আমার বসন্তহীন জীবনেও মুগ্ধ করার মতো এক বসন্ত এসেছিল।তবে নিরবে,গোপনে।যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গিয়েছে।ধরে রাখতে পারিনি।হৃদয়ে ছাপ ফেলার মতো বসন্তটা ছিল একদমই আলাদা।উহু সম্পূর্ণ আলাদা।শীতল সেই অনুভুতি।আবেগের জোয়াড়ে যেন ভরপুর।
আমি তখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছি মাত্র
একদিন রাতে শুনলাম আমাদের বাসায় নাকি আমার মামাতো ভাই আসবে।আমাদের বাসায়ই থাকবে কারণ সে মেডিকেলে পড়ছে।গ্রাম থেকে বেশি দূরে হওয়ায় আমাদের এখানেই থেকে যাবে।তারপরের দিন কলেজ থেকে বাসায় এসে দেখি সোফায় এক সুদর্শন ছেলে বসে আছে।আমি মনে মনে ভাবছিলাম ছেলেটি কে?ছেলেটিও আমায় দেখে হয়তো মনে মনে ভাবে কে এ?এদিকে ছেলেটির ব্যাপারে আমার কৌতুহল বেড়ে যাওয়ায় সোজা রান্নাঘরে মায়ের কাছে যায়।গিয়ে জিজ্ঞাসা করি,
“মা ওখানে ওই ছেলেটি কে?”
“ও আমাদের বাসায় থাকতে এসেছে। তোর মামাতো ভাই হেমন্ত।”
আমি তো মহাখুশি হয়ে যায়।আমি তার সামনে দিয়ে উপরে উঠে যায়।কিন্তু হেমন্ত ভাই একবারও তাকালো না।উফ ছেলেটার কি চোখে সমস্যা নাকি?এসব ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে আসি।রাতে খাওয়ার সময় গিয়ে দেখি হেমন্ত চেয়ারে বসে আছে।আমি গিয়ে তার সামনে বরাবর বসে পড়ি।কিন্তু মানুষটা একটাবারও তাকালো না।মাথা নিচু করে খেয়ে চলেছে।আমার রাগ উঠে।কিন্তু কেন জানি না।এভাবেই চলতে থাকে দিনকাল।আমার স্বভাবটা পরিবর্তন হয়নি।লুকিয়ে চুড়িয়ে অনেকবার দেখেছি।কিন্তু মানুষটা একটাবারও আমার দিকে তাকায়নি।মানুষটা এত পাষাণ কেন? আমায় কি চোখে পড়েনা? নাকি গার্লফ্রেন্ড আছে।এসব ভেবেই কেমন কান্না আসতো।হেমন্ত ভাই আসার এক মাস পর একদিন আমি কলেজের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে দেখি হেমন্ত দাঁড়িয়ে আছে।সেদিনের মতো প্রথমবার সে আমায় দেখে মুচকি হাসে আর আমায় ডেকে বলে,
“কলেজে যাচ্ছো শ্রাবণী? চলো একসাথে যাই আজ।”
আমি তো মহাখুশি। মানুষটা আজ আমার সাথে নিজে থেকে কথা বলেছে। আবার একসাথে যেতে বলছে।আমি একপায়ে রাজি হয়ে যায়। হেটে হেটে যাওয়ার সময় অনেক কথা হয়েছে। বেশি কথা আমিই বলেছি।সে শুধু দু-একটা কথা বলেছে।কলেজের গেইটের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“সাবধানে থেকো শ্রাবণী। আসি।”
আমি মাথা নাড়ায়। মানুষটিকে যতদুর পর্যন্ত দেখা যায় তাকিয়ে থাকি।চোখের আড়াল হতেই আমিও হাটা শুরু করি।সেদিনের পর মাঝেমাঝেই আমার সাথে হেটে কলেজে যেতো।একসাথে যেতাম আর কত শত কথা বলতাম।মানুষটাও আমার সাথে কিছুটা ফ্রি হয়ে গিয়েছিল।মানুষটি বসন্তের ন্যায় আমার মনে স্নিগ্ধ ফুল ফুটিয়েছিল যেন।চাঁদনী রাতের আকাশটাও ডেকে উঠতো আমায়।আর হেমন্তের খোজ করতো। আমি মনে মনে ভাবতাম তার নাম হেমন্ত না হয়ে বসন্ত হলে খুব কি একটা খারাপ হতো।কল্পনার জগতে তাকে নিয়ে হারিয়ে যেতাম।আমার সপ্তাদশী হৃদয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল বসন্তের আমেজ। ফুলগুলো যেন নাড়া দিয়ে উঠছিল। মানুষটাকে প্রতিদিন একটাবারা দেখতে পেলে যেন সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম এক নিমিষেই জল হয়ে যেত।মনের ক্যানভাসে একটা নিখুত ছবি একেঁ দিয়েছিলাম হেমন্তের।তবে বসন্তটা চলে যাওয়ায় সৃষ্টিকর্তাও যেন আমার হৃদয়ে, আমার জীবনে আনা সেই বসন্তটা নিমিষেই শেষ করে দিয়েছিল। দু-সপ্তাহ পর বিকেলে বাসায় ফেরার সময় রোড এক্সিডেন্টে নির্মম ভাবে আমাদের মাঝে থেকে হারিয়ে যায় হেমন্ত ভাই।কথাটা শোনা মাত্রই চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল শুধু। বসন্তের বাতাসটাও যেন থেমে গিয়েছিল। আমেজটাও উড়ে গিয়েছে অন্য কোথাও।প্রিয় মানুষকে হারানো যে কি পরিমাণ কষ্টের সেটা শুধু যে হারায় সে বোঝে।নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়েছিলাম।হেমন্ত ভাইকে দেখার তৃষ্ণা যেন দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল।কিন্তু আমি নিরুপায়।কালের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছে ঠিকই কিন্তু রয়ে গিয়েছিল আমার এই মনে।পারিনি আমি নিজের অনুভুতিটা প্রকাশ করতে তার সামনে।আমি তার রুমে গিয়ে মাঝেমাঝেই কান্না করতাম।একদিন তার একটি ডায়েরী খুজে পায়। ডায়েরীটা খুলে প্রথমেই পেয়ে যায় আমার হাসোজ্জল একটি ছবি। এতে যেন আমার অগোছালো মনে আরেকবার ভুমিকম্পের সৃষ্টি হয়।পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখ যায় একটি লেখায়। যেখানে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ছিল,
“তুমি আমার জীবনের বসন্ত কন্যা শ্রাবণী।”
আমি যেমন অবাক হয়েছিলাম তেমনি কান্নাটাও যেন বাধ মানছিল না। খুব কষ্টে নিজেকে সামলে পড়া শুরু করি।প্রতিটা পাতায় লেখা প্রতিদিনের আমার করা সেই কাজকর্ম।আমি তাকে কিভাবে লুকিয়ে দেখতাম।সেসব ব্যাপারে হেমন্ত ভাই সবই জানতো। আমায় নিয়ে সেও গেথেছিল সুন্দর একটি পুষ্পমালা।শেষের পৃষ্ঠায় গিয়ে আটকে উঠি আমি।গতদিনের লেখা,
“শ্রাবণী,
এবারের বসন্তটা তোমার কেমন লেগেছে জানি না।তবে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বসন্ত ছিল এটি।প্রথম যখন তোমায় দেখেছিলাম আমার মনেও ফুটেছিল বসন্তের ফুল।মনটা যেন গলে ঢলে পড়েছিল জানো।তোমার কোলে যেন বারবার ঢলে পড়তে চাইছিল এই অবুঝ মনটা।ফুলটাও যেন বেড়ে উঠতে চাইছিল। কিন্তু ফুলটি বড় হতে দিতে চাইনি এ মন।তবে আমি অবাক হয়েছিলাম তখন যখন তোমায় আমার দিকে সবসময় তাকিয়ে থাকতে দেখতাম।তোমার ওই তৃষ্ণার্ত অক্ষিযুগল দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম বসন্তটাও তোমার মাঝে এসে গিয়েছে।তারপর থেকে আর পারিনি আমি শ্রাবণী নিজেকে দমিয়ে রাখতে।হারিয়ে যেতে চেয়েছিলাম সেই শ্রাবণ ধারায় নামা বৃষ্টির নিকট।বসন্তের ফুলটাও ততদিনে মনের অগোচরেই বেড়ে গিয়েছিল জানো।তাইতো সেদিন প্রথম তোমার সাথে কথা বলা আর এক রাস্তায় হাটা।সেদিন আমি কল্পনায় সাজিয়ে ফেলেছিলাম তোমায় নিয়ে একটি সুখের সংসার।পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আমি তোমার ওই চোখের মণিতে দেখতে পায় শ্রাবণী।তোমার সাথে আমার দিনকাল কিন্তু স্বপ্নের মতো কাটছে শ্রাবণী।তুমি ছাড়া কাউকে আপন লাগে না যেন।আমার জীবনের সাথে নির্দ্বিধায় তোমায় জড়িয়ে নেব শ্রাবণী।শুধু সময়ের অপেক্ষা।সময় হলে নিজের করে নেব তোমায়।”
আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম সেই ডায়েরীর ভেতরে।মনটা বার বার সৃষ্টিকর্তাকে বলে উঠছিল, ” হে সৃষ্টিকর্তা একবার মিরাকেল করিয়ে দাও।আমার হেমন্তকে ফিরিয়ে দাও না আমার কাছে।নিশ্চয় অনেক কষ্ট পাচ্ছে মানুষটা।পুরো একজীবন কাটানো বাকি তার সাথে আমার।”
কিন্তু এসব কি আর সম্ভব ছিল।নিশ্চয় না।মানুষটা নিজের অনুভুতিটাও বলতে পারেনি।অনেক তৃষ্ণার্ত নিশ্চয়।তৃষ্ণা নিয়েই বিদায় নিতে হয়েছে মানুষটাকে। এসব ভাবলেই বুকের বা পাশে ব্যথা অনুভুত হয় খুব।কেটে গেছে ১২ টি বছর।জানালার ধারে বসে আছি সেই ডায়েরিটা হাতে।প্রতিটা নিঃশ্বাসে যেন এখনো হেমন্তকেই খুজে পায় আমি।ঘন্টার কাটায় কেটে গেছে কতশত সেকেন্ড কিন্তু নেই হেমন্ত।মনে মনে ভাবি সেই হারিয়ে যাওয়া বসন্তটা যদি আরেকটিবার আসতো তবে কি খুব খারাপ হতো?শুধু ভাবি কবে হেমন্তের কাছে যেতে পারবো।আত্মহত্যাটাও যে মহাপাপ।তাই সেটা কখনোই করব না।হেমন্তের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো দিয়েই নাহয় এ জীবন কাটিয়ে দেব।তার নামে রেখে দেওয়া জায়গাটা কাউকেই দিতে পারব না।এইতো এখনো চোখে ভেসে উঠছে বসন্তের সেই দিনগুলো।ওইতো হেমন্ত ভাই মায়া জড়ানো কি সুন্দর হাসছে!
- জুনানী চাকমা~সমাপ্ত