তাঁর চোখে আমার সর্বনাশ [পর্ব-১১]

আমার মরুভূমির মতোন শুঁকনো জীবনে, কেমন করে যেনো এক সমুদ্র প্রেম নিয়ে ঢুকে পরলো অভ্র! আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন মনটাতে জ্বলজ্বল করে সে জ্বলতে থাকলো আলো হয়ে! আমি যতোবারই তাকে অবহেলা করেছি? বিনিময়ে সে আমায় দিয়েছে রজনীগন্ধা ফুল! যতোবার তিক্ত মেজাজ নিয়ে দূরত্ব দেওয়ার অনুরোধ করেছি? ততোবারই সে আমার আরো নৈকট্যে চলে এসেছে! যতোবার তাকে বিরক্তি নিয়ে শুধিয়েছি “কি চাই?”সে শুধু আমাকে চাইলো! দাবানলের আগুনে ফেলে দিয়ে তাকে একটু একটু করে পুড়তে দেখেছি আমি, তার পরও যখন নিষ্ঠুর কন্ঠে জিজ্ঞেস করেছি “কি চাই?” ও এবারো আমাকেই চাইলো! আমি চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে যখন শুধালাম “তোর মতো অমন বেহায়া ধাঁচের ছেলে আমার জীবনে অন্যটি নেই,জানিস?” সে অগ্নিচোখে প্রতিবার উত্তর দিয়েছে “এমন সাহস কেউ করে তো দেখাক” দুঃখ যতোবার আমায় স্পর্শ করতে এলো? ততোবারই সে ঝরের মতোন উড়ে এসে আমার সকল দুঃখ চুকিয়ে দিলো! দুঃখদের সে শাসিয়ে জানান দিয়ে দিল, “ডোন্ট এভার ডেয়ার টু হার্ট মাই লাভ!”ব্যাস! ওরা আর দুঃসাহস নিয়ে আমার সম্মুখীন হলোনা! তটস্থ রইলো সে-ই বেপরোয়া পুরুষের ভয়ে! একটু একটু করে এই অবাধ্য পুরুষের নিকট আমি কখন যে হেরে গেলাম টেরই পেলামনা! বিনিময়ে গুটিগুটি হয়ে নিজেকে গুছিয়ে রাখলাম তাঁর বেহায়া মনটাতে! সাথে শুধালাম “এই তিক্ত পৃথিবীতে তুই আমায় সামলে নিয়েছিস সে-ই শৈশব থেকেই, বার্ধক্য পর্যন্ত পারবি আরেকটু আমায় সামলাতে?” সে মৃদু হেঁসে আমার ললাটে উষ্ণ চুম্বন একে দিয়ে প্রতিবার জবাব দিয়েছে “আমৃত্যু পর্যন্ত সামলে নেবো!”

আজ এক সপ্তাহ হলো আব্বু বাংলাদেশে ফিরেছে। প্রথমদিনে আব্বুকে দেখামাত্রই খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম আমি। সে-ই আট বছর আগের চেহারা আর এখনকার চেহারায় কোনো অমিল দেখতে পেলামনা আমি। আব্বু সে-ই একইরকম রয়েছে। আমাকে দেখামাত্রই আব্বু সবার আগে আমাকেই জড়িয়ে ধরেছেন। আব্বুর আদুরে বুকে সেদিন সারাদিন পার করে দিয়েছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল ছেড়ে দিলেই বুঝি আবার দূরে চলে যাবে। এমনকি ভাইয়াকেও আব্বুর কাছে ঘেঁষতে দেইনি। ভাইয়া অভিমানী মুখ করে শুধিয়েছিলো “হ্যা, মিতুই তো তোমার মেয়ে। আর আমি তো কেউ না। লাগবেনা তোমার আদর আমার আমাকে আম্মু আদর করবে” আমাদের দুই ভাই বোনের আচরণে ফিক করে হেঁসে ফেলছিলেন আব্বু। আম্মু নালিশের স্বরে বলেছিলেন “দেখো, কি রেখে গিয়েছিলে আমার কাছে? কষ্ট করে আমি বড় করছি আর ছেলেমেয়ে দুটো হয়েছে বাপের ন্যাওটা”। আব্বু গর্বের সাথে জবাব দিয়েছিলেন ” রক্তের টান বলে কথা”

খাবার টেবিলে বসে একসাথে খাওয়াদাওয়া সেরে আমি আর আব্বু মিলে টিভি দেখতে বসলাম। অবশ্য টিভি একা আমিই দেখছি। আর আব্বু খুব যত্ন করে সোফায় বসে আমার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন। এমন সময় ঝরের মতো আগমন ঘটলো অভ্রের। ওঁকে দেখামাত্রই আঁতকে উঠলাম আমি। কাঁপা কাঁপা চোখ নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম আব্বুর প্রতিক্রিয়া। বেশ স্বাভাবিক মুখভঙ্গিতে আব্বু জিজ্ঞেস করলো-

-আরেহ অভ্র যে!কেমন আছো,বাবা?

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ন্যায় কিছুক্ষণ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে রইলাম। অভ্র সালাম দিয়ে মৃদু হেঁসে উত্তর দিল। 

-জ্বি আঙ্কেল, ভালো আছি।

-তোমার বাবার শরীর টা কেমন? তিনি তো খুব ব্যস্ত মানুষ। ভাবছি আমিই একদিন যাবো তোমাদের বাসায়। দেখা করে আসবো সবার সাথে। 

-নিশ্চয়ই, আজকেই চলুন না আমার সাথে।

জবাবে মৃদু হেঁসে আব্বু বললেন-

-দিনের বেলাতেই যাবো। এই রাতবিরেতে কারোর বাসায় যাওয়াটা খারাপ দেখায়।

আমি তখনো ভীত চোখে তাকিয়ে। খোঁচা টা যে আব্বু ইনিয়ে বিনিয়ে অভ্রকেই মেরেছে কারোর আর বুঝতে বাকি রইলোনা। আব্বু কিছুক্ষণ চুপ থেকে পূনরায় কিছু বলার আগেই অভ্র বলে উঠলো-

-কিছু নোটস নিয়ে এসেছিলাম মিতুকে দেওয়ার জন্য। এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম ভাবলাম ওকে দিয়ে যাই।

আব্বু উত্তরে কিছু বলার আগেই আম্মু বললো-

-এই বাসায় আসতে হলে তোকে বুঝি কৈফিয়ত দিতে হবে? তোর যখন ইচ্ছে হবে তখনি আসবি। তুই কেমন দূরের লোক হয়ে যাচ্ছিস রে। পাকাপাকা কথাও শিখেছিস। 

আম্মুর কথায় আমি মনে মনে ভেঙচি কেটে বললাম ” ইশশশ খুব আল্হাদ হচ্ছে! আর আরেকজকে দেখো কেমন অবুঝ শিশুর ন্যায় মাথা নুইয়ে রেখেছেন। মনে হচ্ছে, ভাজা মাছটাই উল্টে খেতে জানেনা। এ যে কতো বড় বদের হাড্ডি তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে? 

আম্মুর কথায় আব্বু মৃদু হাসলো তারপর পূনরায় জিজ্ঞেস করলো- 

-শুনলাম অয়ন নাকি বিয়ে করেছে? 

-জ্বী আঙ্কেল(অভ্রের সংক্ষেপে জবাব)

-তা তুমি কবে বিয়ে করছো?

আব্বুর কথায় আমার চোখ যেনো কপালে উঠার উপক্রম হলো । হতচকিত হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলাম আমি। অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে একপলক চেয়ে বললো-

– আমার কাছে কোনো মেয়ের বাপ নিজের মেয়ে বিয়ে দেবে,আঙ্কেল?

আম্মু প্রতিবাদের স্বরে বললো-

-কোন মেয়ের বাপের যোগ্যতা আছে আমার অভ্রকে জামাই বানানোর? লক্ষি একটা ছেলে তুই, পড়াশোনায়ও টপ, দেখতে লাখে একটা, তোর মতোন জামাই পেতে সাত কপালের ভাগ্য লাগবে মেয়ের বাপ দেড়।

আম্মুর কথায় অভ্র মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে আমার দিকে একপলক তাকালো৷ তবে আব্বুর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলোনা। কিছুক্ষণ আব্বুর সাথে আলাপের পর চলে গেলো অভ্র।

নিশির দ্বিতীয় প্রহর । নিষ্ঠুর অন্ধকার ছাপিয়ে ঘরের আলো জ্বালালাম আমি। তারপর টেবিলের বুক থেকে চেয়ার টেনে বসলাম। আমার সম্পূর্ণ নিবেশন যখন বইয়ের পাতায় আচমকা তখন ফোন বেজে উঠলোঃ। আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে রিসিভ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে অপর প্রান্ত হতে পুরুষালি কন্ঠ ভেসে এলো। 

-কি করছিস?

-পড়তে বসলাম

কিছুক্ষণ চুপ থেকে 

-তোর বাপটা অমন মির জাফর কেনো রে? 

আমি প্রকট রাগ দেখিয়ে বললাম-

-কি করেছে আমার বাপ তোকে?

-কি করেনি? ভাবলাম শশুরটা এসেছে একটু দেখা না  করলে বিষয়টা খারাপ দেখাবে। কিন্তু তোর বাপ তো আমার আগমনে মোটেও খুশি হলোনা। উল্টো বিয়ে কেনো করছিনা সে-ই নিয়ে কি তাড়া৷ দুনিয়াতে তোর বাপই বোধহয় প্রথম লোক রে মিতু,যে কিনা নিজের মেয়ের সংসার ভাঙতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তা এতো যেহেতু তাড়া তো মেয়েটা দিয়ে দিলেই পারে। খামোখা আমাকে এই যুবক বয়সে একা থাকতে হয়না।

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম-

-একদম বাজে বকবিনা আব্বুকে নিয়ে।

-ইশশ! বাপকে নিয়ে কী দরদ! স্বামীর প্রতি কোনো আনুগত্যই তোর নেই রে, মিতু। স্ত্রী হিসেবে দশে তোকে একও দিলামনা যা।

আমি বিস্মিত স্বরে শুধালাম –

-তুই বিয়ে কবে করেছিস আমায়?

-করেছি তো। প্রতিদিনি মনে মনে তিন বেলা তিন বার করে কবুল বলে ফেলি। একদিনে তিনবার করে বিয়ে করি তোকে। তুই ভাবতে পারছিস ঠিক কতোবার বিয়ে করেছি তোকে? মনে মনে আমি নিসন্দেহে একজন বিবাহিত পুরুষ। অবশ্য বিয়েটা একপাক্ষিক বলে কোনো অধিকার রটাতে পারছিনা(আফসোসের স্বরে)

আমি বিরক্তি নিয়ে পূনরায় শুধালাম –

-এসব জগা খিচুড়ি মার্কা আলাপ শোনাতে ফোন করেছিস এতো রাতে?

-কেনো? তোর কি এগুলো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ বলে মনে হচ্ছে না? অবশ্য মনে না হওয়ারই কথা। স্বামীভক্তি না থাকলে এমনই হয় বুঝলি?

আমি চোখ মুখ খিচে জবাব দিলাম-

-উফফ! তুই খুব জ্বালাচ্ছিস, অভ্র।

-প্রতিদিন জ্বালাতে পারলে তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে পারতাম রে। কিন্তু আমার মির জাফর শশুরটা তা হতে দিলে তো!

আমি বিরক্তি নিয়ে চ সূচক শব্দ করলাম

 কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভ্র পূনরায় বললো –

-ছাঁদে আয়।

আমি হতভম্ব স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-

-তুই বাসায় যাসনি?

-বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য এতো রাতে তোদের বাসায় ঢুকিনি।

-মাই গড! কেউ যদি দেখে ফেলতো?

অভ্র দায়সারাভাবে জবাব দিল-

-দেখুক, আই ডোন্ট কেয়ার। 

থেমে

-তুই কি আসবি নাকি আমি আবার বাসায় ঢুকবো?

আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম- 

-আসছি।

রেলিঙে ঠেস দিয়ে কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অভ্র। আমি যেতেই পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালো। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো আমার মুখপানে। তারপর মৃদু কন্ঠে বললো-

-চোখ বন্ধ কর।

আমি ভ্রু কুঁচকে শুধালাম –

-কেনো?

-যেটা বললাম সেটা কর। নো কুয়েশ্চন। 

আমি বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।

ও ঠিক কি করতে চাইছে আমার বোধগম্য হলোনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে  অভ্র আমার হাতটা আলতো করে ধরে কিছু একটা পড়িয়ে দিল আমার অনামিকায়। তারপর নরম কন্ঠে বললো- 

-চোখ মেল।

 আমি আস্তে আস্তে চোখ মেলে আঙুলের দিকে তাকালাম। তারপর দেখলাম আমার হাতে জ্বলজ্বল করতে লাগলো একটা সোনার আঙটি। আমি কিছুক্ষণ থম মেরে দাড়িয়ে রইলাম। তারপর তীক্ষ্ণ চোখে, প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। অভ্র কোনো জবাবের আশায় না থেকে আমার লতানো কোমড় আকরে ধরলো। মুহুর্তেই তুফান নেমে এলো আমার বিশীর্ণ দেহে। ওর অবাধ্য হাতের স্পর্শ দৃঢ় হতেই আমার শরীরের রক্তপ্রবাহে শীতলতা বাড়তে লাগলো!শিহরণে থমকে আসতে চাইলো সারা শরীর! 

অভ্র এবার আমার আরো নৈকট্যে আসলো। নিজের উষ্ণ ঠোঁটের চুম্বন বসিয়ে দিল আমার কপোলে! তারপর চোখের আরো নৈকট্যে এসে ফিসফিস কন্ঠে বললো-

-“অপলক চোখ যেনো কার

তোমার চোখের পাশে-হয়তো আমার”

-সঞ্জয় ভট্টাচার্য “

“শুভ জন্মদিন,প্রিয়তমা”

চলবে…..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *