স্মরণ তাদের বাসায় যাওয়ার রাস্তার মোড়ে দেখলো তিনটে দামী দামী গাড়ি। একটি বিল্ডিং এর সামনে দাঁড় করানো। শীতল একদিন বলেছিলো এই এলাকায় বাকি বিল্ডিং গুলোতে মানুষজন থাকলেও এই বিল্ডিং এ মানুষ থাকে না। এজন্যই বিল্ডিংটা কিছুটা পুরোনো হয়ে গেছে। দেয়ালের রঙ উঠে সেগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ উঠেছে। সেগুলো অবশ্য দিনেই দেখা যায়। এই রাতে তো অন্ধকার শুধু।
তবে স্মরণ ভাবছে তো এটা—এখানে এই গাড়িগুলো কি করছে? এসব ভেবে কাজ নেই ভেবে সামনের দিকে এগুলো। তবে তখনই বিকট চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেলো। ভড়কে গেলো স্মরণ। দেহ শিওরে উঠলো সবেগে। ভয়ে আড়ষ্ট হলো দেহ। একা সে, ভয় পাওয়ারই তো কথা! বাহারাজ যদি আসতো তবে একটা কথা ছিলো। তবে লোকটাও তো কোথায় উধাও হয়ে গেছে। ব্যাগটা দিয়েই চলে গেলো৷ ভয়ে স্মরণের মস্তিষ্ক বলে উঠলো ‘কেন স্মরণের পেছন পেছন একটু কি আসা যেতো না?’
নিজের ভাবনাতে নিজেই বিরক্ত হলো। আবারও সেই চিৎকারের আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো। এদিকের এলাকাটাই এমন যে কেউ চিৎকার করলেও কোনো মানুষ শোনার মতো নয়, জানার মতো নয়৷ কারণ এই এলাকায় খুব কম সংখ্যক মানুষ।
স্মরণের কৌতূহল হলো কে চিৎকার করছে ভেবে? ভয় পেলেও এগিয়ে গিয়ে দেখার মতো তৃষ্ণাকে দমাতে পারলো না। পা টিপে টিপে বাসাটার দিকে এগিয়ে গেলো। তখনই একটি কালো অবয়ব দেখতে পেলো যে কিনা তারই দিকে এগিয়ে আসছে। ভয় পেলো স্মরণ। অবয়বটা এতো দ্রুত এগিয়ে আসছে স্মরণ কি করবে না করবে ভেবে পেলো না। দৌঁড়াবে কি? দৌঁড়াতেই যাবে এমন সময় সেই ব্যক্তিটিই তাকে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। ভয়ে স্মরণের আত্মা তখন কাঁপছিলো বেসামাল।
তার ভয়কে দ্বিগুণ করতেই যেন সেই ব্যাক্তিটি দাঁড়িয়ে গেলো। পেছনে ঘুরে স্মরণের দিকে তাকালো। স্মরণ হাঁটতেই ধরবে এমন সময় সেই জন রুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলো,“ ভয়–ই যখন পাও, তবে এখানে আসার কি দরকার ছিলো? বাসায় ফিরে যাও। সবাই আমার মতো তোমায় এভাবে জীবিত ছেড়ে দেবে না। ’’
একদিকে ভয় আর অন্যদিকে বিস্ময়। কারণ কণ্ঠস্বর কোনো মেয়ের। তারমানে এ মেয়ে? শেষোক্ত কথাটাই ভয় পেলো। বিস্ময়তাকে ভুলে জীবন বাঁচাতে সামনে চলে যেতেই নিবে তখনই মেয়েটি আবারও বলে উঠলো,“ এলাকায় যেহেতু নতুন। সাবধানে চলাফেরা করবে মেয়ে। জীবন একটাই, হারিয়ে ফেললে আফসোস।’’
আরও ভীত হলো স্মরণ। তবে পেছনে ঘুরে তাকালো না। দৌঁড়ে চলে গেলো সামনে। মেয়েটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই বাড়িটি থেকে আবারও কেউ বেড়িয়ে এলো আর মেয়েটিকে দেখে বলতে চাইলো, “ আশ…’’
“ শশশ…একদম নয়। আগামীকাল ঝামেলা হবে। শুধু সাবধানতা অবলম্বন করো।’’
মেয়েটি চলে গেলো। এদিকে স্মরণ বাসার সামনে এসে তাড়াহুড়ো করে বাসার ভেতরে ঢুকতে যাবে এমন সময় ধাক্কা খেলো শায়নের সাথে। আজ কি শুধু ধাক্কা খাওয়ারই দিন?
“ দেখে চলতে পারো না মেয়ে? কানা নাকি?’’
“ আমি নাহয় কানা। আপনার তো চোখ ছিলো নাকি? আপনি দেখে চলতে পারেন নি?’’
শায়নের খেয়ালে আসলো সে কার সাথে কথা বলছে। সেখান থেকে চলে যেতে যেতে বললো,“ ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম কার সাথে ধাক্কাটা খেয়েছি।’’
বলার ভঙ্গিতে স্পষ্ট তাচ্ছিল্যতা। তবে স্মরণের আজ সেসবে গুরুত্ব দেওয়ার মতো সময় নেই। তার এখন রুমে গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকাটা প্রয়োজন। হাতে থাকা ব্যাগগুলো নিয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে পড়লো। রুমে এসে দরজায় কলিংবেল বাজালো। তবে কেউ দরজা খুললো না। বেজায় বিরক্ত স্মরণ। পরক্ষণেই মনে পড়লো তার বাসায় তো কেউ নেই? বীথি নামক মেয়েটা তো শীতলদের বাসায়। নিচে চোখ পড়তেই দেখলো তালা মারা। বেক্কল বনে গেলো স্মরণ। দ্রুত তালা খুলে ভেতরে ঢুকে দরজা লক করে দিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে রান্নাঘরে গিয়ে জিনিসপত্রগুলো রাখলো আগে। পানির বোতল হাতে নিয়ে ধকধক করে পুরো এক বোতল পানি নিমিষেই শেষ করলো।
নিজের রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম যা করলো তার হলো নয়নকে কল করলো আচ্ছা মতো গালি আর ঝাড়া দেওয়ার জন্য। নয়ন কল রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে বললো,“ এ কোন মরণকুপে ফেলে দিয়েছিস তুই আমায়? যেখানেই যায় ওখানেই মাফিয়া। সে হয় ছেলে আর নয় তো মেয়ে। আবার আমাকে মেরে ফেলারও হুমকি দেয়?”
নয়ন অপরপ্রান্ত হতে প্রশ্ন করে বসে,
“ তোকে ছেড়ে দেয় কেন? এটাই ভাবছি আমি?’’
রেগে গেলো স্মরণ। বিশ্রি একটা গালি মুখে আসলেও দিলো না নয়নকে। সংযত করলো নিজেকে। বললো,“ আমি বাসা চেঞ্জ করবো। তুই নতুন বাসা খুঁজে দে।’’
“ আমরা কাল আসছি ওখানে। দেখবো কি এমন সমস্যা।’’
বলেই নয়ন কল কেটে দিলো। স্মরণ মেসেজ আচ্ছামতো ঝাড়া দিলো নয়নকে। সেসময় আবার কলিংবেল বেজে উঠলো। স্মরণ ‘কে, কে’ জিজ্ঞাসা করতেই ওপরপ্রান্ত হতে উত্তর এলো,“বীথি।’’
স্মরণ গিয়ে দরজা খুলে দিলো। মেয়েটা ভেতরে ঢুকলো। মেয়েটাকে দেখলেই কার কথা যেন মনে পড়ে স্মরণের। খুব চেনা এই মুখ। বীথি মুচকি একটা হাসি দিলো। খুবই ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলো,
“ তোমাকে ভীত দেখাচ্ছে! কোনো সমস্যা?’’
স্মরণ বোকা বোকা হাসলো। বীথির খুব হাসি পেলেও হাসি আটকালো। স্মরণ সড়ে দাঁড়ালো। বীথি ঢুকলো ভেতরে। স্মরণ জিজ্ঞাসা করলো,“ রাতে খেয়েছো কিছু?’’
“ না তেমন কিছু খাওয়া হয় নি। ক্ষুদা নেই।’’
“ চলো তাহলে দুজনে মিলে রান্না করি।’’
_____________________
শীতকালীন রাতে বৃষ্টি মাধ্যমে মেঘগুলো চুপিচুপি পৃথিবীর উপর ছড়িয়ে দেয় শীতল স্নিগ্ধতা। হালকা বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির রিদম যেন মৃদু সুরে বাজে, আর প্রত্যেকটি বৃষ্টির ফোঁটা শীতের কনকনে আবহাওয়াকে আরও কোলাহলমুক্ত, নির্জন ও শান্ত করে তোলে। রাত্রির গভীরে, এই বৃষ্টির গানের সঙ্গে প্রতিটি বৃষ্টির ফোঁটা যেন একেকটি ছোট্ট স্বপ্ন, ভেসে চলা স্নিগ্ধ অনুভূতির মত।
এই–যে হুট করেই বাইরে বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। বারান্দায় কাপড় মেলে দেওয়া ছিলো স্মরণের। রান্নাঘরে বীথিকে রেখে, স্মরণ দৌঁড় দিলো বারান্দার উদ্দেশ্যে। ঢিপ ঢিপ বৃষ্টির আওয়াজে ভরে উঠেছে চারপাশ। কাপড়গুলো তাড়াহুড়ো করে সড়িয়ে নিলো। হঠাৎ মন চাইলো বৃষ্টির পানিতে হাত ভেজাতে। কাপড়গুলো ভেতরে রেখে এসে আবারও বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। হাত নাড়াতে লাগলো। মুখে হাসি নেই, কারণ আজ সারাদিন যা গেলো হাসি তো দূর সুখ, দুঃখ পেলেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া থাকবে না।
“ হেই স্মরণ!’’
কারও ডাকে পাশের বারান্দায় ঘুরে তাকালো। বাহারাজের বন্ধুটা। যে স্মরণকে স্বাগতম জানিয়েছিলো। স্মরণ সৌজন্যমূলক হাসলো। রিয়াদ বলে উঠলো,“ কেমন আছো তুমি? মন খারাপ নাকি?’’
“ না ভাইয়া এমন কিছু নয়।’’
“ সত্যিই এমন কিছু নয়? ’’
স্মরণ এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। এদেরকে তার ভীষণ ভয় করে আজকাল। একেকটা মাফিয়া বস যেন। ভাবতেই গলবিল মরুভূমিতে পরিণত হলো যেন। স্মরণ মেকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো,“ না। আচ্ছা থাকুন ভাইয়া, আমার কাজ আছে।’’
এই বলে স্মরণ দৌঁড়ে ভেতরে চলে গেলো। রিয়াদ স্মরণের যাওয়া দেখলো আর হেসে উঠলো। সে মুহুর্তে আবার কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ পেলো। না তাকিয়েও বুঝতে পারলো মানুষটা কে।
বাহারাজ সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে বলে উঠলো,“ মেয়েটা বোকা বোকা হাসলে আমার আমার লাগে তাই না?’’
রিয়াদ বিস্ময় নিয়ে বাহারাজের দিকে তাকালো। অভ্র ভেতর থেকে খুব জোরে হেসে উঠলো।
চলবে,…