বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-২.১]

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ↓

মধ্যরাতে কিছু একটার আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেলো কল্পনার।পাশে ফিরে দেখলো রিভান নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।দাতে দাত পিষলো কল্পনা।একে ঠিক কবে মারতে পারবে সেই চিন্তায় ভুগছে ইদানীং।খেয়াল করলো বারান্দার ওপাশে কারো ছায়ামূর্তি।কল্পনা নিঃশব্দে উঠে এলো।এগিয়ে গেলো সেদিকে। বারান্দায় যেতেই মেয়েলী সুঘ্রাণ পেয়ে বুঝলো কে এসেছে?

“ আপু তুই?”

নিঃশব্দে ফিসফিস করে কল্পনা কথাটা বললো। আশিন পড়নের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে স্মিত আওয়াজে বললো,“ কাকে আশা করেছিলি? প্রশান্তকে? নাকি রূপককে?”

বুকে দু-হাত গুজলো কল্পনা,“ এমন কিছুই না।”

আশিন জিন্সের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো।অন্ধকারে সেটা দেখা না গেলেও বোঝা গেলো একটা সাদা কাগজ।আশিন ঘাড় বেঁকিয়ে রুমে একবার উঁকি মারলো।বাঁকা হেসে জিজ্ঞাসা করলো,“ রিলেশন টিলেশন হয়েছে নাকি?”

কল্পনা ঠিক বুঝলো না আশিনের কথার মানে,“ কি?”

“ কচি খুকি হয়েছিস? বুঝিস না কি বলছি? ফিজিকাল রিলেশন কি সেড়ে ফেলেছিস? ”

ভীষণ লজ্জা পেলো কল্পনা।এই শিমু আপুও না সবসময়ই লজ্জা দেয় তাকে।কল্পনা মাথা নিচু করে বললো,“ এর সাথে জীবনেও না।”

“ ভালো তবে। কিন্তু রূপকের প্রতি কোনো অনুভুতি রাখা যাবে না কল্পনা। আমাদের হলফনামায় প্রেমে পড়া,ভালোবাসা এসব বচন নেই। এটা ভুলে গেলেই, হও যত আপনজন তবুও মৃত্যু অনিবার্য।যেমনটা মিসেস উষার সাথে হয়েছে।”

থেমে গেলো আশিন।কথাটা বলার সময় বারবার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিলো তার।এটা কেন হলো? উৎসর জন্য? না এমনটা তো হলে চলবে না।আশিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।মনে পড়লো উৎসর সাথে কুমিল্লা যাওয়ার সেই মুহুর্তটুকু।উৎস এ পর্যন্ত যত কথা বলেছে এ-সমস্তকিছুই নাটকীয়।তাহলে আশিন কেন পিচলে পড়বে? আশিনের ব্যক্তিত্ব আর মানসিকতার সাথে তা যায় না।আশিন স্বাভাবিক মানুষ নয়। এটা ভুলে গেলে চলবে না মোটেও।

এদিকে কল্পনা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাবছে। তারও ভুলে গেলে চলবে না তাদের উদ্দেশ্য ঠিক কি? তবে এর মাঝে বেচারা রিভানই তাকে বিয়ে করে নিজের জীবন ধ্বংস করলো।যেচে নিজের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটা ।কল্পনা রিভানকে মারতে চাইলেও এতটা নিষ্ঠুর সে নয়।তাই ঠিক করেছে শিমু আপুর সাথে কথা বলে এই ছেলের সাথে নিজের ডিভোর্স খুব জলদি করিয়ে ছাড়বে।আশিন গায়ে হুডিটা জড়ালো।কল্পনা বাইরের অবস্থা একবার তাকালো,“ এত কনকনে ঠান্ডা আর এত গভীর রাতে এভাবে আসার কি খুব দরকার ছিলো?কল করলেই পারতে।’’

“ রুমে গিয়ে ফোনটা চেক করিস।’’

যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো আশিন।কল্পন বাধা দিয়ে বললো,“ বাড়ির ভেতর দিয়েই যাও আপু।’’

আশিন সেই কথার উত্তর দিলো না আর না কল্পনার বাঁধা মানলো।বরং প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,“ তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাস।”

‘‘ হু।’’

আশিন বারান্দার রেলিং ধরে অপরপাশে গেলো। তারপর দেয়ালের পাশে থাকা পাইপ বেয়ে নিচে নেমে গেলো।ধীরেসুস্থে হেঁটে সামনে এগোলো।গেইট দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।প্রাচীরের সামনে এসে দাঁড়ালো। সউচ্চ এই প্রাচীর বেয়ে চলার অবলম্বন খুঁজলো। একসময় পেয়ে গেলেই তা দ্বারা উপরে ওঠার চেষ্টা করলো এমনকি সফলও হলো।মুহুর্তেই অপরপ্রান্তে চলে গেলো আশিন।আশিনের এমন ক্লাইম্বিং স্কিল দেখলে কল্পনা মুগ্ধ না হয়ে পারে না।দেখতে সাধারণ হলেও আশিন চরিত্রটা যেন অনন্য।

__________________________

সময় যত বাড়তে থাকে বিভিন্ন দুশ্চিন্তা এসে যেন ভর করে মন মস্তিষ্কে।তার একছত্র উদাহরণ যেন অশোক তালুকদার।এমনিতেই ছোট পুত্রশোকে কাতর তার ওপর আজ জানতে পারলো পাশের গ্রামের খুন হওয়া সেই লোকেদের পরিচয়। অশোক তালুকদার তো যেন চমকে গিয়েছিলেন প্রথমে।নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেই এখন ঠান্ডা মাথায় ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন।আশিয়া তালুকদার সেখানে আসলেন লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে।ছেলের মুখ কালো আর চিন্তান্বিত দেখে ভাঙ্গা ভাঙ্গা আওয়াজে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কি হইছে বাপ?’’

বৃদ্ধা মায়ের আওয়াজ শুনে চোখ খুলে সামনে তাকালেন অশোক।মা–কে দেখে এগিয়ে গেলেন কাছে।চেয়ার টেনে বসিয়ে দিলেন।

“ তোমার শরীর তো খারাপ মা।এই অসুস্থ শরীর নিয়ে এখানে কি করছো?’’

হতাশার শ্বাস ফেললেন আশিয়া তালুকদার। অনুশোচনা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন,“ জীবনে পাপ কি কম করছি রে? এইলেইগাই তো আইজকা আমগোর পরিবারে এমন ফাঁটল ধরছে।তোর বড় বউ মইরা গেলো। ছোট বউও মইরা গেলো।মেজো বউ একা সংসার সামলাইতাছে।হের কি কষ্ট হয় না?হয় তো। পুলার লেইগাও চিন্তা হয় হের।হেইদা আমি বুঝি বাপ।তোর বড় পোলায় তো তাও মাঝেসাঝে আহে। কিন্তু ছোদডা সেই যে গেলো আর তো আইলো না। হেয় কি কাম করে এইডাও জানবার পারলাম না জীবনভর। সৎ মারেও মাইরা ফালাইয়া চইলা গেলো। আর কি দেহার আছে জীবনে।’’

অশোক তালুকদার মায়ের শেষের কথাগুলোর সাথে মত দিতে পারলেন না।মুখ গম্ভীর করে বললেন,“ উৎস এমনটা করে নি মা।আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে ওর ওপর।’’

“ রাখ তোর বিশ্বাস।’’

হঠাৎ হাঁপানো শুরু করলেন আশিয়া।প্রচন্ড কষ্টে আওড়ালেন,“ হেই ডাক্তার আমারে দেইখা যাইবার পর থেইকা শরীরডা কেমন জ্বলে খালি।তোমগোর ব্যস্ততার কারণে কইবারও পারি নাই।আমি মনে হয় বেশিদিন বাঁচমু না আর। ’’

আশিয়া তালুকদারের কথায় খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে চেঁচিয়ে ছোট ভাই বসন্তকে ডাকলেন।বসন্ত তালুকদারও দৌঁড়ে এলেন।দরজার কাছে এসে উদ্বীগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন,“ কি হয়েছে? ’’

“ মা–কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি ধর।’’

ধরাধরি করে নিচে নামানো হলো আশিয়া তালুকদারকে।গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হলো।পথিমধ্যে অশোক তালুকদার বড় ছেলেকে কল করলেন।তিনবার কল করার পর রিসিভড হলো।

উচ্ছ মাটি খুড়ছিলো।গত পরশু গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছে উচ্ছ।শহর বললে ভুল একটা জঙ্গলে এসেছে সে।সাথে রেহানাকেও নিয়ে এসেছে।এইতো গতকালই রেহানাকে নির্মমভাবে মেরে ফেললো।পুরো শরীর টুকরো টুকরো করে পুড়ে ফেলে এখন সে স্থানে মাটি চাপা দিচ্ছে।সারারাত এই জঙ্গলেই ঘুমিয়েছে।চেহারা কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছে উচ্ছর।দেখে একটা সাইকো বললে ভুল নয় বরং সঠিক হবে।তার কাছে মানুষ মারা যেন খুবই তুচ্ছ ব্যাপার।বাবা অনেক্ষণ যাবৎ কল করছিলো।এতে উচ্ছর কাজ করতে ভীষণ সমস্যা হচ্ছিলো।এবার উঠে এসে কলটা রিসিভ করতেই অশোক তালুকদার কাঁদোকাঁদো গলায় বলেন,“ উচ্ছ বাবা তোর দাদীর শরীর অনেক খারাপ রে।ভয় হচ্ছে আমার।’’

মুখ দিয়ে বিশ্রি গালি বের করতে চাইলেও থেমে গেলো উচ্ছ।মাথা ঠান্ডা করার প্রয়াস চালালো।ঠান্ডা গলায় জবাবে বললো,“ হাসপাতালে নিয়ে যাও।’’

তারপর বাঁকা হেসে কষ্ট পেয়েছে এমন আওয়াজে বললো,“ আমি ড. ইভানকে বলে দিচ্ছি যাতে চিকিৎসার কোনো কমতি না থাকে।’’

বলেই কল কেটে দিয়ে এবার সঙ্গে সঙ্গেই কল লাগালো ইভানের নাম্বারে।ইভানও তখনই রিসিভ করলো।

“ বলো উচ্ছ।’’

“ অশোক যাচ্ছে হাসপাতালে।বুড়ি মায়ের চিকিৎসা করাতে।তুমি তোমার সর্বোচ্চ দিয়ে চিকিৎসা সেবা দাও।’’

অপরপ্রান্ত হতে ইভান হো হো করে হেসে উঠলো। সবেই হাসপাতালে এসেছে।ড. শাহরের সাথে বসে চা খাচ্ছিলো।শাহর চোখ দিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন,“ কি হয়েছে?’’

ইভান ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,“ মি. অশোক তালুকদার অসুস্থ মা–কে নিয়ে আমাদের কাছে আসছেন।চিকিৎসা সেবা দিতে হবে।’’

শাহরও হাসলো।ইভান উচ্ছকে বললো,“ তুমি চিন্তা করো না উচ্ছ।তোমার দাদীকে আমরা সঠিক চিকিৎসাই দেবো।তবে তোমার চেয়ারম্যান বাপের হাত তো আবার লম্বা।আমাদের বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে কি?’’

উচ্ছ বিরক্তি ঢেলে বললো,“ আমি আছি।আর যেই গ্রামে পুলিশদের ওপর চেয়ারম্যানেরই কোনো আধিপত্য নেই সেখানে পুলিশই বা কি করবে?’’

ইভান হো হো করে হেসে উঠলো।ভীষণ মজা পেয়েছে কথাটাই।

________________________

উৎস বিভিন্ন কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি গাছের পাশে।নিহাল এগিয়ে আসলো তার দিকে। আরেকটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো,“ তোর কি মনে হয়।’’

“ কালো বাজারে ওদের হাত অনেক লম্বা।তবে তারা ভুল মানুষের সাথে লাগতে এসেছে।আমিও এর শেষ দেখেই ছাড়বো।’’

“ ওপরমহল থেকে মেসেজ এসেছে গতকাল।’’

“ কি?’’

নিহাল ফোনটা বের করলো।একবার পড়ে বললো,“ কাজ কতদূর এগিয়েছে সেই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে।আর কোনো সাহায্য লাগলে তাদের বলতে বলা হয়েছে।’’

উৎস আর কিছু বললো না।দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে। পথ তাদের বহুদূর বাকি।এখনও তো সবে সমুদ্রে ঝাপ দিয়েছে।এরপর মহাসাগরে পৌঁছাতে হবে। শত্রুপক্ষের উদ্দেশ্যটা এখনও অজানা।আগে সেটাই জানতে হবে।তারপর তাদের দূর্বলতা খুঁজে সুযোগ বুঝে কোপ মারবে উৎস।এদের আবার উদ্দেশ্য একটা হলেও ভয়ানক সব আবিষ্কার রয়েছে তাদের। শহরে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্যই এই পরিকল্পনা তাদের।

“ তুই দেখেছিলি?’’

নিহালের কথায় ধ্যান ফিরলো উৎসর,“ খুব সামনে থেকে।তবে আমার কোনো ক্ষতি করেনি।’’

“ দেখতে কেমন?’’

“ মানুষের মতো হলেও ভীষণ ভয়ানক সেটা।’’

“ ক্ষতি করবে কি ওটা?’’

উৎস দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।আশিন যতোই একজন কিলার হোক না কেন এমনটা সে হতে দেবে না এই বিশ্বাস উৎসর আছে।তবে তার ওপর ল্যাভেলের মানুষগুলো তো নিষ্ঠুর।ওদের খোঁজেই তো এই মিশন। উৎসর নিজেকে আজকাল কেমন নিঃস্ব লাগে।আশিন স্বাভাবিক হলেও পারতো।খুব কি দরকার ছিলো নিজেকে ওমন তৈরি করার? উৎস ভাবলো নিজের মনকে বেপরোয়া করলে চলবে না।সংযত রাখতে হবে। আবেগে,মোহে গা ভাসালে চলবে না।

নিহাল উৎসর এতো কিসের চিন্তা সে বিষয়ে বুঝতে পারে না।উৎসর প্ল্যান সম্পর্কেও জানে না।তবে বড়সড় যে কোনো প্ল্যান করছে উৎস এ ব্যাপারে জানে।

চলবে,…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *