ইতিমধ্যে মিরা আর ভ্রমণ এসে কুহেলির পেছনে দাঁড়ায়। কুহেলি শক্ত কন্ঠে বললো, তাতে আমরা কি করতে পারি অফিসার!
“মানে? আপনারা ওনার সন্তান মিস কুহেলি”।
দেখুন অফিসার ওনি সম্পর্কে আমাদের মা হলেও আজ অনেক বছর হয়ে গেছে ওনার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।
” ওনার লাশ দাফন করতে হবে কেউ একজনকেতো আপনাদের মধ্যে যেতেই হবে”
কুহেলি একবার মিরা আর ভ্রমণের দিকে তাকালো দুই ভাই-বোনই চোখের ইশারায় রাজি হতে বললো।
“ভালা ওইছে মরছে এতো ভালা কই আছিলো? চলাফেরার বড় দোষ আছিলো শ্যামলার। মাইয়া পোলাপাইনগুলাও ওর এমন চলাফেরা দেইক্কা চইলা গেছে ছাইড়া” এমন অনেক ফিসফিসের সমালোচনার কথা ইন্সপেক্টর আদির কানে আসছে। ইন্সপেক্টর আদি এইসব কোনো কিছুই কানে না দিয়ে অপেক্ষা করছে কুহেলি এবং তার ভাই বোনদের জন্য।
দাফন শেষে কুহেলি তার ভাই-বোনদের নিয়ে সোজা চলে আসে বাসায়।
আপু..এমন নিমর্মভাবে কে মেরেছে মাকে?
যে যেমন তার সাথেতো তেমনটাই হওয়ার কথা মিরা..শক্ত কন্ঠে ভাবশেলীন হয়ে কথাটা বলে নিজের রুমে চলে গেলো কুহেলি। দরজাটা বন্ধ করে ফ্যানটা ছেড়ে কপালে হাত রেখে চোখ বুঝে ভাবছে ৫ বছর আগের কথা।
ফ্ল্যাসব্যাক…..
মা..ওমা…বাবা তাকাচ্ছেনা কেনো? বলোনা মা বলোনা? ছোট বাচ্চার মতো একনাগাড়ে কথাগুলো কুহেলি বলে যাচ্ছে তার মা শ্যামলাকে। শ্যামলা কুহেলিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো,”মারে তোর বাপ আর আইবোনারে মা আর আইবোনা। ওইদিন থেকে কুহেলি সবসময় চুপ থাকতো। মিরা ভ্রমণ এতো বড় ছিলোনা। ছোট ছিলো অনেক। কুহেলির বাবা মারা যাওয়ার পর সবকিছু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো।
মা..আমি কলেজ যাচ্ছি..এইটা বলেই কুহেলি ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ঠিক আছে মা সাবধানে যাস।
কুহেলির বাবা বেশ ভালো টাকায় রেখেগিয়েছিলেন যার ফলে তাদের কারো কাছো কখনো হাত পাততে হয়নি। কলেজ থেকে ফিরতেই কুহেলি দেখলো..মিরা আর ভ্রমণ ঘুমাচ্ছে।
কিরে চলে এসেছিস? মায়ের কথায় পিছে তাকায় কুহেলি। বললো,হুম। মিরা আর ভ্রমণ এতো অসময়ে ঘুমুচ্ছে কেনো মা?
“আর বলিসনা…ভ্রমণের জ্বর এসেছে। আর মিরার শরীরটা নাকি ভালো লাগছেনা তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আপু জানো? আম্মু আমাকে মেরেছে৷ কুহেলি পড়ছিলো টেবিলে। ভ্রমণের কথায় অবাক হয়ে বললো কেনো? ওইতো রহীম চাচাকে দেখে দুষ্টুমি করার জন্য৷ পরে আমি আমার রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়ি৷ মিরাও সাথে হুম হুম করছে। কুহেলি বেশ অবাক হলো রহীম চাচার নাম বলাতে কারণ সে তেমন ভালো লোকনা। তাকে তার বাবা কখনো দেখতেই পারতোনা। এই বাড়ির আশে পাশে পর্যন্ত আসতোনা আর সে নাকি বাড়িতে এসেছিলো!
পরের দিন কুহেলি..এসে দেখে মিরা ভ্রমণ স্কুলে। মায়ের ঘরে ফিসফিসের আওয়দজ শুনে যায় দেখতে আসলেই কি হচ্ছে। কুহেলি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে যা দেখলো অথবা শুনলো তাতে তার পায়ের মাটি তলিয়ে যাচ্ছিলো। তার মা রহীমের সাথে যৌন কাজে মত্ত। আর বলছিলো..
শ্যামলাঃ ওই বুড়োটূকে বিষ খাইয়ে মেরেছি ভালো হয়েছে নয়তো এতো সুখ কার কাছে পেতাম।
রহীমঃ হুম গো আমার সুখ রাণী। ব্যাস এরপরেই কুহেলি চোখে হাজার রাশ অশ্রু নিয়ে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে নেই। কাউকে কিছু না বলে চলে আসে মিরা আর ভ্রমণের স্কুলে। স্কুল থেকে ওদেরকে নিয়ে অনেক দূরে চলে আসে সে। আর মনে মনে তার মায়ের প্রতি হাজারো ঘৃণা থেকে এইটা ভাবতে থাকে, যেই মহিলা নিজের চাহিদার ফর্তি করার জন্য স্বামী হত্যা করতে পারে সেতো সন্তানদেরকেও খুন করতে পারে।
আপু এই আপু..থানা থেকে কল এসেছে ধরো…মিরার ডাকে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে কুহেলি। দুই চোখের কোনে পানি গড়গড়িয়ে পড়ছে। তার নিষ্পাপ বাবাকে খুন করেছে শ্যামলা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কুহেলি বিরবির করে বললো,”পাপ কাউকে ছাড়েনা।
মিরাঃ আপু নাও..[ মোবাইলটা দিয়ে]
মিস কুহেলি..কোনো আপনি আপনার মায়ের সাথে থাকতেন না? কেনো ভাই-বোন নিয়ে আলাদা থাকেন?..অফিসার আদির কথা শুনে..বেশ বিরক্ত ফিল করে কুহেলি তাও স্পষ্ট হয়ে বললো,, অফিসার আমি চায়না আমার পার্সোনাল বিষয় নিয়ে আপনি ঘাটাঘাটি করুন।
“মিস কুহেলি এইটা এখন আপনার পার্সোনাল বিষয় হলেও বলতে হবে কারণ এইটা একটা খুনের বিষয়।
সরি অফিসার আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আর হুম ওনি আমাদের কেউ ছিলেননা। সো আশা করি নেক্সট এ আমাদেরকে আর এউ কেইসে জরাবেন না…এইটা বলেই বেরিয়ে আসে কুহেলি।
স্যার মেয়েটা বেশ শক্ত। পুলিশ সদস্যের একজনের কথা শুনে অফিসার আদি ভাবশেলীন হয়ে বললো, ” কেনো ওনি ওনার মায়ের সাথে থাকতেন না! ব্যাপারতো একটা আছেই। তবে তুমি ঠিকি বলেছো মেয়েটা বেশ স্পষ্টবাদী এবং প্রতিবাদীও।
কুহেলি বাসায় ফিরছে হাজারো ভাবনা নিয়ে..হঠাৎ চোখ যায় রাস্তার অপর পাশে। একটা মেয়েকে খুব বাজেভাবে স্পর্শ করতে চাইছে একটা ছেলে। কুহেলি যেতে যাবে..এমন সময় পুলিশের গাড়ি দেখে ছেলেটা পালিয়ে যায়। কুহেলি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,”মেয়ে মানুষের কোথাও শান্তি নেই।
মিরা ভ্রমণ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে…কলেজ যেতে হবে। কুহেলির ডাকে তাড়াহুড়ো করে মিরা ভ্রমণ চলে এসে বললো,”আপু চলো চলো অলরেডি লেইট। “আর্য ভাইয়া আজকে ইম্পর্টেন্ট ক্লাস করাবে।
কুহেলিকা…মন খারাপ? টিফিন টাইমে আনমনে খাবার না খেয়ে কি যেনো ভাবছিলো কুহেলি এমন সময় আর্য কথাটা বললো। কুহেলি হেসে বললো,না মন খারাপ নয়। আসলে ভালো লাগছেনা। আর্য এক মনে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললো, ” বাসায় চলে যায় গিয়ে রেস্ট নিন। প্রিন্সিপাল স্যার আসলে না হয় আমি বলে দিবো। কুহেলি বললো, না না থাক লাগবেনা..
আর্য ধমকে স্বরে বললো, কুহেলিকা….
কুহেলি একটু হেসে বললো আচ্ছা যাচ্ছি।
বাসায় ফিরতেই অবাক কুহেলি। বাড়িওয়ালার ছেলে আরশিন নাকি খুন হয়েছে। জঙ্গলে নাকি তার লাশ খুব নির্মম ভাবে পেয়েছে পুলিশ।
কুহেলি একটু সামনে এগিয়ে দেখে আরশিনের বিশ্রীভাবে মৃত দেহ। দড়ফড় করে সরে আসে কুহেলি। কি জঘন্য মৃত্যু তার। কুহেলি মনে মনে ভাবলো,”তাহলে কি আরশিনের মৃত্যুটা এমন নিমর্মভাবেই ছিলো? কুহেলি আর এক মুহুর্তও ওইখানে থাকলোনা তাড়াতাড়ি নিজের বাসায় এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোফায় হাত পা ছেড়ে বসে পড়লো। এমনিতি শরীরটা তেমন ভালো ছিলোনা আবার এইখানে এসে দেখে আরেকটা মৃত্যু! কুহেলি টিভিটা ছেড়ে দিলো৷ টিভিতেও একি নিউজ লাশ আর লাশ।
স্যার…এই আরশিন নামক ছেলেটির লাশের পাশেও কিন্তু কনডম আর চিরকুটে ওই “দামিনী” নামটা লিখা।
ইন্সপেক্টর আদি একটু ভেবে বললো, কি চায় এই “দামিনী”? আচ্ছা আরশিনের গার্লফ্রেন্ড ছিলো?
” ইয়েস স্যার ছিলো। মেয়েটির নাম ফারিন।
চলো ওই ফারিনের কাছে যাওয়া যাক।..
মিস ফারিন..আপনি জানেন যে আরশিন আর পৃথিবীতে নেই? ইন্সপেক্টর আদির কথায় ফারিন তার মা-বাবার দিকে একটু তাকিয়ে বললো হুম জানি।
তাহলে আপনি কেনো জাননি দেখতে?
যাবে কেনো অফিসার? ওই ছেলে আমার মেয়ের জীবনটাকে পুরো নষ্ট করে দিয়েছে৷ অবশ্য ওর মতে ছেলের সাথে যেমনটা হওয়ার কথা তেমনটাই হয়েছে”..পাশে থাকা ফারিনের বাবা কথাটা বলাতে ইন্সপেক্টর আদি বললো,মানে? সামনে থেকে ফারিন বলতে লাগলো,”অফিসার আরশিন আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। আর এই প্রতিশ্রুতিতে.. এইটা বলেই ফারিন কান্না করে দেয়। ফারিনের বাবা ফারিনের মাকে বলে..তুমি ফারিনকে নিয়ে ঘরে যাও। আমি অফিসারদের সাথে কথা বলছি। ফারিন ঘরে যেতেই..ফারিনের বাবা বললো, আগে বসুন৷ বসে কথা বলি..
বলুন কি হয়েছিলো ফারিনের সাথে?
ইন্সপেক্টর আমার মেয়েটা আবেগের বশে আরশিনের সব কথা বিশ্বাস করে নিতো। আর এই অতিরিক্ত ভালোবাসা আর বিশ্বাসের সুযোগই আরশিন নিয়েছে। আমার মেয়ের সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে সে। এরপর আমার মেয়ে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে যায়। আমি কিংবা ওর মা কেউ জানতোনা এইসব। ফারিন আমাদের কাউকে না জানিয়ে টেস্ট করাই কিছু। এরপর ফারিন জানতে পারে যে সে কনসিভ করেছে। ইন্সপেক্টর আদি অবাক হয়ে বলে,”তার মানে ফারিন প্র্যাগনেন্ট ছিলো? ফারিনের বাবা ভীষন্ন নিয়ে বললে হুম। তারপর আরশিন এই বাচ্চার বাবা তা অস্বীকার যায় তার উপর ফারিনকে যা নয় তা বলে। এরপর ফারিন জানতে পারে আরশিন শুধু ওর সাথে নয় এমন অনেক মেয়ের সাথে করেছে।
আপু..ঘুমিয়ে পড়েছো? মিরার ডাকে ঘুম থেকে উঠে কুহেলি। কলেজ থেকে ফিরে কখন ঘুমিয়ে গেছে তা সে নিজেই জানতোনা।
কিরে কখন এলি তোরা? ভ্রমণ পাশ থেকে বললো, “এইতো আপু কিছুক্ষণ হলো। মিরা ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,” আপু আরশিন ভাই..কুহেলি আর কিছু বলতে না দিয়ে বললো,”হুম আমি সব জানি। কি নিমর্ম মৃত্যু!
কুহেলিকা..আপনার শরীর এখন ঠিক আছেতো? ফোনের ওপাশ থেকে আর্য’র আদুরে কন্ঠে কথাটা শুনে কুহেলি কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,”জ্বি আর্য কিছুটা ভালো এখন।
শুনলাম আপনাদের বাড়িওয়ালার ছেলে মারা গেছে?
কুহেলি মন মরা হয়ে বললো, জ্বি। ওপাশ থেকে আর্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”কে যে এতো গুলো খুন করছে..!
কুহেলিকা…আর্য পুনরায় কুহেলিকে ডাকে। কুহেলি ছোট উত্তরে বলে “হুম”
“কুহেলি আপনি কি আমার এক আকাশ শান্তির ঠাঁই হবেন? আমি যে বড় একা ধরণীতে..আপনাকে যে আমার ভীষন প্রয়োজন। আর্য’র অনুকরণ কুহেলির কান অব্দি গেলো কিন্তু মন অব্দি যায়নি।
এতো গুলো খুন হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা লাশ পাওয়া যাচ্ছে আর আমরা পুলিশ হয়েও কিছু করতে পারছিনাআআআ..পুলিয় হেড টেবিলে একটা হাত ঘুষি দিয়ে কথাটা বললো। ইন্সপেক্টর আদি নরম কন্ঠে বললো,স্যার আমরা আমাদের দিক থেকে সম্পূর্ণটা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর তাছাড়া আমরানা. বি ডি আর, আর্মি, সি আই ডি সবাই এই ” দামিনী” নামক খুনিটাকে ধরার চেষ্টা করেই যাচ্ছি।
চেষ্টা নয় অফিসার ওই খুনিকে আমার সামনে চায়।
রাতে সবাই খাবার খাচ্ছিলো। টিভিতে একটা মৃতদেহ দেখে চমকে উঠলো কুহেলি। এইটাতো ওই ছেলেটা যেই ছেলেটা রাস্তায় একটা মেয়েকে বিরক্ত করছিলো। এই ছেলেটাকেও মেরে ফেলেছে!
চলবে… …