“ আশিন মেয়েটা সাধারণ কেউ নয়।”
উৎস’র কথাটা শুনে নিহাল তাকালো।শাওন পায়ের ওপর পা তুলে বসে মোবাইলে কিসব ঘাটাঘাটি করছিলো, উৎসর কথা শুনে সেও তাকালো। কৌতুহলী হয়ে শুধালো,‘‘ কি বলতে চাইছিস?আশিন মানুষ না?’’
উৎস মুখ খিঁচালো।বিরক্তি ঢেলে আওড়ালো,‘‘এমনটা কি আমি একবারও বলেছি শালা?’’
শাওন ভাবছে আশিন যদি সাধারণ মেয়ে নাহয় তো কি এলিয়েন নাকি?জানালার কাছে দাঁড়ানো উৎসর কাছে গিয়ে উৎসর কাঁধে হাত রাখলো নিহাল,‘‘হঠাৎ এই কথা?’’
‘‘মেয়েটাকে গতকাল দেখার জন্যই হাসপাতালে গেলাম তবে গিয়ে দেখলাম একটা লোককে কি নৃশংস ভাবে খুন করলো।আশেপাশে থাকা ডাক্তার নার্সরাও তো কিছু বললো না।’’
নিহাল ভাবুক হয়ে আকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসলো,‘‘এই খুনের সাথে জড়িত নয়তো?’’
উৎস ভুরু কুঁচকে তাকালো নিহালের দিকে,‘‘যা বুঝলাম লোকটাই গতকাল মারতে গেলো।বুঝতেছি না কি চলছে? তবে খুব বড়সড় ঘাপলা আছে এখানে।’’
শাওনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,‘‘কিছু পেয়েছিস?’’
শাওন তৎক্ষণাৎ জবাব দিলো,‘‘আসলে এভাবে একাধারে বুড়ো লোক নিখোঁজ হয়েছে ২০১৯ সালে। গ্রামাঞ্চলের দিকে বেশি।শহরাঞ্চলে নেই বললেই চলে।এটা নিয়ে কিছুদিন কেইস চলেছে তবে তার দুই মাস পরই কেইস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে কয়েকমাস আগে।তবে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো দুই মাস পরই সেই কেইস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।বিষয়টা এ নিয়ে দুবার। তবে আমাদের গ্রামের পাশের গ্রামে ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি আবারও হলো।এবার কেইসটা অনেকদিন যাবৎ চলছে।আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো তোকেই এখানে ফাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।আর মাধ্যম হিসেবে যেন কাজটা করলো বিশাল।কিন্তু বিশাল তো আমাদেরই বন্ধু।’’
তখনই তিনটি প্যাকেট হাতে রুমে প্রবেশ করলো অভি।তিনজনের দৃষ্টি খুব সহজেই আকর্ষণ করে সোজা হেঁটে গিয়ে বিছানায় বসলো।প্যাকেট থেকে খাবারগুলো বের করে বলে,‘‘খেয়ে নে তোরা।’’
উৎস,নিহাল,অভি,শাওন সবাই একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছে।তবে অভি আর উৎসর ডিপার্টমেন্ট একই হলেও বাকিদের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। অভির হোমটাওন অন্য জায়গায় তবে উৎস আর বাকিদের একই জায়গা থেকেই।ছোট থেকেই একসাথে বড় হয়েছে তারা।বন্ডিংটাও ভালো।তবে বিশালের এমন পল্টিবাজির জন্য উৎসর মনচ্যুত হয়েছে।
“ আজ সারাদিন বাসায়ই থাক।বাইরে বের হবি না তোরা কেউ।পুলিশরা পাগলা কুত্তার মতো তোদের খুঁজবে কয়েকদিন।”
অভির কথার জবাবে নিহাল বলে,“ তাই বলে কি এভাবে কোনোকিছু করা ছাড়া বসে বসে থাকবো শুধু?নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে না?”
“ আমিই ব্যবস্থা করছি কিছুর।তার আগে একটু পর একটা ছেলে আসবে।ছেলেটা কুমিল্লার।ওদের গ্রামেও নাকি এমন ঘটনা ঘটেছে অনেক বছর আগে।ছেলেটা হেব্বি জিনিয়াস।তোদের কাজে লাগতে পারে।”
উৎস ভ্রু কুঁচকায়,“ কাজে?”
অভি দাত কেলালো।সবাই খাবারগুলো খেয়ে নিলো।অভি চলে গেলো।কাজ আছে তার।অফিসে যেতে হবে।বিকেলে আসবে ওই ছেলেটাকে নিয়ে।উৎস আবারও উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো।আশিনকে মনে পড়ছে খুব।তার এই মনের কথা নিহাল যেন ধরতে পারলো।কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললো,“ মনে পড়ছে আশিনকে?”
উৎস উত্তর দিলো না।চোখ দুটো শীতল। নিহাল আকস্মাৎ জিজ্ঞাসা করলো,“পছন্দ করিস?”
এবার উৎস খুব যত্নে জবাবটা দিলো মনে হলো,“ উহু ভালোবেসে ফেলেছি।”
নিহাল চমকালো না,“ ভেবেচিন্তে পা দিয়েছিস তো?”
“ গোলাপ ফুলের গায়ে তো কাঁটা থাকবেই তাই বলে যে ধরার সাহস করবো না এমন পুরুষ আমি নই।”
“ কিন্তু এটার ভবিষ্যত তো নেই।”
“ বর্তমান তো আছে! বর্তমানই চলুক আপাতত।”
নিহাল ঠোঁট উঁচু করে একটা শ্বাস ছাড়ে।উৎসর দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকলো সেও।
_______________________
শীতের আমেজটা আজকাল শান্তিপুর গ্রামে নেই আর।আগের দিন হলে এতক্ষণ উৎসব লেগে থাকতো।প্রতি শীতকালেই মেলা বসে এই গ্রামে।পাশের গ্রাম থেকে গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষজন সেই মেলায় এসে নিজ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায়। এছাড়াও পিঠা উৎসবও হয়ে থাকে।তবে এবার এসব কিছুরই আয়োজন হলো না। করবেই বা কে?আগে তো ভালো অশোক তালুকদারই এসব আয়োজনের মূলহোতা থাকতেন এখন নিজের পরিবারই মৃতপ্রায় হয়ে রয়েছে আবার গ্রামের অবস্থাও প্রায় খারাপ বলা চলে।বৃদ্ধ নিখোঁজের ঘটনার পর সবাই বাড়ি থেকেই খুব কম বেড়োয় যেনো। শুধু কর্মের তাগিদে দিনের আলোতে কাজকর্ম সেড়ে রাত এলে বাড়িতে ফিরে আসে পুরুষেরা।যেই দুজন বৃদ্ধ নিখোঁজ হয়েছে তাদের পরিবারের মানুষজন শহরে থাকে।পিতৃ নিখোঁজের কথা শুনে একবার দেখতে এসেছে আবারও যান্ত্রিক জীবনে ফিরে গিয়েছে সেই সন্তানেরা।বৃদ্ধ পিতামাতার খোঁজ রাখতে যেন তাদের দ্বিধা। কতশত বাবা মা এভাবেই অবহেলিত তার হিসাব নেই।পৃথিবীর দিন যত এগোচ্ছে একের পর এক অন্যায় বেড়েই যাচ্ছে যেন।
অশোক তালুকদার বাগানের পাশে রাখা বেতের সোফায় বসে আছেন।কপালে চিন্তার ছাপ।এক ছেলে পলাতক তো অন্য ছেলে ঢাকায় গিয়ে গোপনে বিয়ে করেছে।হাসফাস করে উঠলেন।প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পরও একই অবস্থা।উর্মিলার সাথে প্রেম ছিলো অশোকের।দুপাক্ষিক সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছিলো তাদের।তবে বারো বছর সংসারের মহিমা ত্যাগ করে পরদেশে পাড়ি জমান উর্মিলা।তখন খুবই ভেঙ্গে পড়েন অশোক তালুকদার।স্ত্রী শোকে পাগলপ্রায়ও হয়ে গিয়েছিলেন।উর্মিলার উষা বোন সুযোগ বুঝেই সময়টা কাজে লাগায়। আর প্রথম স্ত্রী মৃত্যুর তিনমাস পরপরই মিসেস উষাকে বিয়ে করেন অশোক তালুকদার।বড় ছেলে উচ্ছ স্বাভাবিক থাকলেও উৎস মেনে নিতে পারে নি।তাইতো এতবছরেও একটাবারও সৎ মায়ের সাথে কথা বলেনি।এমনকি বাবার সাথেও কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে উৎস।যত যাই হোক অশোক তালুকদার নিজেও বিশ্বাস করেন না তার ছোট ছেলে এমন কাজ করবে।যতই বখাটে,রগচটা,বদমেজাজী স্বভাবের হোক না এতটা নিকৃষ্ট,পাপ কাজ অন্তত সে করবে না।কিন্তু রূপকের প্রমাণাদিও যে আজ উৎসের বিরুদ্ধে।তবুও ছেলের প্রতি অগাধ বিশ্বাস রয়েছে অশোক তালুকদারের।বুকে খুবই ব্যথা অশোক তালুকদারের।আজ কতবছর হলো ছেলে তার সাথে কথাই বললো না।এতটা অভিমান?বুক ব্যথা উঠতেই আবারও হাপাতে থাকেন অশোক তালুকদার।পাশে দাঁড়ানো ছোট ভাই বসন্ত বিষয়টা খেয়াল করতেই উদ্বীগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করেন,“ ভাইজান, আপনি ঠিক আছেন?কষ্ট হচ্ছে কি আপনার?আজ হাসপাতালে চলুন।”
হাত দিয়ে বারণ করে দেয় অশোক তালুকদার।চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলেন উনি ঠিক আছেন।রূপক পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো চাচার এই অবস্থা দেখে কাছে আসে।হাটু গেড়ে বসে চাচার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলো,“ আপনি ঠিক আছেন কি চাচা?”
“ ঠিক আছি বাবা।তবে মনের অবস্থা ভালো নেই।”
রূপক বুঝলো বিষয়টা।অশোক তালুকদার বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেন,“ আমার উৎস এমন কাজ করবে না রূপক।তোর কোথাও ভুল হচ্ছে।”
রূপক উঠে দাড়ালো।উৎসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এটা নিয়ে টেনশনে আছে।তার মাথা আর কাজ করছেনা ইদানীং।নিজেকে খুবই পাগল মনে হয় তার।কেইসটা খুবই জটিল এর মাঝে একের পর এক ঘটনা তো ঘটেই যাচ্ছে এতে আরও বেশি মাথা ধরে যাচ্ছে রূপকের।চিন্তায় চিন্তায় আজকাল খাওয়া দাওয়াও ঠিকমতো করছে না রূপক। এদিকে ডাক্তার আশিনের খোঁজ নিয়েছিলো গতকাল।আবার অন্যদিকে অফিসার মঞ্জুরিও হাওয়া হয়ে গিয়েছে।আবার থানার কিছু কাগজপত্রও নেই।রূপক এখন হাসপাতালে যাবে কিছু কাজে।অশোক তালুকদারকে বিনম্র স্বরে বলে,“ আমি এই কেইসটার শেষ অবধি যাব চাচা।যদি উৎস নির্দোষ প্রমাণিত হয় তো তার কাছে আমি নিজেই ক্ষমা চাইবো।আর যদি সমস্ত প্রমাণ ওর বিরুদ্ধে চলে যায় তবে নিজে উৎসর সর্বোচ্চ কঠিন শ্বাস্তির ব্যবস্থা করবো।”
অশোক তালুকদার শুনলেন তবে প্রত্যুত্তর করলেন না।রূপক চলে গেলো। গাড়িতে উঠে তৌশিককে বললো হাসপাতালে যেতে। তৌশিকও তাই করলো।হাসপাতালের কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড় করাতে বললো রূপক।তৌশিক জিজ্ঞাসা করলো,“ স্যার এখানে কেন?”
রূপক উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলো না।সামনে তাকিয়ে থাকলো।একটি ছেলে আশেপাশে ভীত চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে আসছে এদিকে।রূপকদের গাড়ির সামনে আসতেই রূপককে দেখে আবারও আশেপাশে তাকালো।আর বলে,“ স্যার চুরি করে এনেছি এসব।”
কিছু পেপার্স রূপকের হাতে ধরিয়ে দিলো।আর রূপকও তাকে কিছু টাকা দিলো। হাসপাতালের কর্ণারের একটি কক্ষের জানালা থেকে কেউ একজন দেখলো এসবকিছু।ঠোঁট বেকিয়ে হাসলো।মনে মনে সেই ছেলেটিকে নিয়ে বাজে একটা ফন্দি আঁটলো। ছেলেটি আবারও বলে,“ ড. ইভান আসার পর থেকে হাসপাতাল কেমন ভয়ানক হয়ে উঠেছে স্যার।আর রিপোর্টসগুলোতে সমস্ত ডিটেইলস দেওয়া আছে।ড. ইভান, আশিন সমস্ত মিথ্যা কথাই বলেছে আপনাদের।”
রূপক থামিয়ে দেয়,“ তুমি যাও এখন।সেসব আমি দেখছি।”
ছেলেটি মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো।রূপক যাওয়া দেখলো ছেলেটির।রূপক পেপার্সগুলোর দিকে তাকালো।তার বিশ্বাস হচ্ছে না আশিন এমন কাজ করতে পারে? কিভাবে সম্ভব?আশিনের চোখজোড়া দেখে তো মনে হয় না মেয়েটা এত নৃশংস। এবার পেপার্সগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে থাকলো আর চমকে গেলো রূপক।
_______________________
“ আমার ভুল হয়ে গেছে স্যার।দয়া করে আমাকে ছেড়ে দেন।আর আমার জীবনে এমন কাজ করবো না।আপনি চাইলে আমি সেই পেপার্সগুলো আবারও মিথ্যা প্রমাণিত করে দেবো।”
দুপুরের সেই ছেলেটি কাদতে কাদতে কথাটা বললো ইভানকে।ইভান হাতে থাকা ছুড়িটা ঘুরাতে থাকে,“ তার আর কোনো প্রয়োজন নেই কুত্তা*র বাচ্চা।আমাকে কি বোকা*দা মনে করিস নাকি?নিজের চিন্তা কর তুই। আমি শুধু ভাবছি আজ কোন স্টাইলে মারবো তোকে আমরা।”
ভয়ে পিলে চমকে ওঠে ছেলেটির।চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝড়ছে।বাঁচার আকুতি মিনতি করতে থাকে অনেক।অনেক কাঁদলো তবে ইভান কি শিকার ছেড়ে দেওয়ার মতো মানুষ? অবশ্যই না।শাহর কাছে এগিয়ে এসে বলে,“ ছেলে তুই অনেক বোকা।টাকার প্রয়োজন তো আমাদের বলতি এভাবে আমাদের পেছনে লাগার মানে কি?”
ছেলেটা খুব করে নিজের প্রাণ ভিক্ষা চাইলো তবে কে শুনে কার কথা উল্টো ছুড়িটা কণ্ঠনালীর মাঝ বরাবর ঢুকিয়ে দেয় ইভান। শাহর ছেলেটার মুখ চেপে ধরেছিলো।তাই শুধু গোঙাতে থাকলো ছেলেটা।হাত পা ছোড়াছুড়ি করে, কাটা ছাগলের মতো মোচড়ামুচড়ি করলো ছেলেটা।রক্তে রঞ্জিত হলো পুরো ফ্লোর।এতটা নৃশংস মৃত্য যন্ত্রণা সহ্য করে নিমিষেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো ছেলেটা।হাত বাড়িয়ে ছেলেটার মুখ ধরলো।গলার মাঝখানে গর্ত হয়ে আছে।শিরা,হাড়গুলো ভেঙ্গে গেছে মাংসসহ বেড়িয়ে আছে।একটা সাধারণ মানুষ কখনোই এগুলা দেখতে পারবে না। তবে ইভান কি নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শাহর কাছে এগিয়ে এসে বলে,“ এই ছেলের অভ্যন্তরীণ জিনিসগুলো বেশ বেঁচা যাবে। আমি বুঝিনা বস কেন আমাদের শুধু বৃদ্ধদেরই মারতে বলে।এই ছোকরাগুলোর মালগুলোও তো প্রচুর পরিমাণে বেঁচা যাবে।”
ইভান ছুড়িটা ফ্লোরে ফেলে দিলো।শব্দ হলো একটা।শাহরের কথা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে আওড়ালো,“ এই ছেলেটাকে মারার কথা যেন জানতে না পারে কেউ।তার ব্যবস্থা করো।”
চলবে…