শেষ অধ্যায়

সে রামও নেই সে রাজত্বও আজ আর নেই | পড়ে আছে কেবল এক কালের বিশাল জমিদার বাড়ীখানা | ভগ্নদশায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে | অর্ধেক তার স্তূপ বাকী অর্ধেকটার দশাও হাড় কঙ্কালসার জীর্ণ | এখানে সেখানে বড় বড় বট অশ্বত্থের গাছ কাক শকুনের আস্তানা মাথায় নিয়ে অতীতের গৌরব কে ব্যঙ্গ করছে | উপরের ঘরের একটি ঘরকে কোনো মতে কড়ি কাঠগুলোয় শাল বল্লার ঠেকনা দিয়ে  সারাই করে থাকেন পঁচাশি বছরের বৃদ্ধা এক সময়ের জমিদার গিন্নি রাজশ্রী দেবী | অথচ এক কালে এই বকুলপুর চৌধুরী বাড়ীর নাম ডাক আর খ্যাতি চতুর্দিকে ধ্বনিত হতো, আজ কেবল আছে পুরোনো বৃদ্ধ চাকর রামু, রামু তার বৌকে নিয়ে থাকে নীচের কোনের একটা ঘরে | সবাই এক এক করে জমিদার বাড়ী ছেড়ে চলে গেছে, একমাত্ৰ রামু ই আজও রয়ে গেছে, কোন ছোট্ট বেলায় বাবার হাত ধরে এসেছিলো এ বাড়ীতে | রামু আর তার বউ এখন দেখা শোনা করে রাজশ্রী দেবীর, রাজশ্রী দেবীর আর কেউ নেই বল্লে ভুল বলা হবে | তাঁর ছেলে বিশ্বপ্রতাপ চৌধুরী এখন বিদেশের স্থায়ী বাসিন্দা | মেম বিয়ে করে সপরিবার সেখানেই থাকেন, মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বলতে  মাসে মাসে মায়ের জন্য সামান্য কিছু টাকা পাঠান, তাতেই কোনো মতে চলে যায় | একদিন বাড়ীটা গমগম করতো রাশভারি জমিদার বিদ্যুৎ বরণ চৌধুরীর গলার স্বরে | জমিদারির ক্ষয় তখন থেকেই শুরু হয়েছিল, সুরা বাইজী নাচ ঘোড়দৌড় জুয়া কোনোটাই বাদ যেত না তাঁর, সঙ্গে ছিলো নীল কর লাল মুখো সাহেবদের খুশি করতে প্রজা উৎপিড়ন | উশৃঙ্খল জমিদারের হাত ধরেই যেন অলক্ষ্মী এবাড়ীতে প্রবেশ করেছিলো |  আজ ঘড়ার জল সবটুকু শেষ | গত দুদিন ধরে বাতের ব্যাথা টা ভীষন বেড়েছে রাজশ্রী দেবীর | আর শরীরের দোষ কী? অনেক তো হলো, তবু এক সময়ের দুধ-ঘি এর জোরে সঞ্চিত শক্তি তিলতিল করে ব্যায় করছেন বলে নড়ে চড়ে বিছানাটায় ঘুরপাক টুকু খেতে পারেন | রামু এসে বল্লে, গিন্নি মা কালতো জন্মাষ্টমী গোপাল সোনাকে তো কিছু খাওয়াতে হবে মা, রাজশ্রী দেবী পাশ ফিরে রামুর দিকে চাইলেন | মাসের শেষ, খোকার টাকাও আসেনি, যেটুকু পয়সা আছে তাতে তাঁর ওষুধ কিনলে আর কটা টাকাই বা বাকী থাকবে | অথচ একদিন এই জন্মাষ্টমী তে চৌধুরী বাড়ীতে কত ধূমধাম ই না হতো | সেদিনের কথা চিন্তা করতে করতে গিন্নিমায়ের চোখ দুটো ভিজে ওঠে, কাঁপা কাঁপা গলায় রামুকে বলেন, হ্যাঁরে রামু, গোয়ালা বৌকে খবর দিয়েছিলি ? হ্যাঁ মা, রামু উত্তর করে, ঐ এক পোয়া দুধ আর একটা তাল দিয়ে গেছে, কিন্তু একটু চিনি চাই তো, গিন্নি মা মাথার বালিশের নীচে থাকা ছোট্ট পয়সার পুটুঁলিটা বার করেন৷ তার থেকে ঘেঁটে ঘেঁটে একটি দশ টাকার কয়েন বার করে রামুর হাতে দিয়ে বলেন, এতে যে টুকু হয় দেখ | রামু ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় | গিন্নিমা ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেওয়ালের দিকে পাশ ফেরেন | দেওয়ালের গায়ে কাঠের তক্তা লাগিয়ে তার উপর রাখা আছে একটি ছোট কষ্টি পাথরের নাড়ু গোপালের মূর্ত্তি আর বাকী মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের বড় বিগ্রহ নারায়ন শিলা সব গ্রামের হরিমন্দিরে চলে গেছে বহুদিন আগেই,শুধু এই নাড়ুগোপালের মূর্ত্তি টা গিন্নিমা সাথে রেখেছেন, এই গোপালের সঙ্গেই তাঁর দিন কাটে। আজ কেউ আর আসে না এবাড়িতে | মনে মনে ভাবেন যেখানে পেটের সন্তানই আসেনা সেখানে বাইরের লোকের আশা তিনি করবেন কি করে | নানান চিন্তা এসে ভিড় জমায় মাথায়, | মনে পড়ে যায় খোকার ছোটবেলার নানা কথা, ধীরে ধীরে স্মৃতির অতল গভীরে তলিয়ে যেতে থাকেন তিনি|  এমন জন্মাষ্টমীর দিনে সেই আড়াই বছর বয়স থেকেই খোকাকে গোপাল ঠাকুর সাজিয়ে দিতেন তিনি, কপালে চন্দনের ফোঁটা এঁকে ময়ূরের পালক  পাগড়ীতে লাগিয়ে ভারী সুন্দর দেখতে লাগতো খোকাকে, তিনি চোখ বুজে সব যেন দেখতে পান , তিনি অনুভব করতে থাকেন খোকা সারা বাড়ি দৌড় দৌড়ি করে যেন খেলছে , কি সুন্দর ঝলমলে পাথরের নাড়ু গোপাল কে জামা পড়ানো হয়েছে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় | কত ধরনের আলো , ঝাড়বাতির বাহার ,গোপালের সামনে বড় বড় বারকোসে সাজানো হয়েছে ভোগের নানান পদ, নারকেলের কত পদ কত মিষ্টি | দাসদাসীদের দৌড়োদৌড়ি , এরই মধ্যে খোকা দৌড়ে ঘরে ঢুকে ঠাকুরের থালা থেকে টপাং করে একটা নাড়ু তুলে নিয়েই মুখে পুরে দেয় | চমকে ওঠেন গিন্নিমা , তন্দ্রাভাবটা কেটে যায় |

 চোখের পাতা খুলতেই চোখ যায় তাকের   গোপালের দিকে, একটা বড় মাকড়সা কোথা থেকে এসে গোপালের মুখের উপর বসেছে | তিনি বহু কষ্টে হাতপাখার বাঁট টা দেওয়ালে ঠুকে বিছানা থেকেই চেষ্টা করলেন ওটাকে তাড়াতে, কিন্তু বেয়ারা মাকড়সা টাও আর গিন্নি মাকে তোয়াক্বা করেনা | তিনি বহু কষ্ট করে বিছানায় উঠে বসলেন তারপর কাঁপা কাঁপা অসমর্থ শরীর টেনে দেওয়াল আর বিছানার মাঝের খালি সরু জায়গাটায় বিছানা থেকেই ঝুঁকে পরে পাখার বাঁট টা দিয়ে মাকড়সাটাকে তাড়াতে চেষ্টা করলেন | শীর্ণ দুর্বল শরীর ,টাল সামলাতে পারলেন না, মাথাটা ঘুরে গেল, উপুর হয়ে পড়লেন গোপাল রাখা তাকের উপর  সাথে সাথে তাকে রাখা পাথরের নাড়ু গোপাল ছিটকে পড়লো  মেঝেতে | মেঝেতে পড়ে গিন্নি মায়ের আদরের গোপাল তখন দ্বিখন্ডিত | তখন  গিন্নিমা ও মাটিতে, কপাল কেটে ঝড় ঝড় করে রক্ত বেড়িয়ে ভিজে গেছে মেঝে , কাপড় |হয়তো অচেতন হয়ে বেঁচে ছিলেন কিছুক্ষণ কিন্তু খালি ঘরে কেউ শুনতে পাইনি তাঁর ক্ষীণ আর্তনাদ | রামু যখন গিন্নি মায়ের ঘরে ঢুকলো, তখন সব শেষ | মেঝেতে গিন্নি মায়ের নিথর দেহটা পড়েছিলো ,আর ডান হাতটা ছিল ভাঙা গোপালের বুকের উপর | আজ বহুদিন বাদে জমিদার বাড়ীতে বহু মানুষের ভীড় , আজও সবাই ব্যস্ত , তবে জন্মাষ্টমীর গোপালের পূজোর জন্য নয়, | জমিদার গিন্নিকে শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে বাবার জন্য |  কুলো পুরোহিত ভট্টাচার্যী মশাই বিধান দিলেন, দাহ করতে নিয়ে যাবার সময় ভাঙা গোপালের মূর্ত্তিটা ও যেন সাথে নিয়ে যাওয়া হয়, দাহকার্য শেষে অস্থি বিসর্জনের সময় ভগ্নমূর্ত্তি টাও যেন জলে  ভাষিয়ে দেওয়া হয় ” | |

  • রঞ্জন ভট্টাচার্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *