যান্ত্রিকভাবে উন্নত অসভ্য জনগোষ্ঠী

পাশাপাশি দুটি দেশ। একটিসভ্য অপরটিঅসভ্যবলেই পরিচিত। সভ্যদের দেশ থেকে দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অসভ্যদের দেশে বেড়াতে এসেছে। রাজার বাড়িতেই তাদের স্থান হয়েছে।অসভ্যদেশের মানুষগুলি তাদের দুজনকে অত্যন্ত সমাদর করেছে, আপ্যায়ন, আতিথেয়তা করেছে। একদিন সকালে তারা দুজন অসভ্যদের রাজার সাথে বসে নিজ দেশের গল্প করছে, এমন সময় দুজন কৃষক হাজির হয়েছে একটি নালিশ নিয়ে। প্রথম কৃষক এক খণ্ড কৃষিজমি বিক্রি করেছে দ্বিতীয় কৃষকের কাছে। দ্বিতীয় কৃষক মাঠ খনন করতে গিয়ে সেখানে এক কলস স্বর্ণ পেয়েছে। তখন দ্বিতীয় কৃষক স্বর্ণের কলসটি প্রথম কৃষকের বাড়িতে দিতে গেলে দ্বন্দ্বটির সূত্রপাত হয়। প্রথম কৃষক বলে, ‘জমিটি আমি তোমার কাছে বিক্রি করেছি, সুতরাং জমিতে যা কিছু আছে সবই তোমার।আর দ্বিতীয় কৃষকের যুক্তি হলো, ‘আমি তোমার কাছ থেকে জমি কিনেছি, স্বর্ণ ক্রয় করি নি, সুতরাং স্বর্ণ আমার হবার প্রশ্নই উঠে না।এর পরেই উভয়ে রাজার শরণাপন্ন হয়। তখন রাজা সব শুনে ফায়সালা দেন যে, প্রথম কৃষকের ছেলের সাথে দ্বিতীয় কৃষকের মেয়ের বিয়ে হবে এবং স্বর্ণগুলি দিয়ে বিয়ের খরচ নিষ্পন্ন হবে। তারপরও যে টাকা বেঁচে যাবে তার মালিক হবে নবদম্পতি।

.

 এই বিচার দেখে অতিথি দুজন হাসি যেন আর ধরে রাখতে পারছিল না। বিচার শেষে সবাই যখন রাজপ্রাসাদ ছেড়েছে তখন তারা রাজাকে বলল, আপনার রাজ্যের সবাই কি এমন বোকা? আমাদের দেশে এমন কোনো মামলা ভাবাই যায় না। আমাদের দেশে হলে, দ্বিতীয় ব্যক্তি যখন জমি খনন করে স্বর্ণ পেত তখন কাউকেই বলত না। তবে যদি কোনোভাবে প্রথম ব্যক্তিটি জানতে পারত তবে সে স্বর্ণের কলস দখল করার জন্য কোনোকিছু করতেই বাদ রাখত না।

.

রাজা অবাক, বলেন কি? তাহলে তো এটা নিয়ে মারামারিও হত নিশ্চয়ই।

 অতিথিরা হাসলো, শুধু মারামারি? কতজন যে মরত আর আহত হত তার ইয়ত্তা নেই। আর যদি পুলিশ জানতে পারত তাহলে তো পুলিশই সেগুলি দখল করে নিত। আর এটা যদি কোনোভাবে রাষ্ট্রের হাতে চলে আসত তবে যেভাবেই হোক যুক্তিতর্কের মাধ্যমে প্রমাণ করা হত এটা রাষ্ট্রের সম্পদ। বিচার শেষে উভয়পক্ষই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কর্মসূচি দিত, গাড়িতে আগুন দিত। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই স্বর্ণের কানাকড়িও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ত না। কর্তৃপক্ষের মধ্যেই ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যেত।

.

 রাজা সব শুনে বললেন, এসব তো মহা অন্যায়। তখন তারা বলল, অন্যায়? একটি মূল্যবান বস্তুর মূল্য বোঝা অন্যায়? আপনারা বর্বর আর অসভ্য বলেই স্বর্ণের মূল্য বোঝেন না, কিভাবে এটাকে নিজের হস্তগত করা যায় তাও বোঝেন না। এক কলস স্বর্ণ হলে সারাজীবন আরাম আয়েশে কাটানো যায়, বাড়ি, গাড়ি, শানশওকত সব পাওয়া যায়, চাষবাস করা লাগে না, জমিদারী হালে চলা যায়। আমাদের ইচ্ছে হচ্ছিল কৃষক দুটিকে কষে চড় মারি। আচ্ছা রাজা মশাই, কৃষক দুটিকে ডেকে আনা যায় না? তাদের কিছু শিক্ষার প্রয়োজন আছে।

.

 রাজা মশাই তাদের এই কথায় আহত হয়ে বললেন, আপনারা তাদেরকে কি শেখাবেন তা আমি বুঝতে পারছি। আমার রাজ্যের লোকেরা যে কোনো প্রকার মিথ্যা, ছলচাতুরি, প্রতারণা, অতি ছোট চুরিকেও মহাপাপ বলে জানে। স্বর্ণের মূল্য আমরা বুঝি। মাটির নিচে পাওয়া স্বর্ণের মূল্য যেহেতু অনেক তাই এটি নিয়ে প্রতারণা, মিথ্যা বা চুরির পাপও হবে অনেক বড়। জন্যই তারা পথে পা বাড়ায় নি। তারা জানে যে এটির মালিক হতে পারলে সারাজীবন আরামআয়েশ আর ভোগবিলাসিতায় কাটাতে পারবে কিন্তু সে আগামী কাল বাঁচবে কিনা তার কি নিশ্চয়তা আছে? তাছাড়া নশ্বর জীবনে পাপের বোঝা বাড়িয়ে অনন্তকালের সুখস্বাচ্ছন্দ হারানো এবং কঠিন শাস্তির জীবন গ্রহণ করা কি বুদ্ধিমানের পরিচয়? আমাদের প্রতিটা মানুষের মধ্যে স্রষ্টার সন্তষ্টিলাভের বাসনা রয়েছে; তাই তারা কোনো অপরাধ করে না, যদি শয়তানের প্ররোচণায় কখনো অপরাধ করেও ফেলে তবে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজেই শাস্তি পেতে রাজদরবারে চলে আসে। আমাদের দেশে কেউ প্রাসাদ বানিয়ে ভোগবিলাসিতায় মত্ত আর কেউ রাস্তায় বুভুক্ষু অবস্থায় দিনাতিপাত করে না। আপনারা আমাদের কী শিক্ষা দেবেন? যদি আপনারা সত্যিই সভ্য হতে চান তবে আপনাদের উচিত আমাদের এই শিক্ষা আপনাদের দেশে নিয়ে যাওয়া।

.

 সমগ্র পৃথিবীকে আজ যে সভ্যতা আপাদমস্তক আচ্ছাদন করে রেখেছে, যার আলোয় আলোকিত হতে উদগ্রীব সকল অসভ্য জাতিগোষ্ঠী, সেই সভ্যতা নাম হলো পাশ্চত্য ইহুদিখ্রিষ্টান বস্তুবাদী যান্ত্রিক সভ্যতা নিজের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, রুচিঅভিরুচি, ধর্ম, বিবেকবোধ সবকিছুকে উপেক্ষা করে আজ প্রায় সকল জাতি, সকল দেশের মানুষ নির্লজ্জভাবে পাশ্চাত্য ইহুদিখ্রিষ্টান সভ্যতা অন্ধ অনুকরণে ব্যস্ত। উপরোক্ত গল্পে সভ্য দেশের নাগরিক বলতে এই পাশ্চাত্য সভ্যতা ধারক বাহকদেরকেই বুঝিয়েছি। তবে বর্তমানে ১৬০ কোটির মুসলিম নামক জাতিটিসহ সমগ্র মানবজাতি এই পাশ্চাত্য সভ্যতা অন্তর্ভুক্ত।

.

 পাশ্চাত্যরা যেটাকে ভালো ন্যায় বলেছে সেটাই ভালো ন্যায়, তারা যেটাকে মন্দ বা অন্যায় বলেছে সেটাই মন্দ বা অন্যায় এই ধারণার উপর ভিত্তি করে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এই সভ্যতা অন্ধ অনুকরণে মানুষ যত অভ্যস্ত হচ্ছে পৃথিবী ততই অন্যায় অবিচারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। যে কোনো দিনের সংবাদপত্র খুলুন, দেখবেন পৃথিবীময় অশান্তি, ক্রোধ, রক্তারক্তি, অন্যায়, অবিচার আর হাহাকারের বর্ণনা। রাষ্ট্রগতভাবে যুদ্ধ, দলগতভাবে হানাহানি, ব্যক্তিগতভাবে সংঘাত আর রক্তারক্তির হৃদয়বিদারী বর্ণনা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশে, প্রতি বছর খুন, যখম, ডাকাতি, ধর্ষণ, বোমাবাজি আর অপহরণের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। এমন কি বেগুনাহ, নিষ্পাপ শিশুরা পর্যন্ত এই মানুষরূপী শয়তানদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এক দিক দিয়ে মানুষ যেমন বিজ্ঞানের শিখরে উঠছে অন্য দিক দিয়ে ঠিক তেমনিভাবে সে সব রকমের অন্যায়ের চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে।

 তাহলে মানুষ আজ যে সভ্যতার বড়াই করছে সত্যি কি এটা সভ্যতা? আমি বলবো, না, এটা সভ্যতা নয়। এটা আত্মাহীন বিবেকহীন একটা যান্ত্রিক প্রগতি মাত্র, যে প্রগতি মানুষকে যত যান্ত্রিকভাবে এগুচ্ছে, তত তাকে মানুষ হিসাবে টেনে নীচে নামাচ্ছে, অসভ্য বানাচ্ছেতাকে কিছুতেই আর যাই হোক সভ্যতা বলে আখ্যা দেয়া যায় না। এটাকে আমি বলব যান্ত্রিকভাবে উন্নত অসভ্য জনগোষ্ঠী

.

 এবার আসি গল্পটিতে অসভ্য বলে কথিত জাতিটির প্রসঙ্গে। এই জাতিটি বর্তমান পৃথিবীতে অনুপস্থিত। ১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করে উম্মতে মোহাম্মদী নামক যে জাতিটি গঠন করেছিলেন তারা অর্ধ্বেক পৃথিবীতে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে, রক্তের বিনিময়ে যে সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিল সে সভ্যতার মানুষগুলি অমন সৎ মানুষে পরিণত হয়েছিল। প্রকৃত ইসলামের সংস্পর্শে আসার ফলে অর্ধপৃথিবীর মানুষগুলি এমন হয়ে গিয়েছিল যে, অতি সংগোপনে, রাতের অন্ধকারেও আল্লাহর ভয়ে অন্যায়, মন্দ কাজ থেকে তাঁরা বিরত থাকত। ফলে আদালতে মাসের পর মাস অপরাধ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আসত না। স্বর্ণের দোকান খোলা রেখে মানুষ অন্যত্র চলে যেত। রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজন হত না। এটাকেই বলে ইসলামের স্বর্ণযুগ। সেই সভ্যতা কিভাবে লুপ্ত হল সেটা অন্য ইতিহাস। বর্তমান বাস্তবতা হল, এখন তারাও ইহুদিখ্রিষ্টান যান্ত্রিকভাবে উন্নত অসভ্য জনগোষ্ঠীকে পদে পদে অনুসরণ করছে। আর পাশ্চাত্য সভ্যতা ইসলামকে অসভ্য জীবনব্যবস্থা বলেই প্রচার করে।

.

 কিন্তু সভ্য অর্থ ভদ্র, শিষ্ট, মার্জিত, সুরুচিসম্পন্ন, ভালো (civilian
polite
courteous mannerly) ইত্যাদি। ভালোটাকে গ্রহণ মন্দটাকে বর্জন করে ধীরে ধীরে গড়ে উঠে সভ্যতা (Civilization) এই বিচারে বর্তমানে পাশ্চাত্য তাদের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত সমাজ কতটুকু সভ্য এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যাদের সমাজে সমকামিতা ভীষণ জনপ্রিয়, যাদের সর্বগ্রাসী ব্যভিচার কোনো নীতি নৈতিকতা সম্পর্কের বাধা মানে না, যাদের শতভাগ মানুষ মাদকাসক্ত, পশুর মতো ভোগ করাই যাদের একমাত্র জীবনাচার তাদেরকে কিভাবে সভ্য বলা যায়?

 

 সেই স্বর্ণযুগ আবার একদিন ফিরে আসবে ইনশাল্লাহ। হয়ত সেই অকল্পনীয় শান্তিময় সভ্যতার যাত্রা ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। কিছু মানুষ হয়ত নিজেদের সর্বস্ব আল্লাহর রাস্তায় বিলিয়ে দিয়ে নিজেদের প্রাণটুকু নিয়ে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে আত্মনিয়োগ করে নতুন সভ্যতা গড়ার পথ রচনা করছে। নতুন সভ্যতার বীজ হয়ত ক্রমে ক্রমে অঙ্কুরিত হয়ে চারাগাছ থেকে বৃক্ষে পরিণত হচ্ছে, অতি শীঘ্রই তা ফুলেফলে সুশোভিত হয়ে উঠবে। আবার হারিয়ে যাওয়া সেই সভ্যতা মহীরুহ হয়ে সমগ্র মানবজাতিকে শীতল ছায়া প্রদান করবে।  ইনশাল্লাহ!!

লেখা: রাকিবুল বান্না

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *