গ্রামাঞ্চলের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হলো পূর্ণিমা রাতে গ্রামের সরু পথ ধরে হেঁটে চলাটা।এই যেমন আশিনের খুব ভালো লাগছে।তার বাবা আর সে পাশাপাশি হেঁটে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাচ্ছে।যাবে না বলেও কোনো লাভ হয় নি।চেয়ারম্যান বিকেলে নিজে এসে যেতে বলেছেন।আশিন যদি অশোক তালুকদারের মায়ের চিকিৎসা না করতো তবে তিনি নাকি এতোক্ষণ বেঁচে থাকতেন না।সময়মতো চিকিৎসা করা হয়েছে বলেই আজ তিনি নাতির বিয়ে দেখছেন।আশিন অবশ্য যেতে রাজি হয় নি।বাবার জোরাজুরিতে যাওয়ার জন্য রাজি হতে হয়েছে। আগমনী শীতের ঠান্ডা হাওয়ায় আশিনের এখানেই কিছুক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।তবে সব আশা কি পূরণ হয়?রাস্তার এপাশ ওপাশ জুরে ধানক্ষেত।চাঁদের ক্ষীণ আলো এসে পড়ছে সেখানে। আরেকটু হেঁটে গেলেই কিছু দোকানপাট।তবে আজ দোকানগুলো বন্ধ।নয়তো দূর থেকেও সেই দোকানের আলো দেখা যেতো।ধানক্ষেতের আইল বেয়ে গেলেই নদীটা।রাস্তা থেকে নদীটা হালকা দেখা যাচ্ছে, তাও চাঁদের আলো পানিতে পড়ছে বিধায়। এমন অসাধারণ মুহুর্তক্ষণে আশিনের খুব গান গাইতে ইচ্ছে করলো।নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে বাবার সামনেই গুন গুন করে গাইতেও লাগলো,
‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না,
তোমার তুলনা।
নদীর সাথে আমি দেবো না,
তোমার তুলনা।’
আশিনের গুন গুন আওয়াজে গান শুনে রবিন সাহেব হাসেন।তৃপ্তির হাসি দেন, ‘আমার মেয়েটা দেখি গানও গাইতে পারে।’
আশিন হেসে ওঠে বাবার কথায়।আশিনের হাসি রবিন সাহেবের কেমন বাচ্চাদের মতো লাগে।হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় চেয়ারম্যান বাড়ির খুব নিকটে পৌঁছে যায়।দূর থেকে দেখা যাচ্ছে জাকজমক ভাবে আয়োজিত বাড়িটির চমৎকার রূপ।ব্যাপক আওয়াজে গান বাজনায় প্রকৃতিও তাল মেলাচ্ছে যেন।আশিন আর রবিন সাহেব গেইটের কাছে যেতেই উচ্ছকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।বেগুনী রঙের পাঞ্জাবী পড়া উচ্ছকে আজ সুদর্শন লাগছে। আশিনদের দেখেই উচ্ছ’র চোখ চকচক করে ওঠে। মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে খুব খুশি উচ্ছ।এগিয়ে এসে রবিন সাহেবের সাথে কোলাকুলি করে আশিনের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে একপলক তাকায় রবিন সাহেবের অগোচরে।উচ্ছ’র ঠোঁটে হাসি লেগেই আছে। আশিনের আসাতে যে সে অতিরিক্ত খুশি হয়েছে সেটা তার হাসি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।রবিন সাহেব হাঁটতে থাকেন।রবিন সাহেব যেতেই একটু কাছে আসে উচ্ছ আশিনের।আশিন হেঁটে যাওয়ার সময়ই কাছে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘আজ আপনাকে অপূর্ব লাগছে ড.। ’
বিরক্তি নিয়ে তাকায় আশিন।তারপর হেটে চলে যায় সামনে।উচ্ছ’র বিষয়টা খুব ভালো লাগে।নিঃশব্দে হেসে আবারও নিজ কাজে মন দেয়।তখনই আবার একই সাজসজ্জায় সেখানে উপস্থিত হয় অফিসার মঞ্জুরি।মঞ্জুরিকে এখানে দেখে উচ্ছ’র মুখ আপনা- আপনি শক্ত হয়ে ওঠে।মস্তিষ্কে দহন শুরু হয়।সামনে এগিয়ে এসে বলে, ‘ পিছু করতে করতে আমার বাড়ি অবধি চলে এলেন?’
পাশে থাকা এসিস্ট্যান্ট অনিলের সাথে কথা বলছিলো মঞ্জুরি।তবে পরিচিত আওয়াজে এমন বিশ্রি বাক্য শুনে সামনে তাকাতেই দুপুরের সেই লোকটাকে দেখে মঞ্জুরিও রেগে যায়।বিরক্তি ঢেলে বলে, ‘ কি বলতে চান আপনি?’
‘আমার পিছু নিচ্ছেন কেন?’
‘কোন দেশের রাজকুমার আপনি যে আপনার পিছু নেব?’
উচ্ছও ক্ষেপে যায়।দুপুরে রাস্তায় ছিলো।এখন তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে।দাম্ভিকতার সাথে বলে,‘ আমার বাড়িতে এসে আমাকেই শাসাচ্ছেন?’
‘শাসালাম কোথায়?আপনার বেহুদা কথার উত্তর দিচ্ছি মাত্র।’
রেগে যায় উচ্ছ।পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অনিল সামনে এসে উচ্ছ’র সাথে কথা বলা শুরু করে।এই সুযোগে মঞ্জুরি সেখান হতে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এদিকে আশিন আর রবিন সাহেব ভেতরে যেতেই অশোক তালুকদারের মুখোমুখি হয়।অশোক তালুকদার রবিন সাহেবকে নিয়ে অন্যদিকে চলে যান আর আশিনকে বসতে বলেন।আশিনের ফোনে কল আসায় সে বাইরে একটু নিরিবিলি জায়গায় যায়।এত কোলাহল আর শব্দে ভালোভাবে কথাও বলা যাচ্ছে না।
আশিনের থেকে কিছুটা দূরে গাছের নিচে উৎস আর তার বন্ধুরা দাঁড়িয়ে। শাওন নিহালের কাধে হাত রেখে বলে, ‘ডাক্তারকে তো শাড়িতে সুন্দর লাগে। ’
নিহাল আর বিশাল উৎসের দিকে একপলক তাকায়। সে আপাতত সিগারেটে খুব স্টাইলে টান দিচ্ছে।বিশাল গলা ঝেড়ে বলে, ‘সুন্দর হলে কি হবে? ডাক্তারের যেই ব্যবহার? সেদিন তো উৎসকেও চড় মারলো। ’
উৎস সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ঠোঁটের ভাজ থেকে সড়িয়ে হাতে নিয়ে মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে দেয়।উষ্ণ ধোঁয়া আকাশের দিকে মুখ করে ছেড়ে দেয়।মুখ বেকিয়ে বলে, ‘ডাক্তারকে শিক্ষা দেবো আজ। ’
সবাই উৎসুক চোখে তাকায় উৎসের দিকে।উৎস আশিনের দিকে হাঁটা ধরে।আশিনের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।এদিকে মানুষজন তেমন নেই তাই কারোর দেখার সুযোগ ও নেই।
আশিন কথা বলে পেছনে ফিরতেই উৎসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিক ভয় পেলেও নিজেকে সামলে নেয়।তার এমন ভাব দেখেই উৎস বুঝতে পারে মেয়েটা বেশ স্ট্রং।আশিন ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,‘ কি চাই?’
সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর আসে,‘ তোমাকে।’
কণ্ঠে উৎস’র অন্যরকম ভাব।ঠান্ডা হাওয়া গা ছুয়ে যেতেই শীতানুভব হয় আশিনের।তাৎক্ষণিক অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, ‘ এসব ফালতু কথা বার্তা বলার জন্য যদি এসে থাকেন তবে আমি দুঃখের সাথে বলছি, আপনার সাথে কথা বলার মতো মানসিকতা নেই আমার।’
উৎস আরেকটু কাছে আসে আশিনের।শুধায়,‘ কার সাথে মানসিকতা থাকে? উচ্ছ’র সাথে?’
উৎসের এমন কাছে আসাতেও আশিন পিছু হটে না। বরঞ্চ চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে উৎসের।আর ক্লিষ্ট কণ্ঠে জবাব দেয়,‘ আমার আপনাদের দুই ভাইয়ের কারোর সাথেই কথা বলার মানসিকতা থাকে না।’
উৎস হাসে।আশিন দেখে উৎসের হাসিটা ভীষণ সুন্দর।জাম রঙা একটি পাঞ্জাবী পড়েছে মানুষটা। বেশ মানিয়েছে উৎসকে।উৎস আশিনকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে একবার।আশিন ঝাঁঝ মেশানো গলায় বলে,‘ এমন বাজে নজরে আমায় দেখবেন না।শকুনের নজর খুবই খারাপ হয়।’
উৎস হুট করেই ডান হাতে আশিনের কোমড় জড়িয়ে নিজের কাছে টানে।কোমড়ে উষ্ণ হাতের স্পর্শে আশিন কেঁপে ওঠে।শীর্ণ দেহে ভুমিকম্পের আভাস পায়,শিহরিত হয় হৃদয়। পরক্ষণে কি হচ্ছে মনে হতেই পরপুরুষের ছোঁয়ায় গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।ঘৃণায় গাঁট হয়ে আসছে আশিনের দেহ। শক্তপোক্ত হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ চেষ্টা করেও নূন্যতম সফল হয় না আশিন। এদিকে ওপাশে থাকা নিহাল, বিশাল, শাওন, রিশাত একেকটা হতবম্ভ হয়ে যায়।উঠে দাঁড়ায় সবাই।অবাকের সীমা যেন মহাবিশ্বের অন্তে। উৎস আশিনের চোখের দিকে তাকায়।নারী হয়েও ধারালো সেই চাহনী।নারীদের এমন ধারালো দৃষ্টি শোভা পায় না বলেই উৎস মনে করে।বাম হাত দিয়ে আশিনের গাল ছুয়ে দিতে আশিন কিছুটা কেঁপে ওঠে।উৎস হঠাৎ সুরেলা কণ্ঠে গান গায়,
‘ তুমি আমার নয়তো সুখ,
তুমি, সুখের বেদনা। ’
থেমে যায় উৎস, এবার খুবই প্রসন্ন গলায় শুধায়,‘সেদিনের চড়ের হিসাবটা নিয়ে নেই, কি বলো?’
‘ছাড়ুন আমাকে। ’
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে আশিন বলতে থাকে।উৎস আরও দৃঢ় করে ধরে নিজের আরও কাছে আনে আর দৃষ্টি আশিনের চোখে স্থির রেখে বলে,‘ কালো শাড়িতে সৌন্দর্য উপচে যেহেতু পড়ছে সেহেতু এই সৌন্দর্য উপভোগেরও অধিকার শুধুই আমার।কিন্তু তুমি তো দেখছি লোক দেখানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছো। অন্তত এর জন্য শাস্তি তো পেতেই হবে আশিন।’
উৎসের কণ্ঠ নিঃসৃত কথাগুলো কর্ণকুহর হতেই অদ্ভুত অনুভুতি হয়।মন অভিভূত হলেও মস্তিষ্কের টানাপোড়নে সেসব ভুলে আশিন এবার একটু বেশিই বল প্রয়োগ করে ধাক্কা মারে উৎসকে।উৎসও পিছু হটে যায়।আশিন চড় মারার জন্য হাত উঁচাতেই উৎস তা ধরে ফেলে।আবারও আশিনের কাছে এসে ঠোঁটে বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলে,‘ এই হাত আমার সেবা করার জন্য বরাদ্দ।বার বার চড় মারার জন্য নয়।’
আশিন ভীষণ রেগে যায় এবার।ঝাঁঝালো গলায় হুমকি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, ‘তোকে আমি পরে দেখে নেবো। ’
কথাটা বলেই একমুহুর্তও দাঁড়ায় না সেখানে। হনহনিয়ে চলে যায়।মনে মনে ভেবে রাখে উৎসের এমন উচিত শিক্ষা দেবে উৎস নিজেও ভয় পাবে তখন।বাড়ির ভেতরে গিয়ে কারোর সাথে ধাক্কা লেগে শাড়িতে পানি পড়ে যায়।মেয়েটি বার বার সরি বলতে থাকে।আশিন ‘ইটস ওকে’ বলে ওয়াশরুম কোনদিকে জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটি দেখিয়ে দেয় তাকে। আশিন সেদিকেই হাটা ধরে।পথিমধ্যে উষার সাথে দেখা হয়।উষা আশিনকে দেখেই চিনে ফেলে। খোশমেজাজে বলে, ‘কেমন আছো মা তুমি?অনেক দিন পর তোমায় দেখকাম।’’
‘ এইতো ভালো আছি আন্টি।আপনি কেমন আছেন?’
উষা উত্তর দেওয়ার আগেই কেউ পেছন থেকে ডাকে তাকে।উষা আশিনের মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ আছে বলে সেখান থেকে চলে যায়।আশিনও নিজ কাজের জন্য যায়।যাওয়ার আগে ফোনে তার বাবাকে কল করে। ওপাশ থেকে রবিন সাহেব কল রিসিভ করতেই বলে,‘ বাবা আমরা একটুপরই এখান থেকে চলে যাব।এই বাড়িতে থাকার আর এক সেকেন্ডও মন চাইছে না আমার।’
ওপাশ থেকে রবিন সাহেবও সায় দেয়।আশিন ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।মন মেজাজ একদমই ভালো নেই।উৎসকে ধরে ইচ্ছেমতো মারতে পারলে ভালো লাগতো হয়তো।তবে এখন সেটা মোটেও করা ঠিক হবে না।একটি রুম দেখিয়ে দিয়েছিলো মেয়েটি।সেই রুমে ঢুকে ওয়াশরুমে যায় আশিন।
আশিন ভীষণ মাথাব্যথা নিয়ে আজ হাসপাতাল যাচ্ছে।গতকাল রাতে ফ্রেশ হয়ে এসে তার বাবাকে খুজতে বেগ পেতে হয়েছে তাকে।কাউকে কিছু না জানিয়েই তারা চলে এসেছে সবার অগোচরে। বাড়িতে আসার পরও ঘুম আসে নি আশিনের।মাথায় তখনও আগুন জ্বলছিলো উৎসের প্রতি তীব্র ক্ষোভে।রাতে ঘুমাতে দেরি হয়েছে।তাই তো মাথা ব্যথায় ছিড়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে আশিনের।রাস্তায় মানুষজন আসা যাওয়া করছে আর কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ উতলা হয়ে উদাসীন হয়ে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে তাদের।সকলের মুখে মুখেই কিসব কথা?তবে আশিন ভালোভাবে বুঝতে পারছে না।তখনই সামনে থেকে অফিসার মঞ্জুরিকে হেঁটে আসতে দেখে আশিন।খুব তাড়াহুড়ো করেই আসছেন বলে মনে হচ্ছে।মঞ্জুরি আশিনের সামনে এসে আশিনকে দেখে বলে,‘ ভালোই হলো আপনাকে রাস্তায় পেলাম।এখন চলুন চেয়ারম্যান বাড়ি।’
আশিন অবাক হয়।এই সময়ে চেয়ারম্যান বাড়ি মানে?প্রশ্ন করে, ‘ কেন?’
জবাবে খুব বিস্ময়কর তথ্য দেয় মঞ্জুরি।কথাটা শুনে আশিনও খুবই চমকে ওঠে।সাথে কষ্টও হয়।মঞ্জুরি বলে, ‘ অশোক তালুকদারের স্ত্রী উষা তালুকদার মারা গিয়েছে।’
থেমে আবারও বলে,‘ তবে মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় বলেই তাদের পরিবারের মানুষদের ধারণা।এখন আপনাকে ভীষণ জরুরি আশিন চলুন।
চলবে… ….