বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-০৪]

বিয়ে করছে না কেন?এই নিয়ে প্রতিবেশিরা আজকাল কথাবার্তা বলা শুরু করেছে আশিনকে। আশিন কিংবা রবিনের এ বিষয়ে মাথাব্যাথা না থাকলেও সমাজের লোকের কটু কথা কিন্তু ফূরোবার নয়।এদিকে আজকাল চলাচলেও বেশ কাঠখড় পোহাতে হচ্ছে আশিনকে।ওই বখাটে-টা দেখলেই ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয়।কাজ করতে করতে আজ রাত হয়েছে বেশ।এমন রাত হলে আশিনকে তার বাবা রবিন নিতে যায়।আজও এমন। বাবাকে চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখে ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠে আশিনের।বাবা বলে ডেকে উঠতেই রবিন ফিরে তাকান পেছনে।চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বিল পরিশোধ করে মেয়ে নিকট যান।মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,“ আজ কাজের চাপ বেশি ছিলো কি মা?”

“ গুরুতর আহত এক পেশেন্ট এসেছিলো হাসপাতালে। উনার অবস্থা খুব বাজে ছিলো।সার্জারি করাতে হয়েছে।তাই আর কি একটু দেরি হয়েছে।”

রবিন তৃপ্তির হাসি হেসে বলেন,“ আমার মেয়ে বড় ডাক্তার হয়ে গেছে।”

আশিনও হাসে।বাবা মেয়ে দুজনে হাটা শুরু করে। আশিন কিছু একটা প্রশ্ন করার জন্য উশখুশ করলেও পরক্ষণে আর জিজ্ঞাসা করে না।বাসায় এসে পৌঁছে রবিন মেয়েকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলেন।আশিন বুঝে যায় আজ নিশ্চয় তার বাবা তার জন্য রান্না-বান্না করে দিয়েছে।আশিনের খুব ভালো লাগে।তার বাবার রান্নার হাত দারুণ।তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসে আশিন।তার বাবা তার জন্য খাবার সাজিয়ে রেখেছে।দুজন একসাথে রাতের খাবার সেড়ে রবিন মেয়েকে বিদায় জানিয়ে ঘুমাতে চলে যায়।আশিন নিজের রুমে গিয়ে উপন্যাসের বই হাতে জানালার পাশে বসে পড়তে থাকে।হঠাৎ বাইরে থেকে কিছু একটার শব্দ সে শুনতে পায়।জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে তবে কিছু দেখা যায় না। এ ঘটনায় আশিন কিছুটা ভয় পায়।জানালা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে।একটা সময় ঘুমিয়ে যায়।

সকালে হাসপাতালে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে উচ্ছকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশিন।কিছুটা চমকে গেলেও তার বিন্দুমাত্র ছাপ মুখে প্রতিফলিত হয় না।বরং না দেখার ভান করে চলে যেতে নিয়েও থেমে যেতে হয়।

“ ড. আশিন!”

আশিন পেছন ঘুরে তাকাতেই উচ্ছ এগিয়ে আসে। হাসিমুখে বলে,“ আসলে আমার ভাই-টা ইদানীং আপনাকে বেশ জ্বালাতন করে।এর জন্য ক্ষমা করবেন।”

আশিন ভ্রু কুচকায়,“ প্রথমত আমায় বারবার ড. আশিন বলবেন না।আশিন বললেই চলবে।আর আপনার ভাই একজন সাইকো তাকে যতদ্রুত সম্ভব মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করান।”

কেশে ওঠে উচ্ছ।এই কথাটা যদি উৎস শুনতো তাহলে নিশ্চয় এখন আবার ঝগড়া লেগে যেত দুজনের মাঝে।হালকা মাথা দুলিয়ে কথা ঘুরিয়ে বলে,“ হাসপাতালে যাচ্ছিলেন বুঝি? চলুন একসাথে হাটি।আমিও আজ একটু হাসপাতাল পরিদর্শন করে আসি।”

আশিনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানা করতে পারে না। হাসপাতাল যেহেতু উনার দাদুর তৈরি করা তাই তার মানা করার মতো কোনো কারণ ও তো নেই।আর বারণ করবেই বা কোন কারণে।চুপচাপ হাটা শুরু করে আশিন।দুই ভাইয়ের মাঝে উচ্ছ নামক প্রাণীটা ভদ্র হলেও অন্যটা অভদ্র।এদের হাত থেকে কবে যে রেহায় পাবে সেই আশায় মত্ত আশিন।

পাশাপাশি হাটছে দুজন।উচ্ছ আড়চোখে একবার আশিনের দিকে তাকিয়ে স্মিত আওয়াজে প্রশ্ন করে,“ শহরে এতো ভালো ভালো হাসপাতাল থাকতে এই গ্রামে কেন আসলেন?”

প্রশ্নটা শুনে আশিন ভাবতে থাকে।মানুষজন এই একটা প্রশ্ন সবসময়ই তাকে করে থাকে।উত্তরটা সাজিয়ে বলতে না পারলেও আশিন বলে,“ শহরে যেহেতু ভালো হাসপাতাল আছে তার মানে ভালো ডাক্তারও আছে।গ্রামে সেসব নেই তাই আমি এখানে।”

উত্তরটা শুনে উচ্ছ সন্তুষ্ট হয়।প্রাণোচ্ছল হাসি দিয়ে আবারও বলে,“ আপনি তো তাহলে অনেক ভালো মনের মানুষ?”

“ কেন শহর থেকে গ্রামে এসে ডাক্তারি করলেই কি ভালো মানুষ হয়ে যায় নাকি?”

উচ্ছ ভ্যাবাচ্যাকা খায়।প্রসংশা করেছে সে কিন্তু উত্তরটা এমন প্রত্যাশা করে নি মোটেও।মাথা নাড়িয়ে বলে,“ না এমনটা না আসলে।”

আশিন নিজের মতো হেটে চলেছে।হাটার গতি কিছুটা দ্রুত।উচ্ছও আশিনের মতো হাটার চেষ্টা করছে।হাসপাতালের কাছে আসতেই উচ্ছ বলে,“ আমার বোনের কিছুদিন পর বিয়ে।আসবেন কিন্তু।দাওয়াত রইলো।”

আশিন থামে।লোকটার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না তার।তবুও বলে,“ ধন্যবাদ বলার জন্য।তবে আমি যেতে পারবো না।”

কথাটা বলেই হাসপাতালের ভেতর চলে যায় আশিন। উচ্ছ থেমে যায়।দাঁড়িয়ে আশিনের যাওয়া দেখে। মেয়েটা অন্যদের থেকে আলাদা।যেখানে মেয়েরা উচ্ছের সাথে কথা বলতে চায় সেখানে উচ্ছই আশিনের সাথে আগে আগে কথা বলেছে।কিন্তু আশিনের উত্তরগুলো মনমতো হয়নি উচ্ছের। হাসপাতালের ভেতর না ঢুকে অন্য রাস্তায় হাটা ধরে উচ্ছ।ব্রিজের কাছে আসতেই দলবলসহ উৎসকে বসে থাকতে দেখে।মূলত আজ উৎসের থেকে আশিনকে বাঁচাতেই উচ্ছের আজ এত সকাল সকাল বাড়ি থেকে বের হওয়া।হেটে গিয়ে জিপের ওপর উৎসের পাশে বসে থাকা নিহালকে চোখ দিয়ে ইশারা করে সড়তে।নিহাল সড়তেই সেখানে বসে পড়ে উচ্ছ। উৎস আকাশের দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের ফাঁকে একটা সিগারেট।পাশ থেকে রিশাত উচ্ছের উদ্দেশ্যে বলে,“ ভাই আপনি মাইয়াডারে কি আজ বাচাইবার চাইছিলেন আমগোর থেইকা?”

চোখ তুলে রিশাতের দিকে তাকায় উচ্ছ।দাতে দাত চেপে বলে,“ আশিনকে কোনোদিন ডিস্টার্ভ করবি না তোরা।আমি বলে রাখলাম।আমি গ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর তো একদমই নয়।”

“ আমরা নাহয় কিছু কমু না।কিন্তু উৎস ভাই।”

উচ্ছ উৎসের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,“ উৎসও করবে না।”

উৎস নিরুত্তর।যেন তার আশেপাশে কেউ নেই।শুধু সে একাই মানুষ।উচ্ছ’র উদ্দেশ্যে এবার নিহাল বলে,“ ওরা নাহয় কিছুই বলবে না কিন্তু তোর ভাই?তোর ভাইকে বিশ্বাস করিস তুই?”

“ তুই আছিস কেন তাহলে?শুধু মেয়েদের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকলে চলবে না শালা।উৎসকে সংযত রাখবি।হতে পারে ডাক্তারটা তোদের ভবিষ্যত ভাবি।”

পাশ থেকে শাওন বলে,“ কার উৎসের বউ হইবো নাকি?” উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে,“ কিরে উৎস তুই তো কিছু কইলি না আমাদের।”

উচ্ছ দাত কিড়মিড় করে বলে,“ চুপ থাক শালা।উৎসের কেন হতে যাবে?”

লাজুক হেসে উচ্ছ বলে,“ আমার বউ হবে।”

উচ্ছ’র হঠাৎ ভালো লাগতে শুরু করলো।পাশে থাকা সবাই হেসে দেয়।শুধু উৎস নিরব।তার মাঝে কোনো ভাবাবেগ না থাকলেও কপাল সুবিন্যস্ত ভাবে কুচকানো।সবার এমন গা জালানো হাসি শুনে উচ্ছ মুখ কুচকে জিজ্ঞাসা করে,“ সমস্যা কি?হাসছিস কেন?”

রিশাত বলে, “ ভাই আপনে অনেক হাস্যরসিক মানুষ?আমগোরে কেমন হাসাইবার পারেন।”

“ তোর এটা হাস্যকর বিষয় মনে হচ্ছে?ফিউচারে দেখতে পাবি।থাক তোরা।”

বলেই গাড়ি থেকে নেমে চলে যায় উচ্ছ।এই বখাটে গুলোর সাথে সে আর থাকবেনা ভেবে মনস্থির করে। তবে নিহাল হলে অন্যকথা।ছেলেটা বখাটে নয়। সঙ্গদোষে লোহা ভাসলেও নিহাল ভাসে না।শুধু মেলামেশা করে।

___

বিকেলের দিকে রান্নাবান্না করছিলো আশিন।আজ আসার সময়ও ফেরাউনের দলগুলোকে দেখতে পায় নি।মনে মনে হাফ ছেড়ে বেঁচেছে সে।বিনা বাধায় আসতে পেরেছে।তার বাবা বসার ঘরে বসে বসে খবর পড়ছেন।হঠাৎ তার বাবার কথার আওয়াজ শুনতে পায় আশিন।কারোর সাথে কথা বলছেন রবিন সাহেব।এ সময়ে কে আসতে পারে ভাবতে থাকে আশিন।মুহুর্তেই তার বাবার হাঁক শুনতে পায় আশিন।

“ আশিন মা, ও আশিন মা!”

আশিন তাড়াহুড়ো করে হেটে গিয়ে বসার ঘরের সামনে আসতেই হতবম্ভ হয়ে যায়।ঠোঁট দুটো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,চোখে তার বিস্ময়।অপর পাশে তারই দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকা উৎসের হাবভাব বোঝা যাচ্ছে না।তবে দৃষ্টি তার আগের দিনের তুলনায় বহু শীতল।দুজনের দৃষ্টির মিলন হলেও উৎসই আগে সড়িয়ে নেয়।আশিন ভাবছে লোকটা তার বাড়িতে এসেছে কেন?সাথে চ্যালাপ্যালাগুলোও আছে।ঝগড়া করতে এসেছে নাকি আবার?তাহলে আশিনও পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করবে ভেবে ঠিক করে নেয়।আশিনকে দেখে তার বাবা বলে,“ উৎস বাবার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আয় মা।”

উৎস আড়চোখে আশিনের দিকে তাকিয়ে আবারও রবিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলে,“ না আঙ্কেল তার প্রয়োজন নেই।”

“ এ কেমন কথা বাবা।তুমি আজই আমাদের বাড়িতে এলে কিছু খাবে তারপর যাবে।”

আশিন মুখ ঝামটা মেরে ভেতরে চলে যায়।তার এমন কাজে নিহাল,শাওন,বিশাল মুখ টিপে হাসে। উৎসও দেখেছে তবে সে চুপচাপ।রবিন সাহেব বলেন,“ তা বাবা আজ হঠাৎ আমাদের বাড়িতে কি মনে করে?”

“ আসলে আঙ্কেল আমার ছোট বোনটার তিনদিন পর বিয়ে।বাবা আপনাদের নিমন্ত্রণ করার জন্য পাঠিয়েছে আমায়।”

“ ওহ আচ্ছা আচ্ছা।”

আশিন এসে টেবিলে খাবারগুলো অনিচ্ছুকভাবে ঠাস করে শব্দ করে রাখে। তার সামনেই উৎস বসে আছে।তার দিকেই নিষ্পলক তাকিয়ে।আশিন উৎসের চোখে চোখ রেখে দাতে দাত পিষে আস্তে করে বলে,“ পেট ভরে খা তারপর চলে যা।”

কথাটা বলে চলে যায়।রবিন সাহেব নিহালের সাথে কথা বলছিলেন তাই শুনতে পান নি মেয়ের কথা। তবে আশিনের এমন কথা শুনে উৎস হেসে দেয়।পাশে বসে থাকা উৎসের দিকে তাকায়।উৎস সহজে হাসে না।বিশাল আর শাওন একে অপরের দিকে তাকায়।চোখ দিয়ে দুজন ইশারায় কথা বলে।তবে ব্যাপারটা অস্পষ্ট।রবিন সাহেব বলেন,“ খাও বাবা।”

উৎস কিছু খাবার মুখে তুলে।বাকিরাও একই অবস্থা তারপর কিছু কথা বলে চলে যায় তারা।তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে শাওন বিদ্রুপ করে বলে,“ মেয়েটির ব্যবহার দেখেছিস?”

বিশাল বলে,“ ব্যবহার খারাপ হলেও সুন্দর আছে মেয়েটা।”

উৎস আড়চোখে বিশালের দিকে তাকায়।তবে কিছু বলে না।গাড়িতে উঠে বসে চারজন।মুহুর্তেই চোখের আড়ালে চলে যায় গাড়িটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *