরিয়ে গেছে। তার আগেই সরাব গোসলের জন্য ঢুকে গেছে ঘরে আর ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। চিন্তিত রুনা আর বই নিয়ে বসতে পারলো না। একবার ভাবলো রুমা খালার কাছে লাকড়ি চাইবে কিনা। পরে মনে হলো সরাব শুনলে রেগে যাবে। সরাবের আত্ম সম্মান বোধ প্রখর। কারোর কাছে হাত পাতা তার মোটেই সয় না।
গোসল সেরে রান্নাঘরে গেলো সরাব। তাকে রান্নাঘরে দেখা মাত্র রুনা উঠে এসেছে। সরাব রুনাকে উঠতে দেখে কিছুই বললো না যেহেতু এখন খেতে বসবে তারা। সে ব্যস্ত চোখে ভাতের পাতিল আর তরকারির কড়াই খুঁজছে। তাদের দেখা না পেয়ে সে অবাক হয়ে সুধালো ‘ ভাত,তরকারি সবগুলোর পাতিল কোথায় রেখেছিস তুই ? ‘
বিস্মিত সরাবের মুখ পানে চেয়ে অপরাধী সুরে রুনা বললো ‘ এই কদিন পড়াশোনায় এত ব্যস্ত ছিলাম যে লাকড়ি ফুরিয়ে গেছে খোঁজ রাখিনি। তাই আজ আর দুপুরের খাবার রাধতে পারিনি। আম্মা কাল রাতের বাসি পান্তা ভাত মরিচ,পেঁয়াজ দিয়ে ডলে খেয়েছে। ‘
রুনার কথা শুনে সরাবের রাগ হলো। ও বিরক্তিতে বললো ‘ তো একটু চোখ, কান খোলা রাখবি না ? এখন খাবি কি ? একটু তো মন দিবি কাজে রুনা ? পড়াশোনা করতে বলেছি তার মানে তো এই নয় জগৎ,সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যা। ‘
সরাবের কথা শুনে মুখ নামিয়ে নিলো রুনা। তার অপরাধ বোধ যেন উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। সরাব আর কিছু করতে না পেরে রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। খিদেতে পেটটা জ্বলছে তার অথচ খেতে পারছে না। খিদা একেবারেই সহ্য করতে পারে না সে। তাইতো রেগেমেগে কড়া কিছু কথা শুনিয়ে দিয়েছে রুনাকে। এখন চোখের আড়াল না হলে হয়তো আরও কিছু শুনাবে। তার চেয়ে বেরিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।
সরাবের যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো রুনা। তার ভীষন কান্না পাচ্ছে। এরকম একটা ভুল কি করে করে ফেললো সে ? মানুষটা যে খালি পেটে রাগারাগি করে বেরিয়ে গেলো। সে রেগে থাকলে যে রুনার শান্তি মেলে না সে কি কেউ জানে ? রুনার মন খারাপ ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলেছে। ও উদাসী ভঙ্গিতে আকাশ পানে চেয়ে আছে।

—————————
দখিনা হাওয়া বইছে। জাবিয়ার কপালের দিকে রেশমি ছোট ছোট চুলগুলো আকাশে উড়ছে। জাবিয়া ছাদের কিনার ঘেসে দাড়িয়ে আছে। তাদের ছাদে বড় করে বাউন্ডারি দেওয়া হয়নি। যতটুকু দেওয়া হয়েছে ততটুকুই জাবিয়ার কোমর অব্দি পড়ে। তবে জাবিয়া পোক্ত সেই ইটের তৈরি দেওয়ালের উপর হাত রেখেই দাড়িয়ে আছে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে সে আকাশে কবুতরদের দল বেঁধে উড়া দেখছে।
জাবিয়ার থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে শাহরিয়াও আকাশ দেখতে ব্যস্ত ছিল। আকাশ পানে চেয়েই সে বললো ‘ বিয়েতে কি তুমি আদৌ রাজি ? নাকি ফুপিজান জোর করে আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিচ্ছে ? ‘
শাহরিয়ারের কথায় জাবিয়ার হাসি পেলো। নাহ্ তাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। তবে সে আপন মনেই বিয়ে করতে বাধ্য। আজ শাহরিয়াকে সে বিয়ে করতে আপত্তি করে তুষারের হাত ধরে চলে গেলে তার বাবা মা আর কখনও তার মুখ দেখবে না। সাজ্জাদ সাহেব কিংবা জাহানারা কোনোদিনই এই প্রেমের সম্পর্ক মেনে নেবেন না। প্রেমের সম্পর্কে তাদের এক ধরনের বিতৃষ্ণা আছে যেটা সে টের পেয়েছে যখন কয়েক মাস পূর্বে তার খালাতো বোন লামিয়ার প্রেম সম্পর্কের ব্যাপারটা খোলাসা হয়।
লামিয়ার প্রেমের কথা জানতে পেরে জাহানারা তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। লামিয়া রাজিও হয়েছিল। সেই দেখে নিজ দায়িত্বে পাত্রও ঠিক করেন জাহানারা। কিন্তু বিয়ের দিন লামিয়ার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা উনাকে পুরোপুরি রুপে নাড়িয়ে দেয়। উনি প্রতিজ্ঞা করেন বেচেঁ থাকতে আর ভাগ্নি লামিয়ার মুখ দেখবেন না। সেই থেকেই প্রেমের প্রতি উনার এক ধরনের তিক্ততা তৈরি হয়েছে। উনার ধারণা প্রেম করে বিয়ে করলে সংসার কখনও সুখের হয়না।
জাহানারার ধারণা আসলেই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। প্রেম করে বিয়ে করেও সুখে নেই লামিয়া। তার বর রোজ রাতে নেশা করে এসে তাকে মারধর করে অথচ তাদের তিন বছরের প্রেম ছিল। মেয়ের উপর রাগ করে মেয়ের মুখ দেখবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছেন জাহানারার বোন আর বোন জামাই। প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করার পর আর কোন মুখেই বা ফিরে আসবে লামিয়া ? তাই সে নিরবে সবকিছু সহ্য করছে।
লামিয়ার এমন রোজ রোজ মার খাওয়ার কথা শোনার পর জাহানারা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন জাবিয়া যেন ভুলক্রমেও প্রেম পিরিতি করার চিন্তা না করে। কিন্তু এই একই কথা যদি জাহানারা আরও কয়েক মাস আগে বলতেন তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। তুষার নামক সেই স্বপ্ন পুরুষকেও বিরহের মতো কঠিন যন্ত্রণার ভাগীদার হতে হতো না।
জাবিয়ার পুরনো অতীতের কথা ভেবে মলিন হাসলো। বললো ‘ তোমার কেন মনে হলো আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে ? ‘
‘ না মানে বিয়ে নিয়ে তোমার কোনো হেলদোল নেই। এসে থেকে আমার সঙ্গে কথাও বলো না। অথচ আগে সারাদিন আমার পিছন পিছন ঘুরতে। ‘ রয়ে সয়ে বললো শাহরিয়া।
‘ বিয়ের কনে হয়ে নিজেই নিজের বিয়েতে নাচানাচি করবো আশা করছো ? আমার ছোট ভাবীকে দেখেছো তো ? উনি খুবই ঠোঁটকাটা। আমাকে নাচতে দেখলে আরও বাড়িয়ে চাড়িয়ে কাজিন গুষ্টিতে ছড়িয়ে দিবেন এই কথা। ‘ ঠোঁটে দাত চেপেই অসম্ভব এই মিথ্যে কথাটা বলে ফেললো জাবিয়া।
উপযুক্ত কারণ নেই জাবিয়ার কাছে। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই সব দোষ ফেলে দিল বিনীর ঘাড়ে। এতে শাহরিয়া অন্তত আর কোনো প্রশ্ন করবে না। তবে তাকে অবাক করে দিয়ে শাহরিয়া বিস্মিত গলায় সুধালো ‘ সেকি উনি এরকম ? দেখে তো উনাকে একদম শান্তশিষ্ট, ঠান্ডা মেজাজের মানুষ মনে হয়। ‘
শাহরিয়ার কথায় হাসলো জাবিয়া। হালকা হেসে বললো ‘ কার ভিতরটা কেমন সেটা কি আর বাহির থেকে বোঝা যায় ? এই যেমন আমিও তো মামাকে দেখে বুঝিনি আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করবে। মামা তোমার বাবা। তুমি নিজে বুঝেছিলে কি মামার ভিতর ভিতর কি চলছে ? ‘
‘ কথা ঠিক। কার ভিতর কি চলে সে তো একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই জানে না। ‘
কথাটা বলে আকাশ পানে স্থির দৃষ্টি তাক করলো শাহরিয়া। তার ভাবনায় চলছে নবনী কি করছে এখন ? সেও কি এখন আকাশ পানে চেয়ে তাদের দুজনের স্মৃতি চারণ করছে। শাহরিয়ার মনে পড়লো তাদের দুজনের একসঙ্গে কাটানো সোনালী দিন আর রূপালী রাত্তিরের কথা।
—-
প্রস্থানের পূর্বে আঙিনায় দাড়িয়ে জাবিয়াকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো শাহরিয়া। জাবিয়া দাড়িয়ে আছে তার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায়। শাহরিয়ার চলে যাওয়ার পথে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জাবিয়া। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই জাবিয়ার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। প্রকৃতিতে অভিমানী মেঘ তার টুপুর টাপুর বর্ষণ ঝরাচ্ছে।
জাবিয়া এক মনে বৃষ্টি দেখছে। জাহানারা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। জাবিয়া সেটা বুঝতে পেরেও কিছু বললো না। জাহানারা বললেন ‘ বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো যায় না জানিস তো। তুই আমার মেয়ে, আমার বিশ্বাস আমার মেয়ে হয়ে তুই কোনো ভুল করবি না। তোর বয়সটা আবেগের তাই হয়তো ওই ছেলের মায়ায় পড়ে গেছিস। ওসব মায়া মোহ দুই দিনে কেটে যাবে। তখন বোঝা নিয়ে বেড়াতে হবে।
বাবা মা কখনও সন্তানের খারাপ চায়না জানিস তো। শাহরিয়া ভালো ছেলে তার উপরে আমাদের পূর্ব পরিচিত। আমার বিশ্বাস তুই ওর সাথে সুখী হবি। ‘
গম্ভীর গলায় কথাগুলো বললেন জাহানারা। লামিয়ার পরিণতি দেখে উনার মনে জাবিয়ারও একই ভুল করার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন এসেছিল। উনার সেই আশঙ্কাই সত্য হলো যখন জাবিয়ার কলেজ ব্যাগে তুষারকে লেখা পত্র পেলেন। তবে একটা কথা ভেবে সস্তির নিশ্বাস ফেললেন যে জাবিয়া উনাদের কথা ভেবে তুষারের সঙ্গে বিচ্ছেদের চিন্তা ভাবনা করছে যেটা সেই চিঠিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
জাবিয়া এক মনে জাহানারার বক্তব্য শুনলো কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। মেয়েকে নীরব দেখে জাহানারা বললেন ‘ সময় আছে তোর কাছে। নীরবে ভাব আর উপলব্ধি কর আমি আর তোর বাবা তোর খারাপ চাই না। বিয়ে নিয়ে তোকে জোর করবো না। তোর ইচ্ছে হলে করবি নাহলে করবি না। কিন্তু কয়েক বছর পরে হলেও তোকে আমার পছন্দেই বিয়ে করতে হবে কারণ ওই ছেলেকে আমি মেনে নিবো না। ‘
শেষের কথাগুলো রুক্ষ স্বরে বলে বেরিয়ে গেলেন জাহানারা। জাবিয়া নিরুত্তর। ভালোবাসা বুঝি অপরাধ ? তাহলে এই অপরাধ করার পরই কেন সকলে ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি নিয়ে হাজির হয় ? আগে সাবধান করলে কি আজ এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো ? আসলে কাছের মানুষগুলো বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর মতোই। কাউকে ভালোবাসার পর ন্যায় বিচারের শালিসী নিয়ে হাজির হয়। অথচ যখন সময় ছিল তখন তাদের নাগালও পাওয়া যায় না।
—-
হারিকেন জ্বালিয়ে বই খাতা নিয়ে বসেছে রুনা। কোমর ছাড়ানো লম্বা চুলগুলো যত্নের অভাবে উস্কখুস্ক হয়ে ছড়িয়ে আছে পিঠ বেয়ে। নূরজাহান ওর থেকে খানিকটা দূরে আরাম কেদারায় বসে উলের সোয়েটার বুনছেন। সামনে শীতকাল আসতে চলেছে। হয়তো আর কয়েক মাস পরেই কনকনে শীত দাপট দেখিয়ে হাজির হবে। তাই তিনি আগেভাগেই শীতের জামা কাপড় বুনতে বসেছেন।
ঘুম থেকে উঠে রুনা খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন নূরজাহান। সরাবের খবরও নিয়েছিলেন। রুনা শুকনো মুখে মিথ্যে বললো যে দুজন একসঙ্গেই খেয়েছে। এছাড়া যে উপায় নেই। স্বামী স্ত্রীর কলহের মাঝে নূরজাহানকে টানা বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। তাই সে আর এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।
‘ তোর মনে হয়না আমাদের ঘরে আরেকটা সদস্য প্রয়োজন ? ‘
নূরজাহানের কথার মানে ধরতে পারলো না রুনা। ও স্তব্ধ হয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো নূরজাহানের দিকে। নূরজাহান ওকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন ‘ আরে বেকুব মেয়ে বুঝলি না ? বললাম যে আমিও তো বুড়ো হচ্ছি নাকি ? নাতি নাতনী নিয়ে খেলতে তো আমারও ইচ্ছে করে। নাতি নাতনীর মুখ আদৌ দেখবো তো মরার আগে ? ‘
এতক্ষণে রুনা বুঝতে পারলো নূরজাহান কি বলছেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার দোহারা চেহারায় লালিমার আভা দেখা গেলো। সে তার নত মুখ আরও নত করে নিলো। নূরজাহান তাকে আর সরাবকে নিয়ে আরও অনেক কিছুই বললো কিন্তু রুনা লজ্জাবতী লতার মতোই যেন নুয়ে পড়েছে। সে নিরবে স্রেফ জীব বিজ্ঞান পড়ছে। এসব কথায় কান দেওয়ার সুযোগ নেই তার। সরাব তো তার কাছে আসতেই কার্পণ্য করে সেখানে বাচ্চার কথা অনেক দূরে।
সরাবের ইদানিং এক বাজে অভ্যাস তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যা হলেই বাড়ি ফেরার জন্য মনটা আকুপাকু করে। কিন্তু কেন ? কি এমন আছে ঘরে যে তার রোজই বাড়ি ফেরার এমন তাড়া থাকে ? কথাটা বললে ভুল হবে, কি নয় কে। কে আছে যে কাজ পাগল সরাবও বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া লাগিয়ে দেয় ?
উত্তর খুঁজে ফিরে সরাব তবে তার সন্ধান আর মেলে না। বাধ্য হয়েই উত্তর খোঁজার কাজে ইস্তফা দিয়ে লাকড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। আকাশেতে জ্বলজ্বল করছে লক্ষ লক্ষ তারা আর এক রূপালী পূর্ণিমার চাঁদ। নিস্তব্ধ,একলা পথে ফিরতে ফিরতেই সরাব উপলব্ধি করলো দুপুরে রুনার সঙ্গে রাগারাগি করে তারও মনটা ভালো নেই।
রুনার সঙ্গে ছোট থেকেই উঠাবসা তার যেহেতু ওদের বাবা চাচাদের বাড়ি কাছাকাছি। সেই সুবাদে একসঙ্গে প্রায়ই থাকা পড়তো। কিন্তু রুনার উপর রাগারাগি সে কখনও করেনি। বয়সে ছোট বলেই যে রাগারাগি করতে হবে এই জিনিসটা সে মানতে পারে না। ছোট বলেই কথাবার্তায় আধিপত্য বিস্তার করা তার ঠিক আসে না। তাই কখনও ধমকাধমকী করার প্রয়োজন মনে করেনি।
অথচ এই প্রথম ওর উপর রাগারাগি করে তারই মনটা খারাপ হয়ে গেছে। সেখানে রাগটা তো দেখিয়েছেই রুনার উপর। কে জানে অভিমান করেছে কিনা ? মেয়েরা তো স্বভাবতই একটু অভিমানী হয় যেটা সে নূরজাহানকে দেখে বুঝেছে। সে যখন ছোট তখন তার বাবা মায়ের উপর রাগারাগি করলে মা অভিমানে খেতেন না, কথা বলতেন না এমনকি সরাবের সঙ্গেও কথাবার্তা বন্ধ রাখতেন।
হারিকেনের আলো যখন নিভু নিভু তখন হারিকেন নিয়ে উঠে দাড়ালো রুনা। হারিকেনে তেল দেওয়া প্রয়োজন। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না কোথায় তেলের ড্রাম। রুনা কোনোমতে আন্দাজে খুঁজে বের করলো। আন্দাজে তীর ছুঁড়ে সে ড্রাম থেকে তেলও ঢাললো কিন্তু হারিকেন জ্বালিয়ে উঠে দাঁড়াতেই পিছনে সরাবকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো।
রুনাকে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সরাব বললো ‘ কিরে ? এভাবে লাফিয়ে উঠলি যে ? ‘
সরাবের কথা শুনে রুনা নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো। অন্ধকারের সেই অবয়ব যে সরাব সেটা ভেবেই সস্তির নিশ্বাস ফেলল। বললো ‘ যেভাবে হাজির হলে তাতে আমি যে হার্ট অ্যাটাক করিনি এই বেশী। ‘ কথাটা বলে বুকে হাত রেখে থু থু করলো রুনা। আরেকটুর জন্য সে মরতে মরতে বেচেঁ গেছে।
অন্ধকারে সরাবের অবয়ব যেন দানবীয় এক ব্যক্তির সত্তা। রুনা সত্যিই ঘাবড়ে গিয়েছিল তবে রুনার ভয়ে কেপে উঠা মুখ দেখে সরাবের মনে হলো ভীত সন্ত্রস্ত এই নারীর ভয়টাও তাকে ঘিরেই। কেন যেন এক আলাদা ধরনের ভালো লাগা ঘিরে ধরে। সেই ভালো লাগা থেকেই অসম্ভব এক কাজ করে বসে সে। আকস্মিক রুনার ললাটে নিজের রুক্ষ ঠোঁটের আদর ছুঁয়ে দেয়।
সরাবের এই কাজে প্রথমে রুনা চমকে উঠলেও পরক্ষণেই লজ্জায় কুকড়ে যায়। ইতিউতি করে লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠেই সরাবের কাছ থেকে লাকড়িগুলো হাতে তুলে নিয়ে বলে ‘ দুপুরে ওভাবে রেগে বেরিয়ে গেলে। সারাদিন নিশ্চই পেটে কিছু পড়েনি। মুড়ি ভাজা খেতে পারো। আমি ততক্ষনে ভাত বসাচ্ছি। ‘
কথা শেষে লাকড়িগুলো রান্নাঘরে নিয়ে খড়ের পাশে রাখলো রুনা। কিছু লাকড়ি উনুনের ভিতর রেখে আগুন জ্বালালো। সঙ্গে সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখায় রান্নাঘর আলোকিত হয়ে উঠলো। অগ্নির সেই হলদে আলোয় রুনা দেখলো সরাব রান্নাঘরের দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মুচকি হাসি। তার এই মন ভোলানো হাসি দেখে যেন রুনা আরও কুকড়ে গেলো। দ্রুত অন্য দিকে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো।
—————————
সরাবকে এভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অসস্তি হচ্ছে রুনার। ও ভাতের চাল ধুতে ধুতে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো ‘ এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ? মুড়ি না খাবে ? ‘
রুনার কথায় উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এলো সরাব। রুনাকে হাত ধরে টেনে তুলে নিজে পিড়িতে বসে চাল ধুতে শুরু করলো। রুনা ওকে চাল ধুতে দেখে অবাক হয়ে বললো ‘ একি তুমি ধুচ্ছ কেন ? আমি তো ধুচ্ছিলামই। ‘
‘ তোর না কাল পরীক্ষা ? আম্মাকে হারিকেন দিয়ে আয় আর তুই কুপি জ্বালিয়ে হেশেলের কাছে পড়তে বস। জোরে জোরে শব্দ করে পড়বি, দেখি কি পড়িস। ‘
অগত্যা রুনা আর বিপরীতে কিছু বলতে পারলো না। নূরজাহানকে আরেকটা হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে এসে নিজে কুপি জ্বালিয়ে পড়তে বসলো। কুপির আলোয় বইয়ের পাতায় প্রত্যেকটা অক্ষর যেন অন্যরকম লাগছে। গোটা গোটা অক্ষরগুলোয় অমানিশার হালকা ছাপ। আলোহীন সন্ধ্যায় কুপির আলোতে পড়াশোনা করার মজা আলাদা। তাই নিরবচ্ছিন্ন এই বিদ্যুৎহীন এলাকায় ঝি ঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে রুনার পড়াটা বেশ ভালই হয়।
সরাবের বাবা মারা গেছে বেশ ক বছর আগেই। সেই সুবাদেই সরাব এবং তার ছোট বোন দুজনেরই নিজ হাতে রেধে খাওয়ার অভ্যাস আছে। সরাবের ছোট বোন সিরাতের অবর্তমানে সরাবকেই এতদিন রেধে বেড়ে খেতে হয়েছে। যার কারণে মোটামুটি রকমের তরী তরকারি রাধা সেও জানে। অন্তত কারোর সাহায্য পাওয়ার আশায় বসে থাকতে হয়নি।
সরাব একে একে ভাত, পাট শাক ভাজি আর ডাল করলো। রান্না শেষে নূরজাহানকে সে পূর্বেই খেতে দিয়ে দিলো যেহেতু উনার দ্রুত খেয়ে রাতের ওষুধ খেয়ে সময় মতো ঘুমোতে যাওয়া প্রয়োজন। নূরজাহান অবশ্য তাকে আর রুনাকে খেতে বলেছিলেন কিন্তু রুনা জানিয়েছে তার খেতে দেরি আছে, পরীক্ষার পড়া করছে সে। অতঃপর আর কি ? নূরজাহান নিজের মতো খেয়ে শুয়ে পড়লেন।
২৫ আষাঢ়, রাত ১১:০০ ঘটিকা
বাহিরে বাতাবরণের তুমুল আড্ডা চলছে। চারিদিক তমসায় আচ্ছন্ন তবুও হাওয়া বইছে নিজের নিঃসঙ্গ মনের তৃপ্তি মেটাতে। ছোট তিন রুমের ঘরটায় দেখা যাচ্ছে কুপির আলো। রুনা মেঝেতে কুপির স্বল্প আলোয় জীব বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো মনে করছে আর ওর মুখে একে একে লোকমা তুলে দিচ্ছে সরাব। ব্যাপারটা খুবই মিষ্টি তাইনা ?
আসলেই মিষ্টি কিন্তু এই মিষ্টি মুহূর্ত গভীর ভাবে অবলোকন করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই রুনার কাছে। কাল পরীক্ষা আর রুনা এখনও রিভিশন দেওয়া নিয়েই পড়ে আছে। রুমা খালার দাগিয়ে দেওয়া পড়ার অর্ধেক মাত্র শেষ করতে পেরেছে অথচ পরীক্ষায় তার ভালো নম্বর পেতেই হবে নাহলে সরাবের কথার মান যে রাখা হবে না। রুনার পক্ষে আদো জীবনে সম্ভব না সরাবের কোনো কথার অবমাননা করা।
রুনার খাবার শেষে সরাব এবার নিজের খাবার নিয়ে বসলো। রুনা বেশ মনযোগ দিয়ে পড়ছে। বুঝাই যাচ্ছে পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু কিসের জন্য এই চেষ্টা ? আগে তো কখনও এত মন দিয়ে পড়েনি। তবে কি সরাবের বলা কথার মূল্য তার কাছে অধিক ?সরাবের ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য হাসি ফুটলো যে অন্তত কেউ তো আছে যে তার কথার মূল্য রাখতে পারে, তাকে ভালোবাসতে জানে।
সরাব সন্তান হিসেবে কোনোদিনই নূরজাহানের কাছ থেকে ভালোবাসা পায়নি। এমনকী ওর ছোট বোন সিরাতকেও নূরজাহান কখনও ভালোবাসা দেখাননি। উনি চিরকাল ব্যস্ত ছিলেন নিজের সংসার নিয়ে। সংসারে কোনটা লাগবে, কি লাগবে না, ছেলে মেয়েদের কি কিনে দেওয়া উচিত এই নিয়েই উনার ভাবনা ছিল। অথচ কোনওদিন ভাবেননি শুধু প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদাগুলো মেটালেই হয়না, সন্তানদের ভালোবাসাও দেওয়া প্রয়োজন।
বিনী সরাবের কলেজ জীবনের ভালোবাসা। দুজনে সরকারি কলেজে, একই ক্লাসে পড়তো। সেই থেকেই বিনীর প্রতি ভালো লাগার শুরু। রোজ সকালে বিনীদের বাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে থাকা তার নিত্য দিনের নিয়ম ছিল। বিনী তাকে লক্ষ্য করতো কিন্তু কোনওদিন কিছু বলেনি। ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোনো মনোভাবই প্রকাশ করেনি।
তারপর!! তারপরই সরাবের বাবা মারা গেলেন। সরাব পড়ে গেলো সংসারের গ্যাড়াকলে। তবুও সংসার, বাবার ব্যবসা সামলে ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছিলো এবং পড়ালেখায় তুখোড় হওয়ায় ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাসও করে কিন্তু এরপর আর পড়াশোনা এগিয়ে নিতে পারেনি। সংসার, বোনের কলেজ ফি, মায়ের ওষুধ এবং দিনশেষে ব্যবসা সামলে সে আর পড়াশোনা করে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেনি।
অন্যদিকে বিনী ঠিকই এগিয়ে গিয়েছে। ভালো বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। মাঝারি ধরনের ছাত্রী সে। তবুও অনার্স অব্দি পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। আসলে বাবা মার টাকা পয়সা থাকলে পড়াশোনা কখনও মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় না। সরাবের বাবা ছিলেন না, সংসার তাকেই দেখতে হয়েছে তাই পড়াশোনা তার করা হয়নি।
সরাব নূরজাহানকে খুব ভালোবাসত। কিন্তু নূরজাহান কখনও একজন মা হিসেবে তার সন্তানদের কাছে টেনে নেননি, ভালোবাসেননি। কিংবা ভালোবেসেছেন কিন্তু প্রকাশ করেননি। একই কাজ বিনীও করেছে। সরাবের ভালো লাগা, ভালোবাসায় কোনওদিন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। শুধু দূর হতে চেয়ে চেয়ে দেখেছে। কোনওদিন বলেনি সরাবের প্রতি তার অনুভূতি কি। আর বোকা সরাব!! সে তো বিনীর এই নিরবতাকেই সম্মতি ধরে নিয়ে নিজের ভালবাসার পরিমাণ দিনে দিনে বাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু কথায় আছে সবকিছুরই একটা শেষ আছে। তেমনই সরাবের সুন্দর স্মৃতিগুলোরও সময় শেষ হয়ে এসেছে। বিনীর যে তার প্রতি কোনো অনুভূতি নেই সেটা সে বিনীর বিয়ের দিন বিয়ের কার্ড দেখেই বুঝতে পেরেছে। সেই তখন থেকেই নিজেকে কঠিন করে সামলে নিতে শিখেছে সরাব। জেনেছে ভালোবেসে দূর্বল হতে নেই। কিন্তু রুনার তার প্রতি এমন ভালবাসার বহিঃ প্রকাশ তাকে আবারও দূর্বল করছে। সরাব কিছুতেই চায় না পুনরায় দূর্বল হতে।
কিন্তু এই তৃষ্ণার্ত মনও মাঝে মাঝে এক চিলতে ভালবাসার জন্য উচাটন হয়ে উঠে। মনে হয় এত আয়োজন করে নিজেকে সামলে রেখে কি হবে ? সেই তো রুপ ঝলসানো সুন্দরীর পর আবার এক দোহারা সুন্দরীর প্রেমেই পড়তে হবে। পড়লে কি কোনো ক্ষতি আছে ? নিজের স্ত্রীর প্রেমে পড়লে কোনো ক্ষতি আছে এটা অন্তত শুনেনি সরাব।
—-
আছে আমার হৃদয় আছে ভরে,
এখন তুমি যা খুশি তাই করো।
এমনি যদি বিরাজ’ অন্তরে
বাহির হতে সকলই মোর হরো।
সব পিপাসার যেথায় অবসান
সেথায় যদি পূর্ণ করো প্রাণ,
তাহার পরে মরুপথের মাঝে
উঠে রৌদ্র উঠুক খরতর।
এই যে খেলা খেলছ কত ছলে
এই খেলা তো আমি ভালবাসি।
এক দিকেতে ভাসাও আঁখিজলে,
আরেক দিকে জাগিয়ে তোল’ হাসি।
যখন ভাবি সব খোয়ালাম বুঝি
গভীর করে পাই তাহারে খুঁজি,
কোলের থেকে যখন ফেল’ দূরে
বুকের মাঝে আবার তুলে ধর’।
হিম ধরানো বাতাবরণের মাঝে উষ্ণ গলায় বারান্দায় দাড়িয়ে আপন মনে রবীন্দ্র ঠাকুরের প্রেমের কবিতা আউড়াচ্ছে বিনী। তার প্রিয় কবি এবং লেখকদের একজন হলেন রবীন্দ্র ঠাকুর। সেঁজুতি হলো রবীন্দ্রনাথ লিখিত বিনীর প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্র লিখিত নৌকাডুবি তার প্রিয় এক উপন্যাস। উপন্যাসটির প্রতিটি লাইন তার মন ছুঁয়ে যায়।
এক প্রকৃত রবীন্দ্র প্রেমী হওয়ায় নৌকাডুবি নিয়ে বিনীর কোনো অভিযোগ নেই। তবে হঠাৎ হঠাৎ তার মনে হয় রমেশ ও হেমনলিনীদের বুঝি কোনওদিন মিল হতে নেই ? যেমনটা তার আর সরাবের হয়নি। সরাবও তো রমেশের মতোই বিয়ে করে আলাদা সংসার করছে। পার্থক্য শুধু একটাই বিয়েটা তারও হয়েছে এবং সে সরাবকে ভুলে একলা বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
শীতল বাতাবরণে ঘাড়ের ওপর কারোর উষ্ণ নিশ্বাস টের পেলো বিনী। পিছনে দাঁড়িয়ে একজন তার চুল নিয়ে খেলছে। কাছে কোথাও থেকে ভেসে আসছে বেলি ফুলের গন্ধ। বিনী জানে সেই কেউ একজন হলো আবির আর সে বেলি ফুলের মালা জড়াচ্ছে তার হেমনলিনীর চুলে। আবিরকে দেখলে বিনীর মনে হয়, না সব রমেশ আর হেমনলিনীর বিচ্ছেদ হয়না। কেউ কেউ পেয়ে যায় তাদের ভালোবাসার মানুষটাকে খুব গভীর ভাবে।
‘ তুমি রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারো ? ‘
‘ একটু আধটু ‘
‘ তাহলে শোনাও ‘
আবিরের কথায় আপত্তি করছিলো বিনী কিন্তু আবিরের আকুল আবেদনের কাছে তার আপত্তি টিকেনি। প্রিয় মানুষটার মন রাখতেই সে ধরলো তার প্রিয় এক রবীন্দ্র সঙ্গীত…
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে ওগো বিদেশিনী,
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী।
তুমি থাক সিন্ধুপারে
ওগো বিদেশিনী,
আমি চিনি গো চিনি তোমারে
ওগো বিদেশিনী।
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি শারদপ্রাতে
তোমায় দেখেছি মাধবী রাতে,
তোমায় দেখেছি
হৃদি-মাঝারে ওগো বিদেশিনী…
মৃদু শীতল হাওয়ায় মধুর এক রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে প্রিয়তমাকে নিয়ে হারিয়ে হয়েছে গানের দুনিয়ায়। পুরোটা সময় কেটেছে ঘোরের মাঝে। গান যখন শেষ হলো আবির তখনও ঘোরে। বিনীর ডাকে তার সম্বিত ফিরলো। ঘোরে আচ্ছন্ন গলায় বললো ‘ তোমার গলা ঠিক যেন মহুয়া। এত মিষ্টি গলা অথচ সাধারণ এক পরিচয় তোমার। চাইলেই কিন্তু নিজেকে সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলতে পার। ‘
আবিরের কথায় হাসলো বিনী। বললো ‘ ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সেগুলোকে বুড়ি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছি। বিয়ে হয়েছে, সংসার করছি। মেয়েদের না বিয়ের পর অত শখ থাকতে নেই। ‘
‘ ইচ্ছে নেই সেটা বলো। শুধু শুধু বিয়ের নামে দোষ দিও না। আম্মা শুনলে তোমাকে না ধুয়ে দিবেন। বলবেন আর কাম পাও না না ? শুধু শুধু বিয়ার নামে দোষ দাও কিল্লেগা ? ‘
আবিরের কথায় হো হো করে হেসে দিল বিনী। হাসতে হাসতেই কোনক্রমে বলিল ‘ শুধু শুধু আমার শাশুড়ি মায়ের নামে দোষ দিও নাতো। তোমরা সকলে তো আছই আম্মাকে হিটলার রূপে দেখানোর জন্য। কেন যে এমন করো কে জানে। আম্মা খুবই ভালো। ‘
আবির বললো ‘ বাহ্ তোমরা শাশুড়ি বউ দেখি একজন আরেকজনের পাগল। মাঝখান দিয়ে আমি গ্যাড়াকলে পড়লাম। কেউ দেখি আমায় পাত্তাই দেয় না। ‘
‘ অত পাত্তা পাওয়ার প্রয়োজন নেই বুঝলে। রাত অনেক হয়েছে, ঘুমোতে এসো। ‘
—-
বাহিরে অবলীলায় মেঘরাজের তান্ডব চলছে। আজ দিন কয়েক যাবৎ সন্ধ্যা নেমে এলেই মেঘরাজ তার কেরামতি দেখাতে শুরু করেন। সারারাত অবিরাম বৃষ্টি ঝরিয়ে পরের দিন ঠিক যেন ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে যান। তারপর আবার দেখা মিলে সন্ধ্যায়। এ কিসের লক্ষ ? শিউলি ফোঁটানো শরৎ রাজের আগমন বার্তা নাকি ?
হয়তো তাই। আজ মেঘরাজের সঙ্গে সঙ্গে যেন তুষারের চোখেও বর্ষণ নেমেছে। মলিন চোখে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকটায়। সেখানে পড়ে আছে হলদে খামটা। তার চোখের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, পরনের কাপড় এলোমেলো আর মাথার চুলগুলো অগোছালো। মুখে মলিনতার ছাপ। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না মাত্র কিছু দিনের ব্যবধানে সবটা শেষ হয়ে গেলো। যেই মানুষটা কিছু দিন আগে পর্যন্ত তার সঙ্গে ছোট্ট একটা সংসার করার স্বপ্ন দেখছিল তারই আজ বাদে কাল বিয়ে। কালকের পর মানুষটা আর থাকবে না, তাকে নিয়ে ভাবনায় মশগুল হওয়া কিংবা নিজেদের সংসার সাজানোর চিন্তা নিয়ে বসাও আর হবে না।
দূর্বল হাতে খামটা আবারও হাতে নিল তুষার। আসলেই কি তার প্রেয়সী তার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নাকি এসব নিছকই এক মজা তা বোঝার জন্যই সে আবারও চিঠিটা খুলল। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছোট ছোট হিজিবিজি অক্ষরে জাবিয়ার লেখা বিরহ ভাসিত চিঠিখানা…
প্রিয় তুষার,
তোমার নামটা কেমন অদ্ভুত তাইনা ? প্রথম যখন শুনেছিলাম চমকে গিয়েছিলাম। ছোটকালে বাবার কাছে শুনেছিলাম শীতের দেশে শীতকালে সাদা সাদা বরফের কুচির মতো বৃষ্টি হয় যাকে বলে তুষার। ইতালির ভাষায় লা নেভে আর জাপানে বলে ইউকি। ভেবেছিলাম এ আবার কেমন নাম। মানুষের নামও বুঝি তুষার হয় ?
তোমার নামের কারণেই তোমার প্রতি আমার কৌতুহল ছিল। সেই কৌতুহল থেকেই মনে তুমি জায়গা করে নিলে। গড়ে উঠলো এক নতুন প্রেমের কাহিনী। তবে সেই প্রেম আর গড়িয়ে বিয়ে অব্দি গেলো না। কেন জানো ? আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। ছেলে বিলেত থেকে এসেছে। সম্পর্কে সে আমার মামাতো ভাই।
ভাবিনি কোনওদিন মামাতো ভাইকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু আমি ভবিতব্য মেনে নিয়েছি। কেন জানো ? আমি তোমায় ভালোবেসে হারাতে চাইনা। জানি না আর কখনও দেখা হবে কিনা। হয়তো কোনো একদিন শিউলি তলায় আবারও দেখা হবে যখন চামড়ায় ভাঁজ পড়বে, চুলগুলোয় পাক ধরবে আর সমাজকে মেনে চলার মতো সমস্ত শক্তি দেহ ছেড়ে নির্বাসন নিবে।
ইতি,
তোমার প্রণয়িনী
খুবই ছোট এই এক পাতার চিঠিটা পড়ে নিজের চোখের অশ্রুদের আর ধরে রাখতে পারল না তুষার। চিঠিখানা আকড়ে ধরে আর্তনাদ করে উঠলো। গলার কাছে নিঃশ্বাসটা তার ভারী হয়ে এলো। দম বন্ধ হতে শুরু করলো। কেন এমন হলো তার সঙ্গে ? কেন ভালোবাসার মানুষটাকে পেয়েও পাওয়া হলো না ? কেন তাকে ভালোবেসেও ভালোবাসা হলো না ? কেন মনে থাকা ভয়টাই সত্যি হয়ে দাঁড়ালো ?
এত এত কেনর উত্তর পাওয়া হলো না তুষারের। চার দেওয়ালের মাঝেই তার কান্নাগুলো, আত্ম চিৎকারগুলো বন্দী হয়ে রয়ে গেলো। কারোর আর জন্য হলো না নতুন এক বিরহের গল্প। কেউ আর বলতে পারলো না আমায় তুমি তোমার মাঝেই রেখো চিরকাল। সব আর্তনাদেরা এসে ভিড় করলো সেই চার দেয়ালে যেখানে হত্যা হয়েছে এক অসহায় প্রেমিকের নরম হৃদয়খানা, রচিত হয়েছে নতুন বিরহের গল্প। জানা হলো না, আর কারো জানা হলো না দুই হৃদয়ে দাফন হওয়া সেই মৃত্যুর গল্প।
—————————
১৫ই ভাদ্র, সাল ১৯৯০
সময়টা বিকেলের। ভাদ্র মাসের তাল পাকা গরমে বাতাবরণ যেন সিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর জানালার ফাঁক ঠিকরে শোবার ঘরে শাহিদা খাতুনের ফর্সা,চামড়া কুচকে যাওয়া পা দুটোয় এসে পড়ছে। ফর্সা পায়ে রোদ্দুরের আলো যেন ঝলমলিয়ে উঠেছে। শাহিদা নাকে নেমে আসা চশমাখানা ঠিক করে আবারও সুপারী কাটায় মন দিলেন।
চাবির ঝনঝন শব্দ শাহিদা খাতুনের মনযোগ নষ্ট হলো। তিনি মুখ তুলে দেখলেন বিনী এগিয়ে আসছে। তার আঁচলে চাবির গোছা বাঁধা। বিনীকে দেখতে ঠিক যেন মনে হচ্ছে মৃন্ময়ী। শাহিদা খাতুন চোখ দুটো বুজে নিলেন। বিনীর পায়ে থাকা নূপুরের রুমঝুম শব্দ তার কানে আসছে। বুক থেকে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। আজ মৃন্ময়ীর কথা খুব মনে পড়ছে।
মৃন্ময়ী সম্পর্কের শাহিদা খাতুনের ছোটবেলার সখী ছিল। সেই দুই বছর থেকে চৌদ্দ বছর অব্দি দুজনের একসঙ্গেই বেড়ে উঠা। তারপর শাহিদা খাতুনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দুজনের বন্ধুত্বে কখনও চিড় ধরেনি। বিয়ের পরও হাজার বাধা বিপদ থাকা সত্ত্বেও শাহিদা মৃন্ময়ীর সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যান।
এরই মাঝে মৃন্ময়ীরও বিয়ে হয়। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার গর্ভে আসে আনিস। একদিকে মৃন্ময়ীর জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছিল আরেক দিকে প্রিয় সখীর সংসারে ভাঙন ধরে। শাহিদা খাতুনের তিন বছরের সংসার কাচের মতো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যায় কারণ তিনি পারেননি হাজার মারধর সহ্য করেও সংসার করে যেতে। একসময় স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে চলে আসেন বাপের বাড়ি।
সেই থেকে শাহিদা খাতুনের উপর নেমে আসে অমানসিক অত্যাচার। সবকিছু সহ্য করে তবুও ভাই ভাবির সংসারে বোঝার মতো পড়ে থাকেন। যেখানে ভাই আপন হলো না সেখানে ভাবি, পরের মেয়ে আপন হবে এই আশা করাই বোকামি।
অন্যদিকে মৃন্ময়ী জন্ম দিল এই পুত্র সন্তানের। কিন্তু অল্প বয়সে গর্ভ ধারণ করায় বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারেনি। আনিসের যখন এক মাস ঠিক সেই রাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। আজাদ সাহেব যেন স্ত্রীর প্রয়াতে ভেঙে পড়লেন। ছেলে সামলাবেন না নিজেকে। বাধ্য হয়ে শাহিদাই এগিয়ে এলেন নিজের সখীর শেষ স্মৃতিকে আগলে নিতে।
এইদিকে এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন শাহিদার ভাই,ভাবি। তারা সুযোগ বুঝে আনিসের বাহানা দিয়ে আজাদ সাহেবের সঙ্গে শাহিদা খাতুনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। আজাদ সাহেবও ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃন্ময়ীর শেষ কথা রাখতে বিয়ের পিড়িতে বসে পড়লেন কিন্তু শাহিদা খাতুনকে স্ত্রী বিনা প্রেয়সী রুপে কোনওদিন মেনে নিতে পারলেন না।
স্ত্রী মারা যাওয়ার কিছুদিন পরই ছেলের আরেক বিয়েটা মেনে নিতে পড়লেন আজাদ সাহেবের মা। তিনি শুরু করলেন শাহিদার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার। তবে এসব অভ্যস্ত শাহিদা বুঝতে পারলেন তার শাশুড়ি মা ছেলের প্রথম স্ত্রীয়ের মৃত্যু আর ছেলের বিয়ে কোনোটাই মেনে নিতে পারেননি। কারণ দিনশেষে ভালোবেসে তো মৃন্ময়ীকেই ছেলের বউ করে এনেছিলেন তিনি। সেই থেকে তিনি সবটা সহ্য করেই চলেছেন। আজাদ সাহেব তাকে প্রেয়সী রূপে মানতে না পারলেও স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। তাই হয়তো মায়ের অমন দুর্ব্যবহারে শাহিদার হয়ে কথা বলতেন।
সেসবের পর আজ অনেক বছর কেটেছে। আজাদ সাহেবের মা মারা গেছেন মৃন্ময়ীকে মনে রেখেই। শাহিদাকে কোনওদিন তিনি তার ছেলের বউ রুপে মেনে নেননি। কিন্তু শাহিদার তাতে কোনো আপত্তি নেই। আজাদ সাহেবের বাবা যিনি মৃন্ময়ীকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতেন তিনি মৃন্ময়ীর সখী অর্থাৎ ছেলের দ্বিতীয় স্ত্রীকেও সমান ভালোবেসেছেন। মৃণ্ময়ী আর শাহিদা দুজনেই ছিলেন তার খুব আদরের।
শাহিদা যেমন আজাদ সাহেবের স্ত্রী হয়ে অনেক ভালোবাসা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য পেয়েছেন তেমনই মৃন্ময়ীকে হারানোর যন্ত্রণাও সহ্য করেছেন। যেই সখীর সঙ্গে তিনি ছোট থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছেন, যার ছেলেকে নিজ হাতে পেলে বড় করেছেন তাকে সঙ্গে নিয়ে এই সুন্দর স্মৃতিগুলো সাজাতে না পারার যন্ত্রণাও সহ্য করেছেন তিনি। মৃন্ময়ী ছিল তার কাছে স্বার্থপর পৃথিবীর স্বার্থহীন একজন। তাকে ভোলা আদো জীবনে সম্ভব না শাহিদার পক্ষে।
যেই মৃন্ময়ীকে সেই শেষবার তার মৃত্যুর আগে দেখেছিলেন শাহিদা তাকেই কেন আজ আবারও দেখলেন, ঠিক বিনীর রুপে। সেই একই রকম করে শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা বেধে চঞ্চল পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। চির প্রিয় সখীকে বিনীর মাঝে পেয়ে মুগ্ধ হয়ে ছে রইলেন তিনি।
শাহিদা খাতুনকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিনী এগিয়ে এলো। শাহিদা খাতুনের হাত থেকে সুপারী কাটা নিয়ে নিজেই সুপারী কাটতে শুরু করলো। বিনীর হাতের স্পর্শে শাহিদা খাতুনের ঘোর ভাঙলো। অবাক হয়ে বললেন ‘ তুমি এই সময় এখানে কিল্লেগা ? সারাদিন কাম সাইরা ঘরে শুইবাই না। তুমি ঘরে না শুইয়া এইখানে কি করো ? ‘
বিনী সুপারী কাটতে কাটতে বললো ‘ এমনই, ইচ্ছে করলো শুতে। ভাবলাম আপনার কাছে এসে দেখি আপনি কি করেন। আচ্ছা আম্মা আমরা যাকে ভালবাসি তাকে কেন পাইনা আর যাকে কখনও ভালোবাসিনি তাকে কেন অবলীলায় পেয়ে যাই ? ‘
শাহিদা খাতুনকে এই প্রথম যেন হাসতে দেখলো বিনী। তিনি হাসছেন, হ্যাঁ তিনি হাসছেন বিনীর কথায়। বিনীর কথায় হাসতে হাসতেই বললেন ‘ কে বলেছে আমরা যাকে ভালবাসি তাকে পাই না। ভালোবাসা ভাগ্যের লিখন। আর ভাগ্য নির্ণয় হয় সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে। আমাদের উচিত যারা আসলেই আমাদের সঙ্গী তাদের ভালোবাসা।
কিন্তু মানুষ হলো এমন এক জাতি যার নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই টান আর কৌতূহল,ভালো লাগা বেশি। তাই আমরা যে আমাদের সঙ্গী তাকে ভালোবাসতে পারিনা আর যে আমাদের জন্য নয় তাকেই ভালোবাসি। কথাটা এমন যে যেই মানুষটা আমাদের নয় আমরা তাকেই নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলি, তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে আমাদের মনে আর যে প্রকৃত পক্ষে আমাদের তাকে আমরা ভালবাসিনা, তাকে পাওয়ার কোনো ইচ্ছা রাখিনা। তাই আমাদের মনে হয় আমরা যাকে ভালবাসি তাকে পাইনা আর যাকে ভালবাসি না তাকে পেয়ে যাই। বুঝলে ?’
বিনী মাথা নেড়ে সায় দিল। মনে মনে বললো ‘ যে আমার নয়, যাকে পাওয়ার আমার কোনো অধিকার নেই দিন শেষে আমি তাকেই ভালোবেসেছি। এই কি ভাগ্যের পরিহাস ? অথচ যার আমার উপর সবথেকে বেশি অধিকার তাকে এখন পর্যন্ত তার প্রাপ্য দিতে পারিনি। ‘
—-
একলা ঘরে হলদে বাতির টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আছেন আজাদ সাহেব। শরীরটা ইদানিং তার ভালো লাগছে না। অল্পতেই ঘেমে উঠছেন। কে জানে কেন এমন হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যাপারে কিছু জানিয়ে পরিবারের সবাইকে বিপদে ফেলে দিতে চাচ্ছেন না তিনি। তাই আপাতত এই ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।
কানে আসছে নূপুরের রুমঝুম শব্দ। আজাদ সাহেব মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছেন সেই সুর। সুর যেন তাকে কাছ ডাকছে। অনুভব করছেন সুরের মুগ্ধতা নিস্তব্ধ এই প্রহরে। টেবিলের উপর থাকা রেডিওতে বাজছে হেমন্ত কুমার খ্যাত ‘ এই রাত তোমার আমার ‘ গানের সুর। আজাদ সাহেব সেই সুরও শুনছেন সঙ্গে উপভোগ করছেন নূপুর নৃত্য।
‘ আজাদ ‘
নারী কন্ঠের ডাকে চোখ দুটো খুললেন আজাদ সাহেব। আবছা চোখে দেখলেন সামনে দাড়িয়ে আছে এক নারী অবয়ব। হলদে বাতির আলোয় চোখে সয়ে আসতেই সামনে দাড়িয়ে থাকা নারী অবয়ব পরিষ্কার হয়ে এলো। সামনে দাড়িয়ে আছে চায়ের কাপ হাতে মৃন্ময়ী। আজাদ সাহেব মৃন্ময়ীকে দেখে হাসলেন। দাড়িয়ে থাকা মানুষটা আদৌ সত্য নাকি শুধুই দৃষ্টির ভ্রম বোঝার উপায় নেই।
দুই চোখ ভরে মৃন্ময়ীকে দেখেই যাচ্ছেন আজাদ সাহেব। তাকে দেখতে দেখতেই আজাদ সাহেবের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। দূর্বল হাতে চোখ দুটো মুছে নিলেন তিনি। মৃন্ময়ী এখনও কোমল হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আজাদ সাহেব রাগ হলেন। শক্ত কণ্ঠে সুধালেন ‘ কেন এসেছ তুমি ? ‘
আজাদ সাহেবের শক্ত কণ্ঠে শুনে মৃন্ময়ীর মুখভঙ্গি অসহায় হলো। সে কাতর চোখে আজাদ সাহেবের দিকে তাকালো। কোমল গলায় বললো ‘ তোমাকে নিতে এসেছি। ‘
‘ বেশি দেরি করে ফেললে না ? ‘
‘ কিছু কিছু মানুষদের সঙ্গে আমাদের দূরত্বই এত বেশি থাকে যে সেই দূরত্ব মিটিয়ে কাছে আসতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। তোমার আর আমার মধ্যে দূরত্ব ওই সুদূর আকাশের সমান। দিনের আলো পেরিয়ে রাত নামতে যত সময় লাগলে আমাদের মধ্যে দূরত্ব পেরিয়ে কাছে তারও বেশি সময় লাগে। ‘
মৃন্ময়ীর কথায় আজাদ সাহেব কিছু বললেন না। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে দূর আকাশে তাকিয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ এভাবেই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে রেখে একসময় আজাদ সাহেব পাশ ফিরলেন। দেখলেন মৃন্ময়ী তার পাশেই এক চেয়ারে বসে আছে। তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়েও আছে। আজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন ‘ এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে জানতে পারি ? ‘
মৃন্ময়ী হাসলো। আরামে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুঁজে বললো ‘ আপনাকে দেখার তৃষ্ণা মিটাই। ‘
আজাদ সাহেবও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। মৃন্ময়ীর হাতে হাত রাখলেন। মৃন্ময়ী বললো ‘ এই হাত কোনওদিন ছুটবে না। ‘ আজাদ হাসলেন। চোখ বুজে সস্তির নিশ্বাস ফেললেন। আজ যেন পাষাণ হৃদয়ের ভার নেমে গেছে। মনটা হালকা লাগছে। চোখ জুড়ে ঘুম নেমেছে। ইচ্ছে করছে একটু ঘুমোতে। শান্তির ঘুম ঘুমোতে চান তিনি। যেই ঘুম ভেংগে মৃন্ময়ীকে হারানোর কোনো ভয় নেই। মৃদু গলায় শেষবার তার মৃন্ময়ীকে ডেকে চোখ দুটো বুজলেন।
” মৃন্ময়ী তোমার জন্য লিখিব
হাজার বিরহের গান,
যখন কলা পাতায়
বাঁধিবো মোর পরান।। “
—-
রুনার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার খবরে দোকান ফেলে ছুটছে সরাব। চিন্তায় তার মাথাটা ভার হয়ে এসেছে। রুনার হঠাৎ কি হলো যে এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লো ? খাওয়া দাওয়া কি করে না ঠিক মতো ? কিন্তু রুনা তো রোজ তার সামনে বসেই খায় আর সে নিজেই তো ওকে বেশি করে ভাত দেয়। তাহলে ? কোনো রোগ বাঁধিয়ে বসলো নাতো রুনার শরীরে।
চিন্তায় পুরোটা রাস্তা এক প্রকার ছুটে এলো সরাব । ছুটতে ছুটতে বাড়ির কাছে এসে দাড়িয়ে পড়লো। হাঁটুতে হাত রেখে হাপাচ্ছে সে। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে নিজের অনিয়ন্ত্রিত নিশ্বাস নিয়ন্ত্রণে আনলো। তারপর এগিয়ে গেলো বাড়ির দিকে। কিন্তু বাড়ির দরজার সামনে এসে দাড়াতেই পাশের বাড়ির রুমা খালার মা আর নূরজাহানের দেখা পেলো সে।
রুমা খালার মা সরাবকে দেখে বললেন ‘ মিষ্টি খাওয়াও ছেলে। এত বড় একটা সুখবর, মিষ্টি না খেয়ে তো আমি যাচ্ছি না। পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলানো দরকার। আমার বিশ্বাসই হয় না এই ছেলেরে নাকি কালই বাচ্চা দেখছিলাম আর আজ আরেক বাচ্চার বাপ হয়ে গেলো। ‘
মহিলার কথার মানে কিছুই বুঝল না সরাব। অবাক গলায় সে জিজ্ঞেস করলো ‘ মানে ? আরেক বাচ্চার বাবা কে ? ‘
‘ ওই দেখো, ছেলে বলে কি। আরে বাবা বিয়া যখন করছো তখন বাচ্চার বাপ তো হইবাই। তোমার বউ তো পোয়াতি। ‘
রুনার খবর পেয়ে সরাব চমকালো না। সে স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে ঢুকলো। ঘরে ঢুকে দেখলো রুনা মন মরা হয়ে উঠান থেকে তুলে আনা কাপড় গুছাচ্ছে। রুনাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো সে। রুনা কাজেকর্মে থেকে লক্ষ্য করেনি সরাবের আগমন। সে আপন মনে কাজ করছে।
রাত তখন এগারোটা। বাহিরে চলছে মৃদু হাওয়ার তোড়। রুনা হারিকেন নিভিয়ে কুপি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে সরাবের জন্য। ঠিক অপেক্ষাও যে করছে তানা। সে তার সময় কাটাচ্ছে রসায়ন পড়ে। অপেক্ষার প্রহর তার দীর্ঘ সময়ের। নূরজাহান খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছেন।
সরাব যখন ফিরলো তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। সে ফিরেই দেখলো রুনা রান্নাঘরে তরকারি জাল করছে। তাই সে আর রুনাকে কিছু বললো না। সোজা হাতে থাকা পলিথিনখানা রুনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে জামা কাপড় বদলাতে গেলো। রুনা খানিকটা অবাক হলো সরাব হঠাৎ কি আনলো এই ভেবে। তাই সে কৌতুহল মেটাতে পলিথিনখানা খুললো।
পলিথিন খুলতেই রুনার চোখ দুটো খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সরাব ততক্ষণে জামা কাপড় বদলে এসে হাজির হয়েছে। রুনাকে হাসতে দেখে বললো ‘ মন ভালো হয়েছে তোর ? ‘
রুনা খুশি হয়ে বললো ‘ তুমি কি করে জানলে আমার তেতুঁল খেতে ইচ্ছা করছিলো ? ‘
‘ আমি এমন অনেক কিছুই জানি যা তুই জানিস না। ‘ বলতে বলতে সরাব মুখে ভাতের লোকমা তুললো।
‘ আচ্ছা তুমি খুশি তো ? ‘
‘ কিসের জন্য ? ‘
‘ এইযে আমরা মা বাবা হচ্ছি। তুমি নিশ্চই ভাবতে পারনি আমরা এত তাড়াতাড়ি মা বাবা হবো। তুমি কি রেগে আছো ? যে এখন আমি আর পড়াশোনা করবো না ঠিক মতো। বিশ্বাস করো আমি মোটেই পড়াশোনায় ঢিলেমি করবো না। তুমি যা বলবে তাই করবো। ‘
রুনার কথায় কি বলবে বা কি বলা উচিত বুঝতে পড়লো না সরাব। মুখ তুলে রুনার দিকে চেয়ে খানিকটা অপ্রস্তুত গলায় বলল ‘ না মানে আমার কি বলা উচিত আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। আমার মনে হয় প্রথমবার বলেই এরকম ভাষাহীন অনুভূতি হচ্ছে। কোনো ব্যাপার না। সেকেন্ড টাইম অভ্যস্ত হয়ে গেলে তখন জানাবো আমার কেমন লাগছে। ‘
সরাবের কথায় বড় বড় চোখ করে তাকালেন রুনা। সে সরাবের দিকে তাকিয়ে পাতে ভাত নিচ্ছিল। সরাবের কথা শুনে তার হাত থেকে ভাত পড়ে গেছে। সে ভাত তুলতে তুলতে সরাব বললো ‘ কিন্তু আমার মনে হয় জিনিসটা সুন্দর। আমি বাবা হবো, তুই মা হবি। আমাদের একটা মেয়ে হবে। আচ্ছা মেয়ের নাম কি রাখবো ? রুসা ? ভালো নাম, তোর আর আমার নাম মিলিয়ে। ‘
সরাবের কথায় মুখ তুলে তাকালো রুনা। তার অধর কোণে টুকরো হাসি। সরাব স্মিত হেসে রুনার দিকে ওর হাতটা এগিয়ে দিল। আলতো ছুঁয়ে ভাতের দানা সরিয়ে নিলো রুনার ঠোঁটের কোণ থেকে। রুনা খিলখিল করে হেসে উঠলো। ওকে হাসতে দেখে সরাব মুগ্ধ হলো। বিড়বিড় করে বললো ‘ পেরেছি, আমি পেরেছি রুনা। তোকে আমি ভালোবাসতে পেরেছি। ‘
—-
সেলাই মেশিনে শাড়ির ব্লাউজ সিলাই করছেন জাহানারা। নতুন একটা শাড়ি পেয়েছেন শাহরিয়ারের কাছ থেকে। গত পরশুদিন এসে শাহরিয়া নিজ হাতে বাড়ির সবার জন্য নতুন জামা কাপড় দিয়ে গেছে। সঙ্গে জাবিয়া আসেনি। জাহানারা প্রথমে ব্যাপারটা আমলে না নিলেও এখন উনি বেশ বুঝতে পারছেন মেয়ে তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে।
একজন মায়ের কাছে সন্তানের অবহেলা যে ঠিক কতটা হৃদয় বিদারক সেটা শুধু যেই মা অবহেলা পেয়েছে সেই জানে। জাবিয়া তার অনেক আদরের সন্তান। ভেবেছিলেন প্রথম প্রথম এরকম করলেও বিয়ের পরে আস্তে আস্তে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তার ধারণা পুরোটাই ভুল। জাবিয়ার বিয়ের ইতিমধ্যে চার মাস পেরিয়েছে কিন্তু বিয়ের পর এই পর্যন্ত একদিনও মেয়ে তাকে নিজ থেকে ফোন করে কোনো খোঁজ নেয়নি।
বিয়ের পরে জাবিয়া শাহরিয়ারের সঙ্গে নিয়ম রক্ষার্থে একদিন অবশ্য এসেছিল। কিন্তু একদিন পার হতেই সে আজমল সাহেবকে একা ওই বাড়িতে রেখে ভালো লাগছে না অজুহাতে ফিরে গেছে। জাহানারা ভেবেছিলেন মেয়ে হয়তো মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বুঝেননি মেয়ে আসলে মানিয়ে নেয়নি, তার কাছ থেকে দিনে দিনে দূরে সরে গিয়েছে।
জাহানারা বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে জাবিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। তবে জাবিয়া প্রতিবারই দুই মিনিট কথা বলেই কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোনটা আজমল সাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে এড়িয়ে গেছে জাহানারাকে। জাবিয়ার এই মৌনতা, কথা বলতে চেয়েও কথা না বলা জাহানারাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে। এতটাই কষ্ট দিচ্ছে যে বলে বোঝানো যাবে না।
মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতেই অজান্তে আঙ্গুলের উপর দিয়ে সেলাই মেশিন চালিয়ে দিলেন জাহানারা। মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ। আঙ্গুল দ্রুত সরিয়ে নিলেন। আঙ্গুল থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আঙ্গুলটা মুখে চেপে ধরলেন জাহানারা। তার চোখে ভিড় করেছে অশ্রুরা। মনে পড়ছে আদরের মেয়ের কথা।
বিয়ের আগে দিয়ে জাবিয়া পাগলের মত জাহানারার পা ধরে কেঁদেছিল যেন তাকে শাহরিয়ারের সঙ্গে বিয়ে না দেয়। কিন্তু জাহানারা স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিয়েছিলেন উনি কখনোই তুষারকে মেনে নিবেন না। বাধ্য হয়েই অভিমানী মন নিয়েই বিয়ে করে পাড়ি জমিয়েছে শশুর বাড়িতে।
যেদিন জাবিয়ার বিয়ে হলো সেদিন শুধু জাবিয়ার সঙ্গে জাহানারার সম্পর্ক খারাপ হয়নি, সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে তিন তিনটে জীবন। শাহরিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। ঘরে জাবিয়া বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। জাবিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতো তারা সংসারও করছে কিন্তু তাদের মধ্যে মনের মিলটা আর হয়নি। তাদের দেখলে সকলে বাহবা করে কিন্তু বাহিরে দিয়ে তাদের সম্পর্ক যতটা সুন্দর ভিতর দিয়ে ঠিক ততটাই ফাঁকা।

———————
কিংবা মৃত্যু দুটোই বিধাতার ইচ্ছা। জন্ম যেমন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেতে হয় মৃত্যুও তেমনই তার ইচ্ছেতে হয়। স্রষ্টার সৃষ্ট সকল জীবকেই এই মৃত্যুর স্বাদ পেতে হবে। হোক সে স্থল ভাগের পিপড়ে কিংবা সাগরের তিমির। মৃত্যুর স্বাদ পাওয়া যে সকল জীবের জন্য অনিবার্য। এই চিরন্তন সত্য জানার পরও আমরা তৃষ্ণার্ত পথিকের মতোই অন্যের মায়ায় জড়িয়ে যাই। ভালোবেসে নিজের আপন সত্তাকে হারাই।
আজাদ সাহেব তার মৃন্ময়ীকে হারিয়ে তবুও এতকাল মনের জোরে বেচেঁ ছিলেন। সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বুঝ দিতেন মৃন্ময়ী না থাকলেও তার সন্তানরা আছে। মনের জোরে অপেক্ষার ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া শরীরটা টেনে হিচরে সামলে রেখেছেন। কিন্তু সবকিছুরই এক নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময়ের বাহিরে স্রষ্টার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই সম্ভব না।
এতকাল মনের বলে টিকে থাকা আজাদ সাহেবের প্রয়াতে বাড়ির সকলে যেন নীরব দর্শকে পরিণত হলেন। খাটিয়ার উপর আজাদ সাহেবের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে শাহিদা খাতুন স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তার চোখে নেই কোনো অশ্রু,মুখে নেই কোনো হাসি। বিনী তার পাশে তার হাত জড়িয়ে বসে আছে। শাহিদা খাতুনকে এতটা নীরব সে কখনো দেখেনি। শাহিদা খাতুন গম্ভীর ধরনের মানুষ। আজাদ সাহেবের মতো হাসাহাসি করার ক্ষমতা তার নেই।
তবে শাহিদা খাতুন যে একেবারেই হাসেন না তানা। শাহিদা খাতুনকে প্রথমবার তো কালই হাসতে দেখেছিল বিনী। হাসলে মানুষটাকে কি অমায়িক লাগে। চোখ যেন জুড়িয়ে যায়। অথচ সেই মানুষটাই আজ রক্ত মাংসে গড়া শুধুই মাত্র এক পাথরের মূর্তি।
আজাদ সাহেবের মৃত্যুতে আবির আর আনিস নিজেদের বদ্ধ অনুভূতির প্রকাশ করতে পারেনি। দিনশেষে তারা পুরুষ আর সামাজিক শিক্ষা বলে পুরুষ মানুষদের কাদতে নেই। আজাদ সাহেবের জানাজা পড়ানো হয়েছে। উনার জানাজায় এলাকার সব বুজুর্গ, সম্মানিত ব্যক্তিরা ও দুজন এলাকারই আলেম এসেছিলেন।
খবর পেয়ে জহির সাহেব ছুটে এসেছেন। সামাজিক ভদ্রতা রক্ষার্থে ভদ্রতার মুখোশ পড়ে সালমা ইসলামও হাজির হয়েছেন অথচ আবিরদের বাড়ি আসার প্রতি তার বিন্দুমাত্র কোনো আগ্রহ ছিল না। সবটাই আসলে আউট অফ কার্টেসি। নাহলে যেই ছেলের পরিবারকে তিনি দুই চোখে সহ্য করতে পারেননা তার বাবার জানাজায় তিনি আসবেন কথাটা নেহাতই সময়ের বিলাসিতা।
সামাজিক ভদ্রতা রক্ষার্থে এলেও সালমা ইসলামের এই প্রথম শাহিদা খাতুনের মুখ চেয়ে খারাপ লাগলো। ভিতরটা অনুতাপে পুড়তে লাগলো। মনে হলো এই মানুষটাকে কিনা তিনি একেবারেই দেখতে পারেন না অথচ আজ তার অসহায়, নীরব মুখখানা দেখে তার হৃদয়ে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা উঠেছে।
জাবিয়া ছুটে এসেছে শেষবারের মতো তার বড় কাকাকে দেখতে। আজাদ সাহেবকে খাটিয়ার উপর শুয়ে থাকা অবস্থায় দেখে শাহরিয়ারকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে সে। এই মানুষটাই কিনা তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে অথচ আজকের পর আর তাকে দেখা হবে না।
জুহারিন আজাদ সাহেবকে শুয়ে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বারবার তার চোখে মুখে হাত রেখে বলছে ‘ দাদ্দু… ও দাদু উঠো তুমি। বেরু বেরু যাবে না। ‘
মেয়ের কথায় খানিক পরপর কেঁদে উঠছে আফিফা। কোনওদিন ভাবেনি যেই মানুষটা তাকে মা মা ডেকে মেয়ের মতো আদর করতেন তাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখতে হবে। আজাদ সাহেবের বলা একটা কথা আজ অনেক মনে পড়ছে।
‘ আমার বহুকালের আক্ষেপ ছিল আমার একটা মেয়ে হলো না। অথচ আমার একটা মেয়ের আক্ষেপে আল্লাহ আমায় দুটো মেয়ে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। বিনী, আফিফা আমার ছেলের বউ নয়, ওরা আমার মেয়ে। আমাদের বাড়ির সম্মান ওরা। ‘
আজাদ সাহেবের দাফন কার্য সম্পন্ন হয়েছে। জহির সাহেব, শাহরিয়া, আনিস আর আবির নিজে খাটিয়া তুলেছে। সাজ্জাদ সাহেবও আবিরদের সঙ্গে হেঁটে পারিবারিক কবরস্থানের দিকে গেছেন। তাদের পারিবারিক কবরস্থান বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে।
জানালা দিয়ে আবিরদের কবর যাত্রা দেখছেন শাহিদা খাতুন। যেই মানুষটার সঙ্গে এতকাল সংসার করলেন আজ থেকে সেই মানুষটাই নাকি ওই একলা নির্জন জায়গায় সাড়ে টিন হাত মাটির নিচে শুয়ে থাকবেন। যেই মানুষটাকে বিয়ের পর থেকে আজ অব্দি কোনওদিন একলা ছাড়েননি তাকে ছাড়াই আজ থেকে একলা থাকতে হবে।
জাদিদ আজাদ সাহেবকে দাফন করতে যায়নি। তার জীবনে সাজ্জাদ সাহেব ঠিক যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, আজাদ সাহেবও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে আজাদ সাহেব সাজ্জাদ সাহেবকেও ছাড়িয়ে যান।ছোটবেলায় পরীক্ষার খাতায় নাম্বার খারাপ আসলে সাজ্জাদ সাহেবের নাম করে আজাদ সাহেবের বাবা হয়ে হাজির হওয়ার কথাটা মনে পড়লে আজও বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আজও মানুষটা কেন তার সঙ্গে রয়ে গেলো ?
জাদিদের কাছে আজাদ সাহেব বাবার মতো একজন মানুষ। সন্তান হয়ে বাবার লাশ কাধে তুলে নেওয়ার মতো অমানসিক যন্ত্রণা এই নির্দয় পৃথিবীর বুকে আর একটাও নেই। মানুষটা যে তার বাবা। বাবাকে কি করে একলা ওই নির্জন জায়গায় নির্দয়ের মতো ফেলে আসে ? এমনটা করার মত পাষাণ হৃদয়ের মানুষ সে যে এখনও হতে পারেনি।
মৃত ব্যক্তির বাড়িতে তিনদিন চুলা জ্বলতে নেই এমনটাই শুনে এসেছে সকলে। তাই আফিফা আর জাহানারা রান্নার চিন্তা করেননি। শাহিদা খাতুন চিরকাল গাম্ভীর্য বজায় রেখে মুখের উপর সত্য কথা বলায় বিশ্বাসী। তাই তার এই স্বভাবের জন্য আশেপাশের প্রতিবেশী কোনওদিনই তাকে পছন্দ করতেন না। তবে স্বামী হারা শাহিদা খাতুনের প্রতি এতটা নির্দয় হওয়ার মতো পাষাণ হয়তো তারা নয়। সেই কারণেই কয়েকজন এগিয়ে এসেছেন আগামী তিনদিনের খাবার তাদের ঘর থেকে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে।
কিন্তু শাহিদা খাতুন এই ব্যাপারে নম্র কথায় আপত্তি জানিয়েছেন। সরাসরি বলেছেন ‘ আমাগো খাবারের যোগান আমরাই করবার পারি। আর কেউ না রাধলেও আমি রাধমু। এই বয়সেও বিশজন মাইনসের খাবার রান্ধনের শক্তি আমার শরীলে আছে। আমার হাতের খাওন কারো খাইতে সমস্যা হইলে না খাইয়া থাকবো তবুও এই বাড়িতে বাইরের খাবার ঢুকবো না। এসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করিনা। ‘
অতঃপর প্রতিবেশী বিবিরা আর কি করবেন। শাহিদা খাতুনের নম্রভাবে করা অপমানে তারা অপমানিত বোধ উপলব্ধি করিয়া আর জীবনে এ বাড়ি মুখো হবেন না কইয়া প্রস্থান করিলেন। জীবনে অনেক মানুষ দেখেছেন তারা। কিন্তু স্বামী হারানোর পরও শাহিদা খাতুনের মতো শক্ত ধাচের মানুষ দেখেননি তারা। একি আদৌ মানুষ না রক্তে মাংসে গড়া পাথরের প্রতিমা ?
রান্নাঘরে দাউ নিয়ে সবজি কাটছেন শাহিদা। তার সঙ্গে আছে বিনী। জাহানারা আর আফিফাকে রান্নাঘরে আসতে বরণ করেছেন শাহিদা। তেনারা এখনও শোকে কাতর কাজেই রান্না তাদের না করাই উচিত। উনি আবেগী নন। উনার সঙ্গে সঙ্গে উনার ছোট ছেলের বউ বিনীও শক্ত ধাচের। কাজেই নিজেদের সামলে নিতে জানেন তারা।
বিনীকে রান্নার কাজ দিয়েছেন শাহিদা আর নিজে সবজি কাটছেন। কুটকুট আওয়াজে সবজি কাটছেন তিনি। আজকের রাতটা বিনীর বাবা মা এখানেই থেকে যাবেন যেহেতু অনেক রাত হয়ে এসেছে। তাই সবার জন্য নিজেই রান্না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বিনী আপাতত রাধছে, তরকারি কাটা শেষ হলে তিনিও রান্নায় নামবেন।
বিনী অবাক হয়ে দেখছে শাহিদা খাতুনকে। এতটা শক্ত মনের মানুষ আগে দেখেনি সে। তার বিয়ের ছয়মাস হতে চলেছে। এতদিনে সে শাহিদা খাতুনের আচার আচরণ ও ব্যবহারে টের পেয়েছে আজাদ সাহেবকে খুব ভালোবাসেন তিনি। অথচ তার প্রয়াতে তিনি কাদেননি। শাহিদা খাতুন এতটা শক্ত নাহলেও পারতেন। তাকে কাদতে না দেখে এলাকার অনেকেই বাজে গুজব ছড়িয়েছে। শাহিদা খাতুন নাকি স্বামীর মৃত্যুতে একেবারে শোকাহত নন।
বাড়ির পুরুষদের কাদতে দেখেনি বিনী। সে জানে সমাজ পুরুষদের কাদতে নেই বলে যেই প্রবাদ চালু করেছে তারই ফল এটা। একজন মেয়ে মানুষ নিজের কষ্ট যত সহজে মেলে ধরতে পারে, ছেলে মানুষ তত সহজে নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারে না। কিন্তু শাহিদা খাতুনের পাষাণ মন বাকিদেরও ছাড়িয়ে গেছে। বাবার মৃত্যুতে আনিস, আবির অব্দি নীরবে অশ্রু ঝরিয়েছে। সাজ্জাদ সাহেব লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ঘরে কেঁদেছেন।
অথচ শাহিদা খাতুন কাল রাত থেকে এখন পর্যন্ত বিনীর সামনেই আছেন। বিনী একবারও দেখেনি তাকে কাদতে। মানুষটা কি তাহলে অসহনীয় কষ্টের যন্ত্রণায় পাথর হয়ে গেলেন ? তবে আজাদ সাহেবের মৃত্যুতে শাহিদা খাতুনের মুখের জৌলুস যেন হারিয়ে গেছে। একদিনেই চেহারার ধারালো সেই সৌন্দর্য্য কমে এসেছে।
বয়স হওয়ার পরও শাহিদা খাতুন এখনও ফর্সা, সুন্দর, মায়াবতী মুখশ্রীর অধিকারী। চোখের নিচে তার সর্বদা অদৃশ্য এক কাজল পড়ানো। গোলগাল মুখটা মায়াবী। নিজের এত দিনের চেনাজানায় এমন ধরনের মহিলা বিনী কম দেখেছে। মনে যন্ত্রনা নিয়েও সবার সামনে স্বাভাবিক মুখে থাকা চাট্টিখানি কথা নয়।
শাহিদা খাতুন চিচিঙ্গা কাটছেন। কাটতে কাটতেই তিনি আনমনে নিঃশব্দে হাসলেন। মনে মনে বললেন ‘ তুমি চলে গেছো আমার ছেড়ে তোমার মৃন্ময়ীর কাছে!! অথচ এটা ভাবলে না এত বছর তোমার সঙ্গে সংসার করে তোমায় ভালো না বেসে আমি থাকতে পারিনি। ‘
বিনী ব্যস্ত রান্নায়। তার মন, মস্তিষ্কে আজাদ সাহেব ঘাট বেধে বসেছেন। মানুষটার সঙ্গে তার আহামরি কোনো স্মৃতি নেই তবুও যেন মানুষটা এই বাড়ির সবটা জুড়ে ছিল। তার কথা মনে পড়ছে বিনীর প্রতিক্ষণে। জহির সাহেবের পর তো আজাদ সাহেবই তার কাছে বাবার মত একজন।
শাহিদা খাতুন সবজি কাটতে কাটতে হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন। বিনী চুলার পার থেকে দৌড়ে আসলো। শাহিদা খাতুনের আঙ্গুল কেটে রক্ত বের হচ্ছে। বিনী দ্রুত শাহিদা খাতুনের হাত ধরে কাটা আঙ্গুল কল পাড়ে কলের নিচে ধরলো। বহিত রক্তের স্রোত বন্ধ করা দরকার। কিন্তু রক্ত কিছুতেই বন্ধ হতে চাইছে না।
‘ আম্মা হাতে এন্টিসেপটিক দিয়ে ট্রিটমেন্ট করতে হবে ‘ বলে বিনী মুখ ফিরিয়ে এবার শাহিদা খাতুনের দিকে চাইলো। তবে লক্ষ্য করলো শাহিদা খাতুনের শরীর মৃদু কাপছে। কিন্তু কেন ? তার চোখ শুষ্ক ও নরম। জলে চোখ ভেসে আছে কিন্তু অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে না চোখ থেকে।
শাহিদা খাতুনের থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীর জড়িয়ে ধরলো বিনী। তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। শাহিদা খাতুন এমন একজন মানুষ যিনি চাইলেও শব্দ করে কাদতে পারেন না। চিরকাল মনের ভাব লুকিয়ে রাখা যার স্বভাব তাকে হাউমাউ করে কাদতে দেখার সৌভাগ্য হবে বলে আশা করা যায়না।
‘ তাকে আমি খুব ভালোবেসেছিলাম রে। ‘
বেশ খানিকক্ষণ নীরবে কান্নাকাটি শেষে শান্ত হলেন শাহিদা খাতুন। নিজেকে ধীর হাতে ছাড়িয়ে নিলেন বিনীর হাত থেকে। বিনী বললো ‘ আম্মা আপনি একটু ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিন। আমি রান্নার দিকটা দেখে নিবো। ‘
শাহিদা খাতুন মানলেন না। দৃঢ় কন্ঠে বললেন ‘ দরকার নাই। আমি করমু, তোমার দরকার পড়লে তুমি যাইয়া রেষ্ট করো। ‘
বিনীর রাগ হলো। শাহিদা খাতুন বরাবর নিজের মনমতো চলেছেন। কোনওদিন কারোর কথা শুনেনওনি এবং কেউ কখনো তার উপর কথা বলার সাহসও পায়নি। তাই বলে সবসময় নিজের মনমতো চললে তো হয়না। মাঝে মাঝে অন্যদের মতকেও সম্মান করতে হয়।
বিনী অসন্তোষ গলায় বললো ‘ আমি জানি আপনি করতে পারবেন কিন্তু আপনি জেদী হলেই তো আর আমিও জেদী হতে পারছি না। আপনি নিজের শরীরের কথা না ভাবলেও আমাদের চিন্তা আছে আপনাকে নিয়ে। শুধু আপনিই তো আর আমাদের নিয়ে চিন্তা করেন না। আমরাও আপনাকে নিয়ে চিন্তা করি। মেয়ে হয়ে মায়ের ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তা না করার মতো পাষাণ এখনও হয়ে উঠতে পারিনি। ‘
বিনীর কথায় দমে গেলেন শাহিদা খাতুন। বিনীর কথার জবাবে আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। দূর্বল শরীর নিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাড়ালেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন ‘ তোমাদের আব্বার অনুপস্থিতিতে তোমরা এখন আমার লগে এমন শক্ত ব্যবহার করবার পারছো। সেই মানুষটা থাকলে তোমাগো এই সাহস হইতো না। আমি সব বুঝি, তোমরা বদলায় যাইতাছ। ‘
শাহিদা খাতুনের প্রস্থানের পথ চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিনী। শাহিদা খাতুন এতটা ভেঙে পড়বেন সেই আশা সে করেনি। শক্ত পোক্ত নারী শাহিদা খাতুনকে এতদিন অন্যরূপে দেখে এখন আচমকা এত দূর্বল ভাবে দেখতে তার ভালো লাগছে না। শাহিদা খাতুন শেষ কথাগুলো বড্ড লাগছে। আজ আজাদ সাহেব থাকলে পরিস্থিতিটাই অন্যরকম হতো। তাদের এক পরিপূর্ণ এক পরিবার হতো।
—-
রোজকার মতোই সরাবের ফিরে আসার পর বইখাতা রেখে রান্নাঘরে তরকারি গরম করতে ঢুকেছে রুনা। আজকাল শরীরটা ভালো লাগে না তার। দূর্বল লাগে কেমন। তবে রুনা শরীরের জোরে নয় মনের জোরে কাজ করে। তাই শত দূর্বলতা থাকা সত্ত্বেও সে কাজ ফেলে রাখতে পারেনা। বলা যায় আদ্যপান্ত সে এক সংসারী মেয়ে।
সরাব জামা কাপড় বদলে এসে হিসাবের খাতা নিয়ে মেঝেতে বসেছে। রুনা আগেই পাটি বিছিয়ে রেখেছিল। সরাব তখন হিসাব মিলাতে ব্যস্ত কিন্তু রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা বিকট এক চিৎকারে খাতা রেখেই ছুটে গেলো সে। গিয়ে দেখলো রুনা কলপাড়ে দাড়িয়ে বমি করছে। সরাব গিয়ে ওর চুলগুলো সামনে থেকে পেঁচিয়ে এনে পিছনে রেখে আরেক হাত দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।
রুনার মনে হচ্ছে বমির সঙ্গে সঙ্গে তার নাড়িভুঁড়ি অব্দি বেরিয়ে যাচ্ছে। প্রাণ তার ওষ্ঠাগত। হঠাৎ করে কি যে হলো। মনে হলো মাছের গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কি এসব সম্ভব ? সবে তো একদিন হলো খবরটা পেলো। তাহলে ?
রুনাকে রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসে মেঝেতে পাটির উপর বসালো সরাব। রুনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল ‘ তোর আবার কি হলো ? একটু আগে তো ঠিকই দেখলাম। এই কিছুক্ষণের মধ্যে শরীর খারাপ হলো কি করে ? বেশি খারাপ লাগছে ? ‘
রুনা থিতু হয়ে বসলো। পেট থেকে সব উগড়ে দিয়ে এখন শান্তি লাগছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে সে বললো ‘ জানিনা কি হয়েছে। মাছের গন্ধ খারাপ লাগছে। কেমন বমি পাচ্ছে। ‘
‘ তাহলে তোর এখন কিছু করার দরকার নাই। আমি কাল তোকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাবো আর যথা সম্ভব কাজ কম করার চেষ্টা করবি। বাড়ি ফিরলে এসব আমিই করবো নী। তুই এখন এখানে বস, আমি তরকারি গরম করে আনছি। ‘
সরাব উঠে যেতে ধরলে রুনা বললো ‘ দরকার নেই, আমি উঠছি। তুমি সারাদিন পর বাহির থেকে ফিরেছ। একটু রেস্ট করো। ‘
‘ এত কথা না বলে চুপচাপ ওই পিড়িতে বস। আমি কাজ করছি তুই বসে বসে দেখ। কতদিন কথা হয়না তোর সঙ্গে। একটু কথা বলি। ‘
সরাবের কথায় রুনার মনটা ভালো হয়ে গেলো। এরকম একজনকে ভালোবাসতে পেরে সে আসলেই খুশি। মানুষটা সারাদিন শেষে কাজ সেরে বাড়ি ফিরেছে তবুও তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। এমন একজনের স্ত্রী হওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। রুনা নিশ্চই কপাল গুনে ভাগ্যবতী।
——————-
হারিকেনের মৃদু আলোয় হাঁটুতে মাথা রেখে এক নাগাড়ে সরাবকে দেখে চলেছে রুনা। সরাব ব্যস্ত হাতে তরকারিগুলো গরম করছে। মাটির চুলার তাপে ঘরময় ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। সেই ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশে সরাবের মুখশ্রী মায়াবী হয়ে উঠেছে। এই মায়াবী মুখখানার দিকে তাকালে রুনার মনে হয় এই মানুষটা এখন তার। যাকে এতকাল নিজের করে পাবার তীব্র বাসনা মন জুড়ে হাহাকার বসিয়েছিল আজ সে তার হয়েছে।
কাজ করতে করতে কয়েকবার চোরা চোখে সরাব রুনাকে দেখলো। রুনা এক দৃষ্টে তাকে দেখেই যাচ্ছে। তার চোখে মুখের সরাবের প্রতি মুগ্ধতা আর অন্তরে এক আকাশ সমান ভালোবাসা। বিনীর মতো নীরব, আত্মকেন্দ্রিক এক মেয়েকে ভালোবাসার পর আবারও কাউকে ভালোবাসতে পারবে এই কথা সরাবের মনেতেও আসেনি কোনওদিন।
আসলে কোনওদিন আসেনি বলে ভুল হবে। সরাব মনে আনতে চায়নি দ্বিতীয়বার কাউকে ভালোবাসার কথা। কারণ, কারণ সে চায়নি বিনী ছাড়া দ্বিতীয় কেউ তার অনিদ্রিত রাতের রানী হোক। বিনী ছাড়া অন্য কাউকে সে ভালোবাসার চোখে দেখুক। কিন্তু ভাগ্যের উপর কারোর মাইর নেই। তাই হয়তো বিনীকে এতটা ভালোবাসার পরও তাকে পাওয়া হলো না।
সরাবের এখন মনে হয় যা হয় তা হয়তো ভালোর জন্যই হয়। বিনীরা সামাজিক মর্যাদা বলো কিংবা অর্থ বিত্তের দিক থেকে, দুই দিক দিয়েই ওরা প্রভাবশালী। সেখানে বিয়ের পর বিনী ওর সঙ্গে, ওর মায়ের সঙ্গে এবং ওদের এই যৎসামান্য কুড়ে ঘরে হয়তো মানিয়ে নিতে পারতো না। সেদিক থেকে রুনা আর সে একই পর্যায়ের মানুষ। রুনা হয়তো আরেকটু নিম্নে। তাই তারা দুজনে মানিয়ে নিতে পেরেছে।
ভালোবাসলে সামাজিক মর্যাদা, অর্থ বিত্ত সবই নিছক ছেলেমানুষী কথাটা পুরোপুরি ভুল। বিয়ের মতো একটা সম্পর্কে শুধু ভালোবাসা থাকলেই হয়না। মানিয়ে নেওয়ার এবং মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হয়। যেটা হয়তো বিনীর নাও থাকতে পারতো। তাই সরাব এখন অন্তত রুনাকে বিয়ে করে আফসোস করছে না। এখন কেন, সে যখন বিয়ে করেছিল, যখন তার মনে রুনার প্রতি কোনো অনুভূতি ছিল না তখনও সে আফসোস করেনি।
নিজের অনুভূতি, নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সরাব বরাবর পরিষ্কার। সে যা করে ভেবে চিন্তে করে। একটা প্রবাদ আছে করিয়া ভাবিও না, ভাবিয়া করিও। এই প্রবাদখানা সে বড্ড ভাবে মানে। তাই রুনাকে বিয়ে যখন করেছিল তখনও তার কোনো আফসোস ছিল না এবং এখন তাকে ভালবাসার পরও কোনো আফসোস নেই।
সরাবের জীবনসঙ্গী হিসেবে রুনা যোগ্য। সে হয়তো পুরুষ মানুষ কিন্তু রুনা যে সেই অনেক পূর্বকাল হতেই তাকে নিজের করে পাওয়ার আশায় দিন গুনছে সেটা সেও বুঝতে পেরেছে। তাই বুঝতে পেরেই তাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে হয়তো তার ভালোবাসার মানুষটিকে পায়নি কিন্তু অন্যদের পেতে আপত্তি কোথায়।
‘ এভাবে কি দেখছিস ? ‘
সরাব কাজ করতে করতে আড়চোখে রুনাকে দেখে বললো। রুনা ওকে এক দৃষ্টে দেখছিল। ওর কথা শুনে সে নড়েচড়ে তো বসলো কিন্তু সরাবের উপর থেকে নিজের দৃষ্টি সরালো না। মুগ্ধ, বিমোহিত নয়নে সরাবের মুখ পানে চেয়ে বললো ‘ তোমাকে ‘
‘ আমাকে দেখার মতো নতুন কিছু কি আছে ? রোজই তো দেখিস। ‘
সরাবের কথায় রুনা হাসলো। বললো ‘ এই দেখা আর ওই দেখার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। মনে নেই শেষ কখন তোমায় এভাবে মন দিয়ে দেখেছিলাম। তোমায় দেখার সৌভাগ্য ইদানিং আমার খুবই কম হয়। বাড়ি ফিরছ তুমি দেরি করে। তারপর খেয়েদেয়ে নিজের মতো শুয়ে পড়ো। একবারও মন দিয়ে তাকিয়ে আমায় দেখো না কিংবা আমাকেও তোমাকে দেখতে দাও না। আচ্ছা আমায় তুমি ভালোবাসো না তাইনা ? সেই ভালোবাসতে না পারার শাস্তিই বুঝি দিচ্ছ তুমি ? কিন্তু এই শাস্তি কি আদৌ আমার প্রাপ্য ? ‘
শেষের কথাগুলো বলার সময় সরাব রুনার গলায় থাকা কম্পন টের পেলো। ও চকিতে তরকারির পাতিল নামিয়ে রুনার দিকে ফিরে তাকালো। রুনার চোখে জল আর ঠোঁটে হাসি। কিসের হাসি এটা ? তীব্র বেদনায় নীল হয়ে যাওয়া হাসি ? কিন্তু সরাব তো ভালোবাসে রুনাকে। কতটা ভালোবাসে সেটা সে জানেনা। তার ভালোবাসা কোনো পরিমাপক যন্ত্রে তুলে পরিমাপ করার বস্তু নয় যে মেপে দেখবে। এ তো স্রেফ অনুভব করার জন্য।
কিন্তু রুনা তার উপর অভিমান করেছে!! তার ইদানিং দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে অভিযোগ করছে ? সে বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়ে তা নিয়ে অভিযোগ করছে ? অথচ সে জানেই না রোজ রাতে তার ঘুমিয়ে যাওয়ার পর তার অগোচরেই সরাব তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখে সময়টা পার করে। শুধু রুনাকে খুশি রাখবে,রুনার সব ইচ্ছে পূরণ করবে বলেই রোজ রাতে দেরি করে দোকান বন্ধ করে যাতে আরেকটু বেশি টাকা কামাই করতে পারে।
অথচ ছোট্ট এই মেয়েটা কিছু না জেনেই তার নামে মিথ্যা অভিযোগ করছে। যেই মেয়েটা কোনওদিন তার মুখ তুলে তাকানোর আগে শতবার চিন্তা করেছে সে আজ তার নামে অভিযোগ করছে। নারী বুঝি এমনই পাষাণ মনের। প্রিয় মানুষটার কাছে অভিযোগ করার আগে বুঝি তার বুকটা কাপে না ? মনে হয় না অপর দিকের মানুষটা কি ভাববে।
তবে সরাব বিচক্ষণ। সে তার মাকে দেখে বুঝেছে নারী জাতি অভিমানী। তাই এই অভিমানী প্রেয়সীর অভিমান সে নিজেই ভাঙাবে। ভালোবেসেছে যখন তখন ভালোবাসার মানুষটার রাগ ভাঙ্গানোও তার দায়িত্ব। নিজের দায়িত্বে কার্পণ্য করার মতো মানুষ সে নয়।
‘ তুই আমার দেরি করে ফেরাটা দেখলি অথচ এটা দেখলি না তোকে একটু আরামে রাখার জন্য রুমা খালাকে নিজে এসে পড়িয়ে যেতে বলেছি। আমি অন্য সবার মতো নই। নিজের ভালো লাগা,খারাপ লাগা, ভালোবাসা মুখে মুখে প্রকাশ করতে পারিনা। এসব তোকেই বুঝে নিতে হবে। তোকে নিজের ভালো লাগা বুঝাতে না পারা যদি আমার ব্যর্থতা হয় তাহলে হয়তো সত্যিই আমি ব্যর্থ। কিন্তু তুই যে অভিযোগগুলো করলি সেগুলো কি আদৌ সত্য ? আমি তোকে সত্যিই ভালোবাসিনি ? ‘ সরাব এগিয়ে গিয়ে রুনার গালে হাত রেখে ওর অশ্রুগুলো মুছে দিয়ে বললো।
রুনা থমকালো, সরাব শুধুমাত্র তার আরামের জন্য রুমা খালাকে নিজে এসে পড়িয়ে যেতে বলেছে তার জানা ছিল না। সরাব তার জন্য এত ভাবে সে বুঝতে পারেনি। সরাবের মনে তবে সত্যিই সে আছে। রুনাকে চুপ করে যেতে দেখে অস্থির হলো সরাব। রুনার গালে নিজের হাতটা আরও চেপে ধরলো। আগ্রাসী কণ্ঠে বলল ‘ উত্তর দে রুনা। আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা কি তুই আসলেই দেখতে পাস না ? তোকে ভালো না বাসলে,তোর প্রতি ভালো লাগা না থাকলে কোনওদিন তোর অতটা কাছে যেতাম না যতটা গেলে লোকে কাছে আসা বলে। ‘
রুনা কি বলবে স্থির করতে পারলো না। শুধু অপলক চেয়ে রইলো। এইদিকে তার নীরবতা সরাবকে পাগল করছে। সে হয়ে উঠছে আরও অস্থির। ভালবাসার,ভালো লাগার মানুষটা যদি ভুল বুঝে তাহলে সেই কষ্ট সহ্য করা যায়না। হৃদয়টা নীল বেদনায় মুষড়ে পড়ে।
খানিক চুপ থেকে রুনা বললো ‘ তুমি যেভাবে বুঝেছ আমি সেভাবে বলিনি। ওটা বলার ভুল ছিল। আমার শুধু তোমার উপর রাগ আছে। তুমি আমাকে সময় দাও না। আমি বলছিনা তুমি আমার জন্য দোকানের কাজ ছেড়ে দাও। আমি শুধু চাই তুমি আমায় একটু সময় দাও, আমায় ভালোবাসো। আমি কখনো তোমার ভালোবাসায় প্রশ্ন তুলিনি কিন্তু আমি চাই তুমি তোমার ভালোবাসা প্রকা…. ‘
রুনা তার কথার সমাপ্তি দিতে পারলো না। তার আগেই সরাব ওকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরে ওর ঘাড়ে মুখ গুজে বললো ‘ আমায় ভুল বুঝিস না বুড়ি… আমি জানিনা আমি তোকে ভালবাসি কিনা। কিন্তু তুই আমায় ভুল বুঝলে আমার খুব কষ্ট হয়। বুকের বা পাশটা চিনচিনে ব্যাথা দুমড়ে মুচড়ে যায়। দয়া করে ভুল বুঝিস না। ‘
রুনা চমকিত, থমকিত এবং পরমুহূর্তে লজ্জা পেলো। সরাব তাকে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের মনের গোপন কথাও জানিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে তার কি বলা উচিত। রুনা ভেবে পেলো না। শুধু নিজেকে সরাবের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে শ্যাম দেহী সরাবের মুখটা হারিকেনের হলদে আলোয় দেখলো। তারপর সরাবের ললাটে চুমু খেয়ে বললো ‘ আমি তোমায় কখনও ভুল বুঝিনি। আমি জানিনা তুমি আমায় কত ভালোবাসো কিন্তু আমার নিজের ভালোবাসার উপর বিশ্বাস আছে। আমার ভালবাসা তোমায় কখনও আমাকে ভুলতে দিবে না। আমি তোমায় অর্ধ যুগ আগ হতে ভালোবাসি। যেদিন বুঝতে পেরেছি আমি তোমায় ভালোবাসি সেদিনের পর থেকে তোমায় আর সজ্ঞানে ভাইয়া বলে সম্বোধন করে ডাকিনি। কেন জানো ? ‘
সরাব মাথা নেড়ে না বললো। রুনা বললো ‘ কারণ ভালোবাসার মানুষটাকে কোনো নামে সম্বোধন করার ক্ষমতা আমার তখনও হয়নি। এখনও আমি তোমাকে কোনো নামে সম্বোধন করিনা। কেন করিনা জানিনা, শুধু কিছু না ডেকেই ডাকতে ভালো লাগে। ‘
সরাব হাসলো। আলগোছে জড়িয়ে ধরলো তার প্রেয়সীকে। শুধু জড়িয়েই ধরে রইলো। তার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। রুনার সঙ্গে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে মন চাইছে। যাকে ভালোবেসেছে তাকে ভালোবেসে আবারও কাছে পেতে মন চাইছে। চাওয়াটা কি বেশি কিছু ? কে জানে।
—-
ভোরের আলো সবে ফুটতে শুরু করেছে। চারদিকে এখনও কোলাহল জমে উঠেনি। শুধু শোনা যাচ্ছে পাখির কিচির মিচির। পূর্বাকাশে সূর্যের কমলাভা। হয়তো খানিক বাদেই পুরোপুরি দেখা মিলবে সূর্যের। জাদিদ দাড়িয়ে আছে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে। তাদের বাড়ির সামনে যেই বাড়ি তার পিছনে পরপর দুটো বাড়ি আছে। সেই দুটো বাড়ির পরেই এক খোলা মাঠ। ওই খোলা মাথা ছোটবেলায় সে আবির আর আনিসকে সঙ্গে করে আজাদ সাহেব এবং সাজ্জাদ সাহেবের সঙ্গে ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলত।
আজাদ সাহেবের সঙ্গে জাদিদের তেমন স্মৃতি নেই। যা ছিল ওই ছোটবেলা অব্দিই সীমাবদ্ধ। তারপর তো সে বড় হয়ে গেলো আর আজাদ সাহেব দিনেদিনে অসুস্থ হয়ে দূর্বল হয়ে পড়তে শুরু করলেন কিংবা বুড়ো বয়সে একটু আরামে কাটানোর জন্য কাজে মনযোগী হয়ে পড়লেন।
তবুও আজাদ সাহেবকে নিজের বাবার থেকেও বড় এক জায়গা দিয়েছিলো জাদিদ। কিন্তু মানুষটা এখন আর নেই।
সন্তান বেচেঁ থাকতে মাথার উপর থেকে বাবা নামক ছত্রছায়া হারিয়ে গেলে কেমন লাগে তা এখন ধারণা করতে পারছে জাদিদ। আজাদ সাহেব তো তার বাবার মতই একজন ছিলেন। তারই এমন অবস্থা হলে আবির, আনিসের কেমন অবস্থা কে জানে।
জাদিদ যখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে পুরনো স্মৃতি চারণ করতে ব্যস্ত তখন ওর পাশে এসে দাঁড়ালো আসফিয়া। জাদিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে বিশালাকার সেই মাঠের দিকে তাকিয়ে বললো ‘ আমরা মাঝে মাঝেই আবেগে পড়ে নিজেদের বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে ফেলি। যেই মানুষটাকে ভালোবাসি তার অনুপস্থিতি আমাদের কষ্ট দেয় বলে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে নিজেকে আরও কষ্ট দেই। কিন্তু এটা ভাবিনা এতে আমাদের কাছের মানুষটা আরও কষ্ট পাচ্ছেন। ‘
জাদিদ হেসে দিল আসফিয়ার কথায়। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলো। আসফিয়ার দিকে ফিরে বললো ‘ বুঝতে পেরেছি। ‘
‘ কি বুঝলে ? ‘ আসফিয়া জাদিদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো।
‘ এটাই যে যেই মেয়েকে বাচ্চা মেয়ে ভেবেছিলাম সে আসলে এক বুড়ি। আর এই বুড়িই এখন বুড়োকে জ্ঞান দিচ্ছে। ‘
‘ হুম বলেছে তোমাকে। আমি কোনো বুড়ি নই। ‘ আসফিয়া মুখ ভেংচিয়ে বললো।
‘ তাহলে কি ? ‘ জাদিদ ঠোঁট কামড়ে বললো।
‘ সেতো আমার থেকে ভালো যে প্রশ্নটা করেছে সেই জানে। সে বলুক আমি কি, আমি কার। সাহস আছে কি ? আমার মনে হয়না আছে। ‘
আসফিয়ার কথায় জাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো ‘ আমার সাহস নেই বলছো ? ‘
‘ বলছি বৈকি ‘
‘ আমার সাহস নেই ভাবলে আপনি ভুল ভাবছেন ম্যাডাম। এই জাদিদ হাসানের সাহস নেই এমনটা হতেই পারে না। সাহস আমাদের বংশের রক্তে আছে। ‘
‘ আমার বিশ্বাস হয় না। ‘
‘ তাই ? ‘
‘ হুম ‘
‘ তাহলে বিশ্বাস করাচ্ছি ‘ বলে জাদিদ আসফিয়ার দিকে এগোতে লাগলো। জাদিদের কাছ থেকে দূরে যাওয়ার জন্য যেই না পিছন ফিরলো ওমনি চোখ পড়ল সালমা ইসলামের উপর। সালমা ইসলামকে দেখে থমকে গেছে জাদিদ আর আসফিয়া দুজনেই। সালমা ইসলাম কখন এসেছেন দুজনের কেউই টের পায়নি।
সালমা ইসলামের মুখখানা থমথমে। কাল আজাদ সাহেবের জানাজা পড়ানোর সময় শাহিদা খাতুনের অসহায় মুখ দেখে তার মায়া হয়েছিল তাই তিনি এই বাড়িতে দুদিন থেকে জিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন জাদিদ আর আসফিয়াকে একসঙ্গে দেখে মনে হচ্ছে এই বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি মস্ত বড় ভুল করেছেন। রাগে তার শিরা উপশিরা কাপছে। তিনি থমথমে মুখে তাকিয়ে আছেন জাদিদ আর আসফিয়ার দিকে।
—-
খাবার টেবিলে সকলে একসঙ্গে সকালের নাস্তা খেতে বসেছেন। সালমা ইসলাম,জহির সাহেব এবং আসফিয়াও আছে। সালমা ইসলাম জানিয়েছেন জরুরি এক কাজে তাকে আজকেই ফিরতে হবে বাকিদের নিয়ে। যদিও জাহানারা উনাকে দুই একবার অনুরোধ করেছিলেন যদি কাজ সামলে থেকে যেতে পারেন। তবে তিনি জানিয়েছেন অফিসের কাজ ফেলে থেকে যাওয়া যাচ্ছে না। উনার এই একরোখা জবাবের পর তো আর কিছু বোকা যায়না। তাই কেউ আর তেমন অনুরোধ করেনি।
বেয়াইন হিসেবে শাহিদা খাতুনের সালমা ইসলামের সঙ্গে তেমন খাতির কখনোই ছিল না। কেন ছিল না কেউ জানেনা। তবে হয়তো দুই পক্ষ থেকে কেউই এগিয়ে আসেনি বলেই ছিল না। সেরকম আন্তরিক সম্পর্ক না থাকার দরুনই শাহিদা খাতুনও ছোট জাকে বলা সালমা ইসলামের কথা শুনে আর কিছু বলেননি।
কালকের থেকে আজকে সকলের চোখ,মুখের খানিকটা উন্নতি ঘটেছে। যদিও এখনও কেউ তেমনভাবে শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু কালকের মত ভয়াবহ পরিস্থিতি এখন আর নেই। খাওয়ার টেবিলে সকলে একসঙ্গে বসেই খাচ্ছেন। সবাইকে নাস্তা আফিফা আর জাহানারা দিচ্ছেন। রান্নাঘরে শাহিদা খাতুন রুটি ভাজছেন আর বিনী বসার ঘরে সোফায় বসে জুহারিনকে খাইয়ে দিচ্ছে।
জাদিদ খেতে আসেনি। তাকে ডাকা হয়েছিল কিন্তু সে পরে খাবে জানিয়েছে। এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না তাই কেউ আর এই ব্যাপারে জোরাজুরি করেনি। কিন্তু আসল কারণ কেউ জানে না। যদিও সালমা ইসলাম এবং আসফিয়া খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছেন কিন্তু কারোর মুখে রা নেই। সালমা ইসলাম খেতে খেতে মেয়েকে তীক্ষ্ণ নজরে দেখছেন।
খাওয়া দাওয়া শেষে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন জহির সাহেবরা। আবির নিজে বাড়ির গেট অব্দি এগিয়ে দিয়েছিলো। রওনা দেওয়ার পূর্বে জহির সাহেব আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘ জীবনে চলতে গেলে আমাদের সবাইকে আপনজনদের হারাতে হয়। তারমানে এই নয় কাছের মানুষদের অনুপস্থিতিতে আমাদের সবকিছু থেমে যাবে। জীবন গতিশীল, জীবনকে জীবনের মতো চলতে দাও আর নিজেকে সামলাও। আমি জানি তুমি বুঝদার, তোমাকে বলে দিতে হবে না তোমার করণীয় কি। নিজের খেয়াল রেখো আর আমার বিনী মাকে আগলে রেখো। আমি কি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি আবির ? ‘
উত্তরে আবির মলিন হেসে মাথা নেড়ে বলেছিল ‘ জি আব্বা, আমি জানি আমার কি করা উচিৎ। চিন্তা করবেন না, আমি নিজেকে খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে আগের জীবনে ফিরবো। ‘
আবিরের কথায় সস্তির নিশ্বাস ফেলে জহির সাহেব তার যক্ষের ধন,তার বড় মেয়ে বিনীকে সযত্নে আবিরের কাছে গচ্ছিত রেখে স্ত্রী আর ছোট মেয়েকে নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছিলেন।
পর্ব– ২০
———————
নিজেকে কাপুরুষ মনে হচ্ছে জাদিদের। এমন একজন পুরুষ যে প্রেমিকাকে রক্ষা করতে পারে না, যে ধরা খেয়ে মুখ লুকিয়ে রাখে। সকালে সালমা ইসলামকে দেখে ভয়েতে আর মুখোমুখি হওয়ার সাহস করতে পারেনি জাদিদ। সে জানে সালমা ইসলাম ওদের পরিবারের কাউকে পছন্দ করেন না কারণ ওরা যৌথ পরিবারে থাকে। আগেই তো আবিরের চাচাতো ভাই হওয়ায় পছন্দ করতেন না। এখন নিশ্চই সহ্যই করতে পারেন না ওকে।
জাদিদ বুঝতে পারছে না ওর কি করা উচিৎ। সালমা ইসলামের শীতল মুখখানা দেখে ওর প্রাণ উড়ে গেছিলো। অজানা এক কারণে সালমা ইসলামকে সে প্রথম দিন থেকে খানিকটা ভয় পায়। প্রথম দিন, যেদিন আবির আর বিনীর দিন ছিল। ঠিক এই কারণেই সে সালমা ইসলামের মুখোমুখি হতো না। অথচ শেষমেষ তার মেয়েকেই ভালোবেসে ফেললো।
জাদিদের এখন কি করা উচিৎ ? আসফিয়ার সঙ্গে কি কথা বলবে ? কিন্তু তার জন্য তো তাকে ওদের বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করতে হবে। যদি ভাগ্য সুপ্রসন্ন নাহয় আর ফোনটা সালমা ইসলাম ধরেন তাহলে ? তাহলেও কিছু করার নেই। এক্ষেত্রে তাহলে সে সালমা ইসলামের সঙ্গেই আগে কথা বলবে।
জাদিদ ঠিক করে নিল একবার অন্তত সালমা ইসলামের সঙ্গে কথা বলবে সে। যদি পারে তাকে বোঝাতে তাহলে তাই করবে। এভাবে বিনা চেষ্টায় তো হার মানা যায় না। হার মেনে নেওয়া তার ধাঁচে নেই। জাদিদ ঠিক করলো সবাই যখন দুপুরের দিকে নিজেদের ঘরে থাকবে তখনই সে আসফিয়াদের বাড়ি ফোন করবে। হোক না ভাগ্যের পরীক্ষা। দেখা যাক কে জিতে।
—-
শশব্দে গালে চড় পড়ার শব্দে বসার ঘর মুখরিত হলো। সালমা ইসলাম রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছেন আসফিয়ার দিকে। আসফিয়া ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগ। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ একজন তাকে ঠাসিয়ে মেরেছে। তবে আসফিয়ার সেদিকে খেয়াল নেই। তাকে দেখে মনে হচ্ছে মার খেয়ে তার মাঝে কোনো ভাবাবেগ ঘটেনি। সে যেন এই চড়ের জন্যই প্রস্তুত ছিল।
‘ তোর সাহস কি করে হলো ওই ছেলের সঙ্গে প্রেমে সম্পর্কে জড়ানোর ? তুই জানিস না ওই আবির আর ওর পরিবারের কাউকে আমি দু চোখে সহ্য করতে পারিনা। ‘
সালমা ইসলামের কথায় উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না আসফিয়া। সে শান্ত চোখে দেখছে সালমা ইসলামকে। তাকে নীরব দেখে আরও তেতে গেলেন সালমা। ওর চুলের মুঠি ধরে বললেন ‘ কি হলো উত্তর দিচ্ছিস না কেন ? আমাকে কি মানুষ মনে হয় না তোর ? এমন ভাব করছিস যেন আমাকে চোখেই পড়ে না তোর। সকালে ওই ছেলে আমাকে দেখে ঘাবড়ে গেল অথচ আমার মেয়ে হয়েও তুই শান্ত। আমাকে একটুও ভয় পাস না তাইনা ? ‘
হাসলো আসফিয়া। বিকট শব্দে হাসছে সে। মেয়েকে হাসতে দেখে সালমা ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। আসফিয়া হাসি থামিয়ে বললো ‘ তোমার মেয়ে বলেই তোমাকে ভয় পাইনা। তুমি যেই ভয়ের কথা বলছো তাকে আক্ষরিক অর্থে ভয় বললেও এই ভয় সন্তানদের চোখে তাদের মা বাবাকে সম্মানিত করে তুলে। কিন্তু তুমি যা শুরু করেছ তাতে তুমি আমার জীবন নষ্ট করেই ছাড়বে। আপার জীবন নষ্ট করতে পারোনি তাই এখন আমারটা নষ্ট করতে চাইছ। এরপরও কি তুমি তুমি স্বীকার করো যে তুমি মানুষ ? ‘
সালমা ইসলামের হাতের মুঠি আলগা হলো। তিনি আসফিয়ার চুল ছেড়ে দিলেন। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে বিস্মিত গলায় বললেন ‘ তুই আমাকে ঠিক কি প্রমাণ করতে চাইছিস ? পরিষ্কার করে বল। ‘
‘ পরিষ্কার করে বলার কিছু নেই মা। তুমি কি সেটা তুমি নিজেও জানো। আমার শুধু বাবার কথা ভেবে খারাপ লাগে। এত বছর ধরে শুধু তোমাকে ভালোবাসে বলে তোমার মতো মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষের সঙ্গে সংসার করে যাচ্ছে। তোমাকে ভালোবাসে বলেই নিজের সন্তানদের এত কষ্টে দেখেও কিছু বলতে পারে না। বাহিরের মানুষ বাবাকে কাপুরুষ বলে। কিন্তু তার এরকম হওয়ার পিছনে তোমার প্রতি তার ভালোবাসাই দায়ী। ‘
মেয়ে আর স্ত্রীয়ের এই বাকবিতণ্ডা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জহির সাহেব। এমনটা যে হবারই ছিল। সবকিছুরই এক সহ্য সীমা আছে। জহির সাহেব জানেন তার মেয়েরা তার মতো নয়। তিনি সালমা ইসলামকে যতটা ভালোবাসেন ততটা তার মেয়েরা নিজের মাকে ভালবাসেনা বলেই একদিন তারা প্রতিবাদ করতোই। কিংবা তাদের ভালোবাসাই এরকম যে মায়ের ভুল ধরিয়ে তাকে সঠিক পথে আনবে।
সালমা ইসলাম তার সংসার জীবনে শাশুড়ি আর ননদ, ননাসের সঙ্গে বিরূপ অভিজ্ঞতার কারণে প্রায়শই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। তাকে দেখে মনে হয়না তার মানসিক সমস্যা আছে কারণ তিনি কিছু ক্ষেত্রে বিরূপ আচরণ করেন যেটা সবসময় লক্ষণীয় নয়।
সালমা তার সাংসারিক অভিজ্ঞতার কারণেই এমন। মেয়েদের কখনও বাহিরের কারোর সঙ্গে মিশতে দেননি আর না নিজে তাদের সঙ্গে মিশেছেন। বিনী,আসফিয়া ওদের জীবনই ছিল স্কুল থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে স্কুল অব্দি। এর বাহিরে তাদের কোনো বান্ধবী ছিল না। বিনীর ক্ষেত্রে এই জিনিসটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ছিল। সালমা ইসলামের কঠোর নিষেধ ছিল সে যেন কোনো প্রেম নামক সম্পর্কে না জড়ায়। সেটা মেনেই বিনী কখনও এসবে জড়ায়নি।
তবে আসফিয়ার বেলায় ব্যাপারটা একটু শিথিলযোগ্য ছিল। আসফিয়াকে বান্ধবী নিয়ে স্কুল,কলেজ থেকে বাড়ি আসা পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছিলেন সালমা ইসলাম। কিন্তু শর্ত একটাই, আসফিয়া কখনও তার বান্ধবীদের বাড়ি যেতে পারবে না আর তাদেরও নিজের বাড়ি আনতে পারবে না। সেসব মেনেই জীবন স্বাভাবিক গতিতে চলছিল। কিন্তু মাঝ থেকে জাদিদ এসে তাদের জীবনের মোড় বদলে দিল।
আসফিয়ার কথায় সালমা ইসলাম বোধ করে আরও রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে আবারও আঘাত আনলেন মেয়ের উপর। এবার মারের দাপটে আসফিয়া মেঝেতে আছড়ে পড়লো। সেন্টার টেবিলের লেগে তার কপালে আঘাত লাগলো, গড়িয়ে পড়ল রক্ত। জহির সাহেব মেয়েকে দেখে ছুটে গেলেন। স্ত্রীয়ের উপর চেঁচিয়ে বললেন ‘ মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে তোমার ? কি পাগলামো শুরু করেছ তুমি ? ‘
‘ হ্যাঁ, আমার মাথা খারাপ। করছি আমি পাগলামি। এখন এই পাগলামির শেষও দেখবে তোমরা। ‘ বলে আসফিয়াকে জহির সাহেবের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলেন আসফিয়ার ঘরের দিকে।
সালমা ইসলামের এই পাগলামিতে এখন অতিষ্ট জহির সাহেব। সবকিছুরই এক সীমা আছে। সালমা ইসলাম এখন সেই সীমা পার করছেন। তিনি সালমা ইসলামের হাত ধরে বললেন ‘ কোথায় নিচ্ছ তুমি আফিকে ? ‘
‘ আমার হাত ছাড় জহির। না ছাড়লে… ‘
সালমা ইসলাম রাগের মুখে হুমকি দিলেন জহির সাহেবকে। জহির সাহেব আরও রেগে গেলেন। দাতে দাত চেপে বললেন ‘ নাহলে কি ? ‘
‘ আমার মরা মুখ দেখবে তুমি ‘
জহির সাহেব থমকালেন। আলগা হলো তার হাতের বাধন। সালমা ইসলাম হাত ছাড়িয়ে নিলেন তার কাছ থেকে। আসফিয়াকে আবারও টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিলেন সামনের দিকে। আটকে দিলেন ওকে ওর নিজের ঘরেই। বাহির থেকে দরজায় তালা দিয়ে বললেন ‘ বলেছিলি আমি আমার মাথার ঠিক নেই। এখন একজন মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষ কি করতে পারে সেটাও দেখবি তুই। ‘
সালমা ইসলাম বেরিয়ে গেলেন। বেরোনোর পূর্বে জহির সাহেবকে বলে গেলেন ‘ আজ এই দরজায় তালা দিলাম। আমার অনুমতি ব্যতীত এই দরজা এভাবেই থাকবে। আমার অনুপস্থিতিতে দরজা খোলা হলে ধরে নিবো কেউ আমাকে মৃত হিসেবে দেখতে চায়। ‘
সালমা ইসলাম প্রস্থান করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জহির সাহেব। বুঝতে পারছেন না তিনি কি হিসেবে ব্যর্থ। বাবা হিসেবে না স্বামী হিসেবে ? ভালোবেসে স্ত্রীকে সামলাতে পারছেন না আবার ভালোবাসার জন্যই স্ত্রীয়ের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচাতে পারছেন না। অথচ তিনি দুজনকেই ভালোবাসেন। কি হবে তার নিয়তি ? প্রিয়তমা না সন্তান ? কাকে বেছে নিবেন তিনি ?
জানালার ধারে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদঁছে আসফিয়া। সালমা ইসলামের কানে যাবে এই ভয়ে সে জোরে কাদতেও পারছে না। সে কিছুতেই তার দূর্বলতা সালমা ইসলামের সামনে প্রকাশ করবে না। আসফিয়া কখনোই শক্ত মনের মানুষ ছিল না। সে বিনীর মতো নয়। বিনী পেরেছিল সালমা ইসলামের কথার ভুল ধরে তাকে ভুল প্রমাণিত করতে কিন্তু সে কখনো তা করেনি। তার বরাবরই মায়া হতো সালমা ইসলামের জন্য।
সালমা ইসলাম তার সাংসারিক অভিজ্ঞতার জন্য যেই অমানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতেন তার জন্যই মায়া হতো আসফিয়া। তাই সে কোনওদিন তার মায়ের বিপরীতে কিছু বলেনি। কিন্তু আজ যে চুপ করে থাকা গেলো না। প্রশ্নটা তার জীবনের,তার ভালোবাসার মানুষটার। এখন চুপ করে গেলে যে ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলবে সে।
মা হলো এই নিঃসঙ্গ পৃথিবীর একমাত্র কাছের মানুষ যে আমাদের দশ মাস দশ দিন হাজার যন্ত্রণা, হাজার মানসিক অশান্তি, হাজার মুড সুইং সহ্য করেও জন্ম দেন। মাই একমাত্র মানুষ যে আমাদের মনের কথা মুখে আসার আগেই মাঝ পথে ধরে ফেলেন। অথচ এই মা নামক মানুষটাই যখন ভুল করে তখন মনে হয় পৃথিবীটাই বুঝি লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
সৃষ্টিকর্তার সেরা সৃষ্টি হলো মানুষ। মানুষ রূপে, গুনে,বিবেকে সবদিক দিয়ে সবার উপরে। কিন্তু এতকিছু থাকা সত্বেও তারা নিখুঁত নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউই নিখুঁত নয়। নিখুঁত হওয়াটা মানুষের ধাচে নেই। কথায় আছে ‘ Nobody is perfect rather than almighty God ‘। কথাটা ভুল নয়। মানুষ যদি নিখুঁতই হতো তাহলে সে আর মানুষ থাকতো না,হয়ে যেত ফেরেশতা।
আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি তখন আমরা তার ভালো,খারাপ দুটোকেই ভালোবাসি। এতকাল এটাই জেনে এসেছে আসফিয়া। এটা মেনেই সে এতকাল সালমা ইসলাম যে তার জন্মদাত্রী, তার করা ভুল থেকে শুরু করে তার ভালো কাজ সবকিছুকেই ভালোবেসেছে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে সে পারছে না। সে পারছে না সালমা ইসলামকে ভালোবাসতে।
মানুষ নিজ স্বার্থে অনেক কিছু করতে পারে। স্বার্থের প্রয়োজনে সে ভালোও বাসতে পারে আবার প্রয়োজনে ঘৃণাও করতে পারে। আসফিয়া এতকাল সালমা ইসলামকে ভালোবেসেছে স্বার্থের প্রয়োজনে কারণ তার ভালোবাসার মানুষ বলতে কেউ ছিলনা যার সঙ্গে মিল হওয়ার পথে সালমা ইসলাম বাধা হয়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু এখন আসফিয়ার এক নিজস্ব মানুষ আছে যাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে এবং সেই মানুষটাও তাকে ভালোবাসে।
মানুষটা একক পরিবারের হলে হয়তো সালমা ইসলাম কোনো ঝামেলাই করতেন না। কিন্তু বেছে বেছে সে যৌথ এক পরিবারেরই মানুষ যাকে সালমা ইসলাম ঘৃনা করেন। এখানেই লেগেছে আসফিয়ার স্বার্থে আঘাত। আর সেই আঘাতে জর্জরিত হয়ে সে হয়ে উঠলো আত্মকেন্দ্রিক যে শুধুই নিজের কথা ভাবে। নিজের কথা ভেবেই সে এখন আর পারছে না মা নামক মানুষটাকে ভালোবাসতে। এখানে দোষটা কার ? তার নাকি সালমা ইসলামের ? নাকি জাদিদের যাকে আসফিয়া তার সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে ?
—-
বসার ঘরে টেলিফোন বাজছে ক্রিং ক্রিং শব্দে। সালমা ইসলাম ঘরে ছিলেন। ফোনের শব্দে তিনি নিচে নেমে এলেন। ফোন কয়েকবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো। ফোনের কাছে এসে দাড়িয়ে ফোনের দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে রইলেন সালমা ইসলাম। টেলিফোন আবারও বেজে উঠতে এবার কানে ধরে বললেন ‘ কে বলছেন ? ‘
ফোনের ওপারে থাকা জাদিদ বুঝলো গলা সালমা ইসলামের। সে সালাম দিয়ে বললো ‘ আসসালামু আলাইকুম আন্টি,আমি জাদিদ। ‘
জাদিদের কথা শুনে সালমা ইসলামের মুখ থমথমে হয়ে উঠলো। তিনি রাশভারী কণ্ঠে বললেন ‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কিছু বলবে ? ‘
‘ জি আন্টি, আমার আসফিয়ার ব্যাপারে কিছু বলার ছিল। আমি আর আসফি…. ‘
জাদিদ তার কথার সমাপ্তি দেওয়ার সুযোগ পেলো না। সালমা ইসলাম গম্ভীর গলায় বলল ‘ তার আগে আমি কিছু কথা বলি। তুমি সেগুলো মন দিয়ে শোনো। ‘
সালমার কথা শুনে জাদিদ চুপসে গেল। সে জানে না সালমা ইসলাম কি বলবেন কিন্তু মন বলছে যা বলবেন তার কিছুই তার ভালো করবে না। বরং হয়তো তার আর আসফিয়ার সম্পর্ক ভাঙ্গা নিয়েই কিছু বলবেন। তবুও সে বললো ‘ জি আন্টি ‘।
‘ তুমি ছেলে মানুষ, বয়স অল্প তাই ভুল করেছ মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার বিশ্বাস নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে তুমিও বিচক্ষণ মানুষ। আসফিয়া বাচ্চা মানুষ। ওসব প্রেম ভালোবাসা সে বুঝে না তাই ওর মায়ায় জড়িয়ে লাভ নেই। তোমাদের সম্পর্ক আমি কখনো মেনে নিবো না তাই আজকের পর থেকে আর কখনও ওর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো না। এই শুক্রবারে ওর বিয়ে… ‘
—-
টুট টুট টুট…. শব্দে টেলিফোন কেটে গেলো সালমা ইসলামের। তিনি ফোন কান থেকে নামিয়ে একবার ফোনের দিকে তাকালেন। অতঃপর ফোন রেখে এগিয়ে গেলেন ঘরের দিকে। বান্ধবী সায়লার সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সায়লার ছেলে সাহেল পেশায় ম্যাজিস্ট্রেট। একে বান্ধবী পরিচিত তার উপরে শুধুমাত্র এক ছেলে আর স্বামীর সংসার তার। কাজেই এই পাত্র হাতছাড়া করা যায়না।
আজ বিকেলেই আসফিয়াকে দেখতে আসছেন সায়লা সুলতানা স্বামী,পুত্র সমেত। দেখেটেখে আংটি পরিয়ে রেখে যাবেন। তারপর এক সপ্তাহ পরে শুক্রবারে একবারে কবুল পড়িয়ে উঠিয়ে নিবেন।
সালমা ইসলাম ভাবলেন বড় মেয়ের বেলায় তো জাকজমোক করেই বিয়ে দিলেন কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। মেয়ে সেই যৌথ পরিবারে গিয়েই পড়লো। কাজেই এবার আর রাখঢাক করে বিয়ে দিবেন না ছোট মেয়ের। তাছাড়া অত মানুষ খাইয়ে বিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন কি। বিয়ের পর নাহয় নিজেরা একদিন সবাই মিলে একসাথে খাওয়া দাওয়া করবেন। বরং সেটা হলে একসঙ্গে বসে আড্ডা দেওয়া হবে।
—-
দরজা খোলার শব্দে চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে বসলো আসফিয়া। দরজা খুলে ঢুকেছেন সালমা ইসলাম। হাতে তার গোলাপি তাঁতের শাড়ি। শাড়িটা মেয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে সালমা বললেন ‘ দ্রুত শাড়ি পড়ে তৈরি হয়ে নে। তোকে সাহেল দেখতে আসছে। ‘
অপরিচিত এক যুবকের নাম সালমা ইসলামের মুখে শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেললো আসফিয়া। ওকে এমন করতে দেখে সালমা বললেন ‘ আমার বান্ধবীর ছেলে। ও ম্যাজিস্ট্রেট। ওর সঙ্গেই তোর বিয়ে ঠিক করেছি। ‘
বিয়ের কথা শুনে আসফিয়ার চোখ,মুখ শক্ত হয়ে গেলো। ও শক্ত গলায় বলল ‘ জাদিদের সঙ্গে কথা বলবো আমি। ‘
‘ প্রয়োজন নেই, আমি কথা বলে নিয়েছি। এও জানিয়েছি তোর সামনে বিয়ে যেন তোর জন্য দোয়া করে। ছেলে সবই শুনেছে। কিছু বলেনি। আর বলবেও বা কোন মুখে ? না আছে চাকরি আর না আছে কোনো ডিগ্রি। এখনও পড়াই শেষ হলো না ওর। হলে নাহয় তোকে ঘরে তুলতো। এসব নেই বলেই তো হার মেনে নিয়েছে। ‘
সালমা ইসলামের কথায় নির্বাক আসফিয়া। সে শুধুই পাথুরে মূর্তির মতো শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। মেয়েকে রাজি হতে দেখে সালমার মুখে হাসি ফুটলো। যাক কথাটা কাজে দিয়েছে। মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার জন্য এমন কত কথাই তো বলতে হয়। আসফিয়াকে তিনি পুরোপুরি সত্য বলেননি। জাদিদকে তিনি আসফিয়ার খবর জানিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সে কিছু বলেনি কথাটা একেবারেই ভুল।
বরং সে অনেক চেষ্টা করেছে সালমা ইসলামকে যেন আসফিয়াকে বিয়ে না দেওয়া হয়। কিন্তু এসব কি আর মেয়েকে বলা চলে ? বললে মেয়ে নিশ্চই তৈরি হতে রাজি হতো না। আর সেটা হলে তো হবে না। সালমা ইসলাম যেভাবেই হোক মেয়ের বিয়ে বান্ধবীর ছেলের সঙ্গে দিয়েই ছাড়বেন।
বুকে একরাশ অভিমান নিয়েই শাড়ি পড়ে তৈরি হলো আসফিয়া। তার বিয়ের কথা শুনে জাদিদ কিছুই বললো না। একবারের জন্যও অনুরোধ বলে তার মাকে বিয়ে দিতে বারণ করলো না ? এমনটা কি করে পারলো সে ? এরকম একটা কাজ করতে তার বুকে বাঁধলো না ?
বিভিন্ন রকমের মানসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া আসফিয়া আর বিবেক দিয়ে ভাবতে পারলো না যে তার বেয়াই সাহেব এমন একটা কথা কখনোই বলতে পারে না। অভিমানী মন নিয়েই সে রাজি হয়ে গেল বিয়েতে। শুরু হলো জহির সাহেবদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন। চলতে লাগলো আসফিয়ার বিয়ের কেনাকাটা।
এরই মাঝে সায়লা সুলতানা এসে স্বামী,পুত্র সমেত আসফিয়াকে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেছিলেন। তার মতে এই বয়সে মেয়েরা থাকে আগুন সুন্দরী। তাই এদের হাতছাড়া করতে নেই। তাছাড়া এমন অল্প বয়সী মেয়ে নিজের ছেলের জন্য আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবেন কি করে ? তাইতো দেখেই বিয়ের দিন ক্ষণ সব ঠিক করে ফেললেন।

———————
রুনার অনুরোধে সরাব আজ তাড়াতাড়ি কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরছে। রুনা বলে দিয়েছে আজ দ্রুত না ফিরলে তার খবর আছে। ইদানিং মেয়েটার মন মেজাজ ভালো থাকে না। কিছু হলেই মেজাজের বারোটা বেজে থাকে। এই কারণেই সরাব কিছুদিন আগে তাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো।
ডাক্তার জানিয়েছেন রুনার গর্ভাবস্থার তিন মাস চলমান। অথচ সরাব আর রুনা দুজনেই ভেবেছিল রুনার সবে কদিন আগে হয়েছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমান করে রুনার এখন তিন মাস চলমান। ডাক্তার সাহেব জানিয়েছেন গর্ভাবস্থায় একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম ঘটে। রুনার ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো একটু দেরীতে ধরা দিয়েছে।
সরাব হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলো রাস্তার ধারে এক বয়স্ক মানুষ বসে আছেন বালতিতে ফুল নিয়ে। সরাব এগিয়ে গেলো সেদিকে। বালতিতে সাজানো বেলি ফুলের মালা। সরাব সুধালো ‘ কাকা, বেলি ফুলের মালা কত করে ? ‘
‘ আব্বাজান, দশ টাকা কইরা। আপনি নেবেন ? প্যাকেট কইরা দিমুনি ? ‘
লোকটার কথায় মাথা নেড়ে হাসলো সরাব। লোকটা প্যাকেট মালা ঢুকিয়ে সরাবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ‘ আম্মাজান তো মেলা ভাগ্যবতী। আজকাল কেডাও আর ফুলের মালা লয় নাগো। এসবের আর মূল্য কই। যুগ আগাইসে… অহন সবাই লাব লেটার দেয়। ফুলের আর যুগ কই ? আম্মাজান তো বড্ড খুশি হইবো। কারোর প্রত্তম(প্রথম) পেরেম হতে পারা ভাগ্যের ব্যপার। ‘
লোকটার কথায় সরাব থমকালো। অসস্তি নিয়ে মেকি হেসে মালাটা হাতে নিলো। তারপর টাকা মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। লোকটা কি বললো ? কারোর প্রথম প্রেম হতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার ? তবে রুনা কেন তার প্রথম প্রেম হতে পারলো না ? কেন বিনীকেই তার ভালোবাসতে হলো ?
জগৎটা অদ্ভুত মায়ায় ঘেরা। যাকে আমরা চাই তাকেই পাইনা আর যাকে পেয়ে যাই সে আমাদের হয়ে রয়ে যায় চিরকাল। কিন্তু মানুষটাকে কি ঠকানো হচ্ছে না ? সেই তো দিনশেষে সরাবের প্রথম প্রেমে এখনও তার মনের এক কোণে খাপটি মেরে বসে আছে। যাকে সে পারেনি ভুলতে।
বিনী বড্ড ফুল প্রেমী ছিল। রোজ ফুল কুমারী সেজে ক্লাসে আসা যেন বরাদ্দ ছিল। সরাবের ধারণা বিনীর সবথেকে প্রিয় ফুল ছিল বেলি ফুল, যার মালা সে প্রায়ই বেণীতে জড়াতো। এই কারণেই সরাবও ওর জন্য প্রায়ই বেলি ফুলের মালা কিনে সেই মালা হাতে রাস্তার ধারে বিনীদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতো।
তারপর!! তারপর যখন বিনী তার দেখা পেত তখন সেই মালা বিনীদের লেটার বক্সে রেখে চলে যেত সে। এরপর বিনী সেই মালা জড়ানো বেণী দুলাতে দুলাতে সালমা ইসলামের হাজার নিষেধ অমান্য করে বাহিরে বেরিয়ে পড়তো পাড়া বেড়াতে। এর জন্য অবশ্য বিনীকে নিয়ে এলাকায় কম চর্চা হয়নি। কিন্তু বিনী ছিল বড়লোক বাবার বড় মেয়ে। তাই কাজেই কোনওদিন ওকে সরাসরি কেউ কিছু বলবার সাহস পায়নি।
অথচ যেই বিনীর জন্য একসময় সে বেলি ফুলের মালা আনতো আজ তার পরিবর্তে মালা নিচ্ছে তার স্ত্রীয়ের জন্য। আসলে সময় কতকিছুই না বলে। একদিন যেই মানুষটাকে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছিলো আজ তার জায়গা নিয়ে নিচ্ছে সপ্তদশী এক কিশোরী। কোথায় পঁচিশ বছর বয়সী বিনী আর কোথায় সপ্তদশী রুনা।
রুনার জন্য এই মালা নিলে যে ওর সঙ্গে অন্যায় করা হবে কারণ সরাবের নেওয়া সব বেলি ফুলের মালা যে বহু পূর্বেই বিনীর নামে উৎসর্গ করেছে সরাব। তাহলে যেচে এই ভুল কি করে করে সরাব ? আনমনে হাসলো সরাব। হাসতে হাসতেই সে এগোলো বাড়ির দিকে। তবে পথে ফেলে গেলো নিজ হাতে কেনা সেই বেলি ফুলের মালা।
বাড়িতে ঢুকেই সরাব দেখলো পাটি বিছিয়ে ভীষন আয়োজন করে কাদতে বসেছে রুনা। সরাব এবার ওকে কাদতে দেখে হাসলো। এসব নতুন কিছু নয়। বিগত তিন চারদিন যাবত এসবই চলছে। তার আসতে একটু দেরী হলেই রুনা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
সরাবের আসার কথা ছিল সাড়ে নয়টায়। কিন্তু সে একটু দেরী করে পনে দশটায় এসেছে। এই পনেরো মিনিট দেরি কেন হলো তার ? রুনা এই কারণেই কাদতে বসেছে। তার ধারণা সরাবের দোকানের নতুন যেই মেয়ে ঋতু, অর্থের অভাবে নিতান্তই বাধ্য হয়ে কাজ নিয়েছে সরাব কাজ ফেলে তাকেই দেখতে থাকে।
অবশ্য রুনাকে দোষও দেওয়া যায় না। দোষটা সরাবের নিজের। সে নিজেই অতি আবেগে আপ্লুত হয়ে তার দোকানে কাজ নেওয়া ঋতুর কথা বলেছে। এবং তারপরই টের পেয়েছে আর যাই হোক আবেগে আপ্লুত হয়ে স্ত্রীকে কোনো সহকর্মীর কথা বলা যাবে না। বউকে আরেক মেয়ের কথা বলা আর যেচে কুকুরের লেজ পা দেওয়া একই কথা কারণ বাঙালি মেয়েরা আর যাই হোক স্বামী বা প্রেমিকের ভাগ কাউকে দিতে চায়না।
রুনার গর্ভাবস্থায় একটু সাপোর্ট দেওয়ার জন্য সিরাত এসেছে। সিরাত আর রুনার মধ্যে তিন বছরের পার্থক্য মানে সিরাত রুনার তিন বছরের বড়। তবে বয়সে রুনা তার ছোট হলেও দুজনের মধ্যে মিলমিশটা ভালই। এমনকী রুনা যখন কেঁদেকেটে সরাবের নামে অভিযোগ তুলে তখন নূরজাহান আর সিরাত মিলে তাকে একলাই ধুয়ে দেয়।
সরাবকে ঢুকতে দেখে রুনা কান্নার বেগ আরও বাড়িয়ে দিল। এদিকে সিরাত অভিযোগ তুললো সে দেরি কেন করেছে। তখন সরাব হেসে বললো ‘ মাত্র পনেরো মিনিটই তো দেরি হয়েছে। ‘ রুনা তখন কেঁদে বললো তার পনেরো মিনিটই বা কেন দেরি হবে। ওর কথায় সরাব না পারতে হেসে দিল। তাতে রুনা আরও রেগে গেলো। সে ধুপধাপ পা ফেলে বাড়ির পিছন দিকে তক্তায় গিয়ে বসে পড়লো।
সরাবও আলতো হেসে সেই দিকে পা বাড়ালো। তার আফসোস নেই বিনীকে না পেয়ে। তার বদলে সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়েছে মিষ্টি এক অভিমানী মেয়ে যার অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতেই সরাবের পুরো জীবনটাই কেটে যাবে। প্রেয়সী যদি এত সহজ সরল মনের মিষ্টি একটা মেয়ে হয় তাহলে তার অন্তত কোনো আপত্তি নেই।
—-
বারান্দায় দাড়িয়ে রাতের হিমেল হাওয়া উপভোগ করছে জাদিদ। তার দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত, চুল উস্কখুস্ক আর পরনের কাপড় এলোমেলো। হাতে আধ খাওয়া সিগারেট। যেই জাদিদ কোনওদিন হাতে নেশা জাতীয় কিছু তুলেনি সে আজ প্রেম বিরহ ভুলতে হাতে তুলে নিয়েছে বিষাক্ত এক নেশা।
জাদিদ একদৃষ্টে সিগারেটখানা দেখছে। অবাক লাগছে, সিগারেটের নেশাও আসফিয়ার প্রতি তার ভালোবাসাকে ভুলাতে পারছে না। অথচ বন্ধু রায়হান তো বলেছিল সিগারেট সব দুঃখ,কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। তাহলে ধরা যায় আসফিয়ার প্রতি তার ভালোবাসা অবিস্মরণীয়। এক মন ভোলানো ভালোবাসা, যার প্রেমের টানে জাদিদ শুধু ভেসেই যাচ্ছে কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে আর সাঁতরে প্রেমের সাগর পার করতে পারছে না।
সন্ধ্যায় নাস্তার টেবিলে জাদিদকে হাজার ডেকেও যখন পেলেন মা তখন নিজেই নাস্তা প্লেটে সাজিয়ে ছেলের ঘরে আসলেন জাহানারা। এসে দেখলেন ঘরের অবস্থা বেহাল। মেঝেতে জামা কাপড় ছড়ানো, বিছানার চাদর প্রায় ভূলুণ্ঠিত। বইগুলো টেবিলে এলোমেলো ছড়ানো,ড্রেসিং টেবিলে পারফিউমের বোতল পড়ে আছে।
ঘরের এত বাজে অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জাহানারা। জাদিদ কখনোই এতটা অগোছালো ছিল না। হয়তো অত গুছিয়ে রাখে না সে তবে এতটা খারাপ অবস্থা তো তার ঘরের কোনোদিনই হয়না। তবে এখন কি হলো ছেলের কে জানে ? ঘর ছেড়ে তাকে বের হতেও দেখা যায় না। শুধু কোনোমতে ভার্সিটি গিয়ে ক্লাসটা করে এই যা।
নাস্তার প্লেট বিছানায় রেখে বারান্দার দিকে তাকালেন জাহানারা। বারান্দার দরজা খোলা। বারান্দার দরজায় লাগানো সফেদ পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। জাহানারা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। বারান্দায় ঢুকে ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলেন জাদিদ তাকে দেখেও হাতের সিগারেট ফেলেনি। খানিকটা ক্ষিপ্ত হলেন তিনি।
জাহানারা ক্ষিপ্র গলায় বললেন ‘ নিজের কি অবস্থা করেছো তুমি ? বাড়িতে তুমি সিগারেট খাচ্ছ, ঘর ছেড়ে বের হচ্ছো না। বাবা মা আদৌ বেচেঁ আছে না করে গেছে তার খেয়াল রাখছো না ব্যাপার কি ? তোমার হয়েছে টা কি ? ‘
জাহানারার কথায় শ্লেষের হাসি হাসলো জাদিদ। মাথা ঝেড়ে বললো ‘ আমি তোমার খবর রাখছি না বলছো ? তুমি অভিযোগ করছো মা ? ‘
জাহানারা অবাক হয়ে বললেন ‘ কেন আমি কি অভিযোগ করতে পারিনা ? ‘
জাদিদ মাথা নাড়িয়ে বললো ‘ পারবে না কেন ? অবশ্যই পারবে। তুমি আমার মা, তুমি তো অবশ্যই পারবে আমাকে অভিযোগ করতে। কিন্তু যেই মহিলা নিজ হাতে নিজের মেয়ের জীবন নষ্ট করেন তার সো কল্ড মেন্টালিটির জন্য সে কি আদৌ অভিযোগ করার অধিকার রাখে ? আসলেই কি তার কোনো অধিকার আছে অভিযোগ করার ? ‘
জাদিদের কথায় জাহানারা বিস্মিত নয়নে ওর দিকে তাকালেন। তিনি পিছিয়ে গেছেন দু কদম। স্রেফ হতবিহ্বল কণ্ঠে বললেন ‘ এসব কি বলছো তুমি ? আমি কার জীবন নষ্ট করেছি ? জাবিয়ার জীবন নষ্ট করেছি আমি ? ‘
জাদিদ মাথা নেড়ে সায় দিল জাহানারার কথায়। উনি চমকালেন এবং অবাক গলায় বললেন ‘ তোমার কেন মনে হলো আমি জাবিয়ার জীবন নষ্ট করেছি ? কি নেই ওর ? একক পরিবার আছে যেখানে কোনো ননদ, ননাসের ঝামেলা নেই। শাহরিয়ার টাকা আছে, আমার ভাইয়ের মতো শশুর আছে। আর কিসের কমতি তবে তার ? নাকি তোমার ভাষ্য মতে কোনো কিছুর কমতি আছে ? ‘
জাদিদ হাসলো। তার মায়ের চিন্তা ভাবনাও দেখি আসফিয়ার মায়ের মতো। সংসারে ননদ, ননাস থাকাও বুঝি ঝামেলা ? কে জানে, জাদিদ তো এসব কখনও শুনেনি। সে বলল ‘ আছে, কমতি আছে ওর। মানসিক শান্তির আর ভালোবাসার। তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু জানিনা ? আমি জানি আমার ছোট বোনটা তুষার নামের এক ছেলেকে ভালোবাসতো। কিন্তু তুমি চেয়েছিলে ওকে নিজের মন মতো বিয়ে দিতে যেখানে ছেলের টাকা পয়সা আছে আর কোনো ননদ, ননাস নেই।
আচ্ছা মা তুমি যে চাও তোমার মেয়ে যেন ননদ, ননাসের ঝামেলা না পোহায় তা আমার বেলায় কি চাইবে ? আমার সঙ্গে কি কোনো মা চাইবেন তার নাড়ি ছেড়া ধনকে বিয়ে দিতে যেখানে আমার বোন আছে। আমার বোনও তো আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রীয়ের ননদ হবে। তাহলে ? তোমার মত মায়েদের এই চিন্তা ধারার জন্যই আজ আমরা আপনজন থেকেও প্রিয়হারা। এরপরও তুমি বলছো তুমি কি করে জাবিয়ার জীবন নষ্ট করলে ?
তুমি তো নষ্ট করেছোই ওর জীবন ওর আনন্দ কেড়ে নিয়ে। এখন তোমার মতই এক মহিলা আমার জীবন, আমার প্রিয় মানুষটার জীবন নষ্ট করছেন আমাদের আলাদা করে দিয়ে। এরপরও তুমি আশা করো আমি তোমার খোঁজ নেবো ? তোমার কৃত কর্মের চেয়ে তোমার এক্সপেক্টেশন বেশি হয়ে গেলো না ? তুমি কি এত ভালোবাসা ডিজার্ভ করো যেখানে তুমি অন্যের ভালোবাসা কেড়ে নাও ? ‘
ছেলের কথায় বাক্য হারা জাহানারা। কিছু বলার ভাষা খুজে পেলেন। মা ভক্ত ছেলে যে এরকম বিষ বাক্য উগড়ে দিবে সেটা তার জানা ছিল না। অথচ এই ছেলেই নাকি বলতো তার জন্য লাল টুকটুকে বউ আনবে। কোথায় গেলো সেসব ভালোবাসা ? কোথায় গেলো মাকে দেওয়া সেসব প্রতিজ্ঞা ?
জাহানারা জানেন জাদিদের বলা প্রত্যেকটা কথা সত্য। তিনি আসলেই মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছেন। মেয়েকে নিজের পছন্দ মত বিয়ে দিয়ে, তার ইচ্ছার অবমূল্যায়ন করে তিনি তৈরি করেছেন নিজেদের মধ্যে দূরত্ব। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে যে ছেলেকেও হারাবেন জানা ছিল না। জাহানারা কেন পরিষ্কার দেখতে পারছেন তার ছেলে মেয়েরা হারিয়ে যাচ্ছে তার কাছ থেকে।
মেয়ের এই কদিনের ব্যবহারে পূর্বেই অনুতপ্ত ছিলেন জাহানারা। আজ ছেলের ব্যবহারে যেন অনুতাপের আগুনে পুড়তে শুরু করলেন। ছেলে মেয়েদের হারিয়ে ফেলার ভয় জেকে বসলো তার মনে। শুকনো ঢোক গিলে আরেকবার পর্যবেক্ষণ করলেন ছেলেকে। ছেলে রাখা এস্ট্রেতে অবশিষ্ট সিগারেট ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরালো।
—-
বারান্দায় একলা দাড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে বিনী। ঘরে আবির শুয়ে আছে। সে এসেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। দুদিন হলো সে আবারও হাসপাতাল যাওয়া শুরু করেছে। এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশিদিন চাকরি ছেড়ে ঘরে বসেও তো থাকা যাচ্ছে না। সেই ঘটনার তো আজ প্রায় পাঁচ দিন। আর সে হাসপাতালে যাচ্ছে বিগত দুই দিন থেকে।
আজাদ সাহেবের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পেরিয়েছে। তবুও যেন আগের মতোই শোকের শহরে ডুবে আছে বিনী। হয়তো আজাদ সাহেবের সঙ্গে সে সবথেকে কম সময় কাটিয়েছে। তবুও আজাদ সাহেব ছিলেন তার মনে জহির সাহেবেরই আরেক প্রতিচ্ছবি। বাবার মতো সেই মানুষটাকে যে কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। মানুষটার সঙ্গে কাটানো সব মুহূর্ত প্রতি নিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাকে।
আকাশ সাহেবের মৃত্যুর পর থেকে আবির আর বিনীর মাঝে যেন এক অদৃশ্য দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বলা বাহুল্য দূরত্বটা নিজের ঠিক অজান্তে বিনীই তৈরি করেছে। সে নিজেও জানে না সে কখন আবিরের কাছ হতে দূরে সরে গেছে। এখন তার প্রায়শ সময় কাটে শাহিদা খাতুন সঙ্গে গল্প করে, বসার ঘরে আজাদ সাহেবের চেয়ারের কাছে সোফায় বসে বিকেলে গল্পের বই পড়ে আর সময় সুযোগ পেলে বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে।
শাহিদা খাতুনকে প্রাণ ক্রমে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে বিনী। সে চায়না শাহিদা খাতুন কোনো একটা মুহূর্তও নিজেকে একলা মনে করেন। তার মতোই আফিফা আর জাহানারাও শাহিদা খাতুনকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখেন। তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন শাহিদা খাতুনকে একা ছাড়া মানেই তাকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দেয়া।
বারান্দায় একলা রাত্তির উপভোগ করতে ব্যস্ত বিনী টের পেলো এক জোড়া উষ্ণ হাত তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। বিনী ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিল মানুষটার বুকে। তার হাত দুটো আগলে ধরে বললো ‘ এমন কেন হয় আবির ? আমরা যাকে ভালোবাসি সেই হারিয়ে যায় ? আম্মার মুখ দেখেছো ? সারাদিন কেমন উদভ্রান্তের মতো থাকেন। তাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না আমার। আমি আমার পুরোনো আম্মাকে ফেরত চাই। কোথায় সেই আম্মা যে আমায় পারলেই ধমকে দিত। আজকাল সে আর আমার চুলে তেলও দিয়ে দেয় না। কোথায় গেলে ফিরে পাবো তাকে ? তাকে যে আমার বড্ড দরকার। ‘
বিনীর কথা শুনে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো আবির। বিনীর কথার বিপরীতে যুতসই উত্তর দিলো না। বরং বিনীকে আগলে ধরে বললো ‘ ঘরে চলো, রাত করে জাগা উচিত নয়। তুমি অসুস্থ হলে আম্মাকে দেখবে কে ? তোমাকে অসুস্থ দেখলে আম্মা আরও কষ্ট পাবে। ‘
বিনী জবাবে কিছু বলল না। সে জায়গা হতে নড়লোও না। বাধ্য হয়ে আবির তাকে আগলে ধরেই দাড়িয়ে রইলো। নিস্তব্ধ এই রজনী উপভোগ করছে তারা। তারা খচিত আকাশে আজাদ সাহেবকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বিনী। ছোটবেলায় দাদির মুখে শুনেছিল সে মানুষ মারা গেলে নাকি আকাশের তারা হয়ে যায়।
তবে কোথায় আজাদ সাহেব ? কোথায় তার কথায় কথায় আম্মা ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলা মানুষটা ? কেন মানুষটা তাদের একলা করে চলে গেলো ? বিনীর মনে যে অনেক প্রশ্ন। সেগুলোর উত্তর দিবে কে ? রোজ রোজ নতুন বই বের করে তাকে সঙ্গে নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে পড়বে কে ?

———————
পড়ন্ত বিকেল, কাকের কা কা শব্দে পরিবেশ মুখরিত। শাহিদা খাতুন সুপারী কাটা দিয়ে সুপারী কাটছেন। বিনী তারই ঘরে মেঝেতে কাপড় বিছিয়ে বসে সবজি কুটছে। আজ সে সন্ধ্যার নাস্তায় সবজি সমুচা করবে ভেবে রেখেছে। বিনী শাহিদা খাতুন সঙ্গে আছে বিধায় আফিফা আর জাহানারা নিশ্চিন্তে নিজের ঘরে গেছেন।
বিকেলের সময়টা বিনী শাহিদার ঘরেই কাটায়। আবির দুপুরে বাড়ি আসে না কাজেই তার ঘরে গিয়ে লাভ নেই। এর থেকে ভালো সে যদি শাহিদা খাতুনের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে কাজ করে তাহলে সময়টা কাজে দিবে। শাহিদা খাতুন সুপারী কাটতে কাটতে বললেন ‘ তোমার আব্বা ছিল শিকারী মানুষ। সুযোগ পাইলেই জঙ্গলে যাইতো। ‘
শাহিদা খাতুনের কথা শুনে বিনীর আগ্রহ হলো। সে তুমুল উত্তেজনা নিয়ে বললো ‘ কি কি শিকার করতেন আব্বা ? আপনি গেছেন কখনও তার সাথে ? ‘
‘ উনি শিকার করতেন অতিথি পাখি। আমি পারছি না তার সাথে যাইতে। সে নিবো আমারে ? সে নিত মৃন্ময়ীরে। মৃন্ময়ী তার শিকার করা দেখেছে। আমি তো ওর মুখ থেকা শুইনাই জানতে পারছি। ‘
‘ মৃন্ময়ী ‘ বিস্মিত গলায় বলল বিনী। এই নারীই নাম সে আগে শুনেনি।
শাহিদা খাতুন বললেন ‘ হ মৃন্ময়ী। তোমার আব্বার প্রত্তম বউ আর আমার সতীন। হে আছিলো তোমার আনিস ভাইজানের মা আর আমার ছোটবেলাকার সখি। ‘
এবার যেন রীতিমত বাজ ভাঙলো বিনীর মাথায়। সে অবাকের চরম পর্যায় গিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নিলো কারণ তার ধারণা বলছে এই কথা কেউ জানেনা। কাজেই সবাই জানলে ভাইয়েদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি হবে। সে মৃদু গলায় বললো ‘ আব্বার প্রথম বউ আর আপনার সতীন মানে ? আপনি আব্বার নিজের বউ ছিলেন না ? ‘
বিনীর বোকামো কথায় ধমকে উঠলেন শাহিদা। ধমকটা খানিক জোরে দিয়েই বললেন ‘ বউ আবার আপন পর হয় কেমনে ? বউ তো বউ হয়, আমি তার দ্বিতীয় বউ আছিলাম। আমার আগের ঘরে একখান বিয়া হইসিলো। কিন্তু হেই সংসার টিকে নাই তাই ছাইড়া দিসি। তারপর মৃন্ময়ী আনিসরে জন্ম দিয়া মরলো আর আমার ভাই,ভাবি তোমার আব্বা কাছে বিয়া বয়ায় দিলো। তোমার আব্বাও আমারে বাধ্য হইয়া বিয়া করছিলেন আর আমিও তারে বাধ্য হইয়া বিয়া করছিলাম। ‘
‘ তাহলে কি আম্মা আপনি আব্বাকে ভালোবাসেন না ? ‘ বিনীর তির্যক প্রশ্ন।
‘ বোকার মত কথা কইও না বউ। তোমার আব্বার লগে আমার বিয়াল্লিশ বছরের সংসার। তারে ভালো না বাইসা কি করে থাকুম ? এক ঘরে থাকতে থাকতে ভালবাসাডা হইয়া যায়। মায়া বইল্লাও একখান ব্যাপার আছে। ‘
শাহিদা খাতুনের কথায় সায় দিল বিনী। শাহিদা ভুল বলেননি। এক ঘরে থাকলে আসলেই মায়া তৈরি হয়ে যায়। যেমনটা তার হয়েছে আবিরের প্রতি। শাহিদা হাসতে হাসতে বললেন ‘ তবে তোমাগো আব্বার প্রত্তম আর শেষ প্রেম আছিলো মৃন্ময়ী। হেরে সে বড্ড ভালোবাসতো। এত সে আমারে ভালোবাসতে পারে নাই। ‘
বিনী লক্ষ্য করলো শাহিদা খাতুনের কথা শুনে তার জন্য মায়া হচ্ছে ওর। কারোর কাছ থেকে ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা না পাওয়া যে কতটা কষ্টের সে সে ভালই জানে। সে ভালোবেসেছিলো সরাবকে। কিন্তু নিয়তি তাদের এক হতে দেয়নি। তাই তো জীবন পথে তারা এখন দুজন দুদিকে।
‘ আচ্ছা আম্মা আপনার কষ্ট হয়না ? আপনি তো বললেন আব্বা মৃন্ময়ীকে বেশি ভালবাসতেন। ‘
‘ সম্মান দিয়া কথা কও বউ। হে তোমার সৎ শাশুড়ি হইলেও তোমার মা সমান। হেরে তুমি নাম ধইরা ডাকবার পারো না। ‘
বিনী বুঝলো শাহিদা রেগেছেন। তাই সে অপরাধী সুরে বলল ‘ ভুল হয়েছে আম্মা। ক্ষমা করবেন। আর এমন করবো না। ‘
‘ আমার কষ্ট!! ওটা প্রত্তম প্রত্তম হইতো না কারণ তারে আমি তখন ভালবাসতাম না। কিন্তু সময় যত বাড়লো কষ্টও তত বাড়লো। মনে হইলো বুকটা তখন পাষাণ ভারে নাইমা যায়। মৃন্ময়ী আমার যত ভালো সখিই হোক কিন্তু আছিলো তো হে আমার সতীনই। হেরে তোমার আব্বা এত ভালোবাসতো যে আমার হেরে হিংসা হইতো। ‘
বিনীর খারাপ লাগলো। শাহিদা নিজেকে বাহির থেকে যতটা শক্ত দেখান মনের দিক থেকে সে ঠিক ততটাই নরম। শুধু উপর থেকেই নিজেকে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করেন এই যা। যারা গম্ভীর ও চাপা স্বভাবের তারা ভেতর থেকে নিজেদের স্বভাবের প্রখরতার থেকেও বেশি দূর্বল হন।
‘ কিন্তু আমি মৃন্ময়ীরে ভালোও বাসতাম। হে আছিলো আমার সুখ দুঃখের সাথী। হের লেইগাই তোমাগো আব্বারে পাইসি আমি। তাই আমার কোনো আফসোস নাইগা। ‘
‘ আম্মা আপনি এখন আর আমার চুলে আগের মত তেল দিয়ে দেন না। আপনি তো জানেন চুলে আমি তেল দিতে পারিনা। ‘ শাহিদার কথা ঘুরাতে বিনী বললো।
‘ ঐ দেখ কি বলে। তো এই কথাখান স্বামীরে কইবার পারো না ? আমারে তো ঠিকই তেল দিয়া দিতে বলবার পারো। তাহলে হেইডা স্বামীরে বলতে সমস্যা কই ? ‘ শাহিদা খাতুন কপট রাগ দেখিয়ে বললেন।
‘ ওহ ব্যস্ত থাকে আম্মা। সেই সকালে যায় আর রাতে আসে। রাতে এসেও খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। ‘
শাহিদা উঠলেন সুপারী রেখে। সুপারীর বাটি একপাশে সরিয়ে রেখে তেল নিয়ে বসলেন। তাকে তেল নিয়ে বসতে দেখে বিনী উঠে গিয়ে শাহিদার পায়ের কাছে বসলো। শাহিদা চুলে তেল দিতে দিতে বললেন ‘ এমনে চললে হইবো ? স্বামী স্ত্রী এক লগে সময় না কাটাইলে কেমনে হইবো ? ভালোবাসা তো উইড়া যাইবো। তোমারে আমি কইতাছি। আমার মতো ভুল কইরো না। আবিররে বাইন্ধা রাখ নিজের লগে। যে একবার চইলা যায় হে আর ফিরা আয় না। ‘
কথাগুলো বলে এক নজর জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালেন শাহিদা। বারান্দার রেলিংয়ে এক হলদে কালো প্রজাপতি এসে বসেছেন। নিশ্চিত ধ্যানে বসে সেই প্রজাপতি। প্রজাপতির ঘরে আসা মানে ঘরে নতুন অতিথি আসা। কিন্তু কে সেই অতিথি ?
—-
বাড়ি ফিরে সরাব শুনতে পেলো রুনা তেতুলের আচার খাওয়ার জন্য জেদ ধরেছে। তবে নূরজাহান আর সিরাত ওকে বোঝাচ্ছে এত টক খেলে পেট ব্যাথা করবে। কিন্তু সে শুনলে তো। সরাবের আজ মেজাজের ঠিক নেই। দোকানে বিক্রি হচ্ছে না। দোকানের বিক্রি আকস্মিক কমে গেছে কারণ সরাবের দোকানের ঠিক সামনেই আরেকটা কাপড়ের দোকান বসেছে।
সরাবদের এলাকায় একমাত্র সরাবের দোকানটাই ছিল যেখানে ভালো মানের এক নাম্বার কাপড় পাওয়া যেত। কিন্তু এখন নতুন এক ভালো মানের দোকান গড়ে উঠায় লোকজন সেই নতুন দোকানে বেশি ভিড় করছে। কে জানে ব্যবসার অবস্থা ফিরবে কিনা ? এই নিয়েই সরাবের মন মেজাজের ঠিক নেই। তাই রুনাকে এমন জেদ করতে দেখে সে রেগে ধমকে উঠল। জোরে বলল ‘ যেটা বলছে সেটা শোন চুপচাপ। আমার মাথা গরম করাস না রুনা। এমনিতেই মেজাজের ঠিক নেই। বাড়াবাড়ি করলে খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। ‘
সরাবের ধমকে কেপে উঠলো রুনা। সিরাত ভাইয়ের ব্যবহারে হতভম্ব। তার আদো জীবনে সে সরাবকে এভাবে রাগতে দেখেনি। তার ভাই তো তার বাবার থেকেও ঠান্ডা মেজাজের ছিল। তাহলে রেগে গেলো হঠাৎ কি দেখে ? ছেলেকে আদরের মেয়ের উপর রাগারাগি করতে দেখে নূরজাহান রেগে গেলেন। রেগে কয়েক কথা শুনিয়েও দিলেন। কিন্তু সরাব সেসব গ্রাহ্য করলো না। সে ধীর পায়ে ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে দরজা দিয়ে দিলো।
রুনা বাক্য হারা সরাবের ধমকে। এর আগেও একদিন ধমক দিয়েছিলো সরাব তাকে। কিন্তু সেদিন এভাবে এতটা কর্কশ স্বরে কিছু বলেনি। সরাবের এরকম ব্যবহারের সাক্ষী হয়ে রুনার বেদনায় মুখটা কালো হয়ে গেলো। চোখ ভরে জল এলো। তবে রুনা সেই জল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে হাত ধুয়ে খেতে বসলো।
ভাতের সঙ্গে সঙ্গে কান্নাও গলাধঃকরণ করছে রুনা। ভাতের একটা দানাও সেচ্ছায় তার গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। তবে সে সবটা জোর করেই মুখে পুড়ছে। নিজের লুকোনো অশ্রুগুলো সে দেখাতে চায় না কাউকে। বিশেষ করে নূরজাহানকে তো একেবারেই নয়। তিনি দেখলেই কথাটা ছেলেকে বকতে বকতে অজান্তেই ছেলের কানে তুলবেন। তখন নিশ্চই সরাব ভাববে রুনা ছিচকাদুনে, দূর্বলতম এক নারী। মোটেই রুনা সেরকম মেয়ে নয়। সে নিজেকে সামলে নিতে জানে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করলো রুনা। হাতটা কল পাড়ে ধুয়ে সিরাতকে শুভ রাত্রি জানিয়ে ঘরে ঢুকলো সে। সরাব ভাত খেতে আসেনি। বলেছে সে নাকি বাহির থেকে খেয়ে এসেছে। এতে রুনার অভিমানের পারদ আরও গাঢ় হয়েছে। মানুষটা জানে রুনার শরীর এখন আর আগের মত নেই। তবুও রুনা তার জন্য খালি পেটে অপেক্ষা করে। কিন্তু সেই মানুষের মনে মায়া দয়া থাকলে তো। যখন ইচ্ছে করবে তখন ভালোবাসবে আর যখন ইচ্ছা করবে তখন খারাপ ব্যবহার করবে। রুনাকে যেন সে পুতুল পেয়েছে।
সরাব জানালার ধারে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছিল। মারাত্মক এই খারাপ সময়ে অযথা চিন্তা করে প্রেশার না বাড়িয়ে প্রকৃতি দেখাটাই উত্তম। শুধু শুধুই তখন রুনার উপর রাগটা দেখালো। ও তো জানে রুনার এখন শরীর ভালো নেই। থেকে থেকে এটা ওটা খেতে মন চায়। তাহলে এই অমূলক রাগারাগি করাটা বাড়াবাড়ি নয় কি ?
অথচ রুনার কাছে গিয়ে যে ক্ষমা চাইবে সেটাও ইচ্ছা করছে না সরাবের। ক্ষমা চাইলেই রাগারাগির কারণ কি জিজ্ঞেস করে হাজার প্রশ্ন করবে। এর থেকে থাকুক অভিমান করে। কাল ক্ষমা চেয়ে নিলে আর কি কারণে রেগেছিল সেটা জিজ্ঞেস করার কথা খেয়ালে থাকবে না রুনার।
এসব ভাবতে ভাবতেই সরাব পিছন দিকে ফিরল।
রুনা চুলে খোঁপা করে বিছানার দিকে এগোচ্ছিল। মেঝেতে বিছানো আছে এক পুরনো বছরের পাটি। হয়তো সরাব দোকানের হিসাব নিয়ে বসেছিল। সারাদিন দোকানে বসে হিসাব কষেও বাড়ি এসে তার আবারও পুনরায় হিসাব মিলাতে হয়। নয় তার শান্তি মিলে না। যেকোনো কাজ দুই তিনবার তার রোজই করতে হয়।
বেখেয়ালে হাঁটতে গিয়ে পাটির গায়ে লেগে রুনা হঠাৎই ভারসাম্য হারালো। আছড়ে পড়তে নিলো মেঝেতে। কিন্তু ভাগ্যিস সময় মতো সরাব তাকে আগলে নিয়েছিল। নাহলে তার সঙ্গে সঙ্গে আজ তাদের সন্তানও বিপদে পড়তো। বিপদের কথা ভেবে এখনও রুনার বুকটা ভয়ে ধকধক করছে। কি বিপদটাই না হতে যাচ্ছিল।
রুনাকে বেখেয়ালে হাঁটতে দেখে ধমকে উঠল সরাব। বললো ‘ মন কোথায় থাকে তোর ? নিজের প্রতি খেয়াল না রাখ বাচ্চার কথা তো ভাববি। মন কি পুকুর পাড়ে ফেলে এসেছিস ? যতসব বিরক্তিকর!! কি এক মুসিবতে পড়লাম। ‘
না চাইতেও আবার রেগে গেলো সরাব। রাগে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো বিরক্তিকর কিছু শব্দ। যা শুনে রুনা স্তব্ধ। সরাব তার প্রতি বিরক্ত। সরাবের তাকে নিয়ে কোনোই চিন্তা নেই। সে শুধু চিন্তিত নিজের সন্তানকে নিয়ে। কথাটা মেনে নিতে পারলো না রুনা। নীরব মূর্তির মতো এগিয়ে গিয়ে সরাবের পাশে দূরত্ব ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। সরাব তার পাশেই শুয়ে আছে সটান হয়ে। হাত তার কপালে।
সরাব বুঝতে পারছে মেজাজের খেই ধরে রাখতে পারছে না সে। সবকিছুই কেমন বিরক্তিকর লাগছে। আবার রুনার সঙ্গে রাগারাগি করেও মনের শান্তি মিলছে না। এতটা অধৈর্য্য আগে কখনো হয়নি সে। কিন্তু এত কষ্ট সে রুনা আর তাদের সন্তানের জন্যই তো করছে। তাদের জন্যই তো এত পরিশ্রম করা। অথচ মেয়েটা তাকে ভুল বুঝে বসে আছে।
অস্থির সরাব রুনাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু রুনা প্রতিক্রিয়া দেখালো না। নীরবে সে পড়ে রইলো। সরাব তার কোনো নড়াচড়া না পেয়ে আরেকটু নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। রুনার কানের লতিতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে হেসে চোখ বুজলো। আপাতত অভিমান ভাঙালো না বুড়ির। থাক সে অভিমান জমিয়ে। একবারে কাল ভাঙবে সেই অভিমান সে। কিন্তু কে জানত সে আর এই সুযোগই পাবে না প্রিয়তমার অভিমান ভাঙানোর।চঞ্চল প্রিয়তমা চুপ করে যাবে চিরকালের জন্য।
—-
সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ির উপর আছেন সালমা ইসলাম। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। কাজ কাম তো কম হবার নয়। তার উপর বিয়েটা বান্ধবীর ছেলের সঙ্গে। বান্ধবীকে দেখাতে তো হবে মেয়ের বিয়েতে তিনি কোনো কিছুর অভাব রাখেননি। মা হয়ে সন্তানের জন্য যা যা করা প্রয়োজন তার সবই করছেন তিনি।
সালমা ইসলাম আসফিয়ার বিয়ের কথা বিনীকে কালই জানিয়েছেন। শত যাই হোক বিনীও তো তার মেয়ে। বোনের বিয়ের খবর পাওয়ার অধিকার তারও আছে। তিনি ভেবেছিলেন বিনী হয়তো মেনে নিবে। এই বিশ্বাস মেয়ের উপর ছিল তার। তবে বিনী তাকে ভুল প্রমাণিত করেছে। বিনী আসফিয়ার বিয়ের কথা শুনে প্রথমেই জানতে চেয়েছে আসফিয়া রাজি কিনা।
সালমা যখন বললেন তার হ্যাঁতেই আসফিয়ার হ্যাঁ তখন বিনী সরাসরি বলল তবে সালমা ইসলাম যেন এটা আশা না করেন বিনী সেই বিয়েতে আসছে। সালমা ইসলামও এই ব্যাপারে আর কথা বাড়াননি। মেয়ের কাছ থেকে এমন ব্যবহার পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। বিনী তো বরাবরই তার কথার অবাধ্য হয়েছে কাজেই বিনীকে আসফিয়ার বিয়ের কথা জানিয়ে তিনি শুধু একজন মা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আসফিয়ার হাতে মেহেদি দিতে বাহির থেকে মেয়ে আনিয়েছেন সালমা ইসলাম। মেয়েটিকে বলে দিয়েছেন যেন আসফিয়ার হাতে সাহেলের নাম লিখে দেয়। মেয়েটি আসফিয়ার হাতে মেহেদি দিতে দিতে মাথা নেড়ে সায় দিল। এই ফাঁকে আসফিয়ার ঘর আরেকবার গুছিয়ে সালমা ইসলাম বেরিয়ে গেলেন।
লালিমা মাখানো হাতটা চোখের সামনে মেলে ধরেছে আসফিয়া। ফর্সা হাত দুটোর কনুই অব্দি মেহেদীর ছোঁয়া। বাম হাতের তালুতে জ্বলজ্বল করছে সাহেলের নাম। নামটা দেখে কোনো অনুভূতি হচ্ছে না আসফিয়ার। রাগ, দুঃখ,অভিমান কোনোটাই নয়। ভিতরটা অনুভূতিহীন এক রাজ্য লাগছে। অন্তঃসার শূন্য সেই রাজ্যে অনুভূতিদের প্রবেশাধিকার আপাতত নিষিদ্ধ।
—-
বারান্দায় দাড়িয়ে বিকেল বিলাস করছে জাদিদ। আকাশে তখনও বিকেলের সূর্য। আর কিছুক্ষণ!! তারপরই আসফিয়া হয়ে যাবে অন্য কারোর। সে সংসার বাঁধবে অন্য কারোর সঙ্গে। অথচ স্বপ্ন দেখেছিল সংসারটা তাদের দুজনেরই হবে। তবে ইচ্ছা কেন পূরণ হলো না ? আসফিয়ার সংসার করার স্বপ্ন তো পূরন হলো কিন্তু জাদিদের আসফিয়ার সঙ্গে সংসারের স্বপ্ন অধরা রয়ে গেলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো ‘ তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান ‘।

[**শেষ পর্ব**]
প্রিয় মা,
সন্তানের কাছে মা ঠিক কতটা আপন জানো ? ঠিক যতটা আপন হলে সাহস থাকার পরও মুখ ফুটে মায়ের অভিযোগগুলো ধরিয়ে দেয় না শুধুমাত্র মায়ের মনে কষ্ট হবে বলে। আমিও এতদিন এমনটাই করে এসেছি। তুমি সবসময় আমাকে নিজের মনমতো চালাতে চেয়েছ। আমার তাতে খারাপ লাগতো কারণ তুমি আমাকে খেলতে দিতে না, বাহিরেও যেতে দিতে না। কিন্তু তবুও আমি মেনে নিয়েছিলাম কারণ আমি তোমাকে ভালবাসতাম।
কিন্তু এখন আমার পক্ষে আর সম্ভব না তোমার এই অন্যায় আবদারটুকু মেনে নেওয়া। জাদিদ আমার ভালো লাগার, ভালোবাসার মানুষ। তাকে ভালোবেসে আমার পক্ষে অন্য কাউকে বিয়ে করা সম্ভব না। তোমাকে ভালোবেসে আমার আরেক ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে আমার পক্ষে অন্যায় করাও সম্ভব না। আমি তোমাকে যেমন ভালোবাসি তাকেও তো ভালোবাসি। তাই আমি চলে যাচ্ছি। আবারও ক্ষমা চাচ্ছি তোমার সম্মান নিয়ে খেলার জন্য। কিন্তু আমার যে কিছুই করার নেই। আমার যে তাকে সবকিছুর বিনিময়ে চাই।
ইতি,
তোমার অবাধ্য মেয়ে
চিঠি হাতে ধপ করে বসে পড়লেন সালমা ইসলাম। হলদে চিঠিখানা ভূ-লুণ্ঠিত হলো ততক্ষণে। সালমা ইসলাম তার কপাল চেপে ধরেছেন। হাত দুটো অসম্ভব কাপছে, মাথা যন্ত্রণা করছে। মেহমানদের উনি এখন কি জবাব দিবেন ? বাড়ি ভর্তি মেহমান। আর সায়লা!! তাকে কি জানাবেন ? বলবেন যে মেয়ে তার পালিয়ে গেছে ?
গাড়ির জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে আসফিয়া। বাহিরের স্তব্ধ প্রকৃতি এখন গতিশীল। শা শা গতিতে সব পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে তার গাড়ি। লম্বা লম্বা গাছগুলো দেখতে দেখতে আসফিয়ার অধর জুড়ে প্রশস্ত হাসি ছড়িয়ে পড়লো। আসফিয়া হেসে সেই গাড়ির সিটে শরীর এলিয়ে দিল।
আসফিয়াকে বাড়ি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বেরোতে আর গাড়িতে তুলে দিতে জহির সাহেবই সাহায্য করেছেন। তিনি চাননা তার স্ত্রীয়ের এই পাগলামোতে তার মেয়ে বলির পাঠা হোক। এতে যদি স্ত্রীয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হয় তো করবেন। তবুও মেয়ের জীবন নষ্ট হতে দিবেন না।
বাবা হয়ে সন্তানের কষ্টের কারণ হওয়া হয়তো জগতের মধ্যে সবথেকে ঘৃণিত কাজ। কারোর দেওয়া অভিশাপও এর চেয়ে শ্রেয়।
আসফিয়া চোখ বুজতেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো জাদিদের টোল পড়া ডাটিয়াল হাসি খানা। ছেলেটা ঠিক কত সুন্দর করেই হাসে তাইনা ? আসফিয়া জানেনা এই কটাদিন তার কতটা দুর্বিষহ ভাবে কেটেছে। প্রত্যেকটা মুহূর্ত গড়িয়েছে অজানা ভয়ে।
এখন থেকে জাদিদের সেই মন মাতানো হাসি আসফিয়া রোজ দেখতে পারবে। আর সেই হাসি হারানোর ভয় থাকবে না। আফসোস হবে না এই ভেবে যে আর দেখা হবে না সেই হাসি। ভাবতে ভাবতেই আসফিয়ার মনে পড়লো জহির সাহেব জাদিদকে ফোন করে তার বাড়ি থেকে পালিয়ে জাদিদের কাছে যাওয়ার কথাটা জানিয়েছেন। আচ্ছা এই কথা শুনে জাদিদের অভিব্যক্তি কি ছিল ? সে কি হেসেছিল নাকি প্রথমবার হবু শশুড়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভয়ে তার হাত পা কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছিলো।
আচ্ছা সে যাচ্ছে শুনে কি জাদিদ তাকে নিতে আসবে ? কোথায় এসে দাড়াবে সে ? আসফিয়ার আফসোস হলো এক খানা মুঠো ফোন কেন এখনও আবিষ্কার হলো না। বাংলাদেশ তো কত উন্নত হচ্ছে আস্তে আস্তে। তবে এখনও একটা মুঠো ফোন কেন আবিষ্কার করতে পারল না এই দেশের বিজ্ঞানীরা ? এমন বিজ্ঞানী থেকে লাভ কি যদি দেশের কাজেই না লাগতে পারে। এখন কি জাদিদের সঙ্গে বার্তালাপ চালানোর জন্য ওই পেট মোটা টেলিফোন তার শুদ্ধ বয়ে বেড়াতে হবে আসফিয়ার ?
জাদিদের সঙ্গে কল্পনায় লাল, নীল সংসার সাজাতে সাজাতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল আসফিয়া। ঘুম ভাঙলো রাশেদ আলীর ডাকে। আসফিয়া উঠে বসলে রাশেদ আলী বললেন ‘ আইয়া পড়ছি আম্মা। নামবেন নী আপনি অহন ? ‘
রাশেদ আলীর কথা শুনে আসফিয়া গাড়ির জানালা দিয়ে আশেপাশে তাকালো। বললো ‘ গাড়ি কোথায় দাড় করিয়েছ কাকা ? ‘
‘ ওই সের(স্যার) যেখানে কইছিলেন হেহানেই। বড় আম্মার শশুর বাড়ির গলির মোড়ের কাছেই। ‘
রাশেদ আলীর কথায় আসফিয়া গাড়ি থেকে নামতে নামতে বললো ‘ তাহলে এখন ফিরে যাও তুমি। বাবাকে জানিও আমি ঠিকঠাক পৌঁছে গেছি। সময় সুযোগ হলে টেলিফোন করবো। ‘
রাশেদ আলী আসফিয়ার কথার উত্তরে মাথা নেড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরতি পথে রওনা দিলেন। আসফিয়া কয়েক পলক দাড়িয়ে দেখলো ধুলোমলিন পথে রাশেদ আলীর গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। তারপর চোখে মুখে চিরচেনা হাসি টেনে এগোতে শুরু করলো।
আজ আসফিয়ার পরনে সালমা ইসলামের দেওয়া সবুজ রংয়ের শাড়িটা। সালমা ইসলাম এই শাড়িটা মূলত আসফিয়ার মেহেদীর অনুষ্ঠান করার জন্য কিনেছিলেন। কিন্তু বান্ধবী সায়লা জানালেন এত সব উৎসব করার সুযোগ নেই। বিয়ে উপলক্ষে হাজার কাজ পড়ে আছে। তাই ভদ্র মহিলা এক প্রকার বাধ্য হয়েই মেয়ের মেহেদীর অনুষ্ঠান করার ইচ্ছাটা বাদ দিলেন। তার অনেক শখ ছিল মেয়ে এই শাড়ি পড়বে। আসফিয়া ঠিকই পূরণ করেছে তার শখ কিন্তু সালমা ইসলাম আর এই শাড়ি জড়ানো আসফিয়াকে দেখেননি।
বিনীদের বাড়ির গলির মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে আসফিয়া অনেকক্ষণ হলো। কিন্তু জাদিদ এখনও আসছে না। আসফিয়া বারবার হাতের ঘড়ির ডায়ালে সময় দেখছে। এদিকে রিকশা ওয়ালা মামাও তাকে তাড়া দিচ্ছেন। রিকশা ওয়ালা মামাকে আসফিয়াই ঠিক করেছে। জাদিদ এলে এখান থেকে ওরা সোজা কাজী অফিসে যাবে। তারপর বিয়ে করে তবেই ফিরবে।
‘ আর কতক্ষন লাগবো আপা ? আপনি যার লেইগা অপেক্ষা করতাছেন হে কি আদৌ আইবো ? ‘
রিকশা ওয়ালা মামার কথায় আসফিয়ার মাঝে অভিব্যক্তি দেখা গেলো না। সে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছে জাদিদের জন্য। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে জাদিদ এলে ওকে শুনিয়ে দিবে দু চার কথা। বিয়ের আগেই টাইমিং নিয়ে এত কাহিনী করছে। বিয়ের পর নিশ্চই ওকে জালিয়ে মারবে। না এর জন্য তো ছেড়ে দিলে হয় না। কথা তো শুনতেই হবে মশাইকে।
কিন্তু আসফিয়ার এত এত পরিকল্পনা অচিরেই খেই হারালো যখন আসফিয়া দূর থেকে উস্কখুস্ক চুলে এগিয়ে আসা জাদিদকে দেখলো। জাদিদের পরনে অফ হোয়াইট শার্ট আর ব্লু জিন্স। চুলগুলো এলোমেলো আর দৃষ্টি মলিন। যেই দৃষ্টিতে কিছু মাস আগেও আসফিয়া সৌন্দর্যের প্রখরতা দেখেছিল সেই দৃষ্টিই আজ মলিন।
জাদিদের দেখা পেলে কতকিছু বলবে ভেবে মনে মনে গুছিয়ে রেখেছিল আসফিয়া। তবে কিছুই আর বলা হলো না। সৌন্দর্যের প্রতীক জাদিদ হাসানকে মলিন রুপে দেখেও তার অবাধ্য মনটা যেন আবারও সেই জাদিদের প্রেমেই পড়েছে। বাধ্য ঠোঁট জোড়া আজ অবাধ্য হচ্ছে। চোখগুলো বেহায়া হয়ে উঠছে। আসফিয়া স্রেফ অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
এতদিন পর ভালোবাসার মানুষটাকে দেখে কিয়ৎপল আঁখি জুড়িয়ে দেখে নিলো জাদিদও। তারপর আসফিয়াকে এহেন নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকতে দেখে হেসে বললো ‘ যাবে না ? ‘
জাদিদের কথায় হুশ হলো আসফিয়ার। নিজেকে নিজের এই নির্বুদ্ধিতার জন্য অদৃশ্য এক চপেটাঘাত করে হড়বড় করে বলল ‘ হ্যাঁ যাবো তো। ‘
তারপর!! তারপর তারা দুজনে চেপে বসলো আসফিয়ার ঠিক করা রিকশায়। কাছাকাছি, ঘেঁষাঘেঁষি করে। এতটাই কাছাকাছি যে দুজনে নিজেদের নিশ্বাস গুনতে পারছে। জাদিদ খানিকটা আরও এগিয়ে এলো। পিছন থেকে আসফিয়ার ব্লাউজের খোলা অংশের জায়গাটা শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দিয়ে ঢেকে দিল। তারপর আসফিয়াকে এক হাতে আগলে নিয়ে আসফিয়ার হাতে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বললো ‘ আমার আফি ‘
—-
কাজের চাপে আজ দুপুরে বাড়ি খেতে আসতে পারেনি সরাব। দোকানের বিক্রি ভালো নাহলেও ইচ্ছা করেই সে বেশিক্ষন দোকানে বসেছে যাতে বিক্রিটা একটু বাড়ে। নিস্তব্ধ দুপুরে যখন সব দোকান পাট বন্ধ তখন একমাত্র তার দোকান খোলা থাকলে দুপুরের ক্রেতারা তার থেকেই মালামাল নিবে। তাই দোকানটা সে তখন আর বন্ধ করেনি। বরং সাথের ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই বসেছিল দোকানে। এতে অবশ্য লাভই হয়েছে। খানিকটা বিক্রি হয়েছে।
আকাশে মেঘ করছে। মনে হয় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে। আকাশের তাহলে মন খারাপ। কিন্তু
বিক্রি হওয়ার খুশিতে সরাব এখন সব কাজ মিটিয়ে একবারে ফিরছে। আকাশের মন খারাপ কিন্তু তার তো মন ভালো। আজ আর সে দোকানে বসবে না। সবটা সিরাজকে দিয়ে সামলে নিবে। বাড়ি ফিরে সময় দিবে রুনাকে। রুনার অভিমানও তো ভাঙানো প্রয়োজন। তাই অভিমানী প্রিয়ার জন্যই বাড়ি ফিরতে পথে সে বকুল ফুলের মালা কিনে নিলো। বেলি ফুলের মালা নাহয় নিতে পারবে না কিন্তু বকুল ফুলের মালা তো আর নিতে বারণ নেই।
সরাব বাড়ি ফেরার পর সিরাত এসে দরজা খুলে দিল। আজ সিরাতকে দরজা খুলতে দেখে অবাক হলো সরাব। মেয়েটা বুঝি এতটাই অভিমান করেছে যে নিজে এসে দরজাখানাও খুলল না। প্রিয়তমার রাগের পারদ আন্দাজ করতে পেরে সিরাতকে সুধালো সরাব ‘ রুনা কি করছে রে ? ‘
সিরাত বলল ‘ এখন জিজ্ঞেস করছো ? যাও ঘরে গিয়ে দেখো। তোমার বউ এখনও তোমার উপর রাগ করে আছে। দুপুরে খেয়ে বলেছিল তুমি আসলেও যেন ওকে ডাক না দেই। ভেবে দেখো কত রেগে আছে তোমার উপর। ‘
‘ আমার বউ রেগেছে!! রাগটা আমিই ভাঙাবো। তুই ভাত বাড়। দেখে আসি ওকে। ‘ বলে হাসতে হাসতে নিজের ঘরে ঢুকলো সরাব।
ঘরে ঢুকে সরাব দেখলো রুনা অন্য পাশ ফিরে শুয়ে আছে। যাহ বাবা, মেয়েটার এত রাগ যে তার দিকে ফিরলোও না। এই রাগ তো ভাঙ্গানো লাগে। সরাব হাতে ফুলের মালাটা নিয়ে খাটের অন্য পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। খোলা জানালা দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুর ঘরে উকিঝুকি মারছে। এতক্ষণ এই রোদের আলো রুনার চোখে মুখে পড়ছিল। ওর সামনে দাঁড়ানোতে সরাবের গায়ে পড়ছে এবার।
সরাব দেখলো রুনা বালিশে মাথা রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তার সুন্দর কাজল চোখ দুটো দিয়ে। সেই চাহনী বড্ড নিরীহ আর শান্ত। সরাব হাসলো ওকে দেখে। বললো ‘ এখনও রেগে আছিস ? কাছেও আসতে দিবি না আমাকে ? আমার বাচ্চাটাকেও দেখতে দিবি না ? ‘
সরাব ভেবেছিল রুনা বলবে ‘ হ্যাঁ ও শুধু তোমারই বাচ্চা তাইনা ? আমার কিছু না। ও আসার আগেই আমার ভাগের ভালোবাসা সব ওকে দিয়ে দিচ্ছ। ও আসলে তো মনে হয় আমাকে দেখবেও না। ‘
কিন্তু সরাবকে অবাক করে দিয়ে রুনা কিছুই বললো না। তখনও শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে সে। সরাব ভাবলো হয়তো কাল রাতে ওভাবে রাগারাগি করাতে একটু বেশিই রেগে আছে। তাই রাগ ভাঙাতে ও এগিয়ে গিয়ে রুনার কাছে বসলো। রুনা তখনও খাটের অন্য প্রান্তে তার দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। সরাব ওর হাতে হাত রাখলো।
রুনার হাতে হাত রাখতেই ছিটকে দূরে সরে গেলো সরাব। তার ধরা রুনার হাতটা বিছানায় ঢলে পড়েছে। সরাবের মনে হলো সে যেন নিথর কোনো এক দেহকে মাত্র ছুঁয়ে দিয়েছে। রুনার পুরো শরীর ঠাণ্ডা। চাহনি নির্জীব আর চোখের কার্নিশে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু। সেই অশ্রু চোখে নিয়েই সে নির্জীব হয়ে তাকিয়ে আছে সরাবের দিকে। বড্ড শান্ত সেই চাহনী। রুনার এই শান্ত চোখের চাহনি সরাবের সহ্য হচ্ছে না। বুকে কাঁটার মত বিধছে যেন।
রুনাকে ওভাবে নির্জীব চোখে শুয়ে থাকতে দেখে সহ্য করতে পারছে না সরাব। সিরাতকে চেঁচিয়ে ডেকে ছুটে গেছে রুনার কাছে। রুনাকে নিজের বুকে নিয়ে অনবরত ওর গালে চাপড়ে ডাকতে লাগলো কিন্তু আফসোস রুনার আজ কোনো কথা নেই। সে পাষাণী এক নারী। সরাবের ডাকে সিরাত এবং নূরজাহান ছুটে এলেন। নূরজাহান ঘুমোচ্ছিলেন কিন্তু সরাব এমন ভাবে আর্তনাদ করে ডেকেছে যে উনি আর ঘুমিয়ে থাকতে পারেননি।
সরাব তখনও হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে রুনাকে আকড়ে ধরে। সিরাত আর নূরজাহান সরাবের ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন। ঢুকে রুনাকে সরাবের কোলে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখে দু কদম পিছিয়ে গেলেন তিনি আতঙ্কে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন রুনা বলে। রুনার নিথর দেহ দেখে কষ্টে পাথর সিরাত। আজ সকাল অব্দিও ওরা দুজনে বলাবলি করছিলো ছেলে হলে কি নাম রাখবে আর মেয়ে হলে কি রাখবে। অথচ এই কয় ঘণ্টার তফাতে আস্ত মানুষটাই নাই হয়ে গেলো।
সরাব প্রিয়তমার পুরো মুখে অগণিত চুমু খেতে খেতে বললো ‘ এমন করিস না রুনা। আমায় ছেড়ে যাস না। আমার উপর তোর এত রাগ ? রাগ করে থাকিস না জান। আমি প্রমিজ করছি আর কখনো তোকে বকবো না। দয়া করে আমাকে এভাবে একলা করে যাসনা। আমার কাছ থেকে নিজেকে আর আমার সন্তানকে কেড়ে নিস না। তুই না থাকলে আমি মরে যাবো রুনা…. ‘
কিন্তু সরাবের সেই আর্তনাদ আজ আর রুনার কানে গেলো না। সে পাথুরে মূর্তির মতো নির্জীব হয়ে তাকিয়ে রইল তার প্রিয়তমর দিকে। কে বলবে এই মানুষটাকেই সে তার সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে। এর সঙ্গেই সে হাজার পাগলামি করেছে। এর জন্যই হাজার কেঁদেছে। অথচ আজ মানুষটার এক ফোঁটা আর্তনাদও তার মনের ঘরে তৈরি হওয়া শক্ত দেওয়ালে ফাটল ধরাতে পারছে না। মানুষটা তার জন্য কাদছে, তার কাছে মিনতি করছে কিন্তু পাষাণ সে সেই মিনতি গ্রাহ্য করছে না। নারী মন বুঝি এমনই পাষাণ হয়। তারা বুঝি পারে এভাবেই অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে।
একসময় সরাব শান্ত হয়ে এলো। থেমে গেলো তার আর্তনাদ। সে শান্ত হয়ে রুনার পানে চেয়ে রইলো। রুনা এখন খাটিয়ার উপর শুয়ে নিশ্চিন্তে চোখ দুটো বুজেছে। তার গা দিয়ে আসছে সুগন্ধির আতরের সুঘ্রাণ। সরাব বাতাসের গায়ে নিশ্বাস টেনে শেষবারের মতো প্রিয়তমার কপালে চুমু খেল। ভাবলো প্রকৃতি তার প্রতিশোধটা কি দারুন ভাবেই না নিলো। ওর কাছ থেকে আবারও কেড়ে নিলো ভালোবাসার মানুষটাকে। আচ্ছা ভালোবাসা বুঝি এতটাই খারাপ ? কারোর সবটা কেড়ে নেয় তো কাউকে সুদ সমেত ফিরিয়ে দেয়। আচ্ছা সবাইই তো ভালোবাসে নিজের সবটা দিয়ে। তবে কেন একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম ভালোবাসার রূপ ?
—-
আবিরের টেলিফোন পেয়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই বেরিয়ে এসেছে বিনী। সে তখন শাহিদা খাতুনের সঙ্গে বসে গল্প করছিলো। তখনই শুনতে পেলো বসার ঘরে টেলিফোন বাজার শব্দ। সে শাহিদা খাতুনকে বসতে বলে নিজে উঠে গেলো। টেলিফোন কানে ধরতেই আবির বললো শাহিদা খাতুনকে জানিয়ে বাহিরে বের হতে। বিনী কয়েকবার কারণ জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু আবির উত্তর দেয়নি। বাধ্য হয়েই শাহিদা খাতুনকে জানিয়ে সে বেরিয়ে পড়লো।
বিনী হাঁটতে হাঁটতে গলির মোড়ে এসে দাঁড়ালো। দেখলো সেখানে আগে থেকেই সাইকেল হাতে দাড়িয়ে আছে আবির। ও এগিয়ে গিয়ে বলল ‘ হঠাৎ বের হতে বললে কেন ? কারণ কি ? ‘
‘ একটা মাত্র বউ অথচ কাছেই আসতে চায় না। আমারও দোষ আছে। ঘুরতে নিয়ে যাই না বলে হয়তো অভিমান করেছে। তাই ভাবলাম একটু নিয়ে বেরোই। ‘
আবিরের কথা শুনে বিনী ওর দিকে সরু চোখে তাকালো। আবির বিনীর সেই দৃষ্টি গ্রাহ্য করলো না। না দেখার ভান করেই ধীর পায়ে সাইকেল ঠেলে এগোতে লাগলো। বিনী ওকে হাঁটতে দেখে নিজেও এগিয়ে গেলো। ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বললো ‘ সাইকেলটা কার ? তোমার সাইকেল আছে জানতাম নাতো। দেখে মনে হচ্ছে অনেক পুরনো সাইকেল। ‘
আবির মাথা নেড়ে বলল ‘ উহু আমার নয়। আমার এক বন্ধুর। সাইকেলের গ্যারেজে কাজ করে ও। ওখানে সাইকেলও ভাড়া দেওয়া হয়। তাই ওর থেকে ভাড়া দিয়ে এনেছি। ‘
বিনী খানিকটা অবাক হলো। ভাবলো আবির সাইকেল কিনতে পারবে না এমন তো নয়। বরং এমন আরও দশটা পাঁচটা সাইকেল কেনার ক্ষমতা আছে ওর। তবে!!!
বিনীকে চুপ থাকতে দেখে আবির বললো ‘ ভাবছো সাইকেল না কিনে ভাড়া কেন নিলাম তাইতো ? ‘ বিনী ওর কথা শুনে ওর দিকে এক পলক নজর দিল। আবির আলতো হেসে মলিন কণ্ঠে বলল ‘ আমরা বড়লোক মানুষ। উঠতে বসতে রাজার হালে চলি। চলা ফেরা দামী গাড়িতে করি। কাছের মানুষদের মৃত্যুতে শোকও পালন করি ঘটা করে। আয়োজন করে চল্লিশা হয়, অনেক লোকজন নিয়ে জানাজাও হয়। আমাদের দুঃখ হলে সকলে কষ্ট না পেলেও মিথ্যে সান্তনা দেয়।
কিন্তু এই পৃথিবীতে এমন এক শ্রেণীর মানুষ আছে যাদের রাত্রি যাপন হয় মলিন কাথায় শুয়ে। বেলা পেরোয় আধ প্লেট ভাত খেয়ে আর কাছের কারোর মৃত্যু হলে দিন গড়াতে না গড়াতেই নেমে পড়তে হয় জীবিকা নির্বাহের কাজে। ওরা মধ্যবিত্ত। ওদের একটাই কষ্ট, যে ভাবেই হোক ভাত রুজি করতে হবে। ওদের ধ্যান জ্ঞানই ওটা।
অথচ আমাদের দেখো। কেউ কিছু বললে মন খারাপ, কোনো কিছু কিনতে ইচ্ছা করলো কিন্তু সেটা কেনা সম্ভব না তখনও মন খারাপ, কারোর মৃত্যু হলো তখনও মন খারাপ। ঘটা করে চল্লিশা করলাম নিজের মন খারাপ দেখাতে। আবার দান সদকাও করলাম সেই একই কারণে।
আমাদের এত রুজি, এত ক্ষমতা তবুও পান থেকে চুন খসলেই মন খারাপ হয়ে যায়। তার থেকে আমাদের তুলনায় মধ্যবিত্তরা বেশি খুশি। ওদের একটা জিনিষ নিয়েই মন খারাপ, কেন ভালো কিছু খেতে পায় না, একটু ভালো থাকতে পারেনা। আর আমাদের!! আমাদের উঠতে বসতে অভিযোগ। তাহলে বেশি সুখে কে আছে ? ‘
বিনী এক মনে আবিরের কথা শুনলো। এমন করে সে আগে ভাবেনি। আসলেই তো তাদের থেকে মধ্যবিত্তরা বেশী সুখী। তাদের একটাই চাওয়া। অথচ আমাদের চাওয়া পাওয়ার শেষ নেই। আসলে মানুষ যত উপরের দিকে উঠে তার চাওয়া তত বৃদ্ধি পায়। বিনীর ভাবনার মাঝেই আবির আবারও বলতে শুরু করলো।
‘ ইচ্ছে ছিল আমাদের ঘরটা হবে টিন শেডের। যেখানে দুপুরে অনেক গরম তো পড়বে কিন্তু রাতটা হয়ে উঠবে শীতলতম এক রাত্রি। তখন সেই শীতল ঘরে তোমায় নিয়ে শুয়ে শুয়ে সুখ দুঃখের গল্প করবো। কষ্ট একটাই, রুটি কামাই করতে হবে।
এছাড়া থাকবে না আর কোনো চাওয়া পাওয়া, থাকবে না কোনো অভিযোগ, থাকবে না কোনো শখ আহ্লাদ, থাকবে না কোনোকিছু হারানোর ভয়। এমন একটা জীবন আমারও পাওনা ছিল কিন্তু পাওয়া হলো না। হলো না মলিন কাথায় শুয়ে তোমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখা।
স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি আমার। হয়তো কোনওদিন এই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভবও না কারণ একবার যে বিরিয়ানির স্বাদ পেয়েছে সে আর ফিরে গিয়ে আলু ভর্তার কাছে যাবে না। এখন এমন স্বপ্ন দেখা আমার জন্য বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর মতোই। এই বুলি আওড়াতে তো পারবো কিন্তু সুযোগ হলে তখন সবটাই কঠিন মনে হবে।
তাই ভেবেছি অন্তত একটা দিনের জন্য নিজের স্বপ্ন পূরণ করব। তোমায় নিয়ে সাইকেলে চড়ে ঘুরবো, রাস্তার ধারের পরোটা ভাজি খাবো। বাদাম ভাজা খাওয়া হবে, পাঁচ টাকার কেক ও খাওয়া হবে আর সবশেষে আমাদের এই একদিনের মধ্যবিত্তের জীবন কাটানোর শেষটা হবে কাঠি আইস্ক্রিম খেয়ে। আমার এই স্বপ্নটা নাহয় এভাবেই পূরণ হোক। বলো, হবে আমার একদিনের মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গী ? ‘
বিনী এক দৃষ্টে চেয়ে রইলো আবিরের দিকে। আবির ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে দাড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোলে তার মুচকি হাসি। চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। আজ এই মহেন্দ্রক্ষণে তার মনে হলো তার সামনে দাড়িয়ে থাকা এই অতি সাধারণ পুরুষটির প্রেমে আচমকাই সে পা পিছলে পড়েছে। পেটের ভিতর প্রজাপতি উড়ছে, নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে আর চোখ দুটো অপলক চোখে তাকিয়ে আছে।
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। নিমেষেই বৃষ্টির ঝড় এসে ভাসিয়ে নিলো বিনীর দ্বিধান্বিত মনের দ্বিধা। বিনী খুব করে চাইলো সামনে থাকা স্বপ্ন পুরুষটির হাত ধরে অচেনা ভিড়ে মিশে যেতে। মানুষটার মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গী হতে। সঙ্গে তার এও মনে হলো মানুষটার কোনো কথাই তার রাজি নাহলে নয়। তার পক্ষে সম্ভবই না তার কোনো কথা ফিরিয়ে দেওয়া।
বিনী এগিয়ে দিল হাত। আবিরের হাতে হাত রেখে বলল ‘ হবো, হবো আমি তোমার সঙ্গী। শুধু আজ নয়, আমি হতে চাই তোমার আমরণের সঙ্গী। আমাদের এই একদিনের স্বপ্ন কোনদিক না কাটুক। না ভাঙুক আমাদের কল্পনার রাজ্য। আমি শুধু তোমার হতে চাই আবির, শুধুই তোমার। আমি তোমার ছিলাম আর তোমারই থাকবো। ‘
আবির হাসলো। ঝুম বৃষ্টিতে বিনীর ঠান্ডা,বরফ হয়ে যাওয়া হাতটা ছুঁয়ে দিলো। তারপর!! তারপর সাইকেল রেখেই বিনীকে নিয়ে এই ঝুম বর্ষায় ছুটতে শুরু করলো। বিনী ছুটতে ছুটতে বললো ‘ সাইকেলটার কি হবে ? ‘
‘ ওটা থাকুক, আমরা ফিরবো। ফিরবো হারিয়ে যাওয়া এক ঝুম বর্ষায়। আছড়ে পড়ব বর্ষার এক গুচ্ছ কদম হয়ে। বেলী ফুলের মালায় তোমায় নিয়ে গাঁথবো আবারও এক ভালোবাসার গল্প। গল্পের নাম হবে এখানে বেলি ফুলের মালা, আবিরের বেলি ফুলের মালা। ‘
সমাপ্ত….
ছবিয়াল: Maksuda Ratna
(অবশেষে উপন্যাসের ইতি টানলাম। শেষ পর্বটা লেখা সহজ ছিল না। শেষটা পুরো গল্পের থেকে একদম আলাদা। খানিকটা আধুনিক আর ড্রামাটিক হয়েছে তবে আমার মনে হলো একমাত্র এই এন্ডিংটাই মানায়। ভালোবেসে সবার মিলন হতে হবে এমন নয়। মাঝে অপ্রাপ্তিতেও পূর্ণতা থাকে। )