নবোঢ়া [পর্ব ৪২]

বাগান থেকে সবজির ঝুড়ি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল গুলনূর। হঠাৎ কানে এলো চাকর-বাকরদের আনন্দমুখর কলরব! জাওয়াদ ফিরে এসেছে! শুনেই তার বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। চমকে হাত থেকে প্রায় ঝুড়ি ফসকে পড়তে যাচ্ছিল, কোনোরকমে সামলে নিলেও কয়েকটা গাজর আর ঝিঙে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। থমকে দাঁড়িয়ে অনিচ্ছাতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল।

সাধারণ বেশে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জাওয়াদ। শার্ট গুছিয়ে পরা। হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ। প্রথম দেখার দিনটাও এমনই ছিল। তখন গুলনূর ছিল অপরিচিত, আজ সেই গুলনূরই অন্তরের অঙ্গ, বুকের গভীরে আটকে থাকা স্থায়ী অনুভূতি।

গত কয়েকদিন প্রতিটি শ্বাসে সে গুলনূরকে টের পেয়েছে। গুলনূর-বিহীন সময়গুলোর সুতীব্র যন্ত্রণায় সে পুড়ে খাক হয়েছে। সারাক্ষণ বুকের মাঝে অশান্তি, বিরামহীন মোচড়ানো ব্যথা…

সে অন্য প্রেমিকদের মতো প্রেমে পড়েনি, সে পড়েছে গুলনূরের মায়ায়! অদৃশ্য, দুর্নিবার মায়ায়। আজ, এই মুহূর্তে গুলনূরকে চোখের সামনে দেখে মনে হচ্ছে, গুলনূর অসম্ভব সুন্দর। কপালের ডান দিকের লম্বা দাগটাও যেন আজ অবিশ্বাস্য রূপের বাহক হয়ে উঠেছে!

গুলনূর তাকিয়ে আছে বিস্ময়-বিহ্বল চোখে। তার চাহনির প্রভাব যেন চারপাশের বাতাসকেও মোহাচ্ছন্ন করে দিয়েছে।

জাওয়াদ হাসল। সেই হাসিতে হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়ার আনন্দ। যদিও সে এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি, তাকে গ্রাস করেছে এক অতল, অসীম ভালোবাসা। আরও ঠিকভাবে বলতে গেলে, গুলনূরের অস্তিত্বই তার জীবনের সবচেয়ে জরুরি অংশ হয়ে উঠেছে।

সে শুধু জানে, গুলনূরকে প্রতিটি ক্ষণে পাশে চাই। গুলনূর কাছাকাছি থাকলে মনে শান্তি নেমে আসে।

জাওয়াদকে এগিয়ে আসতে দেখে গুলনূর তাড়াতাড়ি কুর্নিশ করল। জাওয়াদ কাছে এসে ছড়িয়ে পড়া সবজিগুলো কুড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এত ভারী ঝুড়ি তুমি কেন বয়ে নিয়ে যাচ্ছ? এটা কি তোমার কাজ? নাকি নিজেকে সর্বগুণসম্পন্না প্রমাণ করতে চাও? বাড়ির পুরুষরা কোথায়?’

জাওয়াদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল সিদ্দিক বাইরে থেকে উঁকি মারছে। সিদ্দিককে ডেকে বলল, ‘এসো, এই ঝুড়িটা রান্নাঘরে পৌঁছে দাও, যাও।’

সিদ্দিক দৌড়ে এসে ঝুড়িটা মাথায় তুলে নিল।

জাওয়াদ হুঁশিয়ারির সুরে গুলনূরকে বলল, ‘আর কখনো যেন তোমাকে ভারী কিছু বইতে না দেখি। যাও রান্না করো, আমার পছন্দের সব খাবার রান্না করবে। আজ তোমার বিশ্রাম নেই।’

গুলনূর বাধ্য খাদিমার মতো মাথা নেড়ে কুর্নিশ করে চলে গেল।

বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে আকাশের নীলিমায় দৃষ্টি মেলে ধরেছেন কোহিনূর। তার মুখজুড়ে আকুলতার চিহ্নমাত্র নেই, চোখে আবেগের ছায়াপাত ঘটেনি। যেন এই আগমন কোনো বিশেষ সংবাদই নয়। তিনি মৌন প্রতীক্ষায় রয়েছেন, দেখতে চান, জাওয়াদ তাকে খুঁজে আসে কি না।

সিঁড়ির ধাপগুলো বেয়ে গুরুভার পায়ে জাওয়াদ উঠে আসে দোতলায়। সামনেই দেখা হয়ে গেল তার বাবা সুফিয়ান ভূঁইয়ার সাথে। শিষ্টাচারের খাতিরে একবার সালাম জানিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল কোহিনূরের ঘরের দিকে।

দরজায় মৃদু আঘাতের শব্দ শুনে কোহিনূর প্রফুল্ল হলেন কি বিমর্ষ, তা অনুধাবন করা দুরূহ। তিনি ধীর পায়ে এসে দরজা খুলে দিতেই জাওয়াদ তাড়াতাড়ি ঢুকে কোহিনূরের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলল, ‘কেমন আছেন দাদিজান?’

কোহিনূরের দৃষ্টি স্থিরনিবদ্ধ হয় জাওয়াদের চোখে। নাতির দৃষ্টিতে অন্যরকম জ্যোতি! মনে হচ্ছে, এই ফিরে আসা জমিদারির মোহে নয়, বরং গুলনূরের আকর্ষণে।

বাড়তি কোনো ভাবপ্রকাশ না করে, শুধু ক্ষীণ হাসিরেখা ফুটিয়ে তিনি বললেন, ‘ভেতরে আয়। তোকে কিছু বলার আছে।’

জাওয়াদ বিস্ময় মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায়। কোনো কুশলজিজ্ঞাসা নেই, ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা নেই…দাদিজান কী এমন বলবেন? কিছু কি ঘটেছে? গুলনূরকে তো ঠিকই মনে হলো। তার চিন্তাজগতে প্রশ্নের তরঙ্গমালা উথাল-পাতাল করতে লাগল।

শৈশব থেকেই সবুজের কোলে লালিত-পালিত হওয়ায় প্রাকৃতিক পরিবেশে নিজের অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পায় জুলফা। নাভেদ জুলফার এই দুর্বলতাকে মূলধন করে তাকে নিয়ে হারিয়ে যায় অচেনা পথে। আজ ভোরেও শঙ্খিনীর মাধ্যমে গোপন বার্তা পৌঁছেছিল জুলফার কাছে।

শব্দর গতকাল বিকেলে আসিদপুরের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ফিরতে পারেনি। এই সুযোগে জুলফার হৃদয়ে জমে থাকা অবদমিত আবেগ আবারও জেগে উঠল। দুপুরবেলা যখন চারপাশ নিস্তব্ধ, ঘুমন্ত মানুষের নিশ্বাসে বাতাস ভারী, তখন জুলফা নিঃশব্দে শঙ্খিনীর কাঁধে সব দায়িত্ব অর্পণ করে উদ্বেলিত হৃদয়ে নাভেদের খোঁজে পাড়ি জমায়।

দুজন একসঙ্গে উপস্থিত হয় চাঁদেরকুটি গ্রামে। নামটি যেমন মনোমুগ্ধকর, তেমনি গ্রামটিও। কান্তারপুরের অদূরেই এই ছোট জনপদ। জুলফা চোখ বুলিয়ে নেয় চারদিকে। শান্ত জলধারায় বয়ে চলেছে সরু একটি খাল, যার একপাশে খেজুর বাগান, অপরপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। ধানের কচি চারাগুলো সবেমাত্র সবুজ রঙে রাঙতে শুরু করেছে।

খেজুর বাগানের এক প্রান্তে, খালের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে খেজুরপাতা দিয়ে ছাওয়া একটি মাটির কুটির। এর পরিবেষ্টনীতে কয়েকটি কলাগাছ ও সাতটি নারকেল গাছ মাথা তুলে আছে আকাশের দিকে। রক্তিম ফুলে ভরা ঝোপ এবং একপাশ ঘেঁষে সর্পিল গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কাঁচা পথ।

খালের স্বচ্ছ জলে খেলা করছে একঝাঁক হাস। আকাশে ঝড়ের আভাস থাকলেও বাতাসে ভেসে আসছে এক ধরনের মন কেমন করা মাদকতা।

জুলফা কুটিরটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই ঘরে কে থাকে? কাউকে দেখছি না যে।’

‘একজন পাহারাদার থাকে৷ তিনি খেজুরবাগান, ধানক্ষেত সবকিছুর তদারকি করেন৷ আজ নেই…কারণ আপনার গোপনীয়তা।’

‘ও্’

কী মিষ্টি বাতাস বইছে! আকাশও ধীরে ধীরে মেঘলা হয়ে আসছে। একটু আগেই রোদ চকচক করছিল। জুলফা চারপাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এত মনকাড়া জায়গাগুলোর সন্ধান আপনি কীভাবে পান?’

‘এখানে-ওখানে ঘুরি। কোথাও সুন্দর কিছু দেখলে মনে হয়, আপনাকে দেখাই।’

‘শুধু আমাকেই?’

নাভেদ কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে বলল, ‘আর কে আছে?’

কথাটা জুলফার হৃদয়ে বাজল। নাভেদের জীবনে কি সত্যিই এমন কেউ নেই যার সাথে সে সুন্দর মুহূর্তগুলো ভাগ করে নিতে পারে? সে-ই কি একমাত্র? বুকের ভেতর একটা অচেনা আবেগ দুলে উঠল। নিজেকে সংযত করে সে খালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুরুষ মানুষের তো অনেকেই থাকে জীবনে…’

নাভেদ ভ্রু তুলে প্রশ্ন করল, ‘কে থাকে?’

জুলফা ঠোঁটের কোণে হাসি লুকিয়ে বলল, ‘অভিনয় করবেন না। যেন আপনি কিছুই জানেন না!’

নাভেদ কাঁধ নাড়ল, ‘তা অবশ্য আছে।’

জুলফার মুখের হাসি মুছে গেল। চোখে সংশয়ের ছায়া নেমে এল, ‘আছে?’

‘হুম… আছে।’

‘আপনার মনের মানুষ?’

‘মনেরই বটে। বন্ধু তো মনেরই হয়।’

‘বন্ধু?’

জুলফা নিজমনে ভাবে, নিশ্চয়ই রাইহার কথা বলছে। নাভেদ আর রাইহার সখ্যতা তো দর্শনীয়। হাস্যরস, গল্পগাথা, আড্ডাবাজিতে মুখোর। যদিও সম্প্রতি দুজনকে আর একসঙ্গে দেখা যায় না।

ঘাসের উপর বসে জুলফা খালের জলে আঙুল ডুবিয়ে দিল। অবাক ব্যাপার এই গ্রীষ্মেও জলধারা ভরপুর! কানায় কানায় উপচে পড়া। আর কী অদ্ভুত শীতলতা! খেজুর গাছের ছায়া পানিতে ছবির মতো ভাসছে। সে মাটির একটা টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে জলে ছুঁড়ে দিল। পানিতে সৃষ্টি হলো ছোট্ট বৃত্ত, ধীরে ধীরে বড় হয়ে শেষে মিলিয়ে গেল অদৃশ্যে।

নাভেদ কাছাকাছি একটা গাছের শিকড়ে বসে নিঃশব্দে জুলফার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। হঠাৎ নাভেদ জিজ্ঞাসা করল, ‘ভয় লাগে না?’

জুলফা ভুরু কুঁচকে তাকাল, ‘ভয়? কিসের ভয়?’

‘যদি জানাজানি হয়ে যায়?’

‘জানাজানি? কীসের জানাজানি?’

‘আমাদের বন্ধুত্বে খবর যদি ছড়িয়ে যায়? এভাবে অবাধে ঘুরে বেড়ানো…জমিদার বধূর সঙ্গে কর্মচারীর… ‘ নাভেদ থেমে গেল। আবার বলল, ‘আমি আর আপনি দুজনই জমিদারদের চোখে কাঁটা হয়ে যাব।’

জুলফা একটু হেসে বলল, ‘ভয় পাচ্ছেন?’

নাভেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘নিজের জন্য না… আপনার জন্য।’

জুলফা পলক না ফেলে কিছুক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘বন্ধুত্বে ভয় থাকতে নেই, নাভেদ সাহেব। আমি ভয় পাই না।’

এই কথায় নাভেদের অন্তরে কী যেন ঘটল। সে জুলফার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জুলফা আগের থেকে অসম্ভব সুন্দরী হয়েছে। অকল্পনীয় রূপসী। প্রথম দেখার সময়েও নিঃসন্দেহে মনোহারী ছিল, কিন্তু তখন তার গায়ে রোদে পোড়া ছাপ ছিল। এখন সেই চিহ্ন মুছে গিয়ে তার সৌন্দর্য আরও দীপ্তিময় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। আর জুলফার ওই টানা চোখ দুটি তো প্রথম থেকেই তার মুখের চেয়েও বেশি কথা বলে। এমন ভাষাময় চোখ সে আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি।

তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জুলফা প্রশ্ন করল, ‘কী দেখছেন?’

নাভেদ পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কাগজে মুড়ানো কিছু জুলফার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘ওমন সুন্দর পা রঙ ছাড়া মানায় না।’

জুলফা কাগজ খুলে দেখে, আলতার শিশি। তার চোখ দুটি চকচক করে ওঠে। মুখে কৌতূহল মাখা উচ্ছ্বাস। শব্দর দামী দামী অলংকার উপহার দিয়েও তার হৃদয়ে যে প্রফুল্লতা জাগাতে পারে না, নাভেদের এই সামান্য উপঢৌকন তাই করে দেখাল।

নারীর মনস্তত্ত্ব বড়ই বিচিত্র। যাকে সে অন্তরে ধারণ করে, যে হৃদয়ের গভীরে বাস করে, তার দেওয়া সামান্য ঘাসও তার মনে আনন্দের প্রবাহ বয়ে আনে।

জুলফার উৎফুল্ল আঙুলগুলো তৎক্ষণাৎ আলতা খুলে পায়ে মাখতে শুরু করল।

চারিদিকে তখন বাতাসের তাণ্ডব বাড়ছে। পূর্বাকাশে মেঘের ঘনঘটা। আজকাল ঝড়বৃষ্টি হয় প্রায়ই। হঠাৎ বাতাসের ঝাপটা আসে, আকস্মিক বজ্রপাত শুরু হয়। মাথার ওপর খেজুর গাছের পাতা কাঁপছে থরথর করে। জুলফা আলতা পরার ফাঁকে ফাঁকে নাভেদের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

নাভেদ তার জীবনে একটি অপরিহার্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো সীমালঙ্ঘন না ঘটলেও, বন্ধুত্বের সেতুবন্ধনে সে তার হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছে। মোমের মতো নরম, প্লাবিত হয়ে আছে তার অন্তর।

পশ্চিম দিগন্তে সূর্য তখন বিদায় নিচ্ছে। খালের জলে লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। নাভেদ সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখুন, সূর্যটা জলে কেমন লুটোপুটি খাচ্ছে।’

জুলফা সেদিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘কী সুন্দর!’

‘তবে আমার চোখে অন্য কিছু আরও বেশি সুন্দর।’

নাভেদ পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে জুলফার দিকে। তার দৃষ্টিতে মুগ্ধ বিস্ময়। সূর্যের শেষ রশ্মি জুলফার মুখে একটি স্বর্ণাভ ছায়া ফেলেছে। জুলফা অস্বস্তি বোধ করে প্রশ্ন করল, ‘কী দেখছেন এভাবে? সূর্যাস্ত তো ওদিকে।’

‘সূর্যাস্ত তো রোজই দেখা যায়… কিন্তু কিছু দৃশ্য আছে যা সবসময় দেখা যায় না। আর দেখলে চোখ ফেরানো যায় না।’

‘আপনি সব সময় এমন ঘোরানো পথে কথা বলেন কেন?’

‘কারণ কিছু কথা সোজা পথে বলা যায় না… ভয় হয়।’

‘কিসের ভয়?’

‘হারানোর।’

ছোট ছোট বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। তা উপেক্ষা করে নাভেদ হঠাৎই বলতে শুরু করল,

নিশীথ রাতের আঁধারে দেখা তোমার সাথে প্রথম

চোখের কোণে জল নামিল, হৃদয় হইল মগন।

বাঁশবনে ঝরে শিশির, গভীর রাতের সুরে,

তোমার পথের ধুলো হই, হারাই আলোর পুরে।

আমি পথিক একা, খুঁজি তোমার ছায়া,

স্বপ্নের বাতায়নে তুমি, বৃষ্টি ভেজা মায়া।

নিরব হল সে। ম্রিয়মাণ হাসিতে বলল, ‘এখন আমি মুসাফির পথের ধূলিকণায়, আর আপনি… অন্য কারো নিকুঞ্জবন।’

জুলফার বুকজুড়ে জমে থাকা অনুভব হঠাৎ করেই দর্পণ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে। এক দুর্বার ঢেউয়ে সে কেঁপে ওঠে। তার সামনে ভেসে ওঠে সেই রাত, যখন প্রথমবার তাদের দেখা হয়েছিল, নাভেদ ছিল মাতাল, সময়টা ছিল রাতের গভীরে, চারপাশ নিঃস্তব্ধ। পাশেই ছিল বাঁশবন! অবাক হয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘আপনার মনে আছে?’

নাভেদ শুধু মাথা নাড়ল, ‘আছে।’

জুলফা নিজের গলার অস্পষ্ট কাঁপুনি সামলে বলল, ‘এতদিন বলেননি কেন?’

নাভেদ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। জুলফার পাশটিতে বসে একটু দ্বিধা নিয়ে৷ তারপর, অনেকটা অনিশ্চিত হাতে, কপালের ওপর ছড়িয়ে পড়া উদ্ভ্রান্ত চুলগুলো ছুঁয়ে দিল। আঙুলের ডগায় তেমন জোর নেই, যেন সে ভয় পাচ্ছে কিছু ভেঙে যাবে বলে। হালকা হাতে সেই কালো রেশমি চুলগুলো সরিয়ে দিল কানের আড়ালে। জুলফার গাল আর কপালে জমা বৃষ্টির জলকণাগুলো আলতো করে মুছে দিল হাতের পাতা দিয়ে; তার আঙুলের ছোঁয়া এত কোমল যে জুলফার মনে হলো যেন কেউ বুকের ভেতর একটা জানলা খুলে দিয়েছে। তার সমস্ত শরীর অস্থির হয়ে উঠল। বুকের ভেতরটা যেন শতধারায় উত্তাল হয়ে উঠেছে, প্রতিটি রক্তকণিকা যেন বিদ্যুৎস্পর্শে কেঁপে উঠছে। দমবন্ধ হওয়ার মতো অনুভূতি; সে নিজেকে সামলে ঠোঁট কামড়ে ধরে, যেন এই অনুভূতির সমুদ্র তাকে ভাসিয়ে না নিয়ে যায়।

নাভেদ প্রায় ফিসফিসিয়ে জানাল, ‘সব কি বলা যায়? এইযে আমি আপনার মনের সবটুকু পাড়ার খবর জানি, সে কথা কি আগে কখনো বলেছি?’

জুলফার বিস্ফোরিত চোখ স্থির হয়ে পড়ে নাভেদের চোখে। এই চোখ দুটি, তার চাওয়া-পাওয়া, না বলা কথা, নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস সব কিছু পড়ে ফেলেছে? সবকিছু?

ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাথে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। নাভেদ যেন কোন গভীর সম্মোহন থেকে হঠাৎ জেগে উঠেছে, এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে জুলফাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, ‘চলুন ফিরে যাই, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে৷ যেকোনো মুহূর্তে ঝড় আসবে।’

জুলফা ভূতগ্রস্তের মতো গাছে ঝুলিয়ে রাখা বোরকা আর নিকাব পরে নিল। তারপর নিঃশব্দে নাভেদের পিছু নিয়ে হাঁটতে শুরু করল জমিদার বাড়ির দিকে। আকাশ যেন ভেঙে পড়বে, এমন চেহারা নিয়েছে। কান্তারপুরে ঢুকতেই হঠাৎ মেঘ ডাকার সাথে সাথে আকাশ থেকে নেমে আসে মুষলধারে বৃষ্টি। দুজনেই ছুটে কান্তারপুরের প্রাথমিক স্কুলের ছাদের নিচে আশ্রয় নেয়। আরো অনেক পথচারী সেখানে আশ্রয় নিয়েছে, ভিজে-কাপড়ে অপেক্ষা করছে ঝড় থামার। জুলফা ভীত হরিণীর মতো গুটিসুটি মেরে নাভেদের পিছনে লুকোয়। আকাশে মেঘের গর্জন আর বজ্রপাতের সাথে প্রবল ঝড় বইছে, স্কুলের চারপাশের গাছগুলো মাথা নুইয়ে দুলছে। বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে তাদের গায়ে, ভিজিয়ে দিচ্ছে কাপড়ের প্রান্ত।

নাভেদ গলার স্বর নিচু করে অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয় পাবেন না, আমি আছি আপনার সাথে।’

জুলফা কেবল মাথা নাড়ল।

যেখানে বিপদের ছায়া, সেখানেই তো দুর্যোগ নেমে আসে অঘোষিতভাবে। ঠিক তখনই যেন মাটি ফুঁড়ে উঠল সুফিয়ান আর মনির। তারাও বাড়ি ফেরার পথে ঝড়ের কবলে পড়েছে। তাদের দেখে নাভেদ আর জুলফার বুকের ভেতরটা পাখির ডানার মতো ধড়ফড় করতে লাগল। সুফিয়ানের চোখেও বিস্ময়ের ঝলক।

চলবে,…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *