তোমার নামে সন্ধ্যা নামুক [পার্ট ০৮]

কুয়াশায় পুরো ঢাকা ডেকে গেছে,আকাশ জুড়ে আজকে আর সূর্য উঠেনি। সূর্য মামার দেখে নেই ঠিক তেমনি আজকে চৈতির মনের আকাশেও কুয়াশার ন্যায় কষ্ট গুলোতে ডেকে গেছে।
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে ঠিক হয়েছে তাও আবার নিজের ফুফাতো ভাইয়ের সাথে যা একদমই মানতে পারছে না সে, এখন মনে হচ্ছে দেশে না ফিরলেই হয়তো ভালো হত।

‘ তার মানে তোর মনে মনে এটা ছিল?’
পিছনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে তানিয়া, ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল চৈতি তার মধ্যে তানিয়ার কথা শুনে উল্টো হয়ে দাঁড়ায়। ‌
‘ মানে?’

তানিয়া চৈতির কাছে এগিয়ে এসে বলে।
‘ তোকে যখন জিজ্ঞেস করলাম কাউকে পছন্দ করিস কী না তখন তো না বললি তাহলে এখন তো দেখছি যেই হিমেল এর সাথে বিয়ে ঠিক হলো সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলি?তার মানে তুই হিমেল কে পছন্দ করিস।’

চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে চৈতি।
সোফায় বসে রুম্পা সিদ্দিক আর আসিফা রহমান আফতাব রহমান শান্তা রহমান ও আনোয়ার রহমান সবাই মিলে খুব জরুরী আলোচনা করছে, ওদের পাশে বসে আছে হিমেল অপেক্ষা করছে চৈতির জন্য। বাড়িতে ঢুকে এত বড় সমাবেশ দেখে ভ্রু কুঁ’চকে চৈতি তার উপর হিমেল কে ওদের পাশে বসে থাকতে দেখে আরেকটু ঘ’টকা লাগে তার।চৈতি কে দেখে নিহা ওর কাছে আসে।
‘‌চৈতি আয় তোর জন্য খুব ভালো কিছু অপেক্ষা করছে।’
‘ ঠিক আছে কিন্তু নিহা কী নিয়ে এত বড় সমাবেশ?’
‘ আগে ভেতরে চল তার পর জানতে পারবি, আর এই ব্যাগ আমাকে দে।’

নিহা চৈতির থেকে ব্যাগ নিয়ে নেয়,আসিফা মেয়ে কে কাছে ডাকে,চৈতি এক নজর হিমেল কে দেখে নেয় হিমেল পলকহীন চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয় চৈতি।
‘ তা চৈতি মা এখন থেকে তুই ওই বাড়িতে আর ভাইজি হয়ে না আমার ছেলের হবু বউ হয়ে যাবি।’

হবু বউ কথা কর্ণ স্পর্শ করতেই আরেক দফা চমকে উঠে চৈতি,আসিফা রহমান এর দিকে তাকায়,উনি চোখের ইশারায় সম্মতি জানালো। সবার মুখে হাসি‌ তার মধ্যে আফতাব রহমান বলেন।
‘‌দেখ আপা আমি চাই আমার মেয়ে কে তুমি দেখে রাখো তাই তো বিয়ের কথা বলার সাথে সাথে আমি হ্যা করে দিয়েছি।’

চৈতি কী করবে বুঝতে পারছে না কিন্তু এখন যদি কিছু না বলে তাহলে পরে আর কিছু করতে পারবে তাই সে ঠিক করে এখুনি সবাই কে বলে দেবে সে বিয়ে করতে চায় না। চৈতি কিছু বলতে যাবে তার আগেই বসা থেকে উঠে দাঁড়াল হিমেল, সবার সামনে থেকে চৈতি হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।কেউ কিছু বলে না, সবাই চায় ওরা দুজনে এই বিয়ে নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিক তাতেই ভালো।

চৈতির রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয় হিমেল,টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে তাকে, হঠাৎ এমন টান খেয়ে হিমেল এর গলা জড়িয়ে ধরে চৈতি।চৈতির খুব কাছে আছে হিমেল, নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। নিজের হাতের বেরায় আটকে ফেলে চৈতি কে,ঘেষে দাঁড়ালো দেয়ালের।
‘ আপনি কিন্তু এবার একটু বেশী করছেন হিমেল ভাই।’
‘ হুস,ভাই ডাক ছাড়া আর কিছু বলতে পারিস না? ভালোবেসে স্বামীও ডাকতে পারিস।’

হিমেল এর এমনতর কথায় বিব্রত হয় চৈতি, হঠাৎ এই জড়ানো গলায় কথা গুলো শুনে হৃদয় স্পন্দন যেন হুঁ হুঁ করে বেড়ে গেছে।চৈতি বার বার জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নেয়।
‘ দেখুন হিমেল ভাই,,,।

হিমেল আরও এক পা এগিয়ে আসে,একদম দেয়ালের সাথে চেপে যায় চৈতি। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে।
‘ কী দেখব?আর এখন দেখে নিলে নিজেকে কন্ট্রোল করা মুশকিল হবে তো। সব কিছু না হয় বিয়ের পরেই দেখবো?’

হিমেল এর কথা গুলো শুনে চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
‘ আপনি এত্ত খারাপ?’
‘ কী করব বল?তুইও তো আমাকে খারাপ করে দিলি বিশ্বাস কর এর আগে এমন ছিলাম না, তুই যবে দেশ ছেড়ে গেছিস তখন ভেবেছিলাম একবার ফিরে আয় সব শোধ তুলে নেব,এত অপেক্ষার পর দেশে ফিরলি এখন তো খারাপ হতেই হবে।’
‘ সরুন প্লীজ?’
‘ বিয়েতে রাজি হয়ে যা, সত্যি তোর পৃথিবীর সব সুখ তোর হাতের মুঠোয় এনে দেব।’
‘ না করব না বিয়ে,ইনফেক্ট এখন আমি নিচে গিয়ে সবার সামনে না করে দেব।’

চৈতি যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় তখনি হিমেল ওকে টান দিয়ে আবার নিজের কাছে এনে ওর হাত দুটো পিছমোড়া করে চে’পে ধরে।
‘ ছাড়ুন আমায়, এবার কিন্তু খারাপ হচ্ছে।’
‘ তুই যদি নিচে গিয়ে বিয়ের জন্য না বলিস তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না। তুই গিয়ে বিয়ের জন্য না বললে আমি সবাই কে বলে দেব তোর আর আরিফের সম্পর্কে।’

চৈতি ভয় পেয়ে যায়,সে চায় না এসব কথা বাড়ির সবাই জানুক।নিহা আরিফের সাথে খুশিতে আছে এটাতেই ওর শান্তি, এখন যদি এসব কিছু জানাজানি হয় তাহলে সবাই চৈতি কে ভুল বুঝবে।আর নিহা? ওতো আর কখনও আমাকে বিশ্বাস করবে না, না না এসব ঠিক হবে না সবার জন্য।
‘ এই চড়ুই পাখি এবার কী হবে? আমি জানি তুই ভাবছিস সবাই জানলে সব কিছু উল্টো পাল্টা হয়ে যাবে আর এটাও জানি তুই এসব হতে দিতে চাস না।নিহার সংসার ভে’ঙ্গে যাক এটাও চাস না আর এসব কিছু না হতে দিতে চাইলে আমাকে বিয়ে কর।’

আর কিছু করতে পারল না চৈতি শেষমেশ সবার সামনে এটাই বলল বিয়েতে রাজী।
‘ এই চৈতি?’

তানিয়ার ডাকে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে চৈতি, না চাইতেও চোখ দুটো টল টল করছে।
‘ কিছু বল? তুই হিমেল কে ভালোবাসিস তাই না?’

তপ্ত শ্বাস ফেলে চৈতি, ধীর কন্ঠে বলে।
‘ ভালোবাসি কী না জানি না তবে বিয়ে করতে চাই আপাতত।’

চৈতি ছাদ থেকে নিচে নেমে যায়, তানিয়া ঠাই দাঁড়িয়ে আছে,ওর কথার মানে বুঝতে পারল না।

নতুন এলাকা এত সহজে বাড়ি পেয়ে যাবে কল্পনা করেনি আরুহী, একতলা বাড়ি চারটে রুম আছে। দুটো বেডরুম একটি কিচেন আর ড্রয়িং রুম,মা মেয়ের জন্য এটাই ঠিক আছে।
সকাল থেকে ঘর গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে,আজকে আর স্কুলে যায়নি আরুহী
প্রিন্সিপাল স্যার কে ফোন করে দু দিন এর ছুটি নিয়েছে,সব কিছু ঠিকঠাক করে তার পর আবার স্কুলে জয়েন করবে। ক্লান্ত শরীর টা কে বিছানায় এলিয়ে দিল আরুহী, আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। কয়েক ঘণ্টা পর নিজের উপর ভারি কিছু অনুভব করে আরুহী,চোখ দুটো ঘুমে ভরপুর তবুও চেষ্টা তাকায়। অন্ধকার পুরো ঘর কিছুই দেখা যাচ্ছে না ঠিক কিন্তু আরুহীর মনে আছে ও লাইট অফ করেনি।
আস্তে আস্তে কানের কাছে এগিয়ে এসে কেউ বলে।
‘ আরু।’
এমন জড়ানো কন্ঠে নিজের নাম শুনে আরুহীর একটুও চিনতে অসুবিধা হয়নি এটা সিফাত।
‘ সিফাত আপনি?’
সিফাত টু শব্দটি করে না,আরুহীর ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়। হয়তো প্রায় এক বছর পর কোনো পুরুষের স্পর্শ পেয়েছে আরুহী।গত এক বছরে কোনো পুরুষ কে নিজের দ্বারে কাছে আসেতে দেয়নি সে কিন্তু আজ?
‘ সিফাত কী করছেন?প্লীজ উঠুন।’
‘ উঁহু এখনো তৃ’প্তি পায়নি।’
‘ প্লীজ,এমন করবেন না সহ্য করতে পারব না।’

সিফাত ফট করে উঠে গিয়ে লাইট অন করে দেয়, উড়না ছাড়া বিছানায় শুয়ে ছিল আরুহী,লাইট অন করার সাথে সাথে মাথার পাশ থেকে উড়না নিয়ে গায়ে জড়িয়ে ফেলে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে দরজা বন্ধ তাহলে সিফাত ভেতরে আসলো কী করে?চোখ পড়ে বেলকনির দরজায় তপ্ত শ্বাস ফেলে সে, বুঝতে বাকি নেই যে সিফাত ওই দরজা দিয়ে ভেতরে এসেছে।
‘ কী ব্যাপার আমার আরু জানের লজ্জা পেয়েছেন?’

লজ্জা দেওয়ার জন্যে কথাটা বলে সিফাত, সত্যি বলতে আরুহী ভীষণ লজ্জা পেয়েছে কিন্তু তা বুঝতে দেয়নি একদমই।
‘ না একদমই লজ্জা পাইনি, আমি বরং অবাক হচ্ছি এটা ভেবে এই রাতের বেলায় একজন মেয়ের রুমে প্রবেশ করেছেন তাও আবার বিনা অনুমতিতে।’
‘ হ্যা করতে হলো যদি মেয়ে কথা না শুনে তাহলে তো এমন করতেই হবে।’
‘ ছিহ্, আপনি এমন?’
‘ হ্যা আমি এমনি, খুব খারাপ আর আমি তো এটা ভেবে এসেছি প্রথমে আপনাকে আমার বাবুর আম্মু বানানোর কাজটি করব এরপর বিয়ে।’

বাবুর আম্মু কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার মত অবাক হয় আরুহী।
‘ দেখুন প্লীজ চলে যান, আমি এসব একদমই পছন্দ করছি না।দয়া করে চলে যান আর ভালো লাগেনা এসব।’
‘ সমস্যা কী? আমাকে বিয়ে করলে কী হয়? নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি তাই এত্ত অবহেলা?’
‘‌না ভ’য়।’
‘ কিসের ভ’য়?’
‘‌জানি না এবার যান আপনি।’

সিফাত আগের ন্যায় আরুহীর খুব কাছে এসে বসে নাকে নাক ঘষে বলে।
‘ আমি বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি? চাইলেও ছাড়তে পারব না,প্লীজ আমাকে কাছে টেনে নেওয়া যায় না?’

সিফাতের কথা গুলো বুকে এসে লাগছে আরুহীর কিন্তু কিছু করার নেই তো। হঠাৎ দরজায় রোশনা বেগম টোকা দেয়।
‘ আরু,এই আরু? কী রে জেগে আছিস তুই? দরজা টা খুল মা।’

রোশনা বেগম কে এই মূহুর্তে আশা করেনি আরুহী, হঠাৎ এভাবে চলে আসায় বিচলিত হয়ে উঠে আরুহী।এক বার দরজার দিকে আর আরেক বার সিফাতের দিকে তাকাচ্ছে।
‘ আপনি আসলেই পাগল কী হবে এখন বলুন তো?এক কাজ করুন যেভাবে এসেছিলেন সেভাবে যান।’

‘‌না শাশুড়ির সাথে কথা বলে যাই?’

‘ কী?’

‘ জ্বি।’

সিফাত এসে দরজা খুলে দেয়, সিফাত কে দেখে ভ্রু কুঁ’চকে ফেলে রোশনা, পিছনে তাকিয়ে দেখে আরুহী দাঁড়িয়ে আছে।
‘ তুমি কে?এত রাতে আমার মেয়ের ঘরে কী করছো?’

‘ আন্টি আমি সিফাত,আর আপনার হবু জামাই।’

রোশনা বেগম বুঝতে পারে এই হলো সিফাত,তিনি কিছু বলেন না।
‘ কী করব বলুন? আপনার মেয়ে এত্ত জেদী তাই আর না এসে থাকতে পারলাম না।’

‘ তা বাবা তুমি চাও কী?’
‘ বিয়ে করতে চাই, আপনার কে প্রচন্ড রকম ভালোবেসে ফেলেছি কিন্তু সে বোঝার চেষ্টা করছে না, একটু বুঝিয়ে বলুন সত্যি আমি ওকে সুখী রাখব।’

‘ তোমার বাড়ির কেউ মেনে নেবে?’

‘আমি মানিয়ে নেব, আমি যাকে পছন্দ করব তার সাথেই আমার বিয়ে হবে। আমি আপনার মেয়ে কে পছন্দ করি।’

‘ ঠিক আছে আমরা বরং এসব নিয়ে কাল কথা বলব, এখন রাত হয়েছে তুমি বাড়ি যাও।’
‘ জ্বি ।’

সিফাত এক পলক দেখে নেয় আরুহী কে,মেয়েটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে,চোখে তার এক আকাশ সম অভিমান, হয়তো ওর অনুমতি ব্যতীত এভাবে বিয়ের কথা বলাতে অভিমান করেছে।

চলবে… …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *