উষা মারা গিয়েছেন, অথচ উৎস বাজারে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত।পুরো গ্রামের আনাচে কানাচে খবরটা পৌঁছে গিয়েছে।অথচ মাতৃশোকের ছিটেফোঁটাও উৎসের মাঝে নেই।হাসি-ঠাট্টার মাঝে আবার তাকে খুব খুশিও মনে হচ্ছে যেন।খাবার হোটেল থেকে বেড়িয়ে জিপে ওঠে পড়ে উৎস। বাকিরাও ওঠে।নিহাল কিছু বলতে চাই,“ আন্টি কিভা…”
বাকিটুকু বলতে পারে না উৎসের হাত উঁচানোতে। উৎস হাত উঁচিয়ে নিহালকে থামিয়ে দেয়।শাওনকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার তাগদা দেয়।শাওন স্টার্ট দেওয়ার আগে জানতে চাই কোথায় যাবে?উৎস চোখ তুলে তাকাতেই বুঝে যায় শাওন এখন গন্তব্য কোথায়?গাড়ি চলতে শুরু করে।
আজ আকাশে সূর্যটা নেই।কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা।শীতের আগমনী সময়ে একটু আধটু বৃষ্টি হয়ে থাকে।তারই পূর্বাভাস।উৎসের আবার বৃষ্টি খুব ভালো লাগে।তার মতে বৃষ্টির দিনে সে জন্মগ্রহণ করেছে বলেই এই বৃষ্টিবাদল তার জীবনে এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।চেয়ারম্যান বাড়ির রাস্তা ধরেই জঙ্গলের রাস্তাটা।গাড়িটা চলাকালীন হঠাৎ আশিনকে দেখতে পেলো মনে হলো উৎসের।উষার মৃত্যুর খবরটা মনে পড়তেই মাথায় চাড়া দিয়ে উঠলো আশিনের কথা। আশিন ডাক্তার, নিশ্চয়ই তাকে এখন ডাকা হবে বাড়িতে।
গতকাল কল্পনার বিয়ের পরপরই উষা কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন।মেয়েকে শশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে চলে যেতেই তিনিও নিজ ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন। তখন বিষয়টা কেউ খেয়াল করেনি।সকালে যখন উৎস বাজারে হোটেলে নাস্তা করার জন্য এলো তার কিছুক্ষণ পরই উচ্ছ কল করে জানায় উষার মৃত্যুর কথা।উৎস শান্ত ছিলো,স্বাভাবিক ছিলো তার ভঙ্গি। তবে চোখে কিংবা মুখে ছিলো না কষ্টের ছাপ।বরঞ্চ খাওয়া শেষ জঙ্গলের কাঠ-ঘরটাই গিয়ে আড্ডা দেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় সে।তবে আশিনকে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে দেখে এখন সিদ্ধান্ত পালটে ফেলে।শাওনকে গাড়ি থামাতে বললে শাওন ও গাড়ি থামিয়ে দেয়।গাড়ি থেকে নেমে ত্রস্ত পায়ে হাটা ধরে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে।বাকিরাও নেমে পড়ে শুধু শাওন বাদে। গাড়িটা এখন বাড়িতে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।রাস্তায় খাম্বার মতো দাঁড় করিয়ে রাখলে মানুষের যাতায়াতের কষ্ট হবে।
আশিন, তালুকদার বাড়িতে ঢুকতেই কিছু মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়।নির্দিষ্ট একটি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রূপক।ফোনে কথা বলছে এম্বুল্যান্সের জন্য।হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে লাশটা।কিন্তু বাড়ির কেউই সায় দিচ্ছে না এতে।রূপকেরও মত নেই তবুও মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় তাই পোস্টমর্টেম করা আবশ্যক।আশিনকে দেখতেই মন না চাইতেও এগিয়ে আসে।আশিন মঞ্জুরির সাথে সেই রুমটির দিকে হাঁটা ধরে।রূপক রেগে গেলেও প্রকাশ করে না।রুমে এসেই দেখা যায় অশোক স্ত্রীর লাশের পাশে বসে আছেন।
গতকাল প্রচুর ক্লান্ততার কারণে আজ সকালে সবাই দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্ত্রীর এমন দশা দেখেই আতকে ওঠেন অশোক।উষার মুখ ছিলো ফ্যাকাসে আর ঠোঁটের পুরোংশে লেপ্টে ছিলো সাদা ফ্যানা।শরীর কিছুটা কালচে বর্ণ ধারণ করেছিলো।গতকাল ভীষণ ক্লান্ত হওয়ায় রাতে যে স্ত্রীর সাথে কি হলো সেটা মোটেও টের পান নি তিনি। বাড়ির সবাইকে ডাকতেই একে একে সবাই এসে উষার এমন অবস্থা দেখেন। আর আহাজারি শুরু হয়ে যায় সকলের।রূপক তৎক্ষণাৎ মঞ্জুরিকে ড. আশিনকে নিয়ে সাথে আসতে বলেন।পথিমধ্যেই মঞ্জুরি আশিনকে পেয়ে যাওয়ায় তাড়াহুড়ো করে তারাও চলে আসে।উচ্ছকে আগের তুলনায় আজ বিষণ্ণ লাগছে যেন।বাড়ির মেজো বউ শাড়ির আচলে মুখ গুজে কাঁদছেন।কল্পনাকে এখনও জানানো হয়নি।আরও থাকা আত্মীয়রাও ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন।শুধু পুরুষরাই চুপ করে আছেন। তবে তাদের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তাদের মনোবস্থাও অতোটা ভালো নয়।
আশিনকে দেখে সকলেই সড়ে দাঁড়ায়।আশিন হেটে গিয়ে উষার লাশের পাশে বসে পর্যবেক্ষণ করে। তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স আনার তাগদাও দেয়।দেখা শেষ হলে সকলকে বলে,“ অতিরিক্ত বিষক্রিয়ার কারণেই উনার মৃত্যু।হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
মঞ্জুরি আশিনের পাশেই ছিলো,“ যেহেতু এটা বিষ খাওয়ার জন্য হয়েছে।তাই এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। পোস্টমর্টেমের জন্য দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে লাশটি। ”
উচ্ছ ক্লেশমিশ্রিত গলায় বলে,“ পোস্টমর্টেম না করলেই কি হয় না?”
মঞ্জুরি তাকায় উচ্ছ’র দিকে।অন্যদিন হলে নিশ্চয় ঝগড়া করতো মঞ্জুরির সাথে।আজ কেমন বিষণ্ণ, মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চোখে মর্মপীড়া স্পষ্ট। কথাগুলোও যে বললো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে।মঞ্জুরি বলে,“ সাধারণ মৃত্যু হলে একটা কথা ছিলো।তবে এটা মার্ডার নাকি সুইসাইড কেইস সেটা আমাদের পরীক্ষণ করতে হবে।এটা আমাদের দায়িত্ব।ক্ষমা করবেন আপনাদের কথা মানতে পারবো না।”
বাইরে থেকে এম্বুল্যান্সের আওয়াজ শোনা যায়। দুজন লোক আসে।লাশটিও সাথে নিয়ে যায়।কেউ বাধা দিতে পারে না অশোক তালুকদারের কথায়। আশিন একপলক উচ্ছ’র দিকে তাকিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই উৎসকে সামনে পায়।উৎস আশিনকে দেখে হাটা থামিয়ে দেয়।আশিন উৎসকে দেখে ভীষণ অবাক হয়।সকলের মুখে বিষণ্ণতার ছাপ থাকলেও এই ছেলের মাঝে কষ্টের রেশও নেই। উলটো কেমন খুশি খুশি লাগছে।আশিন উৎসকে পাত্তা না দিয়েই হাঁটা শুরু করে।সাথে মঞ্জুরিও আছে। মঞ্জুরির এসিস্ট্যান্ট গাড়ি নিয়ে আসে।মঞ্জুরি আশিনকে সাথে নিয়ে চলে যায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।উৎস শুধু তাকিয়ে দেখে।তারপর সে আর বাড়ির বাইরে থাকা বন্ধুরাও চলে যায় আবার জঙ্গলের সেই কাঠঘরে আড্ডা দেওয়ার জন্য। অশোক তালুকদার দরজার সামনে থেকে দেখেন নিজের ছোট ছেলেকে।
নিজেদের সেই কাঠঘরে আসতেই সবকিছু এলোমেলো দেখে উৎস কিঞ্চিৎ রেগে যায়।নিহালকে বলে,“ এসব কি?এখনও পরিষ্কার করিস নি কেন?”
পুরো ঘরটি ছড়ানো ছিটানো আর রক্তাক্ত।উৎসের হাতে ব্যথা।তাই সে বসে পড়ে একটি কাঠের চেয়ারে। গতকাল পাশের এলাকার কিছু ছেলে তাদের বাড়ির পেছনে ঝামেলা করছিলো সেগুলোকে সেখানেই বেধরম পিটিয়েছে তাই হাত ব্যথা আজ।নিহাল আর বিশাল একটি বালতি নিয়ে বেরিয়ে যায়।এসব এখন পরিষ্কার করতে হবে তাদের।রিশাত আর শাওন অবাক হয়ে উৎসকে জিজ্ঞাসা করে,“ এই রক্ত কোথা থেকে?”
“ এসব মরে যাওয়া ওই বৃদ্ধদের রক্ত।”
আতঁকে ওঠে শাওন আর রিশাত।মাথায় নাড়াচাড়া দিয়ে ওঠে গ্রামে পাওয়া যাওয়া সেই বৃদ্ধ লাশগুলো।তারা উৎসের দিকে সন্দিহান নজরে তাকিয়ে থাকে।
__
ড. আশিনের কেবিনে বসে আছে রূপক আর মঞ্জুরি। তখনই হাতে কিছু কাগজ নিয়ে প্রবেশ করে আশিন। মঞ্জুরির দিকে একবার তো রূপকের দিকে একবার তাকায় সে।অন্যদিনের তুলনায় রূপক কেমন চোখে যেন তাকেই দেখছে।নিজের বরাদ্দ জায়গায় গিয়ে বসে রিপোর্টটা বাড়িয়ে দেয় রূপকের দিকে।রূপক রিপোর্টটা হাতে নেয়।আশিন বলা শুরু করে,“ উনার শরীরে যেই বিষ পাওয়া গিয়েছে, সেটা কোনো সাধারণ বিষ নয়।এটি বাংলাদেশে পাওয়া যায় না বললেই চলে।খুবই ব্যয়বহুল একটি বিষ।যেটা বিদেশ থেকে আমদানীকৃত হয়ে থাকে তবে সেটা বেআইনী ভাবে।বিষটি সাধারণত ছয় ঘণ্টা পর কার্যকর হয়। তবে যখনই এটি পান করা হয় তখন থেকেই শরীর খারাপ লাগতে শুরু করে।”
থামে আশিন আবারও একই ভঙ্গিতে বলা শুরু করে,“ কেউ উনাকে পানীয়’র সাথে বিষটি দিয়েছিলো।পরপর তিনি হয়তোবা অসুস্থ হয়ে পড়েন।আর ছয়ঘণ্টা পরই বিষটি কার্যকর হয় এবং মিস উষা মারা যান।আর উনি ঠিক এই মুহুর্ত থেকে সাত ঘণ্টা আগে মৃত্যুবরণ করেছেন।”
রূপক চমকায় তবে কথা বলে না।উঠে দাঁড়ায় সে, সাথে মঞ্জুরীও।মঞ্জুরি একবার আশিনের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হেসে রূপকের সাথে চলে যায়।
রূপক বাড়িতে আসে।সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগে তার বাড়ি তল্লাশি করবে।কাউকে বিশ্বাস করা উচিত নয়। যতই পরিবারের লোক হোক না কেন?বাড়িতে এসে সবাইকে পেলেও একমাত্র উৎসকেই পায় না সে।
এদিকে উৎস গাড়ি গ্যারেজে রেখে বাড়িতে ঢুকতেই রূপকের মুখোমুখি হয়।পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় রূপক উৎসের কাঁধে হাত রেখে থামিয়ে বলে,“ কাজটা ঠিক করিস নি।”
ভ্রুক্ষেপহীন জবাব দেয় উৎস,“ আপনজন হলে অবশ্যই ভেবে দেখতাম।”
তখনই রূপকের টিম এসে হাজির হয় তাদের বাড়িতে।উৎস চলে যেতে নিতেই রূপক বলে,“ দাঁড়া উৎস!”
থামে উৎস।রূপক এগিয়ে এসে বলে,“ চাচীর মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।অত্যধিক বিষক্রিয়ার দরুণ মৃত্যু ঘটেছে।ওই ড. জানিয়েছেন বিষটি এমন বিষ ছিলো যেটা সাধারণত ছয় ঘণ্টা পর কার্যকর হয়।আর কার্যকর হওয়ার সাথে সাথেই মৃত্যু।আর বিষটি কোনো পানীয়তে ছিলো।গতকাল রাতে চাচীকে কেউ খাইয়েছে সেই পানীয়।অর্থাৎ এটা মার্ডার কেইস।”
থামে রূপক।কেমন অদ্ভুতভাবে বলে,“ তাই বাড়ি হোক কিংবা বাইরে সন্দেহভাজন যাদের তাদের চোখে চোখে রাখার দায়িত্ব আমাদের।”
খুবই শান্তচোখে উৎস স্থির দৃষ্টিতে তাকায় রূপকের দিকে।আর দৃঢ়তা বজায় রেখে বলে,“ আমাকে সন্দেহ করছিস?”
হাসে রূপক,“ ঠিক সন্দেহ নয় এটা।কিন্তু তোর সাথে চাচীর সম্পর্ক খুব বাজে ছিলো।”
উৎস এক ভ্রু উঁচিয়ে বলে,“ তো?”
রূপক জবাব দেয় না।রহস্যময় হাসে শুধু।তার টিমের সদস্যকে কিছু বলে একবার উৎসের দিকে তাকিয়ে চলে যায়।সেই অফিসারটি এসে উৎসকে বলে,“ স্যার আপনি এখন আপনার রুমে যান।আপনি আর আজ বাইরে যেতে পারবেন না।”
উৎস গা ঝাড়া দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।উচ্ছ সিড়ির কাছে সেসব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আর শোনে।তবে সে আজ প্রতিক্রিয়াহীন।সেও পা বাড়ায় নিজের রুমের দিকে।
___
রাত তখন ২:৩০।
নির্জন এই রাতে জঙ্গলের ভেতর তিনজন লোক দুটো লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও।লাশগুলো বৃদ্ধের।এমনকি রক্ত নেই লাশগুলোতে।হয়তোবা সেই রিপোর্ট অনুযায়ী বিষ খাইয়ে আগে মারা হয়েছে। একজন লোক ক্লান্ত হয়ে লাশটি মাটিতেই ফেলে রাখতেই পাশে থাকা একজন হালকা চেচিয়ে দাতে দাত পিষে বলে,“ কি করতাছস কি?”
আশেপাশে একবার ভালোভাবে তাকায় সে।তারপর আবারও ধমকে বলে,“ গতবার তোর একটা ভুলের লাইগা আমগোর বিপদ হইছে।নদীত ফালাইবার মানা কইরাও বসের কথা না শুইনা ফালাইছিলি হেই লাশ ভাইসা উঠছে।তহন তাও বস তোরে ক্ষমা কইরা দিছিলো।এহন আর এই ভুল করিস না।এমনিতেই বস আমগোরেই সন্দেহ করে ওই রাস্তার পাশে যে লাশগুলা পাইছে ওইগুলার লেইগা।কিন্তু ওইগুলা আমরা ফালাই নাই।তাও কিন্তু আমগোর উপর বস ক্ষেপা।ত্যাড়াব্যাড়া করলে আমগোরেও এমনেই মাইরা ফালাইবো।সাবধানে কর শালা।”
লোকটি কেঁপে ওঠে।হঠাৎ করেই কেন যেন তার বসের রুক্ষ আওয়াজে বলা একটি কথা মনে পড়ে। একদিন তাদের বস বলেছিলো,“ আমি কোনোকিছু দান না করতে পারলেও বাঁচা আর মৃত্যু খুব সহজেই দান করি।তাই সাবধানে থাকবি তোরা।”
চলবে….