চিঠি নং: ০০১

একটা দুঃসংবাদ দিয়ে তোমাকে পত্র লেখা আরম্ভ করার জন্যে দুঃখিত। প্রেমা  মেয়েটি আজ বিকালে আত্মহত্যা করেছে। থাক, ভাবনার দরকার নেই। প্রেমা মেয়েটিকে তুমি চিনবে না। তুমি চলে যাবার পর এই ধূলোর পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলেছে গনতান্ত্রিক অবস্থান, হ*মাসও দীর্ঘ বিরতির পর ফের হা*মলা করেছে ইজ*রায়েলে, আফগানিস্তানের অর্থনীতির মান উন্নতি হয়েছে, বাংলার মানুষের জীবনের দাম কমে গেছে। মানুষও অতিসহজেই ভুলতে শিখে গেছে রানা প্লাজা, সীতাকুণ্ডের বি এম কনটেনার ডিপু’র আগুনের মতো বড়সড় ট্রাজেডির ক্ষত। গত বছর ফুল ফোটা পহেলা ফাল্গুনের ভোরে আত্মহত্যা করেছিল বন্ধু মঞ্জু।

মাহিন কে তুমি চিনবে, কোঁকড়া চুল ছেলেটার। ওই যে দু’হাজার ষোল সালে একুশে বই মেলা থেকে তোমায় যে বইটি উপহার দিয়ে ছিলাম, ওই বইটি মাহিন লিখেছে। মাহিন খুব দুঃখ করে বলতো,যেদিন তার ডিভোর্সি বোন রাবুর একটা সংসার হবে, ঐ দিন থেকে মাহিন আর কোনো দুঃখ থাকবে না। রাবুর একটা সংসার হলো তারপর, মাহিন বিয়ে করলো। বিয়ের এক বছর মাথায় একটা কন্যা সন্তান হলো তার। বড়োই সুখের সংসার। মাহিন আত্মহত্যার দিন রাতে আমি তার সঙ্গে ছিলাম। আড্ডা দিলাম। বিসমিল্লাহ হোটেলে বসে দু’জন বিরিয়ানি খেলাম। বিরিয়ানি শেষে মাহিন আয়েশ করে লেবুর রস চিপে চা খেলো, চা খাওয়া শেষ করে মাহিন হাঁটলো বাড়ির উদ্দেশ্যে, আমিও সঙ্গে হাঁটলাম তার। সিগারেট খেতে খেতে মাহিন ভারি গলায় গান ধরলো, “শুনোগো দক্ষিণা হাওয়া প্রেমে পড়েছি আমি..” গান শেষে মাহিন খিল খিল করে হাসলো। আমি বাড়ি চলে গেলাম মাহিনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে। সকালে বাড়ির আঙিনার বড় আম গাছের ঢালে ঝুল থাকা অবস্থায় পাওয়া গেলো মাহিনের লাশ। বড়ো হাস্যউজ্জল মাহিন আমার ঐ রাত্তীরে এমন কোন ভূত দেখেছে কে জানে!

ত্রীভুবনে আমার তুমি ছাড়া কেউ না থাকার ধরুন তুমি চলে যাবার পর আমাকে আর কেউ ই পায় নাই। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যে চাকরিটা করতাম একদিন অফিসে গিয়ে জানতে পারি চাকরিটাও আর নেই। জীবন আমাকে কোথায় কোথায় যে নিয়ে গেলো হায়। শেষমেশ ছোট্ট একটা বন্ধ ঘরই আমার প্রিয় হলো। তুমি চলে যাবার পরের বছর যে বইটি লিখেছি তা থেকে প্রকাশনী যা দেয় তা দিয়ে চলতে শুরু করলো। দু’মুঠো ভাতের জন্যে চিন্তা করতে হয় না, চিন্তা করতে হয় বিলাসবহুল জীবন যাপনের জন্যে। এই নগরীর সবচেয়ে সুখি মানুষ ভিক্ষুক। ওদের চিন্তা খুব কম। ওদের ঘুমও খুব ভালো হয়। বিলাসবহুল দালানেই রাতে লাইট জ্বলে ঘুমের অভাবে, গরিবের ঘর থাকে গভীর ঘুমে অন্ধকার। সারাদিন ঘুমাই, রাত জেগে জেগে অলিগলি ধরে হাটাহাটি করি, দুপুরে ছাদে যাই।

আমার পাশে ফ্লাটে তিন’শ পঁচিশ নাম্বার বাড়িতে ছিল রমেয়েটি। বিকেলে ছাদে গেলে প্রেমাকে দেখা যেত রিকশা থেকে নামতে, হাতে কি-সব ফাইলপত্র। পাশাপাশি বাসা হওয়ার সুবাদে দেখা যেত প্রেমার বাসার ভিতরেও। দুপুর হলে প্রেমা বই বুকের উপর রেখে আঁধশোয়া থেকে হেসে হেসে কার সঙ্গে জানি কথা বলে। বড়োই মিষ্টি ঐ হাসি। ছাদে দাঁড়িয়ে ওপাশের ফ্লাটের জানালায় গলিয়ে রুমের ভিতরে বই বুকে শোয়া এক তরুনীর হাসি দেখে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতায় প্রসারিত হচ্ছে আমার ঠোঁট। বিচ্ছিরি কাণ্ড না? আমি অনুসরণ করলাম প্রেমার প্রতিটি কদম। লুকিয়ে লুকিয়ে। ভোরবেলা প্রেমা ছাদের ফুল গাছে জল দেয়, তারপর নাশতা করে, বড় যত্ন করে জেলির প্রলেপ রুটিতে মেখে খায়। অফিসে যায়। বিকালে অফিস শেষ করে এসে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় হেঁসে হেঁসে কথা বলে। সন্ধ্যার দিকে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হয়, ঘুরে, হাঁটাহাঁটি করে, শফিং করে, রেস্টুরেন্টে যায়। বাড়ি ফিরে রাত আটটার দিকে। কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে ফের কফির মগে চুমু দিতে দিতে হেসে হেসে কথা বলে, কথা চলে রাত দুইটা অব্দি, তারপর সে ঘুমায়। এই হলো নিলুর প্রতিদিনের রুটিন। প্রেমার রুটিন পরিবর্তন হয়েছে হঠাৎ লক্ষ করলাম। প্রেমা কে অফিসে যেতে দেখা গেল না, ছাদের ফুলগাছগুলোও জলের অভাবে নেতিয়ে গেল। দুপুরে প্রেমার বুকে বই রইলো ঠিকি কিন্তু প্রেমাজেগে নেই, হাসি নেই, ফোনে কথা বলাও নেই, যা আছে তা শুধু ঘুম। নিলু বুকের উপর বই রেখে ঘুমায়। প্রেমাকে বড্ড ক্লান্ত দেখায় দূর হতে। বাসায় ই থাকে, কোথাও বের হয় না। কোথাও গড়মিল হয়েছে, কোথাও কিছু ঠিক নেই প্রেমার। প্রেমা bযে জগতটিতে ছিল তা কেউ কেঁড়ে নিয়েছে বৈকি? হবে হয়তো-বা। আমি অপেক্ষা করলাম প্রেমার আগের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার, কিন্তু হলো না। নির্মম একটা মৃত্যুর সাক্ষী হলাম আমি। প্রেমা দুপুরের দিকে রুমের ফ্যানের নিচে চেয়ার রাখলো, হাতে ছিল একটা উড়না। উড়নার রঙ মনে নেই আমার। চেয়ারে দাঁড়িয়ে উড়নাটা খুব আয়েশ করে বেঁধেছিল, নিজের হাতে যত্ন সহকারে গলায় প্যাঁছালো তারপর, পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো পায়ের নিচের আশ্রয়। বুকের ভেতর নিঃশ্বাস আঁটকে গেলে কেমন লাগে আমি জানি না, তবে প্রেমাকে দেখে মনে হয়েছিল বড়ো কষ্ট হয়। প্রেমার পা দু’খান ছটফট করছিল, কেঁপে কেঁপে ধমক দিচ্ছিলো শরীর, তারপর হঠাৎ শরীর নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। ওপাশের ফ্লাট হতে লুকিয়ে লুকিয়ে অনুসরণ করা এক তরুণীর আত্মহত্যার দৃশ্য দেখছিল এপাশ হতে এক যুবক। চোখের সামনে একজন মানুষ মরে যাচ্ছে অথচ যুবকের কিছুই করার নেই, অথবা ছিল করার ইচ্ছে করেই সে কিছু করলো না। ইমতিয়াজ মাহমুদ বলেছিল, কারোর মৃত্যুতে যদি আপনার দুঃখ না লাগে তবে ধরে নিবেন আপনিও মরে গেছেন। আমি সম্ভবত সেইসব মানুষের কাতারের দাঁড়িয়ে আছি, যারা ভিতর ভিতরে মরে গেছে শুধুমাত্র বৈধ ঘোষণার অভাবে যাদের সমাধি হয়নি। আজকাল মানুষ মরে যাচ্ছে গোপনে, কেউ টেরই পাচ্ছে না কেন মরছে? কারণ কি? মানুষের এত অভিমান কার উপর? পৃথিবীর নাকি পৃথিবীর মানুষের উপর?

তোমার চলে যাবার সময়ও আমার কিছুই করার ছিল না। চলে যাবার কারণও খুঁজে পাওয়া গেল না। প্রেমা মেয়েটির মৃত্যুর কারণও আমার অজানা।

প্রেমার লাশটি সারা বিকেল ঝুলে রইল ফ্যানের সঙ্গে, এদিকওদিক দুললো। সারাটা দিনও গেল, এখন সন্ধ্যা। দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ ওই ফ্লাটের ছাদে। স্তব্ধ আর নির্জনতায় ভরপুর এই সন্ধ্যায় টকটকে লাল হয়ে আছে পশ্চিমের আসমান। তুমি চলে যাবার পর কত পাখি নীড়ে ফিরে গেছে, কত মানুষ চমৎকার এই পৃথিবীকে বলে দিয়েছে আলবিদা, শুধু আমি রোজকারের ঘটনা তোমাকে জানানোর মত অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারিনা। চিঠি লিখতে গেলে আমার কথার উচুঁ পাহাড় দাঁড়িয়ে যায়।

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চিঠি লিখেছিল হিমু রূপা’কে। পুরো চিঠি জুড়ে ছিল মাত্র একটি বাক্য, রুপা তুমি কেমন আছো?

আমি তো আর হিমু না। তবুও বলছি; কেমন আছো পরাণ?..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *