এই ঠান্ডার মধ্যে হালকা পাতলা একটা ট্রি শার্ট পড়ে জগিং করতে বেড়িয়ে হিমেল,তার পাশেই শীতের জ্যাকেট পড়ার পরেও রিতিমত কাঁপছে মাহমুদ।
‘ ব্রু তুই কী রে? মানুষ নাকি ভূত?’
মাহমুদ এর মুখে এমন কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায় মাহমুদ।হাতে থাকা পানির বোতল থেকে ঢক ঢক করে প্রায় অর্ধেক পানি খেয়ে নেয় হিমেল পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দৃষ্টি নি’ক্ষে’প করে মাহমুদ এর দিকে।
‘এই বার বল কী বলছিলি?’
‘ বলছিলাম তুই কী হ্যা?এই হাড় কাঁপানো শীতে এভাবে ট্রি শার্ট পরে দৌড়াতে পারছিস?এই তোর ঠান্ডা লাগে না?’
হিমেল ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়।
‘না লাগে না তোর মত পঁচা শরীর না আমার যে বছরে দু একবার গোসল করি।’
‘ যাই বলিস ব্রু এবারে কিন্তু খুব ঠান্ডা পড়েছে।’
‘ কী বলছিস এগুলো? মাত্র তো শীতের আগমন ঘটল এখনও পুরো মাস বাকি আর তোর এখনি এত ঠান্ডা লাগছে, তাহলে তো দেখা যাচ্ছে কয়েক দিন পর তুই কাতা কম্বল নিয়ে রাস্তায় বের হবি।’
‘ এই শুন হিমেল আমার তোর মত গন্ডারের শরীর না বুঝলি।’
‘সাট আপ ইয়ার, এবার কী তুই আসবি না কী আমি চলে যাব?’
‘নো ইয়ার তুই সব কিছুতে এত ছটে যাস কেন?’
‘ এমনি,বাই দা ওয়ে তুই জানিস চড়ুই পাখি আসছে।’
‘কী।’
চড়ুই পাখি আসছে শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে মাহমুদ, মনে হচ্ছে এখনি ওর চোখ দুটো যেন খুলে পড়ে যাবে।
‘ ভাই ভাই তুই সত্যি বলছিস তার মানে চৈতি আসছে?’
‘ তোর কী মনে হয় মিথ্যা বলছি?’
‘ না না তুই চড়ুই পাখি কে নিয়ে মিথ্যা কেন বলবি? আচ্ছা বাদ দে এখন বল তুই কী ওদের বাড়িতে যাচ্ছিস?’
‘নো ওয়ে আমি কেন যাব ও নিজে আসবে আমাদের বাড়িতে।’
রাস্তার ধার থেকে কিছু ফুল নিয়ে নেয় চৈতি, এগুলো নিশার জন্য, নিশা ফুল অনেক পছন্দ করে অবশ্য ও নিজেও ফুল প্রেমি, ফুলের প্রতি আলাদা আগ্রহ চৈতির।
বাড়ির সামনে গাড়ি থামে,ভেতরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় চৈতি আর সিফাত। কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় চৈতি, সিফাত আবার ওর কাছে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।
‘ কী হয়েছে চৈতি? দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?’
‘না ভাইয়া অনেক দিন পর বাড়ির ভেতরে যাচ্ছি, একটু ভয় লাগছে।’
‘ আরে আমার ছোট পা গ লী, নিজের বাড়িতে যাচ্ছিস তুই এতে ভয়ের কী আছে?চল ভেতরে আয়।’
সদর দরজায় সবাই অপেক্ষা করছে চৈতির জন্য,বাড়ির ভেতরে আসতেই নিজের মা কে দেখতে পায় চৈতি।আসিফা রহমান হাসি মুখে মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে,এত দিন পর নিজের মা কে দেখে আনন্দে চোখ ভরে যায় চৈতির।
‘ মা।’
‘ আমার সোনা মেয়ে,এত দিন পরে। কেমন আছিস মা।’
‘ ভালো ছিলাম না সত্যি, এখন তোমাদের সবাইকে এক সাথে দেখা সত্যি মন ভালো হয়ে গেছে।’
‘ এই যে মেয়ে আমাকে কী দেখতে পাচ্ছ না?’
আসিফার পিছন থেকে কথাটা বলে উঠে নিহা।নিহা কে দেখে স্মিত হাসে চৈতি।
‘ উঁহু দেখব না কেন? এখন কী জড়িয়ে ধরবে?’
কথাটা বলতে যতটা সময় লেগেছে নিহা গিয়ে ঝাপটে চৈতিকে জড়িয়ে ধরতে ততটা সময় লাগেনি।
‘ কেমন আছিস? আমাদের কথা কী একটুও মনে পড়ে না তোর?’
‘ না পড়লে কী ইতালি থেকে আসতাম?’
‘ ওহ্ মা,নিহা ভাবী তোমরা কী ওকে ভেতরে আসতে দেবে? না কী দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কথা বলবে?এই এত ভারি ভারি ব্যাগ নিয়ে আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।কী জানি কী সব নিয়ে এসেছে এই পা গ লী?’
চৈতি গাল ফুলিয়ে বলে।
‘ ভাইয়া, ভালো হবে না কিন্তু।’
চৈতির কথায় বাড়ির সবাই হুঁ হুঁ করে হেসে উঠে।
‘ বাবা আমাদের ধানমন্ডিতে যে একটা খালি জমি পড়ে আছে ভাবছি সেখানে একটা ফ্ল্যাট তৈরি করব এরপর ভাড়া দিয়ে দেব কী বল?’
আরিফের কথা শুনে মাথা নাড়ল আনোয়ার রহমান।
‘ ঠিক বলেছিস কিন্তু তার জন্য তো প্রচুর টাকা প্রয়োজন। এমনিতেই জায়গাটা এত দিন ধরে খালি পড়ে থাকায় খুব খারাপ অবস্থা হয়েছে,এখনি যদি পরিষ্কার না করানো হয় তাহলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে।’
আরিফ কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেবিনের দরজায় কেউ টোকা দেয়।
‘ মে আই কামিং স্যার?’
তিথি কে দেখে মুচকি হাসে আরিফ।
‘ হ্যা তিথি এসো।’
আনোয়ার এর কথায় একটু নড়েচড়ে বসল আরিফ।
ভেতরে প্রবেশ করে তিথি এক পলক দেখে নেয় আরিফের দিকে তার পর আনোয়ার কে উদ্দেশ্য করে বলে।
‘ স্যার আসলে এই ফাইল গুলোতে আফতাব স্যারের সাইন প্রয়োজন ছিল বাট উনি তো আজকে অফিসে আসেননি।’
তিথির কথা শুনে হাত বাড়ায় আনোয়ার,হাতে থাকা ফাইল গুলো এগিয়ে দেয় তিথি।এক বার চোখ বুলিয়ে নেয় আনোয়ার।
‘ হুম, আজকে বাড়িতে একটু প্রয়োজন আছে তাই ভাইয়া আসতে পারেনি, তুমি বরং এক কাজ কর এগুলো আমাকে দিয়ে দাও আমি তো একটু পরেই বাড়িতে যাব তখন না হয় সাইন করিয়ে ড্রাইভার কে দিয়ে পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা তুমি তো অফিসে আছ তাই না?’
‘ ইয়েস স্যার আমি অফিসেই আছি নো প্রবলেম আপনি ধীরে সুস্থে সাইন করিয়ে আনুন।’
‘ ঠিক আছে।আরিফ চল বাসায় যাই।’
আরিফ কিছুটা আমতা আমতা করে বলে।
‘ বাবা তুমি যাও আমার কিছু কাজ আছে ওগুলো মিটিয়ে ফিরছি।’
‘ এখন আবার কী কাজ তোর?’
‘ উফ্ বাবা বললাম তো কিছু জরুরী কাজ আছে, ওগুলো শেষ করে ফিরব।’
‘ আচ্ছা ঠিক আছে, সময় মত চলে এসো।’
গায়ে চাদর জড়িয়ে ছেলের জন্য কফি নিয়ে দুতলায় যান রুম্পা সিদ্দিক।ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসে হিমেল, মায়ের আগমনে মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি। এগিয়ে যায় মায়ের কাছে,কফির কাপ হাতে নিয়ে বলে।
‘ উফ্ মা তুমি এমন কর কেন?’
‘ আমি আবার কী করলাম?’
কফির কাপ বিছানার পাশের টেবিলে রেখে আবার রুম্পার কাছে যায় হিমেল।
‘ তুমি আগে বস এখানে।’
সোফায় বসে রুম্পা, মায়ের পায়ের কাছে বসে পড়ল হিমেল।
‘ আমি তো তোমাকে বলেছিলাম এই বয়সে এত কিছু না করতে? তাহলে তুমি আমার কথা শুন না কেন?’
‘ কী বলিস এই সব?ছেলে মেয়েদের জন্য কিছু করলে মায়ের কখনো কষ্ট হয় না রে।’
‘ না মা এসব শুনতে চাই না,বাড়িতে তো কাজের লোক আছেই তাহলে আর কী?’
‘ তাহলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আয়,বয়স তো আর কম হয়নি?’
হিমেল কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে।
‘ হুম মা বিয়ে তো অবশ্যই করব, চড়ুই পাখিও তো এসে গেছে।’
চৈতি কে চড়ুই পাখি ডাকে শুনে মাথায় হালকা ধাক্কা দেয় রুম্পা সিদ্দিক।
‘ এটা শেষ করে নিচে আয় নাস্তা করবি।’
বিছানা সোজা হয়ে হাত ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে হিমেল, মুখে তার এক গাল হাসি।
ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল চৈতি,তারই মধ্যে কেউ একজন ফট করে এসে ওর চোখে হাত রাখে। পরিচিত স্পর্শ একদমই ভুলার নয়।
‘ তুফা।’
চোখ ছেড়ে চৈতির হাত দুটো ধরে তুফা আর উৎফুল্ল হয়ে বলে।
‘ বাহ্ বাহ্ তুই তো দেখি মনে রেখেছিস আমায়?’
‘ কেন মনে না রাখলে বুঝি খুশি হতি? আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোকে ভুলে গেছি,এই তুমি কে?’
‘ উঁহু আমাকে ভুলে গেলে আমি তোকে মে’রেই ফেলতাম। এখন জড়িয়ে ধরবি না?’
‘ এটা আবার বলতে হয়?আয় বুকে আয়।’
চৈতি আর তুফা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।
দু’জনে কাজিন বডে কিন্তু দুজনের মধ্যে আরেকটা সম্পর্ক আছে, বেস্ট ফ্রেন্ড এমন একটা সম্পর্ক যা কখনও ভুলার নয়। ফ্যামিলি ভালোবাসার মানুষ গুলোর পরে এই একটা সম্পর্কে এতটা বিশ্বাস করা যায়,যেটাতে না থাকে পাওয়ার আশা না থাকে কিছু দেওয়ার সারাজীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি হাসি আনন্দ সব মিলিয়ে তৈরি হয় এই সম্পর্কের সুতা।
চলবে….