তোমার নামে সন্ধ্যা নামুক [পর্ব-১৮]

ফুলের সুবাসে সারা বাড়ি ম ম করছে,বিয়ে বাড়ি তাই তাজা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। লাল রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে চৈতি, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক,এক হাতে ঘড়ি ও আরেক হাতে দু একটা চুড়ি পড়নে।

কালো রঙের শেরোয়ানি পড়েছে হিমেল,হাতে আছে ছোট্ট একটা ব্যাগ।

‘ এই যে চড়ুই পাখি একটু শুনবেন?’

সালমার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল চৈতি, তার মধ্যে হিমেলের ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকায়।

হিমেল কে দেখা মাত্র হাসি ফুটে ওঠে চৈতির ঠোঁটে, এগিয়ে যায় তার কাছে।

‘ হুম শুনব। বলুন কী বলবেন?’

‘ আপনার হাত দুখানি বাড়িয়ে দিন।’

চৈতি হাত বাড়িয়ে দেয়, হিমেল ব্যাগ থেকে লাল রঙের চুড়ি বের করে ওর হাতের ঘড়ি খুলে চুড়ি গুলো পড়িয়ে দেয়।চৈতির মুচকি হাসি আরও প্রসারিত হয়।

‘ লাল চুড়ি, বিশ্বাস করুন আমি আসার সময় চুড়ি নিয়ে আসতে ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘ জানি তো,কাল রাতে চড়ুই পাখি কী পড়বেন তা চেক করছিলাম তখন জানতে পারলাম মহারানীর চুড়ি নেই।’

‘ রোমিও।’

‘ ইয়েস বাট ইউ আর নট মাই জুলিয়েট।’

‘ তাহলে?’

‘ আপনি আমার বুকের খাঁ’চার চড়ুই পাখি।’

‘ ইশ্,পা গ ল।’

হিমেল আর চৈতি বিয়ের আসরে যায়, এদিকে হিমানি সব কিছু দেখছে আর জ্ব’লেছে ।সহ্য করতে পারছে না হিমেল আর চৈতির এই দৃশ্য গুলো, নিজের ঘরে গিয়ে তেলের বোতল নিয়ে আসে সে।

দেখতে দেখতে সালমার বিয়ে হয়ে যায়, সবাই আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে ওর বিদায় দেয়,পুরো রাত জেগে থাকে সবাই।

‘ আম্মা একটা বলি?’

বিছানায় শুয়ে ছিলেন আনোয়ারা রহমান,আসিফার কন্ঠে উঠে বসেন তিনি।গলা ঝেড়ে বলেন।

‘ হো কইয়া ফেলো।’

‘ আম্মা আমার মেয়ে চৈতির সঙ্গে ছোট আপার ছেলে হিমেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে,কথাটা আপনাকে বলব বলব ভাবছিলাম কিন্তু ভয়ে আর বলতে পারিনি।’

হিমেল আর চৈতির বিয়ের কথা শুনে বেশ খুশী হন আনোয়ারা রহমান,আসিফার মাথায় হালকা ধা’ক্কা দিয়ে বলেন।

‘ এইডা তো খুশীর কথা,এত ভয় পাওনের কী আছে? আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ তাহলে ঘরের মেয়ে তো দেখছি ঘরেই থাকব।’

‘‌জ্বি আম্মা এই সিফাতের বিয়েটা হয়ে গেলেই ওর আর চৈতির বিয়েটা করিয়ে দেব।’

রুমে ঢুকার সময় কথাটা বলে উঠেন আফতাব রহমান।

‘ হো বাপ ঠিকই করছোস তোরা, ওদের তো বয়স কম হয় নাই বিয়াটা এই বারে দিয়াই দে।’

‘ ইনশাআল্লাহ আম্মা দোয়া করিও তুমি।’

আসিফা রহমান পান বানিয়ে আনোয়ারা রহমান কে দেন, শান্তা রহমান ও আফিদা বেগম চা নিয়ে ওদের রুমে আসে। হঠাৎ বাইরে থেকে চৈতির চিৎকার শুনা সবাই দৌড়ে বাইরে যায়,আনোয়ারা রহমান কে আফিদা ধরে নিয়ে যান।

পা পিছলে পড়ে গেছে চৈতি,বুঝতে বাকি নেই বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছে। রিতিমত কান্না আসছে তার,পা টা কী তাহলে ভে’ঙে গেলো? হিমেল তাড়াতাড়ি ওকে নিয়ে রুমে যায় আনোয়ারা রহমান গ্রামের সাধারণ ডাক্তারের নাম্বার দেয় আনোয়ার রহমান কে, আফতাব এর ফোন বেজে উঠে,ফোন রিসিভ করতেই বড়সড় ধাক্কা খায়।তিথি দশ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছে এটা শুনে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে যায়,আসিফা রহমান হিমেলের সাথে রুমে যায়।

আফতাব রহমান ভীষণ ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ে, কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে চৈতি কে দেখে যায়। ভালো করে পরীক্ষা করেন উনি,পা অনেকটাই মচকে গেছে ভালো ডক্টর দেখাতেই হবে। হিমেল ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘ পা ঠিক আছে তো ডাক্তার?’

ডাক্তার কালাম খানিকটা সময় ভেবে বলেন।

‘ যতটা দেখেছি ওনাকে শহরের ডাক্তার দেখাতে হবে,বেশ ভালোই ব্যথা পেয়েছেন। আমি আপাতত এই মলম আর এই ওষুধ গুলো দিয়ে দিচ্ছি খাইয়ে নিবেন।’

এমন কথা শুনে আরও ঘাবড়ে গেল চৈতা আর সাথে হিমেল, ওদিকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল হিমানি।সে মনে মনে ভীষণ খুশি হয় চৈতির অবস্থা দেখে, এরপর মুখ বাঁ’কিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।গরম পানি নিয়ে চৈতির রুমে আসার সময় আফিদা দেখতে পায় চৈতি যেখানে পড়ে গেছে সেই জায়গায় অনেক টা তেল ফেলে রাখা আছে,মনের মধ্যে সন্দেহ হয় আফিদার। তাহলে কী তেলে পিচ্ছিল হয়ে পড়ে গেছে চৈতি?

হিমেল ঠিক করে ফেলে কাল সকাল সকাল ওরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।

‘ মামা আমরা কাল সকালেই রওনা দেব, তুমি প্লীজ সবটা একটু দেখো।’

হিমেলের কথায় রাজী হয়ে যান আফতাব,ওনাকেও এখন ঢাকা যেতেই হবে না হলে খুব প্রবলেমে পড়ে যাবেন।স্বামী কে হঠাৎ এত অস্থির দেখে ভাবুক হয়ে পড়েন আসিফা।

ছেলের কথা শুনে গুজগাজ শুরু করেন রুম্পা সিদ্দিক, হঠাৎ সবাই চলে যাবে শুনে ভীষণ রাগ হয় হিমানির।

রাত বেশ হয়েছে, রাতের সাথে সাথে ঠান্ডাও বেড়ে চলেছে।জানালা দিয়ে হীম শীতল হাওয়া ঢুকছে, কাঁপিয়ে তুলছে চৈতির শরীর।ব্যথাও বেড়ে চলেছে তার,কথায় আছে রাত যত বাড়ে ব্যথাটাও বাড়ে।

রুমের জানালা বন্ধ করে দেয় হিমেল,কাছে এসে বসে চৈতির। কোমল স্বরে জিজ্ঞাস করে।

‘ ব্যথা লাগছে?’

হিমেল এর প্রশ্ন শুনে ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয় চৈতি, সত্যি তার ভীষণ ভাবে ব্যথা করছে। হিমেল নিজের চওড়া বুকে জড়িয়ে নেয় চৈতি কে,মনে মনে ভাবে। সত্যি ওকে নিয়ে কাল ঢাকা গিয়ে ভালো ডক্টর দেখাবে, এভাবে ওর কষ্ট একদমই স’হ্য করবে না।

‘কী গোঁ এত চিন্তিত দেখাচ্ছে?’

আফতাব রহমান রুমে চেয়ারে কপালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন,আসিফা রহমান ভেতরে এসে স্বামী কে এমন দেখে কথাটা জিজ্ঞেস করেন।

‘ আর বলো না আমাদের সব কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

আসিফা রহমান আফতাব রহমান এর কাছে এসে বসেন।

‘ কী শেষ হয়েছে?এমন কথা কেন বলছো?’

‘ তিথি আমাদের পার্সোনাল সেক্রেটারী সে দশ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

‘ ইয়া আল্লাহ কী বলছো এসব?’

‘ হ্যা গো, তুমি সব গুছিয়ে নাও কাল ঢাকা ফিরব।’

‘ এসব কী হচ্ছে আমাদের সাথে? এখন কী করবে?’

‘ জানি না আসিফা কী করব? ব্যাংকে প্রায় পনেরো লাখ টাকা ঋ’ণ অফিসে দশ লাখ টাকা ছিল তা দিয়ে ফ্লাটের কাজ ধরিয়েছিলাম ভেবেছিলাম সব আস্তে আস্তে পরিশো’ধ করব, কিন্তু এখন? আল্লাহ কী হবে?ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে।’

‘এত ভে’ঙে পরো না, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ।’

______________

‘ ভালো লাগছে না,কাল ফিরে যাবো। সত্যি বলতে এখানে আপনার সাথে যতটা সময় কা’টিয়েছি সত্যি ভীষণ ভালো ছিল সময় গুলো।’

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলছে নিশা,ইশান পিছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে,ঘা’ড়ে মুখ গুজে বলে।

‘ ম্যাডাম কাজ করতে হবে তো, না হলে বিয়ের পর আপনাকে কী খাওয়াবো?’

নিশা সোজা হয়ে দাঁড়ায়,ইশান এর গলা জড়িয়ে বলে।

‘ খেতে হলে আপনাকে খাব,চু’মু।’

‘ ইশ্ শুধু ভালোবাসলে পেট ভরবে?’

‘ হ্যা ভরবে,চৈতির জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে জানেন?’

চৈতির কথা বলতেই ইশানের মুখশ্রীতে বিষন্নতার চাপ প্রকাশ পায়, নিশা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইশান এর দিকে।ইশান নিশার হাত ধরে নিয়ে ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে।

‘‌ দেখো নিশা আমি চাই না তুমি কোনো স’ন্দেহর মধ্যে বাস করো,চৈতি কে আমি আগে ভালোবাসতাম,সেই সুবাদে ওর প্রতি আমার একটা সফ্ট কর্ণার থাকবে এটা স্বাভাবিক। এখন যদি তুমি এসব নিয়ে সন্দেহ করো পরে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হবে তখন কেউই সুখে থাকব না,তাই আমি চাই তুমি এটা কে এত সিরিয়াসলি নিও না। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিশা মুচকি হেসে আবারও ইশান কে জড়িয়ে ধরে বলে।

‘ আমি জানি,এসব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।কারণ এই পুরুষ যে শুধুই আমার।’

ইশানও নিশা কে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।

‘ কী বলেছো আম্মা? আমি কেমনে কমু ওই খানে তেল আসল কইতে?’

আফিদা বেগম কাপড় গুছাতে গিয়ে খেয়াল করেন, সকালে হিমানি যে ড্রেস পড়েছিল তাতে খানিকটা তেল লেগে আছে।উনি হিমা কে ডেকে জিজ্ঞেস করেন।

‘ দেখ হিমা সত্যি কইরা কো তুই তেল ফেলছোস তাই না?’

‘ আরে বেডি কী কও আমি কেন ফেলতে যামু? আমার কী খাইয়া কাজ ছিল না?’

হিমানি উল্টো রাগ দেখিয়ে ঘর থেকে চলে যান, ওদিকে আফিদা বেগম বুঝে উঠতে পারছেন না কে এই কাজটি করল?

‘সত্যি?’

কিছুক্ষণ আগেই তুফা সময় বের করে মাহমুদ কে ফোন করে বলে ওরা কাল ঢাকা ফিরে আসছে।তুফার ফিরে আসার কথা শুনে ভীষণ ভাবে খুশী হয় মাহমুদ।

‘ হুম আসছি আমরা কিন্তু?’

‘ কিন্তু কী?’

‘ তুমি জানো চৈতির পায়ে খুব বড় আ’ঘা’ত পেয়েছে?’

‘ ও মাই গড কী করে হলো?’

‘ কী জানি?তেলে পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে গেছে। ভাইয়া খুব টেনশনে আছে।

‘ আচ্ছা ঠিক আছে আমি হিমেলের সাথে কথা বলে নেব।’

‘ আচ্ছা।’

চলবে……..

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *