মায়াঘোর

হৃদিতা, মিশু এখন আরও সুন্দর করে কথা বলতে পারে তাই না? ও কি আমার কথা জানতে চায় একবারও?

হৃদিতার অকস্মাৎ ঘুম ছুটে গেল! সে চোখজোড়া মেলে তাকালো। এটা স্বপ্ন ছিল। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করা শুরু হয়ে গেল মুহুর্তেকের মধ্যে। টেবিলের উপর দুহাতের ভাঁজ ফেলে তার উপর মাথা ভর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেই অবস্থার হদিস পেলো সে এবার।

মাথা তুলে টেবিল ঘরিতে সময় দেখে নিলো। সন্ধ্যা ৭ টা বেজে ১২ মিনিট। স্কুলের এক্সাম পেপারগুলো দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। কদিন যাবৎ চমৎকার ক্লান্ত সময় পার করতে হচ্ছে তাকে।

কিন্তু কিছুসময় আগের স্বপ্নে হৃদিতা যা দেখেছিল ঠিক সেটাই মনে করতে লাগলো সে এখন।

সুব্যক্তরূপে স্বপ্নে সে বিহানকে দেখেছে।

বিহান হৃদিতার হাসবেন্ড। একবছর পূর্বে গাড়ি অ্যাক্সি*ডেন্টে সে প্রাণত্যাগ করে।

তার মা*রা যাওয়ার আগে হৃদিতা স্বপ্নেও খারাপ দেখেছিল।

ঠোঁট নাড়িয়ে হৃদিতা অস্পষ্ট স্বরে নিজেকে ব্যক্ত করল।

বলল, “যদি তোমাকে নিজের সান্নিধ্যে এনে আমার মৃ*ত্যু হওয়া অবধি রূদ্ধ করে ধরে রাখতে পারতাম!

তোমার জায়গাটায় দ্বিতীয় অন্য কোনো ব্যক্তির আজও ঠাঁই হয়নি জানো। বাবা মা জোর করে ফের বিয়ের জন্য।

কিন্তু আমি চাই না তোমার জায়গাটা অন্য কেউ এসে দখলে নিক।

এমন অকাজ আমার দ্বারা করা কোনোদিনও সম্ভবপর হবে না। আর আমার দ্বারা এই কাজটা করা সম্ভব হোক তা আমি কখনো চাইবও না।

অশ্রুপাত হতে থাকে হৃদিতার! বুকের ভেতরটা যেন তার জ্বলে যাচ্ছে! এমন অগ্নিময় ক্লিষ্টতা নির্বাপিত করার মতো কেউ নেই। নিজের মধ্যে সঞ্চার করা এই ক্লেশ সে আজীবন বয়ে বেড়াতে রাজি, তবুও বিহানের স্থানে দ্বীতিয় অন্য কোনো ব্যক্তিকে আশ্রয় সে স্বয়ং আয়ুষ্কালেও দিবে না।

.

টিউশনি থেকে ফিরে সোজা একটা লেকের পার গিয়ে বসে হৃদিতা। এই লেকটাতে আগে প্রায়ই আসতো সে আর বিহান। যখন তাদের ঘর আলো করে তাদের সন্তান মিশু আসলো, তারপর থেকে আর দুই বছরও সেই লেকের ধারে কাছেও যাওয়া হতো না তাদের।

ব্যস্ততা, আর ছোট্ট বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে তাদের সময় প্রবাহ হতো। বেশি দূরে কোথাও যাওয়া হতো না সেসময়। যখন মিশুর তিন বছর পূর্ণ হলো, এরপর থেকেই বিহানের কাজের ছুটি থাকলে একসাথে তারা তিনজন মিলে সেখানে বেড়াতে যেত। এখন মিশুর পাঁচ বছর বয়স। সেও বাবার অবর্তমান খুব করে বুঝতে পারে।

লেকের পারের কাছের একটা বেঞ্চে বসে হৃদিতা। সেই চেনা পরিচিত বেঞ্চটাতে, যেখানে তারা কতশত সময় একসাথে ব্যয় করেছে।

হৃদিতার মাথাটা ধরেছে প্রায় ১ ঘন্টা। সে কপালের দুই পাশে হালকা করে চাপ দিলো। চোখ দুটোও জ্বলছে। যথাযথ ঘুম পরিপূর্ণ না হওয়ায় হয়তো এমনটা হচ্ছে।

বেঞ্চটাতে নীরবে মাথা নিচু করে বসে রইলো হৃদিতা। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। মাগরিব নামাজের ওয়াক্ত নিকটে। কেমন এক শীতল বায়ু বয়ে বিচরণ করছে চারদিকে।

হৃদিতা অনুভব করতে পারছে বিহানের অস্তিত্ব তার খুব সমীপে।

মাথা তুলে হাতের ডান দিকে তাকায়, সত্যিই সে বিহানকে দেখতে পাচ্ছে। এই তো বিহান তার পাশে বসে আছে। খুব সুন্দর হাসি লেগে আছে ছেলেটার অধরে। কতকাল পর এমন অদেখা হাসির সন্ধান পেলো সে। হৃদিতা আলতোভাবে মাথা কাত করে বিহানকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তার মনে হলো বিহানের প্রতি মায়াঘোর যেন এইমুহূর্তে অধিক কোটিগুণ বেড়ে গেল তার ভেতর। নয়নবারি থেকে অশ্রুকণা বেয়ে নাকের ডগায় ঠেকে গড়িয়ে পড়ল হৃদিতার হাতের উপরিভাগে।

সে মনে মনে বাসনা করে ফেলল, “এই মানুষটাকে দেখার তৃষ্ণা, মায়াঘোর যেন কখনো না মিটে যায় তার অন্তঃকরণ হতে। নতুবা এমন পরিণতি ঘটে গেলে তখনই যাতে তার মর*ণ ঘটে।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *