প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে | ভালোবাসার গল্প

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে – ০১

“চলে এসো! এখানে আর এক মুহুর্তও নয়।” সারফারাজ তার স্বদ‍্য বিয়ে করা নববধূর উদ্দেশ্যে কাঠ কাঠ কন্ঠে কথাগুলো বলেই নববধূর নরম হাতখানা নিজের হাতের ভাজে শক্ত করে ধরে পা বাড়ালো রাস্তায় অপেক্ষায়মান গাড়ির দিকে।

দু পা বাড়াতেই বিয়ে বাড়ির জন সমাগমের মাঝ থেকে পুরুষালি তেজস্বী কন্ঠে বলে উঠলো, “আরেহ্ কোথায় যাচ্ছো? এভাবে মেয়ে নিয়ে অনুমতি ব‍্যতীত নিয়ে যেতে পারো না! ভদ্রতা, সভ‍্যতার ও একটা ব‍্যপার আছে। এটা ভদ্রলোকের সমাজ। তোমার মধ্যে ভদ্রতা না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের আছে। মেয়ের বাবার অনুমতি না নিয়ে এক পা ও আগাবে না!”

সারফারাজ হাঁটা থামিয়ে পিছন ঘুরে তাকালো। ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা ফুটিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আপনি কে? কি হন?”

“আমি অন্বেষার বড় চাচা।”

সারফারাজ তার নববধূর নরম হাতখানা ছেড়ে দিল। পাশে থাকা ফাঁকা চেয়ারে নিজে আয়েশ করে বসলো। পাশেরটাই অন্বেষাকে ঠাস করে বসিয়ে দিল।

ভদ্রলোক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কিছু বলছেন না। ভরা বিয়ে বাড়ির মানুষ আগ্রহ ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে সারফারাজের দিকে। বিয়ে বাড়ির মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সারফারাজ। নিরবতার অবসান ঘটিয়ে সারফারাজ অন্বেষার বড় চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কোথায় ছিল আপনার ভদ্রতা, সভ‍্যতা? বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় যখন অতটুকু মেয়েটার ওপর ওর সৎ মা, অনান‍্য মহিলাগুলো চড়াও হয়ে যা নয় তা বলে গালি দিচ্ছিল তখন কোথায় ছিলেন আপনি? পাত্রের অনুপস্থিতিতে যখন আপনার গ্রামের মাতাল, গাঞ্জাখোর ছেলেটার সাথে ওর সৎ মা বিয়ে দেওয়ার তোড়জোড় করছিল কোথায় ছিলেন আপনি? আর কোথায় ছিল আপনাদের ভদ্রতা, সভ‍্যতা?”

উপস্থিত মানুষের মাঝে একটা প্রাণিও কথা বলে না। প্রতিত্তোরে সবাই নিরব। ক্ষেপে ওঠে সারফারাজ। ব‍্যাগ্র কন্ঠে শুধায়, “কি হলো কথা বলছেন না কেন? মুখে তালা লাগিয়ে বসে আছেন কেন? আমার তো মনে হয় দুই ঘন্টায় পরিচিত এই মেয়েটার জন্য আমার যতটুকু দয়ার উদ্রেক হয়েছে তার ছিটে ফোঁটাও আপনাদের কারো মধ্যে নেই। এখানে একটা মানুষের মধ্যে সামান্যতম মায়া দয়া নেই। মানুষ নামের অমানুষ একেকটা। জানোয়ারের দল।”

“দেখ এবার কিন্তু বেশি বেশি করছো ছেলে। যা নয় তাই বলবে?”

“একশবার বলব। কি করবেন?”

সারফারাজ ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়েছে। শার্টের হাতা গুটিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই অবস্থা বেগতিক দেখে দুরে দাড়ানো সারফারাজের বন্ধু রাকিব এসে আটকায় সারফারাজকে। কেউ না জানুক সে অন্তত জানে সারফারাজকে আটকাতে না পারলে একটাকেও আস্ত রাখবে না সে। প্রচণ্ড রকম রাগী ছেলেটা।

আস্তে আস্তে বিয়ে বাড়ির লোকজন যে যার মত প্রাণ নিয়ে সরে পড়ছে। আপাতত তাদের তামাশা দেখে প্রাণ খোয়াবার কোন ইচ্ছে নেই। মিনিট খানিকের মধ্যে বিয়ে বাড়ি ফাঁকা। হাতে গোনা দু চারজন মানুষজন আছে। কিছুক্ষণ পর অন্বেষার বাবা এসে সারফারাজের উদ্দেশ্য নমনীয় কন্ঠে বলে উঠলো, “জামাই বাবা শান্ত হোন। ওদের কথায় কিছু মনে করবেন না।”

শশুরের নরম কন্ঠে মন গললো না তার। বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো চোখে মুখে। বিরক্তিকর কন্ঠে বলল, “রাখেন আপনার ফ‍্যচফ‍্যাচানি। আপনার এ অবস্থার জন‍্যই মেয়েটার এ দশা। বলি আপনি কি কোন খোঁজ খবর রাখেননি? মেয়ের কোথায় বিয়ে ঠিক হলো কার সাথে ঠিক আবার বিয়েটা যখন ভেঙে গেল পূনরায় আবার কার সাথে দিতে চাইলো কিছুই কি আপনার চক্ষুগোচর হয়নি? কেমন বাবা আপনি?”

মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। প্রতিত্তোরে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।

সারফারাজ পূনরায় বলল, “আমি এখন আমার বউকে নিয়ে চলে যেতে চাই। কেউ যদি আটকানোর দুঃসাহস করে গলা থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিব। আমার বউয়ের সাথে এ বাড়ির এ প্রাণিও যেন যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে। আর একটা কথা আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী শাস্তিটা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা দিবেন। আল্লাহ্ ছাড় দেয় কিন্তু ছেড়ে দেয় না। মা হারা মেয়েটার সাথে যে ঘৃণ্য অন‍্যায় করতে যাচ্ছিলেন আল্লাহর ওপর আস্থা রাখছি এর বিচার তিনি করবেন।”

সারফারাজ অন্বেষাকে এক প্রকার টেনে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেল। পিছনে রেখে গেল কতগুলো মানুষ রূপি অমানুষ।

রাকিব নিরব দর্শকের মত সবটা দেখছিল। সে ভাবতেও পারেনি ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের ছেলেটার মধ্যে এতটা দয়া লুকিয়ে থাকতে পারে। কত অনুরোধ করে ছেলের আকিকায় নিমন্ত্রণ করে এনেছিল সারফারাজকে। তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেই কি বিপদে পড়লো ছেলেটা। কখনও বিয়ে করবে বলে পণ করা ছেলেটারও আজ বিয়ে হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক চিরে। প্রাণপ্রিয় বন্ধুর সামনে নিজের অবস্থান খুব নিচে নেমে গেল এমনটাই মনে হচ্ছে রাকিবের।

“সারফারাজ আমি কি তোর সাথে যাবো?”

“নাহ্ দরকার নেই। তোর এখন তৃণা আর বাবুর কাছে থাকা উচিত। আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না।”

“বললেই হলো চিন্তা করতে হবে না। চিন্তা এসে যায় রে ভাই। বাড়িতে জানিয়েছিস?”

“সময় পেলাম কোথায়?”

“তাও ঠিক। তোরা ক্লান্ত। আমি বড় রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি?”

“সমস‍্যা নেই। আমি পারবো। তুই বাসায় যাহ্।”

সারফারাজ গাড়িতে উঠে পড়েছে। পাশে দাড়ানো অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তোমাকে কি নিমন্ত্রণ করে উঠাতে হবে? উঠে বসো!”

অন্বেষা ঠায় দাড়িয়ে তখনো। সে প্রয়োজনে কয়েকবার মাইক্রেবাসে উঠেছে। কিন্তু তখন তো ড্রাইভার দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু এসব প্রাইভেট কারে চড়ার অভ‍্যাস নেই সাথে দরজাটাও খুলতে পারছে না। সারফারাজ গাড়ি থেকে নেমে রাগী স্বরে বলল, “এটুকুও পারো না? তবে পারো কি মেয়ে, ফ‍্যাচফ‍্যাচ করে কাঁদতে?”

সারফারাজ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল, “যাও উঠে বসো।”

অন্বেষা বাধ‍্য মেয়ের মত উঠে বসলো। সারফারাজ সামনে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিবে এমন সময় আবারও রাকিবের আগমন। সারফারাজ অবাক কন্ঠে বলল, “কিরে যাসনি এখনো?”

“চলেই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলে যাওয়া উচিত। অগ‍্যতা আবার ফিরে আসা।”

“দয়া করে আপনার গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলে আমাকে উদ্ধার করেন। এমনিতেই তোদের এদিকটার রাস্তা ভালো না। ঢাকায় পৌছাতে না জানি কত সময় লাগে।”

“বলছি মেয়েটার ওপর অযত্ন অবহেলা করিস না। সবটা তো দেখলি সচক্ষে। অন্তত ওর আত্মীয়দের মত আচরণ করিস না।”

“এই চিনলি আমাকে? সারফারাজ কখনও দায়িত্ব অবহেলা করে না। ইনশাআল্লাহ দায়িত্ব পালনে কোন হেরফের হবে না। নিশ্চিন্তে বাড়ি যা।”

“আমি জানি তুই কেমন। তবুও পরিস্থিতি এখন পুরাই হাতের বাহিরে। মেয়েটার অভিভাবক এখন তুই। দেখে রাখিস। আমি যায় তাহলে।”

“আচ্ছা যা। আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহ হাফেজ।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আল্লাহ হাফেজ।”

রাকিব বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে। অতঃপর সারফারাজ গাড়ির ইঞ্জিন স্টর্ট দিল।

সন্ধা লগ্ন পার হয়ে রাত্রি নেমেছে ধরণীতে। সফেদ রঙা প্রাইভেট কারটির ভেতরে বহু লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, অবহেলা, অনাদর সহ‍্য করা মেয়েটা যাচ্ছে তার অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিয়ে হওয়া স্বামীর সাথে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

গ্রামের আধ ভাঙা রাস্তায় গাড়িতে থাকা মানুষগুলোর জীবন তেজপাতা হয়ে যায়। একের পর এক ধকল সহ‍্য করে অন্বেষার শরীর আর চলছে না। দৃষ্টি নিভে আসছে। একটানা ঘুম হলে ভালো লাগতো। হঠাৎই গাড়ির চাকা ছোট্ট একটা গর্তে পড়েছে। বেশ ঝাকুনি খেয়েছে অন্বেষা। ফলে তার পেটের সব যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। বমি করতে পারলে ভালো হতো। সারাটা সময় জড় বস্তুর মত চুপ থাকা অন্বেষা সামনের মানুষটির উদ্দেশ্য নিভু গলায় বলল, “শুনছেন? গাড়িটা একটু থামাবেন? আমার বমি আসছে।”

অন্বেষার কন্ঠস্বর সারফারাজের কর্ণকুহরে ঠিক স্বদ‍্য জন্মানো বিড়ালের বাচ্চার চেও চেও আওয়াজের মত লাগলো। এক সাইডে গাড়ি থামিয়ে পিছন ফিরে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “কি হয়েছে?”

“বমি পাচ্ছে।”

বিরক্তিতে কপাল কুচকে গেল সারফারাজের। শুরু হয়ে গেল তার জীবনেও মেয়ে মানুষের ফ‍্যাচফ‍্যাচানি। এজন্যই বিয়ে করতে চাইছিল না।

প্রয়োজন সমাধা করে বোনের ফোনে একটা টেক্সট পাঠিয়ে সারফারাজ আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল। চললো নির্দিষ্ট গন্তব্যে।

______________

সারফারাজের ভার্সিটির ফ্রেন্ড রাকিব আর তৃণা। বেস্ট ফ্রেন্ড বলা চলে। ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রাকিব-তৃণা। বিয়ের প্রায় তিন বছর পর কোল আলো করে ছেলে সন্তানের জন্ম। প্রাণপ্রিয় দুই বন্ধুর অনুরোধে ঢাকা ছেড়ে ফুলতলী গ্রামে ছুটে আসতে হয় সারফারাজের। কিন্তু সেখানে তার জন্য ভয়াবহ বিপদ অপেক্ষা করছিল কে জানতো!

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে  (০২)

__________________

কলিং বেল চাপতেই সাথে সাথে ওপাশ থেকে দরজা খুলে দিল সারফারাজদের বাসার হেল্পিং হ‍্যান্ড হাসুর মা। পঞ্চাশর্ধো পৌঢ় মহিলা। ওদের দেখেই নিরষ বললেন, “এসে পড়েছ বাপজান? এদিকে বিশাল কান্ড ঘটে গেছে। তোমার মায়ের অবস্থা তো ভালো না বাপজান!”

সারফারাজের কপালে মৃদু চিন্তার ভাজ ফুটে উঠলো। তার পাশেই ক্লান্ত দূর্বল অন্বেষা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন জোর করিয়ে দাড় করে রাখা হয়েছে।

সারফারাজ বলল, “খালা, আগে ঢুকতে তো দেন। এসেছি তো শুনবো সব কথা।”

দাঁত দিয়ে হালকা জিভ কাটলেন হাসুর মা। অর্থাৎ বিরাট ভুল হয়ে গেছে। দ্রুত সদর দরজা থেকে সরে দাড়ালেন। একপাশে দাড়িয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে অন্বেষাকে দেখছেন তিনি।

“মা কোথায় খালা?”

“আফায় তো তেনার রুমে। ছোট মা যখনই খবর দিল আপনার বিয়ার, শুনেই তার প্রেশার হাই হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চিৎকার চেচামেচি করেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে বড় মা প্রেশারের ওষুধ আর ঘুমের ওষুধ খাওয়ায় দিয়েছে।”

“তাহলে মা এখন ঘুমিয়েছে?”

“হ বাপজান।”

“সাইমা, সাইফাও কি ঘুমিয়ে পড়েছে?”

“ঘুমানোর কি সুযোগ আছে ভাইয়া? বল!” পেছন থেকে সাইমা বলে উঠলো। সাথে সাইফা। দুবোন এগিয়ে আসলো ড্রয়িং রুমে।

সারফারাজ ওদের দেখে বলল, “ওকে নিয়ে যা। তোদের মধ্যে যার পোশাক ওর গায়ে হয় ফ্রেশ করিয়ে পড়িয়ে দে। বেশ ধকল গেছে।”

সাইফা টিপ্পনি কেটে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি। আমরা কি বুঝি না।”

“তোদের সাথে তর্কে জড়ানোর ইচ্ছে নেই বিচ্ছুরা। নিয়ে যা ওকে।”

সাইমা, সাইফা অন্বেষার কাছে এসে আগ্রহভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। বিব্রত বোধ করছে অন্বেষা। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না মেয়েটা। অন্বেষার বিব্রতকর অবস্থা হয়তো সারফারাজ বুঝলো। বোনেদের উদ্দেশ্য বলল, “পরে দেখিস। পালিয়ে যাচ্ছে না। এখন ফ্রেশ হওয়া দরকার।”

সাইমা অবাক কন্ঠে বলল, “ভাইয়া এই হুর পরীকে কোথায় থেকে ধরে এনেছো? রূপের আগুনে আমি নিজেই তো ঝলসে যাচ্ছি মনে হচ্ছে। এজন্যই কি এত তাড়াহুড়ো করে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেললে?”

ধমকে ওঠলো সারফারাজ। বলল, “তখন থেকে ফালতু বকছিস একেকটা। কানের নিচে দিব একেকটার। বলেছি না ওকে নিয়ে যা। পরে বলব সব।”

সাইমা, সাইফা তাৎক্ষণিক অন্বেষাকে নিয়ে তাদের রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। বাঘের সামনে থাকার ইচ্ছে নেই তাদের। অতি কৌতূহলে ভুলেই গেছিল তার ভাইটা আস্ত এক বদমেজাজি গোছের মানুষ।

সারফারাজ পাশে দাড়ানো হাসুর মা’র উদ্দেশ্য ক্লান্ত গলায় শুধালো, “খালা, খাবার কিছু আছে?”

“হ বাপজান। আমি গরম করে রাখতাছি। তুমি বউরে নিয়া আসো।”

সারফারাজ রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। কি যেন মনে পড়তেই আবার ফিরে এলো। ততক্ষণে হাসুর মা ও কিচেনে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিল। সারফারাজকে আবার ফিরে আসতে দেখে শুধায়, “কিছু লাগবো বাপ?”

সারফারাজ স্মিত হেসে প্রতিত্তোরে বলল, “মাঝ রাত্রিরে খুব কষ্ট দিলাম খালা?”

“কি যে কও না বাপ। তুমি সাইমা, সাইফা সবাই আমার সন্তান তূল‍্য। তোমাগে সেবা কইরা মুই শান্তি পাই। এই কথা কইও না। তুমি যাও বাপজান। হাতমুখ ধুইয়া আসো।”

“একটু দুধ গরম করে রাইখেন খালা। ও খুব ক্লান্ত। উষ্ণ দুধ খেলে কিছুটা ভালো লাগবে।”

“আইচ্ছা। তুমি চিন্তা কইরো না।”

অতঃপর সারফারাজ নিশ্চিন্তে চিত্তে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ায়। সাময়িক ভাবে চিন্তা গেলেও মস্তিষ্কে স্থায়ী চিন্তা থেকেই যায়। মাকে কি বলবে সে? অন‍্য আত্মীয়স্বজনের ধার ধারে না সে। কিন্তু মাকে ভিষন ভালোবাসে। তার এহেন কান্ডে যদি কষ্ট পান তিনি। তবে? ক্লান্ত মস্তিষ্ক আর কিছু ভাবতে পারলো না। যা হয় ভালোই হয়। এই বলে মনকে বুঝ দিল সারফারাজ। আল্লাহ্ আছেন তো। এত দুশ্চিন্তা কিসের!

অন‍্যদিকে সাইমা, সাইফা অন্বেষাকে রুমে নিয়ে রিতিমতো প্রশ্নের ঝড় তুলছে। দু বোনের অবুঝ পনা কান্ডে ক্লান্ত অন্বেষার অবস্থা নাজেহাল। না কিছু বলতে পারছে আর না পারছে ক্লান্ত শরীরে এত ধকল সইতে।

দু বোনের উদ্দেশ্য রিনরিনে কন্ঠে অন্বেষা কোনরকম বলল, “শরীর খুব খারাপ লাগছে আপু। আপনাদের ভাইয়ার থেকে সবকিছু জেনে নিয়েন আপুরা। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।”

এটুকু বেশ ভয় নিয়েই বলেছে অন্বেষা। যদি রাগ করে বশে!

অন্বেষাকে অবাক করে দিয়ে সাইফা বলল, “ঠিক বলেছেন মিষ্টি ভাবি। ভাইয়ার থেকেই জানা যাবে। হুদাই আপনাকে প‍্যারা দিলাম। রাগ করেননি তো? বাই দা ওয়ে আপনাকে মিষ্টি ভাবি বলে সম্বোধন করতে পারি?”

মিষ্টি দেখতে দুটো মেয়ের এত স্বাভাবিক ব‍্যবহার অন্বেষাকে আবেগী করে তুলছে। চোখ যুগল ছলছল করে উঠলো। মিষ্টি হেসে ক্লান্ত গলাই প্রতিত্তোরে বলল, “রাগ করবো কেন আপুরা? রাগ তো আপনাদের করার কথা। সম্বোধনটা খুব সুন্দর। এত সুন্দর সম্বোধন পাওয়ার যোগ‍্যতা আদৌ আমার আছে! খুব ভালো লেগেছে।”

সাইফা বলল, “আব্বু মা’রা গিয়েছে আছ পাঁচ বছরের বেশি। এরপর থেকে কখনও ভাইয়া আমাদের কোন অভাব রাখেনি। অভিযোগ করার সামান‍্যতম চেষ্টা টুকুও দেয়নি। ভাইয়া কম বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন মানুষটা। সেই মানুষটার কোন সিদ্ধান্তে অসম্মতি জানানোর কোন প্রশ্নই আসে না। আমরা জানি ভাইয়া কখনও নিজের জন্য বেমানান, খারাপ কিছু বেছে নিবেন না। যেখানে সে হাসুর মা থেকে শুরু করে আমাদের জন্য পর্যন্ত বেস্ট জিনিস বাছাই করেন। সেখানে নিজের জীবনসঙ্গী নিশ্চয়ই যাকে তাকে বানাবেন না!

পেছন থেকে সাইমাও সম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো, “একদম ঠিক বলেছিস সাফু। প্রথম বার কোন কথা ঠিকঠাক বলতে পারলি। সবই আমার ক্রেডিট। ধন্যবাদ জানাবি মেয়ে!”

ফুঁসে উঠলো সাইফা। রাগী স্বরে বলল, “রাখ তোর ক্রেডিট। ফাজিল মেয়ে। কই জামা এনেছিস? দেরি হলে ভাইয়া বকবে পরে।”

সাইমা বাম হাতে ধরা একটা সুতির সুতার অসম্ভব সুন্দর কারুকার্য খচিত সালোয়ার কামিজের সেট সাইফার উদ্দেশ্য বাড়িয়ে দেয়। বলল, “দেখ তো এটা কেমন? ভাবির জন্য চলবে?”

“চলবে কি দৌড়াবে।”

জামাটা অন্বেষার হাতে দিয়ে সাইফা পূনরায় বলল, “মিষ্টি ভাবি ওইদিক টাই ওয়াশরুম। যান গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। কিছু লাগলে ছোট্ট একটা ডাক দিলেই আমরা হাজির হবো।”

অন্বেষা বাধ‍্য মেয়ের মত ঘাড় নাড়িয়ে স্বায় জানালো। তারপর কলের পুতুলের মত ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।

রাতে খাওয়া শেষে সারফারাজ ঘুমানোর উদ্দেশ্য রুমে এসেছে। যদিও আর দের ঘন্টা পরেই ফজরের আজান দিবে। পিছনে গুটিগুটি কদমে অন্বেষাও হাজির।

সারফারাজ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। অন্বেষা রুমের কোনায় তখনও ঠাঁই দাড়িয়ে। সারফারাজের ভ্রু যুগল কুচকে এলো। কর্কশ কন্ঠে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “ছোট বেলায় মেবি বাংলা সিনেমা দেখতে? শাবান খালা আলমগীর মামার। তুমি কি ভেবেছো তোমাকে নিচে শুতে বলব? দ্রুত শুতে এসো। ড্রামা করো না। বিয়ে করেছি বউ নিয়ে ঘুমানোর জন্য। বউকে মেঝেতে রেখে নিজে বিছানায় কাপুরুষের মত শোয়ার জন্য না। কাম!”

অন্বেষার মুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে। তার আবেগতাড়িত মস্তিষ্ক সারফারাজের বলা কথার উল্টা মিনিং খুজতে ব‍্যস্ত।

অন্বেষার মুখভঙ্গি দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসে সারফারাজ। মনে মনে বলে, “কি অদ্ভুত মেয়ে মানুষ। অচেনা মানুষটাকে বিয়ে করে ফেলল অথচ চেনা স্বামীর সাথে বিছানায় শুতে যত আপত্তি!”

সারফারাজের মনের কথা জানা হলো না অন্বেষার। সে তখনও আকাশ পাতাল ভাবনায় মশগুল।

সারফারাজ পূনরায় বলল, “শোন মেয়ে এত কিছু ভেব না। তুমি যা ভেবে ফেলেছো না আমি কল্পনায় ও আনিনি। সুতরাং অহেতুক ভাবনা চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শুতে এসো।”

অন্বেষা বড্ড লজ্জা পেল। লজ্জায় গৌর বর্ণ মুখখানায় গোলাপি আভা ফুটে উঠেছে। দ্রুত পায়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো সে। হুদাই অহেতুক ভাবনা। কতগুলো দিন পরে এমন নরম বিছানায় শোয়ার সৌভাগ্য হলো অন্বেষার। আরামদায়ক বিছানায় শুতেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো অন্বেষা।

সারফারাজ এক নজর ঘুমন্ত অন্বেষার দিকে চাইলো। ভয়ংকর সুন্দর মেয়েটা। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা বিপদ। মাথা ঝিম ধরে যায়। নেশা ধরে যায় চোখে। সাথে বেশ আন্দাজ করলো মেয়েটা বেশ লম্বা। সে নিজেই ছয় ফুট। হয়তো অন্বেষা পাঁচ ফুট পাঁচ বা ছয়ের কাছাকাছি। মেয়ে মানুষ এটুকুতেই অনেক লম্বা লাগে। সুন্দরী মেয়েগুলোর জীবন তাদের চেহারার মত সুন্দর হয় না। সাথে যদি থাকে অন্বেষার সৎ মায়ের মত বিষাক্ত নড়বড়ে অভিভাবক। এসব ভাবতেই সারফারাজের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। মানুষ এমন কেন হয়!

সারফারাজের মা মিসেস সাওদা বেগম ফজরের নামাজ শেষে বলকনিতে গিয়ে বসে আছেন। প্রেশার কিছুটা কমেছে। হাসুর মা চা নিয়ে রুমে উপস্থিত হলো। এ সময়টা মিসেস সাওদা আর হাসুর মা একসাথে বসে চা খাই আর সকালে স্নিগ্ধ রুপ উপভোগ করে। বেশ সখ্যতা দুজনের মধ্যে। গৃহপরিচারিকার সাথে বাড়ির কর্তির এমন সম্পর্কই হওয়া উচিত। যদিও তা বর্তমান সমাজে নেই বললেই চলে। মিসেস সাওদা বললেন, “আজ চা খেতে মন চাইছে না হাসুর মা। ভালো লাগছে না কিছুই। সারফারাজ উঠেছে?”

“না আফা।”

“সে কি নামাজ পড়াটাও ভুলে গেল?”

“বাপ জান ঘুমাতে গেছে চারটার দিকে। হয়তো রুমের মধ্যেই পড়ছে। নতুবা উঠবার পারে নাই।”

“তোমার কি মনে হয় না হাসুর মা সারফারাজ যা করেছে অন‍্যায় করেছে?”

“আফা, বাপজানরে আমার থৈইকা আফনে ভালো চিনেন জানেন। যতটুকু বুঝবার পারছি সে জেনেশুনে অন‍্যায় করবে না। সেখানে আপনারে কষ্ট সে কিভাবে দিবে? সে আসুক সবটা জানেন শুনেন তারপর বিচার কইরেন। আগের থেকে খারাপ কিছু ভাইবেন না আফা। লন চা খান!”

মিসেস সাওদা চা নিলেন। বিষণ্ণ মনে চুমুক দিলেন চায়ে। সূর্যের আলোই দিবালোকে আধার কেটে ফকফকে দিন শুরু হচ্ছে। কিন্তু মিসেস সাওদার মনের খচখচ ভাব আর আধার কোনটাই দুর হচ্ছে না। সময় যাচ্ছে আর তিনি তত অস্থির হয়ে উঠছেন।

# প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৩)

_______________

“বড় হয়ে গেছ এখন মায়ের মতামতের প্রয়োজন পড়ে না। বাপ তো কবেই গত হয়েছে। নিজে নিজে সব সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছ। এই দিন দেখার জন্য এত যত্ন করে লালন পালন করেছিলাম তোমায়? একটাবার মাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না?” একাধারে এতগুলো কথা বলে সাওদা বেগম কিছুক্ষণ থেমে একটু বড় করে শ্বাস নিলেন। পূনরায় ছেলের উদ্দেশ্য আবার বলা শুরু করলেন, “আজকের দিনে তোমার বাবা বেঁচে থাকলে কতটা কষ্ট পেত জানো? ভালোই হয়েছে মানুষটা আগেভাগে চলে গেছে। ছেলেমেয়েদের তামাশা দেখার জন্য রেখে গেছে আমাকে। হয় তোমার বউ নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে নতুবা ওই মেয়েকে বাড়ি থেকে বেড় করে দেবে। অচেনা অজানা কোন মেয়েকে আমি আমার বাড়ির বউ হিসাবে মানবো না। এ হতে পারে না। শুনেছো তুমি?”

“শুনেছি।”

“এখন তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে আমাকে!”

“কেমন সিদ্ধান্তে তুমি খুশি হবে?”

ছেলের পাল্টা প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলেন সাওদা বেগম। প্রতিত্তোরে বলল, “মানে, কি বলতে চাও তুমি?”

“কি বলার বাকি রেখেছো তুমি মা? কিছু না বুঝে না শুনে নিজের মতামত জানিয়ে দিলে। আবার আমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইছো। তাই আমিও বললাম কেমন সিদ্ধান্তে তুমি খুশি হবে।”

“তার মানে অচেনা অজানা ওই মেয়েটার সাথেই তুমি সংসার করবে?”

“একবারও বলেছি সে কথা?”

“তাহলে?”

“রাজীব, তৃণার ছেলের আকিকায় গিয়েছিলাম ফুলতলী গ্রামে। তুমি জানোই তো। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে বাড়ি ফিরে আসছিলাম। সাথে রাজীব ও ছিল। ওদের বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক পরেই অন্বেষার বাবার বাড়ি। বিয়ে বাড়ি থেকে সানাইয়ের আওয়াজের পরিবর্তে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছিল। কি হয়েছে জানতে বেশ কৌতূহল নিয়ে ও বাড়িতে প্রবেশ করলাম। তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না মা! অন্বেষার সৎ মা ওকে ওনার পায়ের জুতা দিয়ে দু গালে দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে ততক্ষণে। কেউ আটকানোর চেষ্টাও করছেনা। আশেপাশের মহিলারাও মেয়েটাকে যা নয় তাই বলে গালি দিচ্ছিল। এক কোনায় অবলার মত পড়ে আছে অন্বেষার বাবা। তার দ্বিতীয় স্ত্রী যে তার মেয়েটার সাথে জানোয়ারের মত আচরণ করছে সে ব‍্যপারে কোন খোঁজ খবর রাখেননি ভদ্রলোক।

এসব দেখে বরাবরের মত আমার মাথা গরম হয়ে গেল। ভদ্রলোককে জানানোর পরেও তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তারপর আমি গিয়ে মহিলার হাত থেকে অন্বেষাকে উদ্ধার করলাম। আমাকে যা নয় তাই বলে গালি’গা’লাজ করলো। মন চাইছিল ক’ষে দুয়েকটা থা’প্পড় লাগিয়ে দেয়। কিন্তু আমার শিক্ষা এমন কাজে আমাকে বাধা দিল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম গ্রামের মেম্বারের গাঞ্জা’খোর, মাতাল ছেলেকে নিয়ে এসেছে অন্বেষার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তারা বিয়ে নাকচ করে দিয়েছে। আসবে না। গাঞ্জাখোরটা মাতালের মত ঢুলছিল তখনও। ভাবো একবার তুমি! আমি আর রাজীব ঘৃণ্য কাজে বাধা দেয়। এতে অন্বেষার সৎ মা সহ অনেকেই ফুঁসে ওঠে। বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে বলে এত যেহতু দরদ তাহলে তুমিই বিয়ে করো। একপ্রকার সিনেমেটিক ভাবে বিয়েটা হয়ে গেল।”

সারফারাজের দীর্ঘ বক্তব্য মনোযোগ সহকারে শুনলেন মিসেস সাওদা। তারপর বললেন, “ওই গ্রামে কি কোন পুলিশ বা প্রশাসন ক্ষমতা নেই? কুরবানির গরু তোমাকেই কেন হতে হলো?”

“রাজীব পুলিশে ফোন দিয়েছিল। ওখানকার যে ওসি তিনি অন্বেষার বাবার ছোট বেলার বন্ধু। তিনিই আমাকে আলাদা করে অনুরোধ করলেন বিয়েটা করতে। মেয়েটা ভালো ছিল না ও বাড়িতে। মা! সৎ মানে তো ভালো। তাহলে ওই মহিলা এত নিষ্ঠুর কেন? অন‍্যের মেয়েকে নিজের মেয়ের মত জানলে খুব কি ক্ষতি হয়!”

“সবার বুদ্ধি জ্ঞান সমান হয় না সারফারাজ। বিবেক বর্জিত মানুষ অমানুষের কাতারে পড়ে। এখন বলো? তুমি কি ওই মেয়ের সাথে সংসার করতে চাও? তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত। আমি আর কিছু বলব না। অচেনা অজানা একটা মেয়ের সাথে মানিয়ে নিতে পারবে?”

“বিয়েটা হওয়ার পরে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ঢাকায় ফিরলে অন্বেষার কোন একটা ব‍্যবস্থা করে দিব। এভাবে কি হয় নাকি। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছি। যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে। সংসার করবো। একটা অবহেলিত মেয়েকে যদি স্থায়ী ঠিকানা দিতে পারি খুব কি খারাপ হয়ে যাবে মা?”

ছেলের কাতর কন্ঠে পিঠে কঠিন কথা বলতে পারলেন না মিসেস সাওদা। মনের মধ্যে যে ক্ষোভ ছিল ক্রমেই তা নিভে আসছে। সারফারাজের কথায় স্বায় জানিয়ে বললেন, “হয় না বাবা। তাহলে ডাকো। আমার একমাত্র ছেলের বউকে দেখব না নাকি! ডাকো?”

সারফারাজ হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন। লম্বা শ্বাস নিল সে। শেষমেশ মাকে বোঝানো গেল। ভাবতেই পারেনি সারফারাজ তার মা এত সহজে সবকিছু মেনে নিবে। মায়ের উদ্দেশ্য বলল, “আমি সাইমাকে বলছি নিয়ে আসতে। তুমি বসো।”

সারফারাজ মায়ের রুম ত‍্যাগ করে বোনেদের রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো। সাইফা, সাইমার সাথে অল্প সময়ের মধ্যে ভাব না হলেও একটু সহজ হয়েছে অন্বেষা। আগের মত অতটা জড়তা নেই। সময় গেলে হয়তো ঠিকঠাক হবে।

তিন রমনী গল্পে মশগুল। তারমধ‍্যে অন্বেষা শুধু মনোযোগী শ্রোতার ন‍্যায় দুবোনের বক’বকানি শুনছে। কিছু বলছে না সে। এমন সময় সারফারাজের আগমন। দরজার সম্মুখ থেকেই তাদের উদ্দেশ্য করে বলল, “মা ডেকেছেন অন্বেষা কে। নিয়ে আয়।”

ভাইয়ের কথায় দুবোন মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। অর্থাৎ তারা নিয়ে আসছে। সারফারাজ আবারও মায়ের রুমের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। মায়ের সাথে কত কথা বাকি।

অন্বেষা শাশুড়ি মায়ের রুমে ঢোকার আগেই লম্বা করে সালাম দিল দরজার সম্মুখ থেকে। “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।”

সাওদা বেগম উত্তর দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্। ভেতরে এসো।”

অন্বেষার দুপাশে দেহরক্ষির ন‍্যায় সাইমা, সাইফা দাড়ানো। মায়ের অনুমতি পেয়ে অন্বেষাকে নিয়ে রুমে ঢুকলো। ওনার রুমে এক্সট্রা কোন সোফা নেই। রুমের এক কোণায় দুটো বেতের মোড়া রাখা। সাইফা তার একটা নিয়ে অন্বেষার দিকে বাড়িয়ে দিল। বলল, “বসুন ভাবি।”

অন্বেষা সাথে সাথে বসলো না। সে শাশুড়ি মায়ের অনুমতির অপেক্ষা করছে। সাওদা বেগম অন্বেষার অস্বস্তি বুঝলেন। অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বসো।”

বেতের মোড়াটাই অন্বেষা বসলো। দৃষ্টি তার মেঝেতে অবনত। মিসেস সাওদা খানিকক্ষণ অন্বেষার চেহারার দিকে চেয়ে রইলেন। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। স্মৃতিপটে ভেসে উঠছে বহু পুরোনো কিছু স্মৃতি। ঝাপসা তা। ভাবনা বাদ দিয়ে বিছানায় বসা থেকে নেমে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন। সারফারাজ বরাবরের মত মায়ের বিছানায় কুশন জড়িয়ে বসে আছে। কিন্তু বর্তমানে অন্বেষা বাদে বাকি তিনটি প্রাণির দৃষ্টিতে অবাকের ছোঁয়া বিদ‍্যমান। কি করতে চলেছেন তাদের মা!

মিসেস সাওদা তার পুরোনো দিনের ছোট কাঠের সিন্দুক থেকে সোনার এক জোড়া বালা, একটা চিকন চেইন, আর ছোট্ট এক জোড়া দুল বের করলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন মোড়ায় বসা অন্বেষার কাছে। অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “দেখি, উঠে দাড়াও মেয়ে। বাড়ির বউদের শূন্য কান, গলা ভালো দেখাই না। এগুলো আমার শাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি যত্ন করে তুলে রেখেছিলাম ছেলের বউয়ের জন্য। ভাগ‍্যক্রমে তুমিই সে। এদিকে আগাও পড়িয়ে দেয়।”

যত্ন করে পড়িয়ে দিলেন গহনাগুলো। ফর্সা সুন্দর গায়ে চমৎকার লাগছে। রুমের বাকি প্রাণিগুলো মুগ্ধ দৃষ্টিতে অন্বেষাকে দেখছে। মাশা আল্লাহ্। সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করে বানিয়েছেন মেয়েটাকে। যেন সব সৌন্দর্য তার জন‍্যই বরাদ্দ।

মিসেস সাওদা ছেলের উদ্দেশ্য বললেন, “বউকে যেখানে নিয়ে যাবে ঢেকে ঘিরে নিয়ে যেও। ঘরের চাঁদ ঘর আলো করুক। বাহিরে আলো ছড়ানোর দরকার নেই। তাছাড়া যেভাবে বিয়ে হয়েছে, হয়েছে। আমি আমার ছেলের আবার বিয়ে দিবে। সমাজ বলেও তো একটা কথা আছে। এ সময় বারবার আসে না। তুমি কি আমার সাথে একমত সারফারাজ?”

“আবশ‍্যই মা।” হঠাৎই সারফারাজের ফোন বেজে উঠলো শব্দ করে। শোরুম থেকে কর্মচারী ফোন দিয়েছে। সারফারাজ ফোন কেটে দিল। রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। তারপর নিজেই কল দিল। ওপাশ থেকে কল ধরতেই ব‍্যস্ত কন্ঠে অল্প বয়সী যুবক কন্ঠে বলে উঠলো, “ভাই? আপনে কখন আসবেন? সেই ম‍্যাডাম আবার আসছেন। বারবার আপনের খোঁজ করতেছেন। আপনার নাম্বার নেওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করছে। কি করবো?”

সবটা শুনে সারফারাজের কপাল বিরক্তিতে কুচকে গেল। আপদ বিদেয় হয় না কেন!

সারফারাজের সাড়াশব্দ না পেয়ে ফোনের অপর প্রান্তের যুবক কন্ঠের অধিকারী ছেলেটি পূনরায় বলল, “ভাই শুনতে পাইতাছেন?”

সারফারাজ প্রতিত্তোরে বলল, হ‍্যাঁ শুনছি। শোন ছোট! ম‍্যাডামকে যেভাবে হোক বিদেয় কর। আমি বিকালে শোরুমে আসছি।”

“আইচ্ছা ভাই।”

সারফারাজ ফোন রেখে পূনরায় মায়ের রুমে গেল। এক চক্ষুশীতলকারী দৃশ্যে তার চোখ দুটো আটকে গেল।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে  (০৪)

______________

শাশুড়ি মায়ের স্নেহপূর্ণ আচারণে বহুদিনের মাতৃস্নেহ  থেকে বঞ্চিত অন্বেষা আবেগাপ্লুত। ফলস্বরুপ ডাগর ডাগর চোখ দুটো থেকে অশ্রুর ঢল বইতে লাগলো। সাওদা বেগম আর কিঞ্চিত দুরে দাড়ানো সাইমা, সাইফার চোখ যুগলও ছলছল করে উঠলো। সাওদা বেগম অন্বেষার উদ্দেশ্য নমনীয় স্বরে বললেন, “কেঁদো না মেয়ে। পৃথিবী একটা সমরঙ্গন। এখানে নানা প্রতিকুল পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে হাজারো যুদ্ধ জয় করতে হয়। আমি তোমার কষ্ট, বেদনা বুঝতে পারছি। আমি নিজেও তো মা। আমার নিজেরও তিনটা ছেলেমেয়ে আছে। জানিনা তোমার সৎ মা কেমন মানুষিকতার। কি করে পারে ফুটন্ত গোলাপের ন‍্যায় ফুটফুটে এই মেয়েটার প্রতি নির্যাতন, অবহেলা করতে! যেভাবেই হোক আমার ছেলে তোমাকে বিয়ে করেছে। এখন তুমি এ বাড়ির বউ। আগে যেমন ছিলে যেভাবে ছিলে সেসব ভুলে যাও। এ সংসার বহু কষ্টের গড়া। আমার পরে তুমিই তো এ সংসারের দায়িত্ব নিবে। শুধু আমার মেয়ে দুটোকে দেখে রাখবে। এতটুকুই চাওয়া। কি পারবে না? এ বাড়ির একজন হয়ে আমাদের সবাইকে আপন করে নিতে পারবে না? আপত্তি আছে? আমাকে ‘মা’ বলে ডাকতে আপত্তি হবে কোন?” কথাগুলো বলে নিজ হাতেই অন্বেষার চোখ থেকে চিবুকে গড়িয়ে পড়া পানি সাওদা বেগম মুছিয়ে দিলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অন্বেষার উত্তরের আশায়।

অন্বেষা প্রতিত্তোরে ধরা গলায় বলল, “আমি বহুদিন কাউকে মা বলে ডাকি না। মাতৃস্নেহ তো দুরে থাক। আমি কি আপনাকে আম্মু ডাকতে পারি?”

“কেন নয় সোনা। আজ থেকে তুমিও আমার আরেকটা মেয়ে। দেখি কাছে আসো।”

অন্বেষা একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়লো শাশুড়ি মায়ের বুকে। সাওদা বেগমের ঠোঁট কোলে মিষ্টি হাসি বিদ‍্যমান। সেও খুশি। পরম মমতায় অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সাইমা, সাইফাও মায়ের সন্নিকটে এসে দাড়ালো। দুবোন দু পাশ থেকে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মাঝে সাওদা বেগমের বুকের সাথে লেপ্টে মিশে আছে অন্বেষা। সাওদা বেগমের চোখ দুটো থেকে আনন্দ অশ্রু প্রবাহিত হলো। এ যেন বহু তৃপ্তির।

রুমের বাহিরে দরজায় দাড়িয়ে এহেন চক্ষু শীতলকারী দৃষ্টি মুগ্ধ করলো সারফারাজকে। সে তাৎক্ষণিক রুমে ঢুকলো না। এমন আবেগপ্রবণ মূহুর্ত সে গিয়ে ভেঙে দিতে পারে না। মন তুষ্ট হলো সারফারাজের। আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া জানালো। মায়ের প্রতি সম্মান ভালোবাসা যেন বেড়েই চলেছে। কমতি নেই। অন‍্যদিকে দ্রুত পা চালিয়ে সাওদা বেগমের রুমে দিকে হেঁটে আসছেন হাসুর মা। সকালের নাস্তা হয়ে গেছে। ঠান্ডা হয়ে গেল যে। খাবে কখন! দরজার কাছে সারফারাজকে দাড়ানো দেখে হাসুর মা তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কি খবর বাপজান? তুমি রুমে না ঢুইকা এইহানে কি করো? আর সকালের খাওন খাইবা না?”

সারফারাজ হাতের আঙুল দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বোঝালো চুপ করুন। হাসুর মা দমে গেল। সে প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে সারফারাজের দিকে।

সারফারাজ রুমের দিকে ইশারা করে হাসুর মায়ের উদ্দেশ্য বলল, “খালা চুপ করুন। দেখুন মা আর ওরা মিলে কি করছে! এমন আবেগঘন মুহূর্ত আমরা গিয়ে কি করবো? থাকুক না। মেয়েটা বহুদিন বাদে একটু মাতৃস্নেহের ছায়াতলে এসেছে। কিছুক্ষণ মনে ভরে উপভোগ করুক।”

হাসুর মাও মৃদু হাসলেন এহেন হৃদয় জুড়ানো দৃশ্য দেখে। নিচু আওয়াজে প্রতিত্তোরে বললেন, “হক কথা কইছো বাপজান। তয়, তোমার মা’রে কিছুতে ভুল বুইঝো না। তেনারে আমি অনেককাল থেইকা চিনি। মানুষটা উপরে শক্ত হলেও ভিতরে ভারী নরম। ঠিক নারকেলের মত। আমারও ভালা লাগছে। আল্লাহ্ রহমত দান করুক।”

শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মুছলেন হাসুর মা। গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো অন‍্যেকর দুঃখে যেমন দুঃখি  হয়ে কাঁদে তেমন অন‍্যের সুখেও তাদের চোখও ভিজে ওঠে। হাসুর মাও তেমনি একজন।

বিকালে সারফারাজ শোরুমের উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। সঙ্গে বাড়ির গাড়ি। যাওয়ার আগে বোনেদের উদ্দেশ্য বলে গেছে রেডি হয়ে থাকতে। সে সন্ধার পর এসে নিয়ে যাবে শপিংয়ে। আরও বলেছে যদি মা আর অন্বেষা রাজী থাকে তবে সেও যেন রেডি থাকে। সেই থেকে সাইমা, সাইফার খুশি যেন ধরে না। কি করবে কি কিনবে দুবোন লিস্ট করতে বসে পড়েছে।

সাইফা বলল, “সাইমা, বেশি লাফাস না। ভাইয়া এখন বিয়ে করেছেন। মা চাইছেন একটু আয়োজন করে আবার বিয়ে দিতে। খুব সুন্দর সিদ্ধান্ত। এখন মাত্রাতিরিক্ত কিছু কিনিস না। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। লিস্ট থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বাদে বাকিগুলো কে’টে ফেল। বুঝেছিস?”

সাইমা, সাইফা জমজ দুবোন। প্রায় একই স্বভাবের। তবে চেহারাই হালকা ভিন্নতা। সাইফা বেশ বুঝদার হলেও সাইমার মধ্যে বেশ অবুঝপনা বিদ‍্যমান। সাইফার হাস‍্যজ্জ্বল মুখশ্রী থমথমে হয়ে গেল। পছন্দ হয়নি সাইফার কথা তার। প্রতিত্তোরে ভারী গলাই বলল, “কি বলতে চাইছিস সাফু? এখানে সবই তো গুরুত্বপূর্ণ। কোনটা রেখে কোনটা কাটবো?”

“মেকাপের জিনিসপত্র যেগুলো তোর আছে সেগুলো কেটে ফেল। যা খুব প্রয়োজন সেগুলো রাখ। তাহলেই হয়!”

“না আমার সব লাগবে।”

“বোকার মত কথা বলিস না সাইমা। ভেবে দেখ দ্রব‍্য মূল‍্যের উর্ধগতির জন্য প্রতিটি পণ্যের যে চড়া দাম তোর একার জিনিস কিনতে গেলেই তো ভাইয়ার বিশ হাজারের বেশি নেমে যাবে। বাকিদের জন‍্যও তো কিনতে হবে। নাকি?”

“তাহলে কি করবো?”

“আমার কথায় মন খারাপ করিস না। ভাইয়া আগে আমাদের পিছনে দুহাত ভরে খরচ করেছে। সমস্যা ছিল না। কিন্তু ভাইয়ার এখন বিয়ে হয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করা প্রয়োজন তাছাড়া খরচও বেড়েছে। আবার সবকিছুর দামও দিন দিন আকাশ ছুয়ছে। আমাদের কি উচিত না ভাইয়ার দিকটাও খেয়াল রাখা? নিজেরা যদি একটু শৃঙ্খলা আনি তাহলে দেখবি সংসারে কোন ঝামেলায় হবে না। বুঝলি?”

“ধুর সাফু। তুই কেন সবকিছু এত ভালো বুঝিস বল তো? আমার মাথায় কেন এসব আসে না?”

“সারাদিন ট্রিপ নিয়ে আর ফোন ঘাটলে বুদ্ধি কোথা থেকে আসবে শুনি? বই পড়, বিভিন্ন লেখকদের লেখা পড় দেখবি অনেক কিছু বুঝে ফেলেছিস। তখন আমাকেই জ্ঞান দিতে পারবি।”

সাইমা বুঝলো সাইফার কথা। হাতের লিস্ট সাইফার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তার উদ্দেশ্যে বলল, “হুম, তাই করতে হবে দেখছি। তাহলে ধর তুই কে’টে কু’টে কমিয়ে দে।”

সাইফা মিষ্টি হেসে বলল, “দিচ্ছি।”

“উফ! সাফু এভাবে হাসবি না। আমি তোর বোন হয়েই ফিদা হয়ে যায়। না জানি ছেলেদের কেমন লাগে! একদম হাসবি না!”

সাইমার বোকা বোকা কথায় শব্দ করে হেসে ওঠে সাইফা। হঠাৎ মনে পড়লো মাস তিনেক আগে এক অদ্ভুত মুহূর্তের কথা। এভাবে একজন তার হাসির প্রশংসা করেছিল। কিন্তু সেদিন নিছক ফ্লাটিং মনে হয়েছিল। বলল, “সত‍্যি বলছিস সাইমা? সুন্দর নাকি?”

সাইমা ভ্রু উচিয়ে বলল, “তুই জানিস না আমি মিথ্যা বলি কম। এটা সত্য। শোন, এবার তৈরি হই। ভাইয়া এলো বলে!”

অন্বেষার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন হাসুর মা। ঢেউ খেলানো চুল। দেখতে সুন্দর লাগে। চুলে মাঝে কাঁটাছেড়া দেখে আতকে উঠেন হাসুর মা। জিজ্ঞাসা করেন, “একি নতুন বউ তোমার চুলের মধ্যে এমনে কাঁটা কেন?”

এহেন প্রশ্নে অপ্রস্তুত বোধ করে অন্বেষা। কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না বেচারি। পাশেই বেতের মোড়ায় মিসেস সাওদা বেগম বসা। আর মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসে হাসুর মা আর অন্বেষা। মিসেস সাওদা অন্বেষার মুখভঙ্গি দেখে আন্দাজ করলেন কিছুটা। অন্বেষার উদ্দেশ্যে বললেন, “তোমার ইচ্ছে না হলে বলতে হবে না।”

ইতস্তত বোধ করলো অন্বেষা। কোন দিক দিয়ে শুরু করবে সে? ফেলে আসা জীবনটা এতটা বিভীষিকাময় যে কাউকে বলতেও বাধে। গর্ব করে বলার মতোও কিছু নেই। আছে একরাশ য’ন্ত্রণা। যা কুঁ’ড়ে কুঁ’ড়ে খা’চ্ছে প্রতিনিয়ত। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, “আমার চুলের গ্রোথ বেশি। দ্রুত লম্বা হয়। আম্মু থাকতে যত্ন নিতেন। আম্মু মারা গেলেন এরপর আসলেন আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী। চুলে তেল দেওয়া লাগতো সপ্তাহে দুই তিনবার। শ‍্যাম্পুও করা লাগতো। যেহেতু অনেক চুল তাই সবকিছু বেশি পরিমাণে লাগতো। একদিন চুলে শ‍্যাম্পু নিয়েছিলাম, কৌটায় অল্প পরিমাণে ছিল। আমি নেওয়াতে আর একটুও বাকি ছিল না। তিনি গোসলে গিয়ে শ‍্যাম্পু শূন্য কৌটা পেয়ে ক্রোধে ফে’টে পরেন। এসেই আমার চুলের মুঠি ধরে চুল কাটতে উদ‍্যাত হন। কা’চি এনে কেবল এক পোচ দিয়েছিল তারমধ‍্যে আমার চিল্লা’চিল্লির আওয়াজ শুনে পাশের বাড়ির এক চাচি এসে পরেন। তিনি উদ্ধার করেন। সেদিন আর চুলগুলো কাঁ’টা হয়নি। রক্ষা পেয়েছিল। তারজন‍্য চুলগুলো অসমান রয়ে গেছে।” অন্বেষা কথাগুলো বলে ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার। চোখের পানি যেন গড়িয়ে না পড়ে।

হাসুর মা তো কেঁদেই ফেলেছেন। মনটা বড্ড খারাপ হলো সাওদা বেগমের। কি দরকার ছিল মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করে তার পুরোনো ক্ষ’ত তা’জা করে দেওয়ার। অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “কষ্ট পেও না মা। সবার জীবন সুন্দর হয় না। আগে সুন্দর ছিল না ইনশাআল্লাহ দেখো এখন সুন্দরে মুড়িয়ে রাখবে আমার ছেলে। চোখ মোছ তো!”

অন্বেষা নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ মুছলো। ঠোঁটে কোনরকম এক চিলতে হাসি ফোঁটানোর চেষ্টা করলো। কতটা সফল হয়েছে কে জানে!

সন্ধ্যায় সারফারাজ নিতে এসেছে ওদের। সাইমা, সাইফা তৈরি। কিন্তু কোথাও অন্বেষাকে দেখলো না। সাওদা বেগম নিজে এসে জানালেন অন্বেষার খুব জ্বর এসেছে। কোথাও তাকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সারফারাজের মনঃক্ষুন্ন হলো। সময়ের সল্পতার জন্য রুম অবধি যাওয়া হলো না তার। সাইফা, সাইমাকে নিয়ে ভড়ক্রান্ত মন নিয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে হলো।  চিন্তাও হচ্ছে। মন চাইছে সব ছেড়েছুড়ে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসে থাকতে। কিন্তু তাও পারছে না সারফারাজ। কাল গায়ে হলুদ। পরদিন আবারও বিয়ে। কেনাকাটা আজই সারতে হবে। অগ‍্যতা মায়ের ওপর অন্বেষার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে সে চলে গেল শপিংমলের উদ্দেশ্য বোনেদের নিয়ে।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (০৫)

______________

সাওদা বেগম নিজের হাতে অন্বেষাকে রাতের খাবার, ওষুধ খাইয়ে দিয়েছেন। অন্বেষার নেত্রযুগল যতক্ষণ না ঘাঢ় নিদ্রায় না ডুবছে ততক্ষণ তিনি পাশেই বসে ছিলেন। পুরোটা সময় অসুস্থ অন্বেষা নিরবে মুগ্ধতার সহিত উপভোগ করেছে। এত আদর, ভালোবাসা এতগুলো বছর পরে তার ভাগ্যে আবার ফিরে আসবে কখনও কি ভেবেছিল সে? আল্লাহ্ চাইলে কি না সম্ভব!

ঘড়ির কাঁ’টা একটার ঘরে অবস্থান করেছে। শপিংমল থেকে এসে কোন রকম খেয়ে, ফ্রেশ হয়ে ঘুমন্ত অন্বেষার পাশে বসে আছে সারফারাজ। সে সময় পেলেই অন্বেষার সুন্দর মুখশ্রীর দিকে এক ধ‍্যানে তাকিয়ে থাকে। এমন না যে সেই দৃষ্টিতে কামনার লেশ থাকে। তবুও সে অত মুগ্ধতা নিয়ে কি দেখে সে আর আল্লাহ ভালো জানেন!

অনেকটা সময় অন্বেষা গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। কপালে শক্তপোক্ত হাতের কোমল ছোঁয়ায় আরাম লাগলেও ঘুম ভেঙে যায় তার। তবুও খানিকটা সময় নিরব থেকে বোঝার চেষ্টা করে। শক্তপোক্ত হাতখানার মালিক কোন মহিলা নয় সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়নি অন্বেষাকে। কপালে হাতখানা তার সবটুকু ভালোবাসা, যত্ন ঢেলে দিয়ে হালকা করে চেপে দিচ্ছে। অন্বেষার খুব ভালো লাগছে। আবেশে নেত্র যুগল বন্ধ করে রাখে। দেখা যাক কতক্ষণ হাতের মালিক এত যত্ন দিয়ে সেবা করতে পারে! মনে মনে হাসে অন্বেষা। কিছু বছরের বিভীষিকাময় জীবনের আড়ালে হারিয়ে যাওয়া সুন্দর, প্রাণোচ্ছল জীবনটা একটু একটু করে ফিরে পেতে চলেছে অন্বেষা। চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে ফোঁটায় ফোঁটায়। সারফারাজের হাতে গিয়ে লাগে সে পানি। তা দেখে দিশেহারা বোধ করে সারফারাজ। ঘুমন্ত অন্বেষাকে নিচু আওয়াজে ডেকে ওঠে সারফারাজ। বলে, “অন্বেষা! কি হয়েছে? খুব খারাপ লাগছে কি? মাথা ব‍্যাথা করছে? কিছু লাগবে?”

রিতিমত প্রশ্নের ঝড় তুলছে সারফারাজ। সে ভয় পাচ্ছে পাছে অন্বেষার কিছু হয়ে যায়!

প্রতিত্তোরে নিরব অন্বেষা। তার চোখ বেয়ে কখন গড়িয়ে পড়েছে পানি সারফারাজ না ডাকলে সে খেয়ালই করতো না। অন্বেষার নিরাবতা চিন্তিত করে তুলল সারফারাজকে। চিন্তাই কিংবা বিরক্তিতে সারফারাজের কপালে মৃদু চামড়ার ভাজের সৃষ্টি হয়। দেখতে খারাপ লাগে না। এবার অন্বেষার নরম বাহুজোড়া ধরে সারফারাজ ডাকলো, “অন্বেষা? অন্বেষা কিছু হয়েছে? না বললে বুঝব কিভাবে বল তো!”

অন্বেষা আর চুপ থাকতে পারলো না। সে শোয়া থেকে উঠে বসলো। জ্বর আগেই পড়ে গিয়েছে। এখন বেশ স্বাভাবিক সে। সারফারাজের সাথে অন্বেষার কথা বলতে খুব লজ্জা লাগে। এই মানুষটার সাথে সেদিন রাত আর আজকের রাত ছাড়া আলাদা করে কথা বা সাক্ষাৎ কোনটাই হয়নি বললে চলে। নিজেকে ওড়না বিহীন আবিষ্কার করে অন্বেষা। লজ্জায় মিইয়ে গেল সে। চোখ তুলে সামনের মানুষটার দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। ফর্সা মুখশ্রীতে গোলাপি আভা ফুটে উঠেছে। ফর্সা মানুষগুলো তাদের অভিব্যক্তি লুকিয়ে রাখতে পারে না। চেহারাই ফুটে ওঠে। লজ্জার রঙ বোধহয় গোলাপি।

সারফারাজ অন্বেষার স্বাভাবিকতায় অবাক হলো কিছুটা। পরক্ষণেই অন্বেষার লাজুক মুখশ্রীর কারণ খুজে পেল না। ভ্রু কুচকে মনোযোগী ভঙ্গিতে সেদিক পানে তাকিয়ে আছে সে। অন্বেষা আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কোথাও ওড়নার দেখা পেল না। হতাশ হলো সে। প্রচণ্ড জ্বর আসায় গায়ে পাতলা কম্বল দিয়ে শুয়েছিল । তাড়াতাড়ি সেটাই গায়ে টেনে নিল। অসহায় দৃষ্টিতে সারফারাজের পানে চাইলো অন্বেষা। অর্থাৎ তার ওড়নাটা খুজে দিতে হবে!

সারফারাজ বেশ সময় ব‍্যায় করে বুঝলো তার নব‍্য স্ত্রীর লজ্জা, অস্বস্তির কারণ। ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হেসে ওঠে সে। ভাবে মেয়ে মানুষ এত নির্বোধ কেন?

সারাফারাজ তার অনুরক্তি খোলসে আবদ্ধ করলো। কন্ঠে গম্ভীরতা ফুটিয়ে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “কি হয়েছে? তোমাকে এতবার ডাকা হলো কিছু বললে না যে? আবার ঘুম থেকে উঠেই লজ্জা পাচ্ছো, মোচড়ামুচড়ি করছো কারণ কি?”

সারফারাজের এহেন প্রশ্নে আরও লজ্জা পাই অন্বেষা। লাজুক কন্ঠে প্রতিত্তোরে বলল, “কিছু না।”

“কিছু না, সিরিয়াস?”

“হ‍্যাঁ।”

“কিছু যেহতু হয়নি পরে কিছু লাগলে বলতে পারবে না। আমি কিছু এনে দিতে পারবো না। অনেক রাত হয়েছে ঘুমাতে হবে আমার। কাল অনেক কাজ।”

“আমার ওড়নাটা খুজেঁ পাচ্ছিনা। আপনি দেখেছেন?”

“অবাক ব‍্যপার না? ওড়না পড়ো তুমি অথচ কোথায় আছে জিজ্ঞাসা করছো আমাকে? আমি পড়ি?”

“না।”

“আমি তোমার কি হই?”

প্রতিত্তোরে কোন জবাব না পেয়ে ধমকে ওঠে সারফারাজ। এতক্ষণে সে তার আসল রূপে ফিরে এসেছে। পূনরায় জিজ্ঞাসা করলো, “তোমার কি হই আমি?”

অন্বেষা চুপ না থেকে জবাবে বলল, “স্বামী।”

“তাহলে এতক্ষণ সময় লাগছিল কেন? সাথে সাথে জবাব দিতে কি হয়?”

অন্বেষার এবার বিরক্ত লাগছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে কি সুন্দর সেবা করলো, ভালো করে কথা বলল অথচ এখন সেই রাগী তেজস্বী রূপ।

সারফারাজ অন্বেষাকে চুপ থাকতে দেখে বলল, “তোমরা মেয়েটা কোন কি দিয়ে গড়া বলতে পারবে? তোমার স্বামী আমি আর আমার সামনে কিনা ওড়না  ছাড়া থাকতে লজ্জা পাচ্ছো! বলি, এত লজ্জা কোথা থেকে আসে? একটু সিরিয়াস হও। আমি কি কচি খোকা। কিছু বুঝি না। তুমি যেমন করলে এতে করে আরও বেশি বুঝতে বাধ্য করলে। আমার কি দোষ বলো? তোমাকে তো এর শাস্তি পেতেই হবে। রেডি হও!”

আঁতকে ওঠে অন্বেষা। কি শাস্তি দিবে এই গিরগিটি টাইপের মানুষটা। ইতিমধ্যেই অন্বেষার সারফারাজকে মি.গিরগিটি নামে ভুষিত করা হয়ে গিয়েছে। যদিও না অন্তরালে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “শাস্তি মানে? কি করেছি আমি?”

পৈশাচিক হাসি হাসে সারফারাজ। অন্বেষার আতঙ্কগ্রস্ত মুখ দারুণ লাগছে তার। সুন্দরী মেয়েদের সব কিছুতেই কি সুন্দর লাগে? নাকি এই মেয়েটার সবকিছু তাকে চুম্বুকের ন‍্যায় আর্কষণ করে? ভেবেও উত্তর পাই না সারফারাজ।

“এইযে আমার সামনে ওড়না ছাড়া যে লজ্জা পেলে আমার তো খুব ভালো লেগেছে। সারারাত ওড়না ছাড়া আমার সামনে ঘুরে বেড়াবে। আর এভাবে লজ্জা পাবে। আমি উপভোগ করবো। সুন্দর হবে না?”

“মোটেই না। তাছাড়া কখনও কোন পুরুষের সামনে ওড়না ছাড়া থাকিনি আমি। অভ‍্যাস নেই। এটা ঠিকও না।”

“অন‍্য পুরুষ আর আমি বুঝি এক?”

“তাইতো।”

“সত‍্যিই? তাহলে এখানে থেকে কি করবে? এখনই এই মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে। আমি যদি অন‍্য পুরুষের কাতারে পড়ি তাহলে আমার সাথে থাকা তো তোমার উচিত হবে না। তাই না! যাও চলে যাও।”

সারফারাজের শক্ত কথায় ছলছল করে ওঠে চোখ যুগল অন্বেষার। মানুষটা এমন কেন! কিছুক্ষণ আগেও অন্বেষার নিজেকে খুব সুখি লাগছিল। এত অল্প সময়ের ব‍্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেল। তবে কি সুখ তার কপালে নেই! অশ্রু বিসর্জনে ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে অন্বেষা। এ ছাড়া এই মাঝ রাত্রে সে কি করবে?

অন্বেষার চোখের পানি সারফারাজের অন‍্যতম দূর্বলতা। কেবলই বোধগম্য হলো তার। মেয়েটার চোখের পানি সহ‍্য হচ্ছে না। কিন্তু নিজের ত‍্যাড়ামো থেকে সরলো না। বলল, “শোন মেয়ে? কাঁদতে হয় রুমের বাইরে গিয়ে কাঁদো আমার সামনে কাঁদবে না। মেয়ে মানুষের কান্নার আওয়াজ আমার ভালো লাগে না।”

অন্বেষার কান্না থামে না। সে আরও শব্দ করে কেঁদে দেয়। সারফারাজের গিরগিটির মত ক্ষণে ক্ষণে বদলানো রূপের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব‍্যার্থ হচ্ছে অন্বেষা। মস্তিষ্ক ফাঁকা লাগছে।

ঠোঁট কামড়ে হেসে নিঃশব্দে হাসে সারফারাজ। এক টানে বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে অন্বেষাকে। সে তখনো অশ্রু বিসর্জনে ব‍্যস্ত। দেখা যাক মি.গিরগিটি করে করে!

শব্দ করে বেলকনির দরজা খুলল সারফারাজ। কিঞ্চিত কেঁপে উঠলো অন্বেষা। হাতের ভাজে সারফারাজের শক্তপোক্ত হাত। বেলকনিতে প্রবেশ করতেই একঝাঁক শীতল হাওয়া গায়ে এসে লাগলো অন্বেষার। জ্বর ছুটে যাওয়ায় শরীরে ঘাম জমেছিল। শীতল হাওয়ায় শরীর ঠাণ্ডা হলেও মন ঠান্ডা হলো না অন্বেষার। বেলকনিতে রাখা ইজি চেয়ালে বসলো সারফারাজ। সময় ব‍্যায় না করে অন্বেষাকেও নিজের কোলে ধপাস করে বসিয়ে দিল। ঠান্ডা হাওয়া ছুয়ে দিচ্ছে নব দম্পতিকে।

“আমি হুটহাট রেগে যায়। কেন এত রেগে যায় তাও মাঝেমধ্যে বোধগম্য হয় না। রগচটা স্বভাবের জন্য আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের অনেকেই আমাকে পছন্দ করতো না। তুমি কি রাগ করেছো অন্বেষা? আমি রেগে গেলে একদম কাঁদবে না। কান্না আমার পছন্দ না। যখন রেগে যাব জড়িয়ে ধরবে। ব‍্যাস আমি ঠান্ডা হয়ে যাব। আমার থেকে দুরে সরে থাকবে না। দুরত্ব সহ‍্য করতে পারি না। জীবনে অনেকগুলো বসন্ত পার করেছি কোন বসন্তে প্রণয় হাওয়া লাগেনি আমার মনে। আশঙ্কা করছি এবার বোধহয় এত বছরের রেকর্ড ভাঙবে। বুঝেছো তুমি?”

সারফারাজের শান্ত শীতলে কন্ঠে বলা কথাগুলোই বড্ড অবাক হলো অন্বেষা। এই গরম এই ঠান্ডা। বোঝা মুশকিল মানুষটাকে। অন্বেষার মনে হলো এই চমৎকার মানুষকে তারও কিছু বলা উচিত। প্রতিত্তোরে বলল, “আপনার এই শান্ত তেজস্বী রূপটাই আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার শান্ত চাই না অশান্ত আপনাকে চাই। যে ক্ষণে ক্ষণে রেগে যাবে আবার ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসবে। সবাই রত্নের যত্ন বোঝে না। আমি অন্বেষা বুঝি। ভাবুন তো, আপনার জায়গায় কোন শান্ত ভীতু পুরুষ থাকলে ওরকম ভয়ংকর প্রতিকুল পরিবেশ থেকে আমাকে প্রবীত্র বন্ধনে আবদ্ধ করে উদ্ধার করতে পারতো? আমি শান্ত আপনি অশান্ত হলেন তাতে কি? ছেড়ে যেতে বললেন কেন?”

“বলেছি, বলেছি। যেতে দিতাম নাকি। আমার খুব রাগ হয়েছিল। তুমি আমার বউ। তোমার সবকিছুর প্রতি পূর্ণ অধিকার অথচ তুমি কিনা আমাকে অন‍্য পুরুষের খাতায় নাম লেখালে। এতে খারাপ লাগে না বলো?”

“বুঝেছি। অন‍্যায় হয়েছে। আর বলব না। জানেন, আম্মু মারা যাওয়ার পর থেকে ও বাড়িতে আমার আমি ছাড়া কিছুই ছিল না। কিছু আমার এটা বলার অধিকার ছিল না। দেখলেন না নিজের জীবনটা কেমন ধ্বংস হতে যাচ্ছিল। আল্লাহ সহায়। তিনি বাঁচিয়েছেন আপনার মাধ্যমে। আমি কৃতজ্ঞ আপনার প্রতি। এত সুন্দর পরিবার উপহার দিলেন আমার গোটা জীবনটাই এক অন‍্যরকম অনুভূতিতে ভরিয়ে দিলেন। এটাই বা কম কিসে। আমার কিচ্ছু চাই না। শুধু আপনি আমার হয়ে থাকুন। এতেই আমি নিজেকে সর্বসুখী মনে করবো ইনশাআল্লাহ।”

“আমিও খুব সরি বউ। আমি আগাম কথা বলব না। কাজে দেখিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ। শুধু ভুল বুঝ না।”

অন্বেষা প্রতিত্তোরে মুচকি হাসে। মুখে কিছু বলে না। বেলকনির হালকা আলোয় সারফারাজ সে মোহনীয় হাসি দেখতে পেল না। অন্বেষার অর্ধনগ্ন ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে দেয় সারফারাজ। দুহাত দিয়ে আকড়ে ধরে অন্বেষার কোমল নরম দেহখানা। দুজনে নিরব। কেঁপে ওঠে অন্বেষা। অন‍্যরকম অনুভূতি গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে। কিছু মুখে কিছু বলল না। মানুষটা তার স্বামী। কিইবা বলার থাকতে পারে।

“ভয় নেই। শুধু একটু সময় ব‍্যায় করে রুমে গিয়ে ঘুমাবো। তোমার অনুমতি না নিয়ে আর কোন ধাপ অতিক্রম করবো না। আর কিছুক্ষণ আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি প্রকৃতির শীতল হাওয়া উপভোগ করি তারপর রুমে যাব। ঠিক আছে!”

অন্বেষা ওষ্ঠদ্বয়ে চমৎকার হাসি ফুটিয়ে বলল, “অবশ‍্যই ঠিক আছে। আমারও ভালো লাগছে।”

বেলা দশটা বেজে ত্রিশ মিনিট। সারফারাজের ছোট খালা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে হাজির। দুপুরের পর থেকে অন‍্যান‍্য আত্মীয়রাও এসে পড়বে। সাওদা বেগম খুব বেছে বেছে নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজনদের নিমন্ত্রণ করেছেন। একেবারে না জানালেই নয় এমন কিছু মানুষ।

সারফারাজের ছোট খালার ছেলেটার চাহনী সুবিধার মনে হচ্ছে না অন্বেষার। নতুন বউ হয়ে কিছু বলতেও পারছে না। কাল রাতের পর থেকে সারফারাজের সাথে অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে অন্বেষা। সাইমা, সাইফা কেউ নেই। সবাই ব‍্যস্ত। সারফারাজ কোন কাজে বাড়ির বাহিরে। অন্বেষার প্রতি মুহূর্তে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (০৬)

______________

অন্বেষা রুমে একা বসে ছিল। সাইমা, সাইফা আর তাদের ছোট খালার মেয়ে মিলে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য যতটা পারছে আয়োজন করছে। বড়রা কিচেনের দিকটা সামলাচ্ছে। আপাতত অন্বেষা একা। হঠাৎই রুমে আগমন ঘটলো সারফারাজের ছোট খালার বছর তেইশের ছেলেটা। টগবগে তাগরা যুবক। অন্বেষা বিরক্তবোধ করলো। কেমন বিবেক ছেলেটার অনুমতি না নিয়ে রুমে ঢুকে গেল? বিছানায় এক কোণায় বসা ছিল সে। যুবককে দেখে উঠে দাড়ালো। মাথায় ওড়নাটা আরেকটু টেনে নিয়ে দৃষ্টি অবনত করে রাখলো। ছেলেটার মতিগতি আসার পর থেকেই অন্বেষার ভালো লাগছে না। কেউ না বুঝুক মেয়ে মানুষের একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে তাদের আশেপাশের মানুষদের খুব ভালো করে বুঝতে ও চিনতে পারে। কার কেমন চাহনি সেটাও বুঝতে বেগ পেতে হয় না। ফলস্বরুপ অন্বেষাও বুঝতে পারলো। তারপর থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে সে। নতুন বউ হওয়ায় কাউকে বলতেও পারছে না। অন‍্যদিকে খুব দরকারি কাজ পরাই সারফারাজ সকাল থেকেই বাসায় অনুপস্থিত।

রুমে ঢুকে চারপাশে গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখে চলেছে ছেলেটা। দৃষ্টিতে কেমন যেন বেহায়া, লাগামহীন ভাব। ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত অন্বেষা সিদ্ধান্ত নিল তাৎক্ষণিক রুম ত‍্যাগ করার। দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে  রুমের বাইরে যেতে নিলেই পিছন থেকে ছেলেটা বলে ওঠে, “আরেহ্ সুন্দরী ভাবি সাহেবা চলে যাচ্ছেন কেন? বসুন একটু আলাপ করি। আপনার সাথে তো সেভাবে কথায় হলো না।”

এহেন গা জ্বালানো কথায় অন্বেষার পা দুটো স্থীর হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিত্তোরে কিছু বলার মত খুজে পাই না। অন্বেষার নিরাবতা দেখে ছেলেটি আবারও প্রশ্ন করে, “কি ব‍্যপার ভাবি কথা বলবেন না? দেবরকে পাত্তা না দিলে হয়? একটা গান শুনেননি? স্বামী আমার যেমন তেমন দেবর আমার মনের মতন। আপনি সেই দেবরকেই পাত্তা দিচ্ছেন না? এটা কি ঠিক বলুন? কষ্ট পেলাম সুন্দরী ভাবি!”

বিশ্রী গান। অন্বেষার গা গুলিয়ে আসলো। কি জঘন্যতম গান। ছিহ্ঃ! অন্বেষার মনে হলো এবার কিছু বলা দরকার। নতুন বউ বলে কি যা নয় তাই সহ‍্য করবে। এতটাও অবলা সে নয়। প্রতিত্তোরে বলল, “গান রাখুন। আপনি নিশ্চয়ই শুনেছেন হাদিসে বলা হয়েছে, ‘দেবর মৃত্যু সমতূল‍্য!’  আপনার সাথে দুরত্ত বজায় রাখা আমার জন্য অধিকতর উত্তম। আপনার সাথে কথা বলার মত প্রয়োজন আমার নেই। আর এভাবে একটা মেয়ে মানুষের রুমে ঢোকা উচিত হয়নি আপনার। পরবর্তীতে এমন করবেন না। বিষয়টা খেয়াল রাখবেন।”

অপমান সহ‍্য হলো না যুবকের। ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল। অন্বেষার দিকে দুপা এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বলল, “আমাকে ইগনোর করছেন ভাবি? এই সানফ কে? কাজটা ভালো করলেন না। আমার বুড়ো ভাইয়ের মধ্যে কি এমন দেখেছেন শুনি? একেবারে গলাই ঝুলে পড়লেন।”

অন্বেষা কিছু বলার পূর্বেই পেছন থেকে ক্রোধান্বিত গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বলে উঠলো, “কি দেখে ঝুলেছে সেটা কি তোকে বর্ণনা করে বলতে হবে ননসেন্স? কত বড় সাহস নিয়ে আমার রুমে ঢুকেছিস? আবার আমারই বউকে যা নয় তাই বলছিস আমার নামে?” সানাফের মুখ রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। সে দিশেহারা বোধ করছে। ইতিমধ্যে তার বোঝা শেষ বাঘের গুহায় ঢুকে পড়েছে। পরিণতি কি ভয়াবহ হবে সেটাও কিছুটা আন্দাজ করে ফেলেছে। কিন্তু আপাতত কিছু একটা বলে আসন্ন বিপদ কাটাতে হবে। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলার আগেই শক্তপোক্ত হাতের ঘুষিতে মুখ থুবড়ে পড়লো টাইলসের মেঝেতে। সারফারাজের ফর্সা মুখশ্রী ক্রোধে আগুনের শিখার ন‍্যায় ফুটছে। অন্বেষা ভয়ে ঢোক গিলল। সারফারাজ নিজের হাতদুটকে বিরামহীন সানাফকে আঘাতের কাজে ব‍্যবহার করছে। অন্বেষা ভয়ে জড়সড় হয়ে রুমের এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। অন‍্যদিকে সারফারাজের উচু আওয়াজের কথা আর সানাফের আঘাত পাওয়ার ফলে ব‍্যাথায় কুকড়ে ওঠা আওয়াজ রুমের বাইরে ছড়াতে বেশি সময় লাগলো না। কিচেনে রান্নায় ব‍্যস্ত ছিলেন সাওদা বেগম, হাসুর মা আর সারফারাজের ছোট খালা। চেচামেচির উৎস খুজতে তড়িঘড়ি করে সারফারাজের রুমে ঢোকে তারা। এহেন ধ্বংসযজ্ঞ দেখে উপস্থিত সকলেই ভিষন অবাক হয়েছে। সারফারাজের ছোট খালাতো কেঁদেই ফেলেছেন। একমাত্র ছেলেকে বোনের ছেলে এভাবে নির্দয়ের মত মারছে। সাওদা বেগম খানিকক্ষণ ঝিম ধরে থেকে দ্রুত গিয়ে আটকায় সানাফকে ক্রোধান্বিত সারফারাজের হাত থেকে। সারফারাজ তখনও রাগে ফুঁসছিল।

সারফারাজের ছোট খালা কান্নারত কন্ঠে সারফারাজের উদ্দেশ্যে বলল, সারফারাজ! আমার ছেলেটারে এমনে মারতে পারলি? কি এমন ক্ষতি করছিল ও?”

“কি করেছে ওর থেকেই শুনেন। ওসব কথা মুখে আনতেও আমার লজ্জা হয়। এত বড় বেলাজ, বেহায়া কি করে হলো। তাও আবার আমার বাড়িতে আমারই বউয়ের সাথে!”

সাওদা বেগম বললেন, “থামো। এত উত্তেজিত হইয়ো  না। বাড়িতে আমরা বড়রা ছিলাম না? আমাদের বলতে পারতে। তুমি কেন মারতে গেলে?”

“তুমি কি বলতে চাও মা? ও যা নয় তাই বলবে আর আমি বিচারের জন্য অপেক্ষা করবো। ও কে তো আমার….”  সারফারাজ আবারও মরার জন্য ধেয়ে যায়। পাশে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে থাকা অন্বেষা দ্রুত গিয়ে আটকায়। সারফারাজের মত লম্বা, বিশাল দেহের স্বাহ‍্যবান পুরুষকে দূর্বল অন্বেষার পক্ষে আটকে রাখা অসম্ভব প্রায়। তবুও অসম্ভব কে সম্ভব করার জোরদার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে।

দরজার ওপাশে সাইমা, সাইফা আর ওদের কাজিন নিহা দাড়িয়ে। সাইমার চোখে অশ্রুকণা ভর করেছে। যেন যেকোন সময় চিবুক গড়িয়ে পড়বে। সে ভাবতেও পারেনি তার সানাফ ভাইয়ের এমন পরিণতি হবে।

“ছেলেটা হয়তো তোর বউকে মজা করে দুয়েকটা কথা বলে ফেলেছে, তাই জন্য এভাবে মারবি? মায়া দয়া নেই তোর?”

সারফারাজ ছোট খালার প্রশ্নের ব‍াক‍্যের পিঠে প্রতিত্তোরে বলল, “যে যেমন তার সাথে তেমন আচারণ করাই আমার স্বভাব। সেটা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয় খালা? আপনার ছেলে যে অন‍্যায় করেছে তার যথোপযুক্ত শাস্তি ওর প্রাপ‍্য। কিন্তু আমি ওকে প্রাপ‍্য বুঝিয়ে দিতে পারিনি। ছোট থেকে ছেলেটাকে আদরে বাদর না কর শক্ত হাতে লাগাম ধরতেন তাহলে এমন উগ্র আচারণ করার সাহস পেত না। অসাধু লোকের জন্য সারফারাজের মায়া দয়া নেই খালা। আপনার জেনে রাখা উচিত।”  একদমে কথাগুলো বলে থামলো সারফারাজ। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিল। মারামারি করে অনেকটা এনার্জি লস হয়েছে তার। হাপাচ্ছে সারফারাজ।

সারফারাজের ছোট খালার মনঃক্ষুন্ন হলো সারফারাজের কঠোর কথায়। সাথে অপমান বোধটাও প্রবলভাবে ধরা দিল তার মধ্যে। উপস্থিত সাওদা বেগমের উদ্দেশ্য ব‍্যাগ্র কন্ঠে বলল, “বড়’পা আমি এখানে আর এক মুহূর্তও ব‍্যায় করতে চাই না। দুদিনের ছেলের বউয়ের কাছে আমার ছেলেটাকে এভাবে অপদস্ত করলে তোমরা। ছোট মানুষ ভেবে মাফ করা গেল না। এখানে আর এক মুহূর্ত নয়। আমি চলে যাব। ডেকে এনে অপমান না করালেও পারতে। ছেলে তোমার লায়েক হয়েছে যেন। দেখব কেমনে এ ছেলে, ছেলের বউয়ের ভাত রান্না খাও।”

তারপর সানাফ, ” নিহাকে বললেন, “চল তোরা। এখানে আর নয়।”

সানাফ মায়ের সাথে রওনা হলেও নিহা ঠাই দাড়িয়ে রইলো। দৃঢ় কন্ঠে বলল, “তোমরা যাচ্ছো যাও। সারফারাজ ভাইয়ার বিয়ে না খেয়ে কোথাও যাচ্ছি না আমি। বলি, আম্মু! এবার অন্তত বোঝ। কম তো নালিশ আসে না ওর জন্য। রাস্তাঘাটে মুখ দেখাতে পারি না।”

ফুঁসে উঠলেন মহিলা। রাগান্বিত কন্ঠে মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন, “মারবো এক চড় বেয়াদব। থাক তুই। বেয়াদব মেয়ে পেটে ধরেছিলাম।” আর এক মুহূর্ত সময় ব‍্যায় করলেন না তিনি। সদর দরজা পেরোনোর সময় পিছন থেকে সাইফা বলল, “ছোট খালা তেইশ বছরের টগবগে যুবককে কখনও ছোটদের কাতারে ফেলানো যায় না। বেয়াদব নিহা নয় করেছে আপনার গুণধর পুত্র। পারলে তাকে ঠেকান।”

মহিলা প্রতিত্তোরে কিছু বললেন না। গটগট শব্দ তুলে চলে গেলেন বাড়ি ছেড়ে।

সাওদা বেগমের মুখখানা থমথমে হয়ে আছে। তা দেখে সারফারাজের ভয় হলো। এই একজন মহিলা যাকে সারফারাজ খুব মেনে চলেন। যে মুখ ভার করে রাখলে সারফারাজের সবকিছু ধূসর বেরঙিন লাগে। ভীত কন্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল, “তুমি রাগ করেছো মা?”

সাথে সাথে জবাব দিলেন না সাওদা বেগম। কিঞ্চিত সময় পার করে প্রতিত্তোরে বললেন, “একদম ঠিক করেছো বাবা। অন্বেষা আমার মেয়েদের থেকে কম কিছু না। তাকে এ বাড়িতে এসে কেউ অপমান অপদস্ত করবে সেটা আমি বাড়ির কর্তী হয়ে কিভাবে মেনে নিবো? আমার রাগ নেই। হোক সে আমার বোনের ছেলে। কিন্তু অন‍্যায়ের ছাড় নেই। আমার বোনটা যদি বুঝতো সঠিকটা। যাক! সেসব ভেবে কাজ নেই। মনে রেখো দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল অনেক ভালো।”

মায়ের স্বাভাবিক এবং প্রতিবাদমুখর জবাবে সারফারাজ খুব খুশি হলো। অন্বেষাও বেশ অবাকতার সাথে গ্রহণ করেছে।

সাওদা বেগম সবার উদ্দেশ্যে বললেন, “এখানে কি হয়েছে কি হয়নি সব ভুলে যাও। ভাইয়ের হলুদ আজ। সেটাই মনে রেখে কাজ করো। যাও সকলে। আর নিহা মা! তোমার কথায় খুব মুগ্ধ হয়েছি সোনা। আমার বোনটার মেয়েটা অন্তত মানুষের মত মানুষ হয়েছে।”

একে একে সবাই রুম থেকে চলে গিয়েছে। শুধু সারফারাজ, অন্বেষা বাদে।

সালফারাজ তার কোণায় জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে থাকা বউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। দুহাত দিয়ে নত মুখখানা উচিয়ে অপরাধি স্বরে তার উদ্দেশ্যে বলল, “খুব সরি বউ। সময় মতো তোমার পাশে থাকতে পারিনি। তোমার কি আপত্তি আছে বুড়ো বরটার সাথে থাকতে?”

অন্বেষা প্রতিত্তোরে কিছু না বলে একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়লো প্রিয় মানুষটার বক্ষে। কান্নারত কন্ঠে বলল, “বুড়ো হন বা যোয়ান। সেটা বড় কথা না। আমার যে আপনাকেই লাগবে। একমাত্র আপনাকে। সুদর্শন বলিষ্ট দেহী যুবককে মানুষ কোন চোখ দিয়ে বুড়ো বলে শুনি?”

সারফারাজ সন্তুষ্ট হলো অন্বেষার কথায়। বলল, “হিংসার চোখ দিয়ে। বুঝলে অন্বেষা!”

হাতদুটো দ্বারা শক্ত করে আকড়ে ধরলো বক্ষে লেপ্টে থাকা অন্বেষাকে। এখন কিছুটা শান্তি শান্তি লাগছে তার।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (০৭)

________________

রাতের আঁধার কে’টে ধরণীতে এবার ঝকঝকে দিনের  সূচনা। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ। আঁধার কে’টে যেমন নব‍্য দিনের সূচনা হয়েছে তেমনি গতদিনের কলুষিত ঘটনা অতীতের পাতায় তালাবদ্ধ করে  পুরো পরিবার সারফারাজ-অন্বেষার বিয়ের আনন্দে মেতে উঠেছে। তবে এত সবের মাঝেও সাইমার ভাব ভঙ্গি ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। সে মাঝেমধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ভাইয়ের বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানে সামিল হচ্ছে কখনও আবার মন খারাপের বিষাদের মেঘ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। ফলস্বরুপ মন খারাপ করে থাকছে।

গতকাল হলুদের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত আত্মীয়ের অনেকে থাকলেও সাওদা বেগমের ছোট বোন এবং ছেলে না থাকাই এ নিয়ে অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। অনুষ্ঠানে কোথাও যেন ভাটা পড়েছিল। সবটাই সারফারাজের নজরে আসলেও সে নিরুপায়। কিইবা করার থাকতে পারে! সে ইচ্ছে করে তো আর এমনটা করেনি। কাল যদি সানাফকে  শাসন না করতো হয়তো পরবর্তীতে অন‍্যায়ের আরও কয়েক ধাপ বাড়তো সানাফের দ্বারা। তাছাড়া শুধু সারফারাজ কেন, অন‍্য যেকোনো পুরুষ হলেও একই কাজ করতো। এটা ঠিক সারফারাজ অতিরিক্ত রাগী। সেক্ষেত্রে সানাফেরও বুঝে চলা উচিত ছিল।

আজ বিয়ে অর্থাৎ ছোট্ট করে রিসেপশন পার্টি দিবে। কারণ বিয়ে তো সেদিন হয়েই গিয়েছে। যেভাবেই হোক বিয়ে তো হয়েছে।

বেবি পিংক রঙের গাউন অন্বেষার আজকের ড্রেস। আর সারফারাজের জন্য একই রঙের পাঞ্জাবি। সে শেরওয়ানি পড়ে না।

আত্মীয়স্বজনের পদচারণায় বাড়ি মুখরিত। বাড়ির সবাই সবার কাজে ব‍্যস্ত। কেউ মেহমান আপ‍্যায়নে ব‍্যস্ত কেউ বা খাবারের দিকগুলো সামলাতে ব‍্যস্ত। কেউ নিজ কর্মে ব‍্যস্ত। যেমন হয় আরকি!

রুমে চুপটি করে গোল হয়ে বসে আছে অন্বেষা। তার সাজ সম্পন্ন। মাঝেমাঝে আত্মীয়েরা কেউ কেউ এসে দেখে যাচ্ছে। এই আত্মীয়দের মধ্যে আবার দুভাগ আছে। কেউ অন্বেষার প্রশংসায় পঞ্চমুখ কেউবা অন্বেষার চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ফলস্বরুপ দুয়েকটা কটু বাক‍্য বলে যেতে ভুলছে না। সকাল থেকে অন্বেষাকে সারফারাজের থেকে আড়ালে রেখেছে মেয়েগুলো। আজ এখন দুপুর বেজে আড়াইটা। সারফারাজ তার শুভ্রময়ীকে এখানো এক পলক দেখেনি। মাঝেমধ্যে তৃষ্ণার্ত কা’কের মত রুমের আশপাশ দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরের অন্বেষাকে সে বরাবরই দেখতে ব‍্যার্থ হচ্ছে। এ অন‍্যায় কি মানা যায়? সারফারাজ না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে এহেন অন‍্যায় অবিচার সইতে।

“কি হইছে বাপ? তুমি এমনে রুমের বাইরে দাড়ায় উকিঝুকি দিতাছো কেন? রুমের মধ্যে যাও। দেহগে মা জননীরে কেমনে কইরা সাজাইছে আম্মারা মিলে।”  হাসুর মায়ের কথায় সারফারাজের মুখ ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে যায়। সর্তক দৃষ্টিতে চারপাশ ভালো করে অবলোকন করলো সে। আশেপাশে তার কথা মনযোগ দিয়ে শোনার মত মানুষের বড় অভাব। সে হাসুর মায়ের কথার প্রতিত্তোরে অসহায় কন্ঠে বলল, “খালা আমি এমনি দাড়িয়ে আছি। কোন সমস্যা নেই তো। আপনি দুপুরে খেয়েছেন তো?”

আলতো হাসলো হাসুর মা। অনুষ্ঠান বাড়ির এত মানুষ, ব‍্যস্ততার ভিরেও ছেলেটা তার খোঁজ খবর নিতে সামান্য ভুলেনি। কৃতজ্ঞতায় চোখ ফে’টে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু সারফারাজের কঠোর নিষেধাজ্ঞা এভাবে যখন তখন কাঁদা যাবে না। তার সামনে সর্বদা হাসিখুশি মুখে থাকতে হবে। হাসুর মা তার বাপজানের সুন্দর মিষ্টি আদেশ কি করে অমান্য করে! প্রতিত্তোরে বলল, “কি যে বল না বাপজান! এত কাম কাজ রাইখা কেমনে খাই বল তো! আফায় কইছে মেহমানদের খাওয়া হয়ে গেলে বাড়ির সবাই খেয়ে নিবে। আমিও তোমাগো লগে খামু। আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা কইরো না তো। তুমি কোন কাজে এইহানে আইছিলা? আমারে কও আমি কইরা দিতেছি।”

“না খালা। আমি আসলে এখানে….”

“তুমি এত দ্বিধাবোধ করো না তো বাপ। বলো কি হইছে?”

“আসলে খালা হয়েছে কি, সকাল থেকে এ পর্যন্ত অন্বেষাকে একবারও দেখিনি আমি। ওরা আমাকে ডুকতেই দিচ্ছেনা রুমে। তাই তো বারবার ব‍্যার্থ চেষ্টা করছি রুমে ঢুকতে।”  সারফারাজের খুব ইচ্ছে হলো একদমে কথাগুলো হাসুর মাকে বলতে। কিন্তু লাজুক সারফারাজ তা মন অব্দি রেখে দিল। শব্দ হয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো না। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল, “খালা, আমার রুমে কিছু দরকার ছিল। কিন্তু মেয়েরা আছে বিধায় ঢুকছি না। তুমি কি একটু দেখবে?”

“আইচ্ছা খাড়াও। দেখতাছি।”

হাসুর মা এক মুহূর্ত সময় ব‍্যায় না করে দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে পড়লো। অন্বেষার আশেপাশে আবিষ্কার করলো কতগুলো অল্প বয়সী মেয়ে মানুষ। হাসুর মা তাদের উদ্দেশ্য বললেন, “মাইয়ারা তোমরা খাইতে যাও। ওদিকে তোমাগো ডাকতাছে।”

ওদের মধ্যে একজন বলে উঠলো, “কিন্তু খালা! আমরা সবাই গেলে নতুন ভাবির কাছে কে থাকবে?”

“তোমরা যাও। আমি থাকমুনে। মা জননীর কাছে থাকবানি আমি। যাও, যাও!”

হাসুর মায়ের ভরসা বাক‍্যে আস্থা রেখে তারা একে একে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুমে রইল শুধু দুটো প্রাণি। হাসুর মা দরজার একপাশে একপ্রকার লুকিয়ে থাকা সারফারাজকে অভয় গলাই বললেন, “যাও বাপজান রুমে যাও। কেউ নাই এহন।”

সারফারাজ কৃতজ্ঞতার স্বরে বলল, “অনেক অনেক ধন্যবাদ খালা। আমি তাহলে রুমে যাচ্ছি। একটু দেখবেন কেউ যেন হুট করে চলে না আসে।”

“আইচ্ছা।”

রুমে ঢুকতেই সারফারাজের চক্ষুদ্বয় আটকে গেল বিছানায় বসা এক অতীব সুন্দর লাস‍্যময়ী রমনীর রূপে। মেয়ে তো নয় যেন হৃদয়হরণী। সারফারাজ বিড়বিড়িয়ে বলল, “মা শা আল্লাহ্! মা শা আল্লাহ্।”

সারফারাজকে দেখে অন্বেষা সামান্য অবাক হলেও অবাকতার রেশ কাটিয়ে মুচকি হাসলো। সারফারাজ আহত সৈনিকের ন‍্যায় বুকে হাত দিয়ে মোহনীয় স্বরে বলল, “ওহে শুভ্রময়ী ওভাবে হেসো না। আমার হৃদয় যে করেছো হরণ। এখন আমার কি হবে শুভ্রময়ী?”

সারফারাজের কথা বলার অদ্ভুত ভঙ্গিমায় মুখে হাত চে’পে শব্দ করে হেসে ওঠে অন্বেষা। সারফারাজের কানে সে হাসির শব্দ সুমধুর পাখির কুজনের মত লাগলো। অন্বেষার পাশে গিয়ে বসলো সে। জীবনে বহু মেয়ে মানুষের সাক্ষাৎ হয়েছে তার সাথে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির পার্ট ছাড়িয়ে এখন একজন সফল  মধ‍্যমান ব‍্যবসায়ী সে। কর্মের সূত্রে এখন আরও বেশি মেয়ে মানুষের সান্নিধ্য থাকা লাগে তার। কই কখনও তো এমন অনুভব হয়নি তার। কম সুন্দর মেয়ে মানুষ দেখেনি সে। কিন্তু এমন নেশালো লাগেনি তো আগে। অন্বেষা নামক মেয়েটির আশেপাশে থাকলেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। তার চোখে মেয়েটাকে অনিন্দ সুন্দরী লাগে। সে জানে না মেয়েটা কত সুন্দর। শুধু জানে তার চোখে সবচেয়ে সুন্দরী রমনী হচ্ছে অন্বেষা। যার চোখ ধাঁধানো রূপে জ্ব’লে পু’ড়ে ঝ’ল’সে যায় সে।

“কেমন লাগছে আমায়?” লাজুক স্বরে সারফারাজের উদ্দেশ্য প্রশ্ন বাক‍্য ছুড়ে দিল অন্বেষা।

প্রতিত্তোরে সারফারাজ পূর্বের ন‍্যায় মোহনীয় স্বরে বলল, “বললে বিশ্বাস করবে?”

সারফারাজের প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা অন্বেষার কাছে অন‍্যরকম লাগলো। সে প্রতিত্তোরে কিছুই বলল না। নিরব রইলো। সে ভেবেছে তাকে দেখতে হয়তো খুবই বা’জে লাগছে। নতুবা খুব হাস‍্যকর লাগছে।

সারফারাজ অন্বেষার মিইয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে শব্দ করে হেসে উঠলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “মেয়ে তুমি কি অবুঝ? সব কথা মুখে বলে বোঝানো লাগবে? আমার চোখমুখ দেখে কিছু বুঝতে পারো না? তোমার রূপে প্রতিনিয়ত এই নিষ্পাপ আমি ঝলসে যাচ্ছি তার কি প্রতিকার হবে শুনি? কি অদ্ভুত  তাই না! প্রণয় হাওয়ার এক ধাপে থাকে যেমন সুখময় শান্ত শীতল হাওয়া। ঠিক তেমনি অন‍্য প্রান্তে থাকে শুধুই হৃদয় পুড়ানো অনুভূতি। যা শুধু প্রণয়ের হাওয়া যে মানুষটার মনে লাগে সে ব‍্যতীত অন‍্য কেউ সামান্য বুঝতে পারে না। তুমি কি বোঝ?”

“স্বর্গীয় সুধা পান করতে হলে অনলে সামান্য পুড়তে হবে এতো অতি স্বাভাবিক বটে। কাউকে ভালোবাসলে বিচ্ছেদের মরন সম যন্ত্রণা সহ‍্য করার ক্ষমতা নিয়েই বাসা উচিত। যেখানে সুখ সেখানেই দুঃখ। আপনার আমার সন্ধি থাকুক আজীবন। নশ্বর দুনিয়া পেড়িয়ে চিরস্থায়ী জান্নাতে পর্যন্ত অটুট থাকুক এ বন্ধন। যেখানে না থাকবে দুঃখ আর না থাকবে কোন কষ্ট। শুধুই শান্তি।”

“ইন শা আল্লাহ্। আল্লাহ্ আমাদের কবুল করুন।”

“সুম্মা আমিন।”

সারফারাজ হাতঘড়ি চেইক করলো। আধ ঘন্টা হয়েছে সে রুমে অবস্থান করেছে। এখন সময় এসেছে বেরিয়ে যাওয়ার। না হলে বিচ্ছুগুলো চোখে পড়লে মান সম্মানের কুরবানি হতে একটুও বাকি থাকবে না। অন্বেষার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে সারফারাজ উঠে দাড়ালো। যেতে যেতে বলল, “শোন শুভ্রময়ী! অনেক কষ্টে সব সামলে রেখেছি। আজ অশান্ত আমিকে তোমাকেই শান্ত করতে হবে। মনে রেখো।”

“ভয় দিচ্ছেন?”

“ভয় কেন হবে মেয়ে? শুধু সংকেত দিয়ে যাচ্ছি। তৈরি থেকো। যায় তবে!”

“আল্লাহ্ হাফেজ।”

দরজায় সাওদা বেগম দাড়িয়ে। মাকে দেখে সারফারাজ খানিকক্ষণ থম মে’রে দাড়িয়ে রইলো। সাওদা বেগম প্রথমে নিজেই বললেন, “তোকেই খুজছিলাম। মোটামুটি সবার খাওয়া শেষ। কেউ চলে যাচ্ছে কেউ বিশ্রাম করছে। বেলা তিনটার ঘরে।   খাওয়া হলো না কারো। খেতে হবে তো নাকি! তুই ওদিকটায় যা। সব দেখ। আমি অনুকে নিয়ে আসছি।”

মায়ের বলা প্রত‍্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনলো সারফারাজ এবং বুঝলোও। কিন্তু শেষের কথাটা বোধগম্য হলো না তার। মায়ের উদ্দেশ্য শুধালো, “অনু কে মা?”

“দেখো ছেলের কান্ড এটুকু বুঝলি না? অন্বেষাকে অনু বলে ডাকা শুধু করেছি আমি। অন্বেষা বড় লাগে। ছোট করে অনু দিয়েছি ভালো হয়েছে না? আর শোন, অন্বেষা থেকে অনু ডেকেছি সে নিয়েও মেয়ে একঘর কেঁ’দে ভাসিয়েছে। ওর মা নাকি ওকে অনু বলে ডাকতো। আমি কি ওর মা না? তবেই থেমেছে বোকা মেয়েটা।”

মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় মায়ের হাসিমুখে বলা প্রতিটা কথা শুনলো সারফারাজ। শেষে বলল,  “খুব ভালো হয়েছে মা। এভাবেই থেকে যেও মেয়েটার মা হয়ে। আমি যাচ্ছি মা। তুমি তোমার অনুকে নিয়ে আসো।”

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (০৮)

________________

নববধূ তার প্রিয় দর্শণের জন্য নিজেকে প্রণয়ের রঙে রাঙিয়ে বাসর ঘরে অপেক্ষা করছে। এ অপেক্ষার যেন শেষ নেই। এক অতীব সুন্দরী রমনী তার প্রণয় পুরুষের জন্য নিজেকে লাস‍্যময়ী রূপে সাজিয়ে তার আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে অথচ সেই মানুষটারই কোন খবর নেই। অন্বেষার ধৈর্যের বাধ এবার যেন ভাঙলো। পড়নে ফিনফিনে পাতলা জামদানি শাড়ি। গলায়, হাতে, কানে হালকা জুয়েলারি। পাতলা শাড়িতে শরীরের কিছু অংশ দৃশ্যমান হলেও এমন সাজে অন্বেষাকে চোখ ধাঁধানো সুন্দর লাগছে। তার দিকে তাকালেই যেন অপর মানুষটির চোখ ঝলসে যাবে। আহা! কি তার সৌন্দর্য। বিশ্রামহীন একটা দিন গিয়েছে। শরীর ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে। চোখে ঘুমেরা এসে হানা দিচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে এসে ঘুমেরা অন্বেষাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে যাবে তাদের ঘুমের রাজ‍্যে। কিন্তু অটল অন্বেষা, সে ঘুমাবে না। তার স্বামী সাহেব না আসা পর্যন্ত তার অপেক্ষায় কাটিয়ে দিবে সে।

এশার নামাজের পরে সবাই যখন রাতে খাবার খেতে ডাইনিংয়ে জড়ো হয়েছে ঠিক সেই সময় শোরুম থেকে সারফারাজের ফোন আসে। জরুরি ডাক পড়াই তখনই বেরিয়ে পড়তে হয়েছে শোরুমের উদ্দেশ্যে। বিয়ের যাবতীয় ঝামেলা, ব‍্যস্ততার জন্য দোকানগুলোর দিকে সারফারাজ সেভাবে নজর দিতে পারেনি। যার দরুণ ফোন পাওয়া মাত্রই তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়েছে পরিবারের বারণ একপ্রকার অগ্রাহ্য করে। অন্বেষা নিরবে, নিশ্চুপে সবটা শুধু দেখে গিয়েছে। কিছু বলার নেই এখানে।

অন্বেষা বিছানা থেকে নেমে ছোট ছোট কদমে রুমময় পায়চারি করছে। ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। সময় এগারোটা বেজে পাঁচ চল্লিশ মিনিট। প্রায় তিন ঘন্টা সারফারাজ বাইরে অবস্থান  করছে বাড়ি থেকে। সবকিছু এক পাশে রেখে অন্বেষার এবার সারফারাজের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। এ বাড়িতে আসার পর সারফারাজ এত রাত পর্যন্ত কখনও বাইরে থাকে না। আজই প্রথম। লো ভলিউমে যান্ত্রিক পাখা চলছে। রাতের আবহওয়া বেশ শান্ত ও শীতল। মাঝেমধ্যে বেলকণির গ্রিল গলিয়ে ফুরফুরে ঠান্ডা বাতাস রুমে আসছে। অথচ অন্বেষার শরীরে মৃদু ঘাম জমেছে। অন্বেষার মনে ভয় দানা বাধছে। মনে মনে বলছে, “কেমন মানুষ তিনি! নতুন বউ, বাসর ঘর রেখে কেউ কখনও এত রাত অব্দি বাইরে থাকে! কান্ডজ্ঞানহীন এক মানব!”

হঠাৎ দরজায় কড়াঘাতের শব্দ হলো। অন্বেষা পায়চারি বন্ধ করে স্থীর হয়ে দাড়ালো। আবারও কড়াঘাতের শব্দ। অন্বেষার চোখে মুখে স্পষ্ট লজ্জা ফুটে উঠেছে। লাজুক হেসে দ্রুতগতিতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। ওপাশে হাসুর মা দাড়িয়ে। অন্বেষা যেন আরেকটু লজ্জা পেল। কি ভেবেছিল আর কি হলো।

”মা জননী! বাপজান কি আহে নাই?”

“জি না, খালা। তিনি আসেননি এখনো।”

“ওহ্। চিন্তা কইরো না। তাইলে সে কামে আইটকা পড়ছে। তুমি কি ঘুমাই গেছিলা? বিরক্ত করলাম মা!”

“না খালা। কি যে বলেন। বিরক্তি কিসের। এখনো ঘুমাইনি আমি। আপনি ঘুমাননি যে!”

“আমি রাইতের খাওন খাইয়া  ঘুমাই গেছিলাম। রুমে পানি আছিলো না। পরে দেখি তোমাদের রুমে বাতি জ্বলতাছে। আন্দাজ করছি বাপজান আসে নাই। দেহো, আমার আন্দাজ ঠিক হইল।”

“ওহ্ আচ্ছা। খালা আপনার যদি সমস্যা না থাকে আসেন ভেতরে। একটু গল্প করি।”

“তুমি কফি খাবা বউ?”

নাহ্ থাক। এত রাতে আপনার কষ্ট করতে হবে না। এমনি আসেন। গল্প করি।”

“কিয়ের কষ্ট বউ! যাবো আর আসব। তুমি এট্টু থাহো।”

“তাহলে আপনার জন্যও আনবেন। ঠিক আছে?”

হাসুর মা ইতস্তত করে বলল, “কি যে বল না। তোমার জন্য আনমুনে।”

অন্বেষা দৃঢ় কন্ঠে বলল, “একদমি না। একসাথে দুজনে পান করবো। দুজনেরটা নিয়ে আসবেন। ঠিক আছে?”

হাসুর মার চোখ মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে। এমন প্রস্তাবে সে খুব একটা অখুশি হয়নি। তার চোখ মুখ দেখেই তা ভালো বোঝা যাচ্ছে। মাথা নাড়িয়ে জানালো ‘আইচ্ছা।’

অন্বেষা রুমে গিয়ে হালকা পাওয়ারের বাতি অফ করে সাদা আলোর ঝকঝকে বাতি অন করলো। সামনের দর্পণে নিজেকে এক অন‍্যরকম অন্বেষায় আবিষ্কার করলো। কি পাতলা শাড়ি। অন্বেষার খুব লজ্জা লাগছে। সে তাড়াতাড়ি একটা বড়সড় নামাজের হিজাবে নিজেকে মুড়িয়ে নিল। হাসুর মায়ের সামনে নিশ্চয়ই এমন সাজে সে যেতে পারে না। এ সাজ শুধু সুন্দরী রমনীর একান্ত মানুষটার জন্য।

কিছু সময় পর ধোঁয়া ওঠা দুকাপ গরম কফি নিয়ে রুমে ঢুকে হাসুর মা। অন্বেষা মুচকি হেসে এককাপ নিল আরেক কাপ হাসুর মা নিল। কথোপকথনের এক পর্যায়ে অন্বেষা হাসুর মার উদ্দেশ্যে বলল, “খালা! তিনি কি আজই এত রাত অব্দি বাইরে নাকি আগেও এমন হয়েছে?”

হাসুর মা মনোযোগ নিয়ে কফি পান করছিল। অন্বেষার প্রশ্ন বাক‍্যের পিঠে প্রতিত্তোরে বলল, “না, আগেও এমন রাইত হয়ছে। মাঝেমধ্যে দোকানপাটের হিসাবে গড়মিল হইলে এমন রাইত হয়। ঢাকার শহরে এ আর কি এমন রাইত। দেহ গে রাস্তায় এহনো কতশত কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা। তুমি চিন্তা করো না। আইয়া পড়বো।”  বলেই  আবারও কফি পানে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লেন হাসুর মা।

অন্বেষা এ পরিবারের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। না জানারই কথা। হাসুর মায়ের কথা অবাক হয়ে শুনলো। অন্বেষার হঠাৎই মনে হলো এই ফাঁকে হাসুর মার থেকে কিছু কথা জেনে নেওয়াই যায়। গল্পের ছলে অজানা কথা জানা হলো। এ পরিবারের কার কি পছন্দ, অপছন্দ সে সম্পর্কে অবগত হতে পারবে। হাসুর মার উদ্দেশ্যে আগ্রহ নিয়ে শুধালো, “খালা! ওনার কিসের শোরুম?”

“ও মা! তুমি জানো না বউ? বাপজানের তো একখান মোবাইলের শোরুম আরেকটা বেডাগো জামাকাপড়  দোকান বড় মার্কেটে। তই তোমার শশুরের আরেকখান দোকান আছে। ওনিও আগে ব‍্যবসা করতেন। পাঞ্জাবির দোকান। এখনো আছে। সেইডা তোমার শাশুড়ির নামে চলে। সারফারাজ দেখাশোনা করে রাখে।”

অন্বেষা খেয়াল করলো হাসুর মা অতিরিক্ত কথা বলে। প্রশ্নের যতটুকু উত্তর দেওেয়া প্রয়োজন সে তার থেকেও কয়েকগুন বাড়িয়ে বলে। যেমন সৃজনশীল প্রশ্নের ক. দাগের এক মার্কের উত্তর সে ঘ. দাগের চার মার্কের উত্তরের মত বৃহৎ আকারে দেয়। ব‍্যাপারটা পরিক্ষার সময় হলে বোকামি আর সময় অপচয় ছাড়া কিছুই হতো না। কিন্তু অন্বেষার ভালোই উপকার হলো। এক প্রশ্নে আরও চার প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে সবটা শুনলো অন্বেষা। তারপর ছোট্ট করে বলল, “ওহ্ আচ্ছা।” আপাতত তার এ সম্পর্কে জানার মত কিছুই নেই। চুপ থাকাই শ্রেয় এটাই মনে করলো অন্বেষা। অন‍্যদিকে আবার সে বাড়াবাড়ি রকমের ইন্ট্রোর্ভাট। এতটা ছিল না অবশ‍্য। কিন্তু তার বিভীষিকাময় অতীত হতে বাধ্য করেছে। এত কিছুর মাঝেও অন্বেষার অতীত তার মস্তিষ্ক থেকে কখনও যায় না। কি করে যাবে! অতীত ভুলা কি এতই সহজ।

হাসুর মা যেন বহুদিন পর কথা বলার মত মানুষ পেল। এ বাড়ির প্রতিটা মানুষ খুবই ভালো। কিন্তু এত কথা কখনও বলার সাহস হয় না তার। অন্বেষা মনোযোগী শ্রোতার ন‍্যায় শুনছে সব। সে নিজেও হাসুর মার উদ্দেশ্যে বলল, “খালা, আপনার নিজের পরিবার নেই? সংসার স্বামী, সন্তান তারা কোথায়?”

হাসুর মা সাথে সাথে জবাব দিল না। এদিকে অন্বেষা খুব খারাপ লাগছে। হয়তো সরাসরি এভাবে প্রশ্ন না করলেও হতো। না জানি মানুষটা কষ্ট পেয়েছে কিনা! হাসুর মার নিরাবতা লক্ষ্য করে অন্বেষা পূনরায় বলল, “দুঃখিত খালা। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আমি বুঝতে পারিনি আমার কথায় কষ্ট পাবেন। দুঃখিত খালা।”

হাসুর মা নিরাবতার অবসান ঘটিয়ে বলল, “না গো বউ সেরকম কিছু না। আমার সংসার আছিলো। নিজের সংসার। কিন্তু বেশিদিন টিক নাই। পর পর দুইডা পোলা হইছিল বেশিদিন দুনিয়ার আলো বাতাস সহ‍্য হয় নাই তাগো। আল্লাহ্ উডায় নিছে। তারপর সে একদিন আরেকটা বিয়া কইরা হাজির হইলো। ব‍্যাস! আমার সংসারের ইতি ঘটলো তহন থেকেই। বাপের ভিটেই জায়গা হয় নাই। তোমার মত আমারো সৎ মা ছিল। মাইরা খ‍্যাদায় দিছে বাড়ি থেকে। আল্লাহর অশেষ রহমতে জায়গা হলো এ বাড়িতে। এ বাড়িতে যখন আসি সারফারাজের বয়স পনেরো থেকে ষোলো হবে। সাইমা সাইফা বেশ ছোট। আমার হাতেই মানুষ দুডো।”

কথার ইতি টেনে চোখের কোণে জায়গা নেওয়া পানিটুকু শাড়ির আঁচল দিয়ে মুচে নিল। হাসুর মার প্রতিটা কথায় ছিল গাঢ় বিষাদের ছোঁয়া।

অন্বেষার খুব খারাপ লাগলো। কয়টা দিনে মানুষটাকে হাসুখুশি রূপেই দেখে এসেছে সে। তার মধ্যে  এত কষ্ট লুকিয়ে আছে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি অন্বেষা। পৃথিবীর সবথেকে দুঃখি মানুষগুলোই বোধহয় অন‍্যের সামনে নিজেকে সুখি হাসিখুশি রাখার মারাত্মক সুন্দর নিখুঁত অভিনয়টা করতে পারে। কেউ কেউ হয়তো সফল হয়। যেমন : হাসুর মা।

হাসুর মা নিজেই আবার বলল, “বড় পোলাডা মাস খানিক বাঁইচা ছিল। নাম ছিল হাসেম। সেই থেকে ভাবিরা ‘হাসুর মা’  বলে ডাকতো। বিয়া শাদী আর করা হয় নাই। কে করবো? ততদিনে বেডা মানুষের ম‍্যালা রূপ আমি দেইখা ফেলছি। বেডার ঘর করবো না। এইতো এ বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে আছি। কাম কাজে সাহায্য করি। দিব‍্যি আছি গো বউ। সবই আল্লাহর রহমত।”  মুখের এক টুকরো হাসি ফুটিয়ে তুলল হাসুর মা। আরেক অভিনয় মানুষটার।

অন্বেষা সৃষ্টি কর্তার নিকট কোটি কোটি শুকরিয়া জানাতে ভুলল না। তার জীবনে সারফারাজ নামক মানুষটা না আসলে কতটা নির্মম হতো ভাবতেই অন্বেষা শরীর কেঁপে ওঠে। হাসুর মার উদ্দেশ্য আহত স্বরে বলল, “দুঃখ কষ্ট সব অতীতের পাতায় তালাবদ্ধ করে রেখে দেন। এইযে আমরা আছি। আমরাই তো আপনার সংসার পরিবার। তাই নয় কি?”

“হ আম্মা। তাই তো।”

“তাহলে আর দুঃখ কিসের? কখনও কষ্ট লাগলে, দুঃখ লাগলে এই অন্বেষাকে বলবেন। আমি আপনার কষ্ট সবথেকে ভালো বুঝবো। মেয়ে হিসাবে এই এতিমকে মেনে নিবেন তো খালা?”

হাসুর মা তাৎক্ষণিক জবাব দিতে পারলো না। চোখ দুটো দিয়ে ঝর্ণার পানির মত অভিস্রোতে পানি পড়ছে তার। অথচ মুখে এক টুকরো প্রাপ্তির হাসি। খপ করে অন্বেষার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিল হাসুর মা। মমতা ভরা কন্ঠে বলল, “মাগো,    জীবনের সবচেয়ে দামি কথাটা শুনালে তুমি। অবশ্যই আমার মাইয়া তুমি। তোমার মত মাইয়ার মা হইতে কিসের আপত্তি থাকবে কও দেহি!”

রুমের দরজা খোলা পেয়ে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো সাইমা, সাইফা। চেহারাই কেমন আতঙ্কিত ভাব। অন্বেষা, হাসুর মা ওদের দেখে স্বাভাবিক হলো। সাইফা ভীত কন্ঠে গড়গড়িয়ে বলে উঠলো, “মিষ্টি ভাবি! ভাইয়া আজ রাতে ফিরতে পারবে না। ভাইয়া বাড়ি ফেরার পথে ওনার গাড়িতে বাচ্চা এক ছেলের এক্সিডেন্ড হয়েছে। এই নিয়েই হাসপাতাল থেকে থানায় দৌড়াদৌড়ি করা লাগছে ভাইয়ার। চিন্তাই থাকব ভেবে একটু আগেই ফোনে জানিয়েছে আমাকে। আমার মনে হলো এতবড় ঘটনা তোমাকে না জানালেই নয়। মাকে কিছু বলিনি। এমনিতেই তিনি প্রেশারের মানুষ।”

অন্বেষার বুকটা কেমন ধ্বক করে উঠলো। খুব মন চাইছে গগনবিদারী কান্নায় লুটিয়ে পড়তে। চোখ অশ্রুতে ছলছল করে উঠলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে সাইফার উদ্দেশ্যে বলল, “বাচ্চাটা কি অবস্থা? খুব কি খারাপ? আর ওনি ঠিক আছে তো!”

“বাচ্চাটার অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। ভাইয়া ঠিক আছে। নিজের কথা কিছুই বলেনি। আল্লাহকে ডাকো। ভাইয়া সকালে আসতে পারবে। ওদিকে ঝামেলা বেধেছে। বুঝোই তো বাংলাদেশের পাবলিক। দোষ কার এটা দেখবে না। কিন্তু গন্ডগোল পাকাতে ওস্তাদ। অন‍্যদিকে সাইমা কেঁদেয় চলেছে। সে বড্ড ইমোশনাল। কিন্তু সাইফা বেশ শক্ত। যেকোনো বিপদে সারফারাজের অনুপস্থিতিতে তাকেই সবাইকে সামলাতে হয়। সাইফার কথা শেষ হতে না হতেই জ্ঞানশূণ‍্য হয়ে লুটিয়ে পড়লো বিছানায় অন্বেষা। রুমের বাকি তিনটি প্রাণি আঁতকে উঠলো এ দৃশ্যে। সাইমার কান্নার পরিমাণ আরও বাড়লো। অন‍্যদিকে হাসুর মাও গুনগুনিয়ে কাঁদছেন।

“কান্না থামাও তোমরা। এভাবে কাঁদলে হবে? ভাবিকে ধরো। জ্ঞান ফেরাতে হবে তো! আমরা একসাথে তাহাজ্জুতের নামাজে ভাইয়া এবং বাচ্চাটার সুস্থতা ভিক্ষা চাইবো আল্লাহর কাছে। আব্বু তো নেই। নিয়ে গেছেন আল্লাহ্। আমার ভাইটার যেন কিছু না করেন। এটাই চাওয়া।”  শক্ত মনের অধিকারী সাইফাও কেঁদে ফেলল। আনন্দ পূর্ণ বাড়িতে শোকের ছায়া নামতে বেশিক্ষণ লাগলো না।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (০৯)

________________

ভোর রাতে সারফারাজ বাড়িতে পৌছায়। কপালে ছোট্ট ব‍্যান্ডেজ। সারারাত ঘুম হয়নি। চোখে মুখে ক্লান্তি ও নিদ্রাহীনতার স্পষ্ট ছাপ। নিজের কাছে বাড়ির এক্সট্রা চাবি দিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। কাল থেকে বাড়িতে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সারাফারাজের দোকানের বাধ‍্যগত কর্মচারী ছেলেটা সাথে সাথেই ছিল। সারফারাজকে বাড়িতে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসতে চাইছিল। কিন্তু সারফারাজ কড়া কন্ঠে বলে দিয়েছে ‘আর এক মুহূর্ত নয়। সোজা বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিবে। সাথে একটা দিনের ছুটি, কিছু টাকা  বকশিষ।’

রুমে ঢুকে সর্বপ্রথম সারফারাজের নজরে আসলো জায়নামাজে ঘুমন্ত অন্বেষাকে। জায়নামাজের সল্প জায়গার মধ্যে কোনরকম শুয়ে আছে। সারফারাজ তা দেখে মৃদু হাসলো। এগিয়ে গিয়ে জায়নামাজ থেকে অন্বেষাকে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিয়ে গায়ে পাতলা কম্বল টেনে দিল। কপালে ভালোবাসার ছোট্ট পরশ একে দিতে ভুলল না মোটেও সারফারাজ। আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। উদ্দেশ্যে ফ্রেশ হওয়ার।

সর্বপ্রথম মায়ের সাথে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো সারফারাজ। মা নিশ্চয়ই গতকালের খবর শুনে অস্থির হয়ে আছে। এক পলক ঘুমন্ত অন্বেষার দিকে চাইলো সারফারাজ। তার শুভ্রময়ী এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। সারফারাজ আর সময় ব‍্যায় না করে মায়ের রুমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

সাওদা বেগম জায়নামাজে বসে কোরআন তেলওয়াত করছিলেন। সারফারাজের আগমনে তিনি কোরআন পড়া স্থগিত রেখে জায়নামাজ থেকে উঠে দাড়ালেন। কোরআন ও জায়নামাজ রাখার ছোট্ট সেলফে সেগুলো গুছিয়ে রেখে এগিয়ে গেলেন ছেলের দিকে। সারফারাজ মাকে দেখে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্, মা।”

সাওদা বেগম সালামের জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।”

তারপর ব‍্যাকুল স্বরে শুধালেন, “কি হয়েছিল বাবা? মেয়েগুলো বলতেই চাই না। কত অনুরোধের পর তোমার এহেন বিপদের সংবাদ জানালো আমাকে।”

“শান্ত হও মা। এতটা চিন্তার কিছু হয়নি। তবে হয়েছে অনেক কিছুই। জীবনে প্রথমবার এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি আমি।”

সাওদা বেগম শান্ত হওয়ার পরিবর্তে আরও অশান্ত হয়ে উঠলেন। সারফারাজের কপালের ক্ষতের ছোট্ট ব‍্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিলেন। ঝরঝরিয়ে কেঁদে ভাসালেন সাওদা বেগম। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন, “কি চিন্তাই ছিলাম বোঝাতে পারবো না বাবা। তোর বাবা থাকলে এদিন দেখা লাগতো না আমাদের। চিন্তাই ছটফট করেছি। শোনা মাত্রই অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। কখন তুই সুস্থ শরীরে আমার কাছে ফিরে আসবি। তা বাবা! সেই ছেলেটা সুস্থ হয়েছে তো?”

“গুরুতর আহত হয়নি। তবে অনেকটা রক্ত পড়েছিল। আল্লাহ সহায় ছিলেন। আমার রক্তের গ্রুপের সাথে বাচ্চাটার রক্তের গ্রুপের মিল ছিল। আমি দিয়েছি কিছুটা আর বাকিটা ব্লাড ব‍্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছিল।”

“কিভাবে এমন দূর্ঘটনা হলো? আগে তো এমন কিছু হয়নি!”

“মা, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে। গাড়ি বরাবরের মত ঠিক ভাবেই চালাচ্ছিলাম কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ সামনে এসে পড়ে। সেদিকে চোখ পড়তেই  দ্রুত ব্রেক করতে গেলেও দূর্ঘটনা যা হবার হয়েই গেল। আমার কপালে হালকা চোট লেগেছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যায়। আমি নিজ থেকেই পুলিশকে খবর দিয়েছি। কিছু ফালতু পাবলিক ঝামেলা পাকানোর মতলব আটছিল। পুলিশ এসে সব ঝামেলার অবসান ঘটায়। আমি আবার দেখতে যাবো। তুমি চিন্তা করো না। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সবটা শুনে সাওদা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। বললেন, “সব ঠিক থাকলেই হলো। আচ্ছা দেখতে যাস। সারারাত অনেক ধকল গিয়েছে নিশ্চয়ই। খাবি চল!”

“না মা। এখন ক্ষুদা নেই। আমি ঘুমাবো। অনেক পরিশ্রম গিয়েছে।”

“কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিলে হতো না!”

“পরে খাবো। এখন না। আমি তাহলে ঘুমাতে গেলাম। সাইমা, সাইফা কে বলো। সারারাত ওদেরও ঘুম হয়নি দেখো।”

“আচ্ছা। যা তাহলে।”

সারফারাজের মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা লক করে অন্বেষাকে একপ্রকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর আয়োজন করলো। নরম গদি, অন্বেষার নরম মোলায়েম শরীরের স্পর্শে ঘুমাতে বেশি সময় লাগলো না ক্লান্ত সারফারাজের।

সকাল নয়টা। অন্বেষা ঘুম থেকে উঠে সারফারাজকে সেই যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মিনিট দশেক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ছাড়ার নামগন্ধ নেই তার। খানিকক্ষণ পর পর দেহ হালকা দুলে উঠছে। ফুঁফিয়ে কাঁদছে মেয়েটি। সারফারাজ কিছু বলছে না। কাঁদার সুযোগ দিয়েছে। কান্না শেষ হলে এমনিই চুপ করবে। মেয়ে মানুষ এমনই খানিকক্ষণ কেঁদে কেঁটে চুপ করে থাকে নতুবা ঘুমিয়ে পড়ে। যেহেতু অন্বেষা ঘুম থেকে সবে উঠেছে তাই তার ঘুমানোর চান্স নেই। চুপ করেই থাকবে বোধহয়।

সারফারাজ অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মোলায়েম স্বরে বলল, “বোকা মেয়ে। এত কাঁদে কেউ? বলেছিনা একদম কাঁদবে না। তোমার কান্না আমার একটুও সহ‍্য হয় না। আমি ঠিক আছি তো। তাহলে এত কান্না কিসের?”

অন্বেষা কান্নাভেজা কন্ঠে প্রতিত্তোর বলল, “হ‍্যাঁ আমার তো খুশি হওয়ার কথা। এত বড় বিপদ গেল অথচ আমি কাঁদতেও পারবো না! এত নিষ্ঠুর কেন আপনি?”

অন্বেষার শিশুসুলভ কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সারফারাজ। পরক্ষণেই মনটা অনুতপ্ততায় ছেয়ে গেল। বলল,

“আমায় ক্ষমা করো অনু। তোমার সাথে অনেক বড় অন‍্যায় করেছি আমি।”

“এসব বলে আমাকে ছোট করবেন। প্লিজ! রাত অনেক আসবে। আমি কামনা করেছি আপনি এবং বাচ্চাটা যেন সুস্থ থাকেন এটাই। আমার মোনাজাতে আপনাদের মঙ্গল কামনা বাক‍্যই ঠাই পেয়েছে। অবিবেচকের মত ফালতু টপিক নিয়ে রেগে থেকে নিজেদের সম্পর্কে তিক্ততা আনার কোন মানে হয় না। বলছি, বাচ্চাটাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে। নিয়ে যাবেন আমাকে?”

“ঠিক আছে যেও আমার সাথে। শুনে খুব ভালো লাগলো তোমরা সবাই বাচ্চাটার এত খোঁজ খবর নিচ্ছো।”

“কি যে বলেন! নিব না! এতবড় বিপদ গেল খবর যে নিতেই হয়।”

“বুঝেছি বিজিজান। আমার ক্ষুদা পেয়েছে তো। সারারাত অভুক্ত। এখন কিছু খেতে দাও!”

অন্বেষা লজ্জা পেল খুব। মানুষটা না খাওয়া অথচ সে বোকার মত তার বক্ষে আয়োজন করে দুঃখ বিলাস করছে। বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অনুতপ্ততার স্বরে বলল, “সব ভুলে যায়। চলুন যাওয়া যাক। এতক্ষণ বিছানায় থাকা মোটেও উচিত হয়নি আমার। আম্মু, খালার কাজে সাহায্য না করে কত বেলা অব্দি ঘুমিয়েছি আমি।”

তাৎক্ষণিক অন্বেষা বিছানা ছাড়তে উঠতে নিলেই সারফারাজ হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল। সম্মোহনী গলাই বলল, “কই যাও বিবিজান? ক্ষুদা অবশ্যই লেগেছে। খাবো তো। আগে তোমার গোলাপের পাপড়ির ন‍্যায় নরম ওষ্ঠদ্বয়ের মিষ্টি মধুর স্বাদ নিতে দাও। তারপর সাধারণ খাবার ভক্ষণ করা যাবে।”

লজ্জায় আড়ষ্টতায় দ্রুত বিছানা থেকে সরে পড়ার ব‍্যার্থ চেষ্টা করলো অন্বেষা। কিন্তু সারফারাজের শক্তপোক্ত পুরুষালি দেহের সাথে পেরে উঠলো না নরম কোমল অন্বেষা। ফলস্বরুপ সাময়িকভাবে নবদম্পতি ডুব দিল এক অন‍্য ভুবনে। যেখানে হালালের সংস্পর্শে অন‍্যরকম সুখময় মুহূর্ত বিরাজ করছে।

সকালের ব্রেকফাস্ট হিসাবে সাওদা বেগম ছেলের পছন্দের ভুনা খিচুড়ি আর গরুর গোশত রান্না করেছে। অন্বেষার জন্য হাসুর মা বিশেষ যত্ন নিয়ে পায়েস রান্না করেছে। পুরো একটা রাত পরিবারের সকলের ওপর দিয়ে বেশ ধকল গিয়েছে। পরিবারের একজন সদস্য বিপদে মানে পুরো পরিবার বিপদে। সেখানে পরিবারের বর্তমান ও একমাত্র কর্তা সারফারাজের এতবড় বিপদে গোটা পরিবার মুষড়ে পড়েছিল। দুবোন গভীর রাত পর্যন্ত ভাইয়ের সুস্থতার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তার মঙ্গল কামনা করেছে। কেঁদেছে হাসুর মাও। অন্বেষা তো একেবারে ফজর নামাজ পর্যন্ত জেগে থেকে সব নামাজ আদায় করে হঠাৎ বেখেয়ালে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাওদা বেগমের মনটা কু ডাকছিল।   ঘুম ভেঙ্গে যায় তারও। কলিজার টুকরো সমতূল‍্য ছেলেটা বিপদে অথচ মা টের পাবে না তাই কি হয়! দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় তার। মেয়েদের ডেকে আনে। একপর্যায়ে জানতে পারে ছেলের এতবড় বিপদের কথা। বাকি রাত ছেলের চিন্তাই ঘুম হয় না তারও। অন‍্যদিকে হায় প্রেশার।

খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছিলো। পরিবারের অল্প সদস্য হওয়ায় টেবিলে সব খাবার রেখে সবাই পাশাপাশি বসে খাবার খেয়ে নেয় তারা। খাওয়ার এক পর্যায়ে সাওদা বেগম ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, “খিচুড়ি, গোশত ভুনা কেমন হয়েছে বাবা?”

সারফারাজ অন্বেষার দিকে দৃষ্টি তাক করে মায়ের কথার প্রতিত্তোরে বলল, “দুটোই জোশ।”

সন্তুষ্ট হলেন সাওদা বেগম। হাত পুড়িয়ে রান্না করা সফল হয়েছে তার। অন‍্যদিকে অন্বেষা হটাৎ বিষম লেগেছে। কেউ না বুঝুক সে অন্তত বুঝেছে সারফারাজের লাগামহীন কথা। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা। অন্বেষার অবচেতন মন বলে উঠলো, “বেডা মানুষ এমন নির্লজ্জ হয় কেন? সামান্য লাজ সরমের বালাই নাই। ছিঃ ছিঃ!”

খাওয়া অর্ধ সমাপ্ত রেখেই অন্বেষা রুমে চলে আসে। এ অবস্থায় সেখানে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব প্রায়।

বেলকনিতে গিয়ে সব ভাবনা একপাশে রেখে প্রকৃতি দেখাই মনোনিবেশ করলো অন্বেষা। নাজুক পরিস্থিতি মনে করে বারবার নুয়ে পড়ছে লজ্জায় সে। যার দরুণ গ‍ৌর বর্ণের মুখখানা গোলাপি আভা ধারণ করছে।

“সবেতো ট্রেইলার। পুরো সিনেমা তো এখনো বাকি। এটুকুতেই কুপোকাত? এমন হলে পোলাপানের বাপ বানাবে কেমনে আমায় হু!”

সারফারাজের উপস্থিতি ও লাগামহীন কথায় আরেকদফা লজ্জায় মিইয়ে গেল অন্বেষা। অবনত দৃষ্টিতে সফেদ রঙা টাইলসের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন দৃষ্টি সামনের মানুষটার দিকে দিলে মহা ক্ষতি হয়ে যাবে।

সারফারাজের মুখে প্রাপ্তির হাসি। আজ এ পর্যন্তই যথেষ্ট। পরক্ষণেই স্বাভাবিক স্বরে বলল, “যেতে হবে তো নাকি? তৈরি হও!”

অন্বেষা দ্রুতগতিতে বেলকনি থেকে প্রস্থান করলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (১০)

_________________

হাসপাতালের নির্দিষ্ট একটা বেডে বছর সাতেকের লিকলিকে গড়নের এক বাচ্চা ছেলেকে আবিষ্কার করলো অন্বেষা। অযত্ন, অবহেলায় শ‍্যামবর্ণের গায়ের রঙে কালো আস্তরণের প্রভাবে গায়ের রঙ পেয়েছে অনেকটা তামাটে বর্ণের। জীর্ণশীর্ণ রোগা শরীর। মাথায় ব‍্যান্ডেজ করা। বাচ্চাটাকে দেখেই অন্বেষার বুঝতে সামান্য বেগ পেতে হলো। অবহেলায়, অনাদরে বেড়ে ওঠা তার। গভীর নিদ্রা আচ্ছন্ন সে। অন্বেষা আর ডাকলো না। অন্বেষাকে বাচ্চাটার কাছে রেখে সারফারাজ গিয়েছে ডাক্তারের কাছে। গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে বাচ্চাটাকে অন্বেষা। আবেগপ্রবণ মনটা কেঁদে উঠলো অন্বেষার। বড্ড মায়া হলো ছেলেটার জন্য। মায়াবর ছোট্ট মুখটাই মলিনতার ছোঁয়া স্পষ্ট।

অন্বেষার চুরির রিনিঝিনি শব্দে ঘুমের রেশ কাটলো।   আখি পল্লব মেলে দিয়ে এক অতীব সুন্দরী রমনীর দেখা পেল ছেলেটি। কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে সেদিক পানে তাকিয়ে রইলো। দৃষ্টিতে কৌতূহলের খেলা। সফেদ রঙা সালোয়ার কামিজে নিজেকে জড়িয়েছে অন্বেষা। মাথায় বড় করে ওড়না টানা। হাতে দুটো সোনার বালা। মধ‍্যমা আঙ্গুলে ছোট্ট একটা আংটি। সবমিলিয়ে দারুণ সুন্দর লাগছে অন্বেষাকে।

ছেলেটিকে জাগ্রত দেখে মিষ্টি হাসলো অন্বেষা। অনেকক্ষণ থেকে কথা বলার জন্য মনটা আকুপাকু করছিল। ছেলেটির উদ্দেশ্যে বলল, “এখন কেমন লাগছে বাবু? শরীরে ব‍্যাথা আছে?”

প্রতিত্তোরে ছেলেটির আস্তে করে ঠোঁট নাড়িয়ে বলল, “ভালো লাগছে। ব‍্যাথা মাঝেমধ্যে অল্প হয়।”

“তোমার নাম কি বাবু?”

“রিফাত।”

“মা শা আল্লাহ্ খুব সুন্দর নাম। কোথায় থাকো তুমি? কিভাবে গাড়ির সামনে পড়লে বল তো!”

“আমার মা আইজ পাঁচদিন হইলো ম’রে গেছে। আব্বায় অনেক আগেই আরেক বেডিরে বিয়া করছে। আমি আর মায় মিলে বস্তির একটা ঘরে থাকতাম। এহন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। ডাস্টবিনে খাবার খুজতে গিয়া কুত্তার দৌড়ানি খেয়ে গাড়ির সামনে পড়ছি। বিশ্বাস করেন আমি ইচ্ছে কইরা এমন করি নাই।”

চোখ যুগল ছলছল করে উঠলো বাচ্চাটার। অন্বেষার চোখের কোণেও অশ্রুরা জড়ো হয়েছে। কি দুঃখের কথা। আল্লাহর দুনিয়ায় বুঝি এতটা অসহায় কেউ হয়! অন্বেষার মনে হলো দুনিয়ায় তার থেকেও বহুগুণ অসহায়, নির্যাতিত, অবহেলিত মানুষের বাস আছে। মাতৃ স্বত্তা জেগে উঠলো বাচ্চাটার জন্য অন্বেষার। মায়া ভরা কন্ঠে শুধালো, “খাবার খেয়েছো আজ!”

প্রতিত্তোরে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে খেয়েছে।

অন্বেষা বলল, “আমাকে খালামনি বা আন্টি ডাকতে পারো। তুমি যার গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়েছো তিনি আমার হাসবেন্ট। মনে কষ্ট নিও না সোনা।”

ব‍্যান্ডেজ বিহিন মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল অন্বেষা। তাকে দেখে এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে অসুস্থ রিফাতের সাথে কতদিনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। মেয়েরা এমনই হয়। সেখানে অন্বেষা তো নিজেও চরম অবহেলার স্বীকার।

আরাম পেয়ে পুনরায় ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো রিফাত। ক্লান্ত শরীরে সবটুকু মমতা শুষে নিল রিফাতের ক্লান্ত দেহ।

“কি করছো?”  সারফারাজের আগমনে উঠে বসলো বেডের পাশের চেয়ার থেকে অন্বেষা।

প্রতিত্তোরে বলল, “একটু আগে জেগেছিল কিন্তু আমি হাত বুলিয়ে দিতেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“ওর অনেকটা ব্লাড গিয়েছে কাল। শরীর ক্লান্ত তাই আরাম পেয়ে আবারও ঘুমিয়েছে।” হাতের ওষুধপত্র নিয়ে বেডের পাশে ছোট্ট ডয়ারে সেগুলো রাখলো সারফারাজ। পূনরায় অন্বেষার উদ্দেশ্যে বলল, “চল,  এবার বাসায় যাওয়া যাক।”

অন্বেষা কিছুটা ভয়ে ভয়ে বলল, “একটা কথা বলার ছিল। বলব কি?”

সারফারাজ অন্বেষার ভিত হওয়ার কারণ খুজে পেল না। বলল, “আশ্চার্য তুমি ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমার স্বামী। সবসময় যা বলবে একদম নির্ভয়ে বলবে। বলো কি বলতে চাও!”

“বলছি, বাচ্চাটাকে আমাদের সাথে নিয়ে গেলে হয় না? ওর বাপের সাথে সম্পর্ক বহু আগে ছিন্ন হয়েছে। মা মারা গেছে অল্প কিছু দিন হলো। ডাস্টবিনের পাশে খাবার খুজতে গিয়ে কুকুরের তাড়া খেয়ে আপনার গাড়ির সামনে পড়েছিল। নিবেন ওকে?”

”এসব তোমাকে কে বলেছে?”

“ও অর্থাৎ রিফাত নিজেই বলেছে।”

সারফারাজ ঘুমন্ত রিফাতের দিকে এক পলক চাইলো। ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। কি নিষ্পাপ মুখখানা। অতঃপর অন্বেষার হাত ধরে হাসপাতালের নির্জন স্থানে নিয়ে গেল। অন্বেষার উদ্দেশ্য শান্ত কন্ঠে বলল, “শোন অন্বেষা! তোমাকে কয়েকটা কথা বলি! ঢাকার শহরে তুমি নতুন। এ শহরের জটিল প‍্যাচগোছ তুমি বুঝবে না। ও যে সত্য কথা বলছে সে ব‍্যাপারে এ মুহূর্তে আমি মোটেও নিশ্চিত নই। হতেও তো পারে ও মিথ্যা বলছে। দয়াকরে বাড়িতে নেওয়ার পর চুরি করে পালাবে না তার কোন নিশ্চয়তা তুমি দিতে পারবে? আবার কর্ম সূত্রে কিছু মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক রেষারেষি পর্যায়ে। এটাও হতে পারে তাদের মধ্যে কেউ আমার ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্য এমন নিচু কাজ করেছে ছেলেটাকে দিয়ে। তবে ওর বলা প্রতিটা কথা যতি শতভাগ সত্য হয় আমি সারফারাজ বলছি, ওর ভরণপোষণের দায়িত্ব ইন শা আল্লাহ আমি নিব। আগে আমার স্পেশাল সোর্চ লাগিয়ে সত্য মিথ্যা যাচাই করি তারপর বাকিটা দেখা যাবে। বুঝেছো অন্বেষা?”

অন্বেষা নিজের হটকারি সিদ্ধান্তে লজ্জিত হলো। এতটা বুদ্ধি খাটিয়ে সে ভেবে দেখেনি। প্রতিত্তোরে বলল, “জি বুঝেছি। আমি কি আপনার মত বুদ্ধিমান নাকি যে এত সব বুঝবো। ওর অসহায়ত্ত্বে আমার নারী মন কেঁদে উঠেছিল তাই তো আপনাকে তাৎক্ষণিক জানালাম।”

“ভালো করেছো। কখনও কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব  যদি মনে হয় তুমি সে বিষয়ে নিশ্চিত নও অবশ্যই আমাকে জানাবে। কারণ অভিজ্ঞতা এবং বয়স দুটোই তোমার থেকে এগিয়ে আমার। তোমাকে ছোট করছি না। একসময় তুমিও বুঝবে। আমার থেকে ভালো বুঝবে সবকিছু। আমার অনুপস্থিতিতে তোমাকেই তো সবটা সামলাতে হবে।”

আঁতকে উঠলো অন্বেষা। অনুপস্থিতি মানে? ধরা গলাই বলল, “কেমন কথা বলেন আপনি? যেখানে আপনাকে ছাড়া আমি নিজের অস্তিত্ব কল্পণাও করতে পারি না সেখানে আপনি দিব‍্যি নিজের অনুপস্থিতির কথা জানিয়ে দিলেন? এই বিশাল দুনিয়ায় আপনি ছাড়া কে আছে আমার?”

সারফারাজ দেখলো অন্বেষা ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে। নিজের উপর রাগ হলো সারফারাজের। কেন যে বোঝাতে গেল। মেয়ে মানুষ বোঝে কম লাফায় বেশি। অন্বেষা চিকন নরম হাতদুটো নিজের পোক্ত হাতের মুটোই পুড়ে সান্ত্বনার সহিত বলল, “বোকা মেয়ে সবকিছু এভাবে ভাবো কেন! আমি আছি ইন শা আল্লাহ থাকবো। আমাদের গন্তব্য হোক জান্নাত পর্যন্ত। হাজারটা হুর চাই না শুধু এবং শুধু তোমাকে চাই। এবার চলো যাওয়া যাক।”

অতঃপর অন্বেষার জবাবের অপেক্ষা না করে হাতখানা ধরে নিজেই হাসপাতালের নির্জন জায়গা ছেড়ে নির্দিষ্ট কেবিনে গেল সারফারাজ। আরেকদফা ছোট্ট রিফাতের সাথে দেখা করে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।

অন্বেষা ব‍্যালকনিতে ঠিকরে আসা সকালের নরম রোদে দাড়িয়ে ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে দিল। কোমর সমান পানির স্রোতের ন‍্যায় আঁকাবাকা এক গুচ্ছ ঘন কালো কেশ ছড়িয়ে পড়লো পিঠময়। অন্বেষা টাওয়াল দিয়ে ভালো করে মুছে নিল। চুলে পানি বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা সর্দি লাগতে সময় নিবে না মোটেও। বেঘোরে প্রকৃতি দেখাই মগ্ন অন্বেষা নিজের ঘাড়ে ঘরম স্পর্শের অস্তিত্ব অনুভব করলো। শরীর জুরে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল।

ঘুম জড়ানো স্বরে সারফারাজ বলল, “সকাল সকাল এখানে কি করছো বিবিজান? তোমাকে বলেছি না! আগামী সাত দিন শুধু আমার সামনে থাকবে। চোখ ভরে আমার শুভ্রময়ীকে দেখবো। তাহলে এখানে কেন?”

অন্বেষা বিরক্ত হলো সারফারাজের এমন খামখেয়ালি কথায়। বলল, “হ‍্যাঁ আমি আপনার সামনে থাকি আর আমার সব কাজ কে করে দিবে শুনি?”

“তোমার সব কাজ হওয়া উচিত আমাকে ঘিরে। বাকিটা আমার মা দেখে নিবে। বুঝেছো শুভ্রময়ী!”

অন্বেষা প্রতিত্তোরে কিছু বলল না। তার স্বামী সাহেব এখন রোমান্টিক মুডে আছে। সে যতই যুক্তি দেখাবে তবুও সারফারাজ তার আজাইরা সিদ্ধান্তে অটল। সুতরাং স্বামীর সাথে অযথা তর্কে না জড়িয়ে পুনরায় সকালে শান্ত সিগ্ধ প্রকৃতি দেখাই মনোনীবেশ করলো। ছাড়া আর কিছু খুজে পেল না অন্বেষা। অন‍্যদিকে চললো সারফারাজের সকালের রোমান্টিক ডোজ। সে এখন নিয়মিত তার বিবিজানকে রোমান্টিক ডোজ দিয়ে পুষ্ট করে তুলছে। আর অতিষ্ট হচ্ছে অন্বেষা।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (১১)

__________________

রাগান্বিত মুগশ্রী সারফারাজের। থমথমে মুখে ফোনটা অন্বেষার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও কথা বলো!”

অন্বেষা অবাক দৃষ্টিতে সারফারাজের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। রাগ করার মত কিছু খুজে পেল না সে। এইতো কি সুন্দর গল্পের ছলে সুন্দর সময় কাটাচ্ছিল দুজনে। তার মধ্যে হঠাৎ সারফারাজের ফোনে রিংটন বেজে ওঠে। কলটা ধরার পর থেকেই কেমন থমথমে ভাব মুখে।

অন্বেষার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সারফারাজ পূনরায় বলল, “কি হলো? ফোনটা নাও। তোমাকে চাইছে।”

অন্বেষা এবার মুখ খুলল। বলল, “আমাকে চাইছে মানে? ফোন দিয়ে খোঁজ করার মত আত্মীয় তো আমার নেই। তাহলে কে?”

অন্বেষার প্রশ্নে বাক‍্যে বিরক্ত হলো সারফারাজ। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “সোজা কথা বুঝতে তোমার এত অসুবিধা হয় কেন? বলেছি ফোনটা ধরতে। ধরবে। তা না একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছো। তোমাদের মেয়েদের কি সমস্যা বল তো! এই লাইন বেশি না বুঝলে হয় না?”

অন্বেষাও ফুঁসে উঠলো। তেজস্বী স্বরে সারফারাজের উদ্দেশ্যে প্রতিত্তোরে বলল, “রাখেন আপনার তুলনা। সব বিষয়ে মেয়ে জাতের ওপর আঙ্গুল তুলেন কেন হ‍্যাঁ? কে ফোন করেছে যখন জানতে চাইছি তখনই বলে দিলে হতো। কথা কে প‍্যাচালো বলেন? অবশ্যই আপনি। মেয়েরা যদি এই লাইন বেশি বুঝে তাহলে তার থেকে কয়েকগুণ বেশিই ছেলেরা বোঝে। মেয়েরা এক লাইন বেশি বুঝলেও সঠিকটাই বোঝে। কিন্তু আপনারা ছেলেরা মেয়েদের থেকে কয়েকগুণ বেশি বুঝেও সঠিকটা বুঝতে ব‍্যার্থ হন। খবরদার কথায় কথায় মেয়েদের ত্রুটি নিয়ে কথা বলবেন না। আমি মোটেও সহ‍্য করবো না। আমি আমার জাত নিয়ে অবশ্যই সচেতন।”  কথা শেষ করে হাপাচ্ছে অন্বেষা। সচরাচর এত কথা একসাথে বলে না সে।

সারফারাজ ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো কল কেটে গিয়েছে। ফোনটা প‍্যান্টের পকেটে রেখে দুহাত  বুকে গুজে আয়েশ করে দাড়ালো সারফারাজ। রাগ তার পড়ে গিয়েছে। কিন্তু অন্বেষার এভাবে বলা কথা হজম করতে কষ্ট হচ্ছে তার। সে অন্বেষার নরম, কোমল, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত কন্ঠস্বর শুনলেও রাগী তেজি কন্ঠ শুনেনি। সারফারাজ কন্ঠে গম্ভীরতা ফুটিয়ে অন্বেষার উদ্দেশ্যে বলল, “ভালোই তো তুমি। কি একটু বলেছি তাতেই এত রাগ। যাও বলব না আর। খুশি তো!”

অন্বেষা প্রতিত্তোরে মুখ খুলে কিছু বলার পূর্বেই সারফারাজের ফোনটা পূনরায় বেজে ওঠে। সারফারাজ কল রিসিভ করে সরাসরি অন্বেষার হাতে দেয়। অন্বেষা এবার কোন দ্বিরুক্তি না করে সারফারাজের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়। ফোন কানে ধরেই নম্র স্বরে সালাম দেয়, “আসসালামু আলাইকুম।”

ওপাশ থেকে অন্বেষার পরিচিত পুরুষালি কন্ঠে জবাব দেয়, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস রে মা?”

অন্বেষার চোখ যুগল ছলছল করে ওঠে। এক পলক গম্ভীরমুখো সারফারাজের পানে তাকায়। সারফারাজ ভরসা দেয়। নিচু কন্ঠে বলল, “কথা বলো। সমস্যা নেই।”

সারফারাজের অভয় বাক‍্য শুনে স্বস্তির শ্বাস নেয় অন্বেষা। ফোন করেছে অন্বেষার হতভাগা পিতা। অন্বেষার কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পূনরায় বলেন, “কি রে মা কথা বলবি না?”  ভদ্রলোকের কন্ঠে অনুতপ্ততার আভাস বিদ‍্যমান।

অন্বেষা প্রতিত্তোরে বলল, “আমি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?”

“আছি একভাবে। হ‍্যারে মা! মনে পড়ে না আমার কথাটা অন্তত!”

“মনে পড়ে। অবশ্যই পড়ে। জন্মের পর থেকে খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছেন ভুলব কি করে। ভুলার মত কিছু হয়নি তো। আপনার শরীর ভালো তো!”

“আছি ভালো। বলছি জামাইকে নিয়ে বেড়িয়ে যা। কতদিন হলো দেখি না তোকে।”

“আপনি কোন মুখে সেখানে যেতে বলেন আমাকে? বরাবরই আপনার বাধ‍্য হয়ে থাকতে চেয়েছি। ফলাফল, আপনার এবং আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীর করা কার্যকলাপ কিছু ভুলে যাইনি আমি। আপনি আপনার পরিবার নিয়ে ভালো থাকেন। আমার খবর না নিলেও চলবে। আমি বেশ আছি এখানে।”

“আমি অন‍্যায় করেছি মা তোর সাথে। আমি জানি। অস্বীকার করছি না। ক্ষমা করে দে বাবাকে। তুই তো আমার আদর্শ মেয়ে।”

“আপনার প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই। জন্মদাতা পিতা আপনি। আপনার জন্য আমার সম্মান সবসময় থাকবে।”

“তাহলে আয়। তোকে দেখি না কতদিন। জামাইকে বলি? না আমি আসবো!”

“খরবদার না। ভুলেও এদিকে আসার কথা ভাববেন না। যে অবস্থায় এ বাড়িতে এসে উঠেছি তাতে এরা মেনে নিয়েছে এটাই অনেক। আপনি এসে নতুন করে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করবেন না। আমার মৃত মাকে যেমন মৃত্যুর পরপরই দুনিয়া ও মন দুটো থেকেই দাফন করেছেন তেমনি আমাকেও ভুলে যান। মনে করবেন আমিও মরে গেছি। ওই গ্রামে যাবো আমি। আমার মা যে শুয়ে আছে। ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।”  অন্বেষা ফোন কেটে দিল। শোনার অপেক্ষা করলো না ফোনের অপর পাশের মানুষটার পরবর্তী কথা। কথা বলাই এতই মগ্ন ছিল যে সারফারাজ কখন রুম থেকে বেরিয়ে গেছে কিচ্ছু ঠিক পাইনি অন্বেষা। নিরব কান্নায় ভেঙে পড়লো অন্বেষা। বাধ ভাঙা অশ্রুর ঢল বইছে চোখ থেকে। ভাসিয়ে দিচ্ছে চিবুক। অন্বেষা মুছলো না। পড়ুক অশ্রু। ভাসুক চিবুক।

এরমধ্যেই সারফারাজের আগমন। অন্বেষাকে তার বাবার সাথে কথা বলতে দিয়ে সে রুমের বাইরে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। তার মতে বাবা মেয়ের কথোপকথনের সময় তার উপস্থিতি না থাকাই ভালো। অন্বেষার অশ্রুসিক্ত নয়ন বরাবরই এই কঠিন পুরুষটাকে পিড়া দেয়। ব‍্যস্ত হাতে অন্বেষার চোখের পানি মুছিয়ে দিল। শাসনের সুরে বলল, “খবরদার মেয়ে মোটেও কান্না নয়। তুমি আমার তোমার কান্নাটাও আমার। ওই চোখের পানিও আমার। আমার সম্পদের অপচয় তো আমি করবো না। কখনও যেন না দেখি এভাবে কাঁদতে।”

সারফারাজ যতই শাসন করুক। করুক বারণ। কিন্তু চোখের পানি কি মানব ভাষা বোঝে। সে তো মনের অব‍্যাক্ত আবেগ দুঃখগুলো অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। সারফারাজের মনে অন্বেষার জন্য বড্ড মায়ার উদ্রেক হলো। দুহাত দিয়ে অন্বেষার কান্নারত মুখখানা উচিয়ে আদুরে স্বরে বলল, ”কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন? বাবার সাথে কথা বলে কেউ এভাবে কাঁদে বোকা মেয়ে! বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে? বলো? দিয়ে আসি তবে!”

আন্বেষা কান্নাভেজা কন্ঠে জবাবে বলল, “না। খবরদার না। আমাকে কখনও ও বাড়িতে যেতে বলবেন না। ও বাড়ি থেকে পরবর্তীতে কেউ কল করলে আমাকে দিবেন না। বাবার প্রতি কোন ক্ষোভ নেই আমার। আমি ভুলে থাকতে চাই আমার বিভীষিকাময় অতীত। ওসব স্মৃতিপটে ভেসে উঠলে বড্ড পিড়া দেয় আমায়। তবে সময় সুযোগ বুঝে ওই গ্রামে আমাকে নিয়ে যেয়েন। আম্মুর কবরটা যে রেখে এসেছি। যেখানে এসেছি বাকি জীবন এখানেই কাটিয়ে দিতে চাই। আপনার যদি আমার সঙ্গ ভালো না লাগে তবে সরাসরি বলে দিবেন। কোথাও চলে যাবো। আল্লাহর দুনিয়ায় আমার মত মানুষের কোন না কোনভাবে জায়গা হবেই।”

অন্বেষার এহেন জবাব আসা করেনি সারফারাজ। কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো, “ব‍্যাস! অনেক বলেছো আর না। কোথায় যাবে তুমি? কোথাও না। সারফারাজের প্রাণপ্রিয় বিবি তুমি। শুধু তার হয়ে থেকো। আর কিছু চাই না। আজ যা বলেছো ভুলেও যেন এসব কথা পরবর্তীতে তোমার মুখে না শুনি। মাথায় ঢুকিয়ে রেখো।

কিছুক্ষণ নিরব থেকে রাগ সংবরণ করে স্বাভাবিক স্বরে বলল, “ব‍্যালকনিতে এসো। একটা দারুণ জিনিস দেখাবো তোমায়।”  কথা শেষ করেই সারফারাজ অন্বেষার নরম হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় পুড়ে নিল। অন্বেষাকে নিয়ে ব‍্যালকনির দিকে অগ্রসর হলো।

সারফারাজের রুমের ব‍্যালকনির সামনে বড়সড় একটা মেহগনি গাছ। সেই গাছের একটা ডালে একজোড়া পাখি প্রতিদিন নিয়ম করে এসে বসে। সারফারাজের চোখে কয়েকবার পড়েছে। আগে আগ্রহ নিয়ে খেয়াল না করলেও এখন বিষয়টা তার কাছে ভালোই লাগে। পাখি দুটো মনে হয় একই জোরার। গাছের ডালে আজও পাখি দুটো এসেছে বসেছে। সারফারাজ পাখিদের বসা ডালটার দিকে আঙুল তাক করে অন্বেষার উদ্দেশ্যে বলল, “এই দেখো অনু! আমি প্রায়শই দেখেছি পাখি দুটোকে মেহগনি গাছটার ওই ডালটাতেই বসতে। জানো নিয়ম করে আসে। কি করে বলতো?”

“প্রেম করতে আসে।”  কথাটা অন্বেষা বলেই মুখে হাত চেপে হেসে ফেলল শব্দ করে।

অন্বেষার হাসি দেখে সারফারাজও হেসে ফেলল। যাক তার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা সফল হলো।

“অনু একটা গুড নিউজ আছে। শুনবে?”

“বলে ফেলুন। অনুমতি নিচ্ছেন কেন!”

“রিফাতের জন্য একটা পাকাপোক্ত থাকার ব‍্যবস্থা করেছি।”

রিফাতের কথা শুনেই অন্বেষার চোখমুখ ঝলমলিয়ে উঠলো। আগ্রহ ভরা কন্ঠে শুধালো, “কি হয়েছে? কোথায় ও! ব‍্যস্ততার জন্য ওর খবর নেওয়া হয়ে উঠেনি। হাসপাতাল থেকে ওকে ছেড়েছে? কোথায় রাখবেন ওকে!”

“নিয়ে আসবো তাড়াতাড়ি। বাড়িতে আনবো না। একটা ভালো মাদ্রসায় ওকে রেখে আসবো। ছুটিতে এ বাড়িতে নিয়ে আসবো বেড়াতে। ইসলামি শিক্ষা অর্জন করুক। এটাই মঙ্গল হবে।”

“মা শা আল্লাহ। ভালো পদক্ষেপ।”

“হুম।” ছোট্ট জবাব সারফারাজের। হাত দিয়ে কাছে টেনে নিল অন্বেষাকে। অন্বেষাও মিশে রইলো বক্ষে। সুন্দর একটা মুহূর্ত হয়ে রইলো সারফারাজ-অন্বেষা কপোত কপোতির।

জানালার কোণ ঘেঁষে বসে আছে সাইমা। পড়ন্ত বিকেলে উদাশ দৃষ্টিতে প্রকৃতি দেখছে সে। কিছুক্ষণ পরে সাইফা এসে বসলো পাশে। সাথে দুকাপ ধোয়া ওঠা গরম চা। এক কাপ সাইমার উদ্দেশ্যে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে ধর। প্রকৃতি বিলাস করছিস। চা ছাড়া জমে নাকি।”

সাইমা দ্বিরুক্তি না করে সাইফার হাত থেকে চায়ের কাপ নিল। সেদিনের ঘটনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে অনেকটাই মিইয়ে গেছে সাইমা। সবার সামনে হাসিখুশি ভাবটা বজায় রাখতে পারলেও সাইফার চোখে ঠিকই সাইমার বিষণ্ণত ভাব ধরা পড়েছে। সাইমার উদ্দেশ্যে সাইফা শান্ত শীতল কন্ঠে বলতে শুরু করলো, “সাইমা কেউ না জানুক আমি জানি তুই কেন এমন করছিস। বিষণ্ণতার কারণটাও অজানা নয় আমার। সানাফ ভাইকে তুই পছন্দ করিস তাই না?”

ভুত দেখার মত চমকে উঠলো সাইমা সাইফার প্রশ্নে বাক‍্যে। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, “না। সেরকম কিছু না সাফু। এমনি ভালো লাগে না আজকাল।”

“আমাকে ভুল বোঝাতে আসিস না। আড়াল করার চেষ্টা করবি না মোটেও। সানাফ ভাই মোটেও ভালো মানুষ নন। ওনাকে কেউ পছন্দ করে না। সেদিন তো দেখলি ওনার কি বাজে ব‍্যবহার। অসৎ মানুষকে মন নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কোন মানে হয় না। মনে জায়গা দিয়ে থাকলেও মুছে ফেল। অসম্ভব বলে কিছু হয় না। মানুষের জন্য তো নয়ই। ভুলে যা তাকে। সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। ফোকাস কর ক‍্যারিয়ারের দিকে। আল্লাহ্ চাইলে সানাফ ভাইয়ের থেকে অনেকগুণ ভালো ছেলে জীবনে আসবে। তুই যে সানাফ ভাইকে পছন্দ করিস এ কথা ভুলেও কখনও মা, ভাইয়ার কানে গেলে আস্ত রাখবে না। আবারও বলছি সামলে নে নিজেকে। দুশ্চরিত্র মানুষের জন্য কোন ভালোবাসা নয়।”

সাইমার কাধে হাত রাখলো সাইফা। চোখ দিয়ে আশ্বাস দিল। সাইমার চোখ বেয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। বলল, “দোয়া কর। আল্লাহ যেন আমাকে উত্তম বুঝ দেন। সব কলুষতা থেকে যেন মুক্ত হতে পারি।”

“তোর জন্য আমাদের সকলের দোয়া সবসময় থাকবে। অনেকদিন তো ভার্সিটি যাওয়া হয় না। পরিক্ষা এগিয়ে আসছে। পড়াশোনায় মনোযোগ দেওেয়া প্রয়োজন। কাল থেকে যাবি?”

সাইমা অলস ভঙ্গিতে প্রতিত্তোরে বলল,

“কাল আসুক তারপর দেখা যাবে।”

“সাইমা এবার কিন্তু আমি এক বর্ণও দেখাবো না। নিজে পড়ে পাশ করবি।”

“দেখা যাবে। মা কে গিয়ে বলল আজকে বিরিয়ানি খাবো।”

“মাকে বলব কেন। চল তুই আর আমি আজ সবার জন্য বিরিয়ানি রান্না করি। মিষ্টি ভাবি ভাইয়া সবাই খুব খুশি হবে। করবি?”

সাইফার প্রস্তাব পছন্দ হলো সাইমার। বলল, “আচ্ছা। আজ রাতে বিরিয়ানি রান্না করবো আমরা। ডান!”

সাইফাও প্রতিত্তোরে বলল, “ওকে।”

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (১২)

_________________

সাইমা আজ ভার্সিটিতে যাবে না। কারণ হিসাবে জানিয়েছে, ‘তার মন চাইছে না আজ ভার্সিটিতে যেতে।’ এমনই সাইমা। মন নিয়ে কথা। মন না চাইলে কোথাও যাবে না সে। সাইফা অনেকবার বলেও রাজি করাতে পারেনি। অগ‍্যতা তাকে একাই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তে হলো। সাইমা, সাইফা এবার অর্থনীতি নিয়ে অনার্স করছে। দুজনেই প্রথম বর্ষে। ভার্সিটিতে পৌঁছে সাইফা হাত ঘড়ি চেইক করে দেখলো অনেকটা দেরি করে ফেলেছে সে। অবশ্যই দেরিটা সাইমার জন্য হয়েছে। কিন্তু তাও তাকে আনতে পারলো না। হতাশা শ্বাস ফেলে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে দ্রুত পা চালালো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। সাইফাদের প্রথম ক্লাস যে স‍্যার নেন তিনি বেশ গম্ভীর ও সল্পভাষী। সেই সাথে ভার্সিটির সবচেয়ে সুদর্শন অবিবাহিত টিচার। চেহারা সুন্দর হলেও কন্ঠে তার গম্ভীর কর্কশ। গ‍ম্ভীরতা ফুটিয়ে যখন জিজ্ঞাসা করে, ‘কি ব‍্যাপার পড়া করে আসেননি কেন?’ তখন চঞ্চলা সাইমাও ভয় পেয়ে যায়। সে একপ্রকার এড়িয়ে চলে এই গম্ভীর স‍্যারকে। আড়ালে অন্তরালে স‍্যার সহ তার চৌদ্দ গোষ্ঠীকে জাহান্নামে পাঠাতে ভুলে না সে। সাইফা ক্লাসের দৌড়গোড়ায় পৌঁছে দেখলো স‍্যার ইতিমধ্যে ক্লাসে ঢুকে পড়েছেন। সাইফা দেরি না করে স‍্যারের উদ্দেশ্যে বলল, “আসসালামু আলাইকুম। স‍্যার আসবো!”

শিক্ষার্থীদের থেকে মনোযোগ উঠিয়ে দরজায় জড়োসড়ো হয়ে দাড়ানো সাইফার দিকে তাকালো এক পলক। সাইফাকে একা দেখে কপাল কুচকে গেল সুদর্শন স‍্যারের। স্বভাবসুলভ গম্ভীর কন্ঠে শুধালেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি ব‍্যাপার আপনি একা কেন? আপনার সাথেরটা কই?”

সাইফা নিচু স্বরে বলল, “ও অসুস্থ স‍্যার। এজন্য আসেনি।”

“ওহ্ আচ্ছা। ভিতরে আসুন। পরবর্তীতে আর দেরি করবেন না। নচেৎ ভেতরে ঢুকতে দেওেয়া হবে না।”

সাইফা আর কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা ক্লাসরুমে ঢুকে পড়লো। স‍্যারের সাথে আলাপকালে বরাবরের মতোই তার বুক ভয়ে দুরু দুরু করে।

মগ্ন হয়ে রইলো অন‍্য ভাবনায় স‍্যার। চিন্তার রেশ ফুটে উঠলো। কি হলো সাইমার? ফাঁকিবাজ মেয়েটার জানা উচিত তাকে এক পলক না দেখলে এই গম্ভীরমুখো মাস্টারের কিছুই ভালো লাগে না। মনে মনে বলল, ‘জ্বালাময়ী বড্ড জ্বালাচ্ছো তুমি। এবার সময় এসেছে খাচায় পোড়ার। বাইরের হাওয়া লাগিয়ে নাও। আমায় জ্বালিয়ে শান্তিতে কি করে তোমায় থাকতে দেয় জ্বালাময়ী!’  অতঃপর অন্তরালের ভাবনা থেকে মনোযোগ উঠিয়ে শিক্ষার্থীদের দিকে মনোযোগ দিল।

“সুহাসিনী দাড়াও! আর কত পোড়াবে আমায়? এক চিলতে ভালোবাসা কি আমার তরে বিলিয়ে দেওেয়া যায় না সুহাসিনী!”

বিরক্ত হলো সাইফা। ক্লাস শেষ করে বাড়ির পথে হাটছিল। কাছেই বাসা। তাই গাড়ি বা রিকশার প্রয়োজন পড়ে না। পিছু ডাকে ফিরে তাকায় সেদিক। বলল, “আপনাকে বলেছি না আমাকে ওই নামে ডাকবেন না। আর কতবার বলব আপনার সাথে কোন সম্পর্কে আমি যাবো না। আপনার মায়ের সাথে আমার মায়ের দারুণ বন্ধুত্ব। আমি চাই না আপনার বা আমার জন্য তাদের এত বছরের বন্ধুত্বে ফাটল ধরুক। এভাবে কোন সভ‍্য ছেলে কোন মেয়ের পিছু নেয় না। আপনাকে যথেষ্ট ভদ্র বলে জানি। দয়াকরে তার উল্টা আচরণ করে আপনাকে অভদ্র ভাবতে বাধ্য করবেন না।”

“তোমায় ভালোবাসি। সেটাকি মিথ্যা?”

“ভালোবাসা সত্য না মিথ্যা সেটা আপনি ভালো জানেন। অন‍্যের মনের খবর আমি কি করে রাখবো।   আবারও বলছি এভাবে আমার পিছু নিবেন না। কখনও মা বা ভাইয়ার চোখে পড়লে আমার ভার্সিটি আসা বন্ধ করে দেবে।”

“তোমার প্রণয়ের অনলে আমার হৃদয় যে প্রতিনিয়ত ঝল’সে যাচ্ছে তার কি প্রতিকার হবে?”

“আমি বলিনি আমায় ভালোবাসুন। ভুলে গেলেই হয়। শান্তিতে থাকবেন।”

“সে ব‍্যার্থ চেষ্টা আমি কখনোই করবো না। মন দিয়ে মন উঠানো অসম্ভব ছাড়া কিছুই না। আমি কি করবো সুহাসিনী!”

সাইফা ক্রমেই নিজের কঠোর রূপ ধরে রাখতে ব‍্যার্থ হচ্ছে। খোলশে আবৃত কোমল দূর্বল মনটা সম্মুখে বেরিয়ে এসে বলতে চাচ্ছে, ‘পুরুষ প্রণয়ের হাওয়া শুধু আপনার একার লাগে নি। আমি অভাগিকেও সে হাওয়া দারুণ ভাবে ছুয়ে দিয়ে গেছে।’ কিন্তু মুখে বলল, “দেখুন। আপনি যদি ভেবে থাকেন বিবাহ বর্হিভূত সম্পর্কে জড়াবো তা হলে সে ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। আমি বরাবরই আমার মা ভাইয়ের বাধ্য। তারা কষ্ট পাবে এমন কাজ ইহ জীবনে আমার দ্বারা হবে না ইন শা আল্লাহ। তাছাড়া স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা বিয়ের আগের সম্পর্ককে হারাম ঘোষনা করেছেন। সেখানে সামান্য জীব হয়ে কি করে তা অবমাননা করি?”

যুবক সাইফার জোড়ালো যুক্তিতে পরবর্তী কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলল। দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল। পুরুষ হয়েও প্রেয়সীকে না পাওয়ার বিরহে কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। ছলছল চোখে সাইফার পানে তাকালো সে। সাইফা সে দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে নামিয়ে নিল নিজের চোখ। বলল, “আমায় সত্যি ভালোবাসলে আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবেন। আশাকরি আর কিছু বলার বা শোনার নেই। আল্লাহ্ হাফেজ। ভালো থাকবেন।” কথার সমাপ্তি টেনে এক মুহূর্ত না দাড়িয়ে দ্রুত পা চালিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। পিছনে ফেলে গেল তার না হওয়া পুরুষটাকে।

সাজ বেলা সারফারাজ অন্বেষা বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সারফারাজ অন্বেষার জন্য ছোট্ট সারপ্রাইজ রেখেছে। অন্বেষা কৌতুহলবশত কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও কাঙ্ক্ষিত কোন উত্তর না পেয়ে পরবর্তীতে রাগে দুঃখে আর কথায় বলেনি। অন্বেষার রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে সারফারাজ মুচকি হেসেছে শুধু। কিন্তু মুখ থেকে কথা বের করেনি এক বর্ণও। তার মতে সারপ্রাইজ সেটা না দেখা পর্যন্ত অলক্ষে, অজান্তে থাকা উচিত। না হলে সেটা কি করে সারপ্রাইজ হলো!

সাওদা বেগমের থেকে অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। যাওয়ার আগে সাওদা বেগম কঠিন স্বরে বলে দিয়েছেন, “যাচ্ছো ভালো কথা। সন্ধার আগে ফিরে এসো। মেঘলা আকাশ। এ সময় বেশিক্ষণ বাইরে না থাকাই ভালো। ছাতাটা নিয়েছো তো!”

প্রতিত্তোরে সারফারাজ বলেছিল, “নিয়েছি মা। তুমি চিন্তা করো না। যায় তবে!”

“যাও।”

বেশ বড়সড় মাদ্রাসার সামনে গাড়ি দার করালো সারফারাজ। ততক্ষণে অন্বেষা যা বোঝার বুঝে গেল। সারফারাজ গাড়ি থেকে নেমে অন্বেষার উদ্দেশ্য বলল, “আমি ভিতরে যাচ্ছি। তুমি একটু অপেক্ষা করো।”

অন্বেষা ছোট্ট করে বলল, “আচ্ছা।”

কিছু সময় পরে শুভ্র পাঞ্জাবী পায়জামা পরিহিত রিফাতকে দেখে আনন্দে ঝলমলিয়ে উঠলো অন্বেষার চোখ মুখ। রিফাতকে পেছনের সিটে বসিয়ে সারফারাজ নিজের ড্রাইভিং সিটে বসে পূনরায় গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো।

রিফাতকে দেখে অন্বেষার মুখে যেন খই ফুটলো। কথার ফোয়ারা বইছে মুখ থেকে। সারফারাজের প্রতি এখন তার কোন রাগ নেই।

রিফাত নিজেই জিজ্ঞাসা করলো, “কেমন আছেন খালামনি?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো। তুমি কেমন আছো? নতুন জায়গা কেমন লাগছে?”

“আমিও ভালা আছি। সবাই আদর করে আমারে। হুজুরও অনেক ভালো জানে।”

স্বস্তির শ্বাস নিল অন্বেষা। যাক ছেলেটা ভালো আছে তবে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সারফারাজের পানে চাইলো অন্বেষা। সারফারাজ ছোট্ট করে বলল, “সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।”

“মাশা আল্লাহ্। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক।”

“তোমারও আমার প্রিয় বিবিজান।”

বড় রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামালো সারফারাজ। রিফাত অবাক চোখে রেস্টুরেন্টের দিকে তাকিয়ে আছে। কত স্বাদ ছিল মায়ের সাথে এমন হোটেলে এসে খাবে। সে স্বাদ অপূর্ণই থেকে গেল। ছলছল করে উঠলো রিফাতের চোখ যুগল। অন্বেষা বলল, “মায়ের কথা মনে পড়ছে? আল্লাহ মাকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছেন। তোমাকে অনেক বড় আলেম হতে হবে। মায়ের জন্য অনেক অনেক দোয়া করতে হবে। ইনশাআল্লাহ জান্নাতে মায়ের দেখা পাবে সোনা। এসো!”  কথা শেষ করে ছোট্ট করে চুমু একে দিল রিফাতের কপালে। গাড়ি দরজা খুলে রিফাতের লিকলিকে হাতখানা ধরে অন্বেষা সারফারাজের সাথে রেস্টুরেন্টের ভিতরে প্রবেশ করলো।

সপ্তাহ খানিক পরের কথা।

সাওদা বেগম চিন্তিত মনে বসে আছেন তার রুমে। এমন সময় সারফারাজও অনেকটা চিন্তিত মন নিয়ে মায়ের রুমে প্রবেশ করলো। অন্বেষা, সাইমা, সাইফা ও হাসুর মা সবাই লুডু খেলায় ব‍্যস্ত। সারফারাজ তার চিন্তার কারণ মায়ের কাছে ব‍্যক্ত করে বলল, “আমাকে কাল জানিয়েছে। শোরুম থেকে আসার সময় ভদ্রলোক নিজে বলে গিয়েছেন।”

সাওদা বেগম বললেন, “আমাকেও তোর রওশনারা আন্টি কিছুক্ষণ আগে ফোন দিয়ে বললেন সাইফাকে আবিদের বউ করে নিতে চান। অনেক দিনের স্বাধ তার। এখন সাইফা বড় হয়েছে তাই এখন প্রস্তাব দিলেন।”

“মা আমি বুঝতে পারলাম না। ভার্সিটির টিচার হয়ে শেষে কিনা তার সাইমাকে পছন্দ হলো!” হেসে ফেলল সারফারাজ।

সাওদা বেগমও ছেলের কথায় হেসে ফেললেন। সাইমা তার চঞ্চলা অষ্টাদশী কন‍্যা। আর ভার্সিটির গম্ভীরমুখো কঠোর ব‍্যক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষকের কিনা তার ডান পিটে মেয়েটাকেই পছন্দ হলো। বাবাকে দিয়ে প্রস্তাবও পাঠিয়েছে কাল।

“মা, ভদ্রলোক খোলাখুলি সব বলে দিয়েছেন। একটাই ছেলে তাদের। মেয়ে বছর পাঁচেক আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। এখন এক ছেলে নিয়ে আছেন। পছন্দের কথা বাড়িতে জানাতেই ভদ্রলোক তাৎক্ষণিক আমার শোরুমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। বুঝলাম ওনাদের আগ্রহ আছে। তোমাকে জানানোর আগে আমি নিজ দায়িত্বে সব খবরাখবর নিয়েছি। মা শা আল্লাহ্ সবই ভালো।”

সাওদা বেগম বললেন, “তোর রওশনা আন্টির কথা তো জানিস। আবিরকেও চিনিস। এখন তোর যা ভালো মনে হয় সেটাই কর।”

“সেকি কথা মা। তুমি যা বলবে সেটাই হবে। তুমি বলো কি করা উচিত?”

“তোর সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। আজ পর্যন্ত বোনেদের জন্য সবচেয়ে সেরাটা বেছে এনেছিস। এ ব‍্যাপারেও সেটাই করবি। বাবা, তোর বুদ্ধিতে যা ভালো মনে হয় সেটাই কর।”

তারপর মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চিন্তিত মুখেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল সারফারাজ। মা তো তার ওপর ভরসা করে দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু এতবড় দায়িত্ব সে কতটুকু পালন করতে পারবে সে নিয়ে চিন্তার যেন শেষ নেই। বোনেদের জন্য পাত্র নির্বাচন করা মোটেই সহজ কাজ নয়। সারাজীবনের ভালো মন্দের ব‍্যাপার যেখানে বিদ‍্যমান। সেখানে সামান্য হেরফের হলে বোনেদের ভালো থাকা খারাপ থাকা নির্ভর করবে।

প্রণয়ের হাওয়া লাগলো মনে (১৩)

________________

দেহটা ইট পাথরের চারকোনা রুমে আবদ্ধ থাকলেও অন্বেষার মনটা পড়ে আছে ফুলতলী গ্রামের মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে বাঁশের বেষ্টনীর কবরটায়। মায়ের  মমতায় ঘেরা মুখখানা কতদিন দেখে না। চোখ থেকে নদীর স্রোতের ন‍্যায় অশ্রু কণা গলগলিয়ে চিবুক বেয়ে পড়ছে।

অন্বেষা-সারফারাজের বিয়ের দুই মাস পেড়িয়ে তিনমাসে পড়েছে। সাইমা, সাইফার বিয়েরও একমাস পূর্ণ হয়েছে। বর্তমানে তারা শশুরালয়ে সুখে দিন যাপন করছে আলহামদুলিল্লাহ্।  বিয়ের মতামত জানার জন্য যখন দুবোন জিজ্ঞাসা করা হলো তারা এ প্রস্তাবে সম্মত কি না! সাইফা নিরবে সম্মতি দিলেও সাইমা কিছুটা অসম্মত ছিল। সে কিছুতেই ভার্সিটির লেকচারাল কে বিয়ে করবে না। তার বক্তব্যে, লোকটা রশকশহীন। দেখা যাবে বাসর ঘরেও গম্ভীর স্বরে শুধাবে, “পড়া বলেন!” সাইমার যুক্তিহীন কথা কেউ খুব একটা আমলে নেয়নি। এক পর্যায়ে সেও ভার্সিটির সুদর্শন স‍্যারের বিয়ের প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করে। প্রায় সপ্তাহ খানিকের মধ্যে জমজ বোন দুটোর একসাথে বিবাহ কার্য সম্পন্ন হয়েছিল। সাইফা তার প্রণয় পুরুষ অনিকের হাত ধরে নব শশুরালয়ে এবং সাইমা তার ভার্সিটির গম্ভীর সল্পভাষী টিচারের পোক্ত হাতের ভাজে নিজের নরম হাতখানা গলিয়ে নব শশুরালয়ে উদ্দেশ্যে এবাড়ি ছেড়ে বিদায় নিয়েছিল। সাওদা বেগম দুই মেয়ের একসাথে বিদায় কালে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। কেঁদেছিল অন্বেষা ও হাসুর মাও। সারফারাজ তখনও আবেগকে দায়িত্বের বেড়াজালে বন্দি করে ব‍্যস্ত হাতে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করছিল। দু দুটো বোনের বিয়ে। কষ্ট যেমন তেমনি দায়িত্ব কর্তব্যের ভারটাও নিছক কম নয়।

সাইমা, সাইফার সাথে অন্বেষার বন্ধুসুলভ ভাব ছিল। ওদের বিদায়ে অন্বেষা মর্মাহত হয়েছে খুব। সারফারাজ শোরুমের কাজে ব‍্যস্ত দিন পার করছে ইদানিং। যতটুকু পারে সাওদা বেগমকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করে অন্বেষা। সাথে হাসুর মাও থাকেন। উঠতি বয়সি দুটো মেয়ে বাড়িময় ঘুরেফিরে বেড়াতো। গমগমে ভাব বিরাজ করতো বাড়ি জুরে। সাইমা, সাইফার অবর্তমানে সুনশান নিরবতা বাড়িময়। এজন্যই বুঝি বলা হয় ‘মেয়েরা হচ্ছে পরিবারের মেহমান স্বরুপ। নির্দিষ্ট কিছুদিন বাপের বাড়ির আদর আহ্লাদ ভোগ করে যেতে হয় সংসার ধর্ম পালনের উদ্দেশ্যে শশুরালয়ে। যেখানে সুখে দুঃখে মেয়েদের বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। অন্বেষা প্রায়শই ব‍্যালকনির সম্মুখে মেহগনি গাছটায় খানিক সময়ের জন্য আশ্রয় নেওয়া জোড়া পাখি দুটোকে মুগ্ধ নয়নে দেখে। আজও ব‍্যতিক্রম হয়নি। পাখি দুটো মিলনমেলায় সেও দুর থেকে দেখে। এখন তার প্রতিদিনকার রুটিনের একটি অংশ হচ্ছে ব‍্যালকনিতে কিছু সময় কাটানো। অতীতের পাতায় বিচরণ কালে কতকিছুই তো স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। অন্বেষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাশুড়ি মায়ের রুমে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করলো মনে মনে। কিছু সময় গল্প করা যাবে। তাতে যদি তার বিক্ষিপ্ত মনটা কিছুটা ভালো হয়। অতঃপর মাথায় ওড়নাটা ভালো করে টেনে বেরিয়ে পড়লো রুম থেকে।

অন্বেষা সাওদা বেগমের রুমের সামনে গিয়ে দরজায় হালকা শব্দে কড়া নেড়ে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম আম্মু।” তারপর আবারও বলল, “আম্মু আসবো!”

রুমের ভেতর থেকে সাওদা বেগম সালামের জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম।”  তারপর দরজায় নত মস্তকে দাড়ানো অন্বেষার উদ্দেশ্যে বললেন, “কে? অনু মা! আয় রুমে আয়। তোকে কতদিন বলেছি না, আমার রুমে আসতে অনুমতি নিতে হবে না। মায়ের রুমে মেয়ে আসবে এতে আবার অনুমতি কিসের রে!”

অন্বেষা সাওদা বেগমের কথা শুনে মুচকি হাসলো। রুমে প্রবেশ করে বিছানার এক কোণায় বসলো গিয়ে। সাওদা বেগম জানালার কর্ণারে বসে ছিলেন। হাতে একটি হাদিসের বই। পড়ছিলেন বোধহয়। অন্বেষার আগমনে হাত থেকে বই খানা রেখে দিলেন। চোখের চশমাটাও খুলে ফেললেন। হাতের বইটার আর চশমা অন্বেষা হাতে দিয়ে বললেন, “যা তো মা! ওয়ারড্রবের তাকের ওপর রেখে দিয়ে আয়।”

অন্বেষা সুবোধ বালিকার ন‍্যায় তাই করলো। তারপর আবার পূর্বের আসনে এসে বসলো। সাওদা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন, “আম্মু! সাইমা, সাইফা কতদিন হলো ও বাড়িতে রয়েছে। ওদের আসতে বলুন। ওদের ছাড়া ভালো লাগে না একটুও। কতদিন হলো দেখা হয় না।”

সাওদা বেগম পূত্র বউয়ের সহজ সরল স্বীকারোক্তি শুনে ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। বললেন, “বোকা মেয়ে আমার। ওরা যে পনেরো দিন আগেই বেরিয়ে গেল। এখন কি আসতে দিবে? তবুও বলে দেখবো।”

শাশুড়ি মায়ের আশ্বস্ত বাক‍্যে স্বস্তি পেল অন্বেষা। পুলকিত হয়ে উঠলো বিষণ্ণ মনটা।

“আমারে রাইখা থুইয়া শাশুড়ি, বেডার বউ গল্প করতাছো? রাগ করছি।”  হঠাৎ তৃতীয় ব‍্যক্তির আবির্ভাবে চমকে উঠলো অন্বেষার। কথার উৎস খুজতে পিছন ফিরে দেখে হাসুর মা দাড়িয়ে। তাকে দেখে অন্বেষা বলল, “আরেহ্ খালা যে! আসুন বসুন।”

হাসুর মা এগিয়ে এসে বেতের মোড়ায় বসলেন। বললেন, “বৈকালের আড্ডা চা ছাড়া জমে নাকি। আমি চা বানায় নিয়া আসি।”

অন্বেষা বাধা দিয়ে বলল, “না থাক খালা। আপনার উঠতে হবে না। আমি বানিয়ে আনছি। আপনি বসুন।”

“তুমি বসো। আমি যামু আর আসমু।”  অন্বেষাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তিনি বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে চা বানানোর উদ্দেশ্যে কিচেনে।

হাসুর মা চলে যেতেই সাওদা বেগম অন্বেষাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, “অনু মা! একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো। যেটুকু জানিস বলবি!”

অন্বেষা কিঞ্চিত ভয় পেল। কি জিজ্ঞাসা করবে তার প্রিয় শাশুড়ি মা! মনের মধ্যে কতশত প্রশ্নেরা জড়ো হয়েছে। সাওদা বেগম বললেন, “তোর মামা বাড়ি কোথায় অনু?”

“মামা আমাদের পাশের জেলায় থাকেন। আমাদের গ্রাম থেকে ঘন্টা খানিকের দুরত্ব।”

“তোর নানা কি সরকারি চাকরি করতেন?”

“সেটা তো জানিনা আম্মু। হঠাৎ এ প্রশ্ন?”

“আছে দরকার আছে। তোকে দেখতে অনেকটা ছোট বেলায় আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের মেয়েটার মত দেখতে লাগে। সে অবশ্যই আরও পঁচিশ বছর আগের কথা। মেয়েটা আমার থেকে কম করে হলেও সাত আট বছরের ছোট ছিল। অথচ মেয়েটার সাথে একদম বন্ধুসুলভ সম্পর্ক ছিল আমার। তারপর তার  বাবার চাকরি অবসরে আসলে ওরা ওদের নিজ বাড়িতে ফিরে যায়। তারপর থেকে বহুবার মনে মনে খুজেছি কিন্তু কোথাও দেখা পেলাম না।”  কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সাওদা বেগম।

অন্বেষা বলল, “সেই মেয়েটার নাম মনে আছে?”

সাওদা বেগম কিছুক্ষণ ভেবে বললেন, “অরনী না কি যেন নাম ছিল।”

‘অরনী নামটা শুনেই অন্বেষা চমকে ওঠলো।    বিস্ময় নিয়ে শুধালো,”সত্যি বলছেন আম্মু?”

“মিথ‍্যা বলে কি লাভ মা?”

অন্বেষা খানিক নিরব থেকে বলল, “অরনী তো আমার মায়ের নাম ছিল।”

“সত‍্যি বলছিস মা? তুই আমার সেই ছোট্ট অরনীর মেয়েটা?”  প্রতিটা কথায় যেন আবেগ ঝরে পড়ছিল সাওদা বেগমের।

অন্বেষা উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বোঝালো ‘হ‍্যাঁ সে ই।’

“তোর এমন বিপদে নানু বাড়ির কেউ আসেনি তোকে দেখতে? শোনেনি এমন বিপদের কথা?”

“আমি ছোট থাকতেই নানাভাই মা’রা গিয়েছেন। আম্মু মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে নানুও মা’রা গিয়েছেন। মামা তো একটাই। তারপর থেকে যোগাযোগ শিথিল। কখনও সেভাবে আমার খোঁজ খবর নেননি।”

সাওদা বেগম অন্বেষার মামার পাষণ্ডতায় কষ্ট পেলেন কিছুটা। আলগোছে অন্বেষাকে কাছে টেনে নিলেন। তিনি বেশ উপলব্দি করতে পারছেন মেয়েটার আল্লাহ আর তারা ছাড়া সাতকুলে কেউ থেকেও নেই। আশ্বাস ভরা কন্ঠে বললেন, “যা হয়েছে, হয়েছে। এখন তুই আমার ঘরের রাণী। আমার ঘর আর ছেলেকে ভালোবেসে আগলে রাখবি। দেখবি সুখ শান্তির অভাব হবেনা মা। আল্লাহর লীলাখেলা বোঝা বড় দায়। ছোট বেলায় পরিচয় হওয়া আমার খেলার সাথী সেই ছোট্ট মেয়েটার মেয়ে তুই। আমারই ছেলের বউ হয়ে এ বাড়িতে এলি। একি আমি বা তুই কখনও ভেবেছি? তাইতো বলি আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন‍্যই করেন। আলহামদুলিল্লাহ্।”

অন্বেষা ছোট বাচ্চাটির ন‍্যায় সাওদা বেগমের বুকে চুপটি করে মুখ খুজে আছে। কেমন যেন মা মা গন্ধ তার গায়ে। অন্বেষা মুখ উচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলো। মনটা ভালোলাগার আবেশে ছেয়ে গেছে। মায়ের আদর পেয়ে অন্বেষার মনটা ফুরফুরে লাগছে। এর মধ্যে হাসুর মা চা নিয়ে হাজির। অতঃপর তিন রমনীর কথোপকথন চললো মাগরিবের কিছু পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

রাতে সারফারাজ বাড়িতে ফেরার পর থেকে অন্বেষা উপায় খুজছিল কি করে মনের মধ্যে বহুদিনের বাসনা সারফারাজকে বলা যায়। একটু আধটু ভয়ও করছিল। পাছে মানুষটা যদি রাগ করে! তবে সারফারাজ অন্বেষার সম্পর্কের বহুবছর না হলেও সারফারাজের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব সুন্দর সহজ আচরণ অন্বেষাকে অনেকটা সহজ করে তুলেছে সারফারাজের প্রতি। রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সারফারাজ। অন্বেষার মনে হলো এটাই সঠিক সময় বলে দেওয়ার।

সারফারাজ রুমের এক্সট্রা সোফায় বসে ল‍্যাপটপে দোকানগুলোর হিসাব দেখছিল। প্রতিদিনই এমন চিত্র দেখতে পাই অন্বেষা। অন্বেষা সারফারাজের কাছে গিয়ে বসলো। মোলায়েম স্বরে বলল, “বলছি আমার মন চাচ্ছে আম্মুর কবরটা দেখে আসতে। আপনি তো বলেছিলেন নিয়ে যাবেন। আমি যেতে চাই। শুধু আম্মুর কবরটা দেখে চলে আসবো।”

অন্বেষার কথায় ল‍্যাপটপ থেকে দৃষ্টি এবং মনোযোগ দুটোই উঠিয়ে অন্বেষার দিকে চাইলো সারফারাজ। সৃষ্টিকর্তার নিখুঁত সৃষ্টি অন্বেষা। লাস‍্যময়ী রমনী। যার প্রতিটি অঙ্গে সারফারাজের মত সুদর্শন পুরুষকে বেসামাল করে দিতে যথেষ্ট। সারফারাজ দেখলো অন্বেষার চোখদুটো তিরতির করে কাঁপছে। যেকোনো সময় ওই ডাগর ডাগর চোখ দুটো থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। সারফারাজ ঝট করে ভালোবাসার স্পর্শ একে দিলে অন্বেষার কপালে। তারপর অন্বেষাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “বেশ তো যাব। কবে যেতে চাও?”

অন্বেষা ভাবতে পারেনি সারফারাজ এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে। অন্বেষার বিস্ময়কর দৃষ্টি দেখা এক দফা নিঃশব্দে হাসলো সারফারাজ। অতঃপর বলল, “আমার তিনটা না চারটা না একটা মাত্র বউ আমার। তার মন বাসনা পূর্ণ করা আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। বিবিসাহেবা তুমি চিন্তা করো না। শিঘ্রই ফুলতলী গ্রামে যাওয়া হবে। যদিও ও গ্রামকে ফুলতলী বলা চলে না। কারন ফুলটা তো আমি সেবার সঙ্গে করে নিয়েই এসেছিলাম। সেখানে আছে শুধু কাঁটা। বলা যায় কাঁটাতলী গ্রাম।”

অন্বেষা সারফারাজের অদ্ভূত যুক্তি শুনে হাসলো। বলল, “কি যে বলেন না আপনি। একদম যা তা।”

“শোন অনু এই সারফারাজ ঠিকই বলে। ও গ্রামে কোন ফুল টুল নেই। যে ছিল সে এখন সারফারাজের হৃদয় বাগানে সৌরভ ছড়াচ্ছে। শোন অনু, একটা কান্ড ঘটে গিয়েছে। শুনবে?”

অন্বেষা কৌতূহলী স্বরে বলল, “কি হয়েছে?”

সারফারাজ বলতে শুরু করলো, “আমার ম‍্যান’স ক্লথে ছেলেদের আনাগোনা বেশি বলা চলে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বয়সের মেয়েরাও আসে। এক মেয়ে গত ছমাস ধরে সপ্তাহে দুই বা তিনদিন দোকানে নিয়ম করে আসে। কখনও কিছু কেনে কখনও ঘুরেফিরে চলে যায়। নিয়মিত ক্রেতা হওয়ায় ছোট খুব একটা কিছু বলে না। ছোট আমার দোকানের কর্মচারী। আমি ওই দোকানটাতে খুব কমই যায়। মাঝেমধ্যে ওই মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যায়। বুঝলে অন্বেষা জানতে পারলাম মেয়ে নাকি আমাকে দেখতেই শপে আসে। শুনে কতক্ষণ হেসে ছিলাম জানো? একদিন তো ছোটর থেকে আমার নাম্বার নিয়েই যাবে। হয়তো কোন বড়লোক বাপের বিগ্রে যাওয়া কন‍্যা। আমার বিয়ের খবর শুনে আসে না শপে। প্রচার করে বেড়াচ্ছে আমার শপের পোশাকগুলো নাকি স্বস্তা। ভালো না। অথচ সে কতগুলো মাস ধরে নিয়মিত ক্রয় করতো। যাক গে। আল্লাহ সহায় হলে ওরকম দু একটা চুনোপুটি আমার কিছুই করতে পারবে না।”

অন্বেষার মনক্ষুন্ন হলো। আহারে! বলল, “এতে যদি কোন ক্ষতি হয়?”

সারফারাজ অভয় দিয়ে বলল, “আল্লাহ্ থাকতে কিসের ভয়। এসব সামান্য বিষয়ে সারফারাজ ভিত হয় না। যখন দেখবে ওই মেয়ের এসব নিচু কাজে আমার কিছুই হচ্ছে না। তখন ও নিজ থেকেই থেমে যাবে। ওসব কথা এখন থাক। ঘুমাতে হবে না?”

“হ‍্যাঁ।”

সারফারাজ অন্বেষার আরেকটু কাছে এসে বলল, “ঘুমাবোতো কিন্তু তার আগে…..”

“অসভ‍্য লোক।” বলে অন্বেষা নিজেই সারফারাজ ঠোঁটজোরা বন্ধ করে দিল। দম্পতি ভাসলো সুখের জোয়ারে। হলো মধুময় আরেকটি রজনী। স্বর্গসুখ যেন বিরাজ করছে ইট সিমেন্টের ওই কক্ষটায়।

দুদিন পরে অন্বেষা, সারফারাজ ও সাওদা বেগম চললেন ফুলতলী গ্রামে। অন্বেষার বাসনার কথা শুনে সাওদা বেগম নিজেকে আর আটকাতে পারলেন না। তারও যে সখ জেগেছে ছোট বেলার খেলার সঙ্গীটির কবর দেখার। অনেক খুজেও যাকে পেলনা অবশেষে পেল তার কবর। চোখ মুছলেন সাওদা বেগম। তার নিজেরই কত কষ্ট লাগছে। না জানি অন্বেষার কতটা খারাপ লাগবে। মনে মনে প্রস্তুত হলেন অন্বেষাকে সামলানোর জন্য।

কবর ঠিক থাকলেও চারপাশের বাঁশের বেষ্টনী ভেঙ্গে পড়েছে। সারফারাজ অনুমতি নিয়ে চারপাশে প্লাস্টিকের বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে দিল। কবর যিয়ারত করে ফিরতেই রাকিব, তৃণা হাজির। বহু অনুরোধের পর রাকিব তৃণার সাথে তাদের বাড়িতে যেতে হলো। খবর পেল অন্বেষার সৎ বোনটিকে মেম্বারের মাতাল ছেলেটি বিয়ে করেছে। খুবই করুণ অবস্থা। সারফারাজ কিছু বলল না। সাওদা বেগমও নিরব রইলেন। অন্বেষার খারাপ লাগলো। তার সৎ মার করা জঘন্য অন‍্যায়ের মাশুল দিতে হচ্ছে বাচ্চা মেয়েটিকে। বয়স কতই বা হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সকলের সাথে আলাপনে ব‍্যস্ত হলো সে। কারো প্রতি রাগ ক্ষোভ না থাকলেও ওদের কারো কথা আর ভাবতে চাই না অন্বেষা। সেখানে ওর কোন ভূমিকা নেই।

দুপুরের খাবার পর্ব সেরে সারফারাজ অন্বেষা ও সাওদা বেগমকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। অন্বেষা ফুলতলী গ্রাম থেকে সঙ্গে করে একটা বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে। ফুলতলী গ্রামের সুন্দর স্মৃতি হিসাবে রেখে দিবে সে। আদর যত্নের কমতি রাখবেনা কোন।

দুর থেকে মেয়ে জামাইকে ঝাপসা চোখে দেখছিল অন্বেষার হতভাগা পিতা। কাছে যাওয়ার সাহস তার হয়নি। সংসারে অশান্তির ভয়ে মেয়েটার ওপর তার দ্বিতীয় স্ত্রীর করা নির্যাতনে সে মুখে কুলুপ এটে বসেছিল। গাড়িটি অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত জলপূর্ণ চোখ সেদিক পানে তাকিয়ে ছিলেন। অতঃপর ফিরে গেলেন এক টুকরো জাহান্নামে। যেখানে অশান্তির অনলে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।

সাইমা, সাইফাকে ফোন দেওেয়া হলো বাবার আসার জন্য। সাইফা জানালো সে অনিকের সাথে মালদ্বিপ যাচ্ছে দুদিন বাদে। আর সাইমা তার মাস্টারকে নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত মধুচন্দ্রীমায় গিয়েছে। সে ঘোরাঘুরি পছন্দ করে। অথএব : তারা কেউই আসতে পারবে না। একটু মন খারাপ হলেও অন্বেষা খুশিও হলো। মেয়ে দুটো তাহলে সুখে শান্তিতে আছে।

সপ্তাহ খানেক পরের কথা। হঠাত সারফারাজ জানালো তারাও মধুচন্দ্রীমায় যাচ্ছে। সব তৈরী। দুদিন বাদে যাবে ইন শা আল্লাহ তারা। সারফারাজ অপরাধী স্বরে অন্বেষাকে বলল, “তোমায় নিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরতে যেতেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আমি একা হাতে সবদিক সামলিয়ে বিদেশ যেতে পারছি না। বিশ্বাস ভরসা করার মত মানুষও আমার নেই। তুমি কষ্ট নিও না বিবিজান। কথা দিলাম সময় সুযোগ হলেই আমরা দেশ বিদেশ ঘুরবো।”

অন্বেষা মুচকি হেসে প্রতিত্তোতরে বলল, “আপনি আমাকে যেভাবে রেখে খুশি থাকবেন আমি সেভাবে থাকতে রাজী। কোথাও না নিয়ে গেলেও আমি অখুশি হতাম না। আমার সুখ শান্তি সব আপনার জন্য এবং আপনার মধ্যে নিহিত। আমি সুখই আমার সুখ। আপনার পাশে আজীবন থাকতে পারাটাই আমার বড় পাওয়া। আর আপনাকে সন্তুষ্ট করে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারাটা হবে আমার সবচেয়ে বড় সাফল্য।”

অন্বেষার সারল্য মুগ্ধ করলো সারফারাজকে। সে পরম আদরে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো অন্বেষা। আচরণে বুঝিয়ে দিল অনেক কিছু। সারফারাজের উষ্ণ ছোঁয়া অন্বেষাকে ভরিয়ে তুলছে আদরে। ভাসছে সুখের সাগরে।

সুখ, শান্তি ভালোবাসা আজীবন থাকুক অন্বেষা সারফারাজের দাম্পত্য জীবনে।

………… -: সমাপ্ত :- …………

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *