আনন্দ নগর যাওয়ার ব্যবস্থা করছে সবাই,যেহেতু আনোয়ারা সিদ্দিক একবার বলে দিয়েছেন তাহলে যেতেই হবে। আফতাব রহমান রুম্পা কে সব জানিয়ে দিয়েছে, রুম্পা মনে মনে খুশিই হয়েছেন।যখন যাবে তাহলে হিমেল এর বাবার কবরও জিয়ারত করে ফিরবেন।
‘ চলে যাবে? আমার ভালো লাগবে না তোমাকে ছাড়া থাকতে।’
তুফা গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছে সেটাই বলতে এসেছিল কিন্তু তা শুনে বিষণ্নতার ছায়া নেমে আসে মাহমুদ এর মনে। মাহমুদ এর মন খারাপ দেখে তুফারও ভীষণ খারাপ লাগতে শুরু করে।
‘ তুমি যদি চাও তাহলে থেকে যাই?’
‘ আরে না, সবাই কী ভাববে?আর মোট কথা সবাই যাচ্ছে তুমি একা কী করে থাকবে? না না দরকার নেই।
কথার মাঝখানে ফোন টুং টুং শব্দ করে বেজে উঠে তুফার, রুম্পা সিদ্দিক ফোন করেছে বলেছে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যাওয়ার জন্য।
__________
মনের মধ্যে এক আকাশ সম বিষন্নতা নিয়ে বাড়ির পথে যাচ্ছে আরুহী, সিফাত গ্রামে যাচ্ছে যা শুনে কেন জানি কিছুই ভালো লাগছে না।
বাসায় গিয়ে ফ্রেশ না হয়েই বিছানায় শুয়ে পড়ে আরুহী, মেয়ে কে হঠাৎ এমন অবস্থায় দেখে চিন্তিত হয় রোশনা বেগম।আরুহী কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘ আরু মা কী হয়েছে?’
মায়ের ডাক শুনে উঠে বসে আরুহী,মাথায় হাত চে’পে ধরে বলে।
‘ কিছু না মা।’
‘ উঁহু, কিছু তো একটা হয়েছে কিন্তু তুই বলতে চাইছিস না।বল আমাকে কী হয়েছে?’
আরুহী নিজের মা কে জড়িয়ে ধরে বলে।
‘ মা সিফাত গ্রামে চলে যাচ্ছে কিন্তু এই বিষয়টি আমার একদমই ভালো লাগছে না ভীষণ খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে প্রচুর,কী করব?’
‘ বুঝলাম।’
আরুহী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়।রোশনা মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বলে।
‘এবার তুই সিফাতের সাথে কথা বল, আমি বুঝতে পারছি তুইও সিফাত কে পছন্দ করিস ভালোবাসিস।’
‘ কিন্তু মা,,,
‘ উঁহু কোনো কিন্তু না, আমি এটাই বলব তুই প্রথম থেকে সব কিছু বলে দে তাহলে হয়তো সিফাত সব বুঝবে।আর আমার মনে হয় সিফাত তোকে এসব জানার পরেও আগের মতো ভালোবাসবে,ছেলেটার চোখে তোর জন্য অসীম ভালোবাসা রয়েছে।’
‘ তবে ঠিক আছে, সিফাত গ্রাম থেকে ফিরে আসলেই আমি সব কিছু বলে দেব।’
_______________
ট্রেনের এক কেবিনে বসেছে চৈতি, হিমেল,তুফা, সিফাত আর নিশা। ট্রেনের জানালা দিয়ে হুঁ হুঁ করে ঠান্ডা বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে নরম তুলতুলে শরীরটাকে। এলোমেলো চুল গুলো এপাশ ওপাশ উড়ছে, নিজের বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দেয় হিমেল।ব্যাগ থেকে চাদর বের করে জড়িয়ে দেয় চৈতি কে। উপস্থিত সবাই মুচকি হাসছে।নিহা,আরিফ, তানিয়া রিতু এক কেবিনে আছে, আফতাব রহমান আসিফা রহমান, আনোয়ার রহমান ও শান্তা রহমান এক অন্য কেবিনে।
চোখ বন্ধ করতেই আরুহীর মুখশ্রী ভেসে উঠছে সিফাতের চোখে, ফুটে উঠেছে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি। না এভাবে থাকা যায় না, পকেট থেকে ফোন বের করে আরুহীর নাম্বারে কল করে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ভেজা চুল গুলো মুছতে ব্যস্ত আরুহী, টুং টাং শব্দ করে বেজে উঠল ফোন। প্রথমে ভেবেছিলো হয়ত স্কুল থেকে ফোন এসেছে এরপর স্ক্রিনে সিফাতের নাম্বার দেখে চোখ বন্ধ করে ফুস করে শ্বাস টেনে নিয়ে কল রিসিভ করে আরুহী।
‘ হ্যলো।’
‘ আয় হায় মেরী জান,আই মিস ইউ।’
‘শুরু হয়ে গেলো লু চু গিরি।’
‘ আচ্ছা
‘ না সত্যি ভীষণ মিস করছি।’
আরুহী টাওয়াল রেখে বিছানায় এসে হেলান দিয়ে বলে।
‘ আহ্ রে তাহলে গেলেন কেন?’
‘ তুমি বললে এখুনি ট্রেন থেকে ঝাঁ’পিয়ে পড়ি?’
‘ এই এই, পাগল নাকি আপনি?’
‘ হ্যা তেরি পেয়ার মে পাগাল হুঁ গায়ি মেরি জান।’
‘ ফাজলামো বাদ দিন আর আমার কথা শুনুন।’
‘ ওকে বলুন মাস্টার সাহেবা।’
‘ আপনার সাথে আমার কিছু একান্ত ব্যক্তিগত কথা বলার আছে,গ্রাম থেকে ফিরে আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?’
‘ একান্ত ব্যক্তিগত? ইশ্ এখুনি চলে আসতে ইচ্ছে করছে।’
‘ না, আপনি এখন আসলেও আমি বলব না।ঘুরে আসুন তার পর সব বলব।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘ এখন ফোন রেখে ভাই বোনের সাথে একটু আনন্দ করুন এত আমার সাথে কী কথা?’
‘প্রেমালাপ।’
‘ রাখছি, আল্লাহ হাফেজ বাই।’
______________
প্রায় রাত আড়াইটা ছুঁই ছুঁই,ট্রেনের অর্ধেক লোকজন ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কিন্তু ওদের মাঝে জেগে আছে হিমেল নামে এক প্রেমিক পুরুষ,যে কী না নিজের প্রেমিকা কে নজরে নজরে রাখতেই ব্যস্ত।চৈতি হিমেলের ঘাড়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে, হিমেল নিজের চওড়া বাহুতে আবধ্য করে নিয়েছে প্রেমপ্রয়াসী কে।চাদের সাথে সাথে ভালোবাসায় জড়ানো অবস্থায় আছে দু’জনে।
সকাল সকাল ট্রেন থেকে নেমে সবাই রওনা দিল বাড়ির পথে,আনন্দ নগর মানেই আনন্দ মিছিল লেগে থাকা একটি গ্রাম। শীতের এই কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে হেঁটে যাওয়ার বিষয়টি এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে, আশেপাশে গাছ পালা ভরপুর।গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মৌহ নদী, নদীটি বেশ বড়সড়। পাশের গ্রামে যেতে হলে এই নদীর পথ ধরেই যেতে হয়।
গায়ে চাদর জড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই, তার মধ্যে একটি গরুর গাড়ি এসে থামল ওদের কাছে।এই যুগে গরুর গাড়ি দেখে বেশ অবাক হয় চৈতি।নিশা উৎসুক হয়ে বলে।
‘ওয়াও বাবা দেখো এই যুগেও গরুর গাড়ি?’
আনোয়ার রহমান মেয়ের কথা শুনে হাসে। আফতাব চালক এর সাথে কথা বলে জানতে পারে এটা আনোয়ারা রহমান পাঠিয়েছেন যাতে ওদের যেতে অসুবিধা না হয়।গরুর গাড়ি দিয়ে যাবে ভাবতেই আনন্দে আতকে উঠে চৈতি। উৎসাহ নিয়ে আগে আগে উঠে পড়ে একে একে সবাই গাড়িতে উঠে।একটি গাড়িতে ছেলে মেয়ে আর অন্য গাড়িতে বাকি সবাই।
আশেপাশে লোকজন নিজেদের কাজে ব্যস্ত কেউ খেজুরের রস বের করছে কেউ মাথায় সবজি নিয়ে বাজারের পথে রওনা দিচ্ছে। প্রায় বছর পাঁচেক পর গ্রামে আসা হলো।
কালো রঙের সালোয়ার কামিজ পড়ে মাঠ দিয়ে বাড়ির পথে আসছে হিমানি, চুলে তার লাল ফিতে দিয়ে বেনী করা আছে, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক দেওয়া সাথে আছে বড় বোন সালমা। সাধারণ সাজুগুজু নিয়ে হাসছে সালমা,হিমানিকেও কখন থেকে বলছে মাথায় কাপড় দিতে কিন্তু সে কারও কথায় পাত্তাই দেয় না নিজের মত করে হেঁটে যাচ্ছে।
‘ হিমানি,কী করতেছোছ এসব? এভাবে হেলে দুলে হাঁটতেছিস কেন?’
‘দেখ আপা আমারে একদম দমক দিবি না, তুই তো জানস আমি এই গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী। এখন যদি আমি এমনে না চইলা তোর মত সাদামাটা থাকি তাইলে তো সব্বাই আমারে নিয়া মজা করব।’
‘ দেখ হিমানি আমি কিন্তু নানীর কাছে গিয়া নালিশ করমু।’
‘ যা ইচ্ছে কর আমার কী?’
হিমানি সালমার কোনো কথায় কর্ণপাত না করে নিজের মত করে হাঁটতে থাকে।
নিজের ভাই ভাবী ওদের ছেলে মেয়ে সবাই আসবে বলে ঘরদোর গুছিয়ে রাখছেন আফিদা,আনোয়ারা রহমান সবার ভালো মন্দ খাওয়ার ব্যবস্থা করছেন। মুক্তা আলীর থেকে খেজুরের রস চেয়ে পাঠিয়েছেন কাল কের মধ্যে পেয়ে যাবে বলেছে মুক্ত আলী।এত দিন পর ছেলে দুইটা আর বড় মেয়ে টাকে দেখবেন আনোয়ারা তাতে যেন খুশী ধরছে না ওনার,কখন যে সবাই আসবে?তার অপেক্ষা করছেন।
_________________
‘ দেখ তুই যদি আমাকে কালকের মধ্যে দুই লাখ টাকা না দিয়েছিস তাহলে কিন্তু তোর জন্য খুব খারাপ হবে।’
নিজের প্রাক্তন স্বামীর ফোন পেয়ে প্রথমে ভয় পেয়ে যায় আরুহী,এই লোকটির থেকে কবে থেকে মুক্তি চাচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না।মাঝে মাঝেই ফোন করে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করে ওর থেকে ,এবারেও এটা করছে।
আরুহী ভীত হয়ে বলে।
‘দেখো সুহান আমার আর তোমার ডিভোর্স হয়েছে প্রায় বছরখানেক আগে তবুও তুমি আমাকে বিরক্ত করছ। এবার কিন্তু আমি আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব।’
ওপাশ থেকে ঝাঁজালো কন্ঠে বলে উঠে সুহান।
‘ আরে রাখ তোর আইন,যদি টাকা না দেছ তাহলে তোর সব কিছু শেষ হবে।মনে আছে তো জিনিস গুলোর কথা।’
আঁতকে উঠে আরুহী,ভয়ে ফোন রেখে দেয়। জড়োসড়ো হয়ে বিছানার পাশে বসে পরে। এভাবে আর কত দিন? না এবার একটা বিহিত করতেই হবে।
নিহার সাথে গ্রামে ঘুরতে গিয়েছে আরিফ বিষয়টি একদমই পছন্দ করছে না তিথি, না না এবার আরিফ কে বিয়ে করার বাহানায় সব কিছু আদায় করতে হবে ভেবে রাখে তিথি। আরিফের চরিত্র ভীষণ খারাপ এটা তিথি প্রথম থেকেই জানে,তার মধ্যে তিথির প্রচুর টাকা প্রয়োজন সে জন্যই সে আরিফের সাথে আছে।মাঝে মাঝেই আরিফের থেকে টাকা নিয়ে যায় সে, কিন্তু ইদানিং আরিফের ভাব সাব ভালো ঠেকছে না তিথির তাই নিজের আ’খের গুছিয়ে নেওয়ার চিন্তা করছে।আরিফ ফিরার সাথে সাথে সব কিছু নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবে তিথি এটা ভেবে প্রশান্তির হাসি দেয় সে।
____________
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে আসছে,তাতে যেন ঠান্ডা বেড়েই চলছে তার উপর ঘুটঘুটে অন্ধকার,মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক শুনা যাচ্ছে, পরিবেশ যেন আরও গা ছমছম করে উঠার মত। বাড়িতে প্রবেশ করার সাথে সাথে আনোয়ারা রহমান এসে দুই ছেলে আফতাব ও আনোয়ার রহমান কে জড়িয়ে ধরে,আফিদা ভাবী কে গিয়ে জড়িয়ে নেয়।নিহা, তানিয়া,চৈতি হিমেল সিফাত সবাই আনোয়ারা রহমান কে সালাম করেন। সালমা সবার বসার জায়গা করে।
‘ আম্মা কেমন আছো তুমি?’
আফতাব নিজের মা কে জড়িয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করে।
আনোয়ারা রহমান স্মিত হেসে বলেন।
‘এই তো তোদের সবাই কে দেখে ভালো লাগছে।’
আফিদা সবার জন্য পানি আনতে যায়।
‘চৈতি মা এই দিকে আয়।’
আনোয়ারা রহমান চৈতি কে হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডাকেন।
‘ কী গো দাদী তুমি দেখি শুকিয়ে গেছো?’
‘ ওই মাইয়া আমার কথা ছাড় তুই দেহি শুকাইয়া খেজুর গাছের মত হইছোস,বিয়া শাদি বাচ্চা কিছুই তো হইল না।’
আনোয়ারা রহমান এর কথা শুনে হুঁ হুঁ করে হেসে উঠে সবাই। হিমেল তাকিয়ে আছে চৈতির দিকে,তাতে যেন যতটা লজ্জা পেয়েছি তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে চৈতির।
চলবে………