মুহূর্তটা যেন কোন অলৌকিক শক্তি নিজের হাতে থামিয়ে দিল। চারদিক নিস্তরঙ্গ হয়ে গেল। একটা অদৃশ্য আবরণ নামল সবার ওপর। দাসীরাও বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে পাথরের মূর্তিতে পরিণত। কারো কণ্ঠে একটি শব্দও উচ্চারিত হচ্ছে না।
জাওয়াদ চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল দাদিজানের বলিরেখায় ভরা মুখের দিকে। তার নিজের সাহসিক উচ্চারণ আর দাদিজানের অভাবিত ঘোষণার মাঝখানে আটকে তার শরীরের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্র শিথিল হয়ে আসছে।
কোহিনূরের মুখে আত্মপ্রসাদের দ্যুতি। জাওয়াদ যখন সুফিয়ানের সামনে নিরন্তর যুক্তিতর্ক পেশ করে গুলনূরের বিয়ে রোধ করতে ব্যাকুল হয়ে উঠছিল, তখন প্রতিটি পলকে তার অন্তরাত্মার গভীর ক্ষত আরো বেদনাদায়ক হয়ে জেগে উঠছিল। তার নিজের যৌবনকালে যদি এমন অদম্য সাহস থাকত, তবে কি বাবার একটি বাক্যে অপরিচিত পুরুষের চরণে নিজের জীবন সমর্পণ করতেন? সম্ভবত না। তিনি অভিযোগ করতেন, নিজের হৃদয়ের অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেন, ঠিক জাওয়াদের অনুরূপ।
আজ জাওয়াদ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হয়েও, ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষায় সংগ্রাম করছে। যদি গুলনূরের বিয়ে অন্য কোথাও হয়ে যায়, ছেলেটা হারিয়ে যাবে জীবনের অনির্দিষ্ট অন্ধকারে। তার চোখেমুখে সেই আশঙ্কা তিনি দেখতে পাচ্ছেন। পথভ্রষ্ট জাওয়াদকে ঘরমুখো করতে পারে শুধুমাত্র গুলনূরের অনুরাগ। ঐতিহ্যের সীমানা ছাড়িয়ে, ভূঁইয়া বংশের দম্ভের বাইরে গিয়ে যদি তারা সুখী হয় তবে তাই হোক!
তিনি পুনরায় ধীরস্থির কণ্ঠে বললেন, ‘শুক্রবারে গুলনূরের সাথে আসাদের নয়, জাওয়াদের বিয়ে হবে।’
সুফিয়ান ক্রুদ্ধ স্বরে আপত্তি জানালেন, ‘কী বলছেন, ফুফুজান? একজন বোবা দাসী… তাকে আমার ছেলে বিয়ে করবে? আর তুমি…’ তার কণ্ঠে অবজ্ঞার তীক্ষ্ণ তেজ, তিনি জাওয়াদের দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলেন, ‘এতক্ষণ তো গর্ব করে বলছিলে, বিয়েই ভবিষ্যৎ নয়! এখন নিজেই কেন বিয়ে করতে চাইছো?’
গুলনূর আতঙ্ক আর সঙ্কোচে বিমর্ষ হয়ে উঠল। অশ্রুপ্লাবিত চোখে মুখ লুকিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল সেখান থেকে। তার আকস্মিক প্রস্থানে জাওয়াদ চমকে গেল। কিছু না ভেবেই, সামান্যতম দ্বিধাবোধ ছাড়াই সে ছুটে গেল গুলনূরের পেছনে।
সুফিয়ান তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকলেন, ‘জাওয়াদ! দাঁড়াও!’
জাওয়াদ শুনল না। সে সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে কেবল গুলনূরকে অনুসরণ করল।
কোহিনূর উঠে দাঁড়িয়ে একমুহূর্ত নাভেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সুফিয়ান, শব্দর ঘরে এসো।’
নাভেদ অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসল। সে কোহিনূরের চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছে। তিনি সংকেতে জানিয়েছেন, নাভেদের উপস্থিতিতে তিনি পারিবারিক আলাপচারিতা করতে অনিচ্ছুক। বৃদ্ধা তাকে প্রথম সাক্ষাৎ থেকেই কেন যেন অনাদর করেন। কী জানি কোন কারণে! কোহিনূরের সঙ্গে সঙ্গে সেও কর্মস্থলে যাবার জন্য হাত ধুয়ে উঠে গেল।
গুলনূর দরজার পাল্লা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, জাওয়াদ বাধা দিয়ে দাঁড়াল। জলস্রোতে ভাসমান চোখ নিয়ে গুলনূর তার দিকে তাকাল। আবারও শক্ত হাতে দরজা টেনে বন্ধ করার চেষ্টা করতেই জাওয়াদ আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ঢুকে পড়ল ঘরের ভেতর।
গুলনূর হতাশায় বিছানার কিনারে ধপাস করে বসে অসহায়ভাবে মাথা নত করে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। তার কাঁধ কেঁপে কেঁপে উঠছে দেখে জাওয়াদ মুহূর্তকাল নীরবতায় ডুবে রইল।
তারপর টেবিল থেকে কলম-কাগজ তুলে নিয়ে গুলনূরের পাশে রেখে, তার পায়ের কাছে বসতে গেল। গুলনূর সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে বসতে উদ্যত হতেই জাওয়াদ দ্রুত হাত বাড়িয়ে তাকে আটকে দিল। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানেই থাকো।’
গুলনূর সংকোচে গুটিয়ে রইল।
জাওয়াদ গলার স্বর নরম করে বলল, ‘ভুল বুঝো না আমায়।’
গুলনূর আহত হরিণীর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। জাওয়াদ ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘আর কোনো উপায় ছিল না আমার সামনে।’
গুলনূর কলম তুলে নিয়ে দ্রুত হাতে লিখল, ‘আপনারাই আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেন, আমি কেউ নই। শুরুতে ফুফুজান আমাকে জিজ্ঞেস না করেই আমার বিয়ে স্থির করলেন। তারপর আপনিও আমার মতামত না নিয়েই আমাকে বিয়ে করার ঘোষণা দিলেন সবার সামনে। একই তো হলো, কোনো পার্থক্য নেই।’
জাওয়াদের ভ্রু কুঁচকে গেল, ‘একই? তোমার কাছে দুটো একই মনে হয়? আসাদকে বিয়ে করা আর আমাকে বিয়ে করা একই?’
গুলনূর লিখল, ‘না, এক নয়। কিন্তু অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হলে অন্তত কষ্টটা একটু হালকা হত। মনে হত, আমি বিয়ে করে ভুল করেছি। কিন্তু আপনাকে বিয়ে করে যে যন্ত্রণা পাব সেটা ভিন্ন। আপনার মতো একজন মানুষ, যিনি আমার ভালোর জন্য এত লড়াই করলেন, আমাকে আগলে রাখলেন, তার ভবিষ্যৎ আমি ধ্বংস করে দিলাম… এই আত্মগ্লানি আমাকে শান্তি দিবে না।’
‘ধ্বংস! আমাদের বিয়ে হলে আমার জীবন ধ্বংস হবে তোমাকে কে বলল? কার অনুমতিতে তুমি এমন ভাবছো?’ শেষের বাক্যটিতে জাওয়াদের কণ্ঠস্বর পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠল।
তাকে রেগে যেতে দেখে গুলনূরের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল। জাওয়াদের তীব্র দৃষ্টি তার চোখের ভয়ার্ত চাহনি ধরতে পেরে নিভে এলো। দ্রুত কোমল হয়ে হাত বাড়িয়ে গুলনূরের গালে স্পর্শ করে বলল, ‘তুমি ভুল চিন্তা করছ। আমি তোমার সঙ্গে ভালো থাকি গুলনূর। আমি…আমি একটা ভয়ানক ঝড়ে, একটা নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি হয়ে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার বন্ধুত্ব, তোমার সঙ্গ আমাকে সেই অসহ্য বেদনা থেকে রক্ষা করে। আমি তোমার উপস্থিতিতে আশ্বস্ত বোধ করি।’ জাওয়াদের চোখ জ্বলজ্বল করছে আবেগে, ‘শহরের দিনগুলো আমার কাছে কেমন অনুভূত হত জানো তুমি? জানো না। মনে হত, দীর্ঘকাল সমুদ্রের গভীরে ডুবে থেকে অবশেষে কিনারায় উঠতে পেরেছি, মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে পারছি। আমার অস্তিত্বকে তো পুনর্গঠন করেছ তুমি… ধ্বংস করবে কী করে?’
গুলনূর অবাক বিস্ময়ে শুনছিল জাওয়াদের বলা এই সরল, স্বাভাবিক স্বীকারোক্তি! তার হৃদয়ের অন্ধকারে যেন একঝলক আলো এসে ছুঁয়ে গেল। সাহস সঞ্চয় করে আবার লিখল, ‘সেটা তো বন্ধু হিসেবে। জীবনসঙ্গিনী হিসেবে আরও অনেক দায়িত্ব এসে জড়ায়। দাম্পত্য…’গুলনূরের হাত হঠাৎ স্থির হয়ে গেল। লেখনী যেন অবশ হয়ে গেছে। সে মুহূর্তের জন্য জাওয়াদকে দেখল, তারপর আবার লিখল, ‘আমি কখনই পরিপূর্ণ স্ত্রী হয়ে উঠতে পারব না। যদি বাধ্যতামূলকভাবে স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করি সেটা আমার কাছে…’
গুলনূরের হাত আবার থেমে গেল। চোখের কোণ থেকে একফোঁটা অশ্রু মুক্তার মতো গড়িয়ে পড়ল। কীভাবে সে বোঝাবে, তার পক্ষে অসম্ভব একজন পুরুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া। দেহে দেহে প্রেমের যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি নর-নারীর অন্তরের গভীরে বাসা বাঁধে সেটা তো তার মধ্যে মৃত। অতীতের সেই কালো আঙুলগুলো তা কেড়ে নিয়েছে চিরতরে। যে তাকে বিয়ে করবে, সে হয় জোরজবরদস্তিতে সেই কালো হাতের প্রতিরূপ হবে নতুবা তারা দাম্পত্যের সেই মিষ্টি আনন্দ থেকে বঞ্চিত থাকবে। তার অধিকার নেই জাওয়াদকে সেই সুখ থেকে দূরে রাখার।
গুলনূরের আঙুলগুলো কাঠের পুতুলের মতো স্থির হয়ে গেল। জাওয়াদ তার মনের কথা বুঝতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে বিষণ্ণতায় মিশে যাওয়া হাসি হাসল। যৌনতা অন্যদের কাছে প্রেম হলেও তার কাছে ঘৃণার রংচটা অদৃশ্য কফিন।
এক সময় ছিল যখন সে আট-দশটা পুরুষের মতোই ছিল। তাপ, আকাঙ্ক্ষা, বাসনা সবই ছিল তার ভেতরে। তারপর একটা সত্য সবকিছু বদলে দেয়। বিভীষিকাময় সেই সত্য, দুঃস্বপ্নের মতো সেই দৃশ্য তার হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষ ঢেলে দিয়েছিল। এক সময় মানসিক ভারসাম্য হারানোর উপক্রম হয়েছিল তার। একটু শান্তির জন্য বন্ধুদের একজন তাকে নিয়ে গিয়েছিল সেইসব অন্ধকার গলির দিকে, যেখানে শরীর বিকোয়, যেখানে সম্পর্ক নয়, শুধু লেনদেন চলে।
শান্তির বদলে সেখানে পা রাখতেই তার ভেতরের বিভীষিকাগুলো আরও তীব্র হয়ে জেগে ওঠে। স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠেছিল অপ্রকাশ্য দৃশ্যপট, ভয়াবহ যন্ত্রণা। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল তার অস্তিত্ব। বমি করে দিয়েছিল সবার সামনে, ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল পুড়ে যাওয়া হৃদয় নিয়ে। সেই দিন থেকে জাওয়াদের মধ্যে অদৃশ্য মৃত্যুর সূচনা হয়। পুরুষসত্তা নিঃশেষ হতে থাকে নিঃশব্দে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, গুলনূরের প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও সে কখনও তাকে নিয়ে কোনো শরীরী কল্পনার মধ্যে যায়নি। এই ভালোবাসায় সে অন্ধকারে আলো ফোটানো শান্ত মশাল, যে মশাল আগুন নয়, শুধু উষ্ণতা দেয়।
জাওয়াদ নরম স্বরে অভয় দিয়ে বলল, ‘ভয় পেও না। সমাজের নিয়ম মেনে আমরা বিয়ে করব ঠিকই, কিন্তু সম্পর্কটা এমনই থাকবে। বন্ধুর মতো। আমি চাই না তোমাকে হারাতে, গুলনূর। তুমি আমার জীবনের একমাত্র আলো। এ আলো নিভে গেলে আমি আর নিজেকেই খুঁজে পাব না। বিশ্বাস করো, আমি কিছু চাই না, শুধু তোমার পাশে থাকাটুকু চাই।’
গুলনূর চোখ মেলে তাকিয়ে রইল। তার চোখে অবিশ্বাস, বিস্ময়। রগচটা, দাম্ভিক জাওয়াদ, জমিদার পরিবারের একমাত্র সন্তান তার সামনে এভাবে বসে আকুতি করছে! তার মতো কলঙ্কিত মেয়েকে জীবনের বেঁচে থাকার কারণ ভাবছে?
জাওয়াদ ধীরে ধীরে তার হাতটি ধরে বলল, ‘তুমি আমার জন্য রান্না করবে, আমার ঘর সাজাবে, দিনশেষে আমি ঘরে ফিরব, তুমি শুধু আমার অপেক্ষায় থাকবে…শুধু তুমি। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না। পারবে না আমাকে এইটুকু ভালোবাসা দিতে? বিনিময়ে তুমি যা চাও, আমি তাই দেব। শুধু থেকো যাও, গুলনূর। আমাকে একা করে ছেড়ে যেও না।’
গুলনূরের চোখের কোণ ভিজে উঠল। সে ধীরে ধীরে জাওয়াদের চোখের দিকে তাকিয়ে একটুখানি মাথা নাড়ল।
সুফিয়ান ঝড়ের বেগে ঘরে প্রবেশ করে বললেন, ‘ফুফুজান, আপনার মতো প্রজ্ঞাবান নারী কী করে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে!’ বাক্যগুলো কামানের গোলার মতো ছুটে এলো তার কণ্ঠ থেকে।
কোহিনূর চিলের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘স্বরে ভদ্রতা আনো, সুফিয়ান।’
সামান্য চারটি শব্দে সুফিয়ানের অন্তরাত্মা হিমশীতল হয়ে গেল। মুহূর্তে নিভে গেল রক্তের উত্তাপ, তাকে গ্রাস করল সীমালঙ্ঘনের অপরাধবোধ।
‘মাফ করবেন, ফুফুজান। তবে আপনার এই সিদ্ধান্ত আমার অন্তরে বিক্ষোভ তুলেছে,’ মাথা নত করে বলল সুফিয়ান।
কোহিনূর চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘আমি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘জাওয়াদ এখনো আবেগে ভেসে চলা তরুণ, ওর আবেগের পেছনে কি আমরা সমস্ত কিছু ছেড়ে দিতে পারি?’
‘আমি আবেগের কথা বলছি না, সুফিয়ান। আমি দেখেছি জাওয়াদের চোখের দৃষ্টি। যে ভালোবাসা গুলনূরের প্রতি ওর হৃদয়ে জন্ম নিয়েছে, সেটা অন্তত ক্ষণিকের জলরঙ নয়।’
শব্দর বলল, ‘জাওয়াদ কি নিজে এসে আপনার কাছে তার অন্তরের কথা বলেছে, ফুফুজান? নাকি আমরা অনুমানের আলোকে পথ চলছি?’
‘না, জাওয়াদ মুখে কিছু বলেনি। কিন্তু মানুষের চোখ যখন কথা বলে, তখন শব্দের প্রয়োজন হয় না। আমি মানুষের চোখ পড়তে পড়তে বুড়ো হয়েছি। জাওয়াদের চোখে আমি যা পড়ে জেনেছি সেই জানা শতবার কথার চেয়ে বেশি সত্য। যে প্রেম আমি দেখেছি, শুধু বিয়ের মালা গাঁথার জন্য যথেষ্ট নয়। জীবনের সমস্ত ঝড়-ঝাপটা সহ্য করার মতো শক্তিশালী।’
‘কিন্তু… বোবা বংশহীন এক দাসীকে হঠাৎ এই পরিবারের পুত্রবধূ করে তোলা… এই সিদ্ধান্ত কি হুট করেই নেয়া হয়ে গেল না?’ শব্দর প্রশ্ন করল, কণ্ঠে সংশয়ের ছায়া।
কোহিনূরের চোখ তীক্ষ্ণ হলো, ‘তুমিও তো এক সাধারণ ঘরের কন্যাকে ঘরে এনেছো, শব্দর। তখন তো তোমার বউকে নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি।’
শব্দর নিশ্চুপ হয়ে গেল।
সুফিয়া বললেন, ‘শব্দরের ব্যাপারটা আলাদা ছিল। ওর বয়স হয়েছে৷ কেউ ওর বিয়ের অপেক্ষা করেনি। জাওয়াদের পরিস্থিতি ভিন্ন। জাওয়াদ শেষ বংশধর। ওকে তো সকল দিক চিনে পথ পাড়ি দিতে হবে। ভূঁইয়া বংশের শেষ বংশধর যে কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারে না।’
কোহিনূর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তুমি এখনো আটকে আছো রক্তের দম্ভে। রক্তই যদি সব হতো, তবে নিষ্ঠুর রাজার ঘরে মহাপুরুষ জন্মাত না।’
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে সোনালি ধানের ক্ষেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন, ‘ভালোবাসা ধন-মান, জাত-পরিচয়ে মাপে না, সুফিয়ান। সেই ভুল আমি একবার করেছি। আর চাই না তা পুনরাবৃত্তি হোক।’
‘কীসের ভুল?’ সুফিয়ানের গলায় বিস্ময়ের সুর।
কোহিনূর কাঁটা কাঁটা গলায় বললেন, ‘তোমার মনে নেই, সুফিয়ান? একদিন তুমি আমার আব্বাজানের কাছে আলীর কথা বলেছিলে। তাইতো আব্বাজান দ্রুত আমার বিয়ে ঠিক করেছিলেন। আলী আমাদের মতো ‘উঁচু ঘরের’ ছেলে নয় বলে তার ভালোবাসার মূল্য আমরা কেউই দেইনি।’
সুফিয়ানের মুখ পাণ্ডুর হয়ে গেল।
কোহিনূর কোনো সংশয় ছাড়া স্পষ্ট কণ্ঠে জানিয়ে দিলেন, ‘এই মুহূর্ত থেকে এই বাড়ির ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ কোনো বিধিনিষেধ ঠিক করবে না, ঠিক করবে তাদের ভালোবাসা। আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাই অটুট থাকবে। যদি আমার সিদ্ধান্ত কারও সহ্য না হয় তবে আমি চলে যাব এই বাড়ি ছেড়ে। আমাকে আর কখনো কোনো উৎসবে, কোনো মিলনমেলায় খুঁজবে না তোমরা। সেই প্রস্তুতি নিয়ে এসো এই ঘরে, সুফিয়ান। অথবা… নিজের অন্তরকে প্রশ্ন করো এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নাও৷ এখন আমাকে একা থাকতে দাও।’
তার কথা ফুরোতেই ঘরে যেন শোক নেমে এলো। শব্দর ও সুফিয়ান একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ভূঁইয়া পরিবার যখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে দুই প্রতিপক্ষ তৈরি হয়ে গোপন যুদ্ধে লিপ্ত তখন মহলের সীমানা থেকে বেশ দূরে, একটি পুরনো বটগাছের ছায়াতলে অপেক্ষারত দুটি পুরুষমূর্তি। নওয়াজ বাহাদুর আর অরিজিত। তাদের ঠোঁটে তালা ঝুলছে, চোখে উদ্বেগের কালো মেঘ জমাট বেঁধেছে। কারো আগমনের প্রতীক্ষায় তারা প্রাণপাখির মতো উৎকর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে।
বিকেলের সোনালি আভা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। রাতের কালো চাদরে ঢেকে গেছে চারপাশ। আকাশে কালো মেঘের দল ঘনিয়ে আসছে।
ক্রমশ রাতের গভীরতা বাড়তে থাকল। আকাশও যেন সেই অদৃশ্য টানাপোড়েনের একটি পক্ষ হয়ে উঠল। মেঘের গর্জন, বিদ্যুতের চমক, বাতাসের শিস শব্দ সবকিছু মিলে এক অশান্ত বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। তারপর শুরু হলো বৃষ্টির ঝরনা।
বট গাছের ঘন পত্রপল্লব বৃষ্টির বেশিরভাগ ধারাকে রুখে দিচ্ছিল। তবুও টুপটাপ শব্দে কিছু জলকণা মাটি স্পর্শ করছে। নওয়াজ আর অরিজিত কচুপাতার প্রাকৃতিক ছাতা নিয়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করল।
হঠাৎ মেঘভেদী বিদ্যুৎ চমকে আকাশ চিরে গেল। সেই আলোকঝলকে স্পষ্ট শোনা গেল মাটিতে কারো পায়ের মৃদু আওয়াজ। ভূঁইয়া পরিবারের গোপন সুরঙ্গপথ দিয়ে কোনো ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। নওয়াজ আর অরিজিত তড়িঘড়ি করে নিকটবর্তী ঝোপের আড়ালে সরে গেল। সতর্কতা যেখানে জীবনমরণের সন্ধিক্ষণ, সেখানে অপ্রয়োজনীয় সাহস মূর্খতা।
বিদ্যুতের আরেকটি উজ্জ্বল ঝলকানিতে একটি নারীমূর্তি দৃশ্যমান হলো। ভিজে জলকাদার মধ্যে তার শরীরে লেপ্টে থাকা সালোয়ার কামিজ, মাথায় একটি ছোট ছাতা। আলোর আরও একটি ঝলসানিতে দেখা গেল তার কপালের ডান পাশে একটি পুরনো লম্বাটে ক্ষতচিহ্ন।
অরিজিত নিজের অজান্তেই আড়াল থেকে ডেকে উঠল, ‘নয়নতারা।’
মেয়েটির চোখে সামান্যতম অনুভূতির ছায়াপাতও নেই, বরং হিমালয়ের তুষারখণ্ডের মতো নিষ্প্রাণ দৃষ্টি। সে ধীর পায়ে নওয়াজ বাহাদুরের দিকে এগিয়ে গেল, পাথুরে চাহনি নওয়াজের চোখে স্থির রেখে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘ওই নরাধমটা তাহলে দেশে ফিরেছে?’
চলবে,…
নোট-১: রাজ্জাক আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম। মানুষের নাম রাখলে আব্দুর রাজ্জাক রাখতে হয়, আলাদা করে ডাকা যায় না। দুটো নাম একসঙ্গে বার বার ব্যবহার করা দৃষ্টিকটু। তাই নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর রাখা হয়েছে ।
নোট-২: ফিনিক্স হলো এক ধরনের পৌরাণিক পাখি, যেটি আগুনে পুড়ে মরে যায়, কিন্তু সেই ছাই থেকেই আবার নতুনভাবে জন্ম নেয়। এটি অমরতা, পুনর্জন্ম এবং পুনরুত্থানের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার হয় ৷