সত্যি অনন্য

পাশের ফ্লাটের ঐতিহ্য ভাইকে আমার বড্ড ভালোলাগে।আজ প্রায় গুনে গুনে দুবছর ধরে।আমি এইচএসসি দিয়েছি সবে।ভার্সিটি এডমিশনের জন্য প্রতিদিন কোচিং এ যাওয়ার সময় প্রতিনিয়ত সিড়িতে দেখা হয় তার সাথে।হয় সে উপরে উঠছে হয় নামছে।আমি ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকি শুধু।এদিকে সে তো এমন ভাবে যায় যেন সে আমায় দেখেইনি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি বিভাগের অনার্স ৪র্থ বর্ষের একজন ছাত্র ঐতিহ্য ভাই।তাকে নিয়ে কতশত কল্পনা-জল্পনা আমার এই ছোট্ট হৃদয়ে।সেই পাষণ্ড পুরুষ কি বুঝে না?মাঝেমাঝে যে ছ্যাচড়ার মতো ব্যালকনি থেকে পাশের ব্যালকনিতে বসে বসে বই পড়া ঐতিহ্যকে দেখি একটাবারও কি বুঝতে পারে না আমি তাকে দেখছি?আমার মনের গ্রীষ্মের তান্ডবে এক পশলা বৃষ্টির ন্যায় ধরা দিয়েছিল সে তাকে কি এত সহজে ভোলা যায়?নিশ্চয় না।পুরুষটির সাথে দু একটা কথা হয়েছে।তবে সেগুলোও আমিই আগে শুরু করেছিলাম।তবে তার উত্তর ছিল শুধু হু হা।ঐতিহ্য ভাইয়ের মা মাঝেমধ্যেই আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন।আমায় বেশ আদরও করতেন।আমি মনে মনে কত যে তাকে শ্বাশুড়ি মা ডেকেছি হিসেব নেই।শ্বাশুড়ি মা-কে নিয়ে ঐতিহ্যকে নিয়ে শ্বশুরকে নিয়ে কল্পনাতীতও কত সংসার সাজিয়েছি।উফফ বলার মতো না।
একদিন দোকানে বসে বান্ধবীদের সাথে চা খাচ্ছিলাম রাস্তার ওপাশে দেখি ঐতিহ্য ভাই একটা সুন্দর মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে।অথচ আজ পর্যন্ত কখনো এভাবে হাসতে দেখিনি আমি তাকে।এমনকি মাঝে মাঝে আমি যদি জিজ্ঞাসা করতাম কেমন আছেন শুধু ভালো বলেই চলে যেতো।চোখের সামনে প্রিয় পুরুষকে অন্যজনের সাথে হেসে খেলে কথা বলতে দেখে হৃদয়ে দহন হতে শুরু করেছিল।চোখ বেয়ে দুফোটা জলও মনে হয়ে গড়িয়ে পড়েছিল।এত কষ্ট বুঝি কখনো হয়নি আমার।পাশ থেকে বান্ধবী নিহা বলে উঠে,
“এই বন্তী কি হয়েছে?কাদছিস কেন?”
আমি দুচোখ মুছে উত্তর দিয়েছিলাম,
“বৃষ্টিটা থেমে গেছে।”
আমার বান্ধবীগুলো কথার মানে বুঝতে না পেরে হেসে উঠেছিল।সেদিন বাসায় এসে বেশ মনমরা হয়েছিলাম।দু চোখের সামনে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম দুজনের হাসোজ্জল মুখখানা।বুকের বা পাশে চিনচিনে ব্যাথাটাও যেন বেড়ে গিয়েছিল।এদিকে রাতে ঘুমও আসছিল না।তাইতো রাত ১টা’র দিকে দুঃখে কষ্টে প্রিয় গিটারটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে টুংটাং আওয়াজে গাইতে শুরু করেছিলাম একটি প্রিয় গান,
“আমার কল্পনা জুড়ে,
যে গল্পেরা ছিল
আড়ালে, সব লুকোনো।
সেই গল্পেরা সব,
রঙিন হলো পলকে,
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন।
প্রেম তুমি, আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি।
আজও আছে সে পথ শুধু নেই তুমি,
বল কোথায় আছো অভিমানী।”


সেদিনের পর কেটে গেছে প্রায় দু বছর।আমি বর্তমানে অনার্স ২য় বর্ষের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের একজন স্টুডেন্ট।লেখাপড়াটায় এখন বেশ মনোযোগ দিয়েছি।অন্যসবে ধ্যান বলতে এখনো ঐতিহ্য নামক পুরুষকে ভুলতে পারিনি।সে এখন মাস্টার্সে পড়ছে আর কি যেন একটা চাকরি করছে শুনেছিলাম।তার সাথে দেখা হয়না বললেই চলে।আগে তো সে যখন আসতো বারান্দা দিয়ে দেখতাম।দেখার সাথে সাথেই রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম এক পলক নিবিড় চোখে দেখার জন্য।এখন আর এমন ছ্যাচড়ামো করি না।শুধু সিড়ির কাছে আসতেই সে দিনগুলো বড্ড মনে পড়ে।হৃদয়বিদারক ঘটনা ক ঘটেনি?অবশ্যই ঘটেছে।এই দুবছরে অনেকবার ঐতিহ্য ভাইকে সেই একই মেয়ের সাথে কথা বলতে ঘুরতে দেখেছি।হ্যা কষ্ট হয়েছে প্রচুর তবে নিজেকে সামলে নিয়েছি।এই দুবছরে সবকিছু সামলে নিতে পারলেও পারিনি শুধু অবাধ্য এই মনকে সামলাতে।রাত খাওয়া দাওয়ার সময় বাবা আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিল।একদম পাক্কা হয়ে গেছে নাকি।দু একদিনের ভেতরেই ঘরোয়া ভাবে হয়ে যাবে।বাবা মা’র উপরে গিয়ে একটা কথাও বলতে পারিনি।দুচোখে জল টলমল করছিল যেন শুধু।আমি বিয়ে করতে চায় না।ভালোবাসি একজনকে আর বিয়ে করব অন্যজনকে।এটা যেন মেনে নিতে পারছিল না মন।সারাজীবন বিয়ে না করেও থাকতে পারব।তবুও এতিহ্য’র জায়গাটা কাউকে দিতে রাজি নই।এদিকে মা বাবাকেও কিছু বলতে পারছিনা।ছোটবেলা থেকেই আদর যত্নে বড় করেছে।আমাকে মানুষ করতে নিশ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।এমন পিতামাতাকে কিছু বলা যায় না।রুমে এসে অনেক্ষণ কাদলাম।বুকটা ফেটে যাচ্ছে মনে হয়।না পারছি কিছু বলতে আর না কিছু করতে।বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে এতিহ্যর মুখশ্রী।সুদর্শন পুরুষটি কি একটি বারের জন্যও বুঝে নি অবন্তীর মনের কথা।
অনেক্ষণ পর কাদার পর বুঝতে পারলাম চোখেও যেন জল ফুরিয়ে গিয়েছে।মনটা বড্ড বেশি পুড়ছে আজ।তাই গিটারটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।গিটারটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে ছিলাম।সেদিনের পর থেকে গিটারটা দু একবার হাতে নিয়েছিলাম শুধু।সবকিছুই কেমন অগোছালো থাকায় গোছানোর জন্য নিজের প্রিয় অনুভুতিটাকেই যেন ভুলে গিয়েছি।অথচ প্রায় প্রতিদিনই এই গিটার হাতে বারান্দায় বসে গান গাইতাম প্রতি রাতে।বারান্দায়ও হাতে গোনা দু একবার ছাড়া দু বছরে একটা বারের জন্যও আসিনি।এখানে আসলেই যে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে যাবে তাই।বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। চাঁদনী রাত।চাঁদ যেন খুব খুশি আজ।অবন্তী গান গাইবে এজন্যই বুঝি?গিটারে টুংটাং আওয়াজে গান গাওয়া শুরু করলাম,
“দু চোখে ভীড় জমিয়েছে,
বাহারী সব স্বপ্ন।
ভালোবাসার অনুভুতি,
সত্যি অনন্য।
বইছে আমাতে আবেগের ঢেউ,
পারিনা ভুলতে চাইলেও।
হয়ে গেছিস খুব কাছের, গোপনে।”
হঠাৎ পাশের বারান্দায় চোখ যেতেই দেখি আমার দিকে এতিহ্য ভাই তাকিয়ে আছে।অনেকদিন পর দেখলাম।চুলগুলো কেমন উষ্কোখুষ্কো লাগছে।শুকিয়ে গিয়েছে মুখটা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।মন চাইছে গিয়ে একটু চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে।কতদিন পর দেখলাম পুরুষটাকে।কতক্ষণ যাবত তাকিয়ে ছিলাম জানা নেই।তবে তার শান্ত কন্ঠে আমার নাম শুনে কেপে উঠি।
“অবন্তী”
আমার মুখে কোনো কথা ছিল না।কি হয় কিজানি আমি সেখান থেকে রুমে চলে আসি।আবারও ঢুকরে কেদে উঠি।কিছুই ভালো লাগছে না আর।বড্ড বিষাদে ভরে গিয়েছে এ মন।


বিয়েটা হয়ে গিয়েছে।কিন্তু কার সাথে বিয়ে হলো মানুষটার মুখ দেখতে পায়নি।শুধু রেজিস্ট্রেশন পেপারে সাইন করেছি।আর ধর্মানুযায়ী কিছু সূত্রপাত করতে হয়েছে।এদিকে চোখের সামনে বারংবার প্রিয় পুরুষটার মুখটা ভাসছে।অনুভুতিটা বড্ড বেড়েছে যেন তার প্রতি।সেদিন রাতের পর আর দেখা হয়নি।আমিও বারান্দায় যায় নি আর।একটি রুমে বসে আছি।আমাদের বাসা থেকে একটু দূরে এই বাড়িটা।জানিনা কাদের দুএকবারা চোখে পড়েছিল বাড়িটা।তখন কন্সট্রাকশনের কাজ চলছিল।আর এই বাড়ির ছেলের সাথেই নাকি আমার বিয়ে হলো।হায় কপাল।সৃষ্টিকর্তা একটুও সহায় হলেন না।মনে মনে এসবই ভাবছিলাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে।এই রুমে বেশ বড় একটা বারান্দা আছে।চাঁদটা আগের তুলনায় বড় হয়েছে।তাকিয়ে আছি সেদিকে।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠে,
“অবন্তী”
শান্ত গলার এই স্বরটি শুনে আমি কেপে উঠি।পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি সাদা শার্ট পরনে এতিহ্য দাঁড়িয়ে।আমি অবাকের থেকেও যেন অবাক হই।এতিহ্য বুঝি আমার মনোভাব বুঝে যায়।তাই বলে উঠে,
“মেয়েটা আমার বোন ছিল অবন্তী।দেশের বাহিরে থাকায় তুমি তাকে কোনোদিন দেখোনি।সেদিনের পর তো আর দেখাও হয়নি।দেখা হলেও কিছু বলতে পারিনি।বড্ড অভিমানী তুমি।”
একটু থামে এতিহ্য।আবারও বলে উঠে,
“বারান্দা থেকে চলে যাওয়ার সময় নিচে যদি একবার তাকিয়ে দেখতে তাহলে হয়তো আমার মুচকি হাসিটা দেখতে পেতে অবন্তী।সিড়ি বেয়ে নিচে যদি নেমে না যেতে তাহলে আমার তোমার নেমে যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকাটা দেখতে পেতে।কেমন আছি জিজ্ঞাসা করার পর যদি ভালোভাবে খেয়াল করতে তবে দেখতে পেতে কি খুশিটাই না হতাম আমি।রাতে বারান্দায় গান গাওয়ার সময় যদি পাশে একটাবার চোখ দিতে তবে হয়তো অন্ধকারে থাকা আমার অবয়বটা দেখতে পেতে।সেদিন বারান্দায় এসে গান গেয়েছিলে যদি একটাবারা আমার বারান্দায় তাকাতে তবে হয়তো দুবছর তোমার এতো অসহ্য যন্ত্রনা সহ্য করতে হতো না।”
আমার কাছে এসে আমার দুগালে হাত রেখে এতিহ্য বলে উঠে,
“তোমায় আমি তোমার আগে থেকেই অনেক ভালোবাসি অবন্তী।তবে নিজের অনুভুতিটা প্রকাশে আমি ব্যর্থ ছিলাম।তোমার প্রতি এই প্রখর অনুভুতিটা তুমি কোনোদিন ধরতে পারলে না অবন্তী।”
আমি কেদে উঠি।কিসের কান্না এটা বুঝতে পারি না। ঐতিহ্যকে পাওয়ার নাকি নিজের করা সেদিনের ভুলের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *