বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-০২]

চেয়ারম্যান বাড়িতে আজ উৎসবের আয়োজন চলছে।উৎসব বলতে তালুকদার পরিবারের বড় মেয়েকে আজ দেখতে আসবে বিকেলে।সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত।তবে এসব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে উচ্ছ।আর এক সপ্তাহই সে গ্রামে থাকবে তারপর শহুরে জীবনে ফিরে যেতে হবে। তাই এই এক সপ্তাহ আয়েশে কাটাবে ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়।দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই উচ্ছ বিরক্তিবোধ করে।উঁচু গলায় বলে, “ দরজা খোলা আছে।”

ভেতরে প্রবেশ করে উচ্ছ’র মা উষা এবং উচ্ছ’র মামাতো বোন নৌশিন।উচ্ছ খেয়াল করে নি তাদের। উষা ছেলেকে ব্যস্ত গলায় শুধান, “ উৎস কোথায়?”

ঠোঁট দিয়ে ‘উৎস’ নামটা একবার আওড়িয়ে জবাবে বলে, “ জানিনা।”

হালকা রেগে যান উষা, “ জানিনা মানে?ছেলেটা সারাদিন ঘুরে বেড়ায়।দিনে কয়বার দেখতে পায় তাকে এর নগণ্য হিসেবেও নেই।তোর সাথেই একমাত্র তার দেখা সাক্ষাৎ হয়।বিকেল হয়ে এলো ছেলেটার কোনো খোজ নেই।আর তুই বলিস জানি না?”

মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকাতেই আগে চোখ পড়ে নৌশিনের দিকে।নৌশিনের লাজুক হাসি দেখেই মাথা বিঘড়ে যায় উচ্ছের।এই বিরক্তিকর মেয়েটিকে মোটেও সহ্য হয় না নৌশিনের।এ আবার কখন এলো ভেবে পাচ্ছে না উচ্ছ।মুখ ঘুরিয়ে তার মা-কে বলে, 

“জানি না আমি।হয়তোবা ঘুরতে গেছে।”

উষা তার এই ছোট ছেলেকে নিয়ে বেশ চিন্তিত থাকেন।উচ্ছ আর উৎস যমজ দুই ছেলে তার।উচ্ছ শান্ত স্বভাবের হলেও উৎস ঠিক ততটাই অশান্ত, উশৃংখল, উগ্র মেজাজের, বখাটে স্বভাবের।এই ছেলেকে নিয়ে চিন্তার শেষ নেই তার।হনহনিয়ে উচ্ছের কক্ষ ত্যাগ করেন উষা।তবে নৌশিন নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে আছে।মুখে তার লাজুক হাসিটা এখনও বিদ্যমান।দাতে দাত চেপে একপলক তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলে, “ মা চলে গেছে, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?”

নৌশিন লাজুক স্বরে মাথা নির্লজ্জের মতো উচ্ছের দিকে তাকিয়ে বলে, “আসলে আমি আপনাকে কিছু বলতে..”

উঠে দাঁড়ায় উচ্ছ।কাজে ব্যস্ত থাকার ভান করে বলে, “ ব্যস্ত আছি।অন্য একদিন বলো।এখন যাও।”

নৌশিন আরও কিছু বলবে তার আগেই উচ্ছ হাত উচিয়ে ধমকে বলে, “ যেতে বলেছি তোমায়।”

নৌশিন এবার হয়তো কিছুটা অপমানিত বোধ করে। তাই ধীরে হেটে প্রস্থান করে।মনে মনে ঠিক করেছে মানুষটাকে সে হেনস্তা করেই ছাড়বে।দরজা ধরাম করে লাগিয়ে চলে যায় নৌশিন।উচ্ছ রেগে যায়।ভাবে মেয়েটাকে অন্য একদিন দেখে নিবে। ফোন হাতে নিয়ে উৎসের নাম্বারে কল করে।এই ছেলেটা যে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায় সারাদিন উচ্ছ ভেবে পায় না। শহরে লেখাপড়া শিখেও লাভ হলো কোথায়? যেখানে উচ্ছ ইঞ্জিনিয়ার সেখানে উৎস একটা বখাটে।কোনো কাজকর্মও করে না। কয়েকবার রিং হয়ে ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই এপাশ থেকে উচ্ছ গম্ভীর স্বরে বলে, “ কোথায় তুই? আজ বাসায় নিশিকে দেখতে আসবে ভুলে গেছিস?সারাদিন কোথায় থাকিস তুই?”

ওপাশে নিরবতা অন্যকিছুর লক্ষণ।উচ্ছ ভ্রু কুচকে ফোনটা কানেই দিয়ে রাখে।পাখির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।পাখির এতো কলকাকলি কোথায় শোনা এই জায়গাটার সাথে পরিচিত উচ্ছও।ওপাশে কল কেটে দেওয়া হয়।উচ্ছ ঠোঁট ফুলিয়ে ফোস করে একটা শ্বাস ছাড়ে।কালো শার্ট গায়ে জড়িয়ে রুম থেকে বেরোয়।উচ্ছের কাকি শায়লা উচ্ছকে কোথাও যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, “ কোথায় যাচ্ছো নাকি বাবা?”

 “ হ্যা ছোট মা একটু বাইরে যাচ্ছি।”

 “ আচ্ছা তাড়াতাড়ি চলে এসো।একটুপর কিন্তু এসে পড়বে ওবাড়ির লোকজন।”

উচ্ছ মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।যে যার কাজে ব্যস্ত থাকায় আর কেউ খেয়াল করে না তাকে।গাড়িতে করে যেতে চাইলেও পরক্ষণে ভাবে আজ হেটেই যাবে।মাঝে মধ্যে হেটে যাওয়া ভালো।শরীরের পক্ষে ভালো।

___

শীত আসছে।বাতাসে শীতকালের আগমনী ঘ্রাণ। সকালের দিকে এখন কুয়াশা থাকে হালকা হালকা।বিকেলের দিকে থাকে না।তবে বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় হেটে বাসায় যাওয়াটা বড্ড ভালো লাগে আশিনের।আজ সারাটাদিন কাজে মনোযোগ দিতে পারে নি।বাবার কথা খুব মনে পড়ছিলো।তার বাবার ফেলে আসা সেই কঠিন দিনগুলো যেন চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিলো।বাবার জন্য খারাপ লাগে আশিনের। আজ বাড়িতে গিয়ে বাবার জন্য প্রিয় খাবার রান্না করে দেবে ভেবে নেয় আশিন। হাসপাতাল থেকে আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছে। তবে এতক্ষণ হয়তো পৌঁছে যেতো।কিন্তু সে যে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে সে রাস্তায় উন্নয়নের কাজ চলছে।রাস্তা মেরামত করা হচ্ছে।তাই ব্যতক্রমী পথ বেছে নিতে হয়েছে।এ রাস্তা দিয়ে কখনো আসা হয়নি।কলিগদের কাছে শুনেছে এই রাস্তায় নাকি আবার বখাটেরা থাকে।এই কথাটা মনে পড়তেই বুক ভার হয় আশিনের।মনটা খচখচ কর‍তে থাকে। নিজেকে আত্মরক্ষা করার মতো উপস্থিতবুদ্ধি আশিনের আছে।একবুক সাহস নিয়ে হাটা শুরু করে । এই রাস্তায় একটি ব্রিজ আছে।ব্রিজের নিচ দিয়ে ছোট একটি খাল বয়ে গিয়ে নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর লাগছে আশিনের কাছে।এই প্রথমবার এই রাস্তা দিয়ে আসছে আশেপাশে তাকিয়ে তাকিয়েই যাচ্ছে।ব্রিজের কাছে আসতেই ব্রিজের ওপর একটি জিপগাড়ি দাড় করানো দেখতে পায় আশিন।সাথে ষষ্ঠধিক পুরুষালী তো হবেই।নিজেকে যথেষ্ট কঠিন রেখে মাথায় ওড়না ভালোভাবে দিয়ে মুখে মাস্কটা পড়ে নিয়ে হাটা শুরু করে আশিন।ব্রিজের ওপর আসতেই তাদের হাসাহাসির শব্দ শুনে।তবে তখনও পর্যন্ত তারা আশিনকে খেয়াল করে নি।আশিন তাড়াতাড়ি তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই পেছন থেকে কেউ ডেকে ওঠে।

 “ ওই মাইয়া!”

আশিনের দ্রুততম কদম মুহুর্তেই থেমে যায়।চোখ বুজে বড় করে এক শ্বাস নেয়।এলাকায় এদের সাথে আজ প্রথম দেখা।ঠিক করেছিলো কখনো এদের সামনে পড়বে না তবে আজ নিয়তি তাদের মুখোমুখি দাড় করালো তাকে।আর ভাষার কি অবস্থা ভেবেই বুঝে যায় ছেলেগুলো আসলেই চরম বখাটে লেভেলের হবে।আশিন পেছনে তাকায় না। আবারও কোনো পুরুষের আওয়াজ শোনা যায়।

 “ ওই মাইয়া আমাগোর দিক তাকাও।তোমার চাঁদ মুখখান আমরাও একটু দেহি।”

আশিন পেছন ফিরে তাকায়।একজন পুরুষ এসে আশিনের সামনে দাঁড়ায়।এক ভ্রু কুচকে বলে, “আমগোরে সালাম না দিয়া যাও ক্যান?”

আশিন স্ববেগে জবাব দেয়, “ দুঃখিত এমন নিয়মের সাথে আমি পূর্ব জ্ঞাত নই।”

সবাই আশিনের দিকে নজর দেয়।গাড়ির ফ্রন্ট সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকা পুরুষটা এতক্ষণ চোখ বুজে ছিলো, তবে মেয়েটার এমন কথা শুনে এবার যেন মজা পায় সে।ফিরে তাকায় মেয়েটার দিকে।

 “ আমার মুখের উপর কথা কও তুমি?তুমি জানো আমরা কেডা?”

 “ মুখের ওপর যেহেতু কথা বলেছি তাহলে অবশ্যই আমি জানি না আপনারা কারা?”

ফ্রন্ট সিটে বসা ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।দু হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙ্গে।ঠোঁটে থাকা সিগারেট-টা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষিয়ে দেয়। হেটে আসে আশিনের দিকে।আশিন মানুষটাকে দেখে চরম অবাক।এটাতো উচ্ছ। তবে সে যে বখাটে এটা জানতো না আশিন।গতকাল তো কি অমায়িক ব্যবহার ছিলো।কত রূপ এই মানুষটার ভাবতে থাকে আশিন।এরই মাঝে মানুষটি এসে বলে, “ ইন্টারেস্টিং মাল। ”

ঘৃণায় গা রি রি করে ওঠে আশিনের।ছি! কি বিশ্রি কথা।আশিনের মন চাচ্ছে এখনই একটা চড় মারতে। তবে এমন কিছু করলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি।পুরুষটি বাজে হাসি দিয়ে আশিনকে সর্বাঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে বলে, “ মাস্কটা একটু খোলোতো জান।”

 “ কেন মাস্ক-টা কি আপনার গায়ে শুরশুরি দিচ্ছে?”

হেসে ওঠে পুরুষটি।ওপাশে থাকা এক ছেলে বলে, “উৎস ভাই! কথার তেজ আছে কিন্তু।”

‘উৎস’ নামটা শুনে আশিন বিচলিত হয়।এই ছেলের নাম তো উচ্ছ।তাহলে উৎস হলো কিভাবে?নাকি বাড়িতে এক নাম বাইরে আরেক নাম।ছেলের যেই অবস্থা,মাস্তানের মতো এটা আর না হওয়ার কি?

উৎস নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বলে, “ তুমি উৎসের লগে বেয়াদবি করেছো নেও এহন আমার জুতাগুলা পরিষ্কার কইরা দাও নয়তো..”

পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করে আশিনের দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বলে, “ এইটা খাও।”

আশিন সহসা উত্তর দেয়, “ যদি একটাও না করি?”

উৎসের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি রিশাত বলে, “ এনেই জ্যান্ত পুইতা দিমু।”

আশিন মাস্কের আড়ালে হেসে ফেলে।আশিন হাসলে তার চোখও হাসে।আশিনের চক্ষুহাসি এড়োয় না উৎসের।আশিন রিশাতকে বলে, “ তাই নাকি?”

রিশাত আশিনের দিকে এগোতে যাচ্ছিলো উৎস থামিয়ে দিয়ে বলে, “ থাম শালা। এতো রক্ত গরম করিস ক্যান?এরা হইলো মাইয়া মানুষ।কোমলমতি নারী।”

আশিনের দিকে তাকিয়ে বলে, “ তোমার সাহস আছে মাইয়া।তবে এই সাহসিগিরি ভুল জায়গায় দেখাইলা। এর ফল তোমারে অনেক ভোগাইবো।নাও এহন তাড়াতাড়ি কাম শুরু করো।কোনটা করবা কও?”

 “ দুঃখিত আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই।এসব কিছু অন্যদের দিয়ে পারলেও আমার সাথে এরূপ ব্যবহার করার সাহস দেখাবেন না।”

কথাটুকু বলেই হাটা ধরে আশিন।পেছন থেকে উৎস এসে আশিনের হাত ধরে বসে।আশিন চমকে যায় সাথে রাগও তিরতির করে বেড়ে যায়।পেছন ফিরে হুট করেই একটা চড় বসিয়ে দেয় উৎসের গালে। উৎস হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে যায়।ছেলেগুলো সবাই চমকে ওঠে সাথে চেচিয়ে ওঠে।সবাই আশিনের দিকে তেড়ে আসে।উৎস থামিয়ে দেয়। উৎসের মস্তিষ্ক হিংস্র হলেও চোখে তার একাংশ ছাপ নেই।বরং বাকা হাসে।উৎসের এমন হাসিতে আশিন আরও বেশি রেগে যায়।রাগে বলে, “ সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার?অমানুষ, জানোয়ার কোথাকার।”

উৎস আশিনের দিকে আবারও এগিয়ে আসতেই কেউ ডেকে ওঠে সামনে থেকে।

 “ উৎস! ”

আশিনের পেছনে উৎসের সম্মুখে।উৎস বিরক্তিকর চাহনীতে চেয়ে দেখে উচ্ছ এসেছে।আশিন পেছন ফিরে একপলক তাকিয়ে দেখে আরেক উৎস।আশিন কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে।এক ছেলে দুই জায়গায় কিভাবে?পরক্ষণেই মাথায় নাড়া দেয়, এরা যমজ না-তো?হতেও পারে।উচ্ছ এগিয়ে এসে একবার আশিনের দিকে তাকাতেই চিনে যায়।আর বলে, “ড. আশিন আপনি?”

আশিন বুঝে যায় এটাই তাহলে ‘উচ্ছ’।আর সামনের ওই জানোয়ারটা ‘উৎস’।রাগ লাগছে আশিনের। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে তার ওপর এসব উগ্র ঝামেলা।আশিন প্রতিউত্তর না করে হাটা ধরলে পেছন থেকে উৎস বলে, “ চড়ের হিসাবটা তোলা থাকুক তাইলে?”

আশিনের পা থেমে যায়।এদিকে উচ্ছ কিছু বুঝতে পারছে না।হয়েছেটা কি?সে শুধু দেখেছে আশিন উৎসকে চড় মেরেছে।এটা নিয়েও সে এখনো ঘোরে আছে।এদিকে আশিন পেছনে ফিরে আত্মবিশ্বাসীর মতো বলে, “ আজ একটা মেরেছি।পরেরবার দেখা হলে  সংখ্যাটা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশি।”

বলেই চলে যায়।উৎসের বন্ধুগুলো ক্ষেপে উঠে এগিয়ে যেতে নিলেই উচ্ছ থামিয়ে বলে, “ কি করছিস কি তোরা?থাম?কি হয়েছে আমায় বল?আর ড. আশিনের হাত ধরেছিলি কেন?”

উৎস বিরক্ত হয়।দাতে দাত চেপে বলে, “ নাচার জন্য।কিন্তু ওই শালী বললো সে আমার সাথে নাচবে না তোর সাথে নাচবে।তাই রেগে গিয়েছিলাম।”

উচ্ছ বোকা বনে যায়।এখনো বুঝতে পারছে না হয়েছে-টা কি?উৎস আশিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট ছোট করে বলে, “ বাঘের গায়ে শুরশুরি দেওয়া ঠিক না।আমাদের আবার দেখা হবে তাহলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *