ছায়াতরু [পর্ব-২.১]

২য় পরিচ্ছে

বিবাহিত স্ত্রীর সামনেই অন্য একটা মেয়েকে নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকলো হিমেল। তার এহেন কাজে রাহা বিস্মিত হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে হিমেলের কাছে এগিয়ে গেলো। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,“ বিয়ের আগে তো খুব বলেছিলে তোমাকেই ভালোবাসি রাহা। এমন দুই নাম্বারি ভালোবাসা হবে সেটা আমি আগেই জানতাম। তবে সচক্ষে না দেখায় ভেবেছিলাম জাতে ভালো হবে। এখন দেখছি তুমি তো জাত খারাপ।’’
হিমেল তার পাশে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল,“ তুমি একটু বাইরে যাও। আমি কথা বলে আসছি। চিন্তা নেই আজ রাতটা তোমার আমারই হবে।’’
রাহার রাগে গা শির শির করে উঠলো। মানুষ নির্লজ্জ হয় তবে এর কাছে নির্লজ্জ, চরিত্রহীনতাও লজ্জা পাবে। মেয়েটা রাহার দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে চলে গেলো। রাহা দাতে দাত চেপে বলে উঠল,“ ফূর্তি করার এতই যেহেতু ইচ্ছে তাহলে বিয়ে করে আমার জীবন নষ্ট করলে কেন?’’
“ তোমার জীবন তো আগে থেকে নষ্টা জীবন।’’
রাহা প্রচন্ড রেগে গেলো। কলার চেপে ধরলো হিমেলের। রুষ্ট কণ্ঠে মেজাজ দেখিয়ে বলল,“ মুখ সামলে কথা বল হিমেল। তোকে মেরে ফেলতে আমার হাত কাঁপবে না। রাগাবি না আমায় একদম। ডিভোর্স চাই আমার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করো।’’
“ তোমাকে বাড়িতে বউ সাজিয়ে রেখেও কোনো লাভ হবে না আমার। ডিভোর্স পেয়ে যাবে। মা ঠিকই বলেছিলো হিরে ফেলে আমি কাঁচের পেছনে ছুটেছি।’’
“ স্মরণের প্রতি এতই যখন দরদ উপচে পড়ছে তো বিয়ে কেন করিস নি? গাধার মতো চুপ করে ছিলি কেন?’’
হিমেলের এই উত্তর নেই। রাহার হাত থেকে নিজের কলার ঝাপটা মেরে ছাড়িয়ে নিলো। এই মেয়েটাকে সে পছন্দ করেছিলো। তবে এই মেয়ের একাধিক সম্পর্ক রয়েছে। চাক্ষুষ প্রমাণ হিমেল নিজেই। তাইতো রাহাকে কিছুটা জেলাস ফিল করানোর জন্য মেয়েটাকে নিয়ে এসেছিলো। তবে এই রাহা যে এমন এমন কথা বলবে বুঝতে পারে নি। যত যাই-ই হোক রাহাকে হিমেল পছন্দ করে। হিমেল ঘুরে দাঁড়ালো। রাহাকে কিছু বললো না। সে রাহাকে ছাড়তে পারবে না। ধরে বেঁধে হলেও নিজের কাছে রেখে দেবে। হোক পাপী। হিমেল নিজেও তো খুব একটা গুণধর ব্যক্তি নয়। একটা মেয়ের বোনের সৎ বোনের সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছে। এসব ভেবেও হিমেলের কিছুটা অনুতপ্ত বোধ আসে মাঝে মাঝে। কাজটা করার আগে ভাবে নি। এখন আফসোস করেও লাভ নেই। এজন্যই হয়তো বলে ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’।


প্রাতঃসন্ধ্যা যাপন উপভোগী ব্যাক্তিদের ছাদেই হয়তো বেশি দেখা যায়–এই ধারণা স্মরণের। সূর্য ডোবার আগমুহুর্ত সবসময়ই উপভোগ করে সে। মনে পড়ে মমতাময়ী মা–কে। স্মরণের চোখ ভিজে আসে সেসময়। মা যদি আজ তার সাথে থাকতো তবে হয়তো তাকে আজ এভাবে একা ভাড়া থাকতে হতো না। ‘মামা গাছ কাটার সময় ভাগিনার সহজ লাগে’, দূর থেকে একা জীবন কাটানো দেখলে অনেকেরই মন চায় একা থাকতে। তবে একা জীবন যে ভারী কঠিন সেটা ততক্ষণ না পর্যন্ত উপলব্ধি করতে পারবে যতক্ষণ পর্যন্ত সে একা একটা জীবনে উপনীত হবে। স্মরণের তো বাপ থাকতেও নেই। তাহলে হয়তো এই জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতো কিছুটা।
খবর পেয়েছে গতকাল হিমেল আর রাহার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। খবরটা শুনে স্মরণ বেশ অনেক্ষণ পাগলের মতো হেসেছে। কথাটা মনে পড়তেই এখন আবারও হেসে উঠলো স্মরণ।
“ কি নিয়ে এতো হাসা হচ্ছে স্মরণ? আমাকেও বলো আমিও একটু হাসি।’’
শীতলের কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো স্মরণ। মেয়েটা তার সূর্যাস্ত উপভোগের একমাত্র সঙ্গী। মাঝে মাঝে স্মরণের বন্ধুগুলোও এই কাজের অংশীদার হয়। বাসাটাই এসেছে আজ প্রায় বারো দিন হলো। বাহারাজদের সাথে দেখা হয় নি আর সেদিনের পর থেকে। তাদের রুমে তালা মারা। স্মরণ এসবে নাক না গলালেও কৌতূহল হয়। ওই ছেলে গেছে কোথায়? রাতে মাঝেমাঝে ভয় করে স্মরণের। পুরো তিনতলায় একা সে। ভয় করারই তো কথা।
“ কিছু না। একা একাই হাসি পায় মাঝে মাঝে। তাই হাসি। তুমিও হাসো।’’
বলেই দাত কেলালো স্মরণ। শীতলও হাসলো,“ বাবা তোমাকে নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানিয়েছে। আজ রাতে এসো।’’
“ এসবের দরকার ছিলো না। আমি রান্না করেছি বিকেলের দিকে।’’
শীতল স্মরণের পাশে বসে বললো,“ বাবা এক কথার মানুষ। তাই তাড়াতাড়ি চলে আসবে। আজ রাতে আমি তোমার সাথে থাকবো তোমার রুমে। একা থাকো তুমি। ভয় করে নিশ্চয়।’’
স্মরণ মনে মনে বলে উঠলো ‘এতদিন পর মাথায় আসলো কথাটা?’। তবে মুখে বললো,“ তারও দরকার ছিলো না।’’
“ অবশ্যই দরকার আছে।’’
স্মরণ না করলো না। দূর আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটা এখন লালচে আভায় ছেয়ে আছে। দেখতে আকর্ষণীয় লাগছে। স্মরণ কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলো,“ আচ্ছা আমার পাশের রুমের ওই লোকটা কোথায় গিয়েছে?’’
“ কে বাহারাজ ভাই?’’
‘‘ হ্যা হ্যা ওই বাহারাজ মহারাজ লোকটা।’’
শীতল কিছুটা ভাবুক আওয়াজেই বলে উঠলো,“ উনি সবসময়ই এমন। হুট করেই উনার কোনো খোঁজ থাকে না। আবার মাঝে মাঝে দেখা যায় উনাকে। উনার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।’’
স্মরণ এবার ভয় পেলো। চোখ ছোট ছোট করে মিনমিনে আওয়াজে শুধালো,“ এ আবার কোনো মাফিয়া টাফিয়া নয়তো?’’
শীতল হেসে উঠলো জোরে জোরে,“ আরেহ ধুর কি যে বলো না! মাফিয়া হতে যাবে কেন? বাহারাজ ভাইয়ের তো কোনো চাকরিও নেই।’’
“ এজন্যই তো মাফিয়া হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেশি।’’
“ না তেমন কিছুই না।’’
স্মরণ আর শীতল উঠে দাঁড়ালো। নিচে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। শীতল বারবার জোর করতে লাগলো রাতে তাদের বাসায় খাওয়ার জন্য। স্মরণ মানা করলো বারংবার। তবে শীতল মানলো না। শীতলের সাথে না পেরে স্মরণ রাজি হলো। শীতল মেয়েটা তার সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানীং। সমবয়সী হওয়ায় বোঝাপড়াটাও একই। তিনতলার সিড়ির কাছে আসতেই চমকে উঠলো স্মরণ শীতল দুজনেই। বাহারাজ, শায়ন, অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। এতদিন পর এদের দেখে স্মরণ শীতল দুজনেই ভ্রু কুঁচকালো। বাহারাজ চোয়াল শক্ত করে ফোনে কারও সাথে কথা বলছিলো। অভ্র, শায়ন ফোন নিয়ে ব্যস্ত। তাদের মাঝে রিয়াদকে দেখা গেলো না। তালা মারা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন। স্মরণ আর শীতলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে বাহারাজ বাদে বাকিরা তাদের দিকে তাকালো। শায়ন দাত কেলিয়ে হাসলো স্মরণের দিকে তাকিয়ে। হাত নাড়িয়ে বলে উঠলো,“ হাই শীতল স্মরণ!’’
শীতল আগে আগে নেমে আসলো। পিছন পিছন স্মরণ নামলো। এবার বাহারাজও তাদের দিকে তাকালো। বাহারাজের সুচালো নাকটা কেমন লাল দেখাচ্ছে। মার খেয়েছে? নাকি রাগে লাল হয়েছে? বুঝতে পারলো না স্মরণ। তবে দুজনের মাঝে চোখাচোখি হলো। একজনের চোখে বিস্ময় তো অন্যজনের চোখের চাহনী তীক্ষ্ণ। শীতল তাদেরকে বলল,“ ভাইয়া তোমরা কখন এলে?’’
অভ্র জবাবে বললো,“ একটু আগেই এসেছি। চাবিটা রিয়াদের কাছে। তাই এখানে দাঁড়িয়ে আছি।’’
“ আজ কি তোমরা থাকবে নাকি?’’
“ না একটুপরই চলে যাবো।’’
শীতল ‘ওহ’’ বললো। তারপর আবারও প্রশ্ন করলো,“রাতের খাবার আমাদের বাসায় খেতে পারবেন ভাইয়া।’’
বাহারাজ ফোনটা পকেটে পুড়ে নিয়ে গমগমে মোটা আওয়াজে বললো,“ দরকার নেই। আমি বাইরে থেকে খেয়ে নেবো।’’
শীতল আর কিছু বললো না স্মরণকে টেনে নিজেদের বাসার উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে লাগলো। যাওয়ার সময় স্মরণ আর বাহারাজের অপ্রস্তুতভাবে চোখাচোখি হলো আবার।
স্মরণের রুমে একটা বারান্দা আছে। এইতো কিছুদিন আগেই বারান্দায় কয়েকটা ফুলের টব এনেছে স্মরণ। গাঁদা আর গোলাপ ফুলের টব। কলি ধরেছে। ধীরে ধীরে ফুল ফুটবে। স্মরণ বারান্দায় আসলো ফোনে কথা বলতে বলতে।
“ শোন আমরা একটা জায়গায় ঘুরতে যাবো। এক কথায় ট্যুর দেবো আর কি।’’
জিনিয়ার কথায় স্মরণ বেশ উৎসাহ পেলো। স্মরণ জিজ্ঞাসা করলো,“ কোথায়?’’
“ সিলেট চল।’’
“ সিলেট কেনো? অন্য জায়গা হয় না?’’
“ অন্য জায়গা পরে। আগে সিলেট ঘুরে আসি।’’
স্মরণ কিছু বলবে তার আগেই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেলো। ফোনে চার্জ ছিলো না। মাত্র দুই পার্সেন্টেই জিনিয়ার সাথে কথা বলতে বসে গেছিলো স্মরণ। মনে পড়তেই নিজের ওপর নিজে বিরক্ত হলো প্রচুর। ফ্লোরের ওপর থাকা ফুলের গাছগুলোকে একবার ভালোভাবে দেখলো স্মরণ। তখনই পুরুষালী আওয়াজ শোনা গেলো,
“ মাফিয়া নই আমি তবে মাফিয়ার থেকেও ভয়ানক কেউ।’’

  • Junani CH

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *