বিষন্ন নক্ষত্র | সকল পর্ব

  • পর্ব – ০১

সকাল ১০ টা ঘড়ির কাঁটায়। এখনো বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না শিউলির। খাটের পাশের জানালায় মস্ত বড় আকাশটা উঁকি দিয়ে হাসছে। দোতলার ঘর বলে বাতাসটা বোনাস পাই। কাঠফাটা রোদ বাইরে আর ঘরের মাঝে ফ্যানের তীব্র বাতাস নিচের ঘরটায় টাইপ রাইটিং এর খট খট শব্দে আমার প্রকৃতি গবেষণায় যেন  ব্যাঘাত পরছে।

আমি সিরিতে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বললাম শাকিল ভাই ও শাকিল ভাই বাড়িতে কি  শান্তিতে থাকা যাবে না? সকাল সকাল ঘট -ঘট আওয়াজ। আমি পড়াশোনায় মনোযোগ হারাচ্ছি এমন শব্দে। দয়া করে ভাড়াটিয়া কে বলবে যেন সকাল-সকাল অমন ফটফট খটখট আওয়াজ না করে।

শাকিল ভাই শুনেছে কিনা সন্দেহ তবে ও ঘর থেকে টাইপ রাইটারের আওয়াজটা  সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল আমি আবার  প্রকৃতি বিলাসে মত্ত  হয়ে গেলাম।

সামিয়ার মা বাড়িতে কাজ করে বহু কাল হবে। আমার দেখাশোনা করতেই বাবা তাকে কাজে রেখেছে হয়তোবা ভেবেছে মা মরা মেয়েকে কে  দেখবে? কিন্তু আমি যে নিজের কাজ নিজেই করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি তা জানার সময় বাবার হয়ে ওঠেনি।

সকালের নাস্তাটা শাকিল ভাই পারার এক দোকান থেকে আনে। রুটি পরোটার সাথে সবজি ডাল। দুপুরের রান্না আমিই করি। সামিয়ার মাকে অবশ্য রাখা হয়েছে এরই জন্য তবে তার রান্না  আমার বেশ অসহ্য লাগে শুকনো মরিচ দিয়ে লাল করে ফেলে।

শাকিল ভাই হাপাতে হাপাতে দোতলায় উঠলো আপামনি আজ মজিবুরের আব্বা মরছে তাই দোকান বন্ধ। এখন কি করবেন আপামনি?

দরজার বাহির থেকে শাকিল ভাইয়ের  এমন কথায় রাগ হলেও রাগ দেখালাম না। সোজা নিচ তলায় রান্না ঘরে গেলাম।

রান্নাঘরে মিস্টার ডিস্টার্ব নাস্তা বানাচ্ছে দেখে চলে আসতে চাইছিলাম।

-মিস শিউলি!  আপনি যদি কিছু মনে না করেন তবে আমি পায়েস বানিয়েছি। নাস্তা হিসেবে খেতে পারেন।আমি ভোরে হাঁটতে গেছিলাম তখনই জেনেছি মজিবুরের বাবা মারা গেছেন তাই পায়েসটা রান্না করেছিলাম।

-মিস্টার সায়ন সাহেব! পায়েসের জন্য ধন্যবাদ।তবে ছেলেমানুষের রান্নাঘরে ঘোরাফেরা করাটা আমার মোটেও  ভালো লাগেনা। আপনার উচিত বাইরে থেকে কিনে খাওয়া নয়তো আমাদের সাথে খাওয়া ।দেখে তো অশিক্ষিত মনে হয় না তাহলে রান্না ঘরের দরজায় লেখাটা পড়তে পারতেন যে এখানে ছেলে মানুষ নট অ্যালাউড।

-আমি দেখেছি মিস শিউলি! তবে কি জানেন কারো ঘরের হাঁড়ির আশায় আমি কেন জানি থাকতে পারি না। বাই দ্যা ওয়ে  পায়েস টা রেখে দিচ্ছি আশা করি ছেলে মানুষের রান্না বলে অবজ্ঞা করবেন না। আরো একটি কথা মেডিকেলের স্টুডেন্টরা এত বেলা করে ঘুমায় না ।খেয়ে পড়তে বসবেন আশা করি তাই এখন থেকে ঠিক ১২:৩০ পর্যন্ত টাইপ রাইটারে বসবো না ।

এতোটুকু বলে হন হন করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়ল উনি। পায়েসটা দেখে মনেই হচ্ছে না যে সে এক ছেলের হাতে তৈরি।

আজ আর পড়তে মোটেও ইচ্ছে করছে না। মানুষ  জাতটাই এমন আদেশকে অগ্রাহ্য আর নিষেধকে আগ্রহ বানিয়ে নেয়। হয়তো আমিও এখন সেই পথেই চলছি ।

সায়েন সাহেব ঠিক দুপুর ১:৩০ টায় লাঞ্চ করেন তা এত দিনে আমার মুখস্ত । আমি পায়েসটা বড় সমিহা করে খাচ্ছি যেন শেষ না হয়ে যায় ।বাবা ডাক্তার তাই চায় আমিও যেন ডাক্তার হই। কিন্তু আমার  সাহিত্য ভালো লাগে। বাবা ব্যস্ততায় এটা জানতে পারেনি আর আমি অভিমানে তা বলতে পারিনি ।

দুপুরের রান্না শেষ করতে না করতে সামিয়ার মা আসলেন সব গুছিয়ে, ধোয়া মুছা করে চলে গেলো। আমি শাকিল ভাইকে দিয়ে সায়ন সাহেবের খাবারটা পাঠিয়ে দিলাম। ছাদে গেলাম ফোনটা নিয়ে ।অনুকে একটা ফোন দিতেই সে ফোন ধরে বলল -কিরে শিউলি ফুল! কি খবর?

-আর খবর। ভাড়াটিয়ার জ্বালায় আর থাকতে পারছি না শান্তিতে ।

-কেন সে আবার কি করল? প্রেমের অফার-টফার করল নাকি?

-তাহলেও বাঁচা যেত। এই লোক তো স্বপ্নেতে এসেও  দখল দিচ্ছে। ভাবা যায়? আজ স্বপ্নে দেখলাম তিনি আমায় বিয়ে করতে এসেছে। সকালবেলা ওই কাকটা যদি জানালার পাশে ডেকে না উঠতো  তাহলে তো কবুল বলেই ফেলতাম। আজ থেকে এই কাকটাকে আমি খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলাম। সে শুধু এসে আমার অর্থহীন স্বপ্নের দি এনড করবে।

-আমার তো মনে হয় তুই আস্তে আস্তে মিস্টার ভাড়াটিয়ার প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস। আজকাল শুধু তার কথাই বলছিস। উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখছিস । ব্যাপারটা অতি সহজ আপনার আকাশে উদ্দীতো হইয়াছে প্রেমেরও সূর্য ।হা হা হা

-চুপ কর তো। এমনি উনাকে দেখলে বড্ড অস্থিরতায় ভুগি তার ওপর তোর এমন কথা আর ওইসব স্বপ্ন। ওফফফ! আমার একটু শান্তি চাই ।তুই কি বিকেলে একটু আসবি? না হয় একটু থেকে চলে যাস ।শাকিল ভাইকে পাঠাই?

-থাক আর শাকিল ভাইকে পাঠাতে হবে না আমি আসতে পারবো ।তবে আমায় আচার আর দই চিরে খাওয়াতে হবে কিন্তু?

-ঠিক আছে আয় আগে ।

  • পর্ব – ০২

ফোনটা রেখে শাকিল ভাইকে ডাকছি তার কোন আতা পাতা নেই ।বাধ্য হয়ে নিচ তলায় দক্ষিণের ঘরটায় পা বাড়ালাম ।ঘরে ঢুকে যেই বলবো ভিতরে আসতে পারি? তার আগেই দেখলাম নীল পাঞ্জাবি পড়ে তিনি বই পড়ছেন।আমার চট করে সকালের স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল ।আমি লজ্জায় নীল হয় যেই না চলে যেতে চাইলাম তখনই উনি ডেকে উঠলো

-মিস শিউলি! ঘরে আসতে পারেন ।

আমি উপায় না পেয়ে ঘরে ঢুকে স্থির চোখ দুটি ফ্লোরে রেখে বললাম

-আমার বান্ধবী আসবে বিকেলে। আপনি কি বাজার থেকে দই আর চিড়ে নিয়ে আসতে পারবেন ?

-মিস শিউলি! ডাক্তারদের মৃত ব্যক্তির চোখের দিকেও স্বাভাবিকভাবে তাকাতে হয় আর আপনি আমার মত জীবিত সুস্থ মানুষের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছেন না ? আসলে আপনার আরো প্র্যাকটিস করার দরকার ।এত দুর্বল হলে চলবে না ।

আমি টাকাটা টেবিলে রেখে কোনমতে দৌড়ে চলে আসি ।আসার সময় দেখলাম শাকিল ভাই বাগানে ফোনে কথা বলছে আর হাসছে। ঠিক ভেবেছি। বউ এর সাথে প্রেম আলাপ করছেন মহাশয়। শাকিল ভাইকে গিয়ে বললাম -কি হলো শাকিল ভাই ,কতবার ডাকছিলাম শুনতে পাওনি ?

-আপা মনি আমার বউয়ের বাচ্চা হইবো ।

-তাতে তুমি এত খুশি হচ্ছ কেন ?

মুখে নিষ্পাপ হাসি এঁকে  শাকিল ভাই বলল

-আমি আব্বা হমু আপামনি ।

-ওওও তাই বলো। যাও  সায়ন সাহেবের ঘরে টাকা রেখে এসেছি। বাজার থেকে এক কেজি দই আধা কেজি চিরে আর 2 কেজি মিষ্টি আনবা এক্ষুনি। যাও যাও

-আচ্ছা আপা মনি এক্ষুনি আনতাছি আমি ।

বিকেলে অনুর সাথে কথা বলতে বলতে বাগানি হাঁটছি। রিক্সা করে সায়ন সাহেব আর  শাকিল ভাই নামলেন। সায়ন সাহেব আমায় বললেন

-একটা কাজের ভার একজনকেই দেয়া ভালো। দুজনকে একই কাজ  দিলে প্রথম ব্যক্তির মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়। আমি চাইনা অহেতুক অপমানিত হতে। যদিও বা আপনি করেছেন তাই কিছু মনে করিনি ।তবে এইটা দ্বিতীয়বার যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

-কেন আমি অপমান করলে বুঝি আপনি অপমানিত হন না?

-(মুচকি হাসি দিয়ে ) আজ আমার একজন গেস্ট আসবেন। তিনি বাইরের খাবার খান না ।পারমিশন পেলে আমি তার জন্য একটু কিছু রান্না করতাম ।

-না ।আমার রান্না ঘরে ছেলেদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ।দরকার পড়লে একজনের খাবার বেশি রান্না করব। আপনার মেহমান আমাদের সাথে খেলে আপনি অপমানিত হবেন না তো ?

উনি আবারও মুচকি হাসি দিয়ে ঘরে চলে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ অনুর সাথে কথা বলে শাকিল ভাইকে দিয়ে মিষ্টি দই আর চিরে পাঠাই সায়ন সাহেবের ঘরে।

সন্ধ্যায় রান্না করছি আর ভাবছি, আমি জানি সায়ন সাহেব রান্না করতে পারেন না। পায়েস, ডিম ভাজা আর মাছ ভাজা পারেন তাও ঠিক হয় তো হয় না ।তবুও আমায় জানানোর জন্য বললেন তিনি ।কেন ? সোজাভাবে বলা যেত না শিউলি আমার মেহমান আসবে একটু রান্না করে দিও ।উফ কি যে ভাবছি। আমি কি পাগল হওয়া শুরু করেছি নাকি?

রাতে সচরাচর রান্না করা হয় না আমার। দুপুরের রান্না টাই গরম করে খেয়ে নিই ।বাবা রাতে বাইরে খেয়ে আসেন ।আর সকালে মজিবরের দোকান থেকে নাস্তা শাকিল ভাই এনে দেয় ।দুপুরটা কি করেন বাবা তা কখনো জানানোর সময় করে উঠতে পারেননি তিনি ।

রূপচাঁদা মাছ আর গরুর গোস্ত রান্না করলাম। ভাতের হাঁড়ি বাসাবো  তখনই রান্না ঘরের দরজা থেকে সায়ন সাহেব বলে উঠলেন

– মিস শিউলি আপনি কি আমায় শেখাবেন শুটকি মাছের ভর্তা কি করে করতে হয় ? আমি ওটা বানাতাম? আমার মেহমান শুটকি মাছের ভর্তা খুব পছন্দ করেন ।

-ইনিয়েবিনিয়ে  না বলে সোজাভাবে বলতে পারেন না? শিউলি একটু শুটকি ভর্তা করে দাও। ইয়ে মানে করে দিন ।

সায়ন সাহেব মুচকি হাসি দিয়ে কিছুক্ষণ  তাকিয়ে ছিল আমার দিকে ।তারপর শাকিল ভাইয়ের ডাকে বাহিরে চলে গেলেন ।রান্না ঘরের জানালা দিয়ে দেখলাম একজন মেয়ে মানুষ রিকশা থেকে  নামছেন। বোরকাতে সারা শরীর আবদ্ধ চেহারাটাও দেখার সুযোগ নেই ।তাহলে কি এটা সায়ন সাহেবের ~~~না না উনি তো দেখেছি পা ছুয়ে সালাম করলেন।যেই হোক আমার কি ?আমি ব্যস্ত হয়ে সব রান্না করা খাবার গুছিয়ে রাখছিলাম টেবিলে তখনই এক মহিলা কণ্ঠ  ভেসে এলো  কানে

-শিউলি! কেমন আছো মা?

আমি অবাক হয়ে  তাকালাম ।সায়ন সাহেব  পিছন থেকে বলে উঠলেন

-মিস শিউলি! ইনিই আমার মেহমান। আমার মা।

আমি সালাম জানিয়ে বললাম

– ভালো আছি আন্টি। আপনি ভালো আছেন?

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। ও মা একি!  এতটুকুনি মেয়ে টেবিল ভরিয়ে  ফেলেছে রান্না করে। আমার শুটকি ভর্তাও ছাড়েনি  দেখছি।  নিশ্চয়ই সায়ন বলেছে এটা বানাতে?

এই বলে ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন তিনি। সায়ন সাহেব মিছে ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বললেন

-আমিতো বানাতে বলিনি মা। আমি বলেছি আমায় শেখাতে যেন আমি বানাতে পারি ।কিন্তু তোমার মত মিস শিউলি ও রান্নাঘরে ছেলেদের ঢুকাতে  নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। তাই আর কি

রাতে বাবা এসেছে তবে তার নাকি ক্লান্ত লাগছে শুয়ে পড়েছে না খেয়েই ।সায়ন সাহেবের মা নাকি বাবার দূর সম্পর্কের বোন  হন তাই ফুফু ডাকার আদেশ পেলাম আমি ।

ফুফু আমি আর সায়ন সাহেব রাতের খাবার খাচ্ছি ।আজ একসাথে প্রথম সায়ন সাহেবের সাথে বসে খাচ্ছি আমি ।উনি বার কয়েক  তাকিয়েছেন  আমার দিকে তা দৃষ্টিগোচর হয়নি আমার ।সায়ন সাহেব তার মাকে বলতে লাগলেন আমার গুণের কথা যার অধিকাংশই উনার মার সাথে মিলে যায় ।আমি শুধু নিলিপ্ত ভঙ্গিতে চেয়ে আছি আর ভাবছি সারাদিন যে লোকটা ঘরের কোণে একা চুপচাপ বসে থাকে, সে কিনা এত আচারি আলাপ জানে! এক সময় ফুপু বলে উঠলো

-জানো শিউলি!সায়ন ছোটবেলায় মেয়েদের দেখলে লুকিয়ে থাকত। আর যদি কেউ বলতো আমি তোমার বউ হব তবে তার কান্না আর থামতো না। হাহাহা

আমি মনে মনে ভাবছি এখনো কি কান্না করবে? এখন কি একবার ট্রাই করে দেখব কাঁদে কিনা?

-মা তুমি কি আমায় লজ্জায় ফেলতে চাইছো? এসব বাদ দাও তো ।মিস শিউলি হয়তো অস্বস্তিতে পড়ে শুনছেন এসব ।

আমার ভাবনার ঘোর কাটলো সায়ন সাহেবের কথায় ।আমি বললাম

-না না! আসলে আমি ভাবছিলাম এখনো কি সায়ন সাহেবকে বিয়ের কথা বললে কেঁদে ফেলবেন কিনা? হা হা

-এখন আর কাঁদলে চলবে না। কারন আমি এখানে তার জন্য মেয়ে দেখতে এসেছি। বউ ঘরে দিয়েই আমি যাব এবার।

আমি সায়ন সাহেবের দিকে একবার তাকালাম দেখলাম তিনিও এক দৃষ্টিতে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আমার বুকটা ধক করে উঠলো। কেন জানি এর কারণ আমি বুঝে উঠতে পারলাম না ।

রাতে ফুপু আমার ঘরেই শুয়েছেন। সায়ন সাহেবের আবার সিঙ্গেল খাট। প্রায় অর্ধ নিশি পর্যন্ত ফুপু সায়ন সাহেবের নানান কোথায় আমায় ডুবিয়ে রেখেছেন । ফুপুর যে আলাদা এক সত্তা  আছে তা যেন তিনি ভুলেই বসেছেন।মা জাতটাই বোধ হয় এমন। হটাৎ  হাসিখুশি আড্ডার মাঝখানে আমার কান্না দেখে ফুপু বুঝলেন হয়তো ।তাই বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন আমায়।

ভোর হতেই জানালার দিকে চেয়ে থাকা আমার এক অন্যতম অভ্যাস হয়ে গেছে ।জানালার পাশে সুপারি আর নারকেল গাছের সারি।আমার কেন জানি মনে হলো আমি মেডিকেলে আর পড়বো না ।সারাদিন এই জানালার পাশে বসে সাহিত্য চর্চা করে দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিব ।হঠাৎ ফুপু চা-নাস্তা নিয়ে আসায় ভাবনার জগত থেকে বাইরে এসে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলাম ।আমার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো ফুপু কে তা মনে করতে। খাবার খেতে খেতে কিছুটা খাবার জানালার পাশটায় রেখে দিলাম সেই কাকটার জন্য ।

বাড়ির পেছনটায় সপ্তাহখানেক পরে এলাম ।ফুপু নিয়ে এলো।  সায়ন সাহেব ও এলেন সাথে।পুকুরের চারপাশটায় নারকেল গাছ ।মস্ত বড় ঘাটও বাঁধানো। বাবার কাছে শুনেছি মা নাকি এই পুকুরের ঘাটে বসে কবিতা পড়তে ভালোবাসতেন ।হয়তো তাই আমি কবিতায় আনন্দ  খুঁজে পাই ।পুকুর পাড়ের পরিবেশটা আমার মনের স্মৃতির পাতা উল্টানোর মতো। এখানে আসলেই ভেতরটা মা মা করে ওঠে।

সায়ন সাহেব আমায় বললেন

-মিস শিউলি! আপনি যদি মনে কিছু না করেন তাহলে আজকের বাজার টা আমি করতে পারি?আমার মেহমান কে যদি নিজের মতো বাজার করে না খাওয়াতে পারি তবে আফসোস করতে হবে আমায় মনে মনে। আর আমার আফসোস করতে ভালো লাগে না।

আমি তাকিয়ে শুধু ছোট করে একটা হাসি দিলাম ।

  • পর্ব – ০৩

আজ বাবা বিকেলেই বাসায় এসে পড়েছে। ফুপু মজার মজার  পিঠা  বানালেন। আমি ফুপুকে সাহায্য করছি আর সায়ন সাহেব সব নিয়ে বাবার পাশে বসে খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। বাবার সাথে সায়ন সাহেবের বেশ জমে।ফুপু আর আমিও চা নিয়ে সে আড্ডায় যোগ দিলাম।হটাৎ কথার মাঝখানে আমায় ঘর থেকে  ফুপুর চশমা আনার কথা বলে পাঠালেন। আমি দরজার পাশটায় দাঁড়িয়ে আছি আর লুকিয়ে তাদের কথা শুনছি। ফুফু বাবা কে আমার আর সায়ন সাহেবের বিয়ের  কথা বলছেন। আমার বুকের পাশটায় ধক ধক করছে। তবে কি সেই ভোরের স্বপ্নটা সত্যি হতে চলেছে ?

বাবা আর ফুপুর কথার মাঝে সায়ন সাহেব বলে উঠলেন

-আমার একটি কথা ছিল।

ফুপু আর বাবা সায়ন সাহেবের এ কথায় অবাক হয়ে তাকালেন তারপর সায়ন সাহেব বললেন

-শিউলির পড়াশোনাটা খুব জরুরী বলে এই মুহূর্তে  আমি মনে করছি। বিয়ের ব্যাপারটা জানানো মানে পড়াশোনার বড় এক ব্যাঘাত ঘটানো ।আমি চাইনা তা হোক ।

ফুপু আর বাবা এ কথায় সায় দিয়ে এ ব্যাপারে কথা শেষ করতেই আমিও ঘরে গেলাম ।ফুপু  আমায় বললেন

-আহা! মা কষ্ট দিলাম তোমায় ।আসলে চশমাটা যে গলায় ঝুলনা ছিল তা মনেই ছিল না ।

সায়ন সাহেবের “মা প্রকাশনী” নামে একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে আসা অধিকাংশ বই যা প্রকাশিত হতে আসে তার মান কেমন  সেটাই সারাদিন পড়ে দেখে যাচাই-বাছাই করেন উনি ।

বাবার কথায় দেড় বছর পর আমার ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলে বিয়ের আয়োজন করা হবে।আমার রোদ জ্বালা ভোরের স্বপ্ন যে এমন ভাবে সত্য মূর্তি ধারণ করবে তা আমার বোধগম্য হয়নি কখনো।

সায়ন সাহেব যে এখন এক অস্থিরতার নাম আমার কাছে ।আমার যে এক সাহসী মন ছিল তা যে উনার চাহনির তাপে বিগলিত হয়ে যাচ্ছে ।তার ওপর আজেবাজে প্রকারের কিছু স্বপ্ন সারাবেলা আমায় তাড়া করে বেড়ায় ।সায়ন সাহেবের সামনাসামনি  হতেই স্বপ্নগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে।এই দেড় বছর যেন এক মানসিক ট্রমার মধ্যে দিয়ে পার করেছি ।একপ্রকার ঘরবন্দী করে রেখেছি নিজেকে ।

আজ  সপ্তাহ খানেক হলো সায়ন সাহেব নিজের বাড়ি গেছেন। তাতেও আমার অবস্থা ব্যাগতিক । সকালবেলা টাইপে রাইটারের আওয়াজ যেন আমার প্রাণ বাঁচানোর শেষ উপায় এখন ।কদিন যাবত স্বপ্নেও আসছেন না তিনি ।আজ কাক টাকে খাবারও দেয়নি যদি স্বপ্নে দেখি ।

পরীক্ষার রেজাল্ট এল বেশ যে ভালো তা বলা যায় না। মোটামুটি ধরনের ভালো করলাম ।

রেজাল্টের কথা শোনা মাত্র সায়ন সাহেব ফিরে এলেন হাতে একটা উপহার নিয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন ।তার সামনে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি ।একটা বই উপহার দিলেন নিমাই ভট্টাচার্যের মেম সাহেব বইটা ।আমি এক চিলতে হেসে বইটা নিয়ে বললাম

-উপহারটা আমার বেশ ভালো লেগেছে ।ধন্যবাদ

উনার ভুবন ভুলানো সেই মুচকি হাসিটা উপহার দিয়ে বললেন

-তা আমি জানি! আপনার শাকিলকে দিয়ে বই নিয়ে আসার ব্যাপারটায়  তা স্পষ্ট প্রকাশ পায়।

আমি লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে চট করে বলে ফেললাম

– বিয়ের তারিখ ঠিক হয়নি আপনার ?

উনি অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন

-আপনি কি বলছেন বুঝতে পারিনি ।

আমি এবার ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেই ফেললাম

– আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক করেননি ?নাকি বাবার মত আপনিও আমায় জানানোর প্রয়োজন মনে করেন না ?

সায়ন সাহেব আতঙ্কিত চেহারায় বলল

-কি বলছেন মিস শিউলি? আপনার সাথে আমার বিয়ে ?আপনি ঠিক বলছেন তো ?

আমি এবার রাগ করেই বললাম

-আমার সাথে অভিনয় করে লাভ নেই সায়ন সাহেব। আমি জানি আমার আর আপনার বিয়ের কথা হয়েছে এখানে এসব সস্তা নাটক করে আমায় চমকাতে চাওয়াটা আপনার বোকামো ছাড়া কিছু নয়।

সায়ন সাহেব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলেন

-এতকিছু জেনে উঠেছেন তবে আমি যে বিয়েতে না করে দিয়েছি তা জানতে এত বিলম্ব কেন করলেন মিস শিউলি ?আমি যে এ কারণে এ বাড়ি ছাড়ছি তাও নিশ্চয়ই জানেন ?

এবার আমি সুতা কাটা ঘুড়ির মতো মুখ থুবরে যে মাটিতে পড়লাম ।যার অস্তিত্বে ঢুকে নিজের সত্তাকে বিলীন করায় ব্যস্ত ছিলাম সে আজ আমার মনগড়া ভাবনা পায় পিষে দিচ্ছে?

উনি যা বলেছেন তাই আমার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে বারবার ।মনের ঝড়ে যখন ছোট্ট ভালবাসার কুঁড়েঘরটা  ভেঙে যাওয়ায় ব্যস্ত তখনই তাকিয়ে দেখি উনি চলে গেছেন ।দৌড়ের সামনের দিকটায় এসে দেখলাম উনি চলে যাচ্ছেন সাথে তার শখানেক  বই আর একটা লাগেজ নিয়ে চোখের সীমানার বাইরে চলে গেলেন ।

আমার এত দিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা  মনের সেই ছোট্ট ভালোবাসার ঘরটা যেন এক নিমিষের ঝড়ে ভেঙে তছনছ করে দিল ।তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার সব দৃশ্য যেন চক্ষু পটে  স্পষ্ট রূপে ভাসছে ।আমি এই প্রথম কারো জন্য এতটা গভীরতায় ডুবে ছিলাম যা আজ কর্পূরের মত  উরে গেল।

অনেকদিন কেটে গেল। সেদিনের কথা যেন এখনো কাটা হয়ে রয়ে গেছে মনের গহীনে।

এমবিবিএস করা ব্যস্ত মনে মাঝে মাঝেই উঁকি দেয় সে সব কথা ।

তবে আমি আর আগের মত সায় দেইনা ।আগের স্বপ্নগুলো যেন আর না দেখতে হয় তাই একটা টিয়াপাখিও কিনে ঘরে এনেছি ।আমার সব মনের কথা যা হয়তো এখন সায়ন সাহেবকে তার বউ হয়ে বলতাম তা সব এই টিয়া পাখিটাকে বলি ।

আমাদের এক প্রজেক্ট নিয়ে ক্যান্সার হসপিটালে আসা হঠাৎ সেখানে ফুপুকে দেখে অবাক হলাম ।প্রায় কয়েক বছর পর,তবে এড়িয়ে চলার চিন্তায় পা বাড়াতেই ফুপু ডেকে উঠল

– শিউলি মা

আমি পিছনে এসে সালাম দিলাম। আমাদের ভালো-মন্দ কুশলাদি জানানোর মাঝেই অন্য একজন নার্স এসে বলল

-চলুন! কেমো থেরাপির সময় হয়ে গেছে ।সব সেটআপ করা আছে। চলুন এবার।

আমি অবাকচিত্তে ফুপুকে দেখলাম।  কই? কোথাও তো ফুপুকে অসুস্থ বলে মনে হলো না। আমি ধীর পায়ে তাদের পিছন পিছন গেলাম। কেবিনে ঢুকতেই আমার বুকটা ধুক করে উঠলো। পা দুটি বরফ হয়ে যেন জমে গেছে ।চক্ষুদয় অশ্রু আটকাবার আর চেষ্টা করল না।

সায়ন সাহেব!!

এটা যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। মন বলছে এটা যেন সকালের সেই জ্বালাময়ী স্বপ্ন হোক যা খানিক বাদে ভেঙে যাবে।

  • শেষপর্ব

মাথা ভর্তি কোকড়ানো চুলের রেস যেন আজ খরার মাঠ । ঘন চোখের পাপড়ি যেন আজ অভিমানে ঝরে গেছে ।চোখের নিচে  অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আছে।আমি আর নিজেকে আটকাতে না পেরে ফুপুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। ফুপু ও কাঁদছে তবে আমায় সান্ত্বনা দেবার ফাঁকে ফাঁকে ।

সায়ন সাহেব কে কেমো থেরাপি দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নিজের ভালোবাসার কর্তব্য পালনের এই ক্ষুদ্রতম চেষ্টা যেন এই মুহূর্তে আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফুপু বাইরে চলে গেলেন তিনি যেন বুঝতে পারলেন আমার আর সায়ন সাহেবের একান্ত কিছু কথা রয়েছে।আবার ফুপু প্রমাণ করে দিলেন মা সন্তানের মনের কথা বুঝতে পারে ।

চলে যাওয়ার পর সায়ন সাহেবের ফ্যাকাশে  হাতটা ধরে কেঁদে উঠলাম । সায়েন সাহেব বললেন

-মিস শিউলি! আপনি এখনো পেসেন্ট হ্যান্ডেল করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি ।আপনার আরও প্র্যাকটিস প্রয়োজন। বি-নরমাল ডাক্তারদের ইমোশনাল হতে নেই।

আমি ওনার চোখে সুন্দর জীবন নিয়ে বাঁচা আক্ষেপ দেখতে পারছি । আমি উনাকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম

-এজন্যই কি বিয়েতে না করা হয়েছিল? যদি তাই হয় তবে আমি এই সপ্তাহেই  আপনাকে বিয়ে করব।

-অনেক কিছু পেতে চাইলেও

পিছিয়ে আসতে হয়;

জীবন দেখায় আঙ্গুল দিয়ে

সবটা তোমার নয়!

এই বলে সায়ন সাহেব ডুকরে কেঁদে উঠলেন যার কারণবশত  শ্বাস কষ্ট হতে থাকল।আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেখান থেকে চলে আসি

রাতে খাবার টেবিলে বসে বাবাকে বললাম বাবা সায়ন সাহেবকে আমি এই সপ্তাহে  বিয়ে করছি ।বাবা অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন

-সায়ন্তো ক্যান্সারের রোগী তার ফুসফুসে ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ।

-হুম জানি। এ কারণেই হয়তো আমাদের বিয়ে উনি ভেঙ্গে দিয়েছিলেন।

-তুমি কিভাবে জানলে বিয়ের কথা? সায়ন বলেছে তোমায় ?

-না। আমি ঐদিন আড়াল থেকে শুনেছিলাম ।বাবা ভালোবাসার মানুষ না পাওয়ার যন্ত্রণা কেমন হয় তো তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না।প্রিয় মানুষটির শেষ সময় অব্দি তার হাত ধরে রাখার আকাঙ্ক্ষা ,লোভ আমি সামলাতে পারছি না ।সায়ন সাহেবের শেষ নিঃশ্বাস যেন আমার অধিকারের জেরে ছুঁতে পারি সেই আশা করব। প্লিজ বাবা

বাবার সাথে প্রায় জোর করেই সায়ন সাহেবের বিয়ের ব্যাপারে মানালাম ।ঠিক হলো পরশু বিয়ে ।কিন্তু সায়ন সাহেব রাজি নয়। আমি অবশ্য তাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে রাজি করিয়েছি।

কোন মতে হলুদ দেওয়া হল। মেহেদির সময় পেলাম না। রাতের সায়ন সাহেবের সাথে ছাদে কথা বলছি। উনি বারবার একই কথা বলে চলেছেন বিয়ে করে লাভ নেই আপনি বিয়ে করবেন না ।এই অসুখ যে আমাকে ভালোবেসে আমার মধ্যে হারিয়ে গেছে! আমি তার থেকে মুক্তি পেতে যতই চেষ্টা করি সে আমাকে ছাড়বে না।

আমি এবার জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। উনিও খুব করে চাইছে তার বুকের খালি খাঁচাটায় আমায় রাখতে তবে পারছেন না ।কোথাও যেন তার জীবনের অনিশ্চয়তার অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। দুজনে এভাবেই কান্নায় রাত পার করলাম ।

পরদিন সকাল থেকে সায়েন সাহেবের বেশ কাশি। অসুস্থ ও কিছুটা। বিয়ের জন্য সায়ন সাহেবের পছন্দের নীল শাড়ি আর খোঁপায় বেলি ফুল দিয়ে সাজলাম। উনার জন্যেও নীল পাঞ্জাবি আমি নিজে কিনেছি।

বাবা এসে কপালে চুমু দিয়ে বলল

-তুমি বেশ সাহসী আমি গর্ব করি তোমার মত সন্তান পেয়ে ।

এমন সময় খবর আসলো কাজী চলে এসেছেন।বিয়ের জন্য সবাই একসাথে কাজ শুরু করলেন। বিয়ের জন্য সিগনেচার দিয়ে সায়ন সাহেব খুব কাঁদছিলেন।

কাজী বিয়ে পরিয়ে যখন কবুল বলার পালা সায়ন সাহেব তখনও অনবরত কাঁশছেন।কোন মতে বিয়ে হয়ে যায় আমাদের ।

আমি আমার ঘরে আজ সায়ন সাহেবের পছন্দের রজনীগন্ধা দিয়ে বাসর সাজিয়েছি ।অপেক্ষার সময় যেন কমছে না। প্রায় রাত সাড়ে বারোটার উপরে বাজছে ।খেয়াল করে শুনলাম নিচের ঘরটায় চাপা কান্নার সুর ভেসে আসছে ।আমি ছুটে নিচে গিয়ে দেখলাম সায়ন সাহেবের অবস্থা ব্যাগতিক ।বাবা পাশে বসে চেকআপ করছেন সাথে সাথেই বাড়ির রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বেজে বেজে আসছে ।শাকিল ভাই আর বাবা সায়ন কে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে উঠালেন ।আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি পাথর মূর্তি হয়ে ।ফুপু আমায় ঠেলে দিলেন সায়নের পাশে বসতে ।আমি এবার কান্না আটকাতে না পারায় বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললাম

-আল্লাহ কেন আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে? আর কত পরীক্ষা বাকি আছে বাবা বলতে পারো ?

বাবা আমায় অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে বলল

-শক্ত হতে হবে তোমায়। ধৈর্য ধরো আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।

সায়ন আমার হাতটা ধরে নিঃশব্দে চোখের বন্যায় ভাসছেন ।উনার মাথাটা আমার কোলে।

কিছুক্ষণ পর ওনার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল আমার হাত। আমি তাকিয়ে দেখি ওনার অবস্থা ভালো নয় ।ফুপু দোয়া কালাম পড়ছেন।বাবা যথা সম্ভব এম্বুলেন্স এর মধ্যে ট্রিটমেন্ট করছে ।সায়ন হাতে ইশারায় আমায় ডেকে কপালে এক চুমু দিয়ে বলল

– আমায় ক্ষমা করে দিও শিউলি ।

এ কথায় যেন আমার ভিতরটা খন্ড বিখন্ড হয়ে যাচ্ছে ।

একে একে ফুপু আর বাবার কাছেও ক্ষমা চেয়ে মুহূর্তেই চোখ মুখ উল্টিয়ে দিলেন ।ফুপুর কান্নায় যেন গাড়িটাও চলতে কষ্ট হচ্ছে ।আমার বেহায়া চোখ দিয়ে আমি সায়নকেই দেখে চলেছি যেন আমার দেয়া শেষ উপহার ‘অশ্রু’ তাকে নিতেই হবে সাথে ।

হঠাৎ করেই দেখলাম উনি আর নড়ছেন না বোধ হয় কষ্ট হচ্ছে না। বাবা ছটফটিয়ে চেকআপ করতে থাকলো। এক সময় বাবা সায়নের চোখ বন্ধ করতে করতে কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলো ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন।

ফুপু এটা শুনে আর নিজের মধ্যে ছিলেন না আহাজারিতে  অ্যাম্বুলেন্সটা ভরে গেল। যে বয়সে নাতি নাতনির জন্য আনন্দিত হবেন তিনি সে বয়সে এমন যুবক ছেলের মরা মুখ দেখা দুর্ভাগ্য বৈকি ?

আমি আস্তে করে সায়নের কপালে একটা চুমু একে দেই তারপর তার বুকে মাথা দিয়ে কান্নার সাগরে ডুবে যাই।

কেন ভালোবাসা গুলো  আমার জীবন থেকে চলে যায় আমি তো বেশি কিছু চাইনি। সৃষ্টিকর্তা আর কি কেড়ে নিতে চায় আমার থেকে? আমি যে নিঃস্ব কাঙ্গাল ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে একটা বলে গেছেন

-ভালোবাসা ও মৃত্যু দুটোই নিমন্ত্রন

বিহীন অতিথি

– একজন এসে নিয়ে যায় মন আর

একজন এসে নিয়ে যায় জীবন।

অনেক কিছু পেতে চাইলেও

পিছিয়ে আসতে হয়;

জীবন দেখায় আঙ্গুল দিয়ে

সবটা তোমার নয়!

                                …….:- সমাপ্ত :-…….

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *