বৃষ্টি হয়ে নামো [পর্ব-৪২]

গ্লেসয়ারের মাঝে বেশ খানিকটা নিচু অঞ্চল, তার মধ্যে বিভোরদের তাঁবু টানানো হয়েছে। ফজলুল প্রভাস ও বিভোর-ধারার জন্য তিনটে ,শেরপা ও কুকদের জন্য দু’টো।এছাড়া টয়লেট টেন্ট, কিচেন টেন্ট ইত্যাদি। এভারেস্ট বেসক্যাম্প অঞ্চল নেপালের একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রচুর অর্থ আমদানি হয় এ অঞ্চল থেকে। সারা পৃথিবী থেকে ট্রেকার, মাউন্টেনিয়ার, বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ, ফটোগ্রাফার আসেন। তাই পুরো অঞ্চল পরিষ্কার রাখার জন্য নেপাল সরকার সর্বদা তৎপর, সতর্ক।আসার সময় দেখা গিয়েছে পুরো রাস্তাটাই দারুন পরিষ্কার, কোথাও এতটুকু নোংরা পড়েনি। এভারেস্ট বেসক্যাম্পে যারা আসেন তাদের সচরাচর বেশ কিছুদিন একটানা থাকতে হয়। আর সেজন্যই নেপাল সরকার টয়লেট টেন্ট(তাঁবু) লাগানো বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে।

পরদিন ঠিক ছয়টা বেজে চল্লিশ মিনিটে সূর্যের আলো এভারেস্ট ওয়েস্ট শোল্ডারের উপর দিয়ে ক্যাম্পে এসে পৌঁছলো।সকাল হলো।রাতে সকলেই পরিশ্রান্ত ছিলো। তার উপর এই গ্লেসিয়ারের মধ্যে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা।স্লিপিং ব্যাগের আরামটুকু পেয়ে নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সকলে।শিশুর হাসির মতো নির্মল অনাবিল এক সকাল সামনে। আজ সারাদিন কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই, গন্তব্যহীন, তাড়াহুড়োবিহীন একটা আস্ত দিন আজ অনেকদিন পর। ব্রেকফাস্ট হলো। এরপর সবাই লেগে পড়ে ডাইনিং টেন্ট তৈরি করতে।ক্যাম্প এখনো পুরো তৈরি হয়নি। মাঝখানে একটা প্রায় সমতল জায়গা আছে। পাথর সরিয়ে সরিয়ে আরো সমতল করে নেয়া হলো জায়গাটা। তারপর মোটামুটি পনেরো ফুট লম্বা দশ ফুট চওড়া এ জায়গাটা জুড়ে টানানো হলো ডাইনিং টেন্ট।অনেক সময় লাগলো এটা ঠিক করতে। এরপর চেয়ার টেবিল সাজানো হলো।

অলস দুপুর কাটে তাস খেলে।ধারা লরার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছে বহুবার।কিন্তু লরা দুটোর বেশি কথাই বলেনা।বিভোর ঘুমাচ্ছে।ধারা বের হয়ে আসে।দেখতে থাকে মানুষের যাতায়াত। কেউ ক্যাম্প- ১ এর দিকে যাচ্ছে।কেউ ফিরে আসছে। সারাদিন ধরেই ধারার খাওয়া চলছে।কখনো এটা খাচ্ছে কখনো ওটা।টেবিলে সাজানো জুস,হরলিক্স, দুধ,গরম জলের ফ্লাস্ক ।চারটে সময় চা,ছয়টায় স্যুপ,পপকর্ন,তারপর ডিনার।এরপরই ঘুম।গভীর আলস্যে শেষ হয়ে গেলো দু’টি দিন।চলে আসে পারমিট।

_____________________________________________

সকাল নয়টায় অধিক উচ্চতা মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাঁরা বের হয় ক্যাম্প-১ এর লক্ষ্যে।মাউন্টেনিয়ারিং বুট পড়ে হার্নেস লাগিয়ে ঠিকমত তৈরি হয়ে তারপরে বের হয়।খুম্বু গ্লেসিয়ারের উপর তাঁবুর পাশ দিয়ে যাওয়ার রাস্তা ধরে এগোতে থাকে।একসময় ক্যাম্প এলাকা পেরিয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন আকৃতির এক বিচিত্র তুষার রাজ্যে। নানা অদ্ভুত অবয়বের বরফ এখানে।বিভোর বার বার ধারাকে বলছে,

— “চোখ,কান খোলা রেখ।তুষার ধসে পড়তে পারে।”

প্রভাস ট্রেকিং জুতা পরে এসেছিল।তাই আর এগোয়নি।ফিরে যায় তাঁবুতে।বিভোর,ধারা, ফজলুল ক্র‍্যাম্পন লাগিয়ে নেয়।এরপর খুম্বু আইসফল জোনের মধ্য দিয়ে চলা। খুম্বু গ্লেসিয়ারের উপরেই এই বৈচিত্র্যময় খুম্বু আইসফল জোন।কোথাও তিনতলা চারতলা সমান আইস টাওয়ার। আবার তার পাশে অতলান্ত খাদ। এই খুম্বু গ্লেসিয়ার শুরু হয়েছে এভারেস্ট চতুর্থ উচ্চতম শৃঙ্গ লোৎসের গা থেকে,শেষ হয়েছে থোকলায়।গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ হলো বরফের নদী।নদীর মতোন এরও গতি আছে।তবে তা এত ধীরে যে অনুভব করা যায়না। যেহেতু কঠিন বরফের তৈরি হিমবাহ ক্রমাগত এগোতে থাকে, তাই এই সরণের ফলে হিমবাহে প্রচুর ফাটল তৈরি হয়।এদের বলে ক্রিভাস।হিমবাহের উপর দিয়ে চলার পথে এগুলোই অন্যতম বিপজ্জনক বাধা। বেশ কষ্টকর আজকের পথ।সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।মাঝে মাঝেই ছোট বড় ক্রিভাস।ছোট ক্রিভাস গুলো লাফিয়ে পেরোতে পারলেও, বড় গুলোর জন্য মই ব্যবহার করতে হচ্ছে। মই আগে থেকে লাগানো আছে। দু’পাশে দড়ি লাগানো মই।এই দু’পাশের দড়ি একটু টান রেখে সাবধানে মই-এর মাঝের রডগুলোতে পা রেখে রেখে পার হতে হচ্ছে।ধারা আগে, ওর একদম পিছনেই বিভোর।বিভোর নিজের জন্য ভয় হচ্ছেনা।শুধু ধারার পা দেখছে।কখন না পড়ে যায় ক্রিভাসে।মই দিয়ে পার হতে গিয়ে ধারার পা ফসকে গিয়েছিল। বিভোর দ্রুত ধারার হাত ধরেছে।বার বার বলছে,

— “সাবধানে।নার্ভাস হইয়োনা।”

ধারা মাথা নাড়ায় ঠিকই।তবে নার্ভাস হয়ে যাচ্ছে কেনো জানি।কেমন ভয় ভয় লাগছে।ভয়ের কারণেই আচমকা ছোট ক্রিভাসে পা ঢুকে যায়।ধারা মাথা নত করে পা বের করতে।তখনি কিছুটা উপর থেকে বড় আকৃতির বরফ পড়ে যেতে নিচ্ছিলো।বিভোর দ্রুত দু’ হাতে বরফটিকে আটকায়।বরফটির ওজন ৩০-৪০ তো হবেই।জেম্বা, ফজলুল আৎকে উঠে।বিভোর চিৎকার করে,

— “তাড়াতাড়ি পা সরাও।নিজেও সরো।”

ধারার ভয়ে হৃদপিন্ড শুকিয়ে আসে।পা বের করতে গিয়ে দেখে আটকে আছে।পারছেনা সে।কান্না চলে আসে।ফজলুল এগিয়ে আসে।সেকেন্ড বিশেকের চেষ্টায় পা বের করতে সক্ষম হয়।ধারা,ফজলুল দ্রুত সরে যায়।বিভোর বরফ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়।এরপর ধারার দিকে চোখ গরম করে তাকায়।বলে,

— “কেয়ারলেস!”

ধারা চোখ সরিয়ে নেয়।ভয়ে চুপসে যায়।তারপর আবার তাকায়। আমতাআমতা করে বললো,

— “প্রথমদিন তো…..সরি, আর হবেনা।”

বিভোর কিছু বললোনা।সামনে হাঁটা শুরু করে।ফজলুল ধারাকে বলে,

— “ছেলেটা খুব ভালবাসে তোমায়।একটু সাবধানে চলার চেষ্টা করো।সামনে ভয়াবহ বিপদ রয়েছে।এইটুকুতে যদি ক্ষতি নিয়ে আসো কীভাবে হবে।”

ধারার চোখ দু’টি চকচক করে উঠলো। চারিদিকে এতো বরফ,আর ক্রিভাস দেখে কেনো ভয় পাচ্ছে সে!প্রশিক্ষণ তো কম হয়নি।নাকি মনের জোরটা হারিয়ে ফেলেছে।ধারা লম্বা করে দম নেয়।তারপর পা বাড়ায়।মই দিয়ে পার হওয়ার সময় মইয়ের মাঝের জায়গাটায় যখন অবস্থান করা হয় তখন দুলুনি শুরু হয়,ভারসাম্য বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে উঠে।তখনি ধারা ভীতু হয়ে পড়ে।মনে হয় এই বুঝি পড়ে গেলাম!

বিভোর পিছন ফিরে তাকায়।ধারা আসছে।তবে মুখটা মনমরা।বিভোর দাঁড়ায়।ফজলুল পাশ কেটে যাওয়ার সময় প্রশ্ন করে,

— “দাঁড়ালে কেনো?”

— “যান আপনারা।আমি আসছি।”

ফজলুল একটা ক্রিভাস লাফিয়ে পার হয়।পিছু জেম্বা।ধারা আসে।বিভোর বলে,

— “তাকাও।”

ধারা তাকায়।বিভোর সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে ধারার ঠোঁটে চুমু আঁকে।এরপর বলে,

— “নার্ভাস হচ্ছো কেনো?নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই।”

— “ফাটল গুলো দেখে ভয় হচ্ছে।কেমন ভয়ংকর দেখতে।চারদিকে বরফ মাঝে বড় ফাটল।আমি পড়লে,আমার উপর বরফের স্তূপ ও পড়বে।ভাবলেই কেমন কাঁপুনি উঠছে।”

— “কিছু হবেনা।সামনে তো আরো ভয়ংকর জায়গা আছে।”

— “জানি আমি।”

— “তাহলে সামান্য ফাটল দেখে নার্ভাস হচ্ছো কেনো?”

— “আর নার্ভাস হবোনা।”

— “গুড গার্ল।চলো।”

বড় বড় ক্রিভাসের ওপর দিয়ে মই বেয়ে বেয়ে চলছে ওরা। সঙ্গে আছে জেম্বা।আড়াই ঘণ্টা হেঁটে অনেকটা উঠে চলে এলো। এখান থেকে বেসক্যাম্প একদম ছোট দেখাচ্ছে। সামনে পুমোরি,লিনটার্ন,লো লো স্পষ্ট সুন্দর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এভারেস্টের কিছুই দেখা যাচ্ছে না।বরফের উঁচু উঁচু স্তম্ব দেখা যাচ্ছে। বিচিত্র তাদের আকৃতি।আরো খানিকটা হেঁটে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়ে ওরা চারজন।এবার ফেরার পালা। বেলা প্রায় সাড়ে বারোটায় বেসক্যাম্পের তাঁবুতে ঢুকে ওরা।আজই প্রথম পর্বতারোহণের পাঠ নেওয়া হলো।তাই স্বভাবতই সবাই পরিশ্রান্ত। লাঞ্চ সেরে শুয়ে পড়ে।বাকি দিনটা আগের দু’দিনের মতোই কাটে।

চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *