‘‘সাতমাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন।সামনে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী অফিসের এক কলিগের সাথে হেসে-খেলে কথা বলে ব্যাগপত্র নিয়ে গাড়িতে উঠার তোড়জোড় করছে।অথচ কত সাধের ছিলো আমাদের সংসারটি।ক্ষণিকের ব্যবধানে নিকৃষ্ট সম্পর্কে জড়িত হয়ে আমার স্ত্রী তার ধ্বংস করেছে।শান্ত তবে ব্যথিত চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছি শুধু।কথা বলার মতো পরিস্থিতি-টুকুও নেই যে।ভারাক্রান্ত হৃদয় শুধু ধুকপুক করেই যাচ্ছে।আমার কোলে থাকা আমার অংশ ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটা অনবরত কেঁদে যাচ্ছে।যার ক্রন্দনধ্বনিতে হয়তো প্রকৃতিও কেঁদে চলেছে।তবুও একটুখানিও মন গলছে না নিষ্ঠুর তার মায়ের। একজন নারী নাকি তখনই সবচেয়ে সুখী হয় যখন সে মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করে।তবে এর প্রতিফলনটাও মোটেও দেখতে পায় নি কোনোদিন আমার স্ত্রীর মাঝে।অনেক্ষণ চুপ থেকেছি কাপা গলায় ডাকলাম, “ শারিন!”
শারিন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো তবে আমার ডাক শুনে থেমে যায়।হঠাৎ-ই ডাকটা কেমন কাপাকাপা শোনালো মনে হলো শারিনের।কিন্তু বিবেকবোধ হারানোতে পেছন ফিরে তাকায় না।আমি একপলক বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকায়।নিষ্পাপ মুখটা দেখেই পুরুষ শক্তি ভেঙ্গে চোখ দিয়ে জল গড়ায়।কান্নাভেজা গলায় বলি, “ থেকে গেলেও পারতে শারিন।মেয়েটা এখনও শিশু।আর…”
‘ভালোবাসি’ কথাটা বলতে চেয়েও বলতে পারিনি সেদিন।প্রেমের বিয়ে ছিলো।এইতো বিয়ের সবে দুবছর হয়েছে।এর মাঝেই বিচ্ছেদ কিছুতেই মানার মতো নয়।আমার মুখ দিয়ে আর কথা বেরোচ্ছিলো না।ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখছিলাম।এই কষ্ট কাউকে বোঝানোর মতো নয়।একদিকে ভালোবাসা অন্যদিকে নিজেরই বাচ্চা মেয়েটা।কি নিষ্ঠুর একটি সময়। নিয়তির ব্যথার্থ পরিণতি সহ্য করা দায় হয়ে যায় মনুষ্য জীবনে।অথচ শারিন কেমন শান্ত স্বরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় শুধায়, “ ডিভোর্স পেপার পেয়ে যাবে।আসি।”
কথাটুকু বলেই গাড়িতে উঠে পড়ে শারিন।শা করে মুহুর্তের মাঝেই গাড়ি চোখের পলকে চলে যায়।আমি আমার মেয়েটাকে নিয়ে মাটিতেই হাটু গেড়ে বসে পড়ি।আমি মোটেই নরম স্বভাবের ছিলাম না তবে সেদিন সমস্ত কষ্ট ছাপিয়ে কেঁদে দিয়েছিলাম।আমার মেয়েটাও আমার সাথে কেঁদেছিলো।বুঝতে পারি নি মা হারানোর কান্না নাকি অন্যকিছু।
দিন ঘুরতেই জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ের সম্মুখীন হই আমি।বাসায় কেউ নেই মেয়েটা ছাড়া। মেয়েটাকে নিয়েই জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েছিলাম। দিনরাত পরিশ্রম করেছি।তবুও বিয়ে নামক বস্তুত বিষয়ে আর জড়ায় নি কোনোদিন।ব্যথিত হৃদয়জুড়ে হাহাকারের বন্যা ছিলো শুধু।পুরুষের পক্ষে একা সন্তানকে মানুষ করা কষ্টসাধ্য।এই কষ্টকর জীবনে পাশে পেয়েছিলাম ছোট বোন রাশিকে।আমার মেয়েটাকে সারাদিন দেখে রাখতো সে।বিকেল হলে বাড়িতে চলে যেতো।নিজের বাড়িতেও পা রাখার মতো মুখ ছিলো না আমার।কারণ পরিবারের অমতেই বিয়েটা করায় বাবা মা ত্যাজ্য পুত্র করেছিলো।তবুও ছোট বোন নিজের সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে আমায়।সারাদিন খেটে এসে রাতে মেয়েটাকে সামলে মুখ চেপে মেয়েদের মতো কান্না করতাম। পুরুষের কান্না শোভা পায় না মোটেও তবে পরিস্থিতি যখন জঘণ্য তখন সকলকিছুই সয়ে নিতে হয়।
যুগ পেরিয়ে গেছে মেয়েটাও বড় হয়েছে।আমার মেয়েটা এখন একজন ডাক্তার।বাবা ছাড়া কিছুই বোঝে না।মেয়েটাকে কখনো তার মায়ের ছবি দেখায় নি আমি।তবে আমার মেয়েটাই যে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি হয়েছে।মেয়েটার দিকে মাঝেমাঝে তাকালেও খারাপ লাগে।অনুধাবনের ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকি ভালো বাবা হতে পেরেছি কিনা?তবে…’’
“ আশিন মা!”
হঠাৎ বাবার ডাক শুনতে পেয়ে তাড়াহুড়ো করে বাবার সেই ডায়েরিটা বন্ধ করে বাবা আসার আগেই যে জায়গায় ছিলো সেই জায়গায় রেখে দেয় আশিন। ওড়না দিয়ে চোখ দুটো মুছে রুমের বাইরে বেরিয়ে সদর দরজার সামনে যায় আশিন।রবিন মেয়েকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাসেন। অমায়িক সেই হাসি দেখে আশিনের খুব কান্না পায়। তার বাবা কত কষ্টই না সহ্য করেছে জীবনে। এক জীবনে এসব ভোলার মতোও নয়।মেয়ের চোখ দুটো লাল লাল দেখে রবিন উদ্বিগ্ন হয়ে শুধান, “কি হয়েছে মা তোর?চোখদুটো লাল কেন?কেঁদেছিলি নাকি?”
বাবার এমন কথাতেও আশিনের কান্না পায়।তবে কান্নাটুকু গিলে নিয়ে নরম সুরে বলে, “চোখে বালি ঢুকেছিলো তো তাই আর কি এমন দেখাচ্ছে।তুমি ভেতরে এসো।”
রবিনও মেয়ের কথা বিশ্বাস করে কদম ফেলে ভেতরে ঢোকেন।বাজারে গিয়েছিলেন রবিন।গ্রামে সপ্তাহে এই শুক্রবার দিনে সবচেয়ে বড় বাজার বসে। তাইতো সাপ্তাহিক প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু কিনে এনেছেন একেবারে। গ্রামে এসেছেন একমাস হবে। আসার কারণ হলো আশিনের শান্তিপুর গ্রামের সরকারি এক হাসপাতালে ট্রানস্ফার হয়েছে।মূলত এটা রবিনই করিয়েছে।কারণ শহরের পরিবেশ ছেড়ে জীবনের শেষ সময়গুলো এই গ্রামে কাটানোটা তার কাছে ভালো মনে হয়েছে।তাছাড়াও মেয়েটাও এর সাথে একমত।শহুরিক ব্যস্ত জীবনের চেয়ে গ্রাম্য জীবনটা বেশি ভালো লাগে আশিনের।তাই এই গ্রামে আসা।
“বাবা তোমার খাবার বেড়ে দিয়েছি, খেতে এসো তাড়াতাড়ি।”আশিন কাজ করতে করতে কথাটি বলে।
রবিনও কিয়ৎক্ষণ বাদে খেতে আসেন।তখনই কেউ দরজায় কড়া নাড়ে।বাবা মেয়ে একজন আরেকজনের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চাওয়া-চাওয়ি করে।আশিন ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে দরজা খুলে দিতেই একটা লোক হাপাতে হাপাতে বলে, “ডাক্তার আপা আপনে এহনি চেয়ারম্যান বাড়িত আহেন। চেয়ারম্যান কাকার মা অসুস্থ হইয়া পড়ছে।আপনে জলদি আহেন।”
আশিন তার বাবার দিকে তাকায়।তার বাবা সায় জানায়।আশিন নিজের ঘরে গিয়ে একটা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে মাস্ক পড়ে রওনা হয় লোকটির সাথে।যাওয়ার আগে বাবাকে খাওয়ার জন্যও বলে যায়।
লোকটি তাড়াহুড়ো করে হাটছে।নিশ্চয় গুরুতর কিছু ঘটেছে সেটা ঠাওর করতে পারছে আশিন। চেয়ারম্যান বাড়ি সে চেনে না।তবে চেয়ারম্যান বাড়ি সম্পর্কে হাসপাতালের নার্সদের থেকে শুনেছে। এলাকায় এখন বড় ডাক্তার যদি কেউ থাকে সেটা আশিনই হবে, তাইতো তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। বেশ অনেক্ষণ হেটে অবশেষে চেয়ারম্যান বাড়িতে পৌঁছায় তারা।লৌহ গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে লোকটি পেছন পেছন আশিনও যায়।ইতস্ততবোধ হচ্ছে তবে চোখেমুখে তা প্রকাশ পাচ্ছে না।এই প্রথম চেয়ারম্যান বাড়িতে এসেছে আশিন।নামডাক শুনলেও বাড়ির মানুষগুলোর মুখ দেখেনি কখনো। চারপাশে গাছগাছালির মাঝে সুন্দর দোতলা ভবন। আকর্ষণীয় বটে।আশেপাশে কয়েকজন লোক কাজ করছে হয়তোবা এই বাড়িতে কাজ করে তারা। আশিনের দিকে তাকিয়ে আছে যেন আশিন কোনো এলিয়েন।উদ্ভট এমন চাহনীতে আশিন ভীষণ অপ্রস্তুত। বাড়ির ভেতরে আসতেই লোকটি নিচতলার সিড়ির পাশের একটি রুমে নিয়ে আসে আশিনকে। রুমে এসে আরও বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আশিন। বিশাল বড় রুমটিতে মানুষজনে ভরপুর বলতে গেলে। যৌথ পরিবার হওয়ায় ছোট বড় সবাই আছে মনে হচ্ছে আশিনের আর তার দিকেই চেয়ে। তাদের মাঝে আশিনের চোখ গিয়ে পড়ে একজনের ওপর।মানুষটাকে সে চেনে।একবার দেখেছিলো হাসপাতালে।‘উচ্ছ’ নাম।চেয়ারম্যানের মেজো ছেলে।নামটা অবশ্য একজন নার্সই বলেছে আশিনকে।চোখ দুটো কেমন বিড়ালের মতো উচ্ছের।দৃষ্টিটা আশিনের দিকেই।আশিনকে দেখে একজন মহিলা কাছে এসে বলে, “ তুমিই ডাক্তার আশিন?”
মহিলাটির দিকে তাকায় আশিন।পোশাক-আশাকে আভিজাত্য।সুন্দর চেহারা।আশিন মাথা নাড়িয়ে বলে, “ জি আমি।”
“দেখোতো মা উনার কি হয়েছে।সকাল থেকে বেশ অনেকবার বমি করেছেন।হাত-পাও ঠান্ডা কেমন!”চিন্তিত স্বরে কথাটি বলে বৃদ্ধার কাছ হতে সড়ে দাড়ান মহিলাটি।
আশিন পরীক্ষণ করে দেখে। অজ্ঞাত সকলের মানুষের ভিড়ে নিজেকে কেমন নিঃসঙ্গ লাগছে তার।
“বেশি সমস্যা নয়।আমি ঔষধাদিগুলো লিখে দিচ্ছি। এগুলো ঠিকভাবে খেলে ঠিক হয়ে যাবেন।”কাগজে ঔষধপত্রের নাম লিখে দিয়ে সেগুলো সেই লোকটির হাতে তুলে দেয় আশিন।উঠে দাঁড়ায়।“আসি।” বলে বেরিয়ে যেতে নিয়ে মহিলাটি থামিয়ে দেয় আশিনকে।
“দাড়াও মা।”আশিনের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “তোমার টাকা..”
আশিন চোখ তুলে তাকায়।বাড়িতে গিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করলে সে কখনোই টাকা পয়সা নেয় না। তাই বলে, “না আন্টি এসবের প্রয়োজন নেই।”
তখনই অন্য একজন মেয়ে এসে আশিনের উদ্দেশ্যে বলে, “কেন দয়া দেখাচ্ছো নাকি আমাদের?এতো সাহস?”
আশিন হতবম্ভ হয়ে যায়।এমন চিন্তাধারা সে কল্পনাও করে না।মহিলাটি ধমকে ওঠে মেয়েটিকে, “মুখ সামলে কথা বলো।বাড়িতে কোনো সম্মানীয় কেউ আসলে কেমন ব্যবহার করতে হয় তুমি জানো না?এখান থেকে যাও।”
সবাই তাদের দিকেই তাকিয়ে।খুব বাজে একটি পরিস্থিতি যে সৃষ্টি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে এ বিষয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারে আশিন।তাই পুনরায় বলে, “ক্ষমা করবেন যদি কিছু ভুল বলে থাকি। তবে টাকা নেওয়াটা আমার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব।ভালো থাকবেন আপনারা।আজ আমি আসি।”
বলেই হাটা শুরু করে আশিন।কেউ কিছু বলে নি আর।তবে বাড়ি থেকে বেরোতেই পেছন থেকে কেউ ডাকে।আশিন পেছনে ফিরে চায়।উচ্ছ দাঁড়িয়ে।তার দিকে এগিয়ে আসছে।
“হাই ড. আশিন। আমি উচ্ছ তালুকদার।চলুন আপনাকে এগিয়ে দি।”
আশিন মাস্কের আড়ালে থেকে জবাব দেয়, “ধন্যবাদ আপনাকে তবে তার কোনো প্রয়োজন নেই।আমি যেতে পারবো।”
কথাটা বলেই হাটা শুরু করে আশিন।এদিকে পেছন থেকে উচ্ছ চেয়ে থাকে আশিনের দিকে।এই ডাক্তারকে সে প্রথম দেখছে।এর আগে কখনো দেখেনি।মুখটা দেখা না গেলেও চোখদুটো মায়াবী ভীষণ।আর ব্যবহারটা।সেটা কেমন এটিটিউডেড মনে হলো উচ্ছের।এরূপ ব্যবহারের শিকার খুব কমই হয়েছে সে।মেয়েটার গুরুগম্ভীর লুকায়িত ব্যবহারটা হঠাৎ ভালো লাগলো তার।বয়স তার থেকে বছর তিনেকের ছোট তো হবেই।মেয়েটার হেটে যাওয়ার দিকেই অপলক তাকিয়ে থাকে উচ্ছ।আগেও একবার দেখেছিলো তবে এতোটা ভালোভাবে খেয়াল করেনি। আজ খুব ভালোভাবেই খেয়ালে আসলো।পেছন থেকে নিজেও গম্ভীর স্বরে জোরে বলে ওঠে,
“সাবধানে যাবেন।”
আশিন শুনতে পেলো কি পেলো না এ বিষয়ে জানে না উচ্ছ।নিজের কাজে নিজেই চমকে যায় আবার।
চলবে.. ..