বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-০৫]

ভাইকে খুজতে খুজতে জান শেষ হয়ে যাচ্ছে উচ্ছ’র।ছোট বোন কল্পনার থেকে খবর পেয়েছে ছাদে থাকতে পারে।তাই ছাদে এসে দেখে আসলেই ছাদে আছে উৎস।রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে।নিশ্চয় সিগারেট খাওয়ার জন্য এসেছে।এই ছেলে এতো সিগারেট খায় কিভাবে ভেবে পায় না উচ্ছ।শিস বাজাতে বাজাতে উৎসের নিকট যায় উচ্ছ।কাছে গিয়ে আড়াআড়িভাবে পা রেখে দাঁড়ায় উচ্ছ।উৎস নিরব।ছেলেটা বখাটে হলেও বাড়িতে চুপচাপ থাকে। বখাটে বললেও ভুল হয়,কারণ উৎস বখাটে নয় তবে এলাকার সবাই এই নামেই চেনে তাকে।তাই না চাইতেও এসে যায় যেন শব্দটা।হালকা কেশে উচ্ছ বলে,“ সিগারেটে কি এমন আছে যে এতো এতো সিগারেট নিমিষেই শেষ করিস?”

 “খেয়ে দেখ বুঝতে পারবি।”

মুখ কুচকে নেয় উচ্ছ।হাত নাড়িয়ে বলে,“ না না এসব জীবনেও না।ডাক্তাররা এসব পছন্দ করে না।”

এক ভ্রু উচিয়ে উচ্ছ’র দিকে তাকায় উৎস।উৎসের এমন চাহনীতে উচ্ছ হেসে ওঠে।খানিক লজ্জাও পায় কিনা সন্দেহ।উৎস রুষ্টস্বরে বলে,“ কি এমন দেখেছিস মেয়েটার মাঝে যে পাগল হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।”

 “আমার চোখ দিয়ে দেখলে তুইও প্রেমে পড়ে যেতি।”

উৎস হাতে থাকা সিগারেটটা নিচে ফেলে দেয়। আরেকটা বের করে গ্যাসলাইট দিয়ে জ্বালিয়ে টানা শুরু করে।ক্ষণবাদে বিদ্রুপের স্বরে বলে,“ আজ মেয়েটাকে দেখলাম।”

 “এমনভাবে বলছিস যেন আজই প্রথম দেখেছিস।এই তুই আবার ওকে ডিস্টার্ভ করিস নি তো?”

বিরক্ত হয় উৎস।

বিরক্তির সুরে বলে,“ আজ ওর মুখ দেখেছি গাধা।আর ডিস্টার্ভ ওটা সারাজীবন করে যাব।”

মুখ দেখেছি শুনে উৎসাহিত হয় উচ্ছ।মুখে হাসিহাসি ভাব এনে বলে,“ দেখতে নিশ্চয় পরীর মতো সুন্দর।”

উৎস আড়চোখে উচ্ছের দিকে তাকিয়ে বলে,“দেখতে একদমই খারাপ।চোখ দুটো তো দেখা আছে অলরেডি।নাকটা তো একদম হাতির নাকের মতো।ঠোঁট তো না যেন বোয়াল মাছের মুখ।এতো বাজে মেয়ে আমি আগে দেখিনি।ওর পিছু ছেড়ে দে। আরও অনেক সুন্দরী তুই ডিজার্ভ করিস।আমি খুজে দেবো।ভার্সিটি পড়াকালীন এক মেয়ে তোকে পছন্দ করতো।কি নাম যেন? আশা রাইট! ওই মেয়েই তোর জন্য পারফেক্ট।”

উচ্ছ চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে থাকে।উৎস যে মেয়েটাকে এতো কেন অপছন্দ করে ধারণা নেই উচ্ছের।গম্ভীর স্বরে বলে,“ রূপবতী হোক বা না-হোক ড. আশিনকে আমার চাই।”

 “আশিন কি তোর বাপের সম্পত্তি নাকি যে বললেই হলো চাই।”

উচ্ছ গালে ডান হাতের তর্জনী দ্বারা চুলকে বলে,“ আমাকে এটা বল তুই হঠাৎ তার ব্যাপারে বলছিস কেন?”

 “তোকে সাবধান করছি।ওই পেতনীকে আমি ভাবি হিসেবে দেখতে পারবো না।ভাবি শব্দটা ওই শালীর নামে উচ্চারণ করতেও তো লজ্জা করছে।”

‘শালী’ শব্দটা পছন্দ হয় না উচ্ছ’র।

কর্কশ গলায় বলে,“ ড. আশিনকে মোটেও এসব ভাষায় ডাকবি না।তুই তোর এক্স লামিশাকে গিয়ে বল।”

‘লামিশা!’ নামটা শুনেই মাথা গরম হয়ে যায় উৎসের।হাতে থাকা সিগারেটটা ফেলে দেয় আবারও।সটান হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্ছকে রেখেই বিবশ কদম ফেলে স্থান ত্যাগ করে উৎস।উচ্ছ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ছেলেটার দিকে।মনে মনে ভাবে ঠিক জায়গায় কোপ দিয়েছে নাকি ভুল জায়গায়।

___

আজকাল রাত হলে কেমন ভয়ানক আওয়াজ শোনা যায়।এই বিষয়টা প্রথমে গুরুত্ব না দিলেও এখন বিষয়টা বেশ ভাবাচ্ছে আশিনকে।বাবার সাথে এই নিয়ে কথাও বলেছে তবে তার বাবা খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না আশিনের।সেদিন রাতেও সে কারোর উপস্থিতি টের পেয়েছে তবে এই ব্যাপারে রবিন সাহেবকে জানায় নি আশিন।তবে মনে একটা খটকা এখনও রয়েছে তার।

আজ শুক্রবার।রবিন সাহেব হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আশিন নিজেই বাজারে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেয়। যেই ভাবা সেই কাজ।রেডি হয়ে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হয় আশিন।রাস্তার পাশে পুকুরের ধারে লোক সমাগম দেখে কপাল সুবিন্যস্তভাবে কুচকে যায়। জানার ইচ্ছার প্রয়াস হয় ‘’কই হয়েছে?’’ সেটা দেখতে। কয়েক কদম ফেলে সেদিকে এগিয়ে যেতেই কানাঘুষা শুনতে পায়,“ দুইদা লাশ পাওয়া গেছে এই পুকুরে।না জানি কেডা মারছে।তাও আবার বুইড়াগুলারে।”

 “হ সাবধানে থাওন লাগবো আমগোরও।দেহো কেমনে মারছে।দেইখাই ডর করতাছে।”

কথাগুলো শুনে আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দেয় আশিন।বিভৎস সেই লাশের মুখ দেখেও ভয় পায় না আশিন।ডাক্তারদের এসব বিষয় ভয় না থাকাটাই স্বাভাবিক।

 “আপনি এসব থেকে দূরে থাকুন আশিন।নয়তো রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে।”

পরিচিত কন্ঠস্বর।আশিন বুঝতে পারছে পেছনে উচ্ছ দাঁড়িয়ে।লাশটি থেকে চোখ সড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকায় আশিন।উচ্ছ তার দিকেই হাসিমুখে তাকিয়ে। আশিনের অভিব্যক্তি বোঝা যাচ্ছে না। মুখে মাস্ক না থাকলে বোঝা যেতো হয়তো মেয়েটার অভিব্যক্তি কেমন?খুশি হয়েছে নাকি রাগ করেছে?তবে সেসবে পাত্তা না দিয়ে উচ্ছ পুনরায় শুধায়,“ চলে আসুন।পুলিশ আসবে একটুপর।ডাক্তার বলে এসবে মাথা ঘামাতে হবে না।”

আশিনের কথাটা পছন্দ হয় না,“ পোস্টমর্টেমের জন্য আমার কাছেই তো নিয়ে যাওয়া হবে তাই না?এখন আর তখন সেইম সেইম।”

উচ্ছ ভেবে দেখে।আসলেই আশিনের কথাটা সত্যি। মেয়েটা হাসপাতালের সবচেয়ে বড় ডাক্তার হিসেবেই পরিচিত।এছাড়াও আসার পর গ্রামে নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে।লাশটাও তার কাছেই নিয়ে যাওয়া হবে হয়তো।নিজের কথার দোষ ঢাকতে উচ্ছ বলে,“ যখন নিয়ে যাওয়া হবে বিষয়টা তখনের।এখন আপনি আসুন।”

 “কোথায়?”

 “এই রাস্তাটা হাসপাতালের রাস্তা নয় তারমানে আপনি বাজারে যাচ্ছিলেন।তাই বাজারেই।”

আশিন সেখান থেকে চলে আসে।বাজার করাটা এখন খুব জরুরী।লাশগুলোর জন্য তাকে ডাকা হলেও সে খুব একটা যেতে পারবে কিনা সন্দেহ।তার বাবার এমনিতেই শরীর ভালো না।তাড়াহুড়ো করে হাটা শুরু করে আশিন।পেছন পেছন উচ্ছও হাটা শুরু করে।

 “একটু আস্তে হাটুন আশিন।”

আশিনের বিরক্ত লাগছে।হাটার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়।এই দুই ভাইকে সে পছন্দ করে না।একপ্রকার দৌড়ে এসে আশিনের পথ আটকায় উচ্ছ।আশিন চোখে মুখে বিরক্তির ভাব ফেলে বলে,“ কি চাই?”

উচ্ছ সহজ সরল স্বীকারোক্তি দেয়,“ আপনার সাথে একসাথে হাটতে চাই।”

 “তো হাটুন না পথ আটকে রেখেছেন কেন?”

 “আপনি অনেক জোড়ে জোড়ে হাটেন।”

আশিন উত্তর দিতে না চেয়েও দাতে দাত চেপে বলে,“ তো কি কচ্ছপের মতো করে হাটবো?পথ ছাড়ুন আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

কথাটা বলেই উচ্ছের পাশ দিয়েই হাটা শুরু করে আবারও।উচ্ছও নির্লজ্জের মতো আশিনের পিছু যেতে থাকে।বাজারে পৌঁছাতেই সবার মুখে মুখেই পাওয়া সেই লাশগুলোর কথা শোনা যাচ্ছে।আশিন সেসবে পাত্তা না দিয়ে কাচা তরকারির বাজারে আগে ঢোকে।লোক সমাগম আর কোলাহল বেশি হওয়ায় উচ্ছ সেদিকে যেতে চেয়েও থেমে যায়।এমন জায়গা তার পছন্দ নয়।তবুও আশিন যেহেতু গিয়েছে তাই সেও চেতে চাইলে কেউ এসে তার হাত ধরে।পেছনে তাকাতেই নিহালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু দুটো উঁচু করে,“ তুই এখানে কি করছিস?”

নিহাল পালটা প্রশ্ন করে,“ তুই এখানে কি করছিস?”

 “আমি তো।”কথাটা বলে পেছনে তাকাতেই আশিনকে আর দেখতে পায় না সে।আড়াল হয়ে গেছে মেয়েটা।এই বড় বাজারে আশিনকে কোথায় খুজবে এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায় উচ্ছ।নিহাল উচ্ছকে টেনে নিয়ে গিয়ে একটি টং এর দোকানে নিয়ে যায়।যেখানে বাকিরাও আছে তবে উৎস নেই।

আশিন একটি সবজির দোকানে গিয়ে ফুলকপি দেখতে পায়।ফুলকপি তার প্রিয়।রবিন সাহেবেরও প্রিয়।তাইতো অপরিপক্ক হলেও ফুলকপি বাছাই করতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে কেউ বলে ওঠে,“ চাচা তোমার দোকানের সবগুলা ফুলকপি আমারে দেও।টাকা দিতাছি।ছোট বোনের বিয়া পরশু।ফুলকপি পছন্দ করে।তাই সব রান্না কইরা দিমু।তোমারেও দাওয়াত রইলো।”

এই কন্ঠটাও অপরিচিত নয় আশিনের।এমন কথা শুনে রেগে পেছনে তাকায়।উৎসকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে।দোকানদারের দিকে তাকিয়ে বলে,“ বাজারে অন্য দোকানে এই ফুলকপি সবজিটা নেই আর।আপনার দোকানেই আছে।আমি যেহেতু আগে এসেছি আমার জন্য দুইটা রেখে দিন।”

উৎস ফোড়ন কেটে বলে,“ চাচা আমগোর কিন্তু শর্ট পইড়া যাইবো কইয়া দিলাম।”

দোকানি হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।একদিকে চেয়ারম্যানের পোলা তো অন্যদিকে আরেকজন মেয়ে।আশিন রেগে উৎসের দিকে ক্রোধান্বিত স্বরে বলে,“ আপনি এত খারাপ কেন?”

 “আপনি এতো ভালো কেন?”

আরও বেশি রেগে যায় আশিন,“আপনি কি আমার পিছু নিয়েছেন?আর আমাকে জ্বালানোর জন্যই কি এসব?”

 “কেন?তুমি এমন কোন রাজকন্যা যে তোমারে জ্বালাইবার লেইগা তোমার পিছু নিমু?”

আশিন ভীষণ রেগে যায়।এই লোকের সাথে আর একটা কথা বললে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।তাই একবার প্রিয় সবজিটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার উৎসের দিকে তাকিয়ে বলে,“ রান্নার পর কারোর কিছু না হয়ে তুই যাতে খেয়ে মরে যাস এই দোয়া করি।”

উৎস মাছি তাড়ানোর মতো করে বলে,“ শকুনের দোয়ায় গরু মরে না।”

চলবে … …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *