সকাল থেকে আমার গুনধর দুই বন্ধু রাশিয়া,ইউক্রেনের চাইতেও সাংঘাতিক যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসে আছে। এই নিয়ে বিপাকে পরেছি আমরা বাকি আন্তর্জাতিক দেশগুলোর মতোন। দুই বন্ধুর সাথেই সুসম্পর্ক রাখতে হবে অথচ পক্ষ নিতে হবে যেকোনো একজনের।তাদের যুদ্ধের বিষয়বস্তুও তাঁদেরই মতোন অদ্ভুত। এঁদের আচরণ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এঁরা সংবিধানের বিয়ের বয়স পার করে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার বয়সে উপনীত হয়েছে।
-ওই অভ্র তুই ক দোষটা কার?
অভ্র অদের অতি মূল্যবান বিচারসভায় কান দেওয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ করলো না। চুপচাপ কানে হেডফোন লাগিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে গান শুনতে লাগলো।
অভ্রের কাছ থেকে কোনো প্রকার পাত্তা না পেয়ে, সিফাত মেঘার নিকট ছুটলো। মেঘা খুব মনোযোগ সহিত হাতে নেইলপালিশ লাগাচ্ছে। ওর সকল আগ্রহ এই মুহূর্তে ওর অতি যত্নের হাতের দিকে। কিছুক্ষণ বিরক্তি নিয়ে সিফাতের বক্তব্য শোনার পর মেঘার অবস্থা হয়েছে কিছুটা ‘ছেড়ে দে বাপ,কেঁদে বাচি’ টাইপ। ওর নালিশের তোয়াক্কা না করে মুখে চ সূচক শব্দ করে ধমকের স্বরে মেঘা বললো-
-এই সর তো এইখান থেইক্কা। একটা বিয়েতে আসছি, মেজাজ খারাপ করাবি না সকাল সকাল। আর এতো সমস্যা হইলে সেইম কালার কিনসোস কেন? তগো মতিগতি আমি বুঝিনা ভাই। সত্যি কইরা ক তো তগো মধ্যে কি চলে? এতো পিরীতি কই রাখোস? আন্ডারওয়্যারও ম্যাচিং ম্যাচিং কিনা লাগবো তগো?
রুম্পা ঘটনা শুনার পর থেকেই সকাল থেকেই হাসছে,কিছুতেই ওর হাসি থামার নাম নেই।
-ভাই প্লিজ,থাম আর সম্ভব না বিনোদন নেওয়া। সমাপ্তি কর আজকে।
জাহিদ রাগ নিয়ে বললো-
-সমাপ্তি পরে হইবো। তোরা ব্যাপারটা বুঝতেছোস না। ইট’স আ প্রাইভেট থিং। এসব শেয়ার করে পরা চলেনা। ওরে আগে আমারটা খুইলা দিতে ক। চোখ কি কপালে রাইখা হাটে নাকি জিগা অরে? হোস্টেলেও প্রতিদিন শা*লার একি কাহিনি।
জাহিদের কথায় সিফাতের অভিমান যেনো এখন আকাশ ছোঁয়াল। ও মুখ ফুলিয়ে বললো-
-ওই যা এখুনি খুইলা দিয়া দিমু। বাইর হ সবগুলায় আমি চেঞ্জ করুম।
অভ্র কান থেকে হেডফোন খুলে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো-
– তোর লজ্জা শরম আবার কবে থেকে উদয় হলো?
এবার যেনো বেচারা আসলেই লজ্জা পেলো। আশেপাশে তাকিয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলো।তারপর কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে পরলো।
সারা বাড়িতে মেহমানদের আনাগোনা চলছে সকাল থেকেই। কোথাও যায়গা না পেয়ে ছাঁদের রুমটায় আমরা রেডি হওয়ার জন্য চলে গেলাম। রুমটা খুব বেশি বড় না হলেও আপাতত এটাই রেডি হওয়ার জন্য সবচেয়ে পার্ফেক্ট ঘর। আমি খয়েরী রঙের কারচুপির ডিজাইনের একটা লেহেঙ্গা পরেছি। লেহেঙ্গাটায় এতো ভারী কাজ যে ঠিক মতোন হাঁটতেও পারছিনা। কোনো প্রকার সাজগোজ ছাড়াই পাথরের কিছু অর্নামেন্টস পরে নিলাম।
– মাশাআল্লাহ! মিতু তোকে মারাত্মক সুন্দর লাগতেছে, দোস্ত! এতো সিম্পল সাজে এতো অ্যাট্রেক্টিভ লাগতেছে! আয় একটু ফু দিয়া দেই, নাহয় নজর লাইগ্যা যাইবো।
রুম্পা চোখে আই লাইনার আঁকতে আঁকতে জবাব দিল-
-আমাদের প্রেমিক পুরুষের পছন্দ বলে কথা, মেঘা। তার পছন্দই মারাত্মক সুন্দর!
কিছুক্ষণ পর-ই সিফাত আর জাহিদের আগমন ঘটলো। আমাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বুকে হাত দিয়ে পেছনে পরে যেতে যেতে সিফাত বললো-
-হায়ে! এটা কাকে দেখছি! আমার সামনে যে আস্ত এক পরী দাঁড়াই আছে তোরা দেখতেছোস? নাকি আমি একাই দেখতেছি? মেঘা একটা চিমটি কাট তো বইন।
মেঘাও কম না। বলতে বলতেই শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে সিফাতের হাতে চিমটি দাগ বসিয়ে দিল।
– আল্লাহ! ওই ওই ছাড়! হারামি মাংসই উঠাই দিল শরীরের! ওই দূরে যা তুই আর সামনে আইবি না আমার! ফাউল বেডি! এমনিতেই ক্রাশের বিয়ার কষ্টে শুকাই যাইতেছি, তার উপর এই রাক্ষসীটায় দিল খাইয়া সব রক্ত।
মেঘা দুঃখীত হওয়ার ভান করে বললো-
-তুই তো বললি!
-জীবনেও তো কোনো ভালা কাম করতে দেখলামনা আমার লাইগ্যা। আর এখন চিমটি দিতে কইলাম দেখে তোর সব লয়ালিটি বাইর হইয়া আইছে? বজ্জাত বেডি!
জাহিদ হঠাৎ মেঘা আর রুম্পার দিকে ভ্রু কুচঁকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো-
-ওই তোরা দুইটায় এমনে ভুতের মতোন সাজছোস কেন? এত্তোডি ময়দা লাগাইছোস, ইশশ কেমন অদ্ভুত লাগতাছে!
ওর কথায় রুম্পা রেগেমেগে তেরে আসতে আসতে বললো-
-ওরে আমার মোল্লা সাহেব রে! আপনার সাদিয়া তো বছরে বারোমাসই মেকাপ মেখে রাখে হুজুর। আমরা নাহয় মাসে ২,১ বার মাখলাম। তাতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে?
মেঘা বললো-
-এন্ড ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এগুলা এক্সপেন্সিভ মেকাপ প্রোডাক্ট। তোদের আন্ডারওয়ার এর দামের সমতুল্য দামের আটা না। তা-ই দয়া করিয়া আটা বলিয়া আমাদের নেসেসারি এন্ড কম্পোলজরি জিনিসগুলোকে অসম্মান করিবেন না,হুজুর।
গত কয়েক ঘন্টা ধরে অভ্রকে চোখে পরছেনা। এতো মানুষের এতো প্রশংসা পেয়েও কোনোভাবেই আমি তৃপ্তি পাচ্ছিনা। একটা নির্দিষ্ট মানুষের অপলক চোখে তাকিয়ে থাকাই আমাকে উপলব্ধি করাতে পারে,আমাকে আসলেই সুন্দর লাগছে কিনা। অভ্র কেনো এখনো সামনে আসলোনা, ভাবতে ভাবতেই মন খারাপ করে বসে রইলাম আমি। বাইরে যেতেও ইচ্ছে করলো না কিছুতেই। মেঘা,সিফাত রা নিচে গেইট ধরার জন্য চলে গেলো। ছাঁদের রুমটায় একা একাই বসে আছি আমি। হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দে দরজার দিকে ফিরে তাকালাম আমি। ‘অভ্র’, ওকে দেখামাত্রই আমি লজ্জায় মিয়িয়ে গেলাম। কোনোরকমে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম-
-কককক কোথায় ছিলি এতোক্ষণ? তোকে দেখলামনা যে কোথাউ?
অভ্র কোনো জবাব দিলনা। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে এক পা এক পা করে সামনে এগোতে এগোতে বললো-
-আমাকে নিয়ে ইদানীং কারোর খুব চিন্তা হয় বুঝি?
আমি কোনো জবাব দিলামনা। এক পা এক পা করে পেছাতে লাগলাম।
-মিস করছিলি আমাকে?
আমি এবারো চুপ রইলাম।
এই মুহূর্তে অভ্র একেবারের আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে। ভয়ে, লজ্জায় আমি কোনো কথাই বলতে পারছিলামনা।
অভ্র আমার চুলের ক্লিপটা হাত দিয়ে খুলতে খুলতে বললো-
– আমাকে আর কতো জ্বালাবি তুই,মিতু?
আমি প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভ্র বললো-
-তোর কোনো আইডিয়া আছে,একটা সভ্য ছেলেকে তুই কতোটা বিপথে নিয়ে যাচ্ছিস?
আমি মাথা বাম-ডানে দুলিয়ে বুঝালাম,না, আমার কোনো আইডিয়া নেই।
অভ্র এবারো কিছুই বললো না। নিজের সর্বনাশা চক্ষুদ্বয় ধনুকের ন্যায় বিঁধিয়ে দিল আমার বুকে। আমাকে পিটপিট চোখে তাকিয়ে থেকে মৃদু হাসলো। তারপর আস্তে আস্তে নিজের হাতের স্পর্শ ছড়িয়ে দিল আমার কোমড়ে। হেঁচকা টান মেরে পেছন ঘুরিয়ে ওর মাথাটা রাখলো আমার কাঁধে। তারপর শক্ত করে পূনরায় জড়িয়ে ধরলো আমার কোমরে। আমি তখনো লজ্জায় আড়ষ্ট প্রায়! অভ্র এসব একদমই তোয়াক্কা করলোনা সেসব। ওর তপ্ত নিশ্বাসের বাতাস ছড়িয়ে গেলো আমার সারা অঙ্গে! অভ্র উন্মাদের মতো নিজের তরল ওষ্ঠদ্বয়ের স্পর্শ বসিয়ে দিল আমার ঘাড়ে! অভ্রের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ মুহুর্তেই আমার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল! পরক্ষণেই আমার মন আর মস্তিষ্ক ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো নিজেদের থেকে। আমি স্বজ্ঞান হারিয়ে ফেলি! বুকের ভেতরটায় কেমন উথাল-পাতাল ঝর শুরু হয়ে গেলো!
কিছুটা সম্বিত ফিরে পেতেই আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম-
-অভ্র
-হু
-কেউ এসে পড়বে,ছাড়।
– উহু, ছাড়বো না।আসুক।
-প্লিজ ছাড়, আমার খুব ভয় লাগছে!
আমার কথা শুনে অভ্র হেঁসে ফেললো। তারপর নিজের সামনে ঘুরিয়ে আমার নাকটা আলতো করে টেনে দিয়ে বললো-
-আপনার ভয় চিরতরে মুছে দেওয়ার ব্যবস্তা খুব শীগ্রই করছি দাঁড়ান।
আমি ওর কথার কোনো মানেই বুঝলামনা। আমাকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ টলমল চোখে তাকিয়ে থেকে শুধালো-
-তোর বাবা কি আমাকে মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নিবে, মিতু?
কোনো প্রকার বনিতা ছাড়াই কথাটা বলে ফেললো অভ্র। আমার চোখে মুখে তখনো বিস্ময়!
– তোকে ছাড়া আমি আর থাকতে পারছিনা বিশ্বাস কর! তোকে এক মুহুর্তও দূরে রাখতে ইচ্ছে হয়না আমার। আর পারছিনা আমি। আমার তোকেই লাগবে,মিতু! এবং খুব শীগ্রই লাগবে!
আমি কিছু বলার আগেই সিফাত রা রুমে ঢুকলো। আমাদের দেখে ওরা কি বুঝলো কে জানে?
-কিছু হইছে? ঝগড়া টকড়া লাগছোস নাকি আবার?
মেঘার প্রশ্নের আমি কোনো জবাব দিতে পারলামনা। অভ্রও কিছু বললো না। চার জোড়া চোখ গভীরভাবে আমাদের দিকে চেয়ে। তাদের কোনো কৌতুহলই আমরা দূর করলামনা। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে একবার দেখে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে পরলো অভ্র।
আগামী সপ্তাহেই আব্বু জাপান থেকে দেশে আসছে। আমি জানিনা এর পর কি হতে যাচ্ছে। ভাবতেও চাইনা। অভ্রকে পছন্দ না করার কোনো কারনই নেই। তবুও আব্বু অভ্রের সাথে মেলামেশা করাটা ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করতেন না। আব্বু জাপানে যাওয়ার পর থেকেই অভ্রের সাথে আমার দূরত্ব কমে যায়। অবশ্য আট বছর আগের চিন্তাধারা আব্বু এখনো বহন করে বেড়াবে কিনা সেটাও প্রশ্ন থেকে যায়। হয়তো আগামী দিনের সবকিছুই বিগত দিনগুলোর মতোন প্রশান্তিময় হবে, কিংবা…….
আমি ভাবতে পারছিনা আর। কিছুই ভাবতে পারছিনা। শুধু জানি আমি এই বেপরোয়া পুরুষের প্রেমে পরেছি!তাঁর অপলক চোখ আমায় উন্মাদ করেছে! সে এক সর্বনাশা পুরুষ! যার সর্বনাশা চোখের ঝিলে আমি দেখতে পাই নিজেট প্রতিচ্ছবি! যে প্রতিচ্ছবি আমায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয়, তার চোখের ঝিলেই লেখা, তার প্রতি আমার আজন্ম সর্বনাশ!
চলবে… …