রিপোর্ট হাতে নিজের কেবিনে বসে আছে রূপক। একটু আগেই লাশগুলোর রিপোর্টগুলো এসেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে লাশগুলোর ভেতরে বিষ পাওয়া গিয়েছে।কিন্তু লাশগুলোর বিকৃত মুখাবস্থা এমন ছিলো যে মনে হচ্ছিলো খুব নিকৃষ্টভাবে মারা হয়েছে বৃদ্ধগুলোকে।রূপক বেশ চিন্তিত।শান্তিপুর গ্রামে নামের মতোই শান্তি বিরাজমান।তবে হঠাৎ করেই এই লাশের ঘটনা নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছে গ্রামে।
রূপক লাশগুলোর অন্য আরেকটা রিপোর্ট হাতে নেয়।যেখানে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে গ্রামের পুলিশ স্টেশনে এমন মানুষ হারিয়ে যাওয়ার কোনো কমপ্লেইন রিপোর্ট খুজে পায়নি। মানুষগুলো যে এই গ্রামের নয় এটা নিয়ে নিশ্চিত রূপক।তবে এখন তাকে অন্য গ্রামে-গঞ্জে খোজ নিতে হবে।দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে রাত ১১টা বাজে।এখন বাড়িতে যেতে হবে।কাল বাদে পরশু চাচাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান।অনুষ্ঠানে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এ নিয়েও কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে রূপককে।রূপক বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠে বসে।
চেয়ারম্যান বাড়ি আজ নতুন রূপে সেজেছে।বাড়িটা আয়তাকারে বেশ প্রশস্ত।চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে আরেকটু দূরেই গেস্টহাউজ।অশোক তালুকদার তাদের বাড়িতে আসা অতিথিদের জন্য সেই বাড়িটি নির্মাণ করেছেন।মেয়ের বিয়েতে আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গিজগিজ করছে সারাদিন।অনেক সুন্দর ভাবে লাইটিংও করা হয়েছে।বাড়ির সকলেই কাজে ব্যস্ত কয়েকদিন ধরে।বাড়ির ঠিক সামনেই গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়ে রূপক।ছুটির মৌসুমেও বাড়িতে আসা হয় না তার।কারণ তার চাচাতো বোন।চাচাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষেও না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।তবে গ্রামের সেই লাশের ঘটনায় তার চাচা তাকে ডেকে পাঠালেন।অন্তত আর কোনো এক্সকিউজ দিতে পারে নি রূপক।এখন যতদিন না কেইস সলভ হয় ততদিনই থাকার জন্য আদেশও পেয়েছে ওপরমহল থেকে।গাড়ি থেকে নেমে সদর দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকে।মানুষজনে ভরপুর বাড়িতে। আত্মীয় -স্বজনদেরও দেখা যাচ্ছে বসে বসে খাচ্ছে তো কিছুজন কাজ করছে।তাদের পেরিয়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার আগেই কেউ পথ আটকে দাঁড়ায়।চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে কল্পনা দাঁড়িয়ে।কল্পনাকে দেখে রূপক জিজ্ঞাসা করে,“ কি চাই?পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“ রূপ ভাই তুমি আজ এসেছো অথচ আমি জানলাম একটু আগে।এমনটা কেন?”
কথায় স্পষ্ট উৎকণ্ঠা এবং কষ্ট বিদ্যমান।রূপক ভাবে কল্পনার সামনে বেশিক্ষণ থাকা যাবেনা।মেয়েটা যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। মেয়েটার হাবভাব দেখে বোঝা যায় সে রূপককে পছন্দ করে।তবে রূপক তাকে সবসময়ই নিজের বোনের চোখেই দেখেছে।বিয়েটা যেদিন ঠিক হলো সেদিন নাকি অনেক কান্নাকাটি করেছে।পালিয়ে যাবারও চেষ্টা করেছে।তবে তার বাবা মায়ের হুমকিতে পরে কিছু করতে পারেনি।অবশ্য রূপকেরও এ বিষয়ে কিছু করার নেই।মেয়েটার জন্য যোগ্য পাত্র ঠিক করা হয়েছে,সুখে থাকবে।কিন্তু মূল কথা হলো মনেরও বোঝাপড়ার একটা বিষয় আছে।অনার্স শেষ বর্ষে পড়ছে বাচ্চা মেয়ে নয়। আবেগের বয়সও নয়।মেয়ে মানুষ ছেলেদের থেকে বেশি ম্যচিউর হয়।রূপকের ধারণা বিয়ের পর কল্পনা নিজের ভালো নিজেই বুঝতে পারবে।মেয়েটার থেকে সবসময়ই পালিয়ে এসেছে।অন্তত খারাপ কিছু হোক বা কল্পনা কষ্ট পাক এমন কিছু চায় নি রূপক।কল্পনা তাকে পছন্দ করে এ বিষয়ে বাড়ির সবাই জানে। নিজেকে সংযত রেখে রূপক বলে,“ কাল বাদে পরশু তোর বিয়ে।এখনও রাত জেগে কি করছিস?যা ঘুমিয়ে পর।পরে কথা হবে।আমি খুব টায়ার্ড।”
কথাটা বলে কল্পনার পাশ ঘেষে চলে ওপরে উঠে যায় রূপক।ওপাশে উষা থাকায় কল্পনাও রূপককে আর কিছু বলতে পারে না।রুমের সামনে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচে রূপক।রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে পেছনে তাকাতেই কিছুটা চমকে যায় উৎসকে দেখে। উৎস আপেল খাচ্ছে খুব আয়েশি ভঙ্গিতে।ফোনটা খাটের ওপর ছুড়ে দিয়ে উৎসকে জিজ্ঞাসা করে,“ তুই এখানে?”
আপেল খেতে খেতেই উৎস জবাব দেয়,“ তোকে দেখতে এলাম।”
“ এলাম না বল এসেছিলাম।”
আপেলে আরেকটা বড়সড় কামড় দেয় উৎস,“ আমাকে ব্যাকরণ শেখাচ্ছিস?”
“ না।”
রূপক টাওয়াল হাতে নিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে যেতেই উৎস বলে,“ লাশগুলো ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছিস?”
রূপক থেমে যায়।সোজাসাপ্টা জবাব দেয়,“ লোকগুলো এই গ্রামের নয়।”
উৎস উঠে দাঁড়ায়।এই গ্রামের নয় মানে অন্য গ্রামের। তবে কে অন্য গ্রামের লাশ এই গ্রামে এসে ফেলে দেবে?আর খুনিটাই বা কে?উৎস প্রশ্ন করে,“ খুনিটা কে বলতো?”
“ খুনি যেই হোক রিপোর্ট নিয়ে আমি সন্দিহিত।”
“ এমন সন্দেহ কেন?”
রূপক উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে,“ লোকগুলোর শরীরের অবস্থা আমিও একটু দেখেছি কেমন বিকৃত ছিলো তবে রিপোর্টে লেখা আছে বিষ পানে মৃত্যুবরণ করেছে।”
উৎস কিছু একটা ভাবে।এই লাশ নিয়ে গ্রামে তোলপাড় শুরু হয়েছে অনেক।তাই রূপকের কাছে তথ্য জানতে এসেছিলো।কে করেছে এই খুন?এই গ্রামের নাকি অন্য গ্রামের?উৎস কিছু না বলে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই রূপক বলে,“ তোর সাহায্যের প্রয়োজন হতে পারে আমার।”
ঘাড় বেঁকিয়ে পেছনে ফিরে চায় উৎস।একটা হাসি দিয়ে চলে যায়।রূপকও ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।
উৎস সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।বিষয়টা কেউ খেয়াল করে না।গাড়ি নিয়ে সোজা কোথাও চলে যায়।
জায়গাটা নির্জন।জঙ্গলের ধারপ্রান্তে।শান্তিপুর গ্রামের এই জঙ্গলের কাছে বসতি একদমই নেই।গাড়িটা সেখানে রেখেই উৎস হেটে যায় জঙ্গলের ভেতর দিয়ে।ফোন বের করে নিহালের নাম্বারে ডায়াল করে।ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই উৎস বলে,“ জঙ্গলে আয়।”
ওপাশ থেকে নিহাল কিছুটা চমকিত ভাবে জবাব দেয়,“ এতো রাতে জঙ্গলে।”
“ আসতে বলেছি আয়।”
কল কেটে আবারও হাটা শুরু করে উৎস।
___
হাসপাতালে নিজের কেবিনে বসে কিছু রোগীর রিপোর্টস দেখছিলো আশিন।সেসময়ে সরাসরি ভেতরে প্রবেশ করে রূপক আর তার সহকারী অফিসার তৌশিক।আশিন ভাবে নি যে এই অফিসার এমন অভদ্র হবে।সরাসরি কেউ এভাবে না বলে ঢুকে পড়ে নাকি?আশিন আবারও নিজের কাজে মন দেয়।রূপক ওপাশে থাকা সোফায় বসে পড়ে।হালকা কেশে আশিনের দিকে একবার তাকিয়ে ডেকে ওঠে,“ ড. আশিন!”
আশিন উত্তর দেয় না।ভাবটা এমন সে ছাড়া কক্ষতে কেউ নেই।রূপক এবার সরাসরিই বলে,“ আপনাদের রিপোর্টসে কোনো ভুল ছিলো কি?”
আশিন এবারও জবাব দেয় না।রূপক খানিক রেগে গেলেও শান্তভাবেই বলে,“ আপনাকে কিছু প্রশ্ন করছি মিস।”
আশিন এবার মাথা তুলে জবাব দেয়,“ প্রথমত নক না করেই আপনি আমার কেবিনে ঢুকে পড়েছেন।এবং দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে পোস্টমর্টেম আমি করিনি যে আমায় রিপোর্টসের কথা জিজ্ঞাসা করছেন।”
“ যেই ডাক্তার করেছে উনি আজ আসেননি।”
“ তো?”
রূপক বেশ দাম্ভিকের সাথে বলে,“ উনি অসুস্থ।তাই আমরা বাধ্য হয়ে আপনার কাছে এসেছি।নয়তো কোনো ইচ্ছে ছিলোনা এখানে আসার।”
“ ঠিক আছে তাহলে চলে যান অফিসার।”
“ উত্তরটা কিন্তু পায় নি।”
দরজার সামনে থেকে কেউ বলে ওঠে,“ আহা রূপক। ড. ম্যাম জানেনা যখন এতো জেরা কেনো করছিস?চলে আয়।”
আশিন দরজার সামনে তাকিয়ে দেখে উৎস দাঁড়িয়ে। আশিন বেশ ক্ষেপে যায়।তবে তার মুখে সে অভিব্যক্তির ছাপ নেই।রূপকও উৎসকে এই সময়ে এই হাসপাতালে দেখে অবাক হয়েছে।আশিন ভালোভাবেই বলে,“ আমার কেবিনটা কোনো পাব্লিক কেবিন নয়, যে অনুমুতিবিহীন আসবেন আর আমায় প্রশ্ন করবেন।ভদ্রতা বজা রাখা আবশ্যক।”
উৎস হেসে বলে,“ আমি খুবই অভদ্র এসব ভদ্রতা আমায় নিয়ে হয় না ড.।”
“ তাহলে আমার সামনেই আপনি আসবেন না। আমিও এমন অভদ্রদের খুব একটা সহ্য করতে পারি না।”
রূপক শুধু তাদেরই কথা শুনছিলো।এবার উঠে দাঁড়িয়ে আশিনকে বলে,“ ড. আশিন আমরা আবারও সত্যিকারের রিপোর্ট চাই।আজকের মধ্যেই।মাথায় রাখবেন।”
কথাটা বলে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে আশিন বলে,“ অন্য কাউকে বলুন অফিসার আমি পারবোনা।এই কাজটা যেহেতু অন্য একজন করেছে আমি এর মধ্যে ঢুকতে যাব না।”
রূপক দাতে দাত চাপে।উৎস মুখ টিপে হাসে।রূপক আর তার সহকারী বেরিয়ে যায়।তবে উৎস সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়।আশিন একপলক উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে,“ আপনাকে কি আলাদাভাবে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে হবে?”
উৎস একহাত পকেটে গুজিয়ে বলে,“ চাইলে করতে পারো।তবে তার দরকার নেই।আচ্ছা ড. ফুলকপি মজা ছিলো তো?আগামীকাল আমাদের বাড়িতে আমার বোনের বিয়ের দাওয়ার খেতে আসবে কিন্তু।তুমি যেহেতু বিশিষ্ট ডাক্তার এই গ্রামের তোমাকে স্পেশাল অপর্চুনিটি দেওয়া হবে।”
“ অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।তবে আমি যেতে ইচ্ছুক নই।”
উৎস জানে উত্তরটা এমনই হবে। চলে যেতে নিয়েও আবার কদম থেমে যায়।পেছনে না ফিরেই আবার বলে,“ সাবধানে থাকবে আশিন।আমার নজরে তুমি বেশ বাজেভাবে পড়েছো।বলাবাহুল্য পরবর্তীতে এই নজর অন্যকিছুতে পরিণত হতে বেশি সময় লাগবে না।”
কথাটা বলেই বেরিয়ে যায় উৎস।আশিন সেসবে পাত্তা দেয় না।সে নিজের কাজে ব্যস্ত।উৎস হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে উচ্ছ আর রূপক কথা বলছে।উৎস ভাবছে এই উচ্ছ আবার এখানে কেন এসেছে?এগিয়ে যেতেই উচ্ছ তাকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে যায়।তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করে,“ তুই এখানে কি করছিস?”
উৎস দুহাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে বলে,“ গতকাল ড. আশিন আমায় হাসপাতালে এসে তার সাথে এক-কাপ চা খাওয়ার জন্য ইনভাইট করেছিলো।তাই এসেছি।”
কথাটা শুনে রূপক ভ্রু দুটো উঁচায়।রূপকের সহকারী তৌশিক বলে,“ কিন্তু স্যার ড. আশিন তো বললেন উনি আপনাকে স…”
কথা কেটে নিয়ে উৎস বলে,“ হ্যা হ্যা আশিন আমাকে সবচেয়ে বেশি স্পেশাল মনে করে।”
রূপক গাড়িতে উঠে বসে।ড. আশিনকে তার সহ্য হয় না।উৎসর দিকে উচ্ছ কেমন চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে।উৎস সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজেও উলটো রাস্তা দিয়ে চলে যায়।উচ্ছ’র এই দুজনকে সন্দেহ হচ্ছে আজ।উচ্ছ হাসপাতালে ঢুকে পড়ে।আজ ড. আশিনকে দেখতে এসেছে সে। তাকে দেখলে নিশ্চয় বিরক্ত হবে।এতেই তো উচ্ছ মজা খুজে পায়।
চলবে… …