আজ ভার্সিটিতে ফাগুন উপলক্ষে একটা প্রোগ্রাম রয়েছে। প্রোগ্রামে আমরা ফ্রেন্ডস রা মিলে একটা গ্রুপ ডান্স করবো। সে-ই নিয়ে অভ্রের কি রাগ। গতকাল সারাদিন এই নিয়ে অভ্র আমার সাথে কথা বলেনি। রাত দুইটায় ফোন করলো অভ্র,আমি তখন গভীর ঘুমে তলিয়ে প্রায়।চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই অন্ধকারে ফোনটা রিসিভ করলাম-
-হ্যালো(ঘুমুঘুমু কন্ঠে)
অভ্র কিছুই বললো না। আমি ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। কোনো সারা না পেয়ে চোখ মেলে একবার স্ক্রেনে তাকালাম। সেখানে অভ্রের নাম দেখতে পেয়ে আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করছিল ওকে ফোন থেকে বের করে হারপিক খায়িয়ে দেই। কোনোরকমে নিজের রাগ সংবরন করলাম আমি। প্রায় দশ মিনিট অতিক্রম হতে চললো, অভ্র এবারো কিছুই বললো না।এবার আমি কিছুতেই রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলামনা।
অনেকখন চোখ মুখ খিচে বসে রইলাম। রাগের চোটে আমার ঘুমই চলে গেলো এই মুহূর্তে।
অভ্রের কন্ঠ ভেসে এলো এবার। ওর কথা বলার ভঙ্গিতে বুঝতে পারলাম ওর রাগ এই মুহূর্তে দশ-টা হক মঞ্জিল জ্বালিয়ে দিতে সক্ষম। অভ্র শান্ত অথচ কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
-ব্লক করেছিস কোন সাহসে তুই আমাকে?
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। ব্লক করলে ও আমাকে ফোন করলো কিভাবে? তখনি মনে পরলো গতকাল নাচের প্রেকটিস শেষে সবাই মিলে একটা গ্রুপ ছবি তুলেছিলাম,ছবিতে নাদিমও ছিল। সেটাই ওর কাছ থেকে লুকিয়ে আপলোড করার জন্যই ব্লক করেছিলাম। অবশ্য আনফ্রেন্ড না করে সোজা ব্লক করে দেওয়ার কারন শুধুই যে রেগে থাকা তা না। অভ্রের আমার প্রতি অতিরিক্ত পজেসিভ আচরণ আমার একটুও পছন্দ না। আরে ভাই বেস্ট ফ্রেন্ড আছিস সেটাই থাক না খামোখা বাপ হতে যাস কিসের জন্য?
আমি গলার স্বর গম্ভীর করে বললাম-
-রেগে ছিলাম!
অভ্র মেজাজ শান্ত করার চেষ্টা করে বললো-
-নাদিমের সাথে মিশতে বারণ করেছিলাম না তোকে?কেনো ছবি তুলেছিস ওর সাথে? আর তোর পাশেই কেনো দাঁড়াতে হলো? মেঘা,রুম্পাও তো ছিল ওঁদের সাথে কেনো দাড়ালো না ?
আমি এতোক্ষণে মহারাজের এতো রেগে থাকার কারণ বুঝতে পারলাম। আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। ওকে আরেকটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম-
-হ্যা তুলেছি তাতে কি হয়েছে? নাদিম কি তোর মতো হিংসুটে? এতো কিউট,সুইট,ভদ্র,হ্যান্ডসাম ছেলেটাকে নিয়ে তুই এতো হিংসে করিস কেনো, অভ্র? আমার কিন্তু খারাপ লাগেনা ওকে। দেখিসনা সবসময় কেমন কেয়ার করে আমার? “মিতু তুমি কিন্তু ফাস্ট ফুড অতো খেয়ো না, এগুলোতে জিবানু আছে, মিতু আস্তে হাটো পড়ে যাবা” হাওওও সুইটটট!
অভ্র কিছুই বললো না কিছুক্ষণ চুপ থেকে দুম করে ফোনটা কেটে দিল। সাথে সাথে ওর নাম্বার থেকেই দশ সেকেন্ডের মধ্যে টেক্সট এলো-
-” খবরদার আমার সাথে তুই আর কথা বলবিনা, মিতু”
ও যে ভয়ংকর রেগে আছে তা বুঝতে আর আমার কসরত করতে হলো না।
ওহহ আপনাদের তো বলাই হয়নি। আমি মিতু,মিতুয়া হক আর এতোক্ষণ ধরে যাকে নিয়ে বলছিলাম ও ‘অভ্র’ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। অভ্রের সাথে আমার প্রথম যখন পরিচয় হয়? তখন আমার বয়স সাত বছর, আর অভ্রের দশ বছর। আমরা একই এলাকাতে পাশাপাশি বিল্ডিংয়ে থাকতাম। আমি ওকে প্রথম দেখেছিলাম নীলা আপুর বিয়ে তে। নীলা আপু আমাদের দু’জনেরই প্রতিবেশী ছিল। অভ্র খয়েরি রঙের একটা শার্ট পরেছিল সেদিন,সাথে সাদা ফুলপ্যান্ট। ওর হাতের রিমোটকন্ট্রোল গাড়িটা দেখে আমার যে কি লোভ হয়েছিল। কোনোকিছু চিন্তা না করেই ওর হাত থেকে ছো মেরে ছিনিয়ে নিয়েছিলাম গাড়িটা। কিন্তু অভ্র আমায় কিচ্ছু বললো না। এমনকি একটু রাগলোও না । আম্মু আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে মেয়েরা এসব নিয়ে খেলেনা এটা ছেলেদের খেলনা। কিন্তু আমি কিছুতেই গাড়িটা দিবোনা বলেই জেদ করেছিলাম। আমার কান্নাকাটি দেখে আন্টিও আমাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে আম্মুকে বললেন “থাক ভাবী এটা দিয়ে মিতু খেলুক, অভ্র মোটেও মন খারাপ করবেনা” অভ্র আসলেই সেদিন একটুও মন খারাপ করেনি। পিটপিট চোখে আমার দিকে চেয়ে ছিল। আমি অবাক হয়ে চেয়েছিলাম ওর দিকে। ছেলেটাকে আমার বড্ড অন্যরকম লেগেছিল সেদিন। অতচ আম্মু যখন আমার চেয়ে ভাইয়াকে একটু বেশি আদর করতেন? আমি সারাদিন মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতাম। রাতে আব্বু এলে আব্বুকেও অভিনয় করে বিচার দিতাম। কিন্তু এই ছেলেকে দেখো ওর এতো সুন্দর নতুন খেলনা গাড়িটা নিয়ে নিলাম,আবার ওরই মায়ের কোলে বসে আদর খাচ্ছি অথচ তার মধ্যে এসব নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। যেনো সে মজা পাচ্ছে আমাকে খেলনা টা দিতে পেরে।
আমার খুব হাসি পায় এগুলো মনে পরলে! অথচ আমার সেদিনের অতি দয়ালু বন্ধুর এখনের হিংসের মাত্রা দেখো? হিংসে নিয়ে কোনো নোভেল যদি দেওয়া হতো,তাহলে আমাদের অভ্রই দেশের দুর্নাম একা বয়ে আনতে সক্ষম হতো।
-এই মিতু,কিরে আজ না ক্যাম্পাসে কি প্রোগ্রাম আছে বললি? পরে পরে ঘুমালে ভার্সিটিতে যাবি কখন?
আম্মুর ডাকে আমি ঝরের গতিতে ঘুম থেকেই উঠে বসলাম। উঠেই দেয়ালের ঘরিতে চোখ বুলালাম। ও মাই গড ইটস টু লেইট!আমাকে দশটার আগেই ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে হবে। অলমোস্ট নয়টা বাজতে চললো। আমি তারাহুরো করে কোনোমতে একটা বাসন্তী রঙের শাড়ী গায়ে জড়িয়ে নিলাম। কোনোরকমে তারাহুরো করে চুলগুলো আঁচড়ে খোঁপা করে নিলাম। কসমেটিকসগুলো একটা ব্যাগে নিয়ে নিলাম, ক্যাম্পাসে গিয়েই সাজবো নাহয়।
ডাইনিং রুমে যেতেই অভ্রকে চোখে পরলো। টেবিলে বসে কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে নাস্তা করছে অভ্র। ওর ভাব দেখে মনে হলো ও এই হক মঞ্জিলের একমাত্র জামাই। আমি নিঃশব্দে ওর পাশের চেয়ারটা টেনে বসলাম। ও পাশ ফিরে তাকালো না। যেনো আমি এসেছি সেটা ও একদমই পাত্তা দিচ্ছেনা। আমার প্রচুর মেজাজ খারাপ হলো আম্মুর উপর। এতো জামাই আদর করার কি দরকার শুনি? অবশ্য এসব ভেবে কি লাভ? মাঝে মাঝে তো মনে হয় অভ্রই বুঝি আম্মুর আসল ছেলে আর আমাকে এনেছে রাস্তা থেকে কুরিয়ে। তাই তো ওর আগমনে আম্মু চাঁদ পাওয়ার মতোন খুশি হয়ে যায়।
-কিরে খাচ্ছিস না কেনো? ছেলেটা সে-ই কখন থেকে বসে আছে,আর মহারানীর ঘুম এই ভাঙলো।
আম্মুর কথায় আমি ব্যাপক অপমানিতবোধ করলাম। অভ্রের দিকে একপলক তাকাতেই দেখতে পেলাম কেমন এটিটিউড নিয়ে খাচ্ছে । ওর খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্চে আমার অপমানিত হওয়াতে ও ভীষণ মজা পাচ্ছে। আমার রাগ এবার চরম মাত্রায়। মনে মনে বেটাকে একশো বার গঙ্গায় চুবিয়ে ফেললাম। ওর প্লেট টা মুখের সামনে থেকে ছো মেরে সরিয়ে ধমকের স্বরে বললাম-
-উঠ,লেইট হয়ে গিয়েছে,আর খেতে হবেনা।
আম্মু বললো
-সে কি! ছেলেটাকে নাস্তাটাও শেষ করতে দিবি না? কিছুই তো খেলোনা অভ্র।
আমি চোখ মুখ খিচে বললাম-
-হ্যা তোমার অভ্র তো কিছুই খায়নি, গরুর মাংস দিয়ে পরোটা,ডিম,কলা এতোক্ষণ তো আমিই ঠুসেছি সব!
আমার কথার মানে বুঝতে পেরে আম্মু আমার প্লেটে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি হনহনিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। অভ্র তখনো মিটিমিটি হাসছে। ওর হাসি দেখে আমার যেনো পিত্তি জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হলো। আমি কোনো কথা না বলেই ওর বাইকের পিছনে বসে পরলাম। পুরো রাস্তা আমি ওর সাথে কোনো কথা বলিনি, এক দু’বার ফ্রন্ট মিররে চোখ যেতেই দেখেছিলাম ও নিঃশব্দে আমার দিকে চেয়ে আছে। এর মধ্যেই অভ্র বাইকটা একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাড় করিয়ে আমাকে জোর করে নাস্তা করালো। আমি খেতে না চাইলে, জোর করে নিজের হাতেই খায়িয়ে দিল,যেনো আমার উপর ওর কতো অধিকার! অভ্র এমনই!
বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা ক্যাম্পাসের গেইটের কাছে পৌঁছালাম। আমি ওর সাথে এবারো কোনো কথা বললাম না।বাইক থেকে নামতেই অভ্র পেছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলো। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে আগাগোড়া অবলোপন করে নিল। তারপর গম্ভীর মুখে বললো-
-শাড়ীটা ব্লাউজের আরেকটু উপরে পরতে পারিসনা? দুই মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যে শাড়ী ঠিক কর।
আমি পিঠে হাত দিতেই বুঝতে পারলাম পিঠের একাংশ খালি হয়ে আছে তবে সেটা খুবই সামান্য। এই সামান্য ত্রুটিও অভ্রের চোখ এড়াতে সক্ষম হয়নি। আমি হাত দিয়ে শাড়ীটা ঠিক করে নিলাম। তারপর চলে যাওয়ার জন্য পা বারাতেই অভ্র আবার আমার আচল টেনে ধরলো। আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। অভ্র সেসব গ্রাহ্যই করলো না। ছোট্ট একটা ব্যাগ থেকে দু মুঠো লাল কাঁচের চুরি বের করলো। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও চুপচাপ চুরিগুলো আমার হাতে পরিয়ে দিল। তারপর আমার শাড়ীর আচল টেনে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললো-
-এটারই কমতি ছিল।বাসন্তী শাড়ীর সাথে লাল চুরিতেই তোকে মানাবে ইমাজিন করলাম,তা-ই এইটাই নিয়ে নিলাম! আর শোন, ফোন করবি যাওয়ার সময় আমাকে না দেখতে পেলে। আমি সিফাতদের সাথেই আছি।
আমাকে পিটপিট চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূনরায় বাইকের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বললো-
-শাড়ীর ফাকে যদি আমার ব্যাক্তিগত সম্পত্তির এতোটুকুও উন্মুক্ত হয়েছে, তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে,মিতু!
আমার শরীরের বেয়ে যেনো কম্পন শুরু হয়ে গেলো। অভ্রের এরকম আচরণ আমাকে বড্ড ভাবনায় ফেলে দেয়। ওর এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রতিবার আমি আমাদের সম্পর্কের ব্যতিক্রম অর্থ খুজে পাই! যা আমায় অসম্ভব লাজুকলতায় মিয়িয়ে রাখে! আমি পথভ্রষ্ট হই! আর ভাবতে থাকি এই সম্পর্কের নাম কি শুধুই বন্ধুত্ব? নাকি তার চেয়েও বেশি কিছু??
চলবে… ….