“আপনার প্রিয় খাবার কি?”
“লাশ।”
“লাশ?”
“জ্বী। লাশ। টাটকা লাশ না। কবর দেয়া লাশ। নতুন কবর দেয়া না। কমসে কম দুই সপ্তাহ আগের কবর দেয়া পুরাইনা লাশ।”
“লাশ কেন? আর পুরনো লাশই বা কেন?”
“কুরবানীর মাংশ রান্নার পর যত পুরান হয়, যত বার জাল দেয়া হয়, যতবার গরম করা হয়, ভাজা ভাজা হইতে হইতে ঝুঁড়া মাংশের যে স্বাদ, যে গন্ধ… ওইটার স্বাদ কেমন? টাটকা রান্না থাইকা শতগুণে মজা না? পুরান লাশের মাংশও ঠিক তেমনই মজা। একবার খাইলে বারবার খাইতে মন টানে। টানতেই থাকে। আবার খাইতে যাই। পেট ভরার আগ অব্দি খাই। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলা পর্যন্ত খাই। আশ তো তাও মেটে না!”
“আপনি নিজে মানুষ হয়ে মানুষের লাশ খাবেন কেন?”
“আমি না খাইলে মাটি খাইব। মাটি আর কত খাইব? আমি মাটিরে সাহায্য করি লাশ খাইতে। লাশ শুষতে শুষতে মাটি ক্লান্ত। একলা আর কত খাইব? কবে না কবে কেয়ামত আসবো, তখন আবার সব খাওয়া লাশেরে মাটি জিন্দা করে দাঁড় করায়ে দিব। তার আগ পর্যন্ত তো খাইবো। মাটিও খায়। আমিও খাই। আপনি খাইবেন?”
“না। আমি মানুষ। আমি মানুষের মাংশ কেন খাব?”
“এরা তো মানুষ না। এরা তো লাশ। এই মাংশ হাড্ডির শরীর থেকে আত্মা বাইর হয়ে যাওয়ার মানে এরা আর মানুষ না। কিছু চামড়া, কিছু পঁচা মাংশ, কিছু নরম হয়ে যাওয়া হাড্ডি। একটা জৈব সার। মরা মানুষর পঁচা শরীর কিন্তু সেরা একটা জৈব সার, জানেন? ওই সারের কারণে মাটি উর্বর হইব, তাতে সবজি হইব, ফল হইব, সেটা আকণ্ঠ গিলবেন কিন্তু লাশ খাইবেন না। হিপোক্রেসি হইলো না?”
“আপনি আমার কাছে কেন আসছেন?”
“খাইতে।”
“কি খাইতে?”
“লাশ।”
“কার?”
“আপনার।”
“আমি জীবিত। আমি লাশ না।”
“আপনি নিশ্চিত যে আপনি একটা চলন্ত ফিরন্ত লাশ না? আপনার জীবন, আপনার ফ্যামিলি, আপনার পড়াশোনা, আপনার ভালোবাসা, আপনার স্বপ্ন, আপনার আকাঙ্ক্ষা, আপনার অভিলাষ, আপনার হতাশা, আপনার চাইর পাশের দুনিয়া আর সেই দুনিয়ার চাপে চ্যাপ্টা হয়েও আপনি এখনো সত্যিকারের ‘জ্যান্ত’? আপনার ভেতরের ওই কলিজার ধুকপুকানি থাইমা গেলে রক্তের দৌড়াদৌড়িটা থাইমা যাওয়া মাত্র আপনি একটা লাশ। আপনি, আপনার বাপ মা বৌ বাচ্চা বন্ধু শত্রু সবাই পোটেনশিয়ালি একেকটা লাশ। বুকের বাম দিকের ওই লাফঝাপ কখন থামবে জানেন? জানেন না। বন্ধ হওয়ার পরের সেকেন্ডে আপনি একটা লাশ। তাইলে কেন নিজেরে লাশ ভাবতে ভয় পান?”
“আমি মরলে খাবেন?”
“মরার আগেই তো খেয়ে ফেলছেন। নিজেই খেয়ে ফেলছেন। বাদবাকি যা বাঁচে রাইখেন আমার জন্য। আছি, আপনার কবরের, চিতার, শ্মশানের আশেপাশে। ডাকা লাগবে না। সবখানেই আছি আমি।
মরার পর খবর দিয়েন।
মাটিই তো খায়।
না হয় আমিও খাইলাম।”
#মুর্দা (২০২২)
#সাজ্জাদ_সিয়াম
“দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছো কেন সাদ? কে এসেছে?” মিরার প্রশ্নের জবাবে সাদের অস্ফুট গলা,“তোমার… তোমার বাবা!”
মিরা পরিষ্কার বুঝতে পারল না সাদের কথা। ওর বাবা মানে? দুই বছর আগে মারা যাওয়া মিরার বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়?
সাদ কি ফাজলামি করছে? এটা তো ফাজলামি করার মত কোন বিষয় না! স্বামী হিসেবে সাদ এতোটাও ইনসেনসেটিভ না যে তার মৃত বাবাকে নিয়ে এ ধরনের রসিকতা করবে। “তোমার কথা বুঝতে পারিনি সাদ। কে এসেছে বললে?”
ওপাশ থেকে সাদ আর কোন জবাব দিল না। মিরা নিজেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। বাসার প্রবেশের মূল দরজার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়েই থমকে গেল! সাদ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আর দরজার চৌকাঠের ওপাশে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। প্রৌঢ়, মুখ ভর্তি সাদা কালো চুল দাঁড়িতে ঢেকে থাকা ওই মানুষটাকে মিরা খুব ভালো করে চেনে! তার নিঃশ্বাসের চেয়েও বেশি কাছের, বেশি প্রিয় সেই মুখটা!
মিরার বাবা হারুণ সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার ওপাশে। নীল পাঞ্জাবি পরা মানুষটার চোখের দৃষ্টি ঠিক মিরার চোখের দিকে।
দুই বছর পর বাবাকে দেখতে পেয়ে মিরা বুঝতে পারছে না সে খুশি হবে না ভয় পাবে। তার ইন্দ্রিয়গুলো তাকে কোনরকম সাহায্য করছে না। মিরার মুখের পেশীগুলো হাসি আর ভয় এর অনুভূতির মাঝে যেন ফেঁসে গেছে। দুই বছর পর তার বাবার হাসিমাখা মুখ… ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারছে না চাইলেও! ঠিক এই নীল পাঞ্জাবি পরা নিথর মৃত শরীরটাকে সামনে শুইয়ে রেখেই তো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে করে কেঁদেছে মিরা। সেই শরীরে কোন স্পন্দন ছিলো না। সেই নিথর মৃত শরীরটাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার চোখের সামনে থেকেই। তার বাবা মারা গিয়েছিল তারই চোখের সামনে!
সেই বাবা ফিরে এলো কিভাবে?
মিরা কি করবে বুঝতে পারছেনা। তার মনের ভেতরে কেমন যেন শিরশির করছে। উত্তরের কনকনে ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলে যেমন কাঁপুনি ওঠে শরীরে ঠিক সেভাবে কাঁপছে তার শরীরটা। ওটা বাবা হতে পারে না। ওই হাসিমাখা মুখটা কোন জাগতিক কিছু হতে পারে না। অশুভ কিছু?
মিরার পোষা কুকুর জেসি বসে আছে ঠিক দরজা বরাবর মুখ করে। কুকুর নাকি অন্য জগতের উপস্থিতি টের পায়! কই? জেসি তো একদম শান্ত! জেসির চোখদুটোও দরজার বাইরে মিরার বাবার মত দেখতে ওই মানুষটার দিকে! জেসির চোখের পলকও পড়ছে না! জেসি কি সত্যিই শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া কোন প্রাণী না মূর্তি বোঝার উপায় নেই!
সাদ দরজা থেকে হাত নামানোর সাহস পাচ্ছে না। সাদ এর চোখদুটো আঠার মত সেঁটে গেছে তার থেকে দুই হাত দূরে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। মিরার বাবা হারুন সাহেবকে চোখের সামনে মরতে দেখেছে সে। সেই মানুষটা কবর থেকে উঠে আসতে পারে না! কখনোই না।
মিরা, সাদ আর জেসি তিনটা শরীরই পাথরের মূর্তির মত তাকিয়ে রয়েছে দরজার ওপাশে। হারুন সাহেবের মত দেখতে মানুষটা কিছু একটা বলার জন্য হাসিমাখা মুখটা খুলে হাঁ করতেই ভয়ংকর এক ঝাঁঝালো পোড়া ঘ্রাণ যেন ছড়িয়ে গেল চারপাশে। সেই পোড়া গন্ধ সজোরে ধাক্কা দিলো সাদ আর মিরার নাক বেয়ে গিয়ে সোজা মস্তিষ্কের গভীরে! কয়েক মুহূর্তের জন্য ওদের চোখ দুটো যেন লালচে আলোয় অন্ধ হয়ে গেল! পোড়া গন্ধে শ্বাস নিতে পারছে না মিরা সাদ দু’জনের কেউই! শুধু নির্বিকার পাথরের মূর্তির মত বসে রয়েছে ওদের কুকুর জেসি!
মিরা আর সাদ জানে যা ঘটছে তা বাস্তব হতে পারে না। আজ থেকে দু বছর আগে এই ঘরেই আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল মিরার বাবা হারুন সাহেব। নীল পাঞ্জাবি পরা ওই শরীরটা জ্বলন্ত কয়লার মত অঙার হয়ে গিয়েছিল। সেই মানুষটা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কখনোই না!
পোড়া গন্ধ সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে ওদের। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই জন্য যেন গভীর আতংক আর শীতল এক অন্ধকারে তলিয়ে গেল মিরা আর সাদ দু’জনে!
—————————————————–
দরজার হাতলটা ধরে রেখে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হারুন সাহেব। আজ নিয়ে সাতবার দেখলেন এই ঘটনা গত দুই বছরের মাঝে। কাউকে বলেন না। কেউ বিশ্বাস করবে না তিনি যদি বলতে চেষ্টাও করেন। তাই নিজের ভেতরেই চেপে রাখেন। সেই চেপে রাখায় মিশে থাকে অব্যক্ত এক হারানোর কষ্ট আর যন্ত্রণা!
আজ থেকে দুই বছর আগে এই বাসায় লাগা এক ভয়ংকর অগ্নিকান্ডে ভেতরের এই রুমটায় থাকা অবস্থায় আগুনে পুরে মারা যায় হারুন সাহেবের একমাত্র মেয়ে মিরা আর মিরার স্বামী সাদ। দুজনেই হারুন সাহেবের চোখের সামনে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল, তিনি কিছুই করতে পারেননি। নিজে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন সেই আগুন থেকে।
সেই শুরু। হঠাৎ হঠাৎ এই ঘরের দরজাটা খুললেই হারুন সাহেব দেখেন দরজার হাতল ধরে অবিশ্বাস মাখা চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে অবিকল সাদের মত দেখতে একটা অবয়ব। আর সাদের পেছনে বিষ্ময়, ভয়, আনন্দ আর আতংক মাখা চোখে দাঁড়িয়ে আছে হারুন সাহেবের একমাত্র মেয়ে… তার আদরের মিরা। আর মিরার পাশে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে মিরার পোষা কুকুর জেসি।
হারুন সাহেব জানেন ওদের উপস্থিতি সম্ভব না। মিরা কিংবা সাদ কারোই কোন অস্তিত্ব নেই এই নশ্বর পৃথিবীতে। যারা দাঁড়িয়ে আছে ওরা দু’জন অন্য জগতের অতিথি! হয়ত অশুভ কিছু, হয়তো অতৃপ্ত আত্মা! তাই কাউকে কিছু না বললেও, ওদের দেখা মাত্র প্রতিবার একটা হাসিমাখা মুখ উপহার দেয়ার চেষ্টা করেন হারুন সাহেব। যেন বোঝাতে চান… সব ঠিক আছে। তোমরা বিশ্রাম করতে পারো এখন ওই জন্মে!
——————————————————–
“কি দেখছো?”
“অবাক লাগছে, বুঝলে!”
“কেন? অবাক লাগার কি আছে?”
“এই টেকনোলজি! এটা অবিশ্বাস্য! আমার মাঝেমধ্যে এটাকে রূপকথার কোন যন্ত্র মনে হয় বুঝলে!”
“আসলেই! আমি মাঝেমধ্যে ভাবি এটা কতটুকু সত্যি!”
“সত্যি মিথ্যে জানিনা। কিন্তু চতুষ্পদ প্রানীদের ব্রেইন থেকে পাওয়া সিগনাল থেকে কিভাবে… ওরা কি স্বপ্ন দেখছে, কি ভাবছে তার হুবুহু ত্রিমাত্রিক ছবি দেখতে পাওয়াটা অবিশ্বাস্যই লাগে এখনো!”
“এই কুকুরটার নাম জেসি না? কি দেখছে সে স্বপ্নে?”
“আজ থেকে দুই বছর আগে ওকে যে পরিবার পালতো, সেই পরিবারের তিন সদস্যকে দেখছে। হারুন রহমান, তার মেয়ে মিরা আর মিরার স্বামী সাদ। জেসি ওদের তিনজনকেই বারবার দেখছে তার সাব-কনশাস মাইন্ডে! চিন্তা করেছ, দুই বছর পরও একটা কুকুর তাকে লালন পালন করা মানুষগুলোকে অবচেতনে ঘুমের ঘোরেও দেখছে!”
“সেই তিনজন কোথায় এখন? কুকুরটা স্ট্রে কেন এখন? আর শরীরটাই পোড়া কেন? ওরা কি কুকুরটাকে ফেলে দিয়েছে?”
“নাহ। আজ থেকে দুই বছর আগে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হারুন, মিরা আর সাদ তিনজনই পুড়ে মারা গিয়েছিল। বেঁচে গিয়েছিল শুধু কুকুরটা। এখন ওর স্বপ্নে শুধু ওরা তিনজনই বারবার আসছে। তবে একেকবার একেক জনের পার্সপেক্টিভ থেকে… কেন সেটা জানিনা। শুধু এটুক বলতে পারব, জেসি ওদের সত্যিই খুব মিস করে, হয়তো এতদিন পরেও!”
ত্রিকোণ
সাজ্জাদ সিয়াম
“এই বাড়িতে জ্বীন আছে!”
মাত্র তিনদিন আগে ওঠা ভাড়াটিয়ার মুখে এই কথা শুনে ভয়াবহ বিরক্ত হলেন রমজান সাহেব। কটমট করে তাকালেন সামনে সোফায় জবুথবু হয়ে বসে থাকা সবুজ মিয়ার দিকে।
“তুমি জানো এই বাড়িতে আমি কয় বছর ধরে বাস করতেছি?” থমথমে গলায় প্রশ্ন করলেন রমজান।
“জ্বী না।”
“১৬ বছর। ১৬ বছর ধরে এই বাড়িতে থাকি আমি। নিজের হাতে নিজের টাকায় করা বাড়ি। কত শত ভাড়াটিয়া আসলো গেলো, কোনদিন কারো মুখে কিছু শুনলাম না। কেউ কোন অভিযোগ দিলো না, আর তুমি তিনদিন হয় এই বাড়িতে উইঠাই বলে দিলা আমার এই বাড়িতে জ্বীন আছে? ম্ম…মশকরা কর?”
রমজান সাহেবের কথা আটকে যাচ্ছে মুখের ভিতর। বেশি রাগ উঠলে এমন হয় তার। সবুজ মিয়া আস্তে আস্তে বললো,
“আমি আপনার সাথে মশকরা করবো কেন? আপনি আমার বাবার বয়সী। আপনার সাথে মশকরা করা সাজে না। যা সত্য তাই বলেছি।”
“সত্য? কি সত্য? কেমনে বুঝলা জ্বীন আছে? দেখাও আমারে। আজকে রাতের মাঝে যদি দেখাতে না পারো কাল সকালের মধ্যে আমার বাড়ি থেকে বিদায় হবা। বুঝছো যা বলছি?”
“জ্বী” মাথা নাড়লো সবুজ। “রাত এগারোটার পর আপনি আমার রুমে আসবেন। আপনাকে দেখাবো। এখন আমি যাই?”
আগুনঝরা চোখে সবুজের দিকে তাকিয়ে রমজান বললেন, “যাও। আমি এগারোটার পরেই আসবো। আর যদি দেখাইতে না পারো, যা বলছি মনে থাকে যেন!”
মাথা নিচু করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলো সবুজ। তিনতলা এই দালানের নিচের তলায় থাকে সবুজ। তিনতলায় থাকেন রমজান সাহেব।
খুব সুন্দর করে সাজানো একটা বাড়ি। ধবধবে সাদা রঙ করা বাইরে। পুরনো দিনের ডিজাইন হওয়াতে বনেদী একটা ভাব আছে। রমজান সাহেব খুব যত্নে আগলে রেখেছেন তার এই বাড়িটাকে।
একতলা আর দোতালা অনেকদিন ধরেই খালি, প্রায় দুই বছর হবে। সবুজ একাই উঠেছে নিচতলায়। ভাড়াও তুলনামূলক বেশ কম। পুরনো দিনের বাসা। চাহিদাও নেই তেমন। সবুজের একার খরচেই চলে যায় থাকা খাওয়া মিলিয়ে।
রমজান সাহেবের মাথায় এখনো আগুন ধরে আছে। দুই বছর ধরে ভাড়া দেন নাই এই বাড়ি কাউকে। কয়েকজন এসেছিলো, কিন্তু ওদের দেখেই মেজাজ এত খারাপ হয়েছিলো, দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই তো সেদিন এক ছেলে আসলো তার বাড়ি দেখতে। তাও রাত করে। দেখেই বিরক্ত লাগছিলো। কাঁধে ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা, এটা সেটা আরো বহু কিছু। চলাফেরা কথাবার্তায় অতি আধুনিক ভাব। ভাড়া দেয়া দূরে থাক, ছেলেটাকে দেখেই মাথা এমন গরম হয়েছিলো এক ধমকে বাড়িছাড়া করেছিলেন।
বাড়ি খালি থাক তাও এসব আলতু ফালতু মানুষকে ভাড়া দেবেন না রমজান। তার উপর আশেপাশে হাউজিং কোম্পানিগুলোর বিশাল বিশাল উঁচু বিল্ডিং, ঝকঝকে তকতকে বাসা ছেড়ে খুব বেশি লোক তার এ বাড়িতে আসে ও না থাকার জন্য।
সবুজ ছেলেটাকে ভালো লেগেছিলো প্রথম দেখাতেই। সাধাসিধে সহজ সরল কিসিমের দেখতে। তাই ছেলেটা বারকয়েক অনুরোধ করার পর আর না করতে পারেননি। কিন্তু এই ছেলে যে এত বড় ফাজিল যদি জানতেন তাহলে চিন্তাও করতেন না!
জ্বীন আছে…! তার বাড়িতে জ্বীন? ফাজলামো!
রাতে যদি কোন রকম ভুজংভাজাং করে তারে জ্বীনের মিথ্যা ভয় দেখানোর চেষ্টা করে চাবকে আগে ছেলেটার পিঠের ছাল তুলবেন পড়ে আজ রাতেই ঘাড় ধরে বের করবেন বাড়ি থেকে।
দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন রমজান। বিকেল পাঁচটা। আজ ভেবেছিলেন বাইরে যাবেন। বেশ কিছুদিন হয় বিকেলে বের হওয়া হয় না। বিকেল হলে তার স্ত্রী আর ছেলের মৃত্যুর জায়গাটাতে গিয়ে প্রায়ই বসে থাকতেন। আজকেও যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু মুডটাই নষ্ট করে দিয়ে গেছে ছেলেটা!
দুই বছর আগে এক মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় নিজের স্ত্রী মেঘনা আর ছেলে আজমানকে হারিয়েছেন রমজান সাহেব।
সৌভাগ্যক্রমে কিংবা দূর্ভাগ্যক্রমে তিনি একা প্রাণে বেঁচে যান। ট্রাকের সাথে যখন বাইকটার ধাক্কা লাগে রমজান ছিঁটকে গিয়ে পড়েন রাস্তা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু তার স্ত্রী আর ছেলেটা বাঁচেনি। আবছা চোখে দেখেছিলেন ওদের পিষে ফেলে ট্রাকটার ফুল স্পীডে চলে যাওয়া!
সেদিন থেকেই একটু এলোমেলো হয়ে গেছে তার চিন্তা ভাবনা, তার পুরো জীবন। প্রায়ই ভাবেন, সেদিন কি চাইলেই ওদের দুজনকে বাঁচাতে পারতেন? ওদের মৃত্যুর পিছনে সম্পূর্ণ দোষ কি তারই?
এখনো নিজের বউ বাচ্চার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে একাকি জীবন কাটাচ্ছেন। নিঃসঙ্গ স্মৃতিচারণ করেই কাঁটছে তার জীবন দুই বছর ধরে।
কোথাও বের হলেন না রমজান। ইজি চেয়ারে কাৎ হয়ে থম মেরে বসে রইলেন। ১১ টা বাজার অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিছু খেলেন ও না। ভয়ংকর রাগ লাগলে কিছুই খাওয়ার রুচি হয় না তার।
ঠিক এগারোটা বাজতেই একতলায় হাজির হলেন রমজান। দরজা খোলাই ছিলো। সবুজ তাকে ভিতরে নিয়ে গেলো। দুটো বেডরুম, একটা ডাইনিং, কিচেন আর একটা বাথরুম। এই সবুজের বাসা।
সবুজ তাকে ভেতরের বেডরুমে নিয়ে গেলো। ফ্লোরে বেডিং করা। একটা ছোট টেবিল। এলোমেলো কিছু জামাকাপড়, আর একটা আয়না। বিরাট বড় একটা আয়না। যে কারো চোখ প্রথমেই আয়নার দিকে পড়বে… এত বড় আয়নাটা।
“কই তোমার জ্বীন? এই আয়নার ভিতরে?” বাঁকা গলায় প্রশ্ন করলেন রমজান।
সবুজ তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো। তার মুখে হালকা বিদ্রুপের হাসি।
“যদি বলি হ্যাঁ? যদি বলি এই আয়নাতেই দেখতে পারবেন?”
“কি? কি দেখতে পাবো? তোমার জ্বীন? ভুত?” ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন রমজান। সবুজের গম্ভীর মুখ দেখে হাসি থামালেন।
“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সিরিয়াস। দেখি কোথায় তোমার জ্বীন ভুত, দেখাও।” বলে আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি।
রমজান সাহেব আয়নাটার দিকে তাকানো মাত্রই ঘরের লাইট অফ করে দিলো সবুজ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রথমবারের মত একটু চমকে উঠলেন রমজান।
“আলো নেভালে কেন?”
“আপনার কি মনে হয় আলোতে দেখতে পাবেন ওদের? আর, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?”
সবুজের গলা শুনে নিজের উপর বিরক্ত হলেন রমজান। ওভাবে চমকে ওঠা ঠিক হয়নি।
“ভয়? আমি? হাহা! তোমার এসব সস্তা ট্রিক্স দিয়ে আর কাউকে ভয় দেখাতে পারো ছোকড়া, আমাকে না! রমজানকে বোকা বানানো এত সোজা নয়।”
বলতে বলতে হাতের মোবাইলটার ফ্লাশ লাইট অন করলেন। আলোটা আয়নার দিকে ধরলেন। প্রথমে আলোর প্রতিফলনের জন্য কিছুই দেখলেন না। চোখ কুঁচকে গেলো তার। মোবাইলটা আরেকটু সরিয়ে আবার ভালো করে আয়নাটার দিকে তাকাতেই থমকে গেলেন।
ভয়ংকরভাবে চমকে গিয়ে হাত থেকে মোবাইলটা পড়ে গেলো রমজানের। কাপা কাপা হাতে ওটা তুললেন আবার। কিন্তু আর জ্বালানোর দরকার পড়লো না। এখন স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছেন সব আলো ছাড়া।
আয়নার ওপাশে… একটা মহিলা আর একটা ছোট্ট বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে! ওই মানুষদুটো ওই চেহারাদুটো তার খুব চেনা!
তার স্ত্রী মেঘনা! আর একমাত্র আদরের ছেলে আজমান!
ওরা আয়নার ওপাশে? কিভাবে সম্ভব! দুই বছর আগেই তো তার চোখের সামনে ওরা দু’ জনই…!
এ হতেই পারে না। কোনমতেই না। নিশ্চয়ই তাকে বিভ্রান্ত করছে সবুজ নামের ছেলেটা। সে কি কোন সাইকিক? হ্যালুসিনেশনস করাচ্ছে তাকে দিয়ে? কোন গ্যাস যা তার ব্রেইনে ইফেক্ট করছে? না অন্য কিছু!
আয়নার ওপাশ থেকে তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো তার স্ত্রী মেঘনা। রমজানের খুব ইচ্ছে করছে হাতটা ধরতে। সাহস পাচ্ছেন না। এত জীবন্ত মনে হচ্ছে কেন? আজমান তার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। খুব করে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে তার আজমানকে।
“কি? বিশ্বাস হলো?” ফিসফিস করে ভেসে আসলো সবুজের গলা।
“কিভাবে?” বিরবির করছেন রমজান। “এত জীবন্ত, এত বাস্তব! নিশ্চয়ই কোন কারসাজি! আ…আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। কোনমতেই বিশ্বাস করা সম্ভব না এটা। কিন্তু, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে চাই! খুব করে চাই…!” রমজান সাহেবের চোখে পানি। তার গলা জড়িয়ে আসছে।
“আপনি কি ওদের ফিরে পেতে চান?” সবুজ কোমল গলায় প্রশ্ন করলো।
“এও কি সম্ভব?” ঘোরলাগা কন্ঠে উত্তর দিলেন রমজান।
“কেন সম্ভব নয়? মন থেকে চাইলে সব কিছু সম্ভব। আয়নায় বাড়ানো হাতটাকে ধরুন। আপনি ফিরে পাবেন হারানো সবকিছু। শুধু হাতটা ধরুন একবার…!” ফিসফিস করলো সবুজ।
মন্ত্রমুগ্ধের মত নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিলেন সামনে, আয়নার দিকে। ওপাশ থেকে বাড়ানো তার স্ত্রীর হাতটা স্পর্শ করলেন, সাথেসাথে তার মনে হলো প্রচন্ড শক্তিতে কেউ তাকে হেঁচকা টানে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে!
তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আয়নার জগতের অসীম শূন্যতায়। রমজান চিৎকার করতে চেয়েও করলেন না, তিনি দেখলেন তার কোলে ওঠার জন্য তার দিকে দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছে আজমান, তার আদরের ছেলে।
কতদিন ছেলের স্পর্শ পান না, কতদিন ছেলের গন্ধ পান না। আয়নার ভেতরে মিশে যেতে যেতে দু’চোখ বন্ধ করে ফেললেন রমজান। তার সাথে সাথে মিশে যেতে থাকলো বাড়িটার ঝকঝকে তকতকে সৌন্দর্য!
ধবধবে সাদা বাড়িটার দেয়ালগুলো হয়ে গেলো ধূসর, স্যাঁতসেঁতে সবুজ শ্যাওলা ধরা! সবকিছু যেন মুহূর্তের মাঝে সব রঙ হারিয়ে শীতল শূন্য এক কবরস্থানের মত নিস্তব্ধ নিরবতায় ছেয়ে গেলো।
রমজান সাহেবের শরীরটা পুরোপুরি মিশে গেলো আয়নার জগতের ওপাশে!
(পরিশিষ্ট)
তিনতলার একটা বাসায় সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে সবুজ। হাতে চায়ের কাপ। তার সামনের সোফায় বসে আছে একজন মহিলা।
সবুজ মহিলাটার দিকে তাকিয়ে কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললো, “আমি জানি আসলে পুরো জিনিসটা কতটুকু সেনসেটিভ আপনার জন্য। আমি চেষ্টা করেছি রমজান সাহেবের জন্য পুরো ব্যাপারটা যতটা সম্ভব সহজভাবে করতে। কষ্ট পাবেন না। ধরে নিন তার জন্য এটাই ছিলো উত্তম গন্তব্য! আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন মিসেস মেঘনা।”
সামনে বসা মেঘনা রহমান চোখের পানি মুছতে মুছতে একবার শুধু মাথাটা দোলালো। পাশে বসা আজমান মাকে জড়িয়ে ধরলো।
এই দুজন হচ্ছে মেঘনা রহমান আর তার ছেলে আজমান রহমান। আজ থেকে ঠিক দুই বছর আগে এক ভয়াবহ মোটরবাইক দূর্ঘটনায় মারা যান রমজান সাহেব। কিন্তু বেঁচে যান তার স্ত্রী মেঘনা আর একমাত্র ছেলে সন্তান আজমান!
সেদিন সেই বাইক দূর্ঘটনার পর রমজানের শরীরটা রাস্তা থেকে ছিঁটকে গিয়ে পড়েছিলো অনেক দূরে, রাস্তার পাশের এক গভীর ডোবায়। মেঘনা আর আজমান দুজনের শরীরই অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলো রাস্তায়, জীবিত অবস্থায়। তাদের সেখান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতাল। রমজানকে কেউ খুঁজে পায়নি।
হাসপাতাল থেকে মেঘনার বাবা তাদের নিয়ে চলে যান বিদেশ, উন্নত চিকিৎসার জন্য। রমজানের লাশটা কেউ কেনদিন এরপর আর খুঁজে পায়নি।
সেই থেকে রমজান এই বাড়িতেই থাকে… কিংবা রমজানের আত্মা!
মেঘনা সবুজের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় একবার বললো, “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে…!” সবুজ উত্তর না দিয়ে মাথা নেড়ে সেটা বিনয়ের সাথে গ্রহণ করলো।
দুই বছর আগে মারা যাওয়া রমজানের আত্মা এতদিন শোক পালন করে গেছে একাকী! কাউকে থাকতে দেয়নি এই দুই বছর। তার ভয়ে কেউ এই বাড়ির ধারে কাছেও আসেনি দু’বছরে। অনেকবার অনেক মানুষ এসেছে এখানে থাকতে, কিন্তু রমজান তাদের থাকতে দেয়নি। সে অপেক্ষা করে গেছে তার স্ত্রীর, ছেলের।
দুই বছর পর দেশে ফিরে এক ইউটিউব কনটেন্ট ক্রিয়েটর যে হান্টেড বাড়িতে ভুতের সন্ধানে যায় তার এক ভিডিওতে নিজেদের বাড়ি আর রমজানের আত্মার ব্যাপারে জানতে পারে মেঘনা। সেই ছেলেটাকেও তার ক্যামেরা সরঞ্জাম সব সহ ভয়ংকর রকমের ভয় দেখিয়ে বিদায় করেছিলো রমজান।
সব জেনে তখন সবুজের সাথে যোগাযোগ হয় মেঘনার। সবুজের কিছু সহজাত ক্ষমতা আছে। জন্ম থেকেই পাওয়া সেই ক্ষমতা।
মৃত মানুষ দেখতে পাওয়া, তাদের সাথে কথা বলা, এমনকি তাদের গোলকধাঁধায় ফেলে দিয়ে তাদের অস্তিত্বকে কোথাও আঁটকে দেয়া, এগুলো তার কাছে খুব সহজ কাজ।
তাই মেঘনার অনুরোধে রমজানকে সেই আয়নাটার ভেতর আঁটকে দিয়েছে সবুজ!
অন্তত সেখানে রমজান ভালো থাকুক… হয়তো!
- সাজ্জাদ সিয়াম