যেহেতু পুষ্পদের দাদা বাড়িতে পৌঁছাতে পৌছাঁতে আমাদের প্রায় রাত হয়ে গিয়েছিল,তা-ই আন্টি আমাদের যাওয়ার সাথে সাথেই ডিনারে বসিয়ে দেয়। কোনোরকমে তারাহুরো করে খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম আমরা। তারপর মেঘা,রুম্পা আর আমি পুষ্পের বিছানাতেই শুয়ে পরলাম। অভ্রদেরও ঘুমানোর জন্য আলাদা রুম দেওয়া হয়েছে। ওরাও ক্লান্ত শরীর নিয়ে যে যার মতোন রাতে ঘুমিয়ে পরেছে।
ভোর পাঁচটা বাজেই হৈচৈ আর চেঁচামেচিতে আমাদের ঘুম ভেঙে গেলো। পুষ্পদের দাদার বাড়িটা সিলেটের গ্রামাঞ্চলে হওয়ার কারনে,এখানের সংস্কৃতিও অতো আধুনিক না। শুনেছি পুষ্পের দাদা এই গ্রামের চেয়ারম্যান। এখানে ওদের দাপটও নাকি অনেক। তা-ই আমাদের নিরাপত্তা নিয়েও এতো উদ্ধিগ্ন হতে হলোনা।
ঘুম থেকে উঠেই আমি আর মেঘা বাড়িটা ভালোভাবে ঘুরে দেখার জন্য বেরিয়ে পরলাম। বিশাল যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাসের জন্য চারতলা বাড়িটিতে কক্ষের সংখ্যাও অগণিত। বাড়িটা অন্তত পক্ষে বিশ, তিরিশ বছর পুরোনো বলেই মনে হয়েছে। সিঁড়ির ডিজাইনগুলোও অনাধুনিক সময়ের বলেই বোঝা গেলো। বাড়ির বাহিরে পশ্চিমের দিকে সিঁড়ির অবস্থান। অর্থাৎ যেকোনো ফ্লোর থেকে ছাদে যাওয়ার সময়ে অন্যান্য ফ্লোরের লোকজন সহজেই তাঁদের দেখতে পাবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বাড়ির প্রতিটা ফ্লোরই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম আমরা। তারপর ছাঁদের দরজার কাছাকাছি আসতেই আমরা আরোও চমকিত হলাম। কোথা থেকে যেনো একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসতে লাগলো। ছাঁদে পা রাখতেই মনে হলো কোনোভাবে ফুলের রাজ্যে এসে পরিনি তো? পুরোটা ছাঁদজুড়েই অজস্র রকমের ফুল গাছ। ছাঁদটাকে এই মুহূর্তে কোনো ফুলের বাগান বললেও ভুল হবেনা। ছাঁদের পূর্বদিকে দুটো কাঠের দোলনা দুলছে। দোলনার উপরে দু,একটা বই। হয়তো ভোরের দিকে কেউ এখানে বসে বই পড়ে। আমি একটা বই হাতে নিলাম। ইংরেজি সাহিত্যের মোটা একটা বই। বইটা দেখে বেশ কৌতুল হলো আমার। এই ছোট্ট, অনাধুনিক গ্রামে ইংরেজি সাহিত্যের বই পড়ার মতোনও মানুষ হয় সেটা ভেবে ভীষণ কৌতুহল বেড়ে গেলো আমার! বইটা রেখে এবার রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম আমি। শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মতোন ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতে শুরু করলো! এতো স্নিগ্ধ অনুভুতি আমি আগে কখোনো পাইনি! এই অরণ্যে ঘেরা বাড়িটির উপর কেমন মায়া জন্মে গেলো মুহুর্তেই! আশেপাশে তাকালে শুধু গাছ আর গাছ! এ যেনো এক অন্য জগৎ!
-মিতু,দোস্ত আমার অসম্ভব ভালো লাগছে রে! এখান থেকে এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না। ইশশশ! আমাদেরও যদি এমন একটা বাড়ি হতো! এতো সুন্দর যায়গা তে!
মেঘার কথায় আমি বেশ শব্দ করেই হেঁসে ফেললাম। দু’জনেই বেশ কিছুক্ষণ জায়গাটার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। তারপর রেলিংয়ের পেছন হয়ে ঘুরে তাকাতেই বাড়ির পুকুরঘাটে অভ্রদের দেখতে পেলাম। লুঙ্গি পরা অবস্থায় ঘাটের সিঁড়িতে বসে ছাই দিয়ে দাঁত মাজছে ওরা। হাফ হাতা গেঞ্জিতে, লুঙ্গি পরা অবস্থায় তিনটাকে কেমন অদ্ভুত দেখালো এই মুহূর্তে। লুঙ্গি গুলোর ডিজাইন দেখে মনে হলো, খুব সম্ভবত এগুলো পুষ্পের বাপ, চাচাদের লুঙ্গি । আমার ভীষণ হাসি পেলো ওদের এভাবে দেখে! মেঘা হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে উঠে উঠলো-
-হেইইই বয়েজ, খুব হট লাগছে তোমাদের!
সাথে সাথে সিফাত আর জাহিদের চেহারার রঙ পাল্টে গেলো। বেচারাদের চোখ, মুখ দেখে বোঝা গেলো এরা আগে কখোনোই লুঙ্গি পরেনি। তা-ই লজ্জাও এঁরাই বেশি পাচ্ছে। অবশ্য অভ্রও কখোনো লুঙ্গি পরেনি বলেই আমি জানি। তবুও, বেটার চেহারায় এতোটুকুও অস্বস্তি দেখা গেলোনা। কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁত মাজতে লাগলো অভ্র।
-মিতু, দেখ দেখ মেয়েগুলা কেমন লুচুদের মতোন অভ্রদের দিকে তাকাই আছে!
মেঘার কথায় আমিও ওর হাত অনুসরন করে তাকালাম। দু,তিন জন অল্পবয়সী মেয়ে ঘাটের পাশের বড় গাছটার ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অভ্রদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। বয়স ষোলো কিংবা সতেরোর বেশি হবেনা। খুব সম্ভবত এরা পুষ্পের চাচাতো,জেঠাতো বোন।
এই দৃশ্য দেখে রাগে আমার গা জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো মেয়েগুলোকে ধরে ঠাস ঠাস করে গালে চর বসিয়ে দেই। ওদের বিশেষ নজর যে অভ্রের দিকেই সেটাও আমি হারে হারেই বুঝতে পারলাম। নাটক আর না বাড়াতে, হনহনিয়ে নিচে নেমে পরলাম আমি।
– এক্সকিউজ মি,আপুরা কোন ক্লাসে পরছো?
মেঘার প্রশ্নে, মেয়েগুলোর মধ্যে দেখতে চঞ্চল ধরনের একজন জবাব দিল-
-আমরা ক্লাস টেনে পরছি আপু। আপনারা গতকাল এসেছেন তাইনা? ওইযে কালো টি-শার্ট পরা ছেলেটা উনিও কি আপনাদের ফ্রেন্ড?
স্থানীয় সিলেটি হওয়ার সত্বেও শুদ্ধ বাংলায় ওকে কথা বলতে দেখে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। অবশ্য আসার পর থেকে বাড়ির সবাইকেই শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলতে দেখছি। হয়তো এই বাড়ির নিয়মই এমন।
কিন্তু এই মেয়ে অভ্রকে এমন উনি উনি করছে কেনো?মেঘা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একবার চেয়ে পূনরায় ওদের জিজ্ঞেস করলাম-
-কেনো আপুরা? কালো টি-শার্ট পরা উনি কি করেছে তোমাদের সাথে?
ফর্সা দেখতে মেয়েটা লাজুক হেঁসে জবাব দিল –
-না না আপু উনি কিছুই করেনি। আসলে আমার উনাকে খুব পছন্দ হয়েছে! যদিও আমি দেখতে ফর্সা আর উনি শ্যামবর্নের,তবুও আমার উনাকেই ভালো লেগেছে। আচ্ছা উনি কি সিঙ্গেল?
ওর কথা শুনে আমি আর মেঘা যেনো আকাশ থেকে পরলাম। মেয়ে বলে কি? এইটুকুনি মেয়ে এই দামরা বেটারে নিয়ে স্বপ্নও দেখা শুরু করে দিছে! মাই গড! আবার কালারশ্যামিং হচ্ছে? বদের হাড্ডি একটা!
আমার চেহারা দেখে হয়তো মেঘা ভেতরের আকাশ বাতাস এক করা রাগটা বুঝতে পারলো। মেঘা বেশ স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিল-
-আহারে ছোট্ট আপু তোমার জন্য খুব মায়া লাগছে আমার!
মেঘার কথা শুনে মেয়েগুলো একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
মেঘা পূনরায় বললো
-তুমি দেখতে তো মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দরী! কিন্তু তোমার পছন্দ এতো বাজে কেনো সেটাই বুঝতে পারছিনা।(আফসোসের ন্যায়)
পুনরায় মেয়েগুলো নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তারপর একজন জিজ্ঞেস করলো-
-কেনো আপু? এভাবে কেনো বলছো?
মেঘা এবার বেশ সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে বলতে লাগলো-
-ওইযে কালো শার্ট পরা ভাইয়াটাকে দেখছো এই ছেলে তো বিবাহিত।
মেয়েগুলো বিস্ময় নিয়ে বললো-
-বলো কী!
-হ্যা।ওকে দেখতে জুয়ান মনে হলে কি হবে? ওর কিন্তু একটা সাত বছর বয়সি বাচ্চাও আছে। যাকে বিয়ে করেছে ওই মেয়েটাকেও এক রত্তি শান্তি দেয়না! আহারে দিনের পর দিন মার খেয়েও বেচারী বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সংসার করে যাচ্ছে!(শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে)
-সে কী! বাপরে! কি সাংঘাতিক লোক! তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আপু! এই লোক যে এতো খারাপ সেটা বুঝলে আমি কখনো উনাকে পছন্দ করতামনা।
আমি তখনো মিটিমিটি হাসছি। মেয়েগুলো চলে যেতেই আমি আর মেঘা একসাথে শব্দ করেই হেঁসে ফেললাম। একদম উচিৎ হয়েছে!
সিলেটে বর্ষাকাল ছাড়াও সময় অসময়ে হুটহাট বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। এই সেঁতসেঁতে পরিবেশেই আমার গুনধর বন্ধুদের বৃষ্টিতেই, পুকুরে পানিতে গোসল করার ইচ্ছা জাগলো। আমাদের হাতে শার্ট প্যান্ট ধরিয়ে দিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে বসিয়ে নেমে পরলো ওরা। বিরক্ত হওয়ার সত্বেও এই দুপুর বেলায়,এঁদের কাপড় নিয়ে বসে থাকতে হলো আমাদের। অভ্র শর্ট প্যান্ট পরে নামলেও বাকি দু’জনের পরনে তখোনো ছিল সকালের লুঙ্গিই। উপায়ন্তর না পেয়ে বসে বসে এই দামরাগুলোর লাফালাফি দেখতে হচ্ছে। সিফাতের মতে ‘আশেপাশের মেয়েরা ওঁদের ইজ্জত লুটে নেওয়ার ধান্দায় আছে’ তা-ই সেইফটির জন্য আমাদের বসে থাকতে হবে। অবশ্য ওর কথা যে একেবারে ফেলনা তা-ও না। যার নমুনা আমি সকালেই দেখেছি। মেয়েগুলো যে সকালে মেঘার সাজানো মহা বড় মিথ্যা কাহিনী একেবারেই বিশ্বাস করেছে তা-ও না। এই ৩,৪ ঘন্টা গবেষণা করে এরা কনফার্ম হয়ে গিয়েছে, অভ্র বিবাহিত নয়।
লাফালাফির এক পর্যায়ে এদের চেঁচামেচি শোনা গেলো। সিফাত গলা সমান পানিতে নেমে অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে বললো-
-ভালোয় ভালোয় কইলাম দিয়া দে,জাহিদ!
-আরে আমি নেই নাই বিশ্বাস কর!
-তুই না নিলে কে নিসে? এমন আকাম অভ্র জীবনেও করবো না।
-তুই চাইলে চেক করতে পারোস আমারে।
-শা*লা **** কি চেক করুম তোরে? আমি স্পষ্ট ফিল করছি তুইই টান মারসোস!
ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু তখনো আমাদের বোধগম্য হয়নি। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সিফাত ধমকের স্বরে বললো-
-তুই না নিলে গেলো কই আমার লুঙ্গি? হোয়ার ইজ মাই লুঙ্গি জাহিদ?? ক্যান ইউ ফিল মাই সিচুয়েশন? এইখানে মিতু রাও আছে,অগো সামনে তুই আমারে এমনে বেইজ্জতি করবি?
এইবার পুরো ঘটনাই আমাদের সামনে পরিস্কার হয়ে গেলো। আমাদের হাসি কিছুতেই থামতে চাইলোনা। কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করলামনা। রুম্পা মুখ চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করে চেঁচিয়ে শুধালো-
-বন্ধু, এনি প্রবলেম?
সিফাত দাঁত কেলিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললো-
-নো প্রবলেম দোস্ত হে হে! তোরা রুমে যা গা। আমাগো গোসল শেষ, তগো কামও শেষ।
ওর কথার অর্থ বুঝতে পেরে চুপচাপ কাপড়গুলো সিঁড়িতে রেখেই কোনোরকমে রুমে ঢুকে উচ্চ স্বরে পেট চেপে হাসতে শুরু করলাম। মেঘা হাসতে হাসতে প্রায় খাট থেকেই পরে গেলো।
গায়ে হলুদের সকল আয়োজনই করা শেষ। সন্ধার দিকেই বোধহয় হলুদ পরানো হবে পুষ্পকে। বিকাল চারটা থেকেই সকলে সাজগোজ শুরু করে দিয়েছে। মেয়েদের মধ্যে প্রায় সকলেই শাড়ী পরেছে। আমিও পরলাম একটা নীল রঙের জামদানী শাড়ী। মেঘা,রুম্পা রা গত দুই ঘন্টা ধরেই মেকাপ করছে। এদের সাজ দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা পুষ্পের না, এঁদের দু’জনের।
-কিরে মুখে কিছুই তো দিসনাই। একটু লিপস্টিক দে ভালো দেখাবে।
ইচ্ছে না থাকাট সত্বেও প্রায় জোর করেই পুষ্প আমাকে লাল রঙের একটা লিপস্টিক দিয়ে দেয়। এই নিয়ে আমি মহা বিরক্ত। কিছুক্ষণ পরপর আয়নায় তাকিয়ে নিজের ঠোঁটে এই টকটকে লাল লিপস্টিক দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। মুখে বিরক্তির ছাপ বসিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই অভ্রের সাথে ধাক্কা খেলাম আমি। সবুজ রঙের একটা পাঞ্জাবী পরেছে অভ্র। ওকে দেখে আমার চোখ যেনো বেরিয়ে আসতে চাইলো! অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! একদম স্ট্রবেরির মতোন লোভনীয়! আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভ্র বললো-
-মুখ বন্ধ কর, মশা ঢুকবে।
ওর কথায় আমি কিছুটা অপমানিতবোধ করলাম। মনে মনে দশ সেকেন্ডের মধ্যে বিশটা গালিও দিয়ে দিলাম শয়তানটাকে। নিজেকে ঠিক কি মনে করে ও? কোনো সিনেমার নায়ক? মোটেও না।তুই মোটেও কোনো হিরো নস , বেটা তুই একটা জাহেদ খান!
আমাকে চুপ থাকতে দেখে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে,ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর পকেট থেকে একটা টিসু বের করে, আলতো হাতে আমার ঠোঁটে থাকা লিপস্টিকগুলো মুছে দিতে দিতে বললো-
-আমার এতো সুন্দর ওষ্ঠদ্বয়ে এসব আর্টিফিশিয়াল প্রসাধনী মেখে,তাদের সৌন্দর্য নষ্ট করার অধিকার তোকে কে দিয়েছে?
আমি নির্বাক চেহারায়, পিটপিট চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে! এতো যত্নশীল লাগলো আমার ওর প্রতিটা শব্দ!
আমাকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভ্র মৃদু হাসলো। তারপর আমার চুলগুলো কানের পিছনে গুজে দিতে দিতে বললো-
-একা একা কোথাও ঘোরাফেরা করবি না। বাড়িতে অনেক ছেলেরা ঘোরাঘুরি করছে,এঁদের সামনে পরার কোনো প্রয়োজন নেই। আর শাড়ীর দিকে যেনো খেয়াল থাকে। মনে থাকবে?
আমি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা উপরনিচ করে বোঝালাম, হ্যা মনে থাকবে।
-দোস্ত কুল কুল। আমি দেখতেছি কি করা যায়। এই সিফাত একটা বুদ্ধি বাইর কর তারাতাড়ি।
রাগে এই মুহূর্তে আমার শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। পুষ্পের চাচাতো বোনটাকে এই মুহূর্তে পুকুরে চুবাতে পারলে ভীষণ তৃপ্তি হতো আমার। এতো বেহায়া কেনো এই মেয়েটা? বারবার রঙঢঙ করে অভ্রের সামনেই কেনো যেতে হবে ওকে? এতোগুলো চেয়ার থাকতে অভ্রের পাশেই বসতে হলো এই অসভ্য মেয়েটাকে? দুনিয়াতে কি ছেলের আকাল পরেছে? রাগে দুঃখে হাতের কাঁচের চুরিগুলো খুলে ভাঙতে শুরু করলাম আমি।
অভ্র মনোযোগ দিয়ে ফোন টিপছে। আশেপাশের কোনোদিকেই ওর তেমন কোনো খেয়াল নেই।সিফাত কানের কাছে ফিসফিস করে কিছু বলতেই অভ্র পাশ ফিরে লামিয়াকে নিজের পাশের চেয়ারে আবিষ্কার করলো। তারপর এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। পেছনে তাকিয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখের ইশারায় ওর কাছে যেতে বললো আমায়।
-লামিয়া, বোন আমার তুমি একটু অন্য চেয়ারে গিয়ে বসবে? আসলে আমি আমার বউ ছাড়া এক মুহুর্তও কোথাউ থাকতে পারিনা। তুমি বসে আছো দেখে আমার বউ টা দেখো এতোক্ষণ আমার থেকে কতো দূরত্ব নিয়ে বসে ছিল। তোমাকে দেখলে আমার কেমন বোন, বোন লাগে তা-ই বলছি কি তুমি একটু এডজাস্ট করতে পারবে? আমি আবার তোমার ভাবিকে ছাড়া থাকতে পারিনা। ওকে ছাড়া থাকলে আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়।
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলো অভ্র। মেঘা,রুম্পা,সিফাত,জাহিদ ওরা সকলেই ঠোঁট টিপে হাসছে। ওর কথায় লামিয়া যতো না বিস্মিত, তার চেয়ে বেশি বিস্মিত আমি!
-উনি আপনার ওয়াইফ?(আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে)
কেমন অবিশ্বাস্য চেহারায় লামিয়া কথাটা জিজ্ঞেস করলো। অভ্র পূনরায় বেশ স্বাভাবিক কন্ঠেই জবাব দিল।
-কেনো শুনতে পাওনি? ও আমার একমাত্র বউ,আর তোমাদের একমাত্র ভাবী।
যোগ্য জবাব পেয়ে লামিয়া হতাশ মুখে চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে দিল। লামিয়া উঠে যেতেই সবাই শব্দ করে হেসে ফেললো-
আমি তখনো মুখ ফুলিয়ে অভ্রের পাশে বসে। আমাকে নির্বাক হয়ে বসে থাকতে দেখে অভ্র কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তারপর ধমকের স্বরে বললো-
-কি সমস্যা? শোনাই দিলাম তো কথা,তাও মুখ ফুলাই আছোস কেনো?
আমি অভিমানী স্বরে বললাম-
-জানিনা!
অভ্র মুখে রহস্যময় হাসি টেনে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো-
-জেলাস???
-মোটেও না।(মুখ ভেঙিয়ে)
অভ্র জবাবে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো।তারপর, আমার চেয়ার টা টেনে ওর চেয়ার এর কাছাকাছি এনে আমার হাত টা শক্ত করে ধরে বললো-
-অভ্রের নজর অন্য কোনোদিকে ঘুরবেনা,ম্যাডাম। অভ্রের নজর মূর্তির ন্যায় এক দিকেই স্থির! মিতু ছাড়া অভ্র পৃথিবীর সবকিছুই ঝাপসা দেখে! অভ্রের সকল মুগ্ধতা, সকল কৌতুহল শুধু মিতুর বেলাতেই! যার এমন এক অভ্র রয়েছে, তার কি অন্য কাউকে ইর্ষার করার কোনো প্রয়োজন আছে?
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেলো অভ্র। চারিদিকে গানবাজনার আওয়াজ। সবার মনোযোগ স্টেজের দিকে, আর একজনের মনোযোগ তার প্রেয়সীর অভিমানিনী মুখে! তার মনোযোগী নয়নেরা ক্লান্ত হয়না! আজন্ম বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থেকেও তাদের তৃপ্তি ফুরোয় না! যেনো তাঁদের এই মুগ্ধতা কেটে গেলেই পৃথিবী ভস্ম হয়ে যাবে!
চলবে….