বাড়ি ফেরার পথে হিমেল একটাও কথা বলেনি যা চৈতি কে ভীষণ ভাবে পু’ড়ায় ষ। হঠাৎ লোকটার কী হলো? এভাবে চুপ কথার কারণ খুঁজে পায়নি চৈতি।সেই যে কাল রাতে কথা বলেছিল এখন পর্যন্ত টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি।হতাশ হয় চৈতি,বাড়ি ফিরে চৈতি কে রুমে দিয়ে রুম্পা সিদ্দিক ও তুফা সিদ্দিক কে নিয়ে নিজেদের বাসায় রওনা দেয়।যাওয়ার আগে আফতাব রহমান এর সাথে কথা বলে জানিয়ে দেয় বিকেলে এসে সে চৈতি কে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে।
মনের কোণে অভিমান জন্ম নেয় চৈতির, যাওয়ার সময় একবার বাই পর্যন্ত বলল না?
গালে হাত দিয়ে বসে আছে হিমানি,চোখ দুটো ফুলে অবস্থা খারাপ। হিমেল যাওয়ার আগে ওকে বলেছিল একটু দেখা করতে, আলাদা কথা বলবে। হিমেলের সাথে আলাদা কথা ও দেখা করবে ভেবে মনের মধ্যে আনন্দের রেশ বসে যায় হিমানির। কিন্তু তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হয় না, মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আছে হিমেল কিছু দূরে চোখ পড়তেই দেখতে পায় হিমানি আসছে, মুখে তার এক গাল হাসি। হিমেল তপ্ত শ্বাস ফেলে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে রইল।
‘ হিমেল ভাইজান আপনি যে আমারে ডাকছেন সত্যি বিশ্বাস হইতাছে না।’
‘ কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘না আপনে যে আমার লগে দেখা করবেন কথা কইবেন আমি কখনও ভাবিনি।’
‘ হুম।’
‘ আচ্ছা এখন কন কী কইবেন?’
হিমেল কিছু সেকেন্ড নিয়ে ভাবে, এরপর হুট করে স’জো’রে থা’প্প’ড় বসায় হিমানির গালে। আ’ঘা’ত একটু বেশি হওয়ায় টাল সা’মলাতে পারে না হিমানি, ছি’টকে পড়ে যায় নিচে।হিমানির সামনে বড় পাথরে পা রেখে কিছুটা ঝুকে হিমেল বলে।
‘ এই ফাস্ট আর এটাই লাস্ট বার ওয়ার্নিং দিচ্ছি তোকে,যদি পরের বার এখানে আসি আর তুই আমার চড়ুই পাখির দিকে নজর দিয়েছিস তাহলে এই হিমেল সিদ্দিক এর আসল রূপ দেখতে পাবি। এখন তো শুধু ডেমো দেখালাম।’
‘ হিমেল ভাইজান আমি কী করছি চৈতি আপার সাথে?আপনে আমারে মারলেন কেন?’
‘ আরেকটা থা’প্প’ড় দিয়ে মনে করাব তুই কী করেছিস? তুই কী ভেবেছিস আমি জানবো না কী করে চৈতি পা পিছলে পড়ে গেছে?কাল আমি তোর হাতে তেলের বোতল দেখেছিলাম তার পর চৈতি যেখানে পড়েছে সেখান দিয়ে তোকে যেতে দেখেছি,দুই এ দুই এ চার হলো।’
‘ হিমেল ভাইজান মাফ করে দেন, আমি সত্যি আর ওমনটা করতাম না।’
‘ যা এই খান থেকে, তুই যদি আমার ফুফাতো বোন না হতি তাহলে কে’টে ফেলতাম।’
কথা গুলো মনে পড়তেই বুক কেঁপে উঠে হিমানির, মনে মনে বেশ ক্ষু’ভ হয়।
স্কুলের থেকে বাড়ির পথে রওনা দেয় আরুহী,সামনে চোখ পড়তেই ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে মৃদু হাসি। পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে সিফাত,পড়নে তার ব্ল্যাক শার্ট আর ব্লু প্যান্ট।আরুহী কে আসতে দেখে এগিয়ে আসে সে।
‘ হেলু দিদি মনি।’
সিফাতের এমন হেলু আর সাথে দিদি মনি ডাক শুনে না হেঁসে থাকতে পারল না।
‘ হেলু কী?আর দিদি মনি? আপনি কী আমার পেশা নিয়ে মজা করছেন?’
‘ একদমই না, পেশা নিয়ে কেন মজা করব?দিদি মনি বলার কারণ হচ্ছে আপনি তো সবসময় দিদি মনি টাইপ মুখ বানিয়ে রাখেন তাই।স্কুলে ঠিক আছে কিন্তু রাস্তা ঘাটে আর বাড়িতে?’
‘ যা ইচ্ছে ভাবুন আমার কী?’
এটা বলে আবারও হাঁটা শুরু করে আরুহী,পিছু পিছু সিফাতও হাঁটতে লাগে।
‘ এই যে দিদি মনি,কী যেন বলবে বললে?’
আরুহী আড় চোখে তাকায় সিফাতের দিকে, এরপর বলে।
‘এখন ভীষণ ক্লান্ত , মাত্র বাসায় যাচ্ছি। আপনি বরং কাল আসুন।’
সিফাত ঠোঁট ফুলিয়ে বলে।
‘না আজকেই শুনব, তোমার সাথে তোমার বাড়িতে যাব।’
‘ আমি বাসায় যাবো ফ্রেশ হবো খাবো এরপর শান্ত ভাবে বলব,এত ধৈর্য আছে?’
‘ অবশ্যই আছে চলুন।’
‘ ঠিক আছে তাহলে চলুন যাওয়া যাক?’
‘ইয়েস দিদি মনি।’
মুচকি হাসে আরুহী।বাড়ির বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল রোশনা বেগম, ভেতরে প্রবেশ করে আরুহী আর সিফাত। সিফাত কে দেখে রোশনা বেগম আরুহীর দিকে তাকায়,আরুহী ইশারা করে শান্ত থাকতে বলে।ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে আরুহী,সাথে সিফাত কেও বসায়।আরুহী কে এতটা পরিবর্তন দেখে ভীষণ খুশি হয় সিফাত।
পার্কে হাতে হাত রেখে হেঁটে যাচ্ছে ইশান আর নিশা, দূরে একটা ছোট ফ্যামিলি কে দেখে থেমে যায় নিশা। ওদের মধ্যে একটা বাচ্চাও আছে,নিশা আনমনে বলে উঠে।
‘ ইশ্ আমাদের বিয়ে হবে,এমন একটা বাচ্চা হবে এরপর আমরাও এভাবে ঘুরতে বের হবো। আনন্দ খুশী সুখ সব কিছু থাকবে তাই না?’
ইশান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিশার দিকে, সেকেন্ড পর নিশা বুঝতে পারে সে কী বলেছে। লজ্জায় লাল হয়ে গেছে সে,এটা কু করেছে? এভাবে নির্লজ্জের মত মুখের উপর বিয়ে বাচ্চা দুটোর কথা বলে দিল? প্রেয়াসী কে এভাবে ল’জ্জা পেতে দেখে মুচকি হাসে ইশান,হাত দুটো তার শ’ক্ত করে ধরে।নিশা তাকাতে পারছে না ইশানের চোখের দিকে।
ইশান স্মিত হেসে বলে।
‘ ইয়েস ম্যাডাম আমাদের বিয়ে হবে বাচ্চা হবে কিন্তু?’
কিন্তু শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় নিশা।ইশান আবার বলে।
‘ কিন্তু বাচ্চা একটা নয়, আপনাকে পুরো ক্রিকেট টিম বানিয়ে দেব।’
ক্রিকেট টিম শুনে আরও ল’জ্জা পায় নিশা, মনে মনে ভাবছে মাটি ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে গেলেই হয়ত এই ল’জ্জা থেকে বাঁচতে পারবে।লোকটি এভাবে বলতে পারল?
নিশার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে ইশানের , না আর নয় এবার একটু বেশি হচ্ছে।এই ভেবে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় নিশা কে,নিশাও নিজেকে ইশানের কাছে সমর্পণ করে দেয়।
হিমেল মাথা চেপে ধরে বসে আছে, প্রচন্ড রকম ব্যথা করছে মাথা। রুম্পা ছেলে কে এক কাপ কফি এনে দেয়, হিমেল মা কে ধন্যবাদ জানিয়ে কফির কাপে চুমুক দেয়। হিমেল এর পাশে এসে ধপাস করে বসে পড়ে তুফা, ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। রুম্পা সিদ্দিক কে ডেকে বলে।
‘ মা এক কাপ কফি দাও না।’
‘দিচ্ছি।’
মাত্র চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা হেলিয়ে বসে তুফা তার মধ্যে হিমেল বলে উঠে।
‘ তা তুফু মাহমুদ এর সাথে দিন কেমন কা’টছে?’
মাহমুদ এর কথা শুনে বিষম খায় তুফা, অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় হিমেলের দিকে। হিমেল দাঁত দেখিয়ে বলে।
‘ আমি তোর বড় ভাই আর আমি জানি আমার ছোট বোন কী করছে আর কী করছে না? এন্ড ইউ নো মাহমুদ ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড?ও অলরেডি আমাকে সব কিছু বলে দিয়েছে।’
‘কী?’
‘জ্বি ,যেদিন থেকে তোমাদের সম্পর্ক শুরু সেদিনই ও আমাকে সব কিছু বলেছে।’
তুফা কিছুটা ভীত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘ ভাইয়া, তাহলে তুমি কিছু বললে না কেন?’
‘ কারণ যে ছেলে কে আমি ছোট বেলা থেকে চিনি তার পর সব কিছু আমাকে বলে দেয় সে কী কখনো খারাপ হতে পারে? আমার বোনের জন্য একদম পারফেক্ট।’
‘ সত্যি?’
‘ হুম।’
তুফা নিজের ভাই কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
‘ আই লাভ ইউ সো মাচ, বিশ্বাস করো আমি ভয় পাচ্ছিলাম কী করে বলব? এখন যখন তুমি জেনে গেছো তাহলে মা কেও রাজী করিয়ে নিও?প্লীজ প্লীজ।’
‘ আচ্ছা বাবা,রাজী করিয়ে নেব কিন্তু?’
‘ কিন্তু?’
‘ কিন্তু আগে আমার আর চড়ুই পাখির বিয়ে হবে তার পর।’
‘ আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘ কী কথা হচ্ছে?’
রুম্পা সিদ্দিক কফি নিয়ে এসে তুফার হাতে দেয়,তুফা কিছু না বলে চুপচাপ রুমে চলে যায়। হিমেলও চুপ করে কাজ করতে থাকে। রুম্পা সিদ্দিক তপ্ত শ্বাস ফেলেন,ছেলে মেয়ে কী করছে কিছুই বলে না।
‘ এবার তো বলে দাও দিদি মনি?’
আরুহী সিফাত এর কথা শুনে স্মিত হেসে ওর হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে যায়, বিছানায় বসতে বলে সিফাত কে। সিফাত চুপচাপ বসে পড়ে, আলমারি থেকে একটা এলবাম বের করে আনে আরুহী। সিফাতের পাশে এসে বসে বলে।
‘ জানেন আমারো বিয়ে হয়েছিল।’
‘ হুম এটা তো জানি, কিন্তু পুরো কাহিনী তো বলই নি?’
আবারও স্মিত হাসে আরুহী।
‘ বলব আজকে, আমার বিয়ে হয়েছে তাও বাবার পছন্দের ছেলের সাথে। বিয়ের আগে ছেলেটা ভালোই ব্যবহার করত কিন্তু,,,
‘ কিন্তু কী?’
‘ কিন্তু বিয়ের পর,রাতে লোকটি নিজের আসল রূপে আসলো।যা ইচ্ছে করছে যেমন ইচ্ছে তেমন, কষ্ট ব্যথা আ’র্তনা’দ কেউ শুনে নি।’
আরুহীর কথা শুনে চোখ বন্ধ করে নেয় সিফাত, চোয়াল শ’ক্ত করে ফেলে।
‘ এর পর থেকে খালি মা’র ধুর করত, কাউকে কিছু বলতেও পারতাম না। হঠাৎ করে টাকা চাইতে শুরু করে এসব সহ্য হয় না বাবার, আমাকে এসবের মধ্যে রেখে উপরে চলে গেলো।দিনে দিনে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না কিন্তু কিছু বললেই থা’প্পড়’ চুলের মু’ঠি টেনে ধরত। একদিন হঠাৎ বলে টাকা দিতে পারছি না যখন ডির্ভোস দিবে এটাই সুযোগ ছিল বের হবার,কিছু দিন এর মধ্যে আমার আর ফিহাদ এর ছাড়াছাড়ি হয়। এরপর আমি অন্য জায়গায় মা কে চলে যাই, কিন্তু হঠাৎ একদিন ফিহাদ ফোন করে টাকা চাইতে শুরু করে। আমিও বলে দিয়েছি।’
‘ কী?’
‘ যে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তাই এখন কোনো টাকা দেব না,ফিহাদ বিশ্রী হাসি দেয় এরপর একটা ভিডিও দেয় যেখানে,,,,।’
‘যেখানে কী?
কথা বলতে পারছে না,হাত পা কাঁপছে তার। তবুও অনেক চেষ্টা করে বলে।
‘ যেখানে আমার উ’ল’ঙ্গ অবস্থার ভিডিও ছিল,একটা মানুষ কতটা খারাপ হলে নিজের স্ত্রীর সাথে এমন করতে পারে?’
‘ কী বলছো এসব?’
‘ হ্যা হ্যা সব সত্যি,এটা দেখিয়ে দেখিয়ে ও আমার কাছ থেকে টাকা নেয়, যেখানে আপনি আমাকে সবসময় ভালোবাসি ভালোবাসি বলেন। এখন আফসোস হচ্ছে তাই না? দেখলেন কাকে ভালোবাসেন?এমন একটা মেয়ে কে যার বিয়ে হয়েছিল,লোকটি জানোয়ারের মত ওকে ব্যবহার করেছে এবং কী ওর ভিডিও আছে। এবার বলুন আর চাইবেন কখনও আমাকে?’
সিফাত ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলে।
‘ প্লীজ এসব বলো না, আমি তোমাকে সব রকম ভাবে ভালোবাসি। বিয়ের পর কে কী ভাবে তোমাকে স্পর্শ করেছে জানি না কিন্তু এখন আমার উপস্থিতিতে কেউ তোমাকে ছুঁতে পারবে না। আমি সত্যি অনেক ভালোবাসি অনেক বেশি।’
‘ পাগলামী করছেন,একটা বিবাহিতা মেয়ে কে পেয়ে কী করবেন?’
‘ আগলে রাখব, ভালোবাসব যত্ন করব। এখন তো পাক্কা আমি তোমাকেই বিয়ে করব।’
আরুহী খাম’চে ধরে সিফাতের শার্ট।
চলবে…..