তোমার নামে সন্ধ্যা নামুক [পর্ব-১৭]

সকাল থেকে বাড়ি সাজানোর কাজ চলছে, আফতাব রহমান ও আনোয়ার রহমান মিলে খাবারের আয়োজনের‌ দিক দেখছে।আজ গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান মোটামুটি সব আয়োজনই ঠিক ঠাক করা,নিশা আর তানিয়া তৈরি হয়ে সালমা কে তৈরি করতে ব্যস্ত। ওদিকে চৈতি একা একা রেডি হচ্ছে তার মধ্যে হিমানি রুমে আসে।

‘ আপা আসব?’

চৈতি মেকআপ করছি তার মধ্যে আপা ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে দেখে হিমানি,চৈতি মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে বলে।

‘ হ্যা হিমা এসো।’

হিমানি রুমে ঢুকে এদিক ওদিক করছিল,চৈতি ভালো করে খেয়াল করে দেখে ও হয়তো কিছু বলতে চাইছে কিন্তু অস্বস্তি বোধ করছে।ওর অস্বস্তি দূর করতে চৈতি নিজ থেকেই বলে।

‘ হিমা তুমি কী কিছু বলবে? না মানে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাইছো?’

‘ হো আপা।’

‘ তাহলে এত ন্যার্ভাস কেন তুমি? বলে দাও কী বলবে?’

‘ আসলে আপা আমি না ওই বলিউড তারকার মত হিমেল ভাই রে পছন্দ করে ফেলছি গো।’

হিমেল কে পছন্দ করেছে শুনে রাগে নাকের পাটাতন ফুলে উঠে চৈতি।

‘ হিমেল কত্ত সুন্দর,আর ওনারে আমার লগেই মানাইব।’

‘ চুপ করো।’

হুংকার করে উঠে চৈতি,ঘাবড়ে গেল হিমানি।

‘ তোমার সাহস হলো কী করে হিমেল কে নিয়ে এসব কথা ভাবার?এই তুমি জানো হিমেল কে হয় আমার?’

‘ এত রাগার কী আছে?হ জানি হিমেল ভাই আপনেরও ভাই হয়।’

‘‌ না , ওনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে বুঝতে পারলে?’

‘ এ্যা এইডা কী কও?’

‘ বিশ্বাস না হলে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। এখন বেরিয়ে যাও রুম থেকে বিরক্ত করবে না একদম।’

হিমানিও মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়,চৈতা অসম্ভব রেগে উঠে কিন্তু তার কারণ কী?তবে কী সে হিমেল কে ভালোবাসে?তাই জন্য অন্য কারো মনে তার জন্য ফিলিংস সহ্য হচ্ছে না।

রেগে সব কিছু খুলে মেকআপ নষ্ট করে মাথা চেপে ধরে কান্না করতে শুরু করে চৈতি।

হলুদ রঙের শাড়ি পরে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে নিহা,তাকে দেখে যে কেউ বলবে তার হয়তো আনন্দ নেই। একজন নিরব দর্শক হয়ে দাঁড়িয়েছে,আরিফ দূর থেকে লক্ষ্য করছে এমন হলুদ শাড়ি পড়নেই প্রথম নিহা কে দেখেছিল সে। সেদিন যে রকম অনুভুতি হয়েছিল আজও ঠিক তেমনি অনূভুতি হচ্ছে,কাল রাতে তিথির সাথে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে মেয়েটা বড্ড লো’ভী।যেখানে ওকে লাখ লাখ টাকার নেকলেস সেট এসব দিয়েও খুশি রাখা যায় না সেখানে নিহা সামান্য শাড়ী চুড়িতেই খুশি হয়ে যায়।

তপ্ত শ্বাস ফেলে আরিফ,আর না যা হয়েছে হয়েছে আর কিছু ভুল করবে না সে, নিজেকে পাল্টে নেওয়ার চেষ্টা করছে।কাল রাতেই তিথি কে বলে দিয়েছে আর কখনও ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা যেন না করে। নিজেকে একটু ঠিকঠাক করে এগিয়ে যায় নিহার পাশে, নিজের পাশে হঠাৎ আরিফ কে দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে নিহার। হলুদের মধ্যে হালকা গোলাপি রঙের ফতুয়া পড়েছেন সে,লোকটি সবসময় নিহার চোখে সুদর্শন যুবক আজও তাই।

তানিয়া নিশা, হিমেল, সিফাত নাচ গান করছে, তানিয়া বার বার আরিফ নিহা কে ডাকছে কিন্তু নিহার ভ’য় হচ্ছে যদি আরিফ রেগে যায়?তার এই ভয় দূর করে দিয়ে আরিফ নিহার হাত ধরে এগিয়ে যায়, মনে এক প্রশান্তি অনুভব করছে নিহা।তবে কী লোকটি আগের মতো হয়ে এসেছে? ঠিক আগের মত করে তাকে আবার ভালোবাসব?

ফুলের তালা নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় নিশা, হঠাৎ বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে নিয়ে যায়।নিশা শিউরে উঠে ,ভয়ে তার হাত পা রিতিমত কাঁপছে। কিন্তু চোখের দিকে তাকাতেই সব ভ’য় কেটে গেছে,চোখ দুটো যে তার প্রিয় পুরুষের হ্যা যাকে সবসময় ভালোবেসেছে এবং কী বাসছে।

তীর তীর করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট দুটো নড়ে উঠে ।

‘ আপনি?’

স্মিত হাসে ইশান।

‘ কখন এসেছেন?আর কেউ কী জানে যে আপনি এখানে এসেছেন?’

রমনীর এত গুলো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রেমিক পুরুষ একটিই কথাই বলে।

‘ আমার প্রেমিকা যে ভীষণ মিস করছিল,তাই চলে এসেছি।আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না ম্যাডাম।’

‘ মিস করছি বলে এভাবে হুট করে চলে আসবেন?’

‘ ঠিক আছে তাহলে চলে যাচ্ছা।’

‘ এই না না,যাবেন না। আমি তো শুধু বলছিলাম বাকি সবাই জানলে কী বলবেন? কখন এলেন কী করে এলেন? আপনি তো কখনোই এখানে আসেননি।’

‘ যা বলার তখন বলব এখন চিন্তা করে লাভ নেই, এখন চলুন আমার সাথে।’

‘ কোথায়? এখানে অনুষ্ঠান?’

‘ কিছু হবে না চলুন।’

ইশান নিশা কে নিয়ে চুপি চুপি বেড়িয়ে গেলো, ওদিকে রিতু এসে হিমেল কে ডাকে।

‘ ফুপা ফুপা ফুপা।’

রিতুর এক সঙ্গে এত গুলো ডাক শুনে হেঁসে উঠে হিমেল,কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে জিগ্গেস করে।

‘ কী হয়েছে আমার মিষ্টি বুড়ি?’

‘ ফুপা তুমি জানো ফুপি রুমে বসে ককান্না করছে।’

রিতু ছোট হওয়াতে মাঝে মাঝে ওর কথা গুলো আ’টকে আসছে, কিন্তু হিমেলের বুঝতে একদমই অসুবিধা হয়নি রিতু কী বলছে?চৈতি কান্না করছে শুনে দৌড়ে ওর রুমের দিকে যায় হিমেল, দরজা কিছুটা ফাঁক করা আছে।ভেতরে পা রাখতেই দেখতে পায় চৈতি মাটিতে বসে মাথা চেপে ধরে নৈঃশব্দ্যে চোখের পানি ফেলছে। প্রিয় মানুষের চোখে পানি দেখে বুকের ভেতরটা মো’চড় দিয়ে ওঠে হিমেলের, এগিয়ে যায় সে।

‘ চড়ুই পাখি কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?’

হিমেল কছ দেখে চৈতির রাগের মা’ত্রা যেন আরও দ্বিগুন হয় , চেঁচিয়ে উঠে সে।

‘ চলে যান আপনি, আপনি ভীষণ খারাপ মানুষ।চলে যান, আমি আপনার সাথে কথা বলব না কখনও।’

হঠাৎ চৈতির এত রাগের কারণ বোধগম্য হয় না হিমেলের, আবারও ওর কাছে যায়।

‘ জান প্লীজ বল না কী হয়েছে তোর?’

‘ চুপ কথা বলবেন না,চলে যান।’

চৈতি এক প্রকার হিমেল কে ধা’ক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, কিন্তু হিমেল তো এত সহজে ছাড়বে না। জাপটে জড়িয়ে ধরে চৈতি কে, নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্য’র্থ চেষ্টা করে চৈতি।এক সময় হা’র মেনে নিয়ে হুঁ করে করে কেঁদে উঠে।

‘ আপনি এত বাজে কেন?এমন কেন?’

‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে আমি বাজে।’

‘ হ্যা, আপনি ভীষণ বাজে মানুষ, আমার সাথে এমন কেন করছেন?’

‘ কী করেছি পাখি? একবার বল?’

‘ আপনি বলেছেন আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু ওদিকে হিমা আপনাকে ভালোবাসে।’

‘ কী?’

‘ এই জন্য সেদিন কথা বলছিলেন তাই না? আমি কিন্তু আপনাকে খু’ন করে ফেলব।’

‘ তোর জন্য খু’ন হতেও রাজী, কারণ আমি তোকে ভালবাসি।’

‘ মিথ্যে সব কিছু মিথ্যে।’

‘ উঁহু সব সত্যি রে চড়ুই পাখি।’

চৈতি খামচে ধরে হিমেলের গলার দিকে,প্রায় দা’গ পড়ে গেছে।

‘ এবার তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে।’

‘ হুম।’

‘ আমি বাইরে অপেক্ষা করছি,আয়।’

অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়,চৈতি হলুদ রঙের গাউন পরে অংশ নেয়,হালকা মেকআপ, হলুদ চুড়ি, নেকলেস সব কিছু ম্যাচিং করে পড়াতে অনেকটাই অন্য রকম লাগছে তাকে। হিমেল চৈতি কে দেখার পর মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয়।

‘ মাশআল্লাহ ‘

______________

প্রায় দশ লাখ টাকা নিয়ে হাওয়া হয়ে যায় তিথি আর সেটা কেউ জানতেও পারে না,এই টাকাটা মূলত ফ্লাট বানানোর কাজের জন্য রাখা হয়েছিল,ম্যানেজার আজিম হোসেন সব কথা ফোন করে আরিফ কে জানায়।এসব কথা শুনে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আরিফের, এখন কী করবে সে? চারিদিকে লোক লাগায় যাতে ওরা ঢাকা ফিরার আগেই তিথি খুঁজে টাকা উ’দ্ধার করা হয়।

বাগানে হাঁটছিল মাহমুদ,কাল তুফার সাথে কথা হয়েছিল আর এখন পর্যন্ত হয়নি।বিয়ে বাড়ীতে অনেক রকম কাজ থাকে সে জানে, হয়তো কাজের চাপে তুফা কথা বলতে পারছে না।এই ভেবে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে মাহমুদ,মনে মনে ভ’য় হচ্ছে তার মত ছেলের সাথে তুফার বিয়ে হবে তো?যার বাবা মা নেই তাকে কী কেউ নিজের মেয়ের স্বামী করে নিবেন? মাহমুদ বারংবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে যাতে সব কিছু ঠিকঠাক থাকে, সে যেন নিজের তুফা কে আপন করে পেতে পারে।

বারান্দায় কফি কাপ নিয়ে বসে আছে আরুহী,আজকে মন বেশ ফুরফুরে লাগছে।স্কুলও বন্ধ, নিজের সাথে সময় কা’টানোর দারুন সুযোগ। সিফাতের কথা মনে পড়তেই ঠোঁটের মৃদু হাসি ফুটে উঠছে। নতুন স্বপ্ন দেখছে সে, নিজেকে নতুন ভাবে জীবনকে সাজিয়ে তুলবে। আবারও ভালোবাসার পথে পা বাড়ালো আশা করে নতুন কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে,যা তাকে সুখের সন্ধান দেবে।চাদরটা আরেকটু জড়সড় করে গায়ে দিয়ে ভেতরে চলে যায়,পথ চলা শুরু হবে আর এবার হয়তো তার হাত শক্ত করে ধরার মত কেউ একজন পাশে থাকবে।

চলবে…….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *