শেষটা সুন্দর ছিলো

মার্কেট থেকে যখন বাসায় ফিরছিলাম তখন খেয়াল করি একটা আবাসিক হোটেল থেকে আমার স্বামী আর আমার আপন ছোট বোন অনু বের হচ্ছে। ওদের একসাথে দেখে আমি যখন হাসিমুখে ওদের ডাকতে যাবো তখন হঠাৎ মনে হলো, ওরা এই হোটেলে কি করে?

হোটেলটা আমার পূর্ব পরিচিত। এই হোটেলের খোঁজ পিয়াস(আমার স্বামী) সর্বপ্রথম আমায় দিয়েছিলো।

ভার্সিটিতে পড়া অবস্থায় আমরা দুইজন দুইজনকে বিয়ে করে ফেলি। তারপর প্রায় সময় এই হোটেলে এসে আমরা একান্তে কিছুটা সময় কাটাতাম। কিন্তু এতো বছর পর পিয়াস সেই হোটেলে আমার ছোট বোনের সাথে…

মুহূর্তের মাঝে আমার হাসিমুখটা বদলে গেলো। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো আমি এই মুহুর্তে রিকশা থেকে পরে যাবো। রিকশাওয়ালা কয়েকবার আমার দিকে ফিরে বললো,

“আফা কোন সমস্যা?”

কিন্তু আমি কোন উত্তর দিলাম না। আমি স্তব্ধ হয়ে শুধু বসে ছিলাম

রাত ৮টার দিকে পিয়াস বাসায় এসে কলিংবেল বাজালো।  আমি দরজা খুলে হাসিমুখে পিয়াসের দিকে হাতটা বাড়িয়ে বললাম,

–দাও

পিয়াস পকেটে হাত দিয়ে অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-” শ্রাবণী খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। আজ তোমার জন্য ফুল আনতে ভুলে গেছি। আসলে অফিসে কাজের এতো প্রেসার ছিলো যে দম নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।”

আমি হাসতে হাসতে পিয়াসকে বললাম,

— আরে তুমি এমন করছো কেন? ভুল তো হতেই পারে। যাও তুমি ফ্রেস হয়ে আসো আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি

চুলায় তরকারি গরম দিয়ে আমি ভাবতে লাগলাম পিয়াসের কথা। এতোবছর সংসার জীবনে আজকে প্রথম এমন হলো পিয়াসের সাথে আমার দেখা হয়েছে অথচ ও আমায় কোন ফুল দেয় নি।

একবার অফিসে কি যেন একটা সমস্যা হয়েছিলো। ওর বাসায় আসতে আসতে রাত ১টা বেজে গিয়েছিলো। এতো রাতে ফুলের কোন দোকান খোলা ছিলো না। পিয়াস তখন বাসার কলিংবেল না চেপে সোজা ছাদে চলে গিয়েছিলো।  ছাদ থেকে লাউ ফুল এনে আমার হাতে দিয়ে বলেছিলো,

“শ্রাবণী, আমি আজোও  তোমায় প্রথম দিনের মতো ভালোবাসি”

আজ সকালেও যে মানুষটাকে আমার খুব কাছের মনে হতো সেই মানুষকে এখন আমার খুব অচেনা মনে হচ্ছে

হঠাৎ খেয়াল করি পিয়াস ভেজা শরীরে দৌড়ে রান্নাঘরে এসেছে। আমি পিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— কি হয়েছে?

পিয়াস বিস্ময়ের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

-” কি হয়েছে তুমি বুঝতে পারছো না?আমি ওয়াশরুম থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ পেয়ে ছুটে আসলাম আর তুমি রান্নাঘরে থেকেও বুঝতে পারলে না?”

পিয়াসের কথা শুনে আমি চুলার দিকে তাকিয়ে দেখি তরকারি পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে অথচ সেদিকে আমার কোন খেয়াল ছিলো না। আমি পিয়াসকে তখন বললাম,

— তুমি গোসলে যাও। আমি অন্য তরকারি গরম দিচ্ছি

আমার পাশে পিয়াস বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে।  অথচ আমি ঘুমাতে পারছি না। শুধু আমার চোখ দিয়ে অনবরত চোখের জল গড়িয়ে পরছিলো। হঠাৎ পাশে থাকা পিয়াসের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার ছোট বোন অনুর নাম্বারটা জ্বলজ্বল করে ভাসছে।  আমি তখন চোখটা বন্ধ করে শুয়ে রইলাম।    পিয়াস ঘুম থেকে উঠে ফোন হাতে নিয়ে চুপিসারে অন্য রুমে চলে গেলো আর আমার তখন চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছিলো….

পরের দিন বিকালে আমার ছোটবেলার বান্ধবী মালিহা আমায় ফোন দিলো।  ইচ্ছে না থাকা শর্তেও আমি ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বললেই অপর পাশ থেকে মালিহা হাসতে হাসতে বললো,

-” বান্ধবী, আজ একটা মজার ঘটনা ঘটেছে রে। রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম খেতে। হঠাৎ খেয়াল করি তোর স্বামী একটা মেয়েকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। পিছন থেকে মেয়েটার খোলা চুল দেখে মনে করেছিলাম মেয়েটা তুই। আমি দুষ্টামি করে চুল ধরে টান দিলাম। পরে তো দেখি এটা তুই না, তোর ছোট বোন ছিলো। বোকার মতো কাজটা করে কি যে লজ্জা পেয়েছিলাম। তাই না খেয়েই রেস্টুরেন্টে থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম”

আমি তখন নিজেকে সামলে মালিহাকে বললাম,

— আসলে অনুর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের  চান্স হয়েছে তো সেজন্য অনু ওর দুলাভাইয়ের কাছে ট্রিট চেয়েছিলো।  আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছিলো তাই আমি যায় নি ওদের সাথে

মালিহা তখন বললো,

– “ভার্সিটেতে চান্স হয়েছে সেটা তো ভালো কথা তাহলে..”

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় মালিহাকে বললাম,

–তাহলে কি?

মালিহা বললো,

-“আসলে অনুকে দেখছিলাম খুব কাঁদছিলো।  আর তোর স্বামী ওরে কি যেন সমানে বুঝাচ্ছিলো”

আমি হাসতে হাসতে তখন বললাম,

— আরে পিয়াস নিশ্চয় অনুকে দুষ্টামি করে বলেছিলো ওকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি করাবে না। ওরে ঢাকায় ইডেন কলেজে ভর্তি করাবে।  এজন্যই হয়তো অনু রাগে কেঁদে দিয়েছিলো

মালিহাকে সাত-পাঁচ বুঝিয়ে আমি ফোনটা রেখে দিলাম। এই মুহুর্তে আমি ঠিক কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি না পারছিলাম এই বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে আর না পারছিলাম এইগুলো সহ্য করতে….

অনেকদিন নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে যখন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম ঠিক সেই সময় আমি বুঝতে পারলাম আমি প্রেগন্যান্ট।  তারপরও আমি শিওর হওয়ার জন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম।  ডাক্তারের চেম্বারের সামনে যখন অপেক্ষা করছিলাম হঠাৎ খেয়াল করি ডাক্তারের চেম্বার থেকে পিয়াস আর অনু বের হচ্ছে।  ওরা আমার দিকে খেয়াল করে নি। পিয়াস অনুকে সমানে কি যেন বুঝাচ্ছিলো আর অনু মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছিলো। ওরা চলে গেলে আমি ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে ডাক্তারকে বললাম,

— ম্যাডাম,  কিছুক্ষণ আগে  একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এসেছিলো।  ওরা কি জন্য এসেছিলো?

ডাক্তার তখন বললো,

-”  মেয়েটার পিরিয়ড হচ্ছিলো না। ওরা ভেবেছিলো প্রেগন্যান্ট কিনা। তাই এসেছিলো”

কথাটা শুনার পর আমার সারাটা শরীর কাঁপতে লাগলো।  আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে ডাক্তারকে বললাম,

— মেয়েটা কি প্রেগন্যান্ট?

ডাক্তার হেসে বললো,

-” আরে না”…

আমি আর কিছু না বলে চেম্বার থেকে বের হয়ে আসলাম।  বাসায় এসে দেখি পিয়াস বাসাতে। আমার দিকে পিয়াস রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,

-“তোমার সমস্যা কি?  এতোবার তোমায় কল দিয়েছি ফোন রিসিভ করছিলে না কেন? চিন্তায় তো আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো ”

আমি হেসে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— বা বা, আমার জন্য তোমার চিন্তাও হয়?

-” মানে!”

— মানেটা কিছু না।  শুধু এটা শুনে রাখো আমার ইচ্ছে করছে তোমার মুখে থুথু ফেলতে কিন্তু ফেললাম না

-” তোমার কি মাথা ঠিক আছে? কি যা তা বলছো?”

আমি চিৎকার করে তখন বললাম,

— আমার মাথা ঠিক আছে। কিন্তু তোর মাথা ঠিক নেই। তোর মাথা ঠিক থাকলে আমার ছোট বোনটার সাথে এমন করতি না।  আমাকে তোর ভালো লাগে না মানলাম।  দুনিয়াতে কি মেয়ের অভাব ছিলো?  তুই অন্য মেয়ের কাছে যেতি। আমি নিজ থেকে তোর জীবন থেকে সরে যেতাম। কিন্তু তুই তা না করে আমার আপন ছোট বোনটার কাছে গেলি।  আরে আমার এই বোনটা তোকে ভাই বলে ডাকতো আর তুই থাকে নিজের লালসার শিকার বানালি

আমার কথা শুনে পিয়াস মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।  আমি আর কিছু না বলে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম…..

রাত ১১টা বেজে ৪০ মিনিট।  অনু আমার রুমে এসে আমায় বললো,

-” আপু তুই কি ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

আমি চোখের নিচে জমে থাকা পানি মুছতে মুছতে বললাম,

–তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর এই মুখটা আমি দেখতে চাই না

অনু কিছু না বলে চুপচাপ আমার পায়ের কাছে এসে বসলো।  আমি রাগে অনুকে বললাম,

–তুই আমার সামনে থেকে যা বলছি। তা নাহলে লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিবো

অনু তখন আমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– আপু আমার ভুল হয়ে গেছে।  তুই আমায় মাফ করে দে। তুই মাফ না করলে আমি মরে যাবো ”

আমি তখন অনুর গালে থাপ্পড় মেরে বললাম,

— তুই কেন মরবি? মরবে তো ও যে তোর সাথে এমন করেছে। পিয়াসকে আমি কখনোই ছাড়বো না

অনু আমার পা ছেড়ে চোখের জলটা মুছতে মুছতে বললো,

-” পিয়াস ভাই কি করলো?”

— কি করলো মানে! তোর সাথে এতোবড় অন্যায় করেছে।আর আমায় ঠকিয়েছে

-” আরে পিয়াস ভাই কখন আমার সাথে অন্যায় করলো? বরং পিয়াস ভাই আমার সাথে না থাকলে আমি এতোদিনে মরে যেতাম। হোটেলে যখন শিহাবের সাথে ধরা খেয়েছিলাম তখন পিয়াস ভাই আমাকে হোটেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলো । ভুলবশত শিহাবের সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক হয়ে যায়।  এজন্য বারবার আমার মনে ভয় হচ্ছিলো আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে যায় কিনা।  আমার মনের ভয় দূর করার জন্য পিয়াসভাই আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। কয়েকদিন আগে আমাকে সাথে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে পিয়াসভাই  শিহাবের বাবা, মা’র সাথে সব কথা বলেছিলো।  উনারা বলেছে উনারা বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে ”

আমি অনুর গালে আরেকটা থাপ্পড় মেরে বললাম,

— এইকথা এতোদিন আমায় বলিস নি কেন?

অনু গালে হাত রেখে বললো,

-” আসলে আপু আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।  তাই পিয়াস ভাইকে সবার আগে বলেছিলাম।  পিয়াসভাই তখন আমায় বলেছিলো কাউকে কিছু না বলতে। উনি সব ব্যবস্থা করে আস্তে আস্তে সবাইকে জানাবে। আজ তোকে রেগেমেগে বাসায় আসতে দেখে ভাবলাম পিয়াস ভাই তোকে বিষয়টা জানিয়েছে।  তাইতো তোর কাছে মাফ চাইতে আসলাম ”

আমি অনুকে বললাম,

— তুই এখন আমার সামনে থেকে যা। তুই হলি একটা গাধী আর তোর পিয়াস ভাই হলো একটা রামছাগল। আর এই মুহুর্তে তোর শাস্তি হলো তুই এখন তোর পিয়াস ভাইয়ের জন্য খিচুড়ি রান্না করবি।

-“মানে!এত রাতে রান্না করবো?”

–তোকে যা বলছি তা কর গিয়ে

অনু চলে গেলে আমি পিয়াসকে ফোন দিলাম।  পিয়াস ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই আমি ওকে বললাম,

— তুই এখনি আমার বাসায় আসবি

পিয়াস শান্তভাবে বললো,

-“কেন, আমার মুখে থুথু দিতে?”

এই কথা শুনে আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,

–তোর মুখে থুতু দিতে না,  তোর কপালে চুমু দিতে ডাকছি। আর শুন আসার সময় আমার জন্য আচার নিয়ে আসবি।  আমার আচার খেতে ইচ্ছে করছে

পিয়াস অবাক হয়ে বললো,

-“এত রাতে আচার খেতে কেন ইচ্ছে করছে?

আমি তখন রাগে চিৎকার করে বললাম,

— তুই এতো বোকা কেন? শাবানা আলমগীরের কাছে কেন আচার খেতে চাইতো সেটা কি তুই বুঝতি না?

-” তারমানে আমি…..

আমি ফোনটা সাথে সাথে কেটে দিলাম। আর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে লাগলাম পিয়াসের জন্য..

…….”সমাপ্ত”…….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *