নাভেদের হারবাল বিষবিজ্ঞান, পুরাতন শাস্ত্র এবং অদৃশ্য প্রাণরহস্যের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন হিমালয়ের প্রত্যন্ত এক পর্বতগাত্রে অভিযানে গিয়ে তার চোখে পড়ে এক বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসী গোষ্ঠীর রক্ষিত প্রাচীন বিষবিধির পাণ্ডুলিপি। মেটে চামড়ায় লেখা সেই নথিতে ছিল এমন এক বিষের বর্ণনা, যে বিষ প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না; শরীরকে শত্রু ভেবে নেয় না, আত্মীয়র মতো মিশে যায় শিরা-উপশিরায়। তারপর সময়ের ফাঁকে ফাঁকে বুনে চলে অভিশাপ। হাড়ের গভীরে জ্বলুনি শুরু হয়, ঘুম হয়ে ওঠে ঘোর বিভীষিকা। শরীরের কোষেরা একে একে নিঃশব্দে বিদ্রোহ করে, অথচ বাইরের পৃথিবী টের পায় না কিছুই।
এই বিষের জাদুকরী জটিলতায় মোহিত হয়ে নাভেদ ফিরে এসে জোটায় দু’জন সহযোগী। একজন বিদেশফেরত রাসায়নিক তত্ত্ববিদ, অন্যজন পুরাতন নক্ষত্রপঞ্জির ব্যাখ্যাকারী স্থানীয় জ্যোতির্বিদ। দিনের আলোয় রসায়ন আর রাতের অন্ধকারে ছায়াগ্রস্ত জ্যোতির্ময় মানচিত্রে চলতে থাকে গবেষণা। তৈরি হয় ধাতবাভা যুক্ত তরল, দেখতে সোনালি। নাম রাখা হয় সর্পকণ্ঠী।
সর্পকণ্ঠী নাভেদের ছোঁয়ায় এখন আরও নিষ্পাপ, আরও ধীর, আরও ছলনাময়। সে শব্দরকে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করিয়েছে এই বিষে। ব্যবসায়ী আলোচনার ফাঁকে চায়ের সাথে, খাবারের পাশ ঢেলে দেয় অল্পমাত্রায়।
নাভেদ নিঃশব্দে আলমারির দরজাটা খুলে সোনালি বিষের শিশিটি ভেতরে রেখে দেয়। শুনেছে, শব্দর নাকি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ আগে একজন ডাক্তার এসেছে তাকে দেখতে। বৈঠকখানা আর খাবার ঘর পর্যন্তই তার যাবার অনুমতি। যে কয়বার ছাদে গিয়েছে অনেক কৌশল করে লুকিয়ে যেতে হয়েছিল৷ ভিতরের অংশ, মানে অন্তঃপুর ওটা একান্তই দাসী ও জমিদারবাড়ির নারীদের দখল।
নাভেদ লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বালিশে মাথা রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। ঠোঁটের কোণে খেলল কুটিল হাসি। এ অঞ্চলে নামকরা চিকিৎসক নেই বললেই চলে। যারা আছে, তারা শুধু উপসর্গ দেখে অনুমান করে, গভীরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই তাদের। বিষ এমনভাবে মিশে গেছে, চিহ্ন রাখবে না, ধরাও পড়বে না সহজে।
কাল সকালেই শব্দর সুস্থ হয়ে উঠবে। শরীরে শক্তি ফিরে এলেই সে ভাববে, জটিল কিছু নয়। নগরমুখো হয়ে ডাক্তার দেখানো তার কাছে নেহাতই বাড়াবাড়ি মনে হবে। নাভেদের ঠোঁটে ফুটে উঠল শব্দহীন প্রাণখোলা হাসি।
ডাক্তার পুরো মনোযোগ দিয়ে শব্দরের নাড়ি পরীক্ষা করছেন। তিনি একবার ধীরে চোখের পাতা তুলে দেখলেন, অন্য হাতে কপালের স্পন্দন অনুভব করলেন। চশমার কাঁচ একটু মুছে নিয়ে চিন্তিত ভাবে কপালে ভাঁজ ফেলে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হুঁ… শরীরটা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই প্রচণ্ড গরমে শরীরের ভেতরের শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে বোধহয়। জোড়ায় জোড়ায় ব্যথা, মাথা ঘোরা এগুলোকে কোনো নির্দিষ্ট রোগ বলে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে দেহের ভিতরে কোথাও গণ্ডগোল হচ্ছে। পুরোপুরি নির্ণয় করতে পারছি না।’
তিনি নিজের চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে কিছুটা সময় নিলেন। গলা পরিষ্কার করে আবার বললেন, ‘ঘুমটা আসুক আগে। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। যদি অবস্থার উন্নতি না হয়, আগামীকালই হয়তো শহরে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে। আপাতত পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করুন।’
কোহিনূরের বুক থেকে যেন এক পশলা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। মুহূর্তেই তার মুখ অন্যমনস্ক হয়ে উঠল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ঘরের চারদিকে তাকাতেই খেয়াল করলেন, ললিতার উপস্থিতি নেই। এমন গুরুতর পরিস্থিতিতেও সে একবারও এসে দেখা করল না! এই বাড়িতে কেমন একটা অস্বস্তিকর উৎকণ্ঠা ক্রমশ বাড়ছে।
জাওয়াদকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। শুনেছেন, আসাদের পিছু নিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। আসাদ তো ফিরে এসেছে, জাওয়াদ কেন এখনো ফেরেনি? কোহিনূরের মনে অশুভ আশঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করল।
তিনি অস্থির পায়ে এগিয়ে চললেন ললিতার ঘরের দিকে। দরজাটি আধাখোলা। অনুমতি চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেন না, নিঃশব্দে পা ফেলে প্রবেশ করলেন ঘরের ভেতরে।
বারান্দার দিক থেকে ভেসে আসছে গুনগুন কান্নার সুর। সেই বেদনাধ্বনি অনুসরণ করে কোহিনূর এগিয়ে গেলেন। বারান্দার ধারে, পুরোনো কাঠের ছোট এক সিন্দুক খুলে বসে আছেন ললিতা। জাওয়াদের ছোটবেলার জামাকাপড়, রঙচটা খেলনা আর গন্ধমাখা পুরোনো রুমাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে কাঁদছেন।
ললিতার আঁচল মেঝেতে গড়িয়ে পড়েছে, চুল একাকার হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঝের ধুলো। সেই চুলের দীপ্তি, গায়ের দীপ্ত রং, অবয়বের শোভা সব এখনো অক্ষুণ্ণ। সময় কিছুই খণ্ডিত করতে পারেনি। আজও মনে পড়ে সেই বিকেল, যেদিন কোহিনূর গিয়েছিলেন রাজপরিবারের কিশোরী রাজকন্যা ললিতাকে দেখতে, সুফিয়ানের ভবিষ্যৎ সঙ্গিনী হিসেবে। পনেরো বছরের এক অপরূপী লজ্জার্ত, মাথা নিচু করা মেয়েটিকে দেখে তখন সবাই বাকরুদ্ধ। যেন মাটির শরীরে সৃষ্টিকর্তা বেহেশতের হূর পাঠিয়ে দিয়েছেন৷ এতটাই প্রখর ছিল তার রূপের জ্যােতি!
কিন্তু আজ সেই বাহ্যিক রূপের অলংকারের নিচে লুকিয়ে থাকা আত্মার বিকৃতি, চারিত্রিক কলঙ্কই বর্তমানে অধিকতর স্পষ্ট কোহিনূরের দৃষ্টিতে। মনুষ্যত্বের নোংরা দাগ, চোখধাঁধানো রূপকেও নিষ্প্রভ করে দিতে পারে। রূপ যদি অন্তরাত্মার প্রতিবিম্ব হত, তবে ললিতার মুখজুড়ে হয়তো এখন প্রতিফলিত হত শুধুই অন্ধকার… নিবিড় কালো অন্ধকার!
কারো পদশব্দ অনুভব করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন ললিতা। দেয়ালের নিকটে নিশ্চলের মতো দাঁড়ানো কোহিনূরকে দেখে চোখের কোটরে জমা অশ্রু উথলে উঠল। সান্ত্বনার আশায় ঠোঁট কেঁপে উঠল, গলা ভারাক্রান্ত করে উচ্চারণ করলেন, ‘ফুফুজান… জাওয়াদ… জাওয়াদ কি আর কখনো আমার বুকে ফিরবে না?’
কথাটা শেষ না হতেই ললিতা একটুকরো পুরোনো খেলনা আঁকড়ে ধরে নিঃশব্দে তাতে চুমু দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। যেন ওতেই জাওয়াদের আত্মা লুকিয়ে আছে কোথাও। তার চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ে দুটি কষ্টস্নাত অশ্রুবিন্দু।
ঠিক তখনই কোহিনূরের গলায় বিষলিপ্ত ফিসফাস ভেসে এলো, ‘অন্যায়ের বীজ একদিন আগুন হয়ে ফিরে আসে ললিতা…’
শোনামাত্রই আশ্চর্য এক জড়তা নেমে আসে ললিতার শরীরজুড়ে। ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকান পেছনে। বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি, ছাদের কার্নিশে জমে থাকা জলে অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। ঘরের ভেতর হারিকেনের তেল ফুরিয়ে আসা আলোয় কোহিনূরের মুখটা কেমন ছায়াময়, ভীতিকর ঠেকছে।
কোহিনূর দু’পা এগিয়ে এলেন। ললিতার কাছাকাছি এসে গলায় চাপা রাগ নিয়ে বললেন, ‘সেই আগুনই আজ তোমার কোল থেকে জাওয়াদকে ছিনিয়ে নিয়েছে।’
ললিতার ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। বুক কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে বলে উঠলেন, ‘অন্যায়? কোন অন্যায়ের কথা বলছেন আপনি?’
কোহিনূর হাসলেন, ‘তোমাকে কি এখন পুরনো খাতা খুলে সব পড়ে শোনাতে হবে?’
ভয়ে আতঙ্কে বোবা হয়ে গেলেন ললিতা। চোখের সামনে ঝলসে উঠল জীবনের প্রতিটি ভুল, প্রতিটি লুকোনো পাপ। মনের পর্দায় ভেসে উঠল সেইসব স্মৃতি যা বহুদিন ধরে মনের অন্ধকার কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখা।
কোহিনূর তার পিছনে পায়চারি করতে করতে বললেন, ‘যে পাপের সাক্ষী এই বাড়ির দেয়াল, এই চৌকাঠ, এই মাটির গন্ধ… যে কলঙ্কের ছোঁয়ায় আমার বাবার নাম, ইজ্জত, আর বংশমর্যাদায় কালি লেপেছে, হোক সেটা গোপনে, সেই পাপের দাম তো একদিন চুকাতেই হতো তোমায়।’
ললিতার হাঁটু কাঁপতে লাগল, দেহ যেন পঙ্গু হয়ে গেল। তিনি থরথর করে কেঁপে উঠে বললেন, ‘রহস্য করবেন না… আমি কিছু করিনি… কোন পাপ করিনি…’
কোহিনূর সামনের চেয়ারটায় ধীর পায়ে বসে পড়লেন। ভুরু কুঁচকে চোখ সরু করে বললেন, ‘তুমি নিশ্চিত, ললিতা? সত্যিই কিছু করোনি?’
ললিতার মুখ পাংশু, চোখে অপরাধবোধের ছায়া। তবু কণ্ঠে জোর আনার অসফল প্রয়াসে বলে উঠলেন, ‘না… কিচ্ছু না…’
কোহিনূর ললিতার দিকে ঝুঁকে গলায় ঝাঁঝ নিয়ে বললেন, ‘চাঁদেরকুটি গ্রামের বাগানবাড়ির কথা মনে আছে? কার সঙ্গে দুপুর গড়িয়ে সন্ধে করতে… কার বুকে মাথা রেখে দিব্যি দিতে দিতে হাসতে… ভুলে গেছো?’
ললিতা যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন। বুকের ভেতরটা কেমন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, ফেটে পড়ার উপক্রম। হাতের আঙুলগুলো শক্তিহীন, পায়ের তলদেশে জলোচ্ছ্বাসের মতো তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। গলায় আটকে থাকা কান্না আর বাঁধভাঙা নদীর মতো উথলে উঠতে চাইছে। তার সমগ্র অস্তিত্ব যেন একসঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল। ধপাস করে বসে পড়লেন কোহিনূরের পায়ের নিচে। কপাল মাটিতে ঠেকিয়ে, শরীর কুঁকড়ে, অসহায় শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, ‘আমি শুধু ভালোবেসেছি, ফুফুজান! আমি জানি অপরাধ করেছি… পাপ করেছি… কিন্তু এমন নিষ্ঠুর প্রতিদান কেন? বিধাতা আমার সন্তানকে কেন ছিনিয়ে নিলেন? জাওয়াদ কি সব জানে? ফুফুজান, আপনাকে মায়ের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি… আপনার কাছে ভিক্ষা চাই, শুধু বলুন… জাওয়াদ কি এসব জানে? সেই কারণেই কি আমাকে ঘৃণা করে?’
কোহিনূর নিশ্চুপ। ললিতার কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার দোষ… আমার পাপ… সবই তো ভালোবাসা থেকে জন্মেছিল ফুফুজান…’
কোহিনূরের চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল।
‘ভালোবাসা?’ তার কণ্ঠে দাবানলের তেজ। ‘স্বামীর ঘরে বসবাস করে পরপুরুষের সঙ্গে রাত্রিযাপনকে তুমি ভালোবাসা বলো?’
ললিতা আর্তনাদ করে কোহিনূরের পা দু’টি জড়িয়ে ধরলেন। তার জীবনব্যাপী অহংকার আজ চূর্ণবিচূর্ণ। তার রূপলাবণ্য, বংশমর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি সব যেন মরীচিকার মতো বিলীন হয়ে গেছে। এখন তিনি শুধুই পাপভারে নুয়ে পড়া এক নারী, পরাজিত জননী।
‘আমি অপরাধ করেছি, ফুফুজান… আমি স্বীকার করছি। সব ভুলে যাব, সমস্ত অতীত মুছে ফেলব।’
কোহিনূরের চোখে খেলে গেল এক ধরনের তৃপ্তি, যেন দীর্ঘ দিনের অন্তর্দাহ আজ কিছুটা প্রশমিত হলো। সামনে থাকা এই নারী, যিনি একসময় রূপে-গুণে-সৌন্দর্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, আজ ভেঙ্গে পড়েছেন ভিখারিণীর মতো।
তিনি বিচারকের আসনে বসে বললেন, ‘এই দেহে যে কলঙ্ক লাগিয়েছো, সেই দাগ কি মুছে যাবার মতো? যে মানুষটি সমগ্র আস্থা উজাড় করে তোমায় ভালোবেসেছিল, তাকে তুমি কি ফিরিয়ে দিতে পারবে তার নিষ্কলুষ বিশ্বাস? তুমি আর তোমার মা মিলে যে তরুণীর জিহ্বা কেটে নিঃশব্দ করে দিয়েছিলে, কেবলমাত্র সে তোমার পাপাচার দেখে ফেলেছিল বলে… তার কথা মনে পড়ে? সে এখনও জীবিত বাকশক্তি হারিয়ে ললিতা। তার কথা বলার ক্ষমতা ফেরত দিতে পারবে?’
ললিতা পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অশ্রুধারা থেমে গেল। মুখ কাফনের মতো বিবর্ণ হয়ে এলো। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।
কোহিনূর আরও বললেন, ‘সুফিয়ান আর তার মামারবাড়ির মধ্যে যে কূটচক্রান্ত করে শত্রুতা সৃষ্টি করেছ যাতে এই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়, কেউ এদিকে পা না বাড়ায়, সেই অপকর্মের জবাবদিহি করবে কে?’
নির্জনতা ভারী হয়ে চেপে বসে ঘরের প্রতিটি অণুতে। হারিকেনের ক্ষীণ আলোয় ললিতার মুখজুড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে তীব্র আত্মবেদনা। চোখে জল নেই, তবুও ভিজে আছে দৃষ্টি।
কোহিনূর বলছেন, ‘পাপের পাঁচিলে স্পর্শ করলে চিহ্ন থেকেই যায় ললিতা। এখন সেই দাগ মোছার চেষ্টা করলেও, সময় তোমাকে ত্যাগ করেছে বহুকাল আগেই।’
ললিতা কেবল চুপচাপ বসে আছেন নিচু মাথায়, নিস্তেজ চোখ, আর বুকের ভেতর নিঃশব্দ ঝড় নিয়ে।
‘বিচারালয়ের দৃষ্টিতে তুমি নিরপরাধ হতে পারো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার নজরে কোনো আবরণ পড়ে না, ললিতা। তিনি ন্যায়বিচার করেন, সময় নিয়ে নিখুঁতভাবে। তুমি যেভাবে নির্মমভাবে অনেকের হৃদয় শূন্য করে দিয়েছ, তেমনিভাবে জাওয়াদকেও তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন আল্লাহ। যাতে তুমি উপলব্ধি করো, প্রতিটি পাপাচারের মূল্য কীরূপ হয়। একাকী মৃত্যুবরণ করবে তুমি, নিঃস্ব হয়ে। চারপাশে মানুষের ভিড় থাকবে, কিন্তু কেউ তোমার হয়ে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলবে না। অধর্ম করলে দণ্ড পেতেই হয়।’
ললিতা কোহিনূরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কিন্তু আপনি তো কোনো দণ্ডভোগ করেননি। আপনিও তো একসময় কাউকে প্রতারিত করেছেন, ফুফুজান। অনিষ্ট করেছেন। তবে কী বিধাতার বিচার দ্বিমুখী আচরণ করে?’
বাক্যগুলি যেন দেয়ালে আঘাত করে প্রতিধ্বনিত হয়। কোহিনূরের চোখ রক্তিম হয়ে ওঠে, ‘আমি?’
‘আপনি অঙ্গীকার করেও একজনকে বিসর্জন দিয়ে অপরজনের সঙ্গে দাম্পত্য শুরু করেননি? আপনার প্রতিশ্রুতির প্রতিদান কী ছিল? প্রতারণা।’
মুহূর্তের মধ্যে কোহিনূরের মুখের রেখাচিত্র বিকৃত হয়ে যায়।
‘এতো বড় দুঃসাহস! আমার বিবাহ ছিল সম্মানজনক। আমি পাপ করিনি। যা করেছি, সামাজিক স্বীকৃতির ভেতরে থেকে করেছি। তুমি যা করেছ, সেটা পাপাচার, নির্লজ্জতার পরাকাষ্ঠা।’
‘ভালোবাসা তো পাপ হয় না। যদি হয়, তবে আপনার সেই বিবাহপূর্ব প্রেমও তো পাপ। কারও হৃদয় ভগ্ন করা, কাউকে আত্মঘাতের পথে ঠেলে দেওয়া এগুলোও কি অপরাধ নয়? একটি প্রাণবন্ত যুবক আপনার প্রতারণা সহ্য করতে না পেরে মরে…’
‘ল-লি-তা!’
কোহিনূরের গলা ফেটে যাচ্ছে রাগে। তার হাত কাঁপছে, ঠোঁট থরথর করছে।
ললিতা দ্রুত মাথা নত করলেন। অজান্তেই তীক্ষ্ণ জিহ্বার স্বভাবে চলে গিয়েছিলেন। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, ‘ক্ষমা করবেন, আমি সীমারেখা অতিক্রম করেছি। আমি পাপিষ্ঠা… আমি অপরাধী। আপনার সামনে আমার কোনো অধিকার নেই। আপনার যতটা ইচ্ছা দণ্ড দিন। আপনি যা নির্দেশ দেবেন আমি তাই পালন করব, শুধু জাওয়াদের দৃষ্টিতে আমি এতটা অবহেলিত কেন? আমার সন্তান কেন আমার ছায়াকেও সহ্য করতে পারে না? কেবল সেটুকু জানতে সাহায্য করুন। আমি এই বিভীষিকায় আর বাঁচতে পারছি না।’
কোহিনূর আর এক নিমেষও সেখানে অবস্থান করলেন না। দ্রুতপদে তিনি বেরিয়ে গেলেন দরজা ঠেলে।
সেই দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে ছিল গুলনূর। সবকিছু শুনেছে সে। চোখ দুটো বিস্ময়ে গোল হয়ে গেছে তার।
চলবে….
নবোঢ়া [পর্ব-৪৫]
