তিন চাকা

বাতাসে আজ বারুদের গন্ধ । ঘরের ভিতরে জমাট বাধা অন্ধকার ঘিরে রেখেছে। দরজা খুলে একটু আলো আগমন জানাবে, তারও কোনো সুযোগ নেই ওদের কাছে। কারণ বাইরে ওত পেতে আছে কিছু হায়না, যেগুলো মানুষের খোলসে ঘুরে বেড়াচ্ছে আজ জহিরদের এলাকায়। ব*ন্দুকের গু*লির আওয়াজে কেঁপে কেঁপে উঠছে জহিরের সাত মাসের ছেলে মনির। ভয়ে বাবার কাঁধে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে ছয় বছরের মেয়ে আমিনা।

“বাজান আমাগোরে কী মাইরালাইবো?” শুকনো কন্ঠে বলে উঠে আমিনা।

” নারে মা। আমগোরে মারবো না। আমরা যে শিক্কিত না।”, জহির মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে। জহিরের বয়স আনুমানিক পয়ত্রিশ। হালকা পাতলা গড়ন ও শ্যামলা গায়ের রঙ। শরীরে কাজের বলিরেখা দৃশ্যমান।

“হও তোমারে মারবো না। এমনি এমনি তোমার মাথাটা কাডা পড়ছে।” জহিরের বউ আকলিমা ভাতের হাড়ি নামাতে নামাতে বলল।

কথাটা শুনে জহিরের মাথার ব্যথাটা একটু চিন চিন করে উঠে। চার দিন আগে রিকশা নিয়ে যখন সে বের হয় তখন বাড্ডা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ছাত্রলীগ ও পুলিশ জোট বেধে হামলা করছিল নিরীহ ছাত্রদের উপর। কারো মাথা ফা*টাচ্ছে। কারো পিঠে চা*পাতি দিয়ে কু*পিয়ে যাচ্ছে। কারো শরীরে অসংখ্য গু*লি করছে। অনেক লা*শও পড়েছিল সেদিন যা অন্যান্য ছাত্ররা নিয়ে যেতে পারেনি। লা*শের কাছে আসলেই গু*লি করত পুলিশ। জহির সেদিন রিকশা ঘর থেকে বের করে সড়কে আসার সাথে সাথে দেখে পিছন থেকে হেলমেট পরিহিত দুইটা লোক এগিয়ে আসে ওর দিকে।একজনের হাতে রা*মদা আরেকজনের হাত খালি।

“এই যাবি?” গমগমে স্বরে বলে উঠে একজন।

জহির বুঝতে পারে এরা ছাত্রলীগ। ছাত্রদের মারতে যাচ্ছে এরা। গতকাল সে ছাত্র একজনকে দিয়ে এসেছিলো আন্দোলনের জায়গায়। ওর সাথে ছিল পানির বোতল অনেক গুলো। জহির আজও ভেবেছিল হয়তো ছাত্রদের সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু ভাগ্য আজ এদের সাথে দেখা করিয়ে দিল।

জহিরের আড়চোখে তাকানো দেখে পাশেরটা বলে উঠে, “কিরে বান্দির পুলা যাবি নি কও?”

জহির একটা নিঃশ্বাস নেয়। সে নিঃশ্বাসে সকল সাহস একত্রিত করে সে বলে, “ না যামু না।”

“কেন যাবি না?”

“আমার ইচ্ছা নাই।” জহির রিকশার সিট আকড়ে ধরে বলে।

বলার সাথে সাথে রা*মদার ভোঁতা অংশ দিয়ে ওর হাতে অনেক জোরে বাড়ি মারে ছাত্রলীগটা। ব্যাথার চোটে হাত ঝিম মেরে যায় জহিরের। চিৎকার দিয়ে উঠে।

তখন পাশেরজন ব*ন্দুক বের করে বলে, “ খা**র পোলা তুই আমাগো নিয়া যাবি। উঠ রিকশায়।”

নিজের পরিবারের কথা ভেবে জহির রিকশায় উঠে বসে। পিছনে উঠে বসে রিকশায় দুইজন। মনের সাথে বিদ্রোহ করে হলেও সে প্যাডেল চালায়। যত সময়ে গন্তব্যে এগোতে থাকে তত সময় মনে একটা বোঝার ঝুলি মেলে উঠে। সে ভাবছিল এদেরকে নামিয়ে দিলে এরা ছাত্রদের জানে মেরে ফেলবে ।

চিৎকার আর গু*লির শব্দ কানে আসতেই সতর্ক হয়ে উঠে জহির। সামনের রাস্তায় অসংখ্য পুলিশ, ছাত্রলীগ দাঁড়িয়ে আছে। আর অপর পাশে লাল সবুজের পতাকা ধরা ছাত্ররা নিজেদের প্রতিরোধ করছে মরণ কামড় থেকে বাঁচতে। জহির রিকশা থামিয়ে ফেলে।

পিছনে বসা একজন বলে উঠে , “কিরে রিকশা থামাইলি কেন? আরো আগে যা।”

“না আমি আর আগে যাইতে পারুম না। আমার রিকশা ভাইঙ্গা লাইবো আপনাগো লোক।” জহির কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলে ।

পরক্ষনেই একটা লাথি এসে পড়ে ওর বুকের উপর। লাথির চোটে রিকশা থেকে ফুট দেড়েক পিছনে গিয়ে পড়ে জহির। ফুসফুস থেকে সকল বাতাস মনে হচ্ছিল বের হয়ে গিয়েছে । কপাল রাস্তায় পড়ে থাকা ইটে লেগে কেটে যায়। সে ভেবেছিল আজই তার শেষ দিন কিন্তু ছাত্রলীগ দুইটা রিকশা থেকে নেমে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি দিয়ে চলে যায় সামনে। যাওয়ার আগে রিকশার সামনের চাকার হাওয়া বের করে দিয়েছে একজন।

রাস্তায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর উঠে বসে জহির। গামছা দিয়ে কপাল বেঁধে ফেলে। র*ক্ত বেশি বের হচ্ছে না কিন্তু বুকে ও মাথায় ব্যথা হচ্ছে কিছু। রিকশা নিয়ে টেলতে টেলতে বাড়িতে রওনা হয় সে । বাড়িতে যাওয়ার পথে জহির দেখতে পায় সামনে থেকে ছাত্রদের একটা বড় মিছিল এগিয়ে আসছে। একেকজনের হাতে ছোট বড় পতাকা,কারো আবার কপালে বাধা পতাকা, কারো হাতে লাঠি, চেলা কাঠ, পাইপ। ছাত্রীদের হাতে মরিচের পানি, পেপার স্প্রে। সবার গলায় ঝুলছে আইডি কার্ড আর কাঁধে ব্যাগ।

দুজন ছাত্র এগিয়ে আসে জহিরের দিকে, তাকে বলে “মামা যাবেন নি? আমাদের সাথে অনেকগুলো পানির ক্যারেট ছিল। অগুলা একসাথে নিয়ে যেতাম।”

জহির মাথা নিচু করে ফেলে। অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকিয়ে বলে, “ ভাই গো আমার রিকশার চাক্কার বাতাস বাইর কইরা দিছে কুলা*ঙ্গার গুলা। আমারে মা*রছেও। আমি নিয়া যাইতে না করছিলাম ওদের। আপনাগো সাহাইয্য করবার পারলাম না ভাই।”

ছাত্রদের একজন ওর কাঁধে হাত রেখে বলে, “আচ্ছা আচ্ছা আপনি শান্ত হোন। সমস্যা নাই, আমরা দেখছি। আর আপনি রিকশায় বসেন আপনার র*ক্ত মুছে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে দেই।”

জহির বারণ করা সত্ত্বেও দুজন ছাত্র মিলে ওর মাথায় একটা ব্যান্ডেজ আর কিছু টাকা জোর করে দেয়। এবার সে আর নিজের চোখের পানি আটকাতে পারলো না। অশ্রু মাখা মুখে সে বলে, “ভাইজান আপনাগো আশা অবশ্যি পুরা হইবো। পুরা দেশ আপনাগো লগে আছে। আপনারা আগাই যান। আমি নামমু মাঠে। আমার মেধা নাই কিন্তু শক্তি আছে আপনাগো সাইয্য করার।”

“ঠিকাছে মামা সুস্থ হয়ে আসেন আগে।” হেসে উত্তর দিয়ে ছাত্ররা সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

সেদিন বাসায় এসে ঘর কিছু না বললেও আস্তে আস্তে কপাল ফুলে যাওয়ায় বউ আকলিমা বুঝে যায়। তাই সেদিন থেকেই ফুঁসে আছে ও আন্দোলন নিয়ে।

“খায়া আর কাম নাই। কিচ্ছু অইলেই বাইর হয়া গেল পোলা মাইয়্যারা। গার্মেন্টস সব বেবাক বন্ধ করাইসে। আর আমাগো পেটে লাত্থি মারছে। মা বাপে আটকাইতেও পারে না হেগো।”

বউয়ের কথা শুনে জহির কিছুটা রেগে উঠে বলে, “বউ ! মুখ সামলাই কতা কও। আমরা পড়াশুনা করি নাই তাই আমাগো কাছে এইডা লাগতাছে না দরকারি। হেগো অনেক বড় জিনিস এই আন্দোলন। যদি পাশ করে তাইলে দেশও পাল্টাই যাইবো।আর তোমার গার্মেন্টসের কাম এমনিই শুরু হইবো ছিন্তা কইরো না।”

কথা গুলো শুনে আকলিমার রাগ আরেক কাঠি বেড়ে যায়। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, “তা তোমারে মারলো কেন। তুমি কোন শিক্কিতের পুলা। চালাও তো রিকশাই।”

“আমারে মারছে কারণ আমি না করছিলাম। খালি মাইর দেখলা আর ছাত্রগো টেকা হেইডা দেখলা না?”

“অগুলা পাইসো বইলাই কিছু কই না। হেই টেহাও শেষ এহন। আইজকা চাইর নাম্বার দিন। ঘরে আর খাওনের কিচ্ছু নাই। সব শেষ। কাইল শাকপাতা নাহয় খাইলাম কিন্তু আমার পোলা মাইয়্যারে কি দিমু। হেরও তো পুষ্টি দরকার।” কথা গুলো বলে আকলিমা ভাত বেড়ে দিয়ে উঠে যায়।

বাইরের গু*লাগুলি আপাতত বন্ধ হয়েছে। ছাত্রদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে গু*লির বৃষ্টি। জহিরের ছেলে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আমিনা পাশে বসে আছে বাবার।

জহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কথা ঠিক বলেছে আকলিমা। এই চারদিনের প্রথম দুইদিন ব্যথার জন্য বেরই হতে পারেনি জহির। পরের দুইদিনও ঘরে থাকতে হয়েছে বাইরের মা*রামা*রির জন্য। পুলিশ ছাত্রলীগ জা*নোয়ারের মত ছাত্রদের মা*রছে। বাসা বাড়িতে গিয়ে গ্রেপ্তার করে হাজতে পুরে দিচ্ছে।

জহিরকে এসব কিছু ভাবাচ্ছে না বেশি কারণ তার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কালকে কিভাবে চলবে। কাল রিকশা না নিয়ে বের হলে অভুক্ত থাকতে হবে তাদের। ছেলেটাকেও এখন অল্প স্বল্প অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হয় বুকের দুধ ছাড়া সেজন্য বের হতেই হবে। পাশে ফিরে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলে একদম মায়ের মত হয়েছে। জহির শ্যামলা হলেও আকমিলা সে তুলনায় ফর্সা তাই মনিরের গায়ের রঙ ফর্সা। শরীর স্বাস্থ্যও ভালো ছেলের। এখন বসতে শিখেছে সে। দাঁতবিহীন মনির যখন বাবার দিকে তাকিয়ে হাসে তখন সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায় জহিরের। এই ছোট্ট হাসির জন্যই তো এসব কিছু।

ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো, “ বউ আজকে কয় তারিখ?”

“তিন তারিখ। ক্যান?”

“কাল বাইর হমু। দেখি যদি কিছু পাই।”

“আব্বা আমার জইন্যি ছকলেট আইনো?” জহিরের পাশ থেকে আমিনা বলে উঠে উৎফুল্ল হয়ে। ভয়টা কেটেছে এখন ওর।

“এই ছ্যামড়ি ছুপ যা। খাইতে পারে না আবার শখের শেষ নাই।” আকলিমা ধমক দিয়ে উঠে।

“আহ বউ সব সময় এরম করো ক্যা?” আমিনাকে কোলে নিয়ে জহির চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল কাল নিয়ে আসবে ওর জন্য চকলেট।

২.

সকালের রোদ এসে ঢুকছে ভাঙ্গা কাঠের দরজার অসংখ্য ফাটল দিয়ে। তার কিছুটা এসে পড়ছে জহিরের মুখে। ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। পাশে শুয়ে থাকা মেয়ের হাত সরিয়ে সে উঠে পড়ে। অন্য সবাই ঘুমেই আছে। রাতের দিকে দুই একটা গু*লির আওয়াজ আর চিৎকার ছাড়া কিছু শুনা যায় নি।

জহির ছাই দিয়ে দাঁত মেজে বের হয়ে আসে ঘর থেকে। রিকশার চাকা তিনটা টিপেটুপে দেখল বাতাস আছে নাকি। ব্রেক দুই তিনবার মেরেও দেখল কাজ করছে। চেইন টানিয়ে মবিল একটু দিয়ে সচল করল। অনেক রিকশাওয়ালারা এখন মেশিন লাগিয়ে ফেলেছে নিজেদের রিকশায়। সেগুলো ব্যাটারিচালিত কিন্তু জহিরের প্যাডেল দেওয়া রিকশাই পছন্দ। তাছাড়া আলাদা খরচ তো আছেই ব্যাটারির জন্য। বাজারের যা অবস্থা তাতে এসব ভাবাও বিলাসিতা। যতদিন গতর আছে তত দিন খাটিয়ে নেওয়া ভালো ভেবেই জহির এখনো প্যাডেলওয়ালা রিকশা চালায়।

রিকশার সবকিছু দেখে রাস্তায় বের হলো সে। সকালের দিকে ছাত্ররা কম বের হয় । কর্মসূচি থাকে একটা নাহলে দুটো থেকে। কোনো সময় বারোটার পরেও হয়। সাধারণ মানুষরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে সকালের দিকে বের হয়। সেটাও খুব কম সময়ের জন্য। এরকম কয়েকজনকে পেয়ে রোজগার শুরু করল জহির। কয়েকজনের ভাড়া খেটে কিছুটা ক্লান্ত জহির রাস্তার একটা পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় রিকশা নিয়ে। তখন রিকশার পিছনে শব্দ করে একটা বালকসুলভ কন্ঠ বলে উঠে, “ কি মিয়া এখানে কী? সামনে আগাও দেখি। এখানে ছাত্ররা আইবো।”

জহির পিছনে ফিরে দেখে ওর এলাকার এগারো বছরের রাকিব। জহিরকে দেখে ওর বিরক্ত মুখে উচ্ছাস ফুটে উঠে। “ আরে জহির ভাই যে ! তুমি কইত্তেকে আইলা? দেখি না কয়দিন হইয়া গেল।”

জহির হেসে উঠে বলে, “যে অবস্থা দেশের দেখবি কেমনে। চাইরদিন আগে আমারে মারছিল। তয় বেশি কিছু হয় নাই। তুই এহানে কেন? এই অবস্থায়ও বাইর হওন লাগে?”

রাকিব কাঠের ক্রাচে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে এসে বলে, “ক্যা মরলে তো ভালার লাইগাই মরমু। এতো মানুষ মরতাছে আর আমি মরলে কিই বা হইবো?কু*ত্তালীগগো সামলাইতে ল্যাংড়া রাকিবরেও লাগে ছাত্রদের।”

জহির রাকিবের কথা শুনে তাজ্জব হয়ে যায় । বহুদিন আগে ট্রেনে কা*টা পড়ে রাকিবের ডান পা। তখন থেকে তার সঙ্গী কাঠের ক্রাচ। আন্দোলনের শুরু থেকেই এক হাতে ক্রাচ ও আরেক হাতে লাঠি নিয়ে সে সতর্ক করে যাচ্ছে একের পর এক গাড়িকে সহিংসতার মাঝে না যেতে। শুধু লাশবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্সকে রাকিব দেখিয়ে দিচ্ছে পথ সাবধানে যাওয়ার জন্য।

জহিরকে সে চিনে বছর খানেক ধরে। জহির ওকে স্নেহ করে। রাকিবের ঘরবাড়ি নেই। রাস্তায় যেখানে পারে শুয়ে পড়ে ক্রাচটা আগলে ধরে। যখন আয় রোজগার ভালো হয় তখন জহির তাকে নিয়ে মোক্তার মিয়ার টং দোকানে চা বিস্কুট খায়।

জহির রাকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধানে থাকতে বলে সেখান থেকে চলে যায়। আরো কিছু টাকা রোজগার করে চলে যেতে হবে বাড়িতে। রাকিবের কাছে শুনেছে আজ আরো বেশি হাঙ্গামা হতে পারে।

বেলা বারোটা। মাথার উপরের সূর্য মাঝে মাঝে লুকোচুরি খেলছে আজ মেঘের সাথে। যখন রোদ পড়ছে তখন চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। ঘামে জহিরের শার্ট একদম পিঠের সাথে মিশে আছে কিন্তু সে নির্বাক ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে সামনে সমানে প্যাডেল মেরে। আজকে কোনোরকম চলে যাবে ওদের ঘরটা। ঢোলা শার্টের পকেটে একটা চকলেট উকি দিচ্ছে। সে ভুলেনি কিনতে চকলেট।

বাড্ডার দিকে রিকশা নিয়ে এগোতেই সে শুনতে পেল অসংখ্য ছাত্রের স্লোগান আর গু*লির আওয়াজ। সে অনেকটাই চলে এসেছিল কাছাকাছি। আর রাস্তার আইল্যান্ড থাকায় পিছনে ফিরে যে অন্য গলি ধরে যাবে তারও সুযোগ নেই। কিছুটা সামনে এগোলেই আইল্যান্ডের একটা গ্যাপ পড়বে। সে দ্রুত গতিতে ওদিকে এগোতে থাকে। রাস্তায় পড়ে আছে অসংখ্য ইটের টুকরা, গু*লির শেল, কাপড়, র*ক্তাক্ত পতাকা, পানির বোতল, লাঠি। একটা বিড়ালেরও ক্ষতবিক্ষত শরীর পড়ে আছে রাস্তায়। অনেক গুলো গু*লি আর মানুষের পদতলে পড়ে বিড়ালটার শরীর প্রায় রাস্তার সাথে মিশে গিয়েছে।

রাস্তার কালচে র*ক্তের দাগের উপর রিকশা চালিয়ে সে অন্য এক গলি দিয়ে ঢুকতে যাবে তখনই একটা চিৎকার ওকে আটকে ফেলে। চিৎকারটা রাকিবের। ক্রাচে ভর দিয়ে যতো দ্রুত পারছে সে রিকশায় এগিয়ে আসছে।

জহিরের কাছে এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ,”জহির ভাই একজন ছাত্ররে নিতে হইব। ছাত্ররা যে অ্যাম্বুলেন্স রাখছিল ওইডা নষ্ট কইরা ফেলছে পুলিশরা। এই গলির মাথাত আরেকডা রাখছে অ্যাম্বুলেন্স । ভাই সাইয্য করো।”

রাকিবের কথা শুনে তড়িগড়ি করে জহির গলির মুখে রিকশা রেখে দ্রুত ওর সাথে যায়। সামনে রাস্তায় তুমুল সংঘর্ষ চলছে। ইট পাটকেল এদিক থেকে ছোঁড়া হচ্ছে আর ওদিক থেকে ছোঁড়া হচ্ছে কয়েক পশলা গু*লি। একটা গু*লি এসে লেগেছিল এক ছাত্রের কাঁধে। গল গল করে র*ক্ত পড়ছে। ওকে রাস্তা থেকে টেনে সরিয়ে আনে আরেক ছাত্র জহিরদের দিকে। জহির মাথা বাঁচিয়ে এগিয়ে গিয়ে ধরে আহত ছাত্রকে। র*ক্ত পড়া বন্ধ করতে সে ছাত্রটার মাথায় বাধা পতাকাটা খুলে কাধে বেধে দেয় শক্ত করে। পরে চারজনই মাথা নিচু করে গলির মুখে এসে পড়ে।

রাকিব রিকশা পাহারা দিচ্ছিল। সে ওদের দেখে তাড়া দিতে থাকে। পুলিশ আর ছাত্রলীগ যেকোনো সময় এদিকে আসতে পারে। আহত ছাত্রকে রিকশার সিটে বসিয়ে শক্ত করে ধরতে বলে জহির।

তখনই একটা কাঁদানে বো*মা এসে পড়ে ওদের গলিতে। সঙ্গে সঙ্গে সে রিকশা টান দেয়। গ্যাস ছড়িয়ে পড়েছে ওদের তিনজনের উপরেও । রাকিব ক্রাচে ভর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায় এক বাড়ির দিকে। ওর চোখ নাক দিয়ে অঝোরে পানি বের হচ্ছে গ্যাসের জন্য।

পিছনে বসা ছাত্র বলে উঠে, “মামা এই নাও এই পেস্ট লাগাও মুখে। চোখ জ্বলবে না। তাড়াতাড়ি ! পরে আর তাকাইতে পারবা না।”

সে রিকশার হাতল থেকে এক হাত পিছনের দিকে নিয়ে পেস্ট নেয়। মুখে ঘষে নেয় সে দ্রুত। কিছুটা জ্বলুনি কমেছে। গলিটা অনেক লম্বা। তার উপর মানুষের দৌড়াদৌড়িতে দ্রুত এগোতেও পারছে না সে রিকশা নিয়ে।

সূর্যকে কালো মেঘ ঢেকে ফেলে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু করে সেটা একটু পর ঝিরঝির শব্দে রূপান্তরিত হয়। রিকশার সবাই ভিজে চুপসে গিয়েছে। আহত ছাত্রের টকটকে লাল র*ক্তের সাথে বৃষ্টির পানি মিশে তা ফিকে করে দিচ্ছে। জহির এগিয়ে চলছে। এই গন্তব্যটার রাস্তা অনেক লম্বা মনে হচ্ছে ওড় কাছে । পা অবশ হয়ে আসছে আগের ক্লান্তিতে কিন্তু সে তা ভ্রুক্ষেপ করে সমানে প্যাডেল মারছে। সামনে অ্যাম্বুলেন্সটা সে দেখতে পেল।

অবশেষে ওরা অ্যাম্বুলেন্সের কাছে পৌছে যায়। সেখানে আরো কয়েকজন শিক্ষার্থী আগে থেকে তৈরী ছিল। জহির রিকশা নিয়ে আসায় ওরা তাড়াতাড়ি আহত ছাত্রকে তুলে ফেলে অ্যাম্বুলেন্সে। একজন ছাত্র সামনে তাকিয়ে দেখে গামছা বাধা মুখে ওদের মতই পেস্ট লাগানো একজন রিকশাচালকের মুখে ফুটে উঠছে তৃপ্তির হাসি। সে জহিরের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে দরজা লাগিয়ে দেয়।

বৃষ্টির পানিতে কাঁদানে বো*মার প্রভাব চলে গেছে। জহির মুখ মুছে ফেলে শার্টের হাতা দিয়ে। হঠাৎ গলির মুখের চিৎকার অনেক গুন বেড়ে যায়। সাথে কান ফাটানো গু*লির শব্দ গলির দেয়ালগুলোতে প্রতিধ্বনি তুলে চলেছে সমানে ।

একটা গু*লি এসে রিকশার হুডে লাগায় জহির হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরে শরীরের সকল শক্তি দিয়ে পা চালাতে লাগে। ওকে বেঁচে ফিরতে হবে। ওর পরিবার অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

জহির যে গলি পেরিয়ে এসেছে সেখানে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সবাই ঘেরাও করে সামনে চলে আসে।

জহির প্রাণপণে মেইন রোড দিয়ে যাচ্ছে। আর কোনো গলিও নেই যে সেখান থেকে সরে যাবে। সবগুলোতে পুলিশ ঢুকে গিয়েছে। তখনই একটা পুলিশের গাড়ি সজোরে এসে পিছন থেকে ধাক্কা মারে জহিরের রিকশাকে। রিকশার পিছনের অংশ দুমড়ে মুচড়ে জহিরকে বাড়ি মেরে গাড়িটা সামনে এগোয় ছাত্রদের পিষে ফেলতে। জহিরের পা আটকে যায় রিকশার সিটের নিচের রডে। রিকশা সহ আছড়ে পড়ে রাস্তার একপাশে।

ডান হাত সাথে সাথে ভেঙ্গে যায়। ভেতরের হাড় সমেত বের হয়ে ঝুলে পড়ে আছে হাতটা। গগনবিদারী চিৎকার করতে গিয়েও চিৎকারটা গলাতেই আটকে যায় তার। একটা গু*লি এসে সে চিৎকারকে বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষের মৃত্যুর আগে নাকি ওর চোখে পুরো জীবন ফুটে উঠে । জহির সে সু্যোগ পেল না। মগজ বেঁধ করে গুলিটা র*ক্তাক্ত রাস্তায় দাগ কেটে যায়।

জহিরের লাশ বসা ভঙ্গি থেকে পড়ে যায় পাশের ড্রেনে। ড্রেনে পড়ে জহিরের অর্ধেক শরীর আর বাকি অর্ধেক রাস্তায় । কালো ড্রেনের পানিতে মিশে যাচ্ছে জহিরের মগজের হলুদ তরল আর লাল র*ক্ত।

পকেটের টাকা আর চকলেটটাও বের হয়ে জহিরের গলার কাছে এসে আটকে রয়েছে। যে চকলেটের অপেক্ষায় আছে ওর মেয়ে আমিনা। হয়তো একটু পর পর বাইরে তাকিয়ে দেখছে ওর বাবা আসছেন নাকি চকলেট নিয়ে। হয়তো অবুঝ ছেলেটাও খুঁজে বেড়াবে শ্যামলা রঙের মুখের সেই মানুষকে যে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো দীর্ঘক্ষণ।

✒️সামসুদ্দোহা রিফাত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *