আজ এক সপ্তাহ কেটে গেছে অথচ রূপক এখনও তার চাচীর খুনিকে খুজে বের করতে পারে নি।উৎসকে সন্দেহ হয়।তবে তার হাবভাব এমন যেন সে তার মা-কেও চেনে না।উৎসের ভাব এমন বাড়িতে কিছুই হয় নি।তার এমন স্বভাবের কারণ থাকারও কথা। উষা তাদের আসল মা নয়।উষা হলেন তাদের সৎ মা।অর্থাৎ কল্পনাও উৎসদের সৎ বোন।উচ্ছ তালুকদার আর উৎস তালুকদার হলো মিসেস উর্মিলার ছেলে।অশোক তালুকদারের প্রথম স্ত্রী। আর ‘কল্পনা নিশি’ অর্থাৎ উৎসদের বোন হলো মিসেস উষার একমাত্র মেয়ে।মিসেস উর্মিলার সাথে অশোক তালুকদারের প্রেমের বিয়ে ছিলো।আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে উষা উর্মিলার ছোট বোন।উৎসের সমস্ত অভিযোগ এখানেই।তারা যখন মাত্র দশ বছর বয়সী বালক তখনই উর্মিলা কার এক্সিডেন্টে মারা যান। কিন্তু উৎস মনে করে তার মায়ের মৃত্যুর পেছনে অবশ্যই তার বাবা এবং মাসির হাত আছেই।নয়তো মিসেস উর্মিলার মৃত্যুর তিনমাস পরই অশোক তালুকদার মৃত প্রথম স্ত্রীর আপন বোনকে বিয়ে করতে পারতেন না।এই সন্দেহ একদিকে যুক্তিহীন তো অন্যদিকে আবার অযৌক্তিকও বটে।
তাইতো উচ্ছ তার সৎ মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করলেও উৎস কোনোদিন ভালো ব্যবহার করেনি।অথচ মিসেস উষা উচ্ছ, উৎস দুজনকেই নিজ সন্তানের মতো স্নেহ করতেন।উৎসের এমন ব্যবহারের জন্য অশোক তালুকদার ছেলেকে অনেকবার ঝেড়েছেন।এমনকি একদিন চড়ও দিয়েছিলেন।সেদিন থেকে শুধু মিসেস উষা নয় নিজ বাবার সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দেয় উৎস।এতে অবশ্য মিসেস উষা এবং অশোক তালুকদার ভীষণ কষ্ট পান।কিন্তু উৎস তো উৎসই।একরোখা,রগচটা। তার এমন বাউণ্ডুলে, বখাটে হওয়ার অন্যতম এক কারণ এটিও বলা চলে।যেখানে উৎস নিজেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেছে পদার্থবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে সেখানে সে কিনা গ্রামে বখাটের মতো মারামারি,হানাহানি করে। শোভা না পেলেও এটাই যেন বর্তমান উৎসের জীবনী হয়ে উঠেছে।এই ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়েও মারপিট করেছে। এমন রেকর্ড তার নামে আছে।অর্থাৎ উৎসের এই অগোছালো ভয়ানক জীবন শুরুই হয়েছে নিজ মায়ের মৃত্যুর পর এবং বাবা অশোক তালুকদারের ওমন একটি কর্মের পর।এজন্যই সন্দেহের লিস্টে উৎসকে রাখা যেন আবশ্যক রূপকের কাছে। ব্যাখ্যাহীন খুনে আরও অনেক সন্দিহান ব্যক্তিত্ব ধরা পড়েছে রূপকের কাছে। যার মধ্যে স্বয়ং রবিন সাহেব, ড. আশিনসহ আরও রয়েছে অফিসার মঞ্জুরি।
রবিন সাহেবকে সন্দেহ করার মূল কারণ হচ্ছে মিসেস উষা যখন একটি পানীয় পান করছিলেন রবিন সাহেব অনতিদূরে তারই দিকে চেয়েছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন গ্রামেরই এক ব্যক্তি।এখন সেটা ঈর্ষান্বিত হয়ে নাকি স্বদ্যোগে বলেছেন এটা শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।যেহেতু রবিন সাহেবের নামে এমন অভিযোগ উঠেছে তাই তাকেও সন্দেহের লিস্টে রেখেছে রূপক।যদিওবা তিনি অসুস্থ এবং ভদ্র প্রকৃতির একজন লোক তাকে সন্দেহ করার মতো না হলেও দুনিয়ায় কাউকে বিশ্বাস করাও যায় না। যেখানে আপনজনকে বিশ্বাস করা দায় হয়ে পড়ে সেখানে রবিন সাহেব বাইরের মানুষ।
এদিকে আবার ড. আশিন আর মঞ্জুরিকে সন্দেহের কারণের ধারাটা ভীষণ চাঞ্চল্যকর।উৎসকে সন্দেহ করার থেকেও এদের সর্বপ্রথমে ঠায় হয়।আশিন এবং মঞ্জুরি, দুজনই সেদিন কালো শাড়ি পরিহিত ছিলেন।আর প্যাচঁটা এখানেই লেগেছে।বিয়েবাড়ি হওয়ায় সাময়িকের জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিলো বাড়ির কিছু কিছু স্থানে।যেহেতু পরিবারের নারীদের ভাষ্যমতে এটা জানা গিয়েছে যে মিসেস উষা নাকি ব্যস্ত ভঙ্গিতে সিড়ি বেয়ে নেমে নিচে আসতেই একজন ওয়েটার উনাকে একটি জুসের গ্লাস ধরিয়ে দেন।মিসেস উষাও মেয়ের বিয়ে হিসেবে খুশিমনেই সেটা পান করেন।বিষয়টি ছিলো নিছকই ছোট ঘটনা তাই সবারই এড়িয়ে চলার কথা।তবে রূপকের মা শায়লার কথামতে ওয়েটারের ট্রে’তে একটি মাত্রই গ্লাস ছিলো। সে হিসেবে সিসিটিভি ক্যামেরাতে কিছুটা অস্পষ্ট হলেও মোটামুটি কালো কাপড়ের একাংশ দেখা গিয়েছে সেই ওয়েটারের সাথে কথা বলতে।তাও আবার আড়ালে।সবার চাক্ষুষ প্রমাণ ছিলো সেদিন এই আশিন এবং মঞ্জুরি নামক দুই রমণীর কালো শাড়িতে নিজেকে প্রদর্শনের বিষয়টি।তাইতো রূপক ড. আশিন এবং মঞ্জুরিকে আলাদাভাবে থানায় একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে ঘণ্টা দেড়েকের মতো জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।প্রথম ব্যাঘাত তো তখন ঘটেছিলো যখন মঞ্জুরিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে।মঞ্জুরি নিজেই একজন অফিসার।তাও আবার গোয়েন্দা টিম প্রধান।যেখানে মঞ্জুরি নিজেই এতো এতো আসামী ধরেছে।আবার তাকেই জিজ্ঞাসাবাদ কিরতে ভীষণ সংকোচবোধ হচ্ছিলো।তবুও উপায় ছিলো না।কারণ অনুষ্ঠানে যেহেতু কালো পোশাক পরিহিত দুজনকেই দেখা গিয়েছে তাই তাদের দুজনকেই বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হয়েছে বলেই রূপকের কথা।কিন্তু আরেকটা বিষয়ও উল্লেখ্য, তা হলো অফিসার মঞ্জুরি কিছুদিন হলো এসেছে এই শান্তিপুর গ্রামে।যেখানে রূপকের সাথেও পর্যন্ত মঞ্জুরির পূর্বপরিচিত ছিলো না সেখানে মিসেস উষাকে খুন করার মতো জঘণ্য কাজ নিশ্চয় সে করবে না।অন্যদিকে ড. আশিনকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন আশিনের কথাগুলো ছিলো দৃঢ়, আত্মবিশ্বাসী।রূপক যখন সেই কক্ষে ঢুকেছিলো আশিন একটি চেয়ারে বসে ছিলো।সিলিং থেকে ঝুলিয়ে রাখা একটি লাইট আশিনের থেকে কিছুটা উপরে ছিলো।যার ক্ষীণ আলো আশিনের মুখমন্ডলে পড়তেই আশিনের সেই সুন্দর মুখশ্রী দেখে রূপক নিজেও কিছুটা বিচলিত হয়েছিলো সেদিন।মন উৎকণ্ঠিত আওয়াজে সমোস্বরে বলছিলো যেন এই তেজস্বী নারীটির পেছনে উচ্ছ আর উৎস এমনি এমনি পা পিছলে পড়েনি।আশিনের মুগ্ধ করা সেই বাঁকা চাহনীতেই যেন রূপক নিজেই অভিভূত হচ্ছিলো ক্ষণে ক্ষণে, বার বার।বাঁকা হাসিটাও চোখে লাগার মতো ছিলো।আর কথার ধাঁচ, ঝাঁঝ সেটা অন্যরকম এক আলাদা অনুভুতির সংমিশ্রণ যেন।ড. আশিনকে রূপক এতদিন ভালোভাবে খেয়াল না করলেও সেদিন বেশ মনোনিবেশ করেছে আশিনের মাঝে।অথচ অত্যধিক শান্ত আশিনের উত্তর শুনেও লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার অনুভুতিও খুব কম হচ্ছিলো না তার।রূপক আশিনের দিকে চক্ষুস্থির রেখে যখন প্রথম সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলো,“ মিসেস উষাকে মারার কারণ কি?”
আশিন দৃঢ় প্রত্যয়ে জবাব দেয়,“ আমি আশিন, মানুষের জীবন, মৃত্যুর হাত থেকে যথাসম্ভব বাঁচানোই আমার কাজ।কাউকে মারা নয়।”
“ আপনাকে বিশ্বাস করার একটি মাত্র কারণ বলুন তবে।”
আশিন বাঁকা হাসে।
বাঁকা চোখে রূপকের দিকে ফিরে তাকায়।দুজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো টেবিলের ওপর থাকা কলমটি পেন স্পিনিং করতে করতে বলে,“ বিশ্বাস!” থামে পুনরায়।
অধৃষ্য স্বরে শুধায়,“ এইযে আপনি নিজেই মনে মনে আমাকে বিশ্বাস করছেন।আপনার মন মস্তিষ্ক দুই মিশ্র অনুভুতিতেই বার বার অদৃশ্যভাবে বলছেন ড. আশিন এমনটা মোটেও করিনি। এটাই সেই বিশ্বাসের অন্যতম কারণ নয় কি?”
রূপক হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।আশিনকে সেদিন বসে থাকতে দেখে এবং তার অঙ্গিভঙ্গি,হাবভাব দেখে মোটেও খুনী মনে না হলেও কিছুটা সন্দেহ হচ্ছিলো।কথাটা আশিনও খারাপ বলে নি।আর কথা বলার জোর না থাকায় হনহনিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে।কিছুক্ষণ আশিনও উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে আসে।চেয়ারে বসে থাকা রূপকের দিকে ঠান্ডা চাহনী নিক্ষেপ করে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নিজ কাজে চলে যায়।আশিনকে প্রথম প্রথম অপছন্দ হলেও সেদিনের পর থেকে ততোটা অপছন্দ করে না রূপক।আবার এমনটাও নয় যে সে আশিনকে পছন্দ করে।এসবে মোটেও রূপক পিছলে পড়বে না।এসপি অফিসার রূপক সে।নিষ্ঠাবান কাজের পাশাপাশি নিজের চারিত্রিক দিকগুলোও ফুটিয়ে তোলার কঠিন প্রচেষ্টা করেন।বিয়ে এবং প্রেম নামক দুজোড়া দুই অক্ষরের শব্দকে সে এড়িয়েই চলে।এটাই তার অন্যতম এক নিদারুণ বৈশিষ্ট্য বলা চলে।তাইতো আশিনের থেকে নিজেকে সংযমী করে রাতভর একটি থ্রিল মিশনে লেগে পড়েছে রূপক।সহযোগী হিসেবে মঞ্জুরি থাকতে চেয়েছে তবে মঞ্জুরিও এখানে মোটামুটি একজন ভিক্টিমের অংশবিশেষ হওয়ায় তাকে বাধা দেয় রূপক।
শান্তিপুরের পাশের গ্রাম এসেছে রূপক।সাথে তৌশিকও আছে।গ্রামপ্রধান তাদের আসার খবর শুনেই ছুটে এসেছেন রূপকদের কাছে।রূপক জানতে চেয়েছিলো এই গ্রামের যারা যারা নিখোজ হয়েছে তাদের সম্পূর্ণ একটি লিস্ট দিতে তবে এটা গ্রামপ্রধান সঠিকভাবে দিতে পারেন না।রূপক ঠিক করে এবার মৃত লোকগুলোর বাড়িতে যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ।প্রথমেই গিয়ে পৌঁছায় অনিক নামক বৃদ্ধ লোকটির বাড়িতে।রূপককে দেখে অনিকের সাহেবের বৃদ্ধা স্ত্রী সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকালেও পরক্ষণে নিজ পরিচয় দিতেই বিনয়ী হয়ে ওঠেন।ভদ্রতার সহিত খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ির ভেতর থেকে চেয়ার এনে দেন বসার জন্য। রূপক আর তৌশিকও বসে পড়ে।বৃদ্ধাটি তাদের বিপরীতে বসেন।রূপক প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে,“ আপনিই অনিক সাহেবের স্ত্রী?”
স্বামীর নামটা শুনতেই বৃদ্ধাটির চোখ টলমল করে ওঠে।হ্যা-সূচক মাথা নাড়ায়।রূপক বাড়ির এদিকে ওদিক দেখছে।কিছু একটা ভেবে ভাবুক হয়ে অকস্মাৎ প্রশ্ন করে,“ বাড়িতে কি আপনি একা থাকেন?আপনাদের ছেলে মেয়ে নেই?”
ভাঙ্গা গলায় কাঁপা আওয়াজে বৃদ্ধাটি উত্তর দেয়,“ একটা পুলা আছে।বিয়াও করছে।পুলা শহরত থাহে,আমি আর আবিরের বাপ মিলা এই গ্রামত থাহি।কিন্তু এহন আবিরের বাপও আমারে রাইখা গেলো গা।”
কথাটা বলা শেষ হতেই শাড়ির আঁচল মুখে ধরে কাঁদা শুরু করেন।রূপক আশ্চর্য হয়।আবারও প্রশ্ন করল,“ আবির কি তার বাবার মৃত্যুর পর একবারও গ্রামে আসেনি?”
বৃদ্ধাটি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।এবার যেন আরও বেশি আশ্চর্য হয় রূপক।এ তো ছেলে নামে কলঙ্ক,“ আবির কি জানে তার বাবার মৃত্যুর কথা?”
“ হ বাপ, হেইদিনই কল কইরা কইছিলাম যেইদিন বাড়িত থেইকা বাইর হইয়া আর আহে নাই।”
রূপক কিছু বলার ভাষা পাচ্ছে না।যাদের পরিবারের সদস্যের মৃত লাশ পাওয়া গেছে তাদেরকে মাসিক কিছু টাকা দেওয়া হয়েছে।হয়তোবা বৃদ্ধাটি সেই টাকা দিয়েই চলছে।লাশগুলো এখনও মর্গে পড়ে আছে।স্বামীর লাশটিও দেখতে পান নি উনি ভাবতেই রূপকের নিজেরই খারাপ লাগে।এই বয়সে এসে এভাবে একা জীবনযাপন করছেন এটা কম কিসের? বর্তমানের যুগ এমন একটি যুগ হয়ে গিয়েছে যে, বাবা মা বৃদ্ধ হয়ে গেলেই সন্তানেরা তাদের ভুলে যেতে বসে।এমনকি খেয়াল রাখার দায়িত্বটাও পর্যন্ত ভুলে বসে।বৃদ্ধ বয়সে এসে সেই বাবা মায়ের নিজেদের খেটে উপার্জন করতে হয়।অথচ দেখা যায় তারা শহরে বসবাস করে আরাম আয়েশে।এই সমস্যা দিন দিন বাড়ছে।এতে নিঃসঙ্গতায়, দারিদ্রতায়, বেখেয়ালিতেই বাবা মা শায়িত হয়।রঙ্গিন জীবন তাদেরও প্রাপ্য।ছোটবেলা থেকে যে সন্তানকে কোলে-পিঠে মানুষ করা হয়, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তানকে ভরণপোষণ করা হয় সেই সন্তানই কিনা বড় হয়ে স্ত্রী সন্তান পেলে নিজ বাবা-মায়ের কথা ভুলে যায়।রূপক হতাশার শ্বাস ফেলে।আহত চোখে একপলক বৃদ্ধার দিকে তাকায়।অন্তত এই বৃদ্ধা মায়ের জন্য হলেও তাদের স্বামীর খুনীর সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করবে রূপক।ভাবে মৃত্যুদন্ডই শ্রেয় সেই খুনীর জন্য। রূপক পুনরায় প্রশ্ন করে,“ অনিক সাহেব কবে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলেন?মনে আছে কি?”
মলিন কণ্ঠে শুধান বৃদ্ধা,“ অসুস্থ আছিল,আমারেও কিছু কইতো না।কাম কইরা যহন বাড়িত আইতো ভালামতো খাইবারও পারতো না।একদিন কয় কি
‘আবিরের মাও আজ রাইত বাড়িত আইতাম না।এক জায়গায় যামু।কাইল সক্কাল সক্কাল আইয়া পড়ুম। তুমি ভালামতো থাইকো,খাইও।’’
হেইদিনিই গেছে গা।আর আহে নাই। যহন হুনলাম আবিরের বাপ নাকি মইরা গেছে হেই সময় জানলাম আমার আবিরের বাপ আর নাই।ও বাপ, তুমি তো পুলিশ আমার আবিরের বাপরে যেই মারছে হের খুব কঠিন শাইস্তি দিও গো বাপ।”
আবারও শাড়ির আঁচলে মুখ গুজে কাঁদেন তিনি। রূপক উঠে দাঁড়ায়।তৌশিককে কিছু একটা বলেই হাঁটা শুরু করে।তার নিজেকে এখন খুবই অসহায় মনে হচ্ছে যেন।অন্ধকারের সমীপে যেন আলোটাও আজ সংকটাপন্ন হয়ে রয়েছে।
________
রবিন সাহেব পুনরায় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আশিন বাবার ভীষণ যত্নসহকারে খেয়াল রাখছে। মেয়েটা ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না।বাবার জন্য চিন্তায় চিন্তায়।রাত নেমেছে।শীতোষ্ণতায় চারপাশ যেন থরথর করে কাঁপছে।পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেন সমস্তকিছু উল্টোপাল্টা হয়ে গেছে কিছুটা।এইযে হুট করেই আজ এতো শীত পড়লো বাড়ির ভেতরে থাকাও দায় হয়ে দাড়িয়েছে যেন।শীতের পোশাক গায়ে জড়িয়ে বাড়ির দরজা খুলে বেরোই আশিন।হাতে টর্চলাইট।সামনের দৃশ্য অবলোকনের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় আশিন।এই কুয়াশাভরা রাতে এটা নেহাৎই পাগলামোও যেন মনে হলো আশিনের।বাড়ির বাইরে এসেছে, বাড়ির সামনে লাগানো তুলসি পাতার গাছ থেকে কিছু তুলসি পাতা ছিড়ে গরম পানিতে সিদ্ধ করে তার বাবাকে খাওয়াবে।এটা ঠান্ডাজনিত রোগে এটা উপকারী হিসেবে গণ্য।গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে বলাও চলে।সারিবদ্ধভাবে লাগানো গাছগুলোর প্রত্যেকটি থেকে একটি একটি করে পাতা ছিড়তে থাকে আশিন।ভাবটা কেমন অদ্ভুত ঠেকায়।মুখের অভিব্যক্তিও কেমন যেন পরিবর্তিত হয়েছে ক্ষণিকের মাঝেই।ঠান্ডার পরিমাণ এতটাই যে এই মুহুর্তে বাইরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাও যেন একটা তুমুল যুদ্ধস্বরূপ। ঠান্ডা হাওয়াটাও গা ছম ছমে।আশিনের হঠাৎ এমন পরিবর্তনে কেমন যেন সামনে তাকিয়ে একনজরে কিছু একটা দেখতে থাকে।এদিকে তারই কিছুটা দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে উৎস।মেয়েটাকে অনেকদিন যাবৎ দেখে না।হাসপাতালে নাকি যাচ্ছে না বেশ কদিন হলো।তাইতো আজ বাড়ি থেকে চুপি চুপি বেড়িয়েছে।রূপকও ছিলো না।সেই সুযোগ হাতছাড়া উৎস করবে না এটা নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত।তবে কুয়াশার মাঝে আশিনকে ভালোভাবে দেখতে না পারলেও আশিনের কাছে টর্চলাইট থাকায় সেই আলোতে কিছুটা হলেও প্রদর্শিত হচ্ছে আশিন।তবে আশিনের মুহুর্তের মাঝেই এভাবে পরিবর্তন হওয়া উৎসের মস্তিষ্কে গিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হলো।এভাবে একদৃষ্টে সামনে এমন কি দেখে যাচ্ছে মেয়েটা।কুয়াশার মাঝে কিছু যে দেখা যাবে সেটাও তো নয়।উৎস হাত থেকে ফোন মাটিতে পড়ে যায়।কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয় উৎস। চারপাশ অন্ধকার।আশিনদের বাড়ির পাশে রূপালিদের বাড়িটা ছাড়া আর কারও বাড়ি নেই। ঘনবসতি জায়গা নয় এটা।এই শীতের রাতে কেউ এলে নিঃসন্দেহে ভয় পাবে।পাওয়ারই কথা। আশিনদের পুরো বাড়িটা অন্ধকার মনে হচ্ছে উৎসের।হাটু মুড়ে মাটিতে তার ফোনটা হাতড়াতে থাকে।দেখার চেষ্টা করে ফোনটা কোথায়। সৌভাগ্যবশত ফোনটা হাতে পেতেই উঠে দাঁড়ায়। ফোনে চাপ লাগতেই সেটা হুট করে জ্বলে উঠলে সামনে তাকাতেই উৎস এতোটাই ভয় পায় যে মাটিতে বসে পড়ে।আশিন পূর্ণহাসিতে তারই দিকে কেমন ভয়ানকভাবে তাকিয়ে ছিলো।উৎস ভীতু নয়। প্যারানরমাল কোনোকিছুতেই সে বিশ্বাসী নয়।এমন অনেক কুয়াশা ভরা রাতে সে চলাফেরা করেছে একা একা তবে আজকের ঘটনা যেন সেইসব ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।উৎস খেয়াল করে আশিন তখনও সেই হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারই দিক চেয়ে।উৎস উঠে দাঁড়িয়ে কর্কশ গলায় বলে,“ ভুতের মতো এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
আশিনের ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়।তার হাতের টর্চলাইটের আলোয় আশিনের মুখের অর্ধাংশ দেখা যাচ্ছে।আশিন নিজরূপে যেন ফিরে আসে।দাতে দাত চেপে বলে,“ আমার বাড়িতে কি করছেন আপনি?”
উৎস ভ্রুকুটি করে বুকে দুহাত জড়িয়ে বলে,“ আমার ইচ্ছা।যেখানে খুশি যাব।”
আশিন তর্জনী উঁচিয়ে বলে,“ দেখুন ব্যাকাত্যাড়া কথা মোটেও আমার সাথে বলবেন না।আপনার নিশ্চয় কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে।”
উৎস হাত নামায়।আকাশ থেকে ভূপতিত হওয়ার ভান করে চোখ দুটো বড় বড় করে বলে,“ ছি!খারাপ উদ্দেশ্য বলতে কি বোঝাচ্ছো তুমি?মাইন্ড ঠিক করো জান।”
আশিন ক্ষেপলো।পেছনে ঘুরে চলে যেতে নেয়।তবে উৎসের শান্তস্বরে স্বগতোক্তিতে পা যেন থেমে যায়।
উৎস প্যান্টের পকেটে হাত গুজিয়ে কার্পণ্যহীনভাবে যেন বলে, “তোমাকে দেখতে এসেছিলাম আশিন।”
আশিনের থেমে যাওয়া দেখে উৎস সটান হয়ে দাঁড়ায়।
পেছনে ঘুরে আশিন উৎসের আপাদমস্তক ভালোভাবে দেখে নেয়।সরল স্বীকারোক্তি, চোখেমুখে অপ্রতিভ ভাব নেই।বোঝা যাচ্ছে সত্যি বলছে।আশিন বলে,“ আমাকে দেখতে হবে না।চলে যান।”
“ আমার জায়গায় উচ্ছ হলেও কি তাড়িয়ে দিতে?”
অভিমানী না হলেও আশিনের মনে হলো উৎসের কথায় অভিমান রয়েছে।একজন নির্দোষ তো অন্যজন পাপী এই দুই ভাইয়ের মধ্যে।আশিন বাঁকা হেসে ওঠে,“ যেই হোক না কেন তাড়িয়েই দিতাম। তবে উচ্ছ যদি হতেন তবে ভেবে দেখতাম।”
চলবে….