সেদিনের পর থেকে আমি অভ্রের সাথে কোনো কথাই বলিনি। আমি যে অভ্রকে পছন্দ করিনা ব্যাপারটা এমনও না। তবে, অভ্রের হটাৎ করা এমন আচরণে আমি মনে হয় অনেকটা অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলাম। কিছুতেই আমি ওর সেদিনের করা আচরণকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারছিলামনা। এই মেনে না নিতে পারার উত্তরও আমার জানা নেই। শুধু জানি আমার এই মুহূর্তে অভ্রকে খুব বিরক্তিকর কিছু বলে মনে হচ্ছে। এই কয়দিনে অভ্র আমাকে অজস্র বার ফোন করেছে, বাসায়ও এসেছে বহুবার। ওকে দেখামাত্রই আমি রুমে চলে যেতাম। আমার আচরণের প্রভাব হয়তো ওর উপর কিছুটা হলেও পরেছে। অভ্র গতো দু’দিন যাবত আমার সামনে আসেনি,এমনকি একবারও ফোন করেনি। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে, আমার আর যেচে ওকে ইগনোর করতে হচ্ছে না।
এক সপ্তাহ পর ভার্সিটিতে গেলাম আমি। অভ্র আসেনি ক্যাম্পাসে। তারপর আরোও কয়েকদিন টানা ক্যাম্পাসে অভ্রকে দেখতে পেলামনা আমি। সিফাতকে জিজ্ঞেস করায় বললো অভ্র গত দশদিন ধরেই ভার্সিটিতে আসছেনা। তার মানে দিপার বিয়ের পর থেকেই? এবার আমার কেমন চিন্তা হতে শুরু করলো। অভ্র ক্যাম্পাসে আসেনি এতোদিন? তাহলে আছে কোথায় হতচ্ছাড়া টা? বান্ধবীর থেকে পাওয়া গোপন রিজেকশনে দেবদাস হয়ে যায়নি তো?
বারোতম দিনে বারান্দার দোলনায় বসে আরাম করে বড়ুই এর আচার খাচ্ছিলাম আমি। বাসার সামনের গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে কেমন শকুন দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে শিশ বাজাচ্ছিল। লাল রঙের শার্ট পরা ছেলেটা জিভে বারবার ঠোঁট ভিজাচ্ছে। দেখেই আমার কেমন শরীর ঘিনঘিন করতে আরম্ভ করলো। চেহারায় কেমন বখাটে ছাপ দেখা গেলো ওদের। এদের অঙ্গভঙ্গি দেখে কেমন গা গুলিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। শান্তিমতো একটু বারান্দায়ও বসতে পারলামনা। এদের কারনেই এদেশে মেয়েরা এখনো অনিরাপদ। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বাপের টাকায় বখাটেপনা করে বেরাতেই এরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমার ইচ্ছে হলো এদের ধরে গণপিটুনি খাওয়াতে। কিন্তু আমি সেটা করলাম না। নিজের প্রতিবাদি ভাবনাকে দমিয়ে রুমে ফিরে গেলাম আমি। রুমে আসার দুই মিনিটের মধ্যেই বাইরে হৈচৈ শোনা গেলো। চিৎকার চেচামেচি তে আমি আর আম্মু দৌড়ে গেটের বাহিরে আসতেই দেখতে পেলাম ওই ছেলেগুলোর মধ্যে লাল শার্ট পরা ছেলেটা অভ্রের পা ধরে বসে আছে। আমাকে দেখামাত্রই ছেলেটা হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোর করে বলতে লাগলো-
-আপা মাফ কইরা দেন আর এমন করুমনা। ভাই রে কন ছাইড়া দিতে।
বলেই আবার কান্না শুরু করে দিল।
আম্মু কিছুই বুঝতে পারছিলোনা। কেমন বিস্ময় আর হতভম্ব হওয়ার ন্যায় তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর ইশারায় আমিও বোঝালাম যে আমিও কিছুই জানিনা। আমার থেকে উত্তর না পেয়ে আম্মু অভ্রকে জিজ্ঞেস করলো –
-কি রে, কি করেছে ওরা? মারছিস কেনো এভাবে?
অভ্র কিছু বলার আগেই ফারদিন বলে উঠলো-
-মারবো না কি করবো, শালাগো কত্তো বড় সাহস জানেন আন্টি? আমাগো ভা…….(অভ্রের দিকে একপলক চেয়ে) না মানে রাস্তা ঘাটে মাইয়াগোরে বিরক্ত করে তো। একটু আগেও আমাগো পরিচিত একজনরে উত্যক্ত করতেছিল। এগুলা তো ঠিক না তাইনা আন্টি? এর লাইগ্যা অভ্র ভাই ধইরা পিডাইয়া থানায় দিয়া আইতে কইলো।
ফারদিনের কথায় যেনো আম্মু খুশি হয়ে গেলো। ওর মাথায় বুলিয়ে বলতে লাগলো-
– খুব ভালো কাজ করছো বাবা । এদেরকে আসলেই পুলিশে দেওয়া উচিৎ। আর তোমাদের মতোন ছেলেরা আছে বলেই এদেশে এখনো অনেক অঘটনের হাত থেকে মেয়েরা বেঁচে যাচ্ছে। যে-ই মেয়েটাকে উত্যক্ত করেছে সেও তো তোমার আর অভ্রের বোনের মতোই তাইনা??
আম্মুর কথায় অভ্র হঠাৎ কেশে উঠলো। কাশতে কাশতে ফারদিনের দিকে গরম চোখে তাকাতেই ফারদিন দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে আম্মুকে বললো-
-না আন্টি আমার বইন হইলেই যে অভ্র ভাইয়েরও হইতে হইবো এমন কিন্তু কথা নাই। ধরেন আমার ফিউচার বউ কিন্তু সম্পর্কে আমার বউ কিন্তু অভ্র ভাইয়ের তো বউ না, সম্পর্কে অভ্র ভাই আমার বউয়ের ভাসুর। একইভাবে আমার বইন হইলেই ওই মাইয়া অভ্র ভাইয়েরও বইন হইতে হইবো এটা কিন্তু কোনো যুক্তি হইলোনা(শব্দ করে হাসার চেষ্টা করে) বুঝছেন আন্টি?
ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলোনা আম্মু। বিরক্তি নিয়েই বললো-
-কি আবোল তাবোল বকছো ফারদিন?
আম্মু আরো কিছু বলার আগেই ফারদিনের গালে একটা দাবাং মার্কা চর বসে গেলো। ফারদিন হতভম্ব চোখে গালে হাত দিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে। নিজের ইজ্জত বাঁচাতে এবার চরটা খাওয়ার পরেও হাসার চেষ্টা করে বললো-
-ভাই-ভাই হে হে! এসব কোনো ব্যাপার না আন্টি। অভ্র ভাই আমারে বেশি ভালোবাসে তো তাই।
অভ্রকে শুরু থেকেই চুপ থাকতে দেখে আম্মু এবার বলে উঠলো-
-কি রে অভ্র, কিছু হয়েছে তোর? তোকে তো আজকাল দেখাই যায়না রে। বাসায় আসিস না কতোদিন বলতো? চল বাসায় চল আজকে। তোর পছন্দের ঝাল ঝাল গরুর মাংস রান্না করেছি আজকে।
অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে একপলক দেখে নিয়ে বললো-
-কাজ আছে আন্টি, অন্য কোনোদিন যাবো।
-ইশশ! কি আমার কাজওয়ালা ব্যস্ত ছেলে রে! তোর আবার কি কাজ রে? কোনো কথা শুনবো না আমি,একদম মার খাবি আরেকটা কথা বললে। চল।
রীতিমতো টেনে হেচরেই আম্মু অভ্রকে বাসায় নিয়ে এলো।
সোফায় বসে বসে পৃথিবীর অষ্টমত আশ্চর্য দেখছি আমি। শুধুই যে দেখছি তা না, আবিষ্কার করছি। এই অদ্ভুত বেটাকে কি করে নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড বানিয়ে এতোগুলো বছর অতিবাহিত করলাম সেটাই বুঝতে পারছিনা। আরে বাপ তুই যে রাগ করেছিস ওইটার ডেইট কি এতো তারাতাড়ি ফেইল হয়ে গেলো? এট লিস্ট আত্মসম্মানের খাতিরে একটা মাস নিজের রাগ এর লাস্টিং করাইতি। তা না উল্টো ঢেঙঢেঙিয়ে বাসায় এসে কেমন করে গিলছে দেখো? মনে হচ্ছে তার রেজিস্ট্রি করা শশুর বাড়ি। আর আমার মা যেমন আদিখ্যেতা করে সেবা করে খাওয়াচ্ছে এইসব নাটক বুঝি স্টার জলসার সিরিয়ালকেও হার মানাবে।
খাওয়া শেষ করে অভ্র ধুম করে সোফায় আয়েশ করে বসে আমার হাত থেকে রিমোট টা নিয়ে নিলো। আমি গরম চোখে তাকাতেও কোনো ফায়দা হলোনা। আমাকে কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করেই সে কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে ক্রিকেট দেখছে।
-তোরা টিবি দেখছিস? আচ্ছা শোন আমি একটু বাজারের দিকে যাচ্ছি টুকটাকি মশলা কিনতে হবে।
আম্মুর কথায় অভ্র লাফিয়ে উঠে বললো-
-কি কি আনতে হবে? আমাকে বলো আমি এনে দিচ্ছি।
-তুই যাবি? কখনো করেছিস বাজার তুই? যেতে হবে না আমি নিয়ে আসি।
বলতেই অভ্র জোর করে বাজার করার ব্যাগটা আম্মুর কাছ থেকে নিয়ে নিল-
-কখনো করিনাই তো কি হয়েছে? এখন না শিখলে পরে তো বউ আমার বিপদে পরবে। আমি থাকতে আমার বউ না খেয়ে থাকবে না তো হতে পারেনা। অভ্রের বউ মানে অভ্র তাকে মাথায় করে রাখবে(আমার দিকে একপলক চেয়ে)
থেমে পুনরায় –
-কিন্তু সেসব কি আর কেউ বুঝে আন্টি? এতো আরাম আয়েশ কারোর সহ্যই হয়না। তাই বিনা দোষে কেউ যে অভ্রকে ডজনখানেক বছর ধরে শুধু দূরত্বই দিয়ে যাচ্ছে, সেটা কারো চোখেই পরছেনা !(শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে)
অভ্রের কথায় আম্মু হো হা করে হেঁসে ফেললো।
-বলিস কি? আমার লক্ষি অভ্রকেও কেউ দুঃখ দিতে পারে? হে রে তুই প্রেমে টেমে পরিসনি তো? তোর কথাবার্তা কিন্তু ঠিক লাগছেনা আমার। তবে যা-ই বলিস বিয়ে করলে একটা গুনি মেয়েকে করবি বুঝলি। আমরা দেখে শুনে বিয়ে করাবো।
অভ্র আক্ষেপের স্বরে বললো-
-সে-ই ভাগ্য কি আর আমার আছে? আমার তো এমন মেয়েই পছন্দ যে আসলে কোনো কাজই পারবেনা,পারবে শুধু জামাই এর মাথা খেতে। খাবে নাহয় একটু মাথাই! এ আর এমন কি? শখের নারীর জন্য নাহয় নিজের অতি মুল্যবান মাথাটাই বিসর্জন দিলাম!
কথাটা বলেই অভ্র আমার দিকে একপলক তাকালো।
ওর এক একটা কথা আমার রাগ তরতর করে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সাথে আম্মুও। আম্মু কেমন দুঃখ প্রকাশ করে আবার ওকে সঙ্গ দিচ্ছে দেখো? দুনিয়ায় সকল প্রকার সার্কাস আমার ঘরেই!
তিরিশ মিনিটের মধ্যে অভ্র বাজার নিয়ে ফিরলো। আম্মু গোসল করছিলো বাথররুমে। আর আমি সোফার কাভারগুলো ঝারছিলাম। দড়জা খুলতেই অভ্রের ক্লান্ত চেহারা চোখে পরলো আমার।কপাল বেয়ে তরতর করে ঘাম পরছে ওর।কেমন নিষ্পাপ আর স্নিগ্ধ দেখালো ওকে!শ্যামবর্ন চেহারায় হাল্কা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, চেহারায় কেমন পুরুষত্ব ভাব ফুটে তুলেছে। আমি এর আগে কখনো অভ্রকে এমনভাবে খেয়াল করে দেখিনি। কেমন মায়াবী আর আদুরে! মুহুর্তেই আমার সারা শরীর বেয়ে রোমাঞ্চকর অনুভুতি ছেয়ে গেলো। আমাকে পলকহীন তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকের স্বরে বললো-
-কি সমস্যা? ব্যাগ গুলা নিয়া যে দাঁড়াই আছি চোখে লাগতেছেনা? একে তো এই গরমে একটা রিকশাও পাইলামনা তার উপর বাইরে দাঁড় করায়ে সং এর মতো সামনে দাঁড়াই আছোস সামনে। এতো কষ্ট কইরা আইলাম কই একটু বাতাস করবি, ওড়না দিয়া ঘাম মুইছা দিবি তা না, স্টেচু হইয়া দাঁড়াই আছে। তোর মন থেইকা কি মায়া, দয়া নামক শব্দ দুইটা নাই হইয়া গেছে রে? মূর্তির মতো দাঁড়াই না থাইকা সর সামনে থেইকা।
আমি হতচকিত হয়ে গেলাম ওর কথায়। এইটুকু একটা কারনে এতো কথা শোনানোর কোনো দরকার ছিল? গন্ডার একটা!
ড্রইংরুমের সোফায় বসে অভ্র ক্লান্ত মুখে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো-
-নিজ থেইকা না বললে তো বিষ ছাড়া কিছুই খাওয়াইবিনা। মাথায় তো গোবর ছাড়া কিছুই নাই। এক গ্লাস সরবত বানাই নিয়া আয় যা!
কতো বড় সাহস আমাকে?? মিতুয়া হক কে অর্ডার করা হচ্ছে?হাহ্! আজকে উপকার না করলে বেটা তোকে সত্যি বিষ খাওয়াইতাম।
-দাঁড়াই আছোস কেন? মনে মনে তো ঠিকি চৌদ্দ গুষ্টি তুইলা গালি দিতেছিস। অবশ্য তোর মতোন গোবর মাথার গালি কি হইতে পারে আমার জানা আছে। গন্ডারের গন্ডি পার কইরা অন্য কোনো গালি আবিষ্কার করার মতোন বুদ্ধি তোর নাই।
অভ্র বেশ আয়েশ করেই শরবত টা খেলো। কিন্তু মুখে বললো “খুবই বাজে বানাইছিস, এতো বাজে ট্রেনিং তোকে কোন ইউটিউবার দেয়? আন্টি এতো বাজে শরবত বানানো কিছুতেই শিখাবেনা। নেভার এভার”
বলতে বলতে আমার ওড়না দিয়ে কেমন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে মুখ মুছতে লাগলো। যেনো এটা তার অধিকারের মধ্যে পরে। আমি কিছুই বলতে পারলামনা। বরাবরের মতোই ওর আচরণে কাবু হয়ে গেলাম আমি। অভ্র চলে গেলো,সাথে রেখে গেলো অজস্র প্রশ্ন। এই বিরক্তিকর মানুষটা আমায় এতো নিখুঁতভাবে জানে! এই আমাকে আমার চেয়েও বেশি জানে! কি করে জানে? ইজ হি আ ম্যাজিক ম্যান? নাকি এই ম্যাজিক শুধু মিতুর ক্ষেত্রেই?
চলবে… …