বৈশাখের কাঠফাটা রোদে প্রকৃতি এখন বিবর্ণ প্রায়। এই রুদ্র-রুক্ষ সকালেই আমি আর অভ্র ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য বের হলাম। এই মুহূর্তে আমি যে তেতে অমলেট হয়ে যাচ্ছি সেদিকে এই স্বার্থপর প্রকৃতির কোনো খেয়াল আছে?নেই। রাস্তায় বের হয়ে আমার মনে হলো পৃথিবীর সব ফালতু ব্যাপার নিয়ে মানুষের যত আক্ষেপ। অথচ চৈত্রের এই রাক্ষসী রুপের বর্ননা দিয়ে কোনো কবি-সাহিত্যিকরা কি বিভৎস কিছু লিখে যেতে পারেনি? চাইলেই লিখতে পারতো কিন্তু এসব লিখে মিতুকে তৃপ্তি দেওয়ার মতোন মহান হৃদয় কোনো কবি-সাহিত্যিকদের নেই।তাতে কি? মিতু এসবের ধার ধারার মেয়ে নয়। মিতু অলওয়েজ শো বুড়ু আঙুল টু অল ইরিটেটিং থিংস অ্যান্ড মুভ অন!
আজ আর অভ্র বাইক নিলোনা। আবার রিকশাও নিতে চাইলোনা। এই ছেলেটার মতিগতি আমি মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারিনা। এটাকে কখনো কখনো আমার নিউটনের সূত্রের মতোন জটিল মনে হয়। এই জটিল লোকের নাকি আজ হেঁটে হেঁটে ভার্সিটি যাওয়ার মতোন মোস্ট এনোয়িং এন্ড উইয়ার্ড ইচ্ছেটা হলো। আমার রক্তলাল চোখে তাকিয়ে থাকাও যেনো তার সে-ই মুহুর্তে বারা ভাতে ছাই দেওয়ার মতোন মনে হলো। আরে ভাই, তোর রোদ খাইতে ইচ্ছা করলে সারাদিন চিৎ হইয়া সুইয়া থাক মরুভূমিতে। নাহয় সূর্য ব্লান্ডার কইরা জুস বানাই খা। আমাকে কেনো টানতেছিস এসবে? জীবনে কি ক্ষতি করসি আমি তোর? তোকে বন্ধু বানানোর শাস্তি এতো তিতা? ইয়া মাবুদ আমাকে এই গরুসঙ্গ ত্যাগ করার তৌফিক দান করুন!
আমার একটুও হাটতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না,বারবার বিরক্তি নিয়ে অভ্রের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছি। কিন্তু বেটার এসবে পরোয়া করার মতোন নরম মন হলে তো!!এবার বিরক্তি নিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে পরলাম আমি। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভ্র চোখের ইশারায় আমাকে দাঁড়িয়ে পরার কারন জানতে চাইলো।
আমি টলমল চোখে শুধালাম –
-একটা রিকশা ডাক না প্লিজ,এই অসহ্য গরমে কেউ হেঁটে হেঁটে যায়? ক্যাম্পাস তো আরো অনেক দূরে, কিভাবে যাবো?
অভ্র ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো-
-আজকে ক্যাম্পাসে যাবো এটা তোকে কে বললো? আর এইটুকু রাস্তা হাঁটতে তোর শরীরে ঠোসা পরে গেলো? তোর বাপ তোকে প্রোটিনজাতীয় খাবার থেকে বঞ্চিত থাকতে বলেছে বুঝি? নিয়ম করে পুষ্টিকর খাবারের পরিবর্তে হরলিক্স খাওয়ালে তো এমনি হওয়ার। নাকি তোর বাপের জাপানি টাকায় আকাল পরেছে?
ওর কথায় আমি যেনো আকাশ থেকে পরলাম। এই অসভ্য,অভদ্র টার সাথে আমার এক পা ও এগোতে ইচ্ছে হলোনা। আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম-
– কথায় কথায় আমার বাপকে টানিস কেনো অভ্র? আব্বু তোকে পছন্দ করেনা বলে তুইও বড়দের রেসপেক্ট করবিনা? আর ক্যাম্পাসে না গেলে আমাকে টেনে হেচরে কেনো আনলি তুই? তোর চেহারা দেখাইতে?
অভ্র শার্টের কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো-
-তাকাতেই পারিস,আফ্টার অল আমার মতোন স্মার্টবয় পাশাপাশি হাটলে যে কোনো মেয়েরই মনোযোগ স্ট্যাচু হয়ে যাবে।
ওর কথায় আমি বিরক্ততে চোখ বন্ধ করে নিলাম! এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে হচ্ছে অভ্রের চুল ছিঁড়ে গরু, ছাগলকে খায়িয়ে দিতে! কিন্তু আফসোস পারলামনা। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অভ্র বললো-
– তোর কোনো আইডিয়া আছে তোকে যে পেত্নীর মতোন লাগছে? চোখ সরা তোর এই চোখে তাকাই থাকা অবস্থায় একটা ছবি নিলে, আমাদের সিক্তকে পেত্নী বলে চালিয়ে দিয়ে ভাত খাওয়ানো যাবে মিতু! নেহাত আমি ভীষণ দয়ালু তা-ই তোর এসব ভয়ংকর রুপ রোজ দেখার পরেও হার্ট অ্যাটাক, ফার্ট অ্যাটাক করিনা। তোর জন্য মায়া লাগে তো!
ওর কথায় রেগে আমি রনমূর্তি রুপ ধারন করলাম।
-আমাকে এখনি বাসায় দিয়ে আসবি তুই, অভ্র!
অভ্র শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো-
-চুপ থাক একটু। আর হাটতে না পারলে কোলে উঠ আমার, তোকে কোলে নিতে আমার কিন্তু প্রব্লেম নাই। আর ইউ রেডি ডার্লিং?(চোখ টিপে)
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম –
-ইম্পসিবল! গো টু হেল! আমি একাই যেতে পারবো বাসায়।
অভ্র আমার হাত টেনে বললো-
-আরে বাপ একটু পরে তো বাসে উঠবোই, এমন করছিস কেনো?একটু ভদ্রমহিলার মতোন হাটতে পারিসনা? বাপের মতোন কেমন মির জাফর হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন!
আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম –
-বাসে উঠছি মানে? কোথায় যাবো?
-সেটা গেলেই জানতে পারবি।
রীতিমতো টেনে হেচরেই বাসে উঠালো অভ্র। কিছুক্ষণ বিরক্তি নিয়ে বসে থেকে, ক্লান্ত হয়ে কখন অভ্রের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছিলাম খেয়াল করিনি। অভ্র সবার মতোন না,ওকে আমি সে-ই ছোট্টবেলা থেকেই জানি তা-ই ওকে যেকোনো পরিস্থিতিতেই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে আমার একবারও ভাবতে হয়না। হি ইজ মাই কম্ফোর্ট জোন! অভ্র মানেই মিতুর কিছুই হবেনা।
এইতো সেদিনের কথা ক্যাম্পাসে একশো চার ডিগ্রি জ্বর নিয়ে আমি ঘাড় কাত করে বেঞ্চে বসে আছি। কারোর সাথে কথা বলার শক্তিটুকুও আমার নেই। ক্লাস শেষে গেইটের বাইরে যেতেই অভ্রকে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেলাম। ওকে দেখামাত্রই আমার সকল দূর্বলতা বেরিয়ে আসতে চাইলো। আমি মলিন চোখে অভ্রকে দেখে নিলাম। কিছু বলতে যাবো তার আগেই অভ্র ঝরের গতিতে বাইক থেকে নেমে আমায় ধরে ফেললো। আমি আমার সর্বস্ব শক্তি হারিয়ে ফেললাম। তারপর কি হলো আমার মনে নেই। চারঘন্টা পর নিজেকে হসপিটালের বেডে শুয়ে থেকে হাতপ সেলাইন লাগানো অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিয়ে বললো-
-“অভ্রটা না থাকলে যে কি হতো! ছেলেটা চারঘন্টা ধরে কেমন উন্মাদের মতোন করছে। তোর ঔষধ পত্র যা লাগে সব অভ্রই দৌড়াদৌড়ি করে এনেছে।”
আমি ক্লান্ত চোখে আম্মুর কথা শুনছিলাম। কিছুক্ষণ পর আন্টি আর ভাবীও এলেন আমায় দেখতে। অভ্র এলোনা। আরো এক ঘন্টা ঘুমিয়ে চোখ মেলার পরই চোখের সামনে কারো শান্ত চাহুনি আবিষ্কার করলাম। অভ্র আমার বেডের পাশেই বসে আছে, ওকে কেমন ক্লান্ত দেখালো,চোখগুলোও ফুলে ফুলে আছে। তারপর অভ্র শান্ত অথচ কঠিন গলায় বললো
– “এমন না করে প্লিজ একেবারেই আমাকে মেরে ফেল তুই। আমার শান্তি তো তোর সহ্যই হয়না তাইনা? ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া করবিনা, শরীরে রোগ বাঁধিয়ে বসে থাকবি, লো প্রেশার নিয়ে পাকিস্তানি সিরিয়াল দেখবি। তোর এনআইডি কার্ডে একুশ বছর বয়সের যায়গায় দশ বছর দেওয়া উচিৎ,মিতু”
আমি সেদিন কিছুই বলিনি ওকে। ওর প্রতিটা বাক্যই কেমন যত্নশীল লাগছিল আমার। আমাকে শান্ত বাচ্চাটির মতোন হাসি মুখে চেয়ে থাকতে দেখে অভ্র বলেছিল-
– “হাসবিনা তুই,একদম হাসি বন্ধ। আর কোনোদিন এমন আনডিসিপ্লিন্ড চলাফেরা যদি দেখেছি!!! আমাকে হার্ট অ্যাটাক দেওয়ার অপরাধে তোর চৌদ্দ গুষ্টিকে জেলের ভাত খাওয়াবো দেখিস!”
অভ্রের কথা শুনে আমি বেশ শব্দ করেই হেসে ফেললাম। ভুলে গেলাম সকল অসুখ,সকল ব্যথা!
অবশ্য পুরোটা অভ্রই আমার কাছে একটা কম্ফোর্ট জোনের প্যাকেট। পৃথিবীতে বাবা-র আর ভাইয়ার পরে এই একটা ছেলেই আমায় সবসময় নিরাপদ অনুভব করায়! যার কারনেই অভ্রকে শুরু থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড এর প্রমোশন করিয়ে দিয়েছিলাম।
অভ্র নিচু হয়ে বসলো যেনো আমার মাথাটা ওর কাধ ছুতে কষ্ট করতে না হয়। আমার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি!
ঢাকা থেকে বাসে করে আমরা কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলায় এসে পৌছালাম। বাসের পুরোটা সময় অভ্র কাকে যেনো বার-বার ফোন করে জানাচ্ছে আমরা কখন,কোথায় আছি। আমি ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে জিগাস্যাসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই প্রতিবার জবাব দিয়েছে-
-“তোকে কিডন্যাপ্ট করার প্ল্যান করতেছি দোস্ত, আর ইউ প্রিপায়ের টু এক্সেপ্ট মি এস ইউর কিডন্যাপারার?”
প্রতিবার আমি বিরক্তি নিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরেছি।
আমরা দাউদকান্দি ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। আমি যেনো এবার ভীষণ উদ্বেগ হয়ে পরলাম মনে মনে। বার-বার মনে হচ্ছিল আমার অভ্রের সাথে এতোদূর আসাটা ঠিক হয়েছে কিনা? তার উপর আব্বু আম্মুকেও জানানো হয়নি। আমার ভয় হচ্ছে শুধু আব্বুকে নিয়ে।
এসব ভাবতে ভাবতেই দেখলাম অল্পবয়সী দুজন ছেলে দূর থেকে অভ্রকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। আমি ভ্যাবাচেকা খাওয়ার ন্যায় তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ ওদের দিকে। ওদের কুশূল বিনিময় চললো বেশ অনেকখন যাবত।তারপর কালো শার্ট পরা ছেলেটি আমাকে হাসিখুশি মুখ করে জিজ্ঞেস করলো-
-কেমন আছো, মিতু আপু?
আমি বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
-তুৃমি আমাকে চিনো?
ছেলেটি হেসে জবাব দিল-
-হ্যা। অভ্র ভাইয়া,ফুপি,অয়ন ভাইয়া ওরা সবাইতো তোমার কথা বলে। তোমার ছবিও কতোবার দেখিয়েছে ফুপি আমাদের।
আন্টিকে বারবার ফুপি বলাতে আমার বুঝতে অসুবিধা হলোনা অভ্র আমাকে ওর নানাবাড়ি নিয়ে এসেছে। আমি বুঝতে পারছিলামনা অভ্র হটাৎ এখানে কেনো নিয়ে এলো আমায়? আবার মনে মনে ভাবতে লাগলাম হয়তো কোনো কাজেই এসেছে। আর কোনো সঙ্গ না পেয়ে আমাকেই টেনে হেচরে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আন্টি ওদেরকে আমার ছবি দেখিয়েছে? ব্যাপারটা কেমন রহস্যজনক মনে হলো আমার!
আমি কৌতুহল নিয়ে অভ্রকে জিজ্ঞেস করলাম-
-অভ্র,এখানে কেনো আসলাম আমরা? বিকালের আগে যেতে পারবো তো? আমি কিন্তু বাসাতে এসব ইনফর্ম করিনাই তুই ভালো করেই জানিস সেটা।
অভ্র আমার সামনে উড়তে থাক চুলগুলো কানের কাছে গুঁজে দিতে দিতে বললো-
-আপনার সেসব নিয়ে ভাবতে হবেনা ম্যাডাম! তাছাড়া আপনি এখানে আছেন সেটা আন্টি অলরেডি জানে।
আমি আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম-
-জানে মানে? এই অভ্র তুই বলে দিছিস আম্মুকে? আয়হায় এখন কি হবে? আব্বু জানতে পারলে আমি শেষ রে! আর আম্মু জানলে তুই আমাকে কেনো জানালি না আগে?
অভ্র বিরক্তি নিয়ে বললো-
– জানালে মনে হয় তুই ঢেঙঢেঙিয়ে চলে আসতি? বেশি কথা বলিস তুই,চুপচাপ হাট।আর আমি বলিনি কিছুই,আম্মুই গতকাল আন্টিকে বলেছে যাতে তোকে দিপার বিয়েতে যেতে দেয় আমার সাথে। আম্মু রা গতকালই এসে পরেছে।
-অ্যাহহহ? আমরা দিপা মানে তোর মামাতো বোনের বিয়েতে এসেছি অভ্র?? এই গাধা,আগে বলতে পারিসনি এটা? আগে বললে আমি ভালো কিছু পরে আসতে পারতাম শিট! দেখ তো ঠিকঠাক লাগছে কিনা?
অভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে একবার আগাগোড়া দেখে নিয়ে মুখে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ হাটতে লাগলো। ওকে চুপ থাকতে দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম-
-কিরে কেমন লাগছে বললি না তো?
অভ্র আমার দিকে একপলক তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী কন্ঠে হাত জোর করে বললো-
-মিতু প্লিজ আমাকে বাঁচতে দে! আর কোনোদিন এতো নিখুঁতভাবে তোর দিকে তাকাতে বলবিনা। আমি যথেষ্ট ধৈর্যশীল মানুষ, তুই কিন্তু আমার মতোন নিষ্পাপ পুরুষের ধৈর্য পরিক্ষা করছিস।
আমি বিস্ময় নিয়ে, ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার ন্যায়, মাথা চুল্কাতে চুল্কাতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছিলামনা আমি। আমাকে কেমন লাগছে সেটা বলতে হলে ওকে ধৈর্য ধরতে হবে? অদ্ভুত তো!
হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম গন্তব্যে। অভ্রদের নানুর বাড়িটা কিছুটা পুরোনো দিনের বাড়িগুলোর মতো। ওর মামা রা সব একই ছাঁদের নিচে থাকেন। অর্থাৎ জয়েন্ট ফ্যামিলি। বাড়িতে ঢুকতেই বাচ্চাদের ছোটাছুটি, চিৎকার, চেচামেচি শুনতে পাওয়া গেলো। আমাকে দেখতে পেয়েই মামনী রা এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেনো আমাকে তারা আগে থেকেই চেনেন,জানেন। আমি অভ্রের নানার বাড়ির মানুষ বলতে দিপাদের দেখেছিলাম একবার অভ্রদের বাসায়। তাছাড়া বাকি সকলের গল্পেই আন্টির থেকে শোনা,কখোনো সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সকলের হইচই শুনতে পেয়ে আন্টি আর ভাবী দোতলা থেকে দৌড়ে নামলেন। ভাবী এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলতে লাগলেন-
-অভ্র কিন্তু আসতে চায়নি। যেই বললাম মিতু কে নিয়ে আসিস ওদের বাসায় গতকাল বলে দিয়েছি ওমনি হনহনিয়ে চলে এলো। ভাবো একবার কতো হিপোক্রিয়েট দেবর আমার!
ভাবীর কথা শুনে আমি আর হাসি দমিয়ে রাখতে পারলামনা। বেশ শব্দ করেই হেসে ফেললাম। অচেনা পরিবেশের কথা মাথায়ও এলোনা আমার। আমার হাসির শব্দে আশেপাশের সকলের দৃষ্টিই এখন আমার দিকে। কেমন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকলে। আমি একটু ইতস্তত হলাম। তারপর কারো দিকে নজর দিতেই দেখতে পেলাম কেবল একজন পুরুষের দৃষ্টিই শান্ত! আশেপাশের কাউকেই পরোয়া করলোনা সে-ই বেপরোয়া পুরুষ! কেমন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো অভ্র! যেনো এর চেয়ে সুন্দর হাসি সে আজন্ম দেখেনি!
চারিদিকে এতো হৈচৈ দেখে কেমন উৎসবমুখর মনে হচ্ছে সবকিছুই । এই কয়েক ঘন্টায় সবাই আমাকে এতো আপন করে নিলো যে আমার মনেই হচ্ছেনা আমি এদের রক্তের কেউ নই। অভ্রের সব কাজিনরাই আমাকে সঙ্গ দিচ্ছে। তার মধ্যে একজন আছে যাকে আমার ভীষণ ভালো লাগলো। মেয়েটার নাম স্মৃতি, বাকি সবার চেয়ে ওকে আমার বেশ মিষ্টি লেগেছে। মেয়েটা অতন্ত্য মিশুক ধরনের।
-এইটা নাও।
আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে স্মৃতি পূনরায় নিজের কাজে চলে গেলো। এমনকি প্রশ্নকরার সময়টুকুও দিলো না। আমি খুলবোনা ভেবেও কৌতুহল নিয়ে প্যাকেট টা খুলেই ফেললাম। একটা সাদা গোলাপ,আর একটা সবুজ রঙের শাড়ী। আমি বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শাড়ীর ভাজ খুলতেই একটা চিরকুট বেড়িয়ে এলো। যাতে খুব যত্ন করে লেখা
” শুভ্র ফুলের খোঁপায় যেনো শুভ্র ফুলই দেখতে পাই! আমার ফুলের জন্য শাড়ীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপহার অন্যটি পেলামনা! আমার খুব ইচ্ছে হয় জানিস? তোকে আজীবন শাড়ীতে দেখার! গিন্নিদের মতোন শাড়ী পরে আমাকে শ্বাসন করবি,ভাত বেরে খাওয়াবি,আমার বাচ্চাদের খেয়াল রাখবি! আরো কত-শত ভাবনা আমার!! সেসব ভাবনা আপাততঃ দমিয়ে রাখলাম। শোন, পাশের আরেকটা প্যাকেটে পেটিকোট আর ব্লাউজ আছে। এই মুহূর্তে রেডিমেড টাই ম্যানেজ করতে পেরেছি,ফটাফট পরে ফেল। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে”
চিরকুট টা পড়ে থম মেরে বসে পরলাম আমি। খুব লজ্জা লাগছিল আমার! এটা যে অভ্রই পাঠিয়েছে তা জানলেও বিশ্বাস করতে চাচ্ছিনা। আমার কেনো জানিনা একটুও রাগ হচ্ছেনা অভ্রের উপর। ওর সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা ‘কেনো লিখেছিস এগুলো? কোন অধিকার নিয়ে?
আমি শাড়ী পরেছি অনেকক্ষণ হয়। কিন্তু আমার কেনো জানিনা বাইরে যেতে সাহস হচ্ছেনা। শরীরের শীতল কাঁপুনি নিয়েই বসে রইলাম রুমেই। এই অভ্রকে আমার জানা নেই! এ যেনো এক অন্যরকম পুরুষ! তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, আবেগময় চিরকুট আমায় যেনো খুব বিশাল কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে! এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ দরজার ছিটকিনির আওয়াজ কানে এলো আমার। আমি ঝটপট পেছনে তাকালাম। অভ্র! ওকে দেখে আমার তাৎক্ষণিক কি যেনো হলো! আমার মুখে কোনো শব্দ নেই। লজ্জায়, ভয়ে আমি মিয়িয়ে গেলাম! নিঃশব্দ পায়ে আমার সামনে এসে, দুই হাত বেঁধে কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে দাড়ালো অভ্র! আমি চোখ তুলে তাকাতে পারলামনা! অভ্র স্বাভাবিক কন্ঠে বললো-
-আমাকে এতোক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য তোকে কি শাস্তি দেওয়া যায় বলতো?
আমি আমতা আমতা করে বললাম-
-অভ্র, প্লিজ আমার কেমন যেনো লাগছে! তুই চলে যা কেউ এসে পরলে ব্যাপারটা খারাপ দেখাবে।
তখুনি আন্টির কন্ঠ ভেসে এলো-
-কিরে মিতু রেডি হচ্ছিস নাকি? দরজা বন্ধ কেনো?
আমি ভয়ে জবুথবু হয়ে ঢোক গিলে অভ্রের দিকে তাকালাম। আমার অবস্থা দেখে অভ্র ঠোঁট টিপে হাসছে। ভীষণ রাগ হলো ওর উপর। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় জবাব দিলাম-
– আর দশ মিনিট দাও আন্টি, আমি অলমোস্ট রেডি হয়ে গিয়েছি।
আন্টি চলে গেলো সাথে রেখে গেলো তারই গর্ভে ধারন করা আতঙ্কটাকে। আমি চোখ বড় বড় করে অভ্রের দিকে তাকালাম। কড়া গলায় কিছু বলতে যাবো তখনি ওর শীতল হাতের স্পর্শ আমার ঘাড়ে লাগলো। অভ্র পেছন থেকে আমার গলাটা ধরে একদম ওর মুখের সামনে নিয়ে এলো।আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম।আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওর ঠোঁটের স্পর্শ বসিয়ে দিলো আমার ললাটে!
তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে লাগলো-
“তুই নিকোটিন কিংবা অভ্যাস নস,তুই আমার মায়াবতী মিতু! পৃথিবীর সকল আসক্তি আমায় কাবু করে রাখলেও সেখান থেকে একমাত্র আমাকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম তোর স্নিগ্ধ মুখ ,তোর কাজল চোখ,তোর চিবুকের তিল আর…….. বলেই অভ্র আমার আরো কাছে আসতে লাগলো। আমি একটু একটু করে পেছাতে পেছাতে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেলাম। আমার চোখ তখনো বন্ধ। অভ্রের তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ তখনো শুনতে পাচ্ছি আমি। সম্বিত ফিরে আসতেই চোখ বন্ধ রাখা অবস্থাতেই আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম।
আমার সারা শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেলো!
-এই আপু কি হলো? চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?
স্মৃতির ডাকে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। তাৎক্ষণিক নিজের ঘাড়ে হাত রাখতেই মনে হলো আসলেই কি অভ্র এসেছিল? নাকি এটা শুধুই আমার কল্পনার?
– না শরীর খারাপ না তুমি যাও আসছি আমি।
কেমন একটা অদ্ভুত চিন্তায় পরে গেলাম। অভ্র এমন কিছু করেছে আমার মন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইছেনা। ভাবতে ভাবতেই বসে পরলাম আমি। তখনই ফ্লোরে অভ্রের ঘড়িটা দেখতে পেলাম। আমার চোখে শুধুই বিস্ময়! তার মানে কল্পনা নয়, অভ্র আসলেইই এসেছিল? আমার কেনো জানিনা খুব কান্না পাচ্ছে! এই অভ্রকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। কেমন অচেনা লাগছে সবকিছু! আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে হচ্ছেনা এখানে।