বৃষ্টি হয়ে নামো [পর্ব-২৪]

মেঘের আড়ালে যেমন জ্বলজ্বল করা সূর্যটা লুকিয়ে পড়ে।তেমনি ধারার হাসি লুকিয়ে পড়েছে গুমোট মুখের আড়ালে।অন্যবার বাড়ি ফিরেই বাড়িটাকে মাথায় তুলে ফেলে।ভাইদের সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠে।শেখ আজিজুরের বকা শুনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে।এরপর ইনিয়েবিনিয়ে ক্ষমা চায়।আর কখনো হবেনা কথা দেয়।কিন্তু আজ তেমন কিছুই করলোনা।বাড়িতে ঢুকে সবাইকে একবার দেখে নিয়ে চুপচাপ নিজের রুমে ঢুকে পড়েছে।এতে, সবাই অবাক।বাকিরা অতোটা পাত্তা না দিলেও শাফি ব্যাপারটা হজম করতে পারছেনা।কিছুতো আছেই।আজিজুর সোফায় বসতে বসতে হুংকার ছাড়েন,

——“নবাবজাদি আসছে।কথাও বললোনা।এতো সাহস কই পেলো?এইযে তোরা,তোরা তিন ভাই ওর কলিজাডা এমন বড় বানায়ছোস।”

ধারার বড় ভাই সামিত বললো,

——“বাবাই প্লীজ আমাকে কিছু বলবা না।আমি ওরে কখনো বলি নাই বাড়ি থেকে পালাইতে।”

আজিজুর কড়াচোখে ছেলের দিকে তাকান।বলেন,

——“তোদের বলি ওরে নজরে নজরে রাখতে।সেটাও পারিস না।এত বড় দামড়া ছেলেদের চোখে ফাঁকি দিয়ে এইটুকু পুঁচকে মেয়ে কীভাবে পালায়?আমিকি বুঝিনা?সবসময় যে এর পিছনের তোদের হাতে থাকে।তোরা সাহায্য করিস ওরে পালাতে।বইনের কি বিয়া দেওয়া লাগবনা?আজীবন পালবি?”

সাফায়েত বিরক্ত নিয়ে বললো,

—–“বিশ্বাস করো বাবাই আমি কখনো ওরে পালাইতে সাহায্য করি নাই।মাত্র অফিস থেকে আসছি।প্লীজ ঘরে যাইতে দেও।”

——“হ যা যা ঘরে যা।বউয়ের আঁচলের তলে যা।বইনডা এমন মন খারাপ কইরা বাসায় ঢুকছে।কই ওর রুমে যাবি তা না।নিজের ঘরে যাইতে পাগল হইয়া রইছস।যা।”

সাফি চুপচাপ শুনছে।সে কথা বলতে চায়না।কথা বললেই মুখ ফসকে ক্লু দিয়ে দিতে পারে সবসময় যে সে সাহায্য করে ধারাকে।সামিত,সাফায়েত কিছু বললো না আর।দুজন ধারার রুমের দিকে এগোয়।পিছু পিছু শাফি আসে।ধারার রুমের সামনে এসে বন্ধ দরজা পায়।শাফি ডাকলো,

——“টুইংকেল?দরজা খোল।”

এরপর সাফায়েত বললো,

——“পরী দরজা খোল।কি হইছে তোর।ভাইয়াকে বল।”

——“টুইংকেল?”

——“পরী?”

সামিত দরজায় জোরে টোকা দিয়ে বললো,

——“সিদ্রাতুল দরজা খোল।”

পাঁচেক মিনিট পর ধারা দরজা খুলে।ক্লান্তভঙ্গিতে বললো,

——“ফ্রেশ হচ্ছিলাম ভ্রাতারা।”

সাফায়েত বললো,

——“গুমোট মুখ বানায়া রাখছিস ক্যান?কি হইছে?

সামিত বললো,

——“কই ছিলি এতদিন?সব ঠিক আছে? কোনো অঘটন ঘটছে?কেউ কিছু বলছে?”

——“বাবারে বাবা!ধীরে ধীরে প্রশ্ন করোনা।মাথা ব্যাথা তাই মনটা খারাপ।আর কিছু হয় নাই।আর এতদিন ফুফির বাসায় ছিলাম।বাবাকে বইলোনা।”

সামিত ফোস করে প্রশান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ধারার কপালে চুমু এঁকে বললো,

——“খুব মিস করছিরে।ডাইনিংএ যা।আমিও আসছি।”

সামিত চলে যায়।সাফায়েত ধারার মাথায় হাত রেখে মৃদু হাসে।ধারাও হাসে।তারপর সাফায়েত চলে যায়।ধারা দেখে শাফি এখনো তাকিয়ে আছে।তাও সরু চোখে।ধারা অপ্রস্তুত হয়ে উঠে।শাফির কাছে কিছু লুকানো যায়না কখনো।শাফি সন্দিহান কন্ঠে বললো,

——“কি হইছে বলতো?মিথ্যে বলবিনা।”

ধারা মিথ্যে বলতে গিয়ে বললোনা।গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।বললো,

—–“বাধ্য করো না মিথ্যে বলতে।সত্যটা বলতে পারবোনা।তবে,একদিন বলবো প্রমিস।”

শাফি কিছুটা আহত হয়।ধারা কখনো এভাবে তাকে বলেনি।সবসময় যা ই হোক শেয়ার করেছে।তবুও জোরপূর্বক হেসে বললো,

——“বলিস কিন্তু।শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো।”

ধারা ঘাড় কাত করে।শাফি চলে যায়।ধারা দরজা বন্ধ করে বিভোরকে কল করে।প্রথম কলেই বিভোর রিসিভড করলো,

——“ধারা?ঠিকভাবে পৌঁছাইছো?কখন বাড়ি গেছো?”

——“এইতো কিছুক্ষণ আগে।তুমি কি আমার কলের অপেক্ষা করছিলে?”

——“হু।”

——“খুব টেনশন হচ্ছিলো না?”

বিভোর ধারার প্রশ্ন এড়িয়ে বললো,

——“পথে কেঁদেছো খুব তাইনা?”

——“কাঁদাটা কি স্বাভাবিক না?”

——“আমি মানা করেছিলাম।”

——“সব মানাই যে শুনতে হবে এমন তো না।”

——“জেদি খুব তুমি।”

——“আমি জানি।”

——“খাইছো? “

——“এইতো যাবো খেতে।তুমি দুপুরে খেয়েছো?”

——“হুম অফিসের ক্যান্টিনে।”

——“অফিসের বস বেশি বকেছে?”

——“না বকবে কেনো।তবে একটু অসন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হলো।সমস্যা নেই কয়দিনের কাজে খুশি করে ফেলবো।”

——“হুম।”

——“যাও খাও।”

—–“ইচ্ছে হচ্ছেনা।”

—–“সারাদিন জার্নি করে এখন ইচ্ছে হচ্ছেনা!যাও।”

—–“আচ্ছা যাচ্ছি।সারারাত কিন্তু কথা বলবো ফোনে।”

—–“আচ্ছা বলবো।”

—–“আসছি।”

—–“ওকে।”

ধারা কল কেটে ফোন চার্জে লাগিয়ে খেতে আসে।শেখ আজিজুর মেয়ের প্রতি খুবই দূর্বল।মেয়েকে এমন গুমোট মুখ করে বাড়ি ফিরতে দেখেছেন।তাই আর কিছু বলবেন না বলে শপথ করেন।ধারা টেবিলে বসতেই আজিজুর বলেন,

—–“কই ছিলো আমার আম্মা?”

—–“ঢাকা ছিলাম বাবাই।”

—–“এমন শুকনা লাগতাছে কেন আমার আম্মারে?”

—–“জার্নি করে এসেছি তো তাই।”

—–“ঢাকা কার বাড়িত ছিলা আম্মা?”

—–“কারো বাড়িনা।হোটেলে ছিলাম।”

—–“সামিতের আম্মা।মেয়ের পছন্দের সব খাবারের লিস্ট করো।কাল আমি বাজারে যাবো।”

তিব্বিয়া খাতুন বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলেন।এমন বেপরোয়া মেয়ের জন্য বাপের এতো দরদ তিনি নিতে পারেন না।কখনো শাসন করলোনা।এজন্য বিয়ের পরও সংসার টিকলো না।তিনি মনে প্রাণে চান ধারা তাঁর এক বছর আগের সংসারে ফিরুক।যদিও সেটা সম্ভব না আর।আজিজুর আবার বলেন,

—–“কি গো?এমন করছো কেন মুখের ভাব?আচ্ছা তোমারে করতে হইবোনা।বড় বউ তুমি লিস্ট করবা।”

মাইশা মাহবুব হেসে মাথা নাড়ায়।সামিতের বউ মাইশা।মাইশা সবসময় শ্বশুর শাশুড়ীর মন যোগানোর ধান্দায় থাকে।শ্বশুর শাশুড়ী হাতের মুঠোয় মানে সংসারের রাজত্ব তাঁর হাতে।খাওয়ার মাঝে ধারার চোখ পড়ে সাফায়েতের ঘাড়ে।ধারা বললো,

——“মেজো ভাইয়া?”

——“বল পরী?”

——“ঘাড়ে কি হইছে?এমন কালা হয়ে রইছে ক্যান?”

——“আর কইস না।হারামির বাচ্চা খামচি মাইরা মাংস তুইলা নিছে।”

ধারা আৎকে উঠে বললো,

——“কে?”

——“বাদইল্লা।”

ধারা সচকিত হয়।বাদইল্লা মানে বাদল মেসবাহ।বিভোরের বড় ভাই।সাফায়েত বাঁকা হেসে গর্ব করে বললো,

——“আমিও এমনি এমনি ছাইড়া দেই নাই।কামড় মাইরা ওর গাল দিয়া রক্ত বের করে দিছি।”

সাফায়েতের পাশেই বসেছিল তাঁর বউ মোর্শেদা লিয়া।লিয়া কথা ভেতরে রাখতে পারেনা।যখন যা মনে আসে বলে ফেলে।সে কাটা কাটা গলায় সাফায়েতকে বললো,

—–“এতো বড় মানুষেরা কামড়াকামড়ি,খামচা-খামচি

কেমনে করে আমি বুঝতে পারিনা।ছিঃ।তোমাদের চেয়ে বাচ্চাদের স্বভাব ভালো।”

সাফায়েত রাগে খিটমিট করে বললো,

—–“লিয়া তোমারে অনেকদিন না করছি আমারে খোঁচাইয়া কথা বলতে।এতোই যখন আমারে অপছন্দ বিয়া করলা কেন?”

—–“তখন তো তোমার এমন রূপ দেখিনাই।আর তোমার বাপ-ভাইয়েরও।আর তোমারতো একদম জানোয়ারের রূপ।”

সাফায়েত হাত মুষ্টিবদ্ধ করে।সামিত ইশারায় শান্ত হতে বলে।লিয়ার বাবা পলিটিক্স করে।তাই তাঁদের লিয়ার বেয়াদবি হজম করতে হয়।ধারা বললো,

—-“তো মাইর লাগছিলা ক্যান?”

আজিজুর বলেন,

—-“আমার ব্যাঠায় লাগে নাই।সিটি মার্কেটের সামনে বাদইল্লার সাথে সাফায়েতের দেখা হয়।বাদইল্লা খোঁচায়া কথা কয় এরপরই তর্কাতর্কি….

—–“এরপর কামড়াকামড়ি?”

বললো ধারা।আজিজুর কিছু বললোনা।ধারা কিছু কড়া কথা শোনাতে গিয়েও শোনালোনা।দোষ টা তো তাঁর।তাঁর জন্যই এতো সমস্যা।কিছু বলতে গেলে আঙ্গুলটা তাঁর দিকেই উঠবে।নিজেকে সামলিয়ে বিভোরর কথা মতো প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে,

—–“আচ্ছা এসব বাদ।বড় ভাইয়া তোমার না গত সপ্তাহে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল গেছিলা?”

—–“হুম।”

—–“কি আনছো আমার জন্য?”

সামিত মৃদু হেসে বললো,

—-“কিছুনা।”

—–“মজা করোনা বলো।”

—–“ট্রাভেল ব্যাগ।কোয়ালিটি কি যে দারুণ!দেখলেই বুঝবি।”

ধারা হাসে।সে জানে এবং মানে তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে কতোটা ভালবাসে।তাঁর বন্ধুরা সবসময় আফসোস করতো,এমন ভাই কেনো তাঁদের নেই।খাওয়া শেষ করে ধারা রুমে এসেই দরজা বন্ধ করে দেয়।কল করে বিভোরকে।বিভোর কল কেটে ঘুরায়।ধারা বলে,

—–“কল কেটে আবার কল দিলা ক্যান?আমার ফোনে যথেষ্ট ব্যালেন্স আছে।”

—–“এমনি।কেমন হলো খাওয়া-দাওয়া?”

—–“আর খাওয়া।গিয়েই শুনলাম,তোমার ভাই আর আমার ভাইয়ের ঝগড়ার কথা।তোমার ভাই খামচি দিছে আমার ভাইরে।আর আমার ভাই কামড় দিছে।”

ফোনের ওপাশে বিভোর হো হো করে হেসে উঠলো।ধারাও হেসে ফেলে।বিভোর বললো,

—–“এত বড় মানুষেরা এভাবে মারামারি করে কীভাবে!তোমার কোন ভাই?”

—–“মেজোটা।সাফায়েত ভাই।”

—–“ইঞ্জিনিয়ার যে?লম্বা?”

—–“হুম।”

—–“এমন হ্যান্ডসাম ছেলে কামড় দিছে!ও আল্লাহ!”

বিভোর আবার হেসে উঠলো।ধারা কিঞ্চিৎ ভ্রু বাঁকায়।বললো,

—–“তোমার ভাইয়াও তো কত হ্যান্ডসাম।উনি খামচি দিলো কেমনে?”

—–“আচ্ছা এসব বাদ।মিস করছি তোমাকে।”

—–“আমিও।খুব বেশি।”

—–“রাজশাহীতে থাকলে এখন তোমার বাড়িতে চলে যেতাম।”

—–“আমার ভাইয়েরা পেটাতো।”

—–“আমি ডরাই না।”

—–“সাহস কত।”

—–“তোমার ভাইয়েরা কামড়াকামড়িই করতে জানে।আমার এক ঘুষির সামনে ওরা কিছুই না।”

—-“বড় ভাইয়া কিন্তু এস.পি।”

—–“সেটাই সমস্যা।জেলে পুরে দিতে পারে মিথ্যে মামলায়।”

–‘আমার ভাই মিথ্যে মামলা করবেনা।সে সৎ।”

বিভোর হাসে।ধারা বললো,

—–“কি?”

—–“কিছুনা।”

—–“বলো।”

—–“ভিডিও কলে আসবা?”

—–“আসছি।”

দেখতে দেখতে কেটে যায় পঁচিশ দিন।বিভোর শীতের ছুটিতে রাজশাহী আসে রাতের ট্রেনে।বাসায় তিনঘন্টা ঘুমিয়ে ধারার বাসার সামনে এসে ধারাকে কল করে।ধারা ফ্রেন্ডের বাসায় যাওয়ার ছুতোয় বাসা থেকে বেরিয়ে আসে।কিছুটা হাঁটার পর তিনমুখী রাস্তা।বিভোর বাম পাশের রাস্তার পাশের মাঠে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে।ধারার হাত-পা অনবরত কাঁপছে।এইটুকু রাস্তা যেনো শেষ হচ্ছেনা।অবশেষে বিভোরের দেখা পায়।বিভোর দাঁড়িয়ে ফোন টিপছে।ধারার বন্ধ হৃদয়ের দরজা যেনো মুহূর্ত খুলে যায়।কোথেকে আওলা বাতাস উড়িয়ে দেয় চুল।দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিভোরের বুকে।বিভোর আচমকা আক্রমণে কেঁপে উঠে।এরপর শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ধারাকে।কয়েক সেকেন্ড পর ঘোর লাগা গলায় বিভোর বলে,

—–“আমার কি মনে হচ্ছে জানো ধারা?”

ধারা ভারী মোহময় গলায় বললো,

—–“কি?”

—–“মনে হচ্ছে,চারিদিকে বৃষ্টি নেমেছে।চারপাশটা স্নিগ্ধতায় ভরপুর।ঝিরিঝিরি আওয়াজও আসছে।তোমার স্পর্শ বৃষ্টির মতো কাজ করছে।কি অদ্ভুত!”

ধারা বিভোরের কথা শুনে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।এভাবে এতো প্রেমময় কন্ঠে কেনো কথা বলে বিভোর।ধারার হৃদয়ে যে তোলপাড় হয় প্রচন্ড জোরেসোরে।বিভোর বললো,

—–“মানুষ দেখছে পাগলি।ছাড়ো।”

—–“উহু।”

—–“অন্য কোথাও চলো।তারপর অনেক্ষণ জড়িয়ে রেখো।”

ধারা বাধন হালকা করে দেয়।বিভোর ধারার কপালে চুমু দিয়ে হাতে ধরে বললো,

—–“চলো।”

ধারা হেসে বিভোরের হাতের বাহু দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাঁটা শুরু করে।আর এতক্ষণের পুরোটা দৃশ্য দুজন খুব মনোযোগ সহকারে দেখে।ধারার ভাই সাফওয়ান সাফি এবং তাঁর গার্লফ্রেন্ড মেহের।

চলবে……

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *