প্রেমসন্ধি

–“এই মাথাপঁচা গরমে আপনি আমাকে কাতান শাড়ি পরতে বলেছেন তার উপর এখন আবার রিকশায় চড়ে যাবেন?বলি,আপনি কি পুরোপুরি গেছেন?”

আমার সদ্য গরম গরম তেলে ভাঁজা কন্ঠ শুনেও সামনের সাদা পান্জাবি পরিহিত সুঠামদেহী ব্যাক্তিটার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলোনা।উনি নির্বিকারচিত্তে রিকশায় উঠলেন।ডানপাশে চেপে বসে অগোছালো চুল হাঁতরে আরো অগোছালো করতে করতে বললেন,”একটু জলদি উঠুন।যেভাবে বিয়ে বাড়ির মতো সেজে এসেছেন মানুষজন ভাববে আপনাকে ভরা আসর থেকে পালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

আমি চোখে আগ্নেয়গিরি নিয়ে চাইলাম।মাথার উপর জলন্ত সূর্য।গরমে জান যায় যায় অবস্থা।এরমধ্যে লোকটার এহেন কমকান্ডে রাগে ঠোঁট কাঁপছে।রাগ উপশম করার উপায়ন্তর না পেয়ে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।লালপাড় সাদা-সোনালি রংয়ের কাতান শাড়ির সাথে মিলিয়ে গাঢ় লাল লিপস্টিক দিয়েছিলাম।সেগুলো বোধহয় উঠে দাঁতে লেগে গেছে।

এক-দুইমিনিট সেভাবেই কেটে গেলো।রাস্তার লোকজন আড়চোখে তাকাচ্ছে।রিকশাওয়ালা মামাও মনে হয় এখন বলে বসবে,”আপনারা অন্য রিকশায় যান,আমার দেরি হইতাসে।”

আমাকে ঠায় দাড়িয়ে থাকতে দেখে উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে কন্ঠে কিন্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বললেন,

—“উঠতে পারছেননা?আচ্ছা,হাতটা দিন।ধরে উঠাই।আপনি দেখছি কিছুই পারেননা।”

আমি হাত দিলামনা।একপলক আশেপাশে তাকিয়ে লোকজনের বাঁকা নজরগুলো পরখ করে নিলাম।অত:

পর দ্রুত উঠে বসলাম অসহ্যকর লোকটার পাশে।আমি উঠতেই উনি হাত সরিয়ে নিয়ে আরো একটু চেপে গেলেন।রিকশা চলতে শুরু করলো।আপনি থমথমে চেহারায় বসে আছি।বাবা কিভাবে এই হতবুদ্ধি লোকটার সাথে আমার বিয়ে পাকা করে ফেলেছে আমি ভেবে পাচ্ছিনা।শুনেছি টাকা পয়সা ভালোই আছে তবে গাড়ি না এনে এই গরমে রিকশায় যাওয়ার শখ কেনো হলো বুঝতে পারছিনা।

মা আসার সময় কড়া গলায় বলে দিয়েছেন,আহসানের সাথে কোনরকম উচ্চবাক্য করবিনা।তোর বাবার খুব পছন্দ ছেলেটাকে।উনার কানে গেলে এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে।আমি সাবধান করে দিলাম।আর তোকে তোর বাবার অনুমতি নিয়েই ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে।তাই লক্ষী মেয়ের মতো ঘুরেফিরে আবার ওর সাথে চলে আসবি।মনে থাকে যেনো।”

মিনিটপাঁচেক না পেরোতেই রিকশার হুটটা তুলে দিলেন আহসান।ফলস্বরুপ মধ্যকার দুরত্ব একটু কমে গেলেও মাথার উপর ছায়া পরে যাওয়ায় একটু যেন স্বস্তি মিললো।আমি ফুঁস করে শ্বাস ছেড়ে সামনের চুলগুলো কাঁধের পিছে দিতে দিতেই আহসান ঝুঁকে আসলেন আমার দিকে।আমি থতমত খাওয়া দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম।উনার চোখ আমার গলার দিকে।মূহুর্তেই যেন তুমুল অস্বস্তি ঘিরে ধরলো আমাকে।উনি চোখ সরিয়ে নিলেন।আরো একটু ঝুঁকে আমার পাশের হুট লাগানোর লোহার জিনিসটায় দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন,

—“আপনিতো ঘেমে নেয়ে একেবারে আইসক্রিমের মতো গলে যাচ্ছেন?দেখি সরুন,হুটটা আটকে দেই।”

আমি তৎক্ষণাৎ মাথাসহ শরীরটা একটু পিছিয়ে নিলাম।উনি হুটটা আটকে দিয়ে ঝুলে থাকা শাড়ির আচঁলটা কোলের উপর উঠিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললেন,”সামলে রাখুন,চাকায় পেঁচিয়ে যেতে পারে।”কথাটা বলেই সরে গেলেন ইনি।তারপর এতটাই চেপে বসলেন যে একটু ঝাকি দিলেই রিকশার বাইরে চলে যাবেন।

আমি খানিকক্ষণ ইততস্ত করলাম।তারপর নিজেই একটু চেপে যেয়ে মিনমিনে কন্ঠে বললাম,”জায়গা আছে,আপনি একটু এদিকে আসেন।পরে যাবেনতো।”

আহসান তাকালেন।সরাসরি চোখের মনিতে।আমি হুড়মুড় করে চোখ নামিয়ে নিলাম।কেনো নিলাম নিজেও জানিনা।আহসান বোধহয় ঠোঁট চেপে হাসলেন।তারপর বললেন,”আপনি আরাম করে বসুন চৈতি,আমার হুটহাট থুবড়ে পরার অভ্যাস নেই।”

শেষের কথাটা শুনতেই এতক্ষণ যেই বিন্দু পরিমাণ ভালোলাগাটা সৃষ্টি হয়েছিলো সেটাও যেনো কর্পূরের মতো উবে গেলো।উনারা যেদিন দেখতে আসলেন সেইদিন সবার সামনেই শাড়িতে পা বেজে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমি।আপু অবশ্য তাড়াতাড়িই উঠিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু মান সম্মানটাতো থুবড়ে পরার সাথে সাথে সেই মাটির সাথেই মিশে গিয়েছিলো।

সেইদিনের অপমান হওয়াটা সহ্য করতে পারলেও এই লোকটার কথা আমার সহ্য হলোনা।দাঁতে দাঁত চেপে আমি বলে উঠলাম,

—“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন।সেইদিনের ঘটনাটা নেহাতই একটা আ্যক্সিডেন্ট ছিলো।”

—“আমি তো কোনো ঘটনার কথা বলিইনি।জাস্ট বলেছি যে আমার পড়ে যাওয়ার অভ্যাস নেই তাই আপনি হাত পা ছড়িয়ে যেভাবে ইচ্ছা বসুন কোনো অসুবিধা হবেনা।”

আমি দ্বিগুন তেঁতে উঠলাম।চড়া গলায় বললাম,”আপনার অভ্যাস নেই মানেইতো বলতে চাচ্ছেন যে আমার অভ্যাস আছে?আমি কি ছোট্ট বাচ্চা যে কিছু বুঝিনা?”

উনি কোনরকম জবাব দিলেননা।শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আবার রাস্তার দিকে তাকালেন।এই পাত্তাহীন ভাবাটাই যেনো আগুন ধরিয়ে দিলো শরীরে।আমার এই একটাই সমস্যা।অল্পতেই রাগ উঠে যায়।এই সমস্যার কারণে আমি কারো সাথে মিশতে পারিনা।কেউ কিছু বললেই মাথা ধরে যায়।হুঁশ হারিয়ে চিল্লাচিল্লি করে ফেলি।

এবারো ব্যতিক্রম হলোনা।অন্য কোনো বিষয়ে না পেরে পূর্বের বিষয়টা নিয়েই চেঁচিয়ে উঠে বললাম,”আপনি আমাকে কাতান শাড়ি কেনো পরতে বলেছেন?আপনার জন্য আমার এতো গরম লাগছে।অসহ্যকর লাগছে।এই মামা রিকশা থামান।আমি নেমে যাবো।বাবা বকলে বকবে তবু আপনার সাথে আর একসেকেন্ডও না।আর বিয়েতো নয়ই।”

রিকশাওয়ালা মামা ঘাড় ঘুরিয়ে আহসানের দিকে তাকালেন।আহসান তাকে রিকশা চালিয়ে যাওয়ার ইশারা করে আমার দিকে চেয়ে আগের মতোই নম্র কন্ঠে বললেন,

—“আমি পরতে বলেছি বলেই আপনার পরতে হবে?আপনি পরেছেন কেনো?না পরলেই হতো।”

—“আপনি আমাকে জোর করেছেন।”

—“সিরিয়াসলি?আপনাকে জাস্ট একবার বলেছি যে কাল আসার সময় কাতান শাড়ি পরে আসবেন।আর সেটাও কোনো জোর গলায় বলিনি।নিত্তান্তই কোমল কন্ঠে বলেছি।আপনি হয়তো ভুলে গেছেন।ওয়েট আমার ফোনে সব কল রেকর্ড হয়।শোনাচ্ছি।”বলেই উনি পকেট থেকে ফোন বের করলেন।

আমি আবারো ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।লোকটা আসলেই আমাকে জোর করেনি।তবে আমি কেনো পরলাম?কি দরকার ছিলো?নিজের উপর একরাশ রাগ নিয়েই আমি আহসানের হাতের ফোনটা কেড়ে নিলাম।আহসান তাকালেন।আমি দ্রুত ফোনের মেইন বাটনে চাপ দিয়ে ওয়ালপেপারের ক্রিন এনে উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,”শোনা লাগবেনা।”

উনি হাসলেন।ফোনটা পুনরায় পকেটে ভরতে ভরতে সামনের দিকে তাকিয়েই স্বগতোক্তি করলেন,

—“আপনার বাবা ঠি কই বলেছেন।আপনাকে সামলানো চাট্টিখানি কথা না।”

_______________

রেস্টুরেন্টা বেশ নিরিবিলি।সবাই সবার মতো আছে।যদিও আশেপাশে জোড়ায় জোড়ায়ই বেশি দেখা যাচ্ছে।ফ্যামিলি নিয়ে আসা মানুষ নেই বললেই চলে।একপাশে পুরো কাঁচের দেয়াল দেয়া।সাড়ে তিনটা বাজে হয়তো।সূর্যের তাপ কমে এসেছে।একটা সরু সোনালি রেখা এসে পরেছে টেবিলের মাঝ বরাবর।

আহসান বসেছেন আমার মুখোমুখি।আমি প্লেটের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ খাবার খাচ্ছি।চামচ দিয়ে চিকেন ফ্রাইটা কাটতে পারছিনা বলে মেজাজ এবার সত্যিই চড়ে যাচ্ছে।এসির মধ্যেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

হঠাৎই আহসান ডাকলেন,

—“চৈতি..”

আমি তাকালাম।উনার ডাকটায় কি যেনো একটা ছিলো।ভেতরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেলো।মুখে একগাল খাবার থাকায় গাল ফুলে আছে।আমি দ্রুত খাবারটা গিলে নিলাম।আহসান পলকবিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার মুখের দিকে।আমার চোখ প্রশ্নাত্বক।লোকটা কি তাকিয়ে থাকার জন্য এভাবে ডাকলো?আমি মুখফুটে কিছু বলার আগেই উনি ছোট্ট করে বললেন,

—“আপনাকে সুন্দর লাগছে।”

আমি হাল্কা কেঁশে উঠলাম।খাবার টাতো সেই কখন গিলে ফেলেছি তাহলে এখন কি আটকালো গলায়?উনি পানি এগিয়ে দিলেন।আমি পানিতে চুমুক দিয়ে আবারো খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।চামচ আর প্লেটের সাথে একপ্রকার যুদ্ধ ঘোষণা করে চিকেন ফ্রাই থেকে মাংস ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম।এই রেস্টুরেন্টে এই একটা সমস্যা।বাসায় থাকলে এতক্ষণে হাত মাখিয়ে খাওয়া শুরু করে দিতাম।

হঠাৎই বুঝলাম আমি আহসানের দিকে তাকাতে পারছিনা।আচ্ছা,আমার কি কোনোভাবে লজ্জা লাগছে?

—“আপনি টমেটো চিনেনতো?”

—টমেটো কে না চেনে?”উনার দিকে না তাকিয়েই খাবার চিবাতে চিবাতে উওর দিলাম আমি।

—“আপনাকে না পুরো টমেটোর মতো লাগছে।এইযে গালদুটো পুরো পাকা পাকা লাল টমেটো।এই গরমের মধ্য  টমেটো খুবই মূল্যবান একটা জিনিস,বুঝলেন?”

আমি বিস্ফোরিত নয়নে তাকালাম।ঝাঁল ঝাঁল কন্ঠে বললাম,”আপনি কিন্তু..”

উনি আমাকে বাকিটা বলার সুযোগ দিলেন না।টেবিলের সাথে ঘর্ষণ করে হাল্কা শব্দ তুলে নিজের প্লেটটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,”আপনি এটা খান,মাংস ছাড়িয়ে দিয়েছি।”

আমি প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি মাংসটা ছোট ছোট করে ছিঁড়ে একপাশে জড়ো করে রেখেছেন।

বাকি খাবারগুলো আগের মতোই আছে।লোকটা এতক্ষণ খায়নি?আমিতো খেয়ালই করিনি।তাহলে করছিলো কি?আমরা এখানে এসেছি প্রায় আধঘন্টা পেরিয়ে গেছে।

আমি চামচ নাড়াচাড়া করতে করতে বললাম,

—“আপনি খাবেননা?”

উনি মুচকি হেসে আমার অর্ধেক খাওয়া এঁটো প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিলেন।বললেন,”আমার এতেই চলবে।আপনি জলদি শেষ করুন।সন্ধ্যার আগে বাড়ি পৌছে দিতে বলেছে আঙ্কেল।”

আমি ইততস্ত করলাম।ওদিকে আহসান দিব্যি আমার এঁটো খাবারটা মুখে পুরে নিয়েছেন।

বিকেল নেমে যাচ্ছে।সূর্য ডুবুডুবু।রাস্তার ধার ধরে হাঁটছি আমরা।আমাদের বাসার ওদিকে রিকশা যেতে চাচ্ছেনা।চায়ের দোকানের লোকগুলো আড়চোখে অনবরত দেখে যাচ্ছে আমাদের।বিশেষ করে আমাকে।

আমি গুটিগুটি পায়ে হাঁটছি।শাড়িতে যদি কোনোভাবে পা পেঁচিয়ে যায় তবেই শেষ।পাশ দিয়ে হাই স্পিডে একটা প্রাইভেট কার চলে গেলো।আরেকটু হলেই আমার গায়ের উপর উঠে যেতো।ভয়ের চোটে শক্ত করে আহসানের বাহু আঁকড়ে ধরলাম আমি।আহসান ঘাড় ফিরিয়ে একবার দেখে নিলেন।আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে হাতটা সরিয়ে নিলে গেলেই উনি অন্যদিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বললেন,

—“ধরে রাখুন।”

আমি যেন এই কথাটা শোনার অপেক্ষাতেই ছিলাম।উনি মুখ ফুঁটে তা বলে দিতেই বিনাদ্বিধায় খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম হাতটা।উনি হাসলেন।ঘাড় বাঁকিয়ে আমার চোখের দিকে চেয়ে বললেন,

—“এসেই পরেছি,মোড় ঘুরলেই হাজার হাজার রিকশা পাওয়া যাবে।আপনি এত ভীতু আগে জানলে আপনাকে ইটপাথরের রাস্তায়ই আনতাম না।প্লেন ভাড়া করে আকাশপথে ঘুরতাম।”

আমি বারকয়েক পিটপিট করলাম।রাগত কন্ঠে কিছু বলতে যেয়েও কেন যেন বলতে পারলাম না।হঠাৎই বুঝলাম আমার আর রাগ লাগছেনা।কেন যেনো রাগ উঠছেইনা।অদ্ভুত!এই রাগী-বদমেজাজি মেয়েটার রাগগুলো কোথায় উধাও হয়ে গেলো?

মোড় পেরোতেই রিকশা পেয়ে গেলাম।রাস্তাটা অনেক চলমান।একটু দাড়ালেই জ্যাম লেগে যাবে।রিকশাওয়ালা মামা তাড়া দিলেন।আমি শাড়ির কুঁচি ধরে তড়িঘড়ি করে উঠতে গেলাম।ঠিক তখনই পেছন থেকে আরেকটা রিকশা এসে সজোরে বারি খেলো আমাদের রিকশায়।রিকশা এগিয়ে গেলো অনেকটা।আমি বেসামাল হয়ে পড়তে গেলেই আহসান দ্রুত হাতটা ধরলেন।আমি সামলাতে পারলামনা।পরে গেলাম আহসানের উপর।আমাকে কোনরকমে জাপটে ধরলেও আহসান ঠাঁই পেলেননা।ফুটপাতের শক্ত ইটের সাথে কপাল ঠুকে যেতেই গড়গড় করে রক্ত বেরিয়ে এলো।উনি “উফফ” বলে আর্তনাদ করে উঠলেন।আমি হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায়ই দিশেহারা হয়ে উঠলাম।ততক্ষনে আমাদের ঘিরে জটলা বেঁধে গেছে।পেছনের রিকশার লোকটার সাথে মানুষের ঝগড়া লেগে গেছে।পরিস্থিতি উন্মাদ!

আমাকে অবাক করে দিয়ে আহসান আহত অবস্থায়ই কোনরকম বিলম্ব না করে উঠে দাড়ালেন।আমাকেও দাড় করিয়ে অস্থির কন্ঠে বললেন,

-“আপনি ঠিক আছেন?হাঁটুতে লেগেছে?”

আমি দু’পাশে মাথা নাড়ালাম।লোকটার রক্ত দেখে কান্না পেয়ে যাচ্ছে।আমার ছলছল চোখজোড়ায় চোখ পরতেই দ্রুত পকেট থেকে রুমাল বের করলেন উনি।কপালে চেপে ধরে ঝগড়া থামিয়ে রিকশাওয়ালা মামাকে বললেন,”মামা গাড়ি চলবেতো?” রিকশাওয়ালা মামা উওর দিলেন,”চলবো ভাই।”উনি দেরি না করে আমাকে উঠিয়ে দিতে দিতে বললেন,

-“আচ্ছা,আপনি সামনের কোনো ফার্মেসীতে চলুন,ভাঁড়া বাড়িয়ে দিবোনে।”

কাছেই একটা ফার্মেসী ছিলো।পৌছোতে বেশিক্ষণ লাগলোনা।ফার্মেসী যেয়ে কপাল থেকে রুমালটা সরাতেই কেঁদে উঠলাম আমি।এতক্ষণ রুমালটা রক্তে চুপচুপে হয়ে গেলেও সেটা কপালছাড়া করেননি উনি।হয়তো ক্ষত দেখে আমি কেঁদে ফেলবো সে জন্যই।

আমার কান্নার গতি বাড়তে দেখে উনি স্নেহপূর্ণ কন্ঠে বললেন,

—“আরে,কাঁদছেন কেনো?আমি ঠি ক আছি।”

আমি কোনোক্রমেই আটকাতে পারলামনা।সশব্দে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

—“কত রক্ত বেরোচ্ছে আর আপনি বলছেন ঠি ক আছেন?’

উনি মলিনভাবে হাসলেন।বললেন,”আপনি একটু চোখটা বন্ধ করে রাখেন।ব্যান্ডেজ করলেই রক্ত বন্ধ হয়ে যাবে।”

আমি চোখ বন্ধ করলামনা।অঝর ধারায় গাল বেয়ে জলপাত অব্যাহত রেখে উনার ব্যান্ডেজ করা দেখতে লাগলাম।লোকটার বারেবারে চোখ কুঁচকে ফেলাটাই জানান দিচ্ছে ঠি ক কতোটা যন্ত্রনা হচ্ছে উনার।

তবুও মুখফুটে ‘টু’ শব্দটাও করছেন না।

মাঝেই আমার ফোন বেজে উঠলো।আম্মু ফোন করেছে।উনি স্ক্রীনে ভেসে উঠা নামটা একপলক দেখে ফোনটা আমার কাছ থেকে টেনে নিলেন।রিসিভ করে কানে লাগিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

—“আসসালামু আলাইকুম আন্টি।চৈতি আমার সাথেই আছে।টেনশন করেননা।রাস্তায় একটু জ্যামতো।আধঘন্টার মধ্যেই পৌছে যাবো।”

ওপাশ থেকে আম্মুর কথাগুলো আমার কানে এলোনা।উনি মুচকি হেসে পুনরায় সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলেন।ততক্ষনে মাথার ব্যান্ডেজ করা শেষ।সাদা পান্জাবির কিছু কিছু অংশ রক্তে লাল হয়ে আছে।

উনি ফার্মেসী থেকে একটা একটা টিস্যুর প্যাকেট কিনে আমার হাতে ধরিয়ে বললেন,

—“ভালোকরে চোখমুখ মুছে নিন,আপনার বাবা দেখলেতো ভাববেন আমি আপনাকে মারধর করেছি।”

__________________

সন্ধ্যাবেলার মৃদু আলোছায়া সর্বত্র।বাড়ির সামনে রিকশা থামলো।আমি নেমে গেলাম।নামলেন উনিও।রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিলেন।আমি ভাবলাম উনিও সাথে আসবেন।তাই দরজার কাছ থেকে একটু সরে দাড়াতেই উনি হেসে বললেন,”আমি যাবনা,আপনি যান।”

—“রিকশা তো ছেড়ে দিলেন।এই রাস্তায় কি করবেন?”

—“একটু কাজ আছে এদিকে।আপনি ঢুকেন।”

আমি কথা বাড়ালামনা।গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই উনি ভরাট কন্ঠে ডেকে উঠলেন,

—“চৈতি,শুনেন?”

উনার একডাকেই ঘুরে দাড়ালাম আমি।কপালের ব্যান্ডেজ এর উপরও হাল্কা রক্ত ভেসে উঠেছে।কেনো যেন খুব কষ্ট হলো আমার।এতো কষ্ট বোধহয় নিজের জন্যও কখনো হয়নি।চোখটা আবারও ভিজে উঠেছে।উনি ধরা গলায় বললেন,

—“আপনি কি সত্যি সত্যিই বিয়েতে মানা করে দিবেন?”

আমি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আলতো হেসে উওর দিলাম,

—“মনে তো হয়না।”

সমাপ্ত.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *