“আমার একলা আকাশ থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে,
আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে তোমার কাছে এসে
শুধু তোমায় ভালোবেসে,
তুমি চোখ মেললেই ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে
ভোরের শিশির মুখ ছুয়ে যায় তোমায় ভালোবেসে”
আমার সাদা-কালো জীবনে ঠিক এমনভাবে রঙীন ফুল হয়ে আগমন ঘটেছিল অভ্রের। বারোটা বসন্ত ধরে অভ্র আমার চোখের সামনে থেকেই নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে এসেছে। একটু একটু করে ও যত্ন করে এসেছে আমার নেতিয়ে যাওয়া শুকনো প্রানটার। প্রজাপতিদের মতোন সারাক্ষন উড়ে বেড়াতো আমার চোখের সামনে,মনের গহীনে। আমাকে বটবৃক্ষের মতোন ছায়া দিয়ে আগলে রাখা এই মানুষটার অনুপস্থিতি আমায় ভীষণ যন্ত্রতা দিচ্ছে! ভীষণ রকম যন্ত্রতা! চোরাবালির মতোন সহজেই ধৈর্য হারিয়ে আমি নিজেকে শুধালাম “ইজ ইট পসিবল দ্যাট ইউ আর লিভিং উইথদ্আউট আ পার্সন ফ্রম হোম উই হ্যাভ লার্নট, হাউ টু লিভ??”
হক মঞ্জিল নিস্তব্ধতার ভার পরেছে। এই ব্যস্ত নগরীও যেনো কোলাহল শূন্যতায় মুড়েছে আজ। চারিদিকে কেবল দুর্জ্ঞেয় নীরবতা। কোনোকিছুতেই শান্তি নেই,নেই একটুখানি স্বস্তি। আস্ত প্রানটা ফাঁসফাঁস করে আটকে আছে। দরজা বন্ধ করে পড়ার টেবিলে মুখ গুজে আমি বসে আছি সকাল থেকেই। একটু পরপর ভাইয়া আর আম্মুর ডাকাডাকিতেও কোনো কাজ হলোনা। বেশ অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে আমি দরজা খুলে দিলাম। ওদের সাথে কথা বলার প্রয়োজনবোধটকুও করলামনা আমি। আমাকে দেখামাত্রই আম্মু গগন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কোনো শব্দ করলামনা। আম্মু এবার শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে করুন স্বরে বলতে লাগলো-
– না খেয়ে আর কতোদিন এভাবে পরে থাকবি বল? তুই এমন করলে আমরা শান্তিতে থাকবো কিভাবে? আমিতো চেষ্টা করেছি তোর আব্বুকে বোঝানোর,ফায়দা হলো কই? বসে আছেন তিনি নিজের জেদ নিয়ে।
আম্মুর কথার কোনো জবাব আমি দিলামনা। নির্বিকার ভঙ্গিতে পূর্বের ন্যায় বসে পরলাম টেবিল চেয়ারে। কিছুক্ষণ একে অপরের দিকে চেয়ে ভাইয়া আমার পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তারপর পরম স্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শুধালো-
-খুব ভালোবাসিস অভ্রকে?
ভাইয়ার কথায় আমি মুখ তুলে চাইলাম। কথাটা শোনামাত্রই আমার কি হলো আমি বুঝতে পারলামনা। আমি তপ্ত নিশ্বাস ফেলে টলমল চোখে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভাইয়া আমার মাথাটা নিজের বুকে ঠেকিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমিও ভাইয়াকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট উল্টে আকুল স্বরে বলতে লাগলাম-
-অভ্র আমাকে খুব ভালো রাখবে ভাইয়া। ও আমায় কখোনো কষ্ট দিবেনা। ওর মতোন করে আমাকে কখোনো কেউ ভালোবাসবে না বিশ্বাস করো। তুমি প্লিজ আব্বুকে বোঝাও ভাইয়া, প্লিজ বোঝাও! ও নিশ্চই এখন খুব কষ্ট পাচ্ছে!
বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম আমি।
ভাইয়া আমার মাথায় হাত রেখে কোমল কন্ঠে বললো-
-আমি আর আম্মু গতকাল রাত থেকেই বুঝানোর চেষ্টা করছি,কোনো লাভ হলোনা। আব্বুকে তো চিনিসই। কিছু একটা পছন্দ হবেনা বললে সেটা উনাকে পছন্দ করানো খুব মুশকিল হয়ে যায়। সেটা যতো পার্ফেক্ট কিছুই হোক না কেনো।
ভাইয়ার কথায় আমার রাগ তরতর করে বেড়ে গেলো। টেবিলের কাঁচের ফুলদানিটা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেললাম ফ্লোরে। একে একে ঘরের সব কিছু টেনে হেচরে ফেলে দিতে লাগলাম আমি। পুরো ঘরটাকে এলোমেলো করেও আমার স্বস্তি মিললোনা । আম্মু আর ভাইয়ার চোখ মুখ শান্ত। আমাকে আটকানোর প্রয়োজনবোধ করলো না ওরা। কেবল আক্ষেপ মুখে শান্ত চোখে চেয়ে রইলো। ফোপাঁতে ফোপাঁতে চিৎকার করে এবার আমি বলতে লাগলাম-
-আমি কষ্ট পাচ্ছি সেটা কারোর দেখতে হবেনা। আমাকে কষ্ট দিয়ে উনাকে জেদ নিয়ে বসে থাকতে বলো। আমাকে একটা সমস্যা দেখাতে বলো অভ্রের মাঝে? আমার পছন্দ কি এতোই তুচ্ছ?
বলেই টেবিলের কাঁচের গ্লাসটা ছুরে ফেললাম ফ্লোরে। সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ে একটা কাঁচের টুকরো এসে ঢুকে পরলো। মুহুর্তের মধ্যেই ঝরঝর করে রক্ত পরতে শুরু করলো পা থেকে। আম্মু আঁতকে উঠে আমার কাছে আসতে নিতেই আমি পূনরায় প্রবল শব্দ করে ধমকের স্বরে বললাম-
– খবরদার কেউ আমার সামনে আসবে না।
আমার চিৎকার চেচামেচি তে আব্বু ছুটে আসলো। আব্বুর আগমনে ভাইয়া আর আম্মু কিঞ্চিৎ ভিত হলেও,কোনো এক দৈব বলে আপনাআপনি আমার মধ্যে সাহস সঞ্চিত হলো। আমি গলার স্বর দ্বিগুণ বাড়িয়ে বলে উঠলাম-
-আমাকে মেরে ফেলো তোমরা প্লিজ। আমি ভালো থাকবো এটা তোমরা মেনে নিতে পারছোনা। মেরে ফেলো আমায়! এভাবে মানসিক রোগী হয়ে আমি আর বাঁচতে পারছিনা,আব্বু! আর পারছিনা!
আমার চেচামেচি তে আব্বু টু শব্দটি পর্যন্ত করলো না। কিছুক্ষণ আমার পায়ের দিকে চেয়ে থেকে চুপচাপ রুমে ফিরে গেলো। আব্বুকে নির্বাক দেখে আম্মু চেচিয়ে বলতে লাগলো-
-আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে খুব শান্তি হচ্ছে উনার। থাকুক শান্তিতে। আমি আর থাকবোনা তোমার বাড়িতে। যেখানে আমার সন্তানদের পছন্দের মুল্যায়ন হয়না সেখানে থাকার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
নিশির শেষ প্রহর। গত দুদিন ধরে ঠিক মতোন খাওয়াদাওয়া না হওয়ার কারনে দুর্বলতা বাসা বেঁধেছে শরীরে। তার উপর দুপুরে পা থেকে রক্ত বের হওয়ার কারনে দ্বিগুণ ক্লান্ত লাগছে। ব্যান্ডেজ করা পায়ে আহত মরিচিকার মতোন পরে রুইলাম জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। জানালার গ্রিল হয়ে বৃষ্টি রা ঘরের মেঝে ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। জানালার পাশে বসে বৃষ্টির সঙ্গে আমার কথোপকথন হলো বেশ অনেকক্ষণ ধরে। কিছুক্ষণ এভাবেই বসে থাকার পর হঠাৎ ফোন বেজে উঠলোঃ আমার। ফোনের স্ক্রিনে আন্টির নাম্বার টা দেখতে পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে রিসিভ করলাম-
আন্টি ভাঙা ভাঙা গলার স্বর শোনা গেলো-
-কেমন আছিস, মা?
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড় করে নিশ্বাস ফেলে জবাব দিলাম-
-ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
আন্টির ফোঁপানো শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আন্টি বললো-
-কিভাবে ভালো থাকি বল? তোরা ভালো থাকতে দিচ্ছিস আমাকে?
থেমে পূনরায়
-আমার ছেলেটা তোকে ছাড়া শেষ হয়ে যাচ্ছে রে, মিতু!
আন্টির আকুল কন্ঠে আমি আঁতকে উঠলাম। ছটফট করতে করতে শুধালাম-
-কি হয়েছে ওর?
আন্টি নাক টেনে জবাব দিল-
-আজ দু’দিন ধরে বাসায় আসছেনা। কোথায় আছে কি করছে কিচ্ছু জানিনা। ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কারোর বাসায় যায়নি। ভাবলাম তোকে একটু ফোন করে জিজ্ঞেস করি কোনো খোঁজ পেয়েছিস কিনা।
থেমে
-আমার ছেলেটা কেমন শান্ত হয়ে গেলো রে মিতু! আমার অভ্রটা এমন ছিলনা! সেদিন কি হয়েছে জানিস? আমি নামাজে বসেছি, অভ্র চুপচাপ আমার রুমে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। নামাজ শেষ হতেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার কোলে শুয়ে দুই হাত দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো “আম্মু আমার খুব যন্ত্রতা হচ্ছে তুমি একটু দোয়া পড়ে আমার মাথায় ফু দিয়ে দাও। যাতে আমার যন্ত্রতা একটু কমে। আমি আর পারছিনা আম্মু!”
আন্টির কথায় আমার গলায় কথারা সব আঁটকে আসতে চাইলো।ওকে নিয়ে চিন্তার পরিমান দ্বিগুণ হয়ে উঠলো আমার। দুঃশ্চিতায় নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম-
-তুমি চিন্তা করোনা আমি দেখছি।
রাত তিনটায় অভ্রের ফোন খোলা পাওয়া গেলো। বেশ অনেকক্ষণ যাবত রিং হলেও অপর প্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ হলোনা। আমার ছটফটানি আরো বাড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ পর ফোন এলো অভ্রের নাম্বার থেকে। আমি চটজলদি ফোনটা রিসিভ করে হাঁপাতে হাঁপাতে শুধালাম-
-কোথায় আছিস তুই?
কোনো জবাব এলোনা। আমি পূনরায় জিজ্ঞেস করলাম-
-অভ্র প্লিজ কথা বল।
– কি করলে একটু স্বস্তি পাবো বলতে পারিস?
অভ্রের আক্ষেপভরা কন্ঠ শোনা গেলো। আমি কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বললাম-
-কোথায় আছিস?
-তোর বাসার সামনে।
আমি ধড়ফড়িয়ে বারান্দার দরজা মেলে দিলাম। অভ্রের স্নিগ্ধ মুখটা ভেসে আসলো চোখের সামনে। সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকা ছেলেটাকেও কেমন এলোমেলো দেখালো আজ। ওর চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তিভাব। করুন চোখে আমার মুখটায় তাকিয়ে থেকে মৃদু করে হাসলো অভ্র। আমার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পরলো এক ফোঁটা পানি। এই বুঝি প্রানটা আমার যাইযাই করে উঠলো। আমি দুর্বলতা আরাল করার চেষ্টা করে নিষ্ঠুর স্বরে বললাম-
-আন্টি টেনশন করছে খুব,বাসায় যা।
অভ্র পূনরায় মৃদু হেঁসে শুধালো-
-তুই টেনশন করছিসনা?
আমি জবাব দিলাম না। কিছুক্ষণ এভাবেই তাকিয়ে রইলাম ওর কোমল চেহারায়। কি ভেবে পাশের বারান্দায় ফিরে তাকাতেই আব্বুকে চোখে পরলো। পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে কেমন শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আব্বু। আব্বু-আম্মুর রুমটা আমার রুমের পাশাপাশি হওয়াতে আব্বুর আগমন সহজেই আমার চোখে পরলো। আব্বুকে দেখার পরও আমার এতোটুকুও ভয় হলোনা। অভ্রও পূর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে শির নিচু করে। অভ্রের স্নিগ্ধ মুখটা দেখেও আব্বুর মায়া হলো কিনা আমি বুঝতে পারলামনা। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পূনরায় রুমে ফিরে গেলো আব্বু। আমি নিরাশ চোখে চেয়ে রইলাম আব্বুর যাওয়ার পানে।
দুই দিন পর।
অতিরিক্ত রাত জাগার কারনে আজকে সকাল দশটায়ও আমার ঘুম ভাঙলোনা। এগারোটার সময়ে কয়েকজনের হাসাহাসির আওয়াজে বিরক্তি নিয়ে চোখ মেলে তাকালাম আমি। চোখ মেলতেই আঁতকে উঠলাম। ভুতের মতোন চারজোড়া চোখের মালিকগন নিজেদের অতি মূল্যবান শিরসমূহ এক করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এদের দেখা মাত্রই আমি ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। আর এই চার শির সমূহের মালিক সমাজ আর কেউ নয় আমার অতি গুনধর চার বন্ধু, সিফাত,মেঘা,রুম্পা,জাহিদ। আমি তাকাতেই ওরা একসাথে চেঁচিয়ে বলে উঠলো-
-শাদি মোবারক বন্ধু!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ন্যায় কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম। আমি কিছু বলার আগেই আম্মু কোথা থেকে ঝড়ের গতিতে উড়ে এসে হাসিহাসি মুখ করে তোড়জোড় করে আমাকে গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলেন। আধাঘন্টা পর গোসল থেকে বেড়োতেই আন্টি আর ভাবীকে চোখে পরলো। আমাকে দেখামাত্রই সদ্য কেনা স্টোনের কাজ করা শাড়ীটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ভাবি শুধালেন-
-নিজে নিজেই পরতে পারবে? নাকি আমি পরিয়ে দেবো?
আমি তখনো আমার বিস্ময়ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছিনা। অবাক হওয়ার চরম পর্যায় পিঠ ঠেকিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব চোখে ভাবির দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। উত্তরে তিনি রহস্যময় লাজুক হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে আলতো করে আমার নাক টেনে দিয়ে চলে গেলেন। সবকিছু এমন তড়িৎ গতিতে ঘটছে যে আমি আমার কৌতুহলী চোখ কারোর উপর ফেলবো এমন সময়ই পেলামনা। হতবুদ্ধি হয়ে বসে বসে কিছুক্ষণ দাঁত দিয়ে নোখ খুঁটলাম তারপর মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে নিজেই নিজেকে শুধালাম-
-আর ইউ ড্রিমিং, মিতু? অর ইট ইজ অ্যা কোয়েন্সিডেন্স?
তারপর নিজেই সেটার উত্তর দিলাম-
-নো, ইউ আর নট ড্রিমিং। দ্যিস ইজ হোয়াট ইউর ডেস্টিনেশন ইজ।
বি:দ্র কিছু কিছু দিন থাকে, দিন ভালো,ওয়েদার ভালো,অফ ডে স্টিল রাইটিং ব্লকে ভুগতে হয়। আজকের দিনটা কিছুটা শব্দভান্ডার ফুরিয়ে যাওয়ার দিন।
চলবে…….