কয়েকদিন ধরে বাবার বিছানায় একটা ছায়া বসে থাকতে দেখছি। ছায়ারা হয় কুচকুচে কালো, চেহারা বিহীন। তবে এই ছায়াটার চেহারা আছে। কুৎসিত কালচে সেই চেহারার দিকে কয়েক সেকেন্ড এর বেশি তাকিয়ে থাকা সম্ভব না। আমার চোখ অবশ হয়ে আসতে থাকে সেই বিভৎস চেহারাটা দেখলে! আমি চোখ ঘুরিয়ে নেবার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না। আমার তাকিয়েই থাকতে হয়।
এই ছায়াটাকে এবার নিয়ে মোট তিন বার দেখলাম। প্রতিদিন রাত দুটো বাজার ঠিক এক সেকেন্ড পর ছায়াটা হুট করে হাজির হয়ে যায়। ভাসা ভাসা কালো ধোঁয়ার মত ছায়ামূর্তিটা তার মাথাটা ঝুঁকিয়ে বসে থাকে ঠিক বাবার শুয়ে থাকা দুই পায়ের পাতা বরাবর। তার ঝোঁকানো মাথা দেখলে বোঝার উপায় নেই সে কি ভাবছে। শুনশান নিরব ঘরে একটা খাটে একটা ঘুমন্ত মানুষের পায়ের পাতার কাছে একটা কালশে বিভাৎস দর্শন অবয়ব বসে থাকে সারারাত, এই ভাবনাটাই যেখানে আমায় অস্থির করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট সেখানে প্রতি রাতে আমার চোখে পড়ে এই দৃশ্য।
বাবাকে অনেকবার বলেছি। তিনি কোন পাত্তাই দেননি। যেন আমি যা দেখছি সব ভুল, যা বলছি সব ভুল! কিন্তু আমি তো জানি আমার দেখায় কোন ভুল নেই।
যা বলেছিলাম। এই ছায়াটাকে আমি এর আগে আরো দুইবার এই বাড়িতে দেখেছি। এর আগের বার যখন দেখি তখন এই ঘরে বাবার সাথে আরেকজন মানুষ ঘুমাতো।
আমার মা। ছায়াটা তখন ঠিক আমার মায়ের পায়ের পাতার দিকে ঝুঁকে বসে থাকতো। এমনি করেই অপলক চেয়ে থাকতো আমার মায়ের দিকে। এক বিন্দু নড়চড় করতো না। অন্ধকার রাতকে যেন আরো গভীর অমানিশায় ডুবিয়ে দিত এই ছায়ার নিশ্চলতা।
আমি তখনো মাকে বারবার বলেছি। কিন্তু মা ও ঠিক বাবার মতোই আমার কথা শুনেননি। আর তারপর…
ছায়াটা মায়ের পায়ের দিকে বসে থাকা শুরু করার ঠিক সাত রাত পর আমার মা মারা গেলেন।
যেদিন মা মারা গেলেন সে রাতে ছায়াটা মায়ের পায়ের দিকে বসেনি। বসে ছিল ঠিক মায়ের মাথার উপর ঝুঁকে থেকে। আমি কোনমতেই বুঝতে পারিনি মা কিভাবে টের পেলেন না তার ঠিক মাথার উপর ঝুঁকে বসে আছে এক অশুভ কোন সত্তা। সারারাত, সেকেন্ড এর পর সেকেন্ড, অপলক!
মা যখন মারা যান, তখন ভোর হয় হয়। আজান দিবে ফজরের। কালচে সেই ছায়াটা তখন মায়ের মাথার উপর থেকে ধীরে ধীরে তার পুরো শরীরটা ছেয়ে ফেলছে। মা তখন অস্ফুট গলায় একবার আমার নাম ধরে ডাকলেন, “নিশাত… আমার নিশাতরে…নিশাত মা আমার…!” মায়ের কথা শেষ হলো না। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি নিশ্চল হয়ে গেলেন। চীর জীবনের জন্য!
মাকে কবর দিয়ে আসার পর থেকে বাবা যেন কেমন হয়ে গেলেন। খান না, ঘুমান না, কথা বলেন না। আমার ভীষন কষ্ট হয় বাবাকে দেখলে। আমি যখনই মাকে নিয়ে কিছু বলতে যেতাম বাবা এড়িয়ে চলে যেতেন।
মানুষ কি মৃত্যুর পর মৃত মানুষটাকে ভোলার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে? নিজের অজান্তেই? জানি না আমি।
আজ আমি গত ছয়দিন ধরে ছায়াটাকে তৃতীয়বারের মত দেখেছি এই ঘরে, এই বিছানায় । বাবার পায়ের দিকে বসে ছিল ছায়াটা এই ছয়দিন। আজ রাত দুটোয় যখন ছায়াটা উদয় হবে তখন হবে সপ্তম রাত।
সপ্তম রাত! তাহলে কি…?
না। সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমি হতে দিতে পারি না। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম বাবাকে বোঝাতে। তিনি এসবে বিশ্বাস করেন না!
সব সময় সব কিছু অবিশ্বাস করলে কি পৃথিবীতে টিকে থাকা সম্ভব? বাবা বিশ্বাস করলেন না। বাবা কথা শুনলেন না। তিনি একাকী সেই বিছানায় শুয়ে রইলেন।
রাত দুটো।
সেই ছায়াটা বসে আছে। বাবার খাটে। বাবার পায়ের দিকে না। তার মাথার দিকে। আমার কোন চেষ্টাই কাজে আসেনি।
ফজরের আজান হয় হয়। ছায়াটা ধীরে ধীরে বাবার পুরো শরীরটা ছেয়ে ফেললো কালচে এক ধোঁয়ার আবরণে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলার চেষ্টা করলাম, একই দৃশ্য আরেকবার দেখতে ইচ্ছে করলো না। কিন্তু পারলাম না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হলো যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে যাওয়া বাবার মুখটা। এক ছটাক নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য তার হাহাকার, তার আকুল চেষ্টা।
বাবার কষ্টটা দীর্ঘায়িত করলো না ছায়াটা। তার ছটফটানি থেমে গেল। নিরব শীতলতায় ঢেকে গেল পুরো ঘরটা। তৃতীয়বারের মত।
বাবার লাশটা যখন নিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে, কয়েকজন আত্নীয় আমার দিকে আফসোসের দৃষ্টিতে তাকালেন। তাদের চোখে করুনা, দুঃখ আর খুশি সবকিছুরই কেমন মিশ্রণ যেন দেখতে পেলাম।
একজন এগিয়ে এসে আস্তে করে আমাকে তুলে নিলেন হাতে।
“এটা নিশাত না? ওনার মেয়ে?”
“হুম! পোড়া কপালী একটা মেয়ে! এই ঘরে পা রাখার পর তিন তিন বার….!”
ওদের মুখে তিন শব্দটা শুনেই খেয়াল হলো, ছায়াটাকে যেদিন প্রথম বার দেখেছিলাম… সেটা বসে ছিল ঠিক আমার দুই পায়ের পাতার বরাবর। টানা ছয়দিন ছায়াটা বসে থাকতো আমার পায়ের দিকে। আমি বাবা মাকে বারবার বারবার বোঝাতে চাইতাম, বলতে চাইতাম… তারা বুঝতো না, তারা শুনতো না।
কানে এলো মানুষ দু’জনের কথা,
“তাহলে নিশাত জন্মের এক বছর পর তার মা মারা গেলেন আর আজ মারা গেলেন নিশাতের বাবা। আহারে…!‘’
আমার মনে পড়লো ছায়াটা আমার পায়ের দিকে ছয় রাত বসে থাকার পর সপ্তম রাতের কথা! আমার ঠিক মাথার উপরের কুচকুচে কালো একটা বিকট দর্শন, ভয়ংকর কালচে চেহারা ঝুঁকে আছে…! দুই চোখের মনি কুচকুচে কালো, নাকের জায়গায় বিশাল বড় একটা গর্ত, দাঁতের জায়গায় কিছুই নেই… শূন্য নিকষ অন্ধকার সেই চেহারায়।
তারপর… তারপর… আর মনে নেই…! শুধু মনে আছে আমি প্রাণপণে চিৎকার করে ডাকছিলাম মাকে, বাবাকে কিন্তু তারা শুধুই আমায় চুপ করাতে চাচ্ছিলেন…! তারা আমার কথা শোনেননি।
“নিশাত মারা গিয়েছিল কত বছর বয়সে?” আমার ফ্রেম করা ছবিটা হাত থেকে নামাতে নামাতে প্রশ্ন করল একজন।
“নিশাত মারা গিয়েছিল মাত্র ছয় মাস বয়সের সময়। এই ঘরেই, এই খাটের উপরই। সারাটা রাত মেয়েটা চিৎকার করে করে কেঁদেছে, সবাই ভেবেছিল হয়তো শরীর খারাপ কিংবা ভয় পেয়েছে। তারপর ভোর বেলায় মারা গেল ছয় মাসের ছোট্ট মেয়েটা। ” আফসোসের স্বরে কথাটা বলে আমার দিকে তাকালো কিংবা ছয় মাস বয়সী আমার ফ্রেম করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো অপর পাশের মানুষটা।
তাদের কথা কানে আসলো না আর। মাথায় শুধু ঘুরছে…
মা আমার কথা শুনলো না… বাবা আমার কথা শুনলো না,
কেউ… আমার কথা শুনলো না।।।
- সাজ্জাদ সিয়াম