তাঁর চোখে আমার সর্বনাশ [পর্ব-০২] 

আমাদের প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধা হয়ে আসে। স্টেজে উঠে আমি দু একবার অভ্রকে খুঁজেছিলাম। ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছটার সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অভ্র। ওর চোখে মুখে শুধুই গাম্ভীর্যতা,আমি যেনো সেসব কোনো তোয়াক্কাই করলামনা। আমাদের নাচ শেষ হতে না হতেই  আশেপাশে হইচই শুরু হয়ে গেলো। স্টেজের আশেপাশে যাঁরা ছিল তারা সবাই দৌড়ে অভ্রদের হলের দিকে ছুটতে লাগলো। আমরাও কিছু না বুঝেই দৌড়াতে লাগলাম। প্রফেসর মফিজুর রহমান স্যার,নাবিলা কামাল ম্যামও দৌড়চ্ছেন সেদিকেই। হলের করিডরে দিক দিশা ভুলে দৌড়াচ্ছে রিয়াদ,আর ওকে ধরার জন্য পেছনে অভ্র দৌড়াচ্ছে, অভ্রের পেছনে ছুটছে পুরো ক্যাম্পাস। রিয়াদের নাকে মুখে রক্ত লেগে আছে। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলামনা অভ্র ওকে কেনো মারছে। আমার আর ভীড় ঠেলে সেদিকে যেতে ইচ্ছে হলোনা। প্রচুর রাগ হলো অভ্র টার উপর। ওর এসব কাজের জন্য না ওর পড়াশোনায় কোনো প্রভাব পরে, আমি আছি সে-ই চিন্তায়। অবশ্য ক্যাম্পাসের সকলে অভ্রকে এতো ভালোবাসে যে কোনো ঝামেলা হলে নিসন্দেহে সবাই অভ্রের পক্ষই নেবে। এদের ধারনা, অভ্র কখনো অন্যায় কিছু করতে পারেনা,যদি করে সেটার পেছনেও ন্যায় কারন রয়েচে নিশ্চয়ই। ওকে এতো ভালোবাসার কারন শুধুই যে ভালো রেজাল্ট, তা না। মানুষ হিসেবে অভ্র সেরা দের সেরা, এমনটাই সকলে মনে করেন। ক্যাম্পাসের যে কারো বিপদে অভ্রই সবার আগে এগিয়ে যায় সাহায্যের জন্য। মফিজুর স্যার তো প্রায়ই বলেন-

-” ইউ হ্যাভ আ স্ট্রং লিডারশীপ কোয়ালিটি অভ্র। এটা ধরে রেখো আজীবন”

এসব ভাবতে ভাবতে দেখলাম মেঘা হাঁপাতে হাঁপাতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। 

আমি জিজ্ঞেস করলাম-

-কিরে এমন সাপের মতোন ফোঁস ফোঁস করছিস কেনো?

-দোস্ত প্লিজ রিয়াদকে বাঁচা, অভ্র ওকে মাইরাই ফেলবো আজকে!

আমি হতচকিত হওয়ার স্বরে জিজ্ঞেস করলাম-

-মানে? অভ্র এখনো মারতেছে? কিন্তু কারন টা কি? জানিস কিছু?

-আরে ভাই আমরা স্টেজে যখন নাচতেছিলাম? রিয়াদ নাকি জুম করে তোর ভিডিও নিছে। ভিডিও টা নরমাল হলে অভ্র এতো রাগতো না কিন্তু ও স্পেসিফিক্যালি তোকেই জুম করছে, আর এমন এমন অ্যাঙ্গেলে ভিডিও টা করছে কি বলবো তোকে! ভিডিও টা করার সময় আশেপাশের কয়েকজন দেখছে ওরাই অভ্রকে জানাইছে।

মেঘার কথা শুনে আমি যেনো আকাশ থেকে পরলাম। রিয়াদ বেয়াদবটার জন্য আমার ঘৃণা যেনো শতগুণ বেড়ে গেলো। এই মুহূর্তে ওকে খু*ন করে ফেলতে ইচ্ছে হলো আমার।

-দোস্ত প্লিজ ওকে বাঁচা,ওর আব্বা কিন্তু এলাকার কমিশনার। কিছু একটা দূর্ঘটনা হইয়া গেলে বিপদে কিন্তু অভ্রই পরবো!

মেঘার কথায় আমি যেনো সম্বিত খুঁজে পেলাম। ঠিকি তো, আমার কারনে কেনো অভ্র সাফার করবে? তাছাড়া ভুলটা তো আমারি? আর কোনোকিছু চিন্তা না করে দৌড় লাগালাম। অভ্র এখনো বেধড়ক ভাবে পেটাচ্ছে ওকে। আশেপাশের কেউ ওকে আটকে রাখতে পারছেনা। ভীড় ঠেলে আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। অভ্র আমাকেও গ্রাহ্য করলো না। গরম চোখে শুধালো –

-সর সামনে থেকে!

আমি সরলামনা ওর হাত থেকে লাঠি টা নিয়ে ওঁকে দুই হাত দিয়ে জাপ্টে ধরে ঝরঝর করে কাত্তে কাত্তে বললাম-

-আর মারিসনা অভ্র! প্লিজ বাসায় চল!

অভ্র কিছুই বললো না। হাতের লাঠিটা একপাশে ফেলে আমাকে ছাড়িয়ে নিঃশব্দে প্রস্থান নিলো। 

সেদিনের পর থেকে অভ্রের সাথে আমার চারদিন যাবত কোনো কথা হয়নি। আমি অনেকবার ফোন করেছি,টেক্সট করেছি ও কোনোকিছুরই রেসপন্স করেনি। এই প্রথম অভ্র আমার সাথে এতোদিন কথা না বলে থাকলো। রাতে ছাঁদে উঠে ওঁর বারান্দার দিকেও তাকিয়ে থেকেছি প্রতিদিন। আমাকে দেখামাত্রই অভ্র রুমে চলে যেতো। অভ্রের এমন অদ্ভুত রুপ আমি আগে কখোনোই দেখিনি। আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেলো। 

পঞ্চম দিনে আমি এদিক সেদিক চিন্তা না করে সোজা অভ্রদের বাসায় চলে গেলাম। কলিংবেলে চাপ দিতেই আন্টি হাসি মুখে দড়জা খুললো। যেনো আমার উপস্থিতি উনাকে একটুও অবাক করেনি। কিংবা আমি আসবো বলেই জানতেন আন্টি।

আমাকে দেখামাত্রই জাপ্টে ধরে অভিমানী মুখ করে বললেন-

– আন্টির কথা কি একটুও মনে পরেনা তোর? বাসা থেকে বেড়িয়ে দু পা এগুলেই তো আসতে পারিস। এতো নিষ্ঠুর হলি কবে থেকে রে?

আমি আন্টিকে জড়িয়ে ধরে বললাম-

-তুমিও তো আসোনা আমাদের বাসায়,নিষ্ঠুর কি আমি একা???

রুম থেকে অয়ন ভাইয়ার স্বর শুনা গেলো। 

-কিরে মিতু থাকিস কোথায়? তোকে তো দেখিই না রে। ভার্সিটিতে উঠে বুঝি বড় হয়ে গেছিস? তাহলে বিয়ে টিয়ে দিয়ে দেই, কি বলিস?

 অয়ন ভাইয়ার কথায় ভাবী আর আন্টি একসাথে হেঁসে ফেললো। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম-

-হ্যা তা তো দেবেই, খুব জ্বালাচ্ছি না তোমাদের? 

ভাবী আমার হাত ধরে টেনে ঘরে নিতে নিতে বললেন-

-হয়েছে ভাই বোনেতে মিলে পরে ঝগরা করবে,মেয়েটাকে বাইরে দাঁড় করিয়েই রাখার ইচ্ছে নাকি তোমাদের? 

সোফায় বসে আমি, অয়ন ভাইয়া আর আন্টি মিলে ক্রিকেট খেলা দেখছি। খেলা না বুঝলেও আমার ভীষণ মজা লাগছে।  ভাবী একটু পরপর এটা সেটা নাস্তা বানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।  অয়ন ভাইয়া একটু পরপর লাফিয়ে ইঠে মাথায় হাত দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলছে-

-শিট! শিট মিতু আজকেও মনে হয় হারবো রে! 

সবার সাথে খুশগল্পে কখন দুপুর হয়ে গেলো আমি খেয়ালই করলামনা। এতোকিছুর মধ্যে আমি অভ্রের কথাই ভুলে গেলাম। আন্টি আর ভাবী আমাকে কিছুতেই বিকালের আগে যেতে দিবেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আম্মুকেও ফোন করে জানিয়ে দিলেন যেনো আমাকে নিয়ে চিন্তা না করে,বিকালে অয়ন ভাইয়া দিয়ে আসবে বাসায়। দেড়টার মধ্যে প্রায় সকলের খাওয়াই শেষ,খেলামনা শুধু আমি। অভ্রের কথা জিজ্ঞেস করায় আন্টি বললো “বাইরেই আছে কোথাও,চলে আসবে তুই খেয়ে নে” আন্টিকে বললাম অভ্র এলেই আমি খাবো । এটা শুনে  আন্টি আর আমাকে জোর করলেন না,মিটিমিটি হাসলেন। আমি এই হাসির অর্থ খুজে পেলামনা।

 দুপুর ২ টার দিকে অভ্র কাকভেজা হয়ে বাসায় প্রবেশ করলো। আন্টি হন্তদন্ত পায়ে ওকে তোয়ালে এনে দিল। অভ্র তখনো আমাকে খেয়াল করেনি। কিছুক্ষণ পর গোসল শেষ করে পরনে একটা তোয়ালে পেচিয়ে, খালি গায়ে, আরেকটা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলো। এসেই আমাকে সোফায় বসে থাকতে দেখেও অভ্র একটুও চমকালো না,এমনকি কথাও বললো না। আমি আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিজে থেকেই বললাম-

-কেমন আছিস অভ্র? ফোন ধরিসনা কেনো তুই? তোর সাথে কথা না বললে আমার মাথা কিলবিল করে বন্ধু!

অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে একবার দেখে নিলো। আমার কথার জবাব না দিয়ে বললো-

-খেয়েছিস?

-নাহ

-আমিও খাইনি, উঠ আমাকে ভাত বেরে দিবি!

আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে রইলাম। বলে কি? যে-ই মেয়েকে এখনো আম্মু ভাত মুখে তুলে না দিলে খায়ই না তাকে কিনা ভাত বেরে দেয়ার আদেশ করা হচ্ছে?

 অভ্র আমায় হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূনরায় বললো-

-কথা কানে গেলোনা মনে হয়? আমি না খেয়ে আছি কেউ কি শুনতে পেলো? 

আন্টি অলরেডি সব খাবার টেবিলে গুছিয়ে রেখেছিলেন আমাদের জন্য, আমি সেগুলোই অভ্রের প্লেটে একটু একটু করে বেরে দিলাম। তারপর বসে নিজের প্লেটে ভাত  নিতে যেতেই অভ্র আমার হাত টেনে ধরলো। 

-কি হলো?

অভ্র কোনো জবাব দিল না। তারপর নিজের প্লেটের খাবার থেকে মেখে আমাকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য হাত বারালো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। আমাকে চুপ থাকতে দেখে অভ্র বললো-

-হা করবি? নাকি দিবো এক চর?

আমি হা করলাম অভ্র আমাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। রান্না এতো ভালো হয়েছে যে আমি খেয়ালই করলামনা অভ্র শুধু আমাকেই খায়িয়ে দিচ্ছে, নিজে কিছুই খাচ্ছেনা। আমি ভাত মুখে নিতে নিতে বললাম-

-তুই খাচ্ছিস না যে?

অভ্র এবারো কিছুই বললোনা। খাওয়া শেষ হলে নিজ হাতে খাবারগুলো গুছিয়ে রাখলো,তারপর প্লেটগুলো ধুতেধুতে বললো-

-বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি আমি।

অভ্রকে আমি বহু সময় ধরে চিনি। আবার যেনো একদমই চিনিনা। মাঝে মাঝে আমার ভীষণ কৌতুহল হয় অভ্রকে জানবার জন্য! এই ছেলেটাকে মাঝেমাঝে আমার কেমন অন্যরকম মনে হয়! এই অভ্র প্রতি কাজে আমায় উপলব্ধি করায়, সে আমায় প্রতিনিয়ত বিস্ময় করা থেকে কখোনোই বিরত থাকবেনা!

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভ্র বললো-

-চা খাবি?

আমি মাথা উপরনিচ করে বুঝালাম হ্যা খাবো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অভ্র চা বানিয়ে আনলো। আমি চা খেতে খেতে টিভি দেখছি আর অভ্র আমার পাশে বসে কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। আমার বারবার মনে হচ্ছে অভ্র আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, আমি পাশ ফিরে তবুও তাকাইনা। অভ্রের অনেক আচরনের অর্থ আমি বুঝি তবুও যেনো বুঝিনা। ওর চোখ দুটো প্রতিবার আমায় অনেককিছুই বলে,আমি তবুও মুখ ফিরিয়ে নেই এবং তাঁদের  জানিয়ে দেই, আমি তার চোখদ্বয় পড়তে ইচ্ছুক নই। কোথায় যেনো একটা বেরিকেট আমার,আবার কোথাও তীব্র যন্ত্রনা অভ্র বিহীন। এতোকিছুর মধ্যেও যেটা আমি চাইলেও অস্বীকার করতে পারিনা তা হলো,অভ্র আছে বলেই মিতু ভালো থাকে,অভ্রই তাকে ভালো রাখে!

চলবে… ….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *